| 28 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -১২)। হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস


(১২)

      আমরা হাই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় নবম দশম শ্রেণিতে আমাদের যে ইংরেজি পাঠ্যপুথি ছিল, সেখানে অন্যান্য প্রবন্ধের সঙ্গে একটি একাঙ্ক  নাটিকাও ছিল। নাম— ক্রিস্টোফার কলম্বাস। ভূগোলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার দিন থেকে কলম্বাসের নাম শুনে আসছি; কিন্তু ইতিহাসের কলম্বাস তথা মানুষ কলম্বাসের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হল সেই নাটিকাটির মাধ্যমে। নাটিকাটির সমস্ত কথা এখন মনে নেই। কিন্তু কলম্বাসের মুখের একটি কথা আমার মনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। মহাসমুদ্রের বুকে উপুর্যপরি আসা বাধা বিঘ্ন যখন কলম্বাসের নাবিকদের ভয়ে কাবু করে ফেলছে এবং তারা অপরিচিত সমুদ্র পথে আর বেশি দূর এগোতে অস্বীকার করে অভিযাত্রী দলের নেতা কলম্বাসির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে, তখন কলম্বাস একদল মামুনের মধ্যে বিশালকায় দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছে–’Danger is the breath of my life’–বিপদই আমার প্রাণ-বায়ু।’

      আমরা প্রত্যেকেই জানি যে পৃথিবীর তিনভাগ জল, এক ভাগ মাত্র স্থল। জল মহাসমুদ্রের রূপ ধরে মহাদেশ গুলিকে বেষ্টন করে  আছে। কয়েক হাজার বছর আগে থেকে মানুষ সমুদ্র ভ্রমন করার প্রমাণ আছে যদিও মহাসমুদ্র অতিক্রম করার সাহস মানুষের ছিল না। তার কারণ ছিল সেই যুগের মানুষের ভৌগোলিক জ্ঞানের অভাব, মহা সমুদ্রের দিক নির্ণয় করার মতো যন্ত্রপাতির অভাব, আর সমুদ্রগামী বড়ো জাহাজ নির্মাণ করতে পারা কারিগরি জ্ঞানের অভাব। অথচ যেহেতু পৃথিবীর তিনভাগই জল অর্থাৎ মহাসমুদ্র, তাই মহাসমুদ্র অতিক্রম করতে না পারলে সমগ্র পৃথিবী আবিষ্কার করা কখন ও সম্ভব নয়। কলম্বাস ইতিহাসের প্রথম মানুষ—যিনি জাহাজে আটলান্টিক মহাসমুদ্র অতিক্রম করে তখনও অনাবিষ্কৃত হয়ে থাকা একটি নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করলেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটা কেবল মানুষের ভৌগোলিক জ্ঞানের পরিসর বৃদ্ধি করল তা নয়। ইউরোপের মানুষ সেই নতুন মহাদেশে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করার ফলে সমগ্র পৃথিবীর রাজনীতি এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রেও নানা যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটল। সেই পরিবর্তনে নানা ক্রিয়া প্রক্রিয়া অবশেষে পৃথিবীর রূপটাকেই পরিবর্তিত করে দিল।

      এই সমস্ত কিছুর মূলে যে মানুষটি ছিলেন—সেই ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৪৬–১৫০৬) ছিলেন নব-জাগরণের যুগের সৃষ্টি এবং সেই যুগের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।

      নবজাগরণ ইউরোপের মানুষকে প্রশ্নশীল, যুক্তিবাদী এবং জ্ঞান পিপাসু করে তোলা ছাড়া তাদের মনে জাগিয়ে তুলল প্রবল আত্মবিশ্বাস, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং পার্থিব জীবনের প্রতি গভীর অনুরাগ। ধর্মই এতদিন মানুষকে পার্থিব জীবনের প্রতি উদাসীন করে রেখেছিল। কিন্তু নবজাগরণের আলোতে মানুষ পৃথিবীটাকে নতুন করে আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুর প্রতি তাঁরা একটি নতুন আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলেন। একজন পন্ডিতের বক্তব্য অনুসারে—’পার্থিব সমস্ত জিনিসের প্রতি নতুন আকর্ষণ এবং পার্থিব যশ গৌরবের আকাঙ্ক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নব-জাগরণের যুগে মানুষ বিশ্ব অভিযানে বের হল। এদিকে তারা ভারত তথা দূরপ্রাচ্যে সমুদ্রপথের খোঁজে দুঃসাহসিক অভিযান আরম্ভ করল, অন্যদিকে পন্ডিতরা প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান জ্ঞান ভান্ডারের পুনরুদ্ধার করার কাজে আত্মনিয়োগ করল।’

      নবজাগরণের আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্ব অভিযানে বাহির হওয়া প্রথম মানুষটি ছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাস। এর আগের একটি অধ্যায় আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাসের কথা বলেছি। সেই যুগের মানুষের মনে নতুন সাহস যোগানোর ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসেরও বড়ো অবদান ছিল। টলেমির তত্ত্ব ভুল বলে প্রমাণ করে কোপার্নিকাস মানুষের মনে এই নতুন ধারণার সৃষ্টি করলেন যে  পৃথিবীটি এক জায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চ্যাপ্টা জিনিস নয়; এটা আসলে একটি চির ঘূর্ণায়মান গোলাকার জিনিস এই নতুন ভৌগোলিক ধারণা মানুষের মনে একটি বিপ্লব এনে দিল।

ক্রিস্টোফার কলম্বাসআমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে কলম্বাসের নামটা স্পেনের সঙ্গে জড়িত, কারণ তার দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন স্পেনের রানী ইসাবেলা। কিন্তু আসলে কলম্বাস ইটালির মানুষ। তার জন্ম হয়েছিল ইটালির জেনোয়ায়। ইটালিয় ভাষায় তার নাম ছিল ক্রিস্তোফেরো কলম্বছ। স্পেনে আসার পরে তার নাম হল ক্রিস্তোবাল কোলোন। কিন্তু পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে ইংরেজি ভাষা প্রচলিত সেই সমস্ত দেশে তিনি ক্রিস্টোফার কলম্বাস নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ।

      কলম্বাসের পিতা ছিলেন একজন উল ব্যাবসায়ি। কলম্বাস পাভিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত এবং জ্যামিতির অধ্যায় শেষ করে পিতার ব্যাবসায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সমুদ্রবোধ হয় তাকে শৈশব থেকেই হাতের ইশারায় ডাকত। উল ব্যাবসায় তার মন বসল না। খুব কম বয়সে নাবিকের জীবন গ্রহণ করে কলম্বাস সমুদ্র পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।

      এখানে কিছুটা আগের কথা বলতে হবে। মধ্যযুগে ইউরোপের মানুষ খুব বেশি ঘোরাফেরা করত না। সেই জন্য তাদের পৃথিবীর জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ ছিল। তেরো শতিকায় ইটালির  পলো নামের দুজন ভাই দাদা স্থলপথে ভ্রমণ করে চিন দেশের সম্রাটের রাজসভা পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন এবং প্রায় কুড়ি বছর পরে তারা স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। তাদের বিচিত্র ভ্রমণ কাহিনি দূরপ্রাচ্যের প্রতি ইউরোপের মানুষের মনে বিপুল কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল। সেই তখন থেকে চিন এবং ভারতে কীভাবে একটা নিরাপদ পথ খুঁজে বের করা যায় সেটা ছিল ইউরোপের মানুষের একটি প্রধান উদ্দেশ্য।

      ইতিমধ্যে স্পেন এবং পর্তুগাল ইউরোপের প্রধান নৌ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে বার্থল’মিউ ডায়াজ নামের একজন পর্তুগিজ নাবিক সমুদ্রপথে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ আবিষ্কার করেছিল। একটি প্রকাণ্ড তুফান বাধা না দিলে তিনি হয়তো আরও পূবদিকে এগিয়ে গিয়ে তখনই ভারতের উপকূলে লঙ্গর ফেলতে পারতেন। সে যাই হোক না কেন,উত্তমাশা অন্তরীপের আবিষ্কার মানুষের মনে এরকম একটি আশা জাগিয়ে তুলেছিল যে ভারতে যাওয়ার সমুদ্র পথ আবিষ্কৃত হতে হয়তো আর বেশিদিন নেই।

      নবজাগরণের কলরব তখন ইউরোপের একটি বিশাল প্রান্তর মুখরিত করে তুলেছে। এতদিন তারা যে সংকীর্ণ পৃথিবীতে বাস করছিল তার সীমা পার হয়ে বাইরের বিশাল পৃথিবীটা আবিষ্কার করার জন্য তারা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রহস্যময় রূপকথার দেশ ভারতবর্ষে একটা সমুদ্র পথ আবিষ্কার করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর। কিন্তু মহাসমুদ্রের বুক ভেদ করে কোন দিকে অগ্রসর হলে তারা একদিন গিয়ে ভারতবর্ষে উপস্থিত হবে সেই বিষয়ে কিন্তু নাবিকদের মধ্যে মতের মিল নেই। কেউ বলে—পূব দিকে যাওয়া ভালো; কেউ বলে পশ্চিম অভিমুখে।

      পর্তুগাল যে সময়ে সমুদ্রে নিজের আধিপত্য বিস্তার করছে আর সেই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র অভিযান গুলির নেতৃত্বদান করছে, সেই সময় ক্রিস্টোফার কলম্বাস পর্তুগালে। ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফেলিপো-মোঞিছ-দে-পেরেস্ত্রেলো নামে একজন পর্তুগিজ নাবিক মহিলাকে বিয়ে করে পর্তুগালের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। ফেলিপোর পিতা ও ছিলেন সেই সময়ের একজন বিখ্যাত নাবিক। অনেকদিন ধরে কলম্বাসের একমাত্র স্বপ্ন ছিল ভারতবর্ষে যাবার একটি সমুদ্র পথ আবিষ্কার করা। সেই উদ্দেশ্যে তিনি একটি বিশদ পরিকল্পনা প্রস্তুত করে পর্তুগাল এবং স্পেনের রাজার কাছে এনে একটা সমুদ্র অভিযানের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করলেন। কিন্তু দুজন রাজাই কলম্বাসের প্রার্থনা নামঞ্জুর করলেন। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন কারণে।

      পূবের সমুদ্রপথে পর্তুগাল ইতিমধ্যেই নিজের একাধিপত্য স্থাপন করেছিল। তাদের মনে গভীর বিশ্বাস ছিল যে আর কিছুদিন চেষ্টা করতে থাকলে তারা নিজেই একদিন ভারতবর্ষে যাবার সমুদ্র পথ আবিষ্কার করতে পারবে। তার জন্য কলম্বাসের মতো বিদেশি একজনের সাহায্য নেবার কোনো প্রয়োজন নেই। পর্তুগালের রাজা কলম্বাসের প্রার্থনা অগ্রাহ্য করার সেটাই ছিল প্রধান কারণ।

      অবশ্য স্পেনের রাজার কারণটা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। এর আগের একটি অধ্যায়ে বলে আসা হয়ছে যে সপ্তম শতকে মূররা স্পেন আক্রমণ করে সেখানে প্রায় সাতশো  বছর রাজত্ব করে। কলম্বাস যখন সমুদ্র অভিযানের জন্য সাহায্য চেয়ে স্পেনের রাজের কাছে আবেদন করেন, তখন স্পেনের রাজ সিংহাসনে ফার্দিনান্দ। তার রানি হলেন ইসাবেলা। আরাগনের রাজা ফার্ডিনান্দ কেস্টিলের রানি ইসাবেলাকে বিয়ে করে সেই মাত্র দুটি রাজ্যকে একত্রিত করে স্পেনকে একটি অখন্ড দেশে পরিণত করেছেন, আর দুজনেই মূরদের তাদের শেষ ঘাঁটি গ্রানাডা থেকে তাড়িয়ে দিতে সংকল্প গ্রহণ করেছেন। অন্য কোনো কথায় কান দেবার মতো তাদের সময় নেই।

      কিন্তু কলম্বাস সহজে হার মানার লোক নয়। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তিনি নিজের সংকল্পে অটল। স্পেনের রাজাকে অনুরোধ করা থেকে তিনি বিরত হলেন না। কলম্বাসের ভাগ্য ভালো, ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের তিন আগস্ট কলম্বাস ঐতিহাসিক সমুদ্র অভিযান আরম্ভ করলেন। তার সঙ্গে ছিল সানটামারিয়া (১০০টন), পিন্টা (৫০ টন) এবং নিঞা (৪০ টন) নামের তিনটি জাহাজ, এবং ৮৮ জন নাবিক। জাহাজের ওজন গুলি উল্লেখ করা হল এইজন্য যে আজকালের বিশালাকার ওসেনলাইনার (Ocean liner) অর্থাৎ মহাসমুদ্র পারাপার করা জাহাজের তুলনায় কলম্বাসের জাহাজগুলি ছিল ডিঙ্গি নৌকা মাত্র। যে ৮৮ জন নাবিককে সারথি করে কলম্বাস সেই ভয়ংকর সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছিলেন সেই নাবিকরা ছিল জেল থেকে মুক্তি লাভ করা দাগি অপরাধী, এবং নরহত্যার মতো নানা গুরুতর অপরাধে লিপ্ত সমাজবিরোধী শ্রেণির লোক।

      সেইযুগে একমাত্র অপরাধী শ্রেণির মানুষ ছাড়া অন্য মানুষ সমুদ্রে ভ্রাম্যমাণ নাবিকের জীবনের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে হেণ্ড্রিক-উইলেম-ভান-লুনে লিখেছেনঃ মধ্যযুগে সমুদ্র মানুষকে আকর্ষণ করত না।তার যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল,প্রথমত জাহাজগুলি ছিল খুবই ছোটো।যে সমস্ত জাহাজে উঠে মেগেলান পৃ্থিবী প্রদক্ষিণ করেছিল আর তা করতে গিয়েতার অনেক বছ সময় লেগেছিল সেই জাহাজগুলি আজকাল ব্রহ্মপুত্র পারাপার করা ফেরি নৌকার মতো বড়োও ছিল না।জাহাজগুলিতে মাত্র কুড়ি থেকে পঞ্চাশ জন মানুষের জায়গা হত।তাদের যে সমস্ত নোঙরা ঘরে থাকতে হত সেগুলি এত খাটো ছিল যে কারও পক্ষে ,তাতে শরীরটা সম্পূর্ণ সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হত না।সমুদ্রের খারাপ আবহাওয়ার জন্য আগুন জ্বালানো প্রায়ই সম্ভব হত না,ফলে নাবিকদের প্রায়ই আধা সিদ্ধ বা সিদ্ধ না হওয়া নিকৃষ্ট খাবার খেতে বাধ্য করা হত।মাছ শুকিয়ে বা তেলে ডুবিয়ে অনেকদিনের জন্য কীভাবে খেতে পারার মতো করে রাখা যায় সে কথা মধ্যযুগের মানুষ জানত।কিন্তু ডিবেতে ভরিয়েরেখে খাদ্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা তখন ছিল না।কাঁচা শাক-সব্জি কী জিনিস সে কথা নাবিকরা উপকূল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভুলে যেতে বাধ্য হত।খাবার জল নেওয়া হত ছোটো ছোটো পিপেতে ভরিয়ে।খুব দ্রুত সেই জল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ত।জল মুখে দিলেই পচা কাঠ কিংবা লোহার মরচে খাওয়া বলে মনে হত।তাছাড়া সেই জলে নানা ধরনের পোকা কিলবিল আরম্ভ করত।চোখে দেখার বাইরে জীবাণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে মধ্যযুগের মানুষের কোনো ধারনা ছিল না।(তেরো শতকে বিদ্বান সন্ন্যাসী রজার বেকন জীবাণুর অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন,কিন্তু নানা কথা বিবেচনা করে তিনি সেই আবিষ্কার নিজের মনের মধ্যে গোপন করে রেখেছিলেন)।নাবিকদের সবসময় এই ধরনের নোংরা জল খেতে হত;ফলে কখনও একই জাহাজের সমস্ত নাবিক সান্নিপাত জ্বরের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে  মৃত্যুমুখে পতিত হত।সেই যুগে নাবিকের মৃত্যুর হার ছিল অতি ভয়াবহ।১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে যে দুশোজন নাবিক মেগেলানের সঙ্গে্ পৃথিবী প্রদক্ষিণ অভিযানে বাহির হয়েছিল,তাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় স্বদেশে ফিরে এসেছিল মাত্র আঠারো জন।এমনকি সতেরো শতক পর্যন্ত শতকরা প্রায় চল্লিশজন নাবিকের এভাবে মৃত্যু হওয়াটা ছিল খুবই স্বভাবিক ঘটনা।বেশিরভাগ নাবিকের মৃত্যু হত স্কার্ভি রোগে।আহারে সজীব শাকসব্জির অভাব ঘটলে এই রোগ হয়।এই রোগের ফলে দাঁতের মাড়িতে ঘা হয় এবং পরবর্তীকালে শরীরের রক্ত দূষিত হয়ে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।সমুদ্র যে কেন সমাজের শ্রেষ্ঠ এবং গুণী মানুষদের সেই যুগে আকর্ষণ করতে পারত না সে কথা বোঝার জন্য এর পরে আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না।মেগেলান,কলম্বাস এবং ভাস্কো দ্য গামা প্রভৃতি বিখ্যাত পর্যটকরা যে সমস্ত নাবিককে সারথি করে দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযানে বাহির হয়েছিল,সেই নাবিকদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন জেল থেকে মুক্তি লাভ করা দাগী অপরাধী,কথায় কথায় নরহত্যা করতে পারা জিঘাংশু প্রবৃত্তির মানুষ এবং চোর ডাকাত ইত্যাদি।’


আরো পড়ুন: আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -১১)। হোমেন বরগোহাঞি


      এইধরনের ৮৮ জন নাবিককে সঙ্গে নিয়ে কলম্বাস অপরিচিত মহাসমুদ্রের বুকে ১৪৯২ সনের ৩ আগস্ট পাড়ি দিলেন।প্রায় সত্তর দিন পরে তাঁরা প্রথম মাটি দেখতে পেলেন।কলম্বাস ভাবলেন যে তিনি কিছুক্ষণ পরে ভারতের মাটিতে পা রাখবেন।কিন্তু সত্তর দিনের ভয়ঙ্কর এবং বিপদসঙ্কুল সমুদ্র ভ্রমণের শেষে যে উপকূল রেখা দেখে কলম্বাস এবং তাঁর সঙ্গীদের মন-প্রাণ আনন্দে নেচে উঠেছিল আর যাকে তাঁরা ভারতের উপকূল রেখা বলে ভুল করেছিল সেটা আসলে ভারত ছিল না।সেটা আসলে ছিল এখনকার বাহামা দ্বীপপুঞ্জ নামে বিখ্যাত দ্বীপপুঞ্জেরওয়াটংলি নামে একটি দ্বীপ।

      কলম্বাস ভারত পর্যন্ত সমুদ্রপথ আবিষ্কার করতে পারলেন না সত্যি,কিন্তু তিনি আবিষ্কার করলেন একটি নতুন মহাদেশ,তিনি সূচনা করলেন ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়।

      কলম্বাসের এবারের অভিযানে ওয়াটলিঙের বাইরে আরও অন্য কয়েকটি দ্বীপ আবিস্কৃত হয়।কিন্তু এই যাত্রায় তাকে হারাতে হয় সান্টা মারিয়া নামে তাঁর সবচেয়ে বড়ো জাহাজটা।নাবিকদের গাফিলতির ফলে জাহাজটা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়।সে যাই হোক না কেন,কলম্বাসওয়াটলিং দ্বীপে একটা দুর্গ নির্মাণ করে সেখানে চুয়াল্লিশ জন নাবিককে রেখে নিঞা নামের জাহাজে করে ইউরোপে ফিরে আসেন।

      ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ কলম্বাস পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে এসে উপস্থিত হলেন।যে পর্তুগালের রাজা কলম্বাসকে সমুদ্র অভিযানের জন্য সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিলেন,সেই একই রাজা এখন কলম্বাসের সম্মানে বিপুল রাজকীয় অভ্যর্থনার আয়োজন করলেন,লিসবনের পরে কলম্বাস স্পেনের রাজধানী বার্সিলোনায় গেলেন।সেখানে তো প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিল বিপুল উচ্ছ্বাসপূর্ণ সম্বর্ধনা।কিন্তু এই সমস্ত আড়ম্বরপূর্ণ ভোজ-ভাত এবং সম্বর্ধনা কলম্বাসের চিরচঞ্চল মনটাকে বেশিদিন বেঁধে রাখতে পারল না।মাত্র কয়েকমাস বিশ্রাম নিয়েই ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি পুনরায় সমুদ্রে পাড়ি দিলেন।তাঁর এইবারের অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ইতিমধ্যে আবিষ্কার করে আগামী দ্বীপগুলিতে  উপনিবেশ স্থাপন করা।তাই এবার তাঁর সঙ্গে ছিল সতেরোটি জাহাজ এবং ১৫০০ জন অনুচর।তার ভেতরে বারোজন ধর্মপ্রচারক।এইবারের যাত্রায় তিনি কয়েকটি নতুন দ্বীপ আবিষ্কার করা ছাড়া কিউবা আর জামাইকাও আবিষ্কার করেন।কিন্তু প্রথমবারের যাত্রায় তিনি ওয়াটলিং দ্বীপে যে দুর্গ নির্মাণ করে চুয়াল্লিশ জন নাবিককে রেখে গিয়েছিলেন,এবার সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন যে দুর্গটার কোনো চিহ্নই নেই।তিনি নতুন করে একটা দুর্গ নির্মাণ করে ইসাবেল্লা নামের একটি নগর প্রতিষ্ঠা করলেন।

      এরপরেও কলম্বাস আরও দুবার অভিযান চালায়।১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা তৃতীয় অভিযানে কলম্বাস দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন।১৫০২ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে থেকে ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত করা চতুর্থ অভিযানে তিনি হন্দুরাসের প্রতিবেশী কয়েকটি দ্বীপ আবিষ্কার করেন।কিন্তু দূর থেকে হন্দুরাছ দেখে তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি নিশ্চয় কেথে তথা চিনদেশের কাছাকাছি পৌছেছেন।এই চতুর্থ অভিযানের সময় তাকে নাবিকদের চূড়ান্ত উচ্ছৃঙ্খলতা এবং বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়।এই অধ্যায়ের শুরুতে আমি পাঠাশালার পাঠ্যপুথিতে পড়া যে একাঙ্ক নাটিকার কথা উল্লেখ করেছিলাম,সেই নাটিকার বিষয়-বস্তু ছিল কলম্বাসের চতুর্থ সমুদ্র অভিযানের সময় হওয়া নাবিক-বিদ্রোহ।চতুর্থ অভিযান শেষ করে কলম্বাসযখন স্পেনে ফিরে এলেন,তখন তাঁর প্রায় ভগ্ন-প্রায় অবস্থা।দুবছর রোগশয্যায় কাটানোর পরে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে তাঁর মৃত্যু হয়।কিন্তু মানুষের ইতিহাসে যে সমস্ত পুরুষ সত্যিই অমর,তাদের ভেতরে কলম্বাস ও একজন।যে বন্ধন-মুক্তি এবং অনুসন্ধিৎসা এবং অভিযান-স্পৃহা ছিল নবজাগরণের আদর্শ,সেই আদর্শের একটি মূর্ত প্রতীক ছিলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস।মানুষের অভিধানে তিনি আজ কেবল একটি নাম নয়,তিনি একটা নতুন শব্দ।সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বিষয়ে বলতে গিয়ে মানুষ বলেঃ‘তিনি ছিলেন মানুষের অবচেতন মনের অনাবিস্কৃত নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করা কলম্বাস।’অসমের কার্বিদের বিষয়ে বলতে গিয়ে বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা বলেছিলেনঃ‘কার্বিরা হল অসম আবিষ্কার করা কলম্বাস।’

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত