| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

ইরাবতীর মুখোমুখি কবি ঈশিতা ভাদুড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

১৯৮০ সালে গোধূলি মন পত্রিকায় কবিতা নিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ সাহিত্যের আকাশে। ঈশিতা ভাদুড়ী বাংলা কবিতায় খুব পরিচিত নাম। তাঁর কবিতা ভিড়ের মধ্যে খুঁজে বের করা যায় লেখার শক্তিতেই।  ঈশিতা ভাদুড়ীর মুখোমুখি হয়েছিলেন শৌনক দত্ত। জানা অজানা অনেক কথা উঠে এসেছে সেই আলাপচারিতায়। অনেক বিষয়ে আলো ফেলেছেন ঈশিতা ভাদুড়ী। কথা বলেছেন কবিতা ছাড়া ও আরো অনেক বিষয় নিয়ে। এই আলাপচারিতার আগে এভাবে ঈশিতা ভাদুড়ী কে এত বড় ক্যানভাসে জানা বা চেনা যায়নি।


 

শৌনক দত্ত: তোমার কবিজীবনের প্রথম দিককার কথা দিয়ে আলাপ শুরু করতে চাই।

ঈশিতা ভাদুড়ী: কবিতা যে কবে কখন এলো সাল-তারিখ মনে নেই। কীভাবে এলো সেকথাও স্পষ্ট করে বলতে পারি না। আমি কিন্তু কবিতা লিখবো ভেবে কবিতা লেখা শুরু করি নি। কবিতা-চর্চা আমার পেশাও নয়।

… বাবা রেকর্ড কিনতেন প্রচুর। সেই রেকর্ডে যখন কাজী সব্যসাচী বা শম্ভু মিত্র বা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বা উৎপল দত্তের কণ্ঠে একে একে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আবৃত্তি হতো, হয়তো তখনই মনের মধ্যে কবিতার বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল।

… আমাদের সময় শৈশব-কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পড়া হতো বেশী। তবে যে বইটি পড়ে আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়েছিল সেটি হলো পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘তুমি এলে সূর্যোদয় হয়’। পাঠ্যবইয়ের বাইরে রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে রেখে বলি যদি, তবে এই কবিতার বইটিই আমি প্রথম পড়েছিলাম। এই বইটিই সম্ভবত জাগিয়েছিল কিশোরীর কবিসত্তা।

এছাড়া কবিতার মধ্যে আমার বেড়ে ওঠার পেছনে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল গড়িয়াহাটের বালিগঞ্জ ইন্সটিট্যুট লাইব্রেরীআর, আইডিয়াল বুক স্টোরের।সেই লাইব্রেরীতে বসে বই পড়া যেতো। আমি সেখানে বসে অনেক বই পড়েছি। বালিগঞ্জ ইন্সটিট্যুট লাইব্রেরি নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল আমার সামনে। আর, আইডিয়াল বুক স্টোরে দাঁড়িয়ে কত যে কবিতার বই পড়েছি ভাবা যায় না। সেই দোকানের কর্মচারীরা এবং ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত মালিক আমার হৃদয়ে অনেকখানি রয়ে গেছেন আজও। সব সময় তো বই কিনতামও না, পড়ে চলে আসতাম, পরের দিন আবার যেতাম, তাঁরা পরম আদরেই বই বার করে দিতেন। রক্তের মধ্যে কবিতার শিরশিরানি ওই আইডিয়াল বুক স্টোর থেকেই…

 কবিতা তোমার কাছে আসলে কি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: কবিতা হল একটি উচ্চারণ-মাধ্যম, সঠিক শব্দ-প্রয়োগে এবং ভাষার সুব্যবহারে একটি চিত্রকল্পের নির্মাণ, একটি ক্যানভাস, যেখানে কল্পনার রঙ লেগে থাকবে, অন্তরের বোধ বা বিশুদ্ধ আবেগ এবং পারিপার্শ্বিক অভিজ্ঞতার কাহিনী সুস্পষ্ট থাকবে সেখানে, কিন্তু কোনো আতিশয্য বা চিৎকার থাকবে না। একটি রহস্যের আঁচলও কখনও কখনও থাকা দরকার। মূলত সূক্ষ অনুভূতি এবং তীব্র অনুভব নিয়েই তো কবিতা। মনন-ধর্মের অসীম ব্যাপ্তিতেই তো কবিতার সৃষ্টি ।

 

ঈশিতা ভাদুড়ী

এত বছর পরে যদি কবিতা লেখার প্রস্তুতির কথা বলতে বলি কোন তরুণের প্রতি কি বলবে? কিভাবে শুরু করা উচিত?

ঈশিতা ভাদুড়ী: তরুণরা আমাদের চেয়ে ভালো জানে সব কিছুই, ওরা নতুন প্রজন্ম। তবে নিজেকে কবিতার কাছে যথার্থ এবং সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ এবং অন্তর্মুখী ভাবনাকে সঠিক শব্দ-প্রয়োগে ব্যক্ত যেন করতে পারে। নিপুণ চিত্রশিল্পীর দক্ষতায় যেন একের পর এক চিত্রকল্প বা রূপকল্প তৈরী করতে পারে।

 

তোমার কবিতা যাপন মুহূর্ত বা রচনার মুহূর্ত জানতে ইচ্ছে করে…কবিতায় তোমার নিবিষ্ট যে ভ্রমণ… একান্ত যে বিচরণ সেগুলোর কথা।

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমাকে একসময় প্রতিদিন ভিড় ট্রেনে বাসে অফিস করতে হয়েছে। এসব কারণে এবং আমার স্বভাবগত কারণেও আমার কবিতা লেখার কোনো নির্দিষ্ট সময় অথবা নির্দিষ্ট কোনো আসন নেই। কত কবিতা ট্রেনে লেখা হয়েছে, কত কবিতা এলোমেলো উড়ে গেছে। কবিতা লিখবো ভেবে কবিতা সচরাচর লিখি না। তীব্র মন-খারাপের মধ্যে দিয়ে যখন পথ চলি, তারই মধ্যে কখনও হয়তো এসে যায় কবিতা। কখনও দিনের পর দিন মাসের পর মাস কোনো কবিতাই আসে না। এমন হয়েছে রাস্তায় হাঁটছি অথবা ট্রেনে পাশের মহিলাদের ঝগড়া শুনছি তার মধ্যেই হঠাৎ কোনো একটা লাইন ভাসতে ভাসতে এসে গেল এবং সে থেকেই গেল মাসের পর মাস একা। তারপর হয়তো কোনও একদিন বাকি লাইনগুলি একসঙ্গে। কখনও হয়তো একসঙ্গেই পুরো কবিতা লেখা হয়ে গেল। তবে আমি কবিতা লেখার পরে দু-চারবার এদিক-ওদিক বদল করি।

তোমার কবিতার নির্মাণ ভাবনা বা বিনির্মাণ নিয়ে জানতে চাই?

ঈশিতা ভাদুড়ী: যখন নির্জন রাতে শীত ভাঙে নদীর জলে আর নদীর বাঁকে উপুড় চাঁদ, যখন কোন রাত ডুবে যায় কান্নাভেজা মেঘে আর হৃদয়ে শূন্যতা বাজে ভীষণ, যখন বিষাদ থেকে উড়ে যায় পালক বিষাদে আরও, অথবা পার্পল রঙের কোন আলো যখন জ্বলে ওঠে বুকে আর চোখের পাতা কেঁপে ওঠে তিরতির, ঝাউগাছে বেজে ওঠে যখন মালকোষ আর জেগে ওঠে আষাঢ় শ্রাবণ, সেইসব স্তব্ধতা সেইসব নিঃশব্দতা, সেইসব চাঁদের আলো থেকেই ফুটে ওঠে শিরীষ অথবা কদম্বফুল, সেইখান থেকেই কবিতার জন্ম। বোধ থেকে কবিতার জন্ম হয়।

 

কবিতার আন্তর্জাতিকতার বিষয়টিকে কীভাবে দেখ?

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমি মনে করি প্রত্যেক ভাষার কবিতারই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠা জরুরী। সেটা একমাত্র অনুবাদের মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষের কাছে পৌঁছানো দরকার প্রতিটি কবিতা।

ঈশিতা ভাদুড়ী

একটা কথা প্রায়শ শুনি কবিতার নিরপেক্ষ পাঠক নেই, কবিতার পাঠক মানেই তিনি কবি,বা ব্যর্থ কবি।তোমার কি মনে হয়? এমনটা হবার কারণ কি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: এ আমরা সন্দেহ করি এমন, ভাবি কবিতার পাঠক নেই। কিন্তু একথা সত্যি নয়। কবিতার পাঠক আছে। তাঁরা নিভৃতে নির্জনে পাঠ করে চলেছেন কবিকে।

 

বাংলা কবিতার এখন কি মন্দা চলছে—তুমি কী মনে কর? 

ঈশিতা ভাদুড়ী: একটা টানেলের মধ্যে দিয়ে আমরা হাঁটছি। অন্ধকার রয়েছে সেখানে। খুব এবরোখেবরো পথ।অনেকদূরে একচিলতে আলো।সেই আলোর কাছে পৌঁছাতে হবে আমাদের।

 

কোন ধরনের কবিতা তোমার পছন্দ?

ঈশিতা ভাদুড়ী: মানুষ এবং সমসাময়িক জীবন যাপন।

 

তোমার কবিতায় আমি লক্ষ্য করেছি একটা বড় অনুষঙ্গ হচ্ছে প্রেম আর নারী এ বিষয়ে কিছু বল।

ঈশিতা ভাদুড়ী: প্রেম তো জীবনের অঙ্গ। সে তো থাকবেই কবিতায়। আর নারী? শুধু আমাদের সমাজে নয়, সর্বত্রই নারীরা কম-বেশি অবহেলিত। আসলে সারা বিশ্ব জুড়ে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এতবেশি প্রকট, এই বিংশ শতাব্দীতেও। এখান থেকে নিষ্কৃতি খুব সহজ নয়। তার জন্যে অনেক লড়াই-এর প্রয়োজন। একেকজন একেকভাবে লড়াই করে। কেউ মিছিল করে, কেউ লিখে। আমাকে তাই লিখতে হয়‘নষ্টঅন্ধকার’বা‘গর্ভবতীকে পড়ে আপাদমস্তক’অথবা‘বিষরাত’ বা ‘কাঁদছে পাখি’। সেগুলি সবই তো নারীর প্রতি অবহেলার প্রতিবাদ।

ঈশিতা ভাদুড়ী

নিজের ব্যক্তিজীবনের টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা ধরা আছে তোমার কবিতায়। কবিতাকে কি তুমি আত্মজীবনী মনে করেন?

ঈশিতা ভাদুড়ী: দেখ, কবিতা তো ইতিহাস নয়, দর্শনও নয়, হৃদয়ের ভাব, একই সঙ্গে জীবনেরও ছবি। কবিতা আত্মজীবনী নয়, ডায়েরী বা দিনলিপি বলা যায়, সেখানে পারিপার্শ্বিক সব ঘটনাই উঠে আসে। লেখক বা কবির সৃষ্টি সাহিত্য হয়েছে কিনা সেটাই বিচার্য, কতখানি নিজস্ব জীবন রয়েছে সেটি অবান্তর।


আরো পড়ুন:ইরাবতীর মুখোমুখি কবি,কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক জয়া চৌধুরী


 

কবিতা সবসময়ই সময়কে ধারণ করেই চলে। কিন্তু, শব্দ, ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প নিয়ে তোমার ভাবনার কথা জানতে চাই।

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমার মনে হয় প্রাথমিকভাবে সাহিত্যবোধ এবং চেতনা থাকা দরকার, ব্যুৎপত্তি এবং চিত্তের নির্যাসও।ছন্দ এবং ভাষা-জ্ঞান থাকাও খুব জরুরী।শব্দ-চয়নে অসাধারণ দক্ষতা ও বিশেষন-ব্যবহারে শিল্প-কুশলতাথাকা দরকার। সবচেয়ে জরুরী হল যে, কোন্‌ কবিতা কোথায় শেষ করতে হবে সেই বোধটিও থাকা দরকার। মোট কথা কবিতার ভাব ও ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। কোনও উচ্ছ্বাস-প্রাবল্যে কবিতার সীমারেখা কখনোই অতিক্রম করা যাবে না।

 

কবিতায় আছো কয়েক দশক ধরে শুরুর সেই সময় আর আজকের মধ্যে পার্থক্য কিভাবে দেখ?

ঈশিতা ভাদুড়ী: আমার মনে হয় পরিবেশের পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়া আমরা যখন লিখতে এসেছিলাম তখন আমরা লিটল ম্যাগাজিন স্টলে গিয়ে পত্রিকা আবিষ্কার করতাম। পত্রিকার ঠিকানায় ডাকযোগে লেখা পাঠাতাম তারপর অপেক্ষা করতাম। আমরা ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে চিনতাম না তখন। পত্রিকায় কবিতা পড়েই আমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে যেতাম। এখন সোস্যাল মিডিয়ার যুগ, আমাদের পরিচিত হওয়ার জন্যে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। এখন বিখ্যাত হতে সময় লাগে না। আমি বলছি না এটা খারাপ। সব কিছুরই প্লাস পয়েন্ট আছে।

 

তুমি তো প্রচুর বই পড় জানি বর্তমানে কি পড়ছো? বইটির পাঠ অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

ঈশিতা ভাদুড়ী: গদ্য-পদ্য মিলিয়ে অনেকগুলো বই একসঙ্গে পড়ছি। বিশেষত গত বইমেলায় কেনা বইগুলো। একেকটি বই পাঠ-শেষে পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখছি তো সোস্যাল-মিডিয়াতে, পত্রিকাতে।

 

সারা পৃথিবীতে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। এর ছোঁয়া আমাদের দেশেও লেগেছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি তো মানুষকে আরো বেশি অমানবিক করে তুলছে। আমাদের এখন আর কোনো গল্প নাই, আড্ডা নাই। তবে কি এই প্রযুক্তি মানুষের শেষ হাসিটুকু নিংড়ে নেবে? নাকি প্রযুক্তিসম্পন্ন সমাজে এটাই স্বাভাবিক? কবিতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতিকে কিভাবে দেখ?

ঈশিতা ভাদুড়ী: প্রযুক্তি সব সময়ই ভালো। কিন্তু কোনও কিছুরই অপব্যবহার বা আতিশয্য ভালো নয়। আমাদের সতর্ক থাকা দরকার যাতে আমরা ডিজিটাল হাওয়ায় উড়ে না যাই। তবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কবিতার ভিডিও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আমরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রান্তের কবি-লেখককে একত্রিত করে কবিতা-পাঠ বা গল্প-পাঠের আয়োজন করতে পারি,একে অন্যের কাছাকাছি আসা যায়। আর, এগুলো তো প্রযুক্তির মাধ্যমেই করা যায়।

 

একজন কবির পঠন-পাঠন কেমন হওয়া উচিত বলে মনে কর?

ঈশিতা ভাদুড়ী: নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, কবির জন্য মানসিক ধ্যানের দরকার, স্থিতি দরকার, একাত্ম হয়ে বসে জীবন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা দরকার। এসব দরকার, পাশাপাশি কবিদের বিশ্বসাহিত্য সম্বন্ধে জ্ঞান দরকার। পূর্বজদের লেখা সম্বন্ধে সম্যক ধারণার পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মের লেখা পড়া ভীষণ জরুরী।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষা কি পরবর্তী বাংলা কবিতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: তা কেন? কবিতার মধ্যে প্রবেশ করতে গেলে জীবনানন্দ দাশ অবশ্যই পড়া জরুরী। এখনও তাঁকে নিয়ে অনেক গবেষণা বাকি আছে।জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র উপর বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কবিতা’ পত্রিকায় একটি আশ্চর্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন,‘প্রকৃতির কবি’নামে। জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে আজকের দিনে প্রশংসার জয়ধ্বনি উঠেছে। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু-ই প্রথম তাঁর কবিতা সম্বন্ধে আলোচনা করে সবিস্তারে পাঠককে বুঝিয়েছিলেন আধুনিক অর্থে প্রকৃতির কবি কাকে বলে, জীবনানন্দের ছন্দের বিশেষত্ব ঠিক কোনখানে। তিনি লিখেছিলেন, এই আলোচনা আমি দীর্ঘ করলুম কেননা জীবনানন্দ দাশকে আমি আধুনিক যুগের একজন প্রধান কবি বলে বিবেচনা করি, এবং ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ তাঁর প্রথম পরিণত গ্রন্থ। কারণ এ-বইয়ের পাতা খুললে তাঁর একজনের পরিচয় পাবেন যিনি প্রকৃতই কবি, এবং প্রকৃত অর্থে নতুন। বিশেষ করে, ‘শকুন’, ‘পাখীরা’‘অবসরের গান’, ‘মৃত্যুর আগে’, ‘ক্যাম্পে’, এসব কবিতা পড়ে স্বতঃই উপলব্ধি করা যাবে যে বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে এক অপূর্ব শক্তির আবির্ভাব হয়েছে”।

ঈশিতা ভাদুড়ী

তোমার পারিবারিক একটা ঐতিহ্য আছে,প্রভাবশালী কবির রক্ত বইছে তোমার শরীরে। এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।

ঈশিতা ভাদুড়ী: হিন্দুস্তান পার্কে ইলাবাসের দেওয়ালে টাঙানো ‘সপ্তাশ্ব বাহিত সূর্য’ ছবিটি অপার বিস্ময়ে দেখতাম, বিশ্বকবি ছাড়াও সাত সাতজন কবি-লেখক একসঙ্গে, তাঁদের মধ্যে একজন আবার আমার মায়ের পিতামহ ও, সেও খুব আশ্চর্যের ছিল সেই বয়সে, তবে যতীন্দ্রমোহন বাগচী যে রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন, সেই কথা বুঝতে আরও অনেক সময় লেগেছিল।

ছোট থেকে অনেক গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি আমি। ইলাবাসের পাশেই সুনীলমাধব সেনের বাড়ী। উলটো দিকে ‘ভালো-বাসা’, রাধারাণী দেবী নরেন্দ্র দেবের বাড়ী। কয়েক পা হাঁটলেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ী। এসবই খুব বিস্ময়ের ছিল।

 

কবিতা ছাড়াও তোমার প্রবন্ধ বা গদ্য সমান গতিশীল,কী ভাবে এবং কখন বুঝতে পারো যে একটা লেখা হয়ে উঠলো?

ঈশিতা ভাদুড়ী: কবিতার বাইরে আমি প্রবন্ধ লিখি, লিখতে ভালোবাসি। লেখাটি কখন লেখা হয়ে উঠল সেটা বুঝতে নয়, অনুভব করতে হয়। তবে কবিতা বলো বা গদ্য, লেখার পর বারবার পড়তে হয়। ভুলগুলো চোখে পড়ে।

 

ছোট্টবেলা থেকেই তুমি নানান জেলা, প্রদেশে থেকেছ এতে তোমার কবিতা বিনির্মাণে বা চিত্রকল্পে কোন প্রভাব পড়েছে বলে মনে কর?

ঈশিতা ভাদুড়ী: অবশ্যই। পরিবেশ ও পরিস্থিতি তো প্রভাব ফেলে সর্বদাই। কবি তো সর্বক্ষণই সব জায়গা থেকেই খুঁটে নেয়।

নির্জন দ্বীপে একজনমাত্র লেখকের বই নিয়ে যেতে বললে, কোন লেখককে বেছে নেবে, কেন?

ঈশিতা ভাদুড়ী: কোনও একজনের বই নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব?

 

প্রিয় কবি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও পূর্ণেন্দু পত্রী অনেকখানি স্থান দখল করে রয়েছেন। এছাড়াও কবিতা সিংহ, শঙ্খ ঘোষ, ভাস্কর চক্রবর্তী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ও আরও অনেকেই আমার প্রিয়।আরও অনেকের কবিতা পড়ে বড় হয়েছি।

ঈশিতা ভাদুড়ী

একসময় ছোটকাগজের খুব বড় একটা ভূমিকা ছিল।লিটলম্যাগের ম্রিয়মাণতা আর দৈনিকগুলোর দায়সাড়া সাহিত্য,এই দুইয়ের সুবাদে সাহিত্য এখন অনলাইন কেন্দ্রিক,তুমি কিভাবে দেখো এই বিষয়টি?

ঈশিতা ভাদুড়ী: অনলাইন পত্রিকা ভাল, স্থায়িত্বর দিক বিচার করলে। তবে আমি এখনও পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়তে ভালোবাসি, নতুন কাগজের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে। লিটল ম্যাগাজিন ম্রিয়মাণ কেন হবে? অনেক ভালো ভালো পত্রিকা আজও প্রকাশিত হয়।

 

এই সময়ের কবিদের কবিতা পড়? কেমন লেখা হচ্ছে,কোনদিকটা মুগ্ধ করে তোমায়? দূর্বলতা কি কি চোখে পড়ে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: অবশ্যই পড়ি। কখনও ছন্দ, কখনও ছন্দ ভাঙার রীতি, কখনও শব্দ-নির্বাচন, কখনও চিত্রকল্প, বিভিন্ন বিভিন্ন কারণে তাঁদের লেখা আমাকে টানে।তরুণদের কবিতার ভাষার মধ্যে যে স্মার্টনেস আছে, সেটিও ভাল।

তরুণদের ভিতরে ছন্দবিমুখতার যে একটা প্রবণতা, এটিকে কীভাবে দেখ?

ঈশিতা ভাদুড়ী: এখন জীবনযাত্রা বদলেছে, সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এসেছে, এখন তো কবিতা প্রাচীন কালের মতন হতে পারে না। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হচ্ছে, মননশীলতার প্রকাশও দেখা যাচ্ছে এবং নির্মাণ-কুশলতা। ছন্দেও তো লেখা হচ্ছে যেখানে প্রয়োজন আছে।

 

সমাজে এমন একটা ধারণা চালু আছে যে, কবিকে হতে হবে অন্যায়-অবিচারের মুখপত্র? এই ধারণার ভিত্তি কী? তুমি কি মনে কর কবি মাত্রই রাজনৈতিক সচেতন মহামানব হতে হবে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: দেখ, কবিকে তো অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে লিখতে হবে। কারণ আমি মনে করি মানুষের মধ্যে চেতনার উন্মেষ হতে পারে ইতিবাচক সাহিত্যের মাধ্যমে। রাজনৈতিক সচেতনতাও সর্বদাই থাকা প্রয়োজন। চারপাশের মানুষের বিচ্যুতি বা স্খলন থেকেই লেখক বা কবির যে কান্না, যে প্রতিবাদ, সেখানেই তাঁদের কলম একটি নিজস্ব স্থান তৈরী করে নেয়। এবং সেইখান থেকেই সচেতনতার জন্ম।

ভবিষ্যতে কি মানুষ কবিতা লিখবেপড়বে? কবিতার কি আর প্রয়োজন হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে?

ঈশিতা ভাদুড়ী: সাহিত্য যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ কবিতা লিখবে এবং পড়বেও। কবিতা প্রয়োজন থেকে লেখা হয় না, কবিতা লেখা হয়।

 ধন্যবাদ তোমাকে এতটা মূল্যবান সময় ইরাবতীকে দিলে, নিরন্তর ভাল থেকো।

ঈশিতা ভাদুড়ী: তোমাকে ও ইরাবতীকে ধন্যবাদ।

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত