| 7 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

ভ্রমণ: অস্ট্রেলিয়ার আলো-আঁধার । শাহীন আখতার

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

মেলবোর্ন বাংলা সাহিত্য সংসদ

আমার অস্ট্রেলিয়া সফরের অভিজ্ঞতা ছিল অভিনব। দেশে যখন বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে, তখন দক্ষিণ গোলার্ধের হাড়কাঁপানো শীতের দেশে যাত্রা। তাই ঘামতে ঘামতে উলের জামাকাপড় দিয়ে সুটকেস ভরাতে হচ্ছিল। সেই সঙ্গে ছিল মেলবোর্ন বাংলা সাহিত্য সংসদের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি। সেটা না নিলেই নয়। আমি মাইক হাতে নিলে নিমেষে মাথা ফাঁকা, চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকি। সম্বৎসরের কাঁড়ি কাঁড়ি বই পড়া, প্রায় নিয়মিত লিখতে—পড়তে কম্পিউটারে বসা সবই বৃথা মনে হয়।

অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া স্টেটের মেলবোর্ন বাংলা সাহিত্য সংসদ (বিএসএস) দুই বাংলার প্রবাসী বাঙালিদের সাংস্কৃতিক সংগঠন। আমার জানামতে, অস্ট্রেলিয়ায় বিএসএস—ই শুধু পর্দার আড়ালের মানুষ যথা সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানায়, সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং বাংলাসাহিত্যের মহারথী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে শুরু করে এই প্রচেষ্টা দীর্ঘ একুশ বছর ধরে চালু রেখেছে। তখন এ আড়ম্বরহীন, ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হন ‘মুখচোরা’ বা ‘বাচাল’ প্রকৃতির আমন্ত্রিত সেই সাহিত্যিক। প্রথম দলে পড়া আমি, দেশে থাকতেই এ নিয়ে দুর্ভাবনায় ছিলাম। কীভাবে সম্ভব আমার মতো ‘সাহিত্য—আড্ডা’ বিবর্জিত মানুষের এতগুলো দিন শুধু সাহিত্য নিয়ে মেতে থাকা বা অন্যকে মাতানো! শুনেছি- আমাদের দেশের সাহিত্য—আড্ডার পুরোহিত আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার মেলবোর্নে খুব জমিয়ে গেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের সভায় মানুষ হল ভেঙে পড়েছিল। আসলে এমন সফলতার কাহিনী নিয়ে আমি ভাবছিলাম না। আমার ভাবনা ছিল নিজেকে নিয়ে। ধন্যবাদ মেলবোর্ন বাংলা সাহিত্য সংসদের মাননীয় সদস্যদের, যাঁদের আন্তরিকতা, সহৃদয়তা আমাকে ‘অসামাজিকতা’র বাধা ডিঙ্গাতে সাহায্য করেছে। তাঁদের সপ্তাহব্যাপী ‘সাহিত্য—উদযাপন’—এ আমি শুধু শরিকই হইনি, তা উপভোগ্য ও উদ্দীপনাময় হয়ে উঠেছিল আমার কাছে।


যথারীতি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের বাইরে বিএসএস—এর সিডিউলে ছিল একটি পাবলিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি হয় ২৫ জুন ২০২৩, মেলবোর্নের পশ্চিমের শহরতলী টার্নিটের স্থানীয় গ্রন্থাগারে। অস্ট্রেলিয়ার স্বল্পকালীন (২০১০—২০১৩) প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের নামে এ গ্রন্থাগারের নাম। জুলিয়া গিলার্ড এমপাওয়ার্ড হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, গাড়ি চালিয়ে ভ্যেনুতে যেতে যেতে আমার অন্যতম হোস্ট নাহিদ খান তা বিশদে জানান।

ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আমি মাইক ও মঞ্চভয়জনিত টেনশনে মেলবোর্নের শীতের অপরাহ্নে মৃদু ঘামতে থাকি। অতঃপর বিএসএস—এর সভাপতি প্রতীশ বন্দোপাধ্যায়ের স্বাগত ভাষণ, মেলবোর্ন—বাসী লেখক লুনা রুশদীর আমার ‘লেখক—পরিচয়’ নিয়ে প্রণোদনামূলক সুন্দর উপস্থাপন, কঠিন বিষয়টিও সহজ করে তোলে। আমি আমার লেখালেখি নিয়ে ‘আমার সাহিত্য ভুবন’ ব্যানারে কিছু কথা বলি। তারপরের লেখক—পাঠক পর্বটি ছিল সত্যিই প্রাণবন্ত। প্রশ্নগুলি চারদিক থেকে তিরের মতো ছুটে এলেও সেসব তির ছিল ভালোবাসা—মাখা আর বুদ্ধিদ্বীপ্ত। তার মধ্যে কক্ষের শেষ প্রান্তে বইয়ের ডিসপ্লে—টেবিল কখন খালি হয়ে গেছে! তা সত্যিকারের চমকই বটে। লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে এসে, কেউ তার বইয়ের কথা ভুলে যায়নি, সবাই বই কিনে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। অর্থাৎ লেখককেও খানিকটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।



সাহিত্যিকদের নিয়ে যে কোনো আয়োজনে, যে কোনো দিবসে, ধরা যাক তাঁর মৃত্যুদিবসে, ‘বই—উৎসব’—এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। ‘ডন কুইকজোট’—এর খ্যাতিমান লেখক সার্ভেন্তেসের মৃত্যুদিনে বিপুল সংখ্যক স্পেনীয় তাঁর বই কিনে উপহার বিলান। রাস্তার মোড়ে, হাটে—বাজারে দাঁড়িয়ে—বসে অগণিত মানুষ সেদিন তাঁর বই পড়ে। সত্যিকারে লেখককে জানার সহজ উপায়- বইয়ের বিকল্প কিছু আছে কী? নেই তো। পাঠককেও লেখক চিনে নেন সেই বই দিয়ে। পরস্পরের চেনা—জানার মাধ্যম এই বই। পরস্পরের ভালোবাসার উৎস বই। সম্পর্কের নির্ণায়ক হচ্ছে বই। তাই বিএসএস—এর এই সাহিত্য—আয়োজনে অন্য কোনো সাজ—সজ্জা নয়, প্রসাধনস্বরূপ টেবিল জুড়ে বইয়ের প্রদর্শনী দারুন লেগেছে। তাছাড়া অনুষ্ঠানের আগে—পিছে মনোরঞ্জনের শো ব্যতিরেকে শুধুমাত্র সাহিত্যকে ঘিরে উৎসব—আয়োজন- অভিনব বৈকি। যেন জুলুস বাড়ানোর অনুষঙ্গের দরকার নেই। সাহিত্য যারা ভালোবাসেন, হৃদয়ের টানে আপনিই হাজির হবেন। আয়োজকদের পক্ষ থেকে অর্থ—যশ নয়, সাহিত্যের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থাকলেই এমন কাজ করা সম্ভব।
আমি এ লেখা শুরু করেছিলাম আবহাওয়া—বার্তা দিয়ে। জুনের শেষাশেষি যদিও প্রচণ্ড শীত, পাতাঝরার দিন, কিন্তু মেলবোর্নের নাতিদীর্ঘ গাছগুলি পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যায়নি। সব কিছু ছাপিয়ে নজর কাড়ছিল দিগন্ত—উদভাসিত ছাতাকৃতির বিশাল নীলাকাশ। গাড়ির জানালার কাচে ধেয়ে ধেয়ে আসছিল কনিফার গাছের সারি, জনমনুষ্যহীন খোলা প্রান্তর, বিস্তীর্ণ পশুখামার, নজর—কাড়া অচেনা পাখির ঝাঁক, অদ্ভুত জীব—জন্তু।


টিকেট কেটে, কখনো—বা বিনা টিকিটে মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লে দেখা মেলে বিশাল ডাইনোসরের কংকাল, অ্যাবঅরিজিনাল আর্ট। তাই ভোর না হতেই সেসব দেখার তৃষ্ণা। কিন্তু রাতভর দেয়ালে বৃষ্টির ছাট, বাতাসের গর্জন, বিছানায় শুয়েই ভাবতাম দিনটা আজ মাটি হবে। কিন্তু নাশতার টেবিলে থাকতেই ঘরের বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর। আবহাওয়ার পূর্বাভাষ যদিও বলছে এ ক্ষণিকের ভ্রম, তাতে কী? এত বড় উন্মুক্ত আকাশ, এর নিচে হু হু বাতাস তো বইবেই। আর এন্টার্কটিকার এত কাছে যখন, বাতাস বরফশীতল না হয়ে যায় না। আবহাওয়ার মুহূর্মুহূ এ রং—বদলের মাঝখানে ঝটপট তৈরি হয়ে নেই। ততক্ষণে দুয়ারে দাঁড়ায়ে গাড়ি। পালাক্রমে বিএসএস—এর বন্ধুরা বেড়াতে নিয়ে যাবেন। একটা গোটা দিন গ্রেট ওশান রোড ধরে চলা তো, অন্যদিন মেলবোর্ন থেকে প্রায় ১৫০ কি মি দূরে ব্যালারাটের সোনার খনি। ১৮৫৪ সালে, আমাদের সিপাহি বিদ্রোহের পাক্কা তিন বছর আগে ব্যালারাটে ‘ইউরেকা’ নামে সশস্ত্র বিদ্রোহ হয়। তাতে মারা যান অসংখ্য খনি শ্রমিক।

আদিবাসী সমাচার

মেলবোর্ন ছিল আমার অস্ট্রেলিয়া সফরের প্রবেশদ্বার। সিডনি, ব্রিসবেনে স্বজনেরা অপেক্ষা করছে। আমি যেদিন সাহিত্য—উৎসব—এর পাট চুকিয়ে মেলবোর্ন ছাড়ব, সেদিনই আমার পার্টনার জাহিদুর রহিম অঞ্জন ঢাকা থেকে সিডনি পৌঁছবে। একটা মহাদেশ আবিষ্কারে নামব আমরা। ইউরোপের মতো আভিজাত্য না থাক, এর আছে স্বচ্ছ আকাশ, সুনীল সাগর, নির্মল বায়ু, নির্ভয় প্রাণীকূল- সে স্থলচর বা খেচর যাই হোক। আমাদের বৃদ্ধ—মুমূর্ষু পৃথিবীর নবীন রূপ যেন।



আসলেই কি নবীন? হ্যাঁ, সে তো প্রকৃতির দান। কিন্তু সাদা অস্ট্রেলিয়ার ভিত গাড়ার বছর অর্থাৎ ১৭৮৮—এর পূর্বের ইতিহাস কয়েক সহস্রাব্দের। এখানের ভূমিপুত্র—কন্যাদের কালেভদ্রে দেখা যায়। আমরা যেহেতু জেলখানা পরিদর্শনে যাইনি, তাই গাদাগাদি পড়ে থাকা আদিবাসীদের সঙ্গে মোলাকাত হয় নাই। যাদের কাছ থেকে আস্ত একটা মহাদেশ কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তারা আজ চোর বটে। আর সাধু হলেন খুনি—দস্যু মহারাজ। সেই অসহায় যাতনা থেকে কিনা জানি না, শুনেছি অস্ট্রেলিয়ান অ্যাবঅরিজিনরা খুব ড্রাগ করে, মদে বুঁদ হয়ে থাকে। এ যুগে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে তাদের গড় আয়ু মাত্র সাঁইত্রিশ বছর। এসব প্রাথমিক তথ্যাদি আমাদের আরেকটু গভীরে যেতে উসকায় তখন। এ অবস্থায় শুধু ব্লু মাউন্টেন বা সিডনি অপেরা হাউজের মতো দর্শনীয় স্থানে ঘুরপাক খেলে চলে না। বড় বড় শহরের যাদুঘর—আর্টগ্যালারি, আদিবাসী—দ্বীপ আমাদের হাতছানি দিতে থাকে। প্রকারান্তরে এসব পীঠস্থানের দ্বার হাট করে খুলে যায়, হালে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অতীতের অন্যায় স্বীকার’—এর কালপর্ব চলছে যেহেতু। মেলবোর্নের ইমিগ্রেশন মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অফ হিস্ট্রি এনএসডব্লু (নিউ সাউথ ওয়েলস) তাছাড়া সিডনি ও ব্রিসবেনের বেশ কিছু মিউজিয়াম দেখে মনে হয়েছে এরা কালপর্বের সাক্ষী, নতুন করে ঢেলে সাজানো হয়েছে। আদিবাসীদের দিক থেকেও ঘন ঘন আওয়াজ উঠছে ‘সবসময় ছিল, সবসময় থাকবে এই ভূমি আমাদের।’ সম্প্রতি ক্যাপটেন জেমস কুকের ভাস্কর্যে লাল রং ঢেলে দিয়ে পাশের গ্রাফিতিতে লেখা হচ্ছে ‘গণহত্যা গর্ব নয়।’
বছর কয়েক আগে অ্যাবঅরিজিনাল আর্টিস্ট গর্ডন শ্যারনের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে- ‘ভূমি কেড়ে নিলো, আদিবাসীদের খেদালো লাল কোটের ব্রিটিশ… আমরা হিসাব রাখছি, আমরা চলে যাইনি, এখনো এখানে আছি।’ শ্যারনের জন্মস্থান নিউ সাউথ ওয়েলস, যেখানে ব্রিটেন থেকে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের নিয়ে আসা প্রথম জাহাজটি ভিড়েছিল। কিছু সংখ্যক মেয়ে কয়েদিও ছিল শুরুর দিকের সেসব জাহাজে। তারপর পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা—পর্বের অনুকরণে, নারী—পুরুষে ভারসাম্য আনতে সিঙ্গেল মেয়েদের নানা সুযোগ—সুবিধা দিয়ে অভিবাসনে উৎসাহিত করা হতো। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী কয়েদিদের বসবাসের স্থানকে বলে কনভিক্ট সাইট। যার একটি সিডনির হাইড পার্ক ব্যারাক। বর্তমানে মিউজিয়াম। এর আশপাশে ছিল টাকশাল, হাসপাতাল। এখনো আছে পুরোনো কোর্ট বিল্ডিং। অদূরে সিডনি হারবার। গভর্নর ম্যাককুয়ারি কনভিক্টদের জন্য ১৮১৮—১৮১৯ সালে গড়েন এই ব্যারাকটি, যার স্থপতিও ছিলেন এক সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। ইংল্যান্ডে জালিয়াতি মামলায় স্থপতি ফান্সিস গ্রিনওয়ের কারাদণ্ড হয়। ম্যাককুয়ারি যখন দেখলেন কনভিক্টরা শ্রম খাটার পর শহরে গিয়ে মাতলামি—চুরি—চামারি—স্থানীয়দের ওপর মাস্তানি এসব করে বেড়ায়, তখন তাদের শৃংখলায় এনে আরও কাজ আদায় করতে ব্যারাকজীবন জরুরি মনে হয় তার। সাজাপ্রাপ্ত এ শ্রমিকেরা প্রতি—কক্ষে দুসারিতে ঝোলানো দড়ির দোলনায় সত্তর জন করে থাকত। খেতো পাতলা পরিজ। বর্তমানে ব্যারাকটি সিডনির লিভিং মিউজিয়ামও বটে। এখানে প্রথম দুবছর বিদ্যাপীঠের ছাত্র—ছাত্রীদের কয়েদির জামা পরে, টলটলে পরিজ খেয়ে, হ্যামকে ঘুমিয়ে উপলব্ধি করতে বলা হয়েছে- মাত্র দু শ বছর আগে জীবন কেমন ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের। যথারীতি হাইড পার্ক ব্যারাক মিউজিয়ামেও অ্যাবঅরিজিন—সেকশন রয়েছে। কোথাও রাখ—ঢাক নেই। ১৭৭০ সালে, রাজকীয় জাহাজ এন্ডেভার নিয়ে ক্যাপটেন জেমস কুকের অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে পাক খেয়ে ঘুরে যাওয়া, অনতিকাল পর দেশ থেকে জাহাজভর্তি কয়েদি এনে ব্রিটিশদের উপনিবেশ স্থাপন এবং এর নানা পর্বের হত্যা—গণহত্যা—ধর্ষণ—সংঘাত—উৎখাত সবই আজ শ্রাব্য ও দৃষ্টিগ্রাহ্য বিশেষত যাদুঘর ও আর্ট—গ্যালারিতে। আদিবাসীদের মধ্যে স্টোলেন জেনারেশন বলে একটি প্রজন্ম আছে। তা বেশি দিন আগের কথা নয়। ১৯১০ থেকে ১৯৭০, অস্ট্রেলিয়ার সরকার জোরেশোরে আদিবাসীদের ‘সভ্য’ বানানোর প্রকল্প চালায়। তার জন্য আদিবাসী শিশুদের চুরি করে, কখনো—বা জোরপূর্বক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে মিশনারিদের হাতে তুলে দেওয়া হতো বা বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হতো, হোয়াইট পরিবারে পালক দেয়া হতো। সেখানে তাদের জুটতো নতুন নাম, নতুন ধর্ম—পরিচয়, নতুন ভাষা—কৃষ্টি। ‘সভ্য’ করার এ প্রক্রিয়ায় লাইটস্কিনের অর্থাৎ মিশ্ররক্তের শিশুদের বরাবরই কদর বেশি। আর শারীরিক—মানসিক নিপীড়নের শিকার হতো ‘পিওর ব্লাড’—এর কালো আদিবাসী শিশুরা। এখনো শিশু—সুরক্ষার নামে এ বর্ণবাদী ও অমানবিক কালা—কানুন চালু আছে। পাশাপাশি জারি রয়েছে তুমুল প্রতিবাদ। গাইডেড ট্যুরগুলোও এ নিয়ে বেজায় সরব এবং যারপরনেই চিত্তাকর্ষক।

স্টার্ডব্রুক আইল্যান্ড

স্টার্ডব্রুক আইল্যান্ডের হাঁটু—কাটা জিনস পরা, লাইটস্কিনের আদিবাসী গাইড সারাক্ষণ গাছ নিয়ে মাছ নিয়ে অনেক উপকথা শোনাল। গাছের ছাল—বাকলের ইতিহাস আছে। প্রাণ তো আছেই। আছে ঔষধি গুণাগুণ। গাইড আমাদের এমন একটা গাছ দেখালো, যার মগডালে স্পিরিট বা পূর্ণ্যাত্মা বাস করেন। তিনি আদিবাসীদের স্বপ্নে ঢুকে ন্যায়—নীতি শেখান, মুশকিল আসানের পথ বাতলান, দরকারে প্রতিবাদী হতে বলেন, আদিতে কিছু আইনও প্রণয়ন করেছেন, যাতে মানুষের কাজকারবারে প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট না হয়। গাইড মেয়েটি দ্বীপের বালু—কণা, তৃণ—লতা, প্রস্তরখণ্ড হাতে—কলমে চিনিয়ে দিচ্ছিল। তার পূর্বপুরুষ, আদি দ্বীপবাসীদের সুদীর্ঘকালের অত্যাচার ও লড়াইয়ের কাহিনী সবিস্তারে শোনাচ্ছিল। তার কথামতো লতা—পাতার গন্ধ শুঁকে শুঁকে, ফুল থেকে চঞ্চুতে মধু টেনে নিতে নিতে আমরা সশরীরে জ্ঞান আহরণ করি। আমাদের আদিম জ্ঞান—ভাণ্ডার ক্রমে স্ফীত হতে থাকে…



ভ্রমণের শেষপর্বে দ্বীপের প্রান্তভাগ থেকে তিন দিকে তিনটি সমুদ্র আঙুল তুলে দেখায় গাইড। যার একটিতে এক তিমি যেন বিশাল সিরিঞ্জ দিয়ে সাগরের নীল জলে ফোয়ারা ছাড়তে ছাড়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামনেই তাদের বাচ্চা প্রসবের মৌসুম। তার কিছুদিন পর বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতে তীরের আরও কাছাকাছি চলে আসবে মা তিমিরদল। গাইড এবার ঘুরে তাকায়, বলে সাগর ঘেরা এ বনভূমি, আবাস, আবাদ, ক্যাঙারু—কোয়ালা, সাদা কাকাতুয়া, একদিন সব ছিল আমাদের; শুধুই ফাস্টর্ ন্যাশন আদিবাসীদের।



অভিবাসন বৈরী মহাদেশ

‘এখন ১৪০টি জাতিসত্তার লোকের বাস অস্ট্রেলিয়ায়,’ তথ্যটি গর্বভরে জাহির করেন সে দেশের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড। ‘কিন্তু কারা এদেশে আসতে পারবে, কিভাবে আসতে পারবে ঠিক করব আমরা।’ সময়টা ২০০১। বোটে করে কয়েক শ আফগান শরনার্থীর আগমন নিয়ে হুলস্থুল। এ লোকগুলো ইন্দোনেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া আসার চেষ্টা করছিল জেলে নৌকায় চেপে। সেই বিপদাপন্ন অবস্থায় একটি নরওয়েজিয়ান জাহাজ তাদের তুলে নেয়। কিন্তু সে জাহাজটিকে অস্ট্রেলিয়ার ভূখণ্ডে ভিড়তে দেওয়া হয় না। সে দেশের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ তাদের নিয়ে তোলে ৩ হাজার মাইল দূরে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রজাতন্ত্র, প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপ নাউরুতে। সেই সঙ্গে প্রণয়ন করে ‘প্যাসিফিক সলিউশন’ নীতি। যার সার কথা হচ্ছেÑ কোনো আশ্রয়প্রার্থী অস্ট্রেলিয়া প্রবেশের সময় হাতে—নাতে ধরা পড়লে, তার অ্যাসাইলামের আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্য একটি দেশে তাকে রাখা হবে।
অভিবাসনের ফলে যে সব ধনী দেশের ডেমোগ্রাফিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে- অস্ট্রেলিয়া সেসব দেশের একটি। কিন্তু বিগত দু দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ—সংঘাতজনিত শরনার্থীর ঢলের আঁচ ইউরোপের মতো অতোটা লাগেনি এখানে। তবু ‘প্যাসিফিক সলিউশন’—এর জের চলছে এখনো। দিন দিন আরও কঠোর আইন তৈরি হচ্ছে।
এ বছরের মার্চ মাসে পত্রিকাসূত্রে দুই বাংলাদেশি তরুণের করুণদশায় বিক্ষোভ করার খবর পাওয়া যায়। প্যাসিফিক সলিউশনের কোপে পড়ে ওরা প্রায় এক দশক নাউরু দ্বীপে বন্দী। আত্মীয়—পরিজনসহ তামাম দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ও যোগাযোগহীন হয়ে আছে। তাই নিজের ঠোঁট সেলাই করে, হাতে—লেখা পোস্টার নিয়ে দুর্দশার কথা জানাচ্ছে পৃথিবীকে।
‘বাংলাদেশি বয়েজ’ নামে ১৬ বাংলাদেশি তরুণও নৌকায় চেপে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল। আমরা তাদের গল্প শুনি আমার অস্ট্রেলিয়া—প্রবাসী কাজিন আরেফিনের কাছ থেকে। আমরা তখন ব্রিসবেন থেকে কিলকয়ের পাশ দিয়ে গোল্ড কোস্টের দিকে যাচ্ছিলাম। গ্রামীণ শহর কিলকয়ের অধিবাসীর সংখ্যা মাত্র ১৩ শ। তারা ১৬ তরুণের আগমনে হাতে চাঁদ পেয়ে যান। অচিরেই গ্রামের কসাইখানায়, রেস্তোঁরায় কাজ জোটে ছেলেদের। ‘ওরা আমাদের অ্যাসেট,’ বলেন কিলকয় পৌরসভার মেয়র। কিলকয় মেডিকেল সেন্টারের ডাক্তার এগিয়ে এসে জানান- ছেলেগুলি খুব উদ্যমী। ওরা আমাদের পনিক্লাবে যায়। ক্রিসমাসে অ্যাটেন্ড করে। অস্ট্রেলিয়াদিবস উদযাপন করে। কমিউনিটির যে কোনো পালা—পার্বণে দলবেঁধে কাজে লেগে পড়ে। স্থানীয়দের কাছ থেকে যে সহযোগিতাটা আমরা কখনো পাই না। ওরা আমাদের কমিউনিটির সব কিছুতে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের সবাইর কাছে ওরা ভীষণ প্রিয়। ওরা প্রত্যেকে ভালো স্বভাবের বললে খব কমই বলা হবে।
এত গুণগান, তবু ভবি ভোলবার নয়। অস্ট্রেলিয়ায় ৩ বছর থাকার পর তাদের ভিসা নিয়ে যথারীতি গোলমাল বাঁধে এবং ১৬ জনের মধ্যে ৭জন সে অগ্নিপরীক্ষায় উৎরায়। বাকি ৯ জনকে ধরে রাখতে কিলকয়ের মানুষ যা করার, সবই করেছে। তারা পত্র লিখে কেন্দ্রীয় ইমিগ্রেশন মন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানান। ব্রিসবেনের কিং জর্জ স্কয়ারে জড়ো হন। র‌্যালি করেন। হ্যান্ডমাইক হাতে কিলকয়ে আসা ১৬ বাংলাদেশির ‘ইমিগ্রেশন সাকসেস স্টোরি’ শত মুখে এলান দেন। বলেন, তারা কতোটা গর্বিত এ ছেলেদের নিয়ে। তাদের বিশ্বাস- ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট এ ঘটনাকে অস্ট্রেলিয়ার অর্জন হিসাবে দেখবে।
‘যারা নিরুপায় হয়ে, ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে আমাদের সৈকতে হাজির হয়’, প্রচণ্ড করতালির মধ্যে সর্বশেষ বক্তা বলেন, ‘আমরা আশা করি অস্ট্রেলিয়া তাদের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হবে, তাদের দয়া দেখাবে, মর্যাদা দেবে।’
এটি একটি উদাহরণ- শরনার্থী নিয়ে যে জুজুর ভয়, তা কতখানি অসার স্থানীয় লোকজনের কাছে, যারা কাছ থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের দেখার এবং তাদের সান্নিধ্য পাবার সুযোগ পেয়েছে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত