| 5 মে 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

অলীকের লাল কুকুর ও হিমালয় পর্বতমালা । অলীক অনামিকা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
 
অলীকের বয়স পাঁচ। 
অলীকের লাল কুকুরের বয়স দুই। 
দুজনের খুব ভাব। 
ঘুম থেকে উঠে রাতে আবার ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা একে অপরকে ছেড়ে এক মুহূর্ত আলাদা থাকতে পারেনা। 
 
কয়েক বছর এমনি চব্বিশ ঘন্টা একসাথে জড়িয়ে থাকার পর লাল কুকুর একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করে, তার আর ঘরে মন টিকছে না। সে ঘরের এদিক ওদিক দৌড়ে ভাবতে থাকে কোথায় যাবে।
 
পাশের ঘরে বসে অলীক প্রথম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। লাল কুকুর অভ্যাসবশত তার পাশে বসে ইতিউতি চায়। হঠাৎ সে দেখে, অলীক পড়ার বইয়ের নীচ থেকে একটা নীল সাদা প্রচ্ছদের বই বের করে চোরা চোখে ফিসফিস করে পড়ছে। সব‌ বই জোরে‌ জোরে পড়া অলীকের বদভ্যাস। এই বই চুরি করে পড়া বই, তাই ফিসফিস করে পড়ছে।
 
লাল কুকুর কান খাড়া করে‌ শুনছে:
 
“হিমালয়ে হিমঝড় – আজব আ্যডভেঞ্চার!
 
শিশুরা, তোমরা কি হিমালয় পর্বতমালার নাম শুনেছ? তার আয়তন ২,৪০০ কিলোমিটার বা ১,৫০০ মাইল। তার অবস্থান মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশ নিয়ে বিস্তৃত এক অঞ্চল। হিমালয়ের কেবল একটি নয়, অনেকগুলি পর্বতশৃঙ্গ। যেমন:
 
১) এভারেস্ট
২) কে-টু
৩) কাঞ্চনজঙঘা
৪) মাকালু
৫) ধবলগিরি
৬) নাংগা পর্বত ইত্যাদি।
 
আজ আমি তোমাদের এক বিভীষিকাময় হিমঝড়ের গল্প শোনাব। হিমালয় পর্বতমালার এক বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গ ধবলগিরির ধবধবে গায়ে সে এক রোমহর্ষক কাহিনী। আজ থেকে অনেক বছর আগে…”
 
– অলীক! এই তোর পরীক্ষার পড়ালেখা? দে বইটা দে আমাকে।
 
কোথাও কিছু নেই। অলীকের রোমহর্ষক বাবা কি করে যেন টের পেয়ে যায় মেয়ের স্কুলের পড়ায় মন নাই। শাস্তি স্বরূপ বাবা বই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ময়লার বালতিতে ফেলে দেয়। 
 
তার উপর জোটে আচ্ছামতন‌ ধোলাই। অলীক চোখ লাল করে পাঠ্যপুস্তক খুলে জোরে জোরে মুখস্ত করে: 
The name of my pathshala is adorsho pathshala! The name of my pathshala is adorsho pathshala! The name of my pathshala is adorsho pathshala!…
 
লাল কুকুর সবার চোখের আড়ালে ময়লার বালতি থেকে খুঁজে পেতে “ধবলগিরি” লেখা দুটো পাতা উদ্ধার করে। জমাদার ময়লা নিতে আসার আগে সে মুখে পুরে অলীকের পড়ার টেবিলের নীচে দৌড়।
 
গভীর রাত।
 
অলীক ঘুমিয়ে কাদা।
 
এদিকে ধবলগিরি লাল কুকুরের মুখের ভিতরে খচখচ করে। হিমালয় পর্বতমালা পঠিত হতে চায়। অথচ লাল কুকুর দুই একটা শব্দের বেশি পড়তে শেখে‌‌ নাই। তার কুকুর স্বভাব। ছাগলের মতন বইয়ের পাতা খেয়ে হজম করার শক্তি সে কোথায় পাবে?
 
সারা রাত লাল কুকুর ধবলগিরির স্বপ্ন দেখে।
 
সকালে ঘুম থেকে উঠে অলীক আবিষ্কার করে লাল কুকুর হিমঝড়ে সাদা ও শীতল হয়ে কাঠ। সে মরে পড়ে আছে বিছানার নীচে।
 
পশুচিকিৎসকের ডাক পড়ে। তিনি অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গম্ভীর মুখে বলেন:
 
“Frostbite! Don’t ask me how is it possible but that is how she died!”
 
অলীক ও অলীকের বাবা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
লাল কুকুরের শোকে দুজনেরই চোখ লাল।
অলীক, অলীকের বাবা, বা পশুডাক্তার – কারোর ই চোখে পড়েনা –
 
লাল কুকুরের মুখের কোণে
হিমালয় পর্বতমালা 
উঁকি মেরে জানান দেয়।
 

২.
 
সত্তর বছর পরের কথা। 
 
অলীক এখন ঢাকা শহর ছেড়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এক বরফের দেশে থাকে। 
 
সে একা চিলেকোঠার ঘরে বসে ছোটদের জন্য ভ্রমণ কাহিনী লেখে। পৃথিবীতে কত দেশ সমুদ্র জঙ্গল মরুভূমি পর্বতমালা। কিন্তু অলীকের সব গল্পের শুরু আর শেষ হয় হিমালয় পর্বতমালায়। 
প্রকাশক ও শিশু পাঠক বিরক্ত হয়ে তাকে চিঠি লেখে: 
 
“অন্য কিছু নিয়ে লিখুন না। আর কোন বিষয় কি‌ নেই ইহজগতে?”
 
অলীক তার উত্তরে আরেকবার ধবলগিরির ধবধবে গায়ে গলে যাওয়া গ্লেসিয়ারের কান্নার গল্প লেখে।
 
অলীকের সব চুল এখন সাদা। 
সে চোখে ভালো দেখতে পায় না। 
পিঠ কুঁজো করে হাঁটে আর এদিক ওদিক চায়। 
তার আর‌ ওই দেশে থাকতে ভালো লাগে না।
 
একদিন খুব ভোরে উঠে সে দেখে সারা শহর বরফের কম্বল গায়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোথাও কোন কিছুর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।
 
এককাপ কালো কফি খেয়ে অলীক গরম জামা বরফ টুপি পরে রওনা দেয়।
 
গন্তব্য: হিমালয়।
 
হাতে তার সবসময়ের সঙ্গী একটা লাঠি আর তার পিছু পিছু হাঁটছে কালো কলার পরা একটা লাল কুকুর। 
 
সবাই ছেড়ে গেলেও লাল কুকুরটা তাকে ছেড়ে যায়নি। 
 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত