ধারাবাহিক: শ্রাবন্তীদের দিনরাত্রি (পর্ব-২) । ইকবাল তাজওলী
আরজুমান্দ বানু ফজরের নামাজ শেষে প্রার্থনায় বসেছেন। তাঁর চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়ছে। তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে মোছবার চেষ্টা করছেন।
কী সোনার সংসার ছিল তাঁর। শ্রাবন্তীর বাবাকে তিনি বড়ো বেশি ভালোবাসতেন। নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে তিনি তাঁকে ভালোবেসেছিলেন। একটি রাতও তাঁকে ছাড়া কোথাও থাকতেন না। এ নিয়ে কত হাসাহাসি, কত টিটকারি! ছোটোবোন আফরুজা প্রায়ই বলত,‘আপা, তুই এত জামাই পাগল কেন!’ তিনি কোনো উত্তর দিতেন না। বরং মনে মনে বিরক্ত হতেন।
একবার হলো কী! সকালে তিনি স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছেন। আফরুজা এসে বলল,‘দুলাভাই বুবু থাকুক। কালকে যাবে।’ আহমদ আলি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন,‘ঠিক আছে। অসুবিধা কী। থাকুক। পারলে আমিও থাকতাম।’ কিন্তু দেখা গেল, তিনি রাজি হলেন না। বললেন,‘না রে আফরুজা, তোর দুলাভাইয়ের অফিস খোলা। আজ না, আরেকদিন এসে থাকব। তোর দুলাভাই সকালে উঠে কী না কী খেয়ে যাবে। সারাদিন অফিস করে এসে শেষবিকেলে আমাকে পাবে না, কী না কী খাবে। আরেকদিন এসে থাকবনি রে।’
আরজুমান্দ বানু নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তাঁর আর মোনাজাত করা হলো না। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে গেলেন।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন। দেখলেন,‘শ্রাবন্তীর বাবা ফিরে এসেছেন। তিনি শ্রাবন্তীর বাবাকে দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। চিনেও চিনতে পারলেন না। তাকিয়ে রইলেন। আহমদ আলি তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,‘আরজু, আমি আহমদ আলি। শ্রাবন্তীর বাবা। তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমায় ক্ষমা করে দাও।’ বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। আরজুমান্দ বানু নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। জ্ঞান হারালেন। তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
আরো পড়ুন: শ্রাবন্তীদের দিনরাত্রি (পর্ব-১) । ইকবাল তাজওলী
স্বপ্ন দেখার পর থেকে আরজুমান্দ বানুর মনটা ভালো নেই। এতটা বছর পর স্বপ্নে আবার শ্রাবন্তীর বাবাকে দেখলেন। সেই তরুণ, সুদর্শন আহমদ আলি। কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু শরীর কিছুটা ভেঙ্গেছে।
আরজুমান্দ বানু বড়ো করে নিশ্বাস নিলেন। শ্রাবন্তীর বাবাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা তিনি ছেলেমেয়েকে বললেন না ; এমনকী শ্রাবন্তীকেও না। যদিও বড়োমেয়ে হিসেবে শ্রাবন্তীর সঙ্গে অনেক কথা বলে থাকেন তিনি।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার একটু আগে শ্রাবন্তী অফিস থেকে ফিরেছে। হঠাৎ একপশলা বৃষ্টি হওয়ার কারণে কাপড়-চোপড় ভিজে একাকার হয়ে গেছে। ছাতা সঙ্গে থাকলে এমনটি হতো না। ফোল্ডিং ছাতাটা ঠিক করতে হবে। ছমাস আগের কেনা। সামান্য দমকা বাতাসে সিক ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। সস্তায় কেনা। সস্তার তিন অবস্থা হয়েছে।
রাস্তায় ইট ফেলেনি শাওন। রাস্তার অবস্থা বেহাল। সকাল বেলা শ্রাবন্তী অফিসে যাওয়ার সময় শাওনকে বলে গিয়েছিল,‘রাস্তায় দুই-চারটা ইট বিছিয়ে দিস ,শাওন।’ গাধাটা কথা শুনেনি। কষে একটা থাপ্পড় মারতে হবে গাধাটাকে। কোনো কাজ একবার বললে করে না। দুবার বলতে হয় গাধাটাকে।
কাপড়-চোপড় পাল্টিয়ে শ্রাবন্তী তার ঘরে এসে দেখল লাইট জ্বালানো হয়নি। মা তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন। সে মায়ের কপালে আলতো করে হাত রাখল।
‘কী রে শ্রাবন্তী খেয়েছিস?’
‘অফিসে খেয়েছি। তোমার কি খারাপ লাগছে, মা? শরীরটা তো গরম দেখছি।’
‘ভালো লাগছে না। এমনিতে শুয়ে আছি। আরজুমান্দ বানু বিছানা ছাড়লেন। সুইস অন করে লাইট জ্বালালেন।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। সেইসঙ্গে তীব্র মেঘের গর্জনও ধেয়ে এল।
বৃষ্টি পড়া আবার শুরু হয়েছে। বৃষ্টির তীব্রতার কারণে ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। আরজুমান্দ বানু রান্নাঘর থেকে দুটো হ্যারিকেন জ্বালিয়ে আনলেন। অবন্তী বলল,‘দুইটা হ্যারিকেন এনেছ কেন, মা। আমি তো এখন আর পড়ব না। বৃষ্টি দেখব।’
টিনের চালের কারণে বৃষ্টির তীব্রতা টের পাওয়া যাচ্ছে। শ্রাবন্তী অবন্তী-কে কী যেন বলল। বৃষ্টির তীব্রতার কারণে শোনা গেল না। শ্রায়ন্তী, শাওনও পড়ার টেবিলে বসল না । তাদেরকে কেউ কিছু বলল না।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে শ্রাবন্তী বারান্দার এককোণে অবন্তীর পাশে এসে বসেছে। বৃষ্টির তীব্রতাও আস্তে আস্তে কমছে।
অবন্তী বলল,‘আপা কিছু কি বলবি? বললে পরে বলিস। এখন না।’
‘তুই খাসনি কেন?’
‘বৃষ্টিতে ভিজব। তারপর খাব। তুই ভিজবি আপা? খুব মজা হবে রে। আয়, আয়, ভিজি।’
অবন্তী হ্যাচকা টানে শ্রাবন্তীকে নিয়ে উঠোনে নেমে গেল। বড়বোনদের ভিজতে দেখে শ্রায়ন্তী, শাওনও যোগ দিল। সকলে মিলে হৈ-হুল্লোড় করে বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করতে লাগল।
ছেলেমেয়েদের এহেন ছেলেমানুষি দেখে আরজুমান্দ বানুর মনটা ভালো হয়ে গেল।

জন্মঃ ১লা জানুয়ারি, সিলেট শহর। ছোটোগল্পে হাতেখড়ি ২০০৯ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখার মাধ্যমে। তারপর আর থেমে থাকেননি। অবিরাম লিখেই চলেছেন। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল সিলেটের জনমানুষ, প্রকৃতি ধরা দেয় নির্মোহ ভঙ্গিতে।