| 6 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৪) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
 
 
রাণী সুদেষ্ণার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন দ্রৌপদী। 
“এ কেমন আদেশ মহারাণী? আমি আপনার কাজ করতে কখনও অস্বীকার করিনি। কিন্তু এই আদেশ মানা আমার পক্ষে তো সম্ভব নয়। প্রথম কথা আপনার মহলের বাইরে আমি যাব না। আর যার কথা আপনি বলছেন, সম্ভবত সেই লোকটিই দুদিন আগে আমাকে দেখে কুৎসিত মন্তব্য করেছিল। লোকটি তাহলে আপনার ভাই! তাই এমন অনায়াসে অন্তঃপুরে ঢুকে এমন সব কথা বলেও পার পেয়ে যায়! এই রকম মানসিকতার কারুর কাছে কোনও মতেই আমি যেতে রাজি নই। আপনি বললেও না। ক্ষমা করবেন আমাকে।”
আরে, মালিনী! তুমি এমন অদ্ভুত কথা ভাবছ কেন? কীচক আমার ভাই। এমন খারাপ কাজ সে করবে কেন? তাছাড়া আমি পাঠিচ্ছি তোমাকে। সুতরাং তোমাকে অপমান করার প্রশ্নই নেই। তোমাকে যেতেই হবে। আমার জন্য মদ নিয়ে আসতেই হবে। ওই মদটি পান করার জন্য আমার গলা শুকিয়ে আছে। আমার চাইই চাই।” এই বলে সুদেষ্ণা দ্রৌপদীর হাতে একটি ঢাকায়ালা সোনার পানপাত্র ধরিয়ে দিলেন।
 
কীচক তো প্রস্তুত হয়েই ছিল। সে জানত যে কূট ভয় সে দিদির মনে ঢুকিয়ে দিয়ে এসছে, তার জন্যই দিদি ওই মেয়েটিকে পাঠাবে। যাকে দেখে পর্যন্ত কীচকের শরীর মন অস্থির হয়ে উঠেছে। এমন সৌন্দর্য্য, যাকে শয্যায় সহস্র বার পেলেও যেন তৃষ্ণা মেটে না! দূর থেকে মেয়েটিকে আসতে দেখেই সে লাফিয়ে উঠল। দ্রৌপদীকে বলল, “তুমি এসেছ? জানতাম আমি। তোমার জন্য সমস্ত সাজ, অলঙ্কার আনিয়ে রেখেছি। তুমি আমার মনের রাণী। চলো। ময়া সার্দ্ধং পিবস্ব মধুমাধবীম্। আমার সঙ্গে ফুলের মধু দিয়ে বানানো মদ খাবে। একসঙ্গে বিছানায় বসে দুজনে ফুর্তি করি!”
 
 কীচকের এই অসহ্য স্পর্ধায় দ্রৌপদী প্রথমে হতবাক্ হয়ে গেলেন। এও বুঝলেন মনে মনে যে রাণী সব  জেনে বুঝেই তাঁকে পাঠিয়েছেন। নিশ্চয়ই এই ধূর্ত তাঁকে কিছু ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু তিনি তো সুদেষ্ণা নন। নিজেকে কঠিন করে তিনি বললেন, “আপনার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি রাণীর জন্য বিশেষ মদটি নিতে এসেছি। সেইটি দিন। আর কোনও কথা বলার স্পর্ধা দেখাবেন না”! 
“আহা! তোমার মতো নরম নারীর কাছ থেকে এমন কঠিন কথা শুনতে আরও ভালো লাগে। নারী একটু ছটকাবে, একটু চিৎকার করবে, তবেই তো তাকে সমর্পিত করানোর মজা! সুদেষ্ণার পানীয় অন্য কেউ নিয়ে যাবে। আপাতত তুমি আমার আকন্ঠ তৃষ্ণা মেটাও তো”! এই বলে কীচক দ্রৌপদীর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল আর জড়িয়ে ধরল। দ্রৌপদী প্রথমে ভাবতেই পারেন নি যে এই লোকটা এতখানি এগোবে। তিনি প্রাণপণে একটা ধাক্কা মারলেন। দুই হাতে। যত জোরে সম্ভব। লোকটা পড়ে গেল সেই মসৃণ মেঝেতে। দ্রৌপদী দৌড় লাগালেন। না। রাণীর মহলের দিকে নয়। সেখানে গিয়ে লাভ তো হবেই না। বরং রাণী কীচককে সাহায্যই করবেন। তিনি ছুটলেন রাজসভার দিকে। যেখানে বিরাট রাজা আছেন। স্বয়ং যুধিষ্ঠির আছেন। তিনি তো রাজার প্রিয় সভাসদ। তাঁকে পাওয়াই যাবে। আর ওখানেই তাঁর লাঞ্ছনার শেষ হবে।

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১৩) । রোহিণী ধর্মপাল
 
 
দ্রৌপদী পৌঁছেই গেছিলেন প্রায়। তখনই চুলে প্রচণ্ড জোরে একটা টান অনুভব করলেন। ঠিক যেন সেই কৌরব সভাগৃহ আর দুঃশাসনের টান! ঠিক সেইভাবেই টানতে টানতে কীচক তাঁকে সভার মাঝখানে সবার সামনে এনে ফেলল আর সজোরে লাথি মারল। 
“হা হতোস্মি”! দ্রৌপদী নিঃশ্বাস ফেললেন। যে অভিজ্ঞতা একবার হলেই একটি মেয়ে সারা জীবন দুঃস্বপ্ন দেখে, সেই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে দু দুবার যেতে হয়েছে তাঁকে। কী অসহনীয় সেই অপমান! সেইবারও। এই সময়েও। প্রত্যেকটি অচেনা পুরুষ দেখছে তাঁকে। না। কেউ উঠল না। এখানেও। বিরাট রাজা এখানে চোখ থেকেও অন্ধ। পুরুষেরা কি এমনটাই হয়? নয়ত সর্বত্র এমন হবে কেন? আর যুধিষ্ঠির! ঈশ্বর! তিনি এখানেও চুপ। কোনও কারণে ভীম এসেছিলেন রাজসভায়। কারণ রাজা একটি মল্লোৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা করছিলেন। আর তাঁর এই নবনিযুক্ত পাচকটি যে কী বলশালী আর কুস্তিতে পটু তা তিনি আগেই দেখেছিলেন। সেই উৎসবে ভীম জীমূত নামের এক পৃথিবীজয়ী কুস্তিগীরকে অনায়াসে হারিয়ে রাজ্যের সবার মন জয় করেছিলেন। দ্রৌপদী জানতেন না যে ভীমও রাজসভায় থাকবেন। কিন্ত যুধিষ্ঠিরের ইশারায় ভীম এখানেও চুপ করে রইলেন। সেই সময়েও দ্রৌপদীর সম্মান বাঁচিয়েছিলেন দ্রৌপদীই। এখানেও দাঁত কিড়মিড় করতে করতে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করার পরেও যুধিষ্ঠির নিজের পায়ের আঙুল দিয়ে ভীমের পায়ের আঙুল চেপে ধরলেন। ভীমকে শান্ত হয়ে যেতে দেখে দ্রৌপদী বুঝলেন এখানেও নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে হবে। জগতে পুরুষের বড়ই অভাব। কাপুরুষেই ভরে গেছে সবটা। এর চেয়ে সত্যিই তাঁর জঙ্গল ভালো ছিল। যেখানে অকারণে কেউ কাউকে আক্রমণ করে না। যেখানে ঈর্ষা দ্বেষ ক্ষমতার লোভ নেই। কাম থাকলেও তার প্রকাশ অন্য।
 
এখানেও তাঁর মনে হচ্ছিল নিজের তীরধনুকটির কথা। বা একটি বাঁশ চেঁচে মাছ ধরার যে চোঁচটি বানিয়ে ছিলেন, সেটার কথা। মনে হচ্ছিল উপস্থিত সকলকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেন। আর রাগ কীচকের ওপর বেশি করা উচিত না নিজের স্বামীদের ওপর, বিশেষ করে যুধিষ্ঠিরের ওপর, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একজন সম্রাট, যাঁর কিনা পুরো দেশের শাসনের ভার নেওয়ার কথা, নিজের স্ত্রীর প্রতি অন্যায়কারীর প্রতিবাদ করে উঠতে পারছেন না! ছিঃ! ওই অবস্থাতেই কেঁদে ফেলেছিলেন তিনি। এখনও স্পষ্ট মনে আছে। চোখে আপনিই জল চলে এল তাঁর। কিভাবে সামলেছিলেন সেদিনও। বিরাট রাজার দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে রাগে দুঃখে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে বলেছিলেন,  “পাঁচ পাঁচজন বীর স্বামীর স্ত্রী আমি, যাঁদের শত্রুরা রাতেও ভয়ে ঘুমোতে পারে না, যাঁদের অস্ত্রের ঝনঝন আওয়াজ শত্রুদের বুকের রক্ত শীতল করে দেয়, চাইলে যাঁরা পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলতে পারে, তাঁদের স্ত্রী আমি। সেই আমাকে কিনা এই সূতপুত্র সকলের সামনে পদাঘাত করল!”
 
সেদিন খেয়াল করেন নি, আজ এই পাথরে একা শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে দ্রৌপদী চমকে উঠলেন যেন। সেই সূতপুত্র! তাই তো! কৌরবদের সভায় তাঁকে সবচেয়ে নোংরা আক্রমণ করেছিল তো কর্ণই। প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারে নি কর্ণ, সঙ্গে সূতপুত্র আখ্যা! কী বা করতেন তিনি সেই মুহূর্তে! অনেক পরে, যুদ্ধের শেষে যখন জেনেছিলেন কর্ণ পঞ্চ পাণ্ডবের অগ্রজ আর সেই সূত্রে তাঁর স্বামীও হতে পারতেন হয়ত, ভেতর পর্যন্ত কেমন ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল তাঁর। স্বয়ংবর সভায় ধনুতে গুণ পরানোর পরেই দ্রৌপদীর না শুনে কেমন একটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে। আর তারপরেই চলে গেছিল সভা ছেড়ে। আর যখন দুঃশাসন তাঁর কাপড় ধরে টানছে, কী অসভ্যের মতো তাকিয়ে ছিল তাঁর দিকে! একটার পর একটা ভয়ঙ্কর কথা বলে যাচ্ছিল সেই সভার মধ্যে। রাগ ঘৃণা কিভাবে পুষে রাখতে পারে একজন পুরুষ! যেমন যুধিষ্ঠিরও। এত বছর ধরে অর্জুনের প্রতি তাঁর ভালোবাসা নিয়ে কী হিংসাই না পুষে রেখেছিল! একী পুরুষের অতি সাধারণ প্রবৃত্তি না কি কৌন্তেয়দের মধ্যের সাধারণ সাদৃশ্য? কর্ণও তো আসলে  কুন্তীপুত্রই। আরেক কৌন্তেয়। সেই টানেই কী এতখানি ঘৃণা উগরেছিল কর্ণ! ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা! আলিঙ্গনের উষ্ণতার পরিবর্তে উলঙ্গ করার আদিম শীতলতা! আর এই কীচকও! সেই এক সূতপুত্রই। এক থেকে আরেক। কর্ণ নিজে স্পর্শ করে নি তাঁকে, এই পর্যন্ত। আর এই কীচক তাঁকে পদাঘাত করল! কী ভীষণ শারীরিক আঘাতও পেয়েছিলেন। যদিও মনের ক্ষতের কাছে তা কিছুই ছিল না!
 
তাঁর মনে পড়ল, বিরাট রাজাকেও তিনি ছাড়েন নি। যুধিষ্ঠিরকেও না। গোটা সভা চুপ করে শুনেছিল তাঁর তিরস্কার। “আমাকে এই নীচ ব্যক্তি এইভাবে পদাঘাত করল জেনেও আমার সেই তেজস্বী বাহুবলী বীর্য্যবান পতিবৃন্দ কী করছেন? আর মহারাজ বিরাট! আপনিই বা কী বিচার করলেন! আপনার সামনে আপনার সেনাপতি আমাকে সকলের সামনে এমন অত্যাচার করল, আপনি তো তার কোনও প্রতিকারই করলেন না! এই কী রাজার কাজ!”
 
তাঁর জ্বালা ধরানো কথা শুনে বিরাট যা উত্তর দিলেন, ভাবলে এখনও তাঁর হাসি পায়। বিরাট বললেন, “তোমাদের কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছে, আমি তো তা ঠিক করে জানি না! না জেনে বিচার করব কী করে”! 
 
একটা ভীরু কাপুরুষ রাজা যা বলে আর কী! নিজে বুড়ো। কীচকের হাতেই রাজ্যের সম্পদ রক্ষার ভার। তাই কীচককে চটানো যাবে না। পাণ্ডবদের নিজের পরিচয় কোনও মতেই আগে জানানো যাবে না। স্ত্রীকে বলি দেওয়া যাবে বরং। আর দাসী হোক বা রাজরাণী, নাগরিক  সভ্যতায় নারী সব জায়গাতেই ক্রীড়নক। ক্ষমতা দেখানোর অস্ত্র। বরং অরণ্যের আঁধারে আলো অনেক বেশি। 
(এইখানে,  দ্রৌপদীর চোখে মহাভারতের ঘটনা দেখতে দেখতেও নিজের কিছু কথা বলতে বাধ্য হলাম। মেয়েদের ক্ষেত্রে বা কোনও বড়সড় ঘটনার দায় এড়াতে রাজনৈতিক নেতারা এই সময়েও এই ধরণের অজুহাত দিয়ে থাকেন। ‘আমি তো জানি না ঠিক কী হয়েছে’! ক্ষমতার আসনে থাকা মানুষের স্বভাব যুগ যুগ ধরে অপরিবর্তিতই থাকে।)
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত