ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-১৯) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-১৯।
দুদিন বাদেই নির্ঝর হাজির। মোট কথা আবার স্কুল, খেলাতে ফিরে এসেছে নির্ঝর। স্যার মুখে একটু চোটপাট করলেও দারুন খুশী। আর দুদিন পর ম্যাচ। আর ম্যাচটাও ভাইটাল। তাদের জিততে হবেই। তবে মন্মথনাথ হাই স্কুলের টিমও খারাপ নয়। কিন্তু নির্ঝর আসায় স্যারও কিছুটা ভরসা পাচ্ছেন।
বিকেলবেলায় আজকাল জোরদার প্র্যাকটিশ হচ্ছে। ইন্দ্রদা কোনভাবে তার কাজের জায়গা ম্যানেজ করেছে। মাঠে রোজ সময় দিতে পারছে।
বিকেলে তাড়াতাড়ি মাঠে পৌছাল রাজ।
মাঠে ইন্দ্রদা হাজির, রীতিমত গোল প্র্যাকটিশ শুরু করে দিয়েছে দু-একজনকে নিয়ে। রাজ তাড়াতাড়ি পোষাক পরে নামল।নির্ঝর আসে নি এখনো। ইমনরা বসে আছে। ওর মুখ গম্ভীর। সে কথা বলব না বলব না করেও সে বলল, “কিরে চল?”
ইমন হঠাৎ বলল, “এটা কিন্তু স্যার ঠিক করছেন না।“
“কি?
“নির্ঝরকে কেন খেলায় নেবে এতদিন আবসেন্ট ছিল তবু ছাড় দিল কেন?”
রাজ ওর রাগের কারণটা বুঝল। নির্ঝর আসায় ওর ভালো লাগে নি। সে একটু চিন্তায় পড়ে গেছে। যদি তাকে স্যার বসিয়ে দেয়। সে উন্মনা হয়ে ভাবল কিছুক্ষন। ইমন ভুল বলছে না। তারা কামাই করলে স্যার রীতিমত খেলায় বসিয়ে দেবার ভয় দেখান। নির্ঝরের বেলায় তা হয় নি।কিন্তু এটাও ঠিক নির্ঝরের ব্যাপারটা অন্যরকম। সে মাথা চুলকে বলল, “ দ্যাখ। ও নিজের ইচ্ছে যায় নি। ওর জেঠু ওকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।“
ইমন রাগ করে বলল, “সে যেখানে খুশি যাক। স্যার তাও ওকে নেবেন?”
রাজ ওর দিকে তাকাল।ওর রাগ কমানোর উপায় তার হাতে নেই। যদি থাকত সে ব্যবস্থা করত। ইমন যে করে হোক পরের ম্যাচটা খেলতে চায়।কিন্তু ওর চান্স খুব কম, নির্ঝর আসার পর একবারে নেই বললেই চলে। রাজ নিজেও এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। যদি এমন সুযোগ থাকত তাহলে সে নিজের জায়গা ছেড়ে ইমনকে খেলতে বলত। সে বলল, “স্যারকে বল তাহলে।“
“বলব তো। এটা ঠিক নয়।“
সে বলল,”বল।“
“তখন তো আবার ওকে সাপোর্ট করবি? আমি বলব তুই থাকবি আমার সাথে?”
রাজ মাথা ঘোরাল। মাঠের একদম কর্নার দিয়ে নির্ঝর ঢুকছে।তার দিকে চেয়ে হাত নাড়ল। সে ইমনকে একবার দেখল। তার খারাপও লাগে। একই কথা কতদিন ধরে যে ও বলে যাচ্ছে। সে বলল, “ছাড় ওসব। মাঠে চ।আরে । ভাল করে খ্যাল।তুইও চান্স পাবি।“ স্যার তো সুযোগ দিচ্ছেন।
“বলছিস?”
আপাতত ঠান্ডা করার জন্য সে বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ।খেল না মন দিয়ে।“
ইমন বলল, “হুম।“
গোলপোষ্টের ধারে পৌছে গেল রাজ।একটা বল রিসিভ করতে করতে ইন্দ্রদা বলল, “অনেকক্ষন এসেছিস। তাড়াতাড়ি নাম।“
“নামছি।“
নির্ঝর ইতিমধ্যে গোল প্র্যাকটিশে চলে গেছে। সে বল মারতে শুরু করেছে। ওর বল মারার গতির দিকে তারা সবাই অবাক হয়ে যায়। সত্যিই ওর পায়ে অস্বাভাবিক জোর। ওই রোগা চেহারায় এত জোর পায় কি করে কে জানে?তাছাড়া শুধু জোর বলে নয়, ওর প্রত্যেক বলে সুইং আছে। কোনদিকে যাবে তা ইন্দ্রদার মতো গোলকিপার বুঝতে পারে না। গত পরশু ও ফেরার পর ইন্দ্রদা নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরেছিল।বলেছিল, “ আরে? কোথায় গেছিলিস ভাই? জানিস রামলাল স্কুল আমাদের হারিয়ে দিল।তুই থাকলে আমার চিন্তা হত না। যাই হোক পরের ম্যাচটা কিন্তু জিততেই হবে। বুঝলি।“
নির্ঝর মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল।
ইন্দ্রদা বলেছিল, “তুই কোথায় গেছিলিস?”
“আসানসোল।“
“কে আছে ওখানে?”
“মামাবাড়ি।“
“ও।যাই হোক এখন আর যাস না কোথাও।“
একটু পরে খেলা শুরু হল।রাজের ধারনা এবার তাদের টিম জোরদার হবে। স্যার তো আছেনই কোচিংএ ।তার উপর স্যার তাদের প্র্যাকটিশ করার জন্য তীর্থজেঠুকে ব্যবহার করছেন। তিনি এজন্য হেডস্যারের কাছে পারমিশন নিয়েছেন। হেডস্যার শুনেই একপায়ে রাজি। তিনি বলেছেন, “তীর্থবাবু এলাকার গর্ব।তিনি যদি আমাদের সাহায্য করেন খুব ভাল।“ পারমিশন পাওয়ার পর স্যার তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তীর্থজেঠুও নেমে পড়েছেন তাদের প্র্যাকটিশে। তবে কথা কম বলেন।
আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-১৮) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
তবে আজ আবার দায়িত্ব ইন্দ্রদার। স্যার আজ বেশিক্ষন থাকলেন না। তীর্থজেঠুও দুএকদিন আসছেন না। ইন্দ্রদা দুটো টিম করে দিল। ইমন অবশ্য প্রথম থেকেই বেগড়বাঁই করতে শুরু করল।ও নির্ঝরের দিকে থাকবে না। ইন্দ্রদা শেষে তাই করল। খেলা চালু হবার পর রাজ বুঝল ইমনের উদ্দেশ্য। আজ স্যার নেই। তাই সু্যোগ পেলেই নির্ঝরকে কড়া ট্যাকল করার চেষ্টা করছে। নির্ঝর বুদ্ধিমান। সে ঠিক ওকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। খেলা শেষ হতে রাজ স্বস্তি পেল। ইমন একবারও নির্ঝরকে ছুঁতে পারে নি। সে খেললও রাজার মত। তাকিয়ে দেখবার মত।
খেলা শেষ হবার পর দুজনে বাড়ি ফেরার জন্য উঠল। এরপর বাড়ি ফিরেই প্রাইভেটে পড়তে যেতে হবে। সে বলল,“চ রে। তুই কি আজকে যাবি পড়তে?”
নির্ঝর বলল,“স্যার যদি কিছু বলেন?”
নির্ঝর ক্লাস এইটের প্রথম সারির ছেলে। স্যাররা তাকে এমনিতেই ভালবাসেন। কিন্তু এতদিন যায় নি বলে স্যাররা রাগ করতে পারেন।সে বলল,“না। না। কিছু বলবে না চ।“
“আচ্ছা।সৌম্য। কাকিমাকে বলেছিস আমি ফিরেছি?”
“হ্যাঁ।“
“বলিস আমি একদিন দেখা করতে যাব।“
রাজ বলল, “তুই ঠিক কোথায় গেছিলিস বল তো?”
“বলেছি তো মামার বাড়ি।”
“কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ চলে গেলি?”
নির্ঝর বলল, “হঠাৎ একদিন জেঠু আমাকে দিয়ে এল। আমি ভাবলাম ভালোই হল মা মারা যাবার পর কোনদিন ও বাড়ি যায় নি। ভাই-বোনও আছে।“
“তারপর?”
“মামা-মামী এমনি খুব ভাল ।ওখানে বেশ ছিলাম। এখন অবস্থা খুব ভাল মামার। বলল, ওখানেই স্কুলে ভর্তি করে দেবে। জেঠুরও সুবিধা হল।“
“তাহলে ফিরলি কেন?”
নির্ঝর বলল, “কি জানি! জেঠু যেমন রেখে এসেছিল তেমনই একদিন আবার মামাবাড়ি গেল। গিয়ে বলল আমার কিছু ভাল লাগছে না। তুই ফিরে চ।“
রাজ আশ্চর্য হয়ে বলল,“বাবা! তাই নাকি! তোর জেঠু পালটে গেল নাকি!”
“কি জানি? তবে আমার মনে আছে রে জেঠু কিন্তু খারাপ ছিল না। আগে আমাকে খুব ভালবাসত। তারপর কাজটাজ ভাল না করার জন্য কেমন বিগড়ে গেল। তবে এখন আবার জেঠু খুব ভাল ব্যবহার করছে।“
রাজ হাসে। এর পেছনে যে তার মা আছে সে জানে।সেদিন আসার পর থেকে মা বঙ্কুজেঠুকে ফোন করে বারবার বুঝিয়েছেন। নির্ঝরকে ফিরিয়ে আনবার জন্য। জেঠু মায়ের কথা ফেলতে পারেন নি। সে অবশ্য কথাটা বলল না। বরং ওকে বলল,”তুই কিন্তু পালটে গেছিস।“
“আমি?”
“হ্যাঁ।“
“তাই?কি রকম?”
“আগে এত কথা বলতিস না।“
নির্ঝর হাসে।
রাজ বলে, “তুই স্বার্থপরও আছিস। ওখানে গিয়ে একবারও তোর আমাদের কথা মনে পড়ে নি? না?“
তার হাত দুখানা চেপে নির্ঝর বলল, “না রে। খুব মনে হয়েছিল তোর কথা।কাকিমার কথা।“
রাজের চোখ উজ্জ্বল হল। সে বলল, “ ঠিক আছে। এবার চ।দেরী হয়ে যাবে।“
“আচ্ছা।“
নির্ঝর চলে গেল। ওকে বিদায় জানিয়ে রাজ প্যাডেলে চাপ দিল। খুব খিদে পেয়েছে তার। তাড়াতাড়ি না গেলে তাকে না খেয়েই টিউশুনি যেতে হবে।এগোতে না এগোতেই সে তীর্থজেঠুকে দেখতে পেল। কাঁধে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে লম্ব লম্বা পা ফেলে কোত্থেকে যেন ফিরছেন।রাজ সাইকেল একদিকে দাঁড় করাল। তারপর সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ ও জেঠু কোথায় গেছিলেন? আপনি তো দুদিনএলেন না”
তীর্থজেঠু একটু দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে বললেন, “একটু কাজ ছিল।বাইরে গেছিলাম। আসতে আসতে দেরি হল। তা খেলা কেমন হল?”
রাজ মাথা নাড়ল। সে বলল, “হ্যাঁ। হয়েছে।“
“আচ্ছা।এখন চলি। কাল মাঠে দেখা হবে। যেতে যেতে হঠাৎ থমকালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,” ওই ছেলেটা ফিরেছে নাকি? কি যেন নাম! নির্ঝর?
রাজ মাথা নেড়ে সায় দিল।
“বেশ। বেশ।“
দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।