শারদ অর্ঘ্য গল্প: একজন দুষ্টু লোক আর কুর্চিফুলের গন্ধ । অমিতাভ দাস
–কাল সারারাত তোমাকে আদর করেছি।
–মানে?
–মানে তোমার ওই দুটো আমার বুকের ওপর ছিল।আমি কেবল হাত বুলিয়েছি।
–কী সব যা তা বলছেন স্যার?
–শোনো আমি ওই দুটোর নাম দিয়েছি গঙ্গা আর যমুনা? কী নাম দুটো ভালো না?
কুর্চি আর সহ্য করতে পারে না। ফোন কেটে দেয়। আবার ফোন করেন কিঙ্করবাবু।
–ফোনটা কেটে গেল? তুমি কি কেটে দিলে সোনা?
–আসলে স্যার, আমাদের এখানে নেট ওয়ার্কের খুব সমস্যা।
–তাই বলো। আচ্ছা শোনো, সবাই আমায় স্যার বলে। তুমি কেন বলবে?
–তাহলে কী বলব?
–ভালোবেসে কিঙ্কর বলবে। আপনি আজ্ঞে নয়, তুমি করে ডাকবে। তোমার মুখে কিঙ্কর ডাকটা শুনলে ভেতরে কেমন যেন একটা হয়। আচ্ছা, রাতে শোয়ার পর আলো নিভিয়ে আমাকে ফোন করবে।
–ধ্যুস্, কী যে বলেন স্যার, আমি আপনার নাতনির বয়সী। এসব কী বলছেন আপনি। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি স্যার। আপনাকে নাম ধরে কেন ডাকতে যাবো আমি! আশ্চর্য তো!
–আশ্চর্যের তো কিছু নেই। তোমার কবিতা পড়ে আমার ভালো লেগেছে। তুমি বাংলা সাহিত্যের বিরাট সম্ভাবনাময় কবি। কবে আসছো বলো? একদিন আমি আর তুমি গড়ের মাঠে গিয়ে বসব। হাওয়া খাবো। হাতে হাত রেখে জীবনানন্দ শোনাবো। অথবা কোনো ভালো রেস্তোয়ায়। বদ্ধ কেবিনে আমরা দুজনে, বলে বেশ জোরে হেসে উঠলেন।
–স্যার আমার পক্ষে কলকাতা যাওয়া সম্ভব নয়। অনেক দূরে থাকি। তাছাড়া স্যার, আপনার অনেক বয়স হয়েছে, এই বয়সে এত ঘোরাঘুরি শরীরের পক্ষে ভালো নয়। আচ্ছা রাখি। আমার অনলাইনে ক্লাস আছে।
–শোনো, রেখো না। আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না। তোমার নরম তুলতুলে বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে চাই। কথা দাও তোমার বুকে আমার মাথা রাখতে দেবে? আমি ওই দুটো নিয়ে খেলব।
কান গরম হয়ে গেছে কুর্চির। শরীরটা রাগে রি রি করছে। সে ফোনটা কেটে সুইচ অফ করে দেয়।
কিঙ্কর হালদার বাংলা সাহিত্যের নাম করা অধ্যাপক। বহু বছর অবসর নিয়েছেন। এখন আশির কাছাকাছি বয়স। বেশ নামডাক। প্রচুর বইয়ের লেখক। তাঁর সঙ্গে বইমেলায় আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আর্যব্রত। তার পর থেকে মাঝে মাঝে ফোন করতেন কিঙ্করবাবু। কুর্চি খুব সম্মান করত। কিন্তু কয়েক মাস পর থেকে রাত্রিবেলা ফোন করে বিরক্ত করছেন তিনি। নানা রকম কু-প্রস্তাব। নরম স্বভাবের কুর্চির কান্না যেমন পাচ্ছে, তেমনি ঘেন্নাও হচ্ছে ভীষণ। আর তো সহ্য হয় না। আর্যব্রতকে ফোন করে আজ সব বলে দিল কুর্চি। আর্য বললে, মালটা পারভার্টেড। শোন একটা বুদ্ধি দিচ্ছি। কাল সেইটে এপ্লাই করবি। তাতে কাজ না হলে অন্য ব্যবস্থা। যথারীতি পরদিন কিঙ্করবাবুর ফোন। কুর্চি কনফারেন্সে আর্যব্রত ও আরো এক বান্ধবীকে ডেকে নিল। ওদের তো আগেই বলা ছিল। কিঙ্করবাবাকে হোল্ডে রখে ওদের কল করেছিল কুর্চি। কিঙ্করবাবুর বলতে শুরু করলেন, ‘কুর্চি তোমাকে খুব মিস করছি জানো তো। রাত্রি হলেই তোমাকে মিস করি। আমাকে একটা চুমু খাবে সোনা। আমি কাল সারারাত গঙ্গা-যমুনাকে চুমু খেয়েছি।’ এবার আর্যব্রত বললে, ‘শালা, বুড়োভাম, নাতনীর বয়সী মেয়ের সঙ্গে নোংরামি করছ। আপনাকে খুব সম্মান করতাম। এখন স্যার বলতেও ঘেন্না হচ্ছে। সব কথা রেকর্ড হয়েছে। ‘
আমতা আমতা করতে থাকেন কিঙ্করবাবু।–কী সব জা তা কথা বলছ’। কুর্চির বান্ধবী তৃণা তখন বলে ওঠে, ‘ছি ছি স্যার, আপনি এত নোংরা.’..সে আরো বললে, ‘আপনি যমেরও অরুচি। আর যদি কুর্চিকে ফোন করেন, সব রেকর্ডিং ভাইরাল করে দেবো। আর শুনুন দাদুস্যার, আমার দাদা কিন্তু এস পি। আর বাবা হাইকোর্টের এডভোকেট জানেন তো। নিজের সম্মান বাঁচাতে চাইলে এখনি ক্ষমা চান কুর্চির কাছে…না হলে…’
–‘তোমরা আমাকে হুমকি দিচ্ছ…’
–‘যা বুঝবেন।’ বললে আর্যব্রত । ‘কী থানায় যাবো নাকি স্যার?’
বোধহয় ভয় পেলেন কিঙ্করবাবু। বললেন, ‘আসলে আমি তো ওর সঙ্গে একটু মজা করছিলাম। ওর কবিতা আমার ভালো লাগে। বাচ্চা মেয়ে।’
–‘নাটক। মজা করছিলেন’। রাগত স্বরে বললে কুর্চি।
কিঙ্করবাবু বললেন, ‘তোমরা আমায় ভুল বুঝলে। যাইহোক, আমি ক্ষমা চাইছি কুর্চি। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আমি তোমাকে আর ফোন করব না’। কন্ঠস্বরটা কেমন যেন কাঁদো কাঁদো ঠেকল।
আর্যব্রত বললে, ‘মনে থাকে যেন…’
কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । জন্ম-কর্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়াতে । পড়াশুনো হাবড়া হাই স্কুলে। শ্রীচৈতন্য মহা বিদ্যালয়ে কলেজ জীবন । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । পেশায় গৃহশিক্ষক , নেশায় লেখক । কিছু কবিতা , ছোটগল্প , অণুগল্প ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত । এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ২৫টি । সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কাব্যোপন্যাস ” পাখি-যাপনের জার্নাল ” । ২০১৯ এ প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ” বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম ” গল্পগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ” অনিলা দেবী সাহিত্য সম্মান ” । এছাড়াও পেয়েছেন বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ পুরস্কার , সুতরাং সাহিত্য সম্মান , টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার সহ আরো কিছু পুরস্কার ও সম্মান । ১৯৯৬ সাল থেকে সম্পাদনা করে আসছেন ‘ অবগুণ্ঠন সাহিত্যপত্র’টির । প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত কবিতা ” নির্বাচিত ১০০” । মূলত লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক বলতেই গর্ববোধ করেন । তবে বেশ কিছু বানিজ্যিক কাগজেও লিখেছেন । অণুগল্পের বই ” ছক্কুমামা , কর্নেল কাপুর ও অন্যান্য গল্প ” যথেষ্ট জনপ্রিয় ।