| 6 অক্টোবর 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: টিক-টক টিক-টক । পূজা মৈত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

“টিক-টক / টিক-টক” ডার্ক ওয়েবসিরিজটা নেটফ্লিক্সে দেখার পর থেকেই মাথায় বারবার এই শব্দবন্ধটাই ঘুরছে আরণ্যকের। একটা ‘অদ্ভুত’ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। সবে ক্লাস এইটে পড়ে ও। হয়তো দেখা উচিৎ হয়নি ওর সিরিজটা। বড্ড জটিল, বারবার রিওয়াইন্ড করে দেখতে হয়। দেখে মনে রাখতে হয়। একটু বেভুল হলে সব চরিত্রগুলোর মধ্যেকার জটপাকানো সম্পর্কগুলো আরো জটিল হয়ে যাবে। ফিজিক্স স্যারের ব্যাচে স্যারের মুখে সিরিজটার প্রশংসা শুনে উৎসাহবশত দেখে ফেলেছে। ফিজিক্স ওর প্রিয় সাবজেক্ট। ক্লাসে ফার্স্ট হয় ও। নামী স্কুলে পড়ে। মা ডাক্তার, বাবা ফিজিক্সেরই প্রফেসর। বাড়িতে ওর কিছুতে মানা নেই। যেহেতু ও নিজে ভীষণ সিরিয়াস আর ডিসিপ্লিনড মা-বাবা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে মাথা ঘামান না। সেই সুযোগেই সপ্তাহখানেক রোজ রাত জেগে খাতা কলম নিয়ে বসে ডার্ক দেখে ফেলেছে আরণ্যক। এইচ জি ওয়েলস্‌ আর টাইম মেশিনের গল্প ছোট থেকেই বাবার মুখে বহুবার শুনেছে ও। টাইম ট্র্যাভেল নিয়েও দারুণ আগ্রহ ছিলো বরাবর। প্রথমদুটো সিজন তাও তাল রাখতে পারছিলো, থার্ড সিজনে যখন প্যারালাল ইউনিভার্স এসে ঢুকলো গল্পে কে কোন দুনিয়ার মার্থা, কোন জোহান আসল, অ্যাডাম আর ইভা কোন দুনিয়ায় কি চাইছে ভীষণ ভাবেই ঘেঁটে যাচ্ছিলো। তার উপর হেলগির সারাক্ষণ “টিক-টক / টিক-টক” করে যাওয়া, সময় ট্র্যাভেল করার জন্য ক্ষতয় ভরে যাওয়া অ্যাডামের শরীর আর বারবার হওয়া অ্যাপোক্লিপস্‌! সিরিজটার হ্যাংওভার কাটাতেই বেশ কিছুদিন লেগে যাবে, বেশ বুঝতে পারছে আরণ্যক।

        কাকে বলবে কথাটা? মা’কে বললে সাইকোলজিক্যাল কনসাল্টেন্সির কথা ভেবে বসবে প্রথমেই। বাবাকে বললে টাইম ট্র্যাভেলের উপর আরোকিছু বইয়ের পি ডি এফ পাঠাবে, হোয়াটস্যাপে। অথচ বিষয়টার থেকে দূরে যেতে চাইছে আরণ্যক। ক্লাসে, টিউশনে, ঘুমের মধ্যেও ওর কানে “টিক-টক / টিক-টক” শব্দটা হতেই থাকছে। ভীষণই আনক্যানি ফিলিং এটা। অথচ ও থামাতে পারছে না। রাতে কানে হেডফোন দিয়ে ঘুমাচ্ছে ক’দিন। তবুও ঘুমের মধ্যেও শব্দটা শুনছে। কথাটা কাউকে বললে যে বুঝবে কেউ তাও সম্ভব না। কিন্তু ওর মনে হচ্ছে টাইম মেশিন ওর খুব কাছেই আছে। আর কেউ চাইছে – ও তাতে করে টাইম ট্র্যাভেল করুক। কিন্তু সেটা কে? জোহান? না মার্থা? নাকি অ্যাডাম নিজেই? দূর দূর! ওরা সব তো কল্পচরিত্র। কোন লেখকের কল্পনা। কিন্তু এইচ জি ওয়েলস্‌! ঘড়ির দোকান? টাইম মেশিনের বই? সবই তো বাস্তব। তাহলে কেউ কি সত্যিই চায় ও টাইম ট্র্যাভেল করুক? কি দেখাতে চায় ওকে? অতীত না ভবিষ্যৎ?

        মাম্মার ডাক শুনে তাকালো আরণ্যক, “স্কুল যাবি না?” সকালে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো আরণ্যকের। মাম্মাও ডাকেনি, “যেতে তো হতো, লেট হয়ে গেলো না?” মাম্মা ওর পাশে বসলো। মাথায় হাত রাখলো, “নাহ! জ্বর নেই। রাত জেগে পড়ছিলি নাকি?” আরণ্যক মিথ্যা বলে না সাধারণত। কিন্তু ঘুম আসেনি “টিক-টক / টিক-টক” শব্দে মাম্মাকে বলা যাবে না, “হ্যাঁ।” “টেস্ট আছে কোন?” “না, না মাম্মা।” “তাহলে থাক, আজ আর যেতে হবে না।” আরণ্যক প্রথমে খুশিই হয়েছিলো। একটু ঘুমতে পারবে বাড়ি থাকলে। পরক্ষণেই মনে পড়লো মাম্মাও বাড়ি থাকবে না। বাবাও কলেজে যাবে। রাধামাসির সাথে একা থাকতে হবে আরণ্যককে সারাদিন। রাধামাসি সর্বক্ষণের মেইড। আরণ্যক জন্ম থেকেই দেখছে। কিন্তু আরণ্যক এখন একা থাকতে চায় না। একা থাকলেই শব্দটা আরো তাড়া করবে ওকে। তার থেকে স্কুলে যাওয়াই ভালো, “না, স্কুল যাই। ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে কয়েকটা।” আরণ্যক বুঝলো মাম্মা যথেষ্ট অবাক হলেও কিছু বললো না। উঠে চলে যাচ্ছিলো। আরণ্যকই বললো, “মাম্মা-” মাম্মা ঘুরে তাকালো, “বল্‌।” একবার ভাবলো মাম্মাকে বলে আজ থেকে যেতে। তাহলে আরণ্যকও স্কুলে যাবে না। কিন্তু মাম্মার সেমিনার আছে। কালই ডিনারে বলছিলো বাবাকে। “না, থাক।” ডাক্তার রঞ্জিনী মিত্র এগিয়ে এলেন, “কী হয়েছে? কিছু চাই? কিছু আনবো?” আরণ্যক মাথা নাড়লো। মাম্মা ভাবলো ও কোন আব্দার করবে। কিন্তু ওর আব্দার করার কিছুই নেই। ও না চাইতেই মাম্মা আর বাবা সব এনে দেয়। এইসময় ওর অল্প একটু সময় চাই। দুজনের থেকেই। কিন্তু কী কারণে সেটা বলা যাবে না।

        স্কুল থেকে ফেরার পথে স্কুল বাসে শৌনককে প্রশ্নটা করেই ফেললো, আরণ্যক, “ডার্ক দেখেছিস্‌?” শৌনক একই ফিজিক্স টিউশনে পড়ে। ক্লাসে সেকেন্ড হয়। আরণ্যকের ভালো বন্ধুও। “নাহ রে, আমার তো নেটফ্লিক্স সাবস্কিপশন নেই। দিদিকে বলেছিলাম দিতে, দেয়নি। বললো বড়দের জন্য নাকি। তুই দেখলি নাকি?” “হ্যাঁ।” “কেমন রে?” “খুব কমপ্লিকেটেড, খুব ভেঙে ভেঙে দেখতে হয়। কিন্তু দেখা থামানো যায় না। দেখেই যেতে হয়।” “আমাকে তোর আই ডি পাসওয়ার্ড-টা দিবি?” “হ্যাঁ, নে না। শৌনক – টাইম ট্র্যাভেল কি বাস্তবে সম্ভব? কী মনে হয় তোর?” “থিয়োরিটিক্যালি পসিবল তো মনে হয়। তুই আঙ্কলকে তো আস্ক করতে পারিস, আঙ্কলেরই সাবজেক্ট তো।” আরণ্যক ঘাড় নাড়লো। বাবাকে বললে ঐ কয়েকটা পেপার আর পি ডি এফ – ওটাই পাবে আরণ্যক। বাবার ব্যস্ততা এতোটাই। “তবে জানিস আমার মনে হয় আনসলভড্‌ মার্ডার মিস্ট্রি – যেমন ধর স্টোন ম্যান মার্ডারস্‌। যেটা এইট্টিসে হয়েছিলো – কেউ টাইম ট্র্যাভেল করে এসে খুন করে দিয়ে যায়নি তো?” শৌনকের কথায় আরো হিমস্রোত বয়ে গেলো আরণ্যকের শিরদাঁড়া দিয়ে। যদি শৌনক যা বলছে তা সত্যি হয় – তবে তো মারাত্মক ব্যাপার। ওর কানের গোড়ায় আবার বেজে উঠলো – “টিক-টক / টিক-টক।” নিশ্চয় কিছু আছে – কেউ কিছু দেখাতে চাইছে ওকে। কিন্তু সে কে? আর কীভাবেই বা দেখবে আরণ্যক? অথচ না দেখেও শান্তি নেই। শব্দটা ওকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

        “স্টোনম্যান মার্ডারস্‌-এ স্টোনম্যান ধরা পড়েনি?” ডিনার টেবিলে আরণ্যকের কথায় প্রফেসর আবির মিত্র তাকালেন, “হঠাৎ এই প্রশ্ন? কোন মার্ডার মিস্ট্রি দেখছিস নাকি, আজকাল?” “না, না। শৌনক বলছিলো যে ধরা পড়েনি – তাই।” “ধরা পড়েনি। হয়তো কোন সাইকোপ্যাথের কাজ। সে মারা গেছে বা অন্যকোন অপরাধে জেলে।” রঞ্জিনীও সম্মত হলেন, “সেটাই হবে খুব সম্ভবত।” “এমনও তো হতে পারে যে স্টোনম্যান টাইম ট্র্যাভেল করে পাস্ট বা ফিউচার থেকে এসেছিলো – মার্ডারগুলো করেই ফিরে গেছে?” আবির এমন প্রশ্ন আশা করেননি। একটু থামলেন, খেতে খেতে। “টাইম মেশিন বাস্তবে থাকলে, সম্ভব।” “থিয়োরিটিক্যালি তো পসিবল।” “একদম। কিন্তু প্র্যাক্টিক্যালি তো করা গেল না এতোদিনও।” “কেন এইচ জি ওয়েলস?” আবির ঘাড় নাড়লেন। “ঠিক, তবে ফিকশন ওটা। এমন অন্য অনেক বিষয়েই ফিকশন আছে।” “তুমিই তো বলেছিলে নাইন্টিজে ভিডিও কলিং-কেও ফিকশন লাগতো।” আবির মৃদু হাসলেন, “তা ঠিক। তাহলে কী আরণ্যক মিত্র দ্যা সায়েন্টিস্টের ফিল্ড অফ ইন্টারেস্ট টাইম মেশিন?” রঞ্জিনী হেসে ফেললেন, “সায়েন্টিস্ট না ফিজিসিস্ট। বায়োলজির বি-ও পড়তে দেখি না কখনো।” “ওটা পড়তে লাগেও না। বাদ দাও।” “মানে!” “বাবা- টাইম মেশিন না। টাইম ট্র্যাভেল। জোহানের মতো।” আরণ্যক বলেই বুঝলো ভুল করে ফেলেছে। “জোহান? সে কে?” আবির তাকালেন। “ফিকশান। একটা ক্যারেক্টার।” “ওহ। নভেল? পি ডি এফ আছে? দিস তো আমায়।” “ওকে, বাবা।” আরণ্যক খেয়ে উঠে এলে রঞ্জিনী বললেন, “রাত জাগছে, পরপর ক’দিন।” “তাই?” “খুব চুপচাপ, চিন্তিতও লাগছে।” “মনের মধ্যে অনেক জিজ্ঞাসা জন্মেছে, সেই জন্যই। সিরিয়াসলি নিও না।” “সামনে ফাইনাল। ভাবছি যদি কাউন্সেলিং লাগে? টিন এজ প্রবলেমস্‌। জানোই তো।” আবির ভাবলেন একটু। তারপর বললেন, “আর ক’দিন দেখি। ওকে আমি কয়েকটা পি ডি এফ দেবো। টাইম ট্র্যাভেলের উপর। ও বাস্তবটা বুঝবে তাহলে। বড্ড কল্পনাপ্রবণ এখন।” “টিন এজে এটা হয়।” “পড়াশোনাটা হ্যাম্পারড না হলেই হলো।” আবিরকে একটু চিন্তিত লাগলো যেন।


আরো পড়ুন: তৃতীয় বর্ষপূর্তি সংখ্যা গল্প: শ্মশান-বন্ধু । প্রতিভা সরকার


      ঘুমটা হঠাৎ-ই ভেঙে গেলো আরণ্যকের। জাগলোও কানের মধ্যে “টিক-টক / টিক-টক” শব্দ নিয়ে। ঘড়িটার দিকে তাকালো-ও। সকাল ছটা বাজে। রাতে আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো আরণ্যক। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দুটো স্বপ্ন দেখেছে। একটা আজ ফিজিক্স টিউশান ব্যাচে এক্সামের খাতা দিয়েছে। শৌনক ফুল মার্কস পেয়েছে। আরণ্যক হাফ মার্কস কম। কোথায় নাম্বার কাটা গেছে স্যারকে জিজ্ঞাসা করেছে ও। স্বপ্নেই। স্যার পয়েন্ট আউট-ও করে দিয়েছেন, লাল পেন দিয়ে গোল করে। এমন স্বপ্ন দেখে না আরণ্যক। এক্সাম নিয়েও টেনশান করে না, ভুলে যায়। স্বপ্নে সবটাই খুব ডিটেলে দেখেছে। স্যারের চেক শার্ট, জিনস্‌, বাকি সব্বার জামার রং – সব। এখনো রি কল করতে পারছে। তারপরেই আর একটা স্বপ্ন শুরু হয়েছিলো। মাম্মা আর বাবা ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তারকে ও কখনোই দেখেনি এর আগে। মাম্মাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল, বাবাও বেশ অস্থির। তবে ওদের এখনকার চেহারা দেখেনি আরণ্যক। বেশ ইয়ং ওরা, দুজনেই। বেশ কয়েকবছর আগের দৃশ্য, “ভেবে বলছেন তো প্রফেসর মিত্র?” “হ্যাঁ একদম। আমার কোন আপত্তি নেই।” “ডক্টর রঞ্জিনী? যেহেতু আপনি ইনভলবড্‌ থাকছেন না…” “থাকতে তো চেয়েছিলাম ডক্টর। পারলাম কই? দেখছেনই তো বারবার…” “বেশ, তাহলে তাই হোক। সারোগেট মেয়েটিকে পেলেন?” “হ্যাঁ, পেয়েছি। অল্পবয়সী। ফিট। আমাদেরই পরিচিত।” “তা হলে তো মিটেই গেলো। পরবর্তীতে কোন সমস্যা হবে না তো?” “না, একদম না। আমাদের আত্মীয়ই হয়।” “এনেছেন তাকে?” “হ্যাঁ, মৃণাল – বৌমাকে নিয়ে আয় তো।” আরণ্যক চমকে গিয়েছিলো স্বপ্নের মধ্যে। মৃণাল ওর কাকা, বৌমা বলতে কাকিমা। কাকা-কাকিমা ওদের গ্রামে থাকে। কাকার মেয়ে মিঠাই দিদি ওর থেকে বছর তিনেকের বড়। কাকা তেমন পড়াশোনা করেনি। গ্রামে থাকে। গ্রামে ওদের জমিজমা দেখাশোনা করে। কাকা কাকিমা দিদি কেউই তেমন আসে না কলকাতায়। কালেভদ্রে ওরা গ্রামে গেলে দেখা হয়। ডাক্তারের চেম্বারে কাকা কাকিমা কেন – অবাক হয়েছিলো আরণ্যক। কাকিমা চেম্বারে ঢুকতে যাবে তখন ভেঙে গেলো স্বপ্নটা। ঠিক স্বপ্ন না, এটাও খুব ভিভিড আর ডিটেইলসে দেখেছে আরণ্যক। যেন ও ওখানেই ছিলো, নিজের চোখে দেখেছে সবটা। “টিক-টক / টিক-টক” তার মানে কি ঘুমের মধ্যে টাইম ট্র্যাভেল করলো আরণ্যক। কে করালো? নাকি সব ওর অতিরিক্ত ভাবনা? ট্র্যাভেল যে করবে – মেশিন কই? নাকি ওর ব্রেন কেউ দখল করে নিয়েছে? রিমোর্ট কন্ট্রোলে চালাচ্ছে? সেই টাইম ট্র্যাভেল করাচ্ছে ওকে? সেটা কী করে সম্ভব! ও তো কেবল একটা সিরিজই দেখেছে। তাহলে কে করছে এটা? এসি ঘরেও ঘামছে, বেশ বুঝতে পারলো আরণ্যক।

        দে জ্যাঁ ভ্যু। কথাটা আগে শুনেছে আরণ্যক। আজ ফিল করলো, ফিজিক্স টিউশনে গিয়ে। স্যার যখনই খাতা দিলেন। এতোক্ষণ স্যারের চেক শার্ট-এর একই রং আর একই রং-এর জিনস্‌ দেখেও মনকে প্রবোধ দিয়েছিলো আরণ্যক। কিন্তু খাতার রেজাল্টও তো এক। শৌণক ফুল মার্কস, আরণ্যক হাফ মার্কস কম।ভুল কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই স্যার ঠিক একইভাবে লাল পেন দিয়ে গোল করে দেখালেন। গোলটাও ঠিক একরকম দেখতে। আরণ্যক এতোটা অবাক জীবনে হয়নি। স্বপ্ন – শুধু স্বপ্ন বলে এর ব্যাখ্যা করবে কী করে? তাহলে অতীতের যে দৃশ্যটা দেখেছে, সেটাও স্বপ্ন নয়? যদি বাস্তব হয়, তাহলে কী বলতে চাইছে? মাম্মা-বাবা, কাকা-কাকিমা সবাই ডাক্তার খানায়। কেন? কাকে জিজ্ঞাসা করবে কথাটা?

        আরণ্যক নিজের পড়ার টেবিলে বসেছিলো। মন বসছিলো না। দে জ্যাঁ ভ্যু নিয়ে অনেক গুগুল করেছে ও। প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়েও। সবচেয়ে বেশি যে সম্ভাবনা ওর মাথায় আসছে তা হলো প্যারালাল ইউনিভার্সের আরণ্যক হয়তো ওর খুব কাছেই আছে। হয়তো সে এই ইউনিভার্সে এসেছে। এসে আরণ্যককে দেখেছে এবং আরণ্যককে অনেককিছু দেখাতে চাইছে। এই কথাটা আর যে কাউকে বললেই সে হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু আরণ্যক ওড়াতে পারছে না। সারোগেট শব্দটা নিয়েও অনেকটা পড়েছে ও আজ। বায়োলজি পড়ে না বলে জানতো না শব্দটা। মানেটা জেনে থেকে ভীষণ অস্থির লাগছে নিজেরই। কাকিমাকে উদ্দেশ্য করে ডাক্তার বলছেন, “সারোগেট”। কাকে ক্যারি করছে কাকিমা? মিঠাই দিদিকে? তাহলে কাকিমা মিঠাই দিদির মা না? মাম্মাকে কেন বললো যে মাম্মার ইনভলভমেন্ট থাকছে না? মাম্মা – কি… ভাবতে ভাবতেই মাম্মার গলার আওয়াজ পেলো আরণ্যক। আজ ফিরে এসেছে তাড়াতাড়ি, মাম্মাকে কি জিজ্ঞাসা করবে কথাটা?

        মাম্মা আজ ওর জন্য চিকেন সিক্সটি ফাইভ এনেছিলো। আরণ্যক পছন্দ করে খেতে। পড়ার টেবিলে ওর পাশে বসলো মাম্মা। ওর পিঠে হাত রাখলো। “কী ভাবছিস্‌ এতো?” “নাথিং, মাম্মা বায়োলজির কিছু কিছু জায়গা বুঝছি না, বলে দেবে?” রঞ্জিনী খুশি হলেন, “অফকোর্স। তুই তো এক্সামের আগে ছাড়া বায়োলজির বই ধরিস না, আজ হঠাৎ?” আরণ্যক বিরক্ত হলো, “দেবে কি না বলো, নাহলে নিজেই পড়ে নিচ্ছি।” রঞ্জিনী বুঝলেন মুড সুইং হচ্ছে আরণ্যকের। “বেশ, দিচ্ছি। বল কোন চ্যাপ্টার।” প্রথমেই সারোগেট নিয়ে জিজ্ঞাসা করা যাবে না, জানে আরণ্যক। তাই অন্য একটা চ্যাপ্টার খুলে দিলো। মাম্মা মুচকি হাসলো, “রিপ্রোডাকশন?” আরণ্যক তাকিয়ে দেখলো, শিট! হাতের কাছে যেটা পড়েছে খুলে দিতে গিয়ে রিপ্রোডাকশনটাই খুলে দিয়েছে! এটা তো বায়োলজির ম্যামও ওদের পড়াননি। স্যার পড়িয়েছেন। সারা বই জুড়ে অনেকরকম ছবি আছে। মাম্মার সামনে এসব… না, না। চ্যাপ্টারটা চেঞ্জ করে দেবে আরণ্যক। “না, ভুল করে খুলে গেছে এটা, সরি।” মাম্মা আরণ্যকের মাথায় হাত রাখলো, “সরি কেন?” “এটা স্যার পড়িয়েছেন, ম্যাম পড়াননি। এটা আমি পড়ে নেবো মাম্মা।” রঞ্জিনী বুঝলেন স্কুলে জীবনশৈলী চর্চা ঠিক ভাবে হচ্ছে না। ওনাকেই এগিয়ে আসতে হবে। “ম্যাম কেন পড়ায়নি? আর মাম্মা-কে কেন এড়াতে হবে এটা? ওরা মেয়ে বলে? মেয়েদের সামনে বলা যায় না? কোন কথা?” আরণ্যক মাথা নিচু করলো। ডার্কের প্রথম সিনটা মাথায় এলো, মার্থার বাবা আর জোহানের মা ওদের চিলেকোঠার ঘরে… বারবার রিওয়াইন্ড করে সিনটা দেখেছে আরণ্যক। একটা অদ্ভুত ভালো লাগছিলো। বারকয়েক দেখেই আবার গিল্টি ফিল করছিলো ও। এটা ওর দেখার কথা নয়, তাও দেখে ফেলেছে। বন্ধুদের সাথে কথা বলে বুঝেছে এটা কোন বিগ ডিল না, সবাই দেখেছে। অনেকে তো নিয়মিত দেখে, পর্ণ। কিন্তু আরণ্যকের কোথায় যেন খারাপ লাগে মাম্মাকে, বাবাকে লুকানোয়। বন্ধুরা কিছু সাইট সাজেস্ট করেছে ওকে। কিন্তু ও সেগুলো দেখেনি কখনো।

        রঞ্জিনী বুঝলেন আরণ্যকের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। ছোট থেকেই সমস্ত কিছু খোলামেলা ভাবে বুঝিয়েছেন রঞ্জিনী। গুড টাচ, ব্যাড টাচ থেকে শুরু করে প্রাইভেট পার্টসের প্রাইভেসি অবধি। এবার আরো কিছু ধাপ উপরে উঠতে হবে। রঞ্জিনী পিছপা হলেন না। যতটা সহজ করে, আরণ্যকের বোঝার মতো করে পারেন বুঝিয়ে দিলেন বিষয়টা। উদাহরণ দিয়ে, ধাপে ধাপে। “এবার বোঝা গেলো?” “ইয়েস মাম্মা।” “বুঝিসনি যখন স্যারকে বলিসনি কেন?” “স্যার অত ডিটেলে যাইনি তো। জাস্ট নেমস্‌গুলো – ইউ নো।” “ইয়েস, আই নো। এটাই সমস্যা সব স্কুলের, এই বয়সেই সব বোঝাতে হয়। ডিটেলে। না হলে গ্যাপস্‌ থেকে যায়।” “থ্যাংকস্‌ মাম্মা। একটা কোয়েশ্চেন করবো?” “হ্যাঁ, কর না।” “সারোগেসি কী? আর সারোগেট?” মাম্মা কিছুক্ষণ থমকে গেলো যেন। তারপর বললো, “বই-এ পেলি?” “না- একটা মুভিতে। সিরিজ…” “ওহ। যখন কোন মা বাচ্চা ক্যারি করতে পারে না বা চায় না – তখন অন্যকোন ফিমেলের ইউটেরাসে এমব্রায়ো আইমিন বেবিটাকে রেখে দেওয়া হয় ন’মাস। তারপর বেবিটা জন্মালে আসল বাবা-মা নিয়ে নেয়।” “যে ক্যারি করলো সে-ই তো আসল মা – মাম্মা?” আরণ্যকের প্রশ্নে রঞ্জিনী আবারও স্তব্ধ হল। কিছুক্ষণ পর গুছিয়ে নেন নিজেকে, “বায়োলজিক্যালি তো না। যার ওভাম আছে সেই আসল মা। বায়োলজিক্যাল মাদার। আর যে ক্যারি করলো সে সারোগেট।” “ওহ। ক্যারি করা খুব ইজি, মাম্মা?” রঞ্জিনী সত্যিটা লুকালেন না, “নাহ। ভেরি টাফ। অনেকেই পারে না তাই।” “তাহলে সারোগেট তো কষ্টটা করলো, না? সে-ও তো মা, তাই না, মাম্মা?” রঞ্জিনী আরণ্যকের মাথায় হাত রাখলেন, “তাও ঠিক। আমি একটু আসছি। তুই চ্যাপ্টারের কোয়েশ্চেনগুলো দেখে রাখ।” আরণ্যক স্পষ্ট দেখলো মাম্মার চোখে জল। মাম্মা চোখ মুছবে বলে উঠে চলে গেলো। সারোগেট ইস্যুটা কষ্ট দিলো মাম্মাকে। কিন্তু কেন? তাহলে কি কাল রাতের অতীতের দৃশ্যটা যেটা ও টাইম ট্র্যাভেলের মতোই স্পষ্টভাবে দেখেছে, সেটা ঠিক? মিঠাই দিদি কি তাহলে মাম্মার মেয়ে? কাকিমা সারোগেট মাত্র? আরণ্যকের কানে আবারো বেজে উঠলো, “টিক-টক / টিক-টক।”

        আবির রঞ্জিনীর কথায় অবাক হলেন, “রিপ্রোডাকশন, আই মিন, ক্লাস এইটের রিপ্রোডাকশন পড়তে পড়তে সারোগেসি কী জিজ্ঞাসা করলো?” “হ্যাঁ।” “স্ট্রেঞ্জ।” বায়োলজি নিয়ে তো মাথা ঘামায় না একদম। হঠাৎ করে এটা মাথায় এলো কেন?” রঞ্জিনী ডিনারের পর নিজেদের বেডরুমে আবিরের মুখোমুখি বসেছিলেন, “কেন জানি না। তবে ওর কৌতূহলটা যেন মাত্রা ছাড়া ছিলো। যেন ও ডেফিনিট কিছু জানে।” আবির মাথা নাড়লো “একটু বেশিই ভাবছো, ও জানবে কী করে?” “কেউ বলে দিলে? মিঠাই… ও তো জানে সব। ছোট হলেও মনে থাকবে ওর। আরণ্যকের ফেসবুকেও আছে।” “রঞ্জিনী – কাম ডাউন। মিঠাই বলবে না। ভীষণ ভালো মেয়ে ও। মাধ্যমিকে স্টেটে র‍্যাঙ্ক করলো – দেখলে না? এখন ইলেভেন। ওর এসবের সময় নেই। ডাক্তার হতে চায় ও। বড়মার মতো। মনে নেই? তোমাকে আইডল ভাবে মেয়েটা, এমন করবে?” রঞ্জিনী লজ্জিত হলেন, “সরি। আসলে ওর প্রশ্নভরা চোখদুটো তুমি দেখোনি আবির। অ্যাজ ইফ ও সবটা জানে। সব নিজে চোখে দেখেছে। জেনেই ওর এত প্রশ্ন।” “এটা তোমার গিল্ট রঞ্জিনী। আর কিছুই না। গেট রিড অফ ইয়োর গিল্ট। ঘুমিয়ে পড়ো।” দরজায় নক শুনে তাকালেন আবির। রঞ্জিনীও চোখ মুছলেন। আরণ্যক এলো ঘরে। আবিরও দেখলেন বেশ অবিন্যস্ত লাগছে ওকে, “কী রে? কিছু বলবি?” আরণ্যক বলতে এসেছিলো মাম্মা কি বাবা কেউ একজন যদি ওর সাথে শোয়। নাহলে “টিক-টিক / টিক-টিক” আওয়াজ ওকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। যে আওয়াজটা করছে সে খুব কাছে আছে যেন, “নাহ- জলের বোতলটা?” রঞ্জিনী বললো, “ফ্রিজে আছে, চল্‌ দিচ্ছি।” “আমি নিয়ে নিচ্ছি, মাম্মা। গুডনাইট।” মাম্মা আর বাবাকে কিছু বলবে না ও। ওরা ওর মনের কথাটা বোঝেই না। ও বলে কি করবে, তাহলে?

        নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো আরণ্যক। ঘুমটা গভীর হতে না হতেই টের পেলো ওর পাশে কেউ এসে বসেছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো আরণ্যক। যে বসেছে সে আর কেউ না, ও নিজে। চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলো ওই আরণ্যক মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বললো, “কে তুমি?” “আরণ্যক।” “মানে?” “মানে যাকে তুমি এতোক্ষণ গুগুল করে খুঁজছিলে।” “প্যারালাল ইউনিভার্স?” আরণ্যক ভাবলো এটাও স্বপ্ন। চিমটি কেটে দেখলো নিজেকে। নাহ লাগছে। “কোথায় থাকো তুমি?” “আমি? আমি ডেল্টাতে থাকি। ওখান থেকে তোমাদের এখানে আসার জন্য বেশ লাইন পড়েছে এখন। এডুকেশনাল ট্যুর।” “আমাদের এখানে…” “আমরা আর্থ বলি। তোমাদেরইউনিভার্সেরএই প্ল্যানেটটাকে। আমাদেরটাও আর্থ কিন্তু আদরের নাম ডেল্টা।” “এডুকেশনাল ট্যুর, মানে?” “টাইম ট্র্যাভেল। ওটা লিগাল আমাদের ওখানে, বেশ কয়েক বছর।” “টাইম মেশিন আছে তোমাদের?” “দিব্যি আছে। আমিই গেছি, অতীতে, ভবিষ্যতে। এবার প্যারালাল ইউনিভার্সে ট্রাই করলাম। ন্যাশানাল স্কলারশিপ পেয়েছি যে, ফিজিক্সে। নাহলে আমাদের মতো গরিব ফ্যামিলি থেকে পসিবল ছিলো না গো।” “গরিব? ওখানে আমরা আই মিন তোমরা বড়লোক না?” ঐ আরণ্যক হাসলো। “নাহ গো, আমি গ্রামে থাকি। তুমি যাদের এখানে কাকা-কাকিমা বলো – তারা আমার মা-বাবা। চাষবাস করেন। আর তোমার মিঠাই দিদি শহরে থাকে, তোমার এই মাম্মা-বাবার মেয়ে। আমি স-ব দেখেছি এখানে এসে। তোমাদের এই প্ল্যানেটের গ্রামটাও অনেক বেশি সুন্দর, সবুজ। ওখানে বড্ড বেশি রেডিয়েশন।” “মিঠাই দিদি সারোগেসিতে জন্মেছে, না?” আরণ্যক প্রশ্ন করলো। ঐ আরণ্যক ওর হাত ধরলো। “কই না তো।” “তাহলে ঐ স্বপ্নটা? কাল রাতে?” “স্বপ্ন কোথায়? টাইম ট্র্যাভেল। মাইন্ড ট্র্যাভেলও বলতে পারো। আমি করিয়েছি তোমাকে। তোমার ব্রেনকে কন্ট্রোল করে।” “কীভাবে?” “আসলে তুমি ডার্ক দেখছিলে এটা আমি দেখেছিলাম লুকিয়ে। তোমার মনে টাইম ট্রাভেল করার ইচ্ছা জন্মেছে এটা বুঝতে পেরেছিলাম। সেইজন্যই একটু মাইন্ড ট্র্যাভেল করিয়ে দিলাম।” “কীভাবে? দেখাও না।” “দেখবে? ওয়েট। চোখ বন্ধ করো। আর আমার উপর ভরসা রাখো।” আরণ্যক তাই করলো। যেন ঘুমিয়ে পড়লো ও। গভীর ঘুমে।

        অতীতে গিয়ে চোখ খুললো ওর। একটা হাসপাতাল এটা। অপারেশন থিয়েটার। মাম্মা-বাবা-কাকা সব্বাই দাঁড়িয়ে। মিঠাই দিদি মাম্মার কোলে। আড়ালে লুকিয়ে পড়লো আরণ্যক। সেই ডাক্তারবাবু ওটি থেকে বেরিয়ে এলেন। “কনগ্র্যাচুলেশানস্‌। ইটস্‌ আ বয়।” বাবা লাফিয়ে উঠলো প্রায়। রঞ্জিনী বলেছিলাম না – ছেলেই হবে, নামও তো ঠিক করে রেখেছি, আরণ্যক।” চমকে উঠলো আরণ্যক। অতীতটা তাহলে ওর জন্মের দিন। কাকা ক্ষীণস্বরে বললো, “ আমার স্ত্রী ঠিক আছে তো…” “ঠিক আছেন। খুব খুশি উনি, ছেলে হয়েছে।” আরণ্যকের পৃথিবী দুলে উঠলো যেন। তাহলে ও কি মাম্মা-বাবার ছেলে না? কাকা কাকিমার ছেলে, ঐ আরণ্যকের মতোই?

        ভাবতে না ভাবতেই আর একটা দৃশ্যে চলে এলো ও। কাকা আর বাবা কথা বলছে। ওদের ফ্ল্যাটেরই বাইরের ঘরে, “মৃণাল বৌমাকে বল জেদটা ছাড়তে, বাচ্চাটা আমাদের।” “জানি দাদা। কিন্তু মেয়েমানুষের প্রাণ। মা-ও। জন্ম দিয়েছে। যতোই তোমরা বায়োলজিক্যাল আর সারোগেট কিসব বলো – ছয় মাস ওর বুকের দুধই তো খেলো। হঠাৎ ছাড়বে কী করে?” আরণ্যকের চোখে জল চলে এলো। মিঠাই দিদি না – আরণ্যকই সারোগেসিতে জন্মেছে। আর ওর জন্মদাত্রী মা কাকিমার থেকে ওকে আলাদা করতে চাইছে বাবা। মাম্মা ঘরে এলো তখন, “দেখো মৃণাল, এই সব নাটক বন্ধ করো। টার্মস্‌ এন্ড কন্ডিশনস্‌ তুমি সব জানতে। তবে? তোমাকে আমরা পাঁচ লাখ দিয়েছি, চাইলে আরো দেবো। তোমার বউকে বোঝাও, ছেলেটা আমার। আমার ওভাম আর আবিরের স্পার্মে জন্ম ওর। কেউ ন’মাস ক্যারি করেই মা হয়ে যায় না।” কাকা হাসলো, “কিন্তু ক্যারি না করলে তোমার মা হওয়ার সাধটা তো মিটতো না বৌদি।” “কী চাও, বলো?” “সঠিক দাম। পাঁচ লাখেই দাদা হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে। তুমি বোঝাও।” বাবা কথা বললেন এবার, “বেশ। আরো পাঁচ। এবার বৌমা আর মিঠাই-কে নিয়ে চলে যা। আর কোনদিন আসবি না।” কাকা অদ্ভুত ভাবে হাসলো, “আসবো না। কিন্তু মিঠাই-এর পড়াশোনা আর বিয়ের খরচ তোমার। কাগজে লিখে দাও আগে।” আরণ্যক আর দেখতে পারছিলো না। ওকে নিয়ে দরদাম করছে সবাই। বাবা-কাকা-মাম্মা। ও যেন একটা কমোডিটি। বস্তু একটা, মানুষ না।

        আবারো একটা নতুন দৃশ্য খুলে গেলো ওর চোখে। ওদের গ্রামের বাড়ি। দু’একবার গেছে আরণ্যক। কাকিমা দাওয়ায় বসে মিঠাই দিদিকে কোলে করে ভাত খাওয়াচ্ছে।“ভাইটাকে ও বাড়ি রেখে এলে কেন মা?” “জ্যেঠু বড়মা চাইলো যে, ওদের তো ছেলে নেই।” “কিন্তু ও তো আমার ভাই। তোমার পেটে ছিলো।” কাকিমা চোখ মুছলো, “মিঠাই, এসব কথা কাউকে বলবে না, কেমন? বড়রা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেখছোই তো।” “আচ্ছা। তাহলে তুমি আর ভাইয়ের জন্য কাঁদবে না, বলো?” “কে বললো আমি কাঁদি – বোকা মেয়ে?” “কাঁদো তো, আমি দেখি। রোজ রাতে কতো কাঁদো।” আরণ্যকের চোখে জল চলে এসেছিলো। মনে হচ্ছিলো ছুটে গিয়ে কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে, মা বলে ডাকে। “কাঁদব না। আর তোর ভাই ঠিক একদিন আমাদের কাছে আসবে – দেখিস। এসে মা বলে ডাকবে আমায়…”

        হঠাৎ-ই ঘুম ভেঙে গেলো আরণ্যকের। ঘুম না, ঘোর বলা ভালো। টাইম ট্র্যাভেলের ঘোর। চোখ খুলে দেখলো নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। ঐ আরণ্যক আর নেই। ভোর হতে যাচ্ছে। পাশ ফিরতে গিয়ে ভারি অবাক হলো। মাম্মা ওর পাশে বসে আছে, মাথায় হাত বোলাচ্ছে। “মাম্মা…” “এই তো। ঘুমের ঘোরে মা-মা করছিলি। আমি শুনতে পেয়ে চলে এলাম।” আরণ্যক বুঝলো, মা-ও কাকিমাকে বলছিলো। মাম্মা-কে না। কিন্তু মাম্মা তাও ঠিক শুনতে পেয়ে চলে এসেছে। আর মাম্মা এসেছে বলেই ওই আরণ্যক চলে গিয়েছে। “সবে পাঁচটা বাজে, ঘুমো।” “ওকে, মাম্মা।” “ঘুমের মধ্যে মা’কে ডাকিস, আর মা এলে বলা যায় না আমার পাশে শোও? এতো দ্বিধা? এতো লজ্জা?” “তুমি শোবে?” “একদম। সরে শো তুই।” আরণ্যককে অবাক করে ওর পাশে শুয়ে পড়লো মাম্মা। “জ্বর জ্বর ভাব গায়ে। আজ স্কুল না। আমিও ছুটি নেবো আজ। সারাদিন তোর সাথে থাকবো।” আরণ্যককে কোলের মধ্যে টেনে আনলো মাম্মা। ওর কপালে চুমু খেলো, চোখ মোছালো। মাম্মা আজ না বলতেই আরণ্যক কী চায় ঠিক বুঝে ফেলেছে। এমন তো মায়েরাই বোঝে। তাহলে আরণ্যক কী করে ভাববে মাম্মা ওর মা না? মা ছাড়া কেউ এভাবে আগলে রাখ, এতোটা বোঝে?” “মাম্মা-” “বলো।” মাম্মা ওকে আদর করছিলো। “অ্যানুয়াল হলে আমাকে একবার গ্রামে নিয়ে যাবে?” মাম্মা চুপ করে থাকলো। “প্লিজ, মাম্মা।” একটাবার কাকিমার কাছে যাবে ও। সব্বার নজর এড়িয়ে একবার কাকিমাকে জড়িয়ে ধরবে। “মা” বলে আসবে একবার। শুধু একটাবার। এই জন্যই ঐ আরণ্যক ওকে সবটা দেখিয়েছে। এটা করবেই ও। “বেশ, যাস্‌। অ্যানুয়াল কেন – এই উইকএন্ডেই যাওয়া যায়।” আরণ্যক খুব খুশি হল, “সত্যি?” “সত্যি। সারাদিন এই একঘরে বসে তোর কষ্ট হয়, বুঝি। বাবাকে বলছি। এই উইকএন্ডেই যাব গ্রামে। একদিন থেকেও আসবো।” আরণ্যক মাম্মা-কে হঠাৎ করে চুমু খেলো একটা। মাম্মার উপর কোন রাগ নেই ওর। থাকবেই না কেন? মাম্মাও তো ওর মা। মাম্মা আরণ্যকের খুশির পরিমাপ করতে পারলো। “এতো খুশি? আগে বলতে কী হয়েছিলো? তাহলে আগেই ঘুরে আসতাম আমরা।” “এখন বললাম তো।” বাবার গলা পেয়ে চমকে উঠলো আরণ্যক, “রঞ্জিনী – কি আব্দার করেছে তোমার ছেলে?” আবিরের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো অনেকক্ষণ। রঞ্জিনী ছেলের ঘরে বুঝেই এলেন এখানে, “গ্রামে যাবে। উইকএন্ডে।” আরণ্যক  বাবার দিকে তাকালো, বাবার কোন কাজ থাকলে যাওয়া হবে না। “তা বেশ তো। আমিও যাবো, সবাই মিলে যাওয়া হবে। আমারও কদিন মনটা টানছিলো যেন।” আবির বললেন, “এবার সরে শোও। আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই, তোমাদের সাথে।” রঞ্জিনী খাটের অন্যপাশটা দেখিয়ে দিলেন, “ওপাশে যাও। ছেলেকে পাবে।” আরণ্যককে অবাক করে দিয়ে আবির তাই করলেন। আরণ্যকের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন, “রঞ্জিনী – বলেছিলাম না এতোটা চিন্তার কিছু নেই। যতটা ভাবছো – ততটা বড় হয়নি তোমার ছেলে।” রঞ্জিনী কিছু বললেন না। আরণ্যককে চুমু খেয়ে বললেন, “ঘুমো।” আরণ্যক চোখ বুজলো, ও যা জানলো – কাউকে কিচ্ছু বলবে না। না মাম্মাকে না বাবাকে, কষ্ট পাবে ওরা। শুধু একটাবার কাকিমার কাছে যাবে, মা বলে ডাকবে, নাহলে শান্তি পাবে না। ঐ আরণ্যকও তাই চায়, সেইজন্যই সত্যিটা দেখিয়ে গেলো ওকে। ওদের প্ল্যানেট সত্যি অনেক এগিয়ে। ওদের আর্থ, ডেল্টা। যেখানে কেবল সত্যিই থাকে। “টিক-টক / টিক-টক” আওয়াজটা আর কানের মধ্যে হচ্ছে না। কী অদ্ভুত! ঐ আরণ্যক কি ফিরে গেছে? ওদের ডেল্টায়? ওদের প্যারালাল ইউনিভার্সে?

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত