অসিতের ফোন পেয়ে কৌস্তভ অফিস থেকে সোজা উপস্থিত হল শ্মশানে। সেখানে অসিতের পরিবারের লোকজন আর তার পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের ভিড়। সাদা কাপড়ে ঢাকা কাকিমার প্রাণহীন শরীরটা ইলেকট্রিক চুল্লীর অগ্নীগর্ভে প্রবেশের অপেক্ষায় শুয়ে রয়েছে নিথর ভাবে।
শ্মশানের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে অসিতের শান্ত কণ্ঠস্বর কৌস্তভের রক্তে বরফের শীতল স্পর্শের ছোঁয়া দিল –“কৌস্তভ, আমার নিজের বলে আর কেউ রইল না রে”।
ওর ভারী কণ্ঠস্বর কৌস্তভের হৃদয়ে যেন হাতুড়ির আঘাত হানল। সে একবার কাকিমার নিষ্প্রাণ মুখের শান্ত ঘুমন্ত নির্লিপ্ততাকে দর্শন করল। অতীতের অনেক দৃশ্য সরে সরে গেল তার মানসচক্ষুর পাতা ছুঁয়ে। সত্যিটাকে সে উপলব্ধি করল কাকিমা চলে গেছেন।
ফোনেই খবরটা দিয়েছিল অসিত। কৌস্তভ জেনে অবাক হয়েছিল। সুস্থ সবল মানুষটার হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া সে মেনে নিতে পারেনি। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তখনই। অফিস থেকে ছুটি করে দ্রুত রওনা দিয়েছিল।
শ্মশানে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কাকিমার মরদেহ মৃতদেহ বহনের গাড়ী স্বর্গযানের সওয়ারী হয়ে এসে গেছিল শহরের শেষ প্রান্তের এই শ্মশানে।
অসিত কৌস্তভের ছোট বেলার বন্ধু। তাদের একসঙ্গে পড়াশুনা, খেলাধূলা, একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। জীবনের সেই সব সুখের মুহূর্তে কাকিমার স্নেহ ভালোবাসা অনেকখানিই জড়িয়ে ছিল কৌস্তভকে। বছরের বেশীর ভাগ দিনই কাটত তার অসিতদের বাড়ীতে, তার মায়ের আদরে, ভালোবাসায়। সেই মাতৃসমা কাকিমা আজ ভোরে হঠাৎই চলে গেছেন ঘুমের ভিতরে, সবার অজান্তে। কৌস্তভের মনটা কেমন ভার হয়ে ওঠে। তার চোখের সামনে নিজের মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। বুকের ভেতরটা কে যেন খামচে ধরে সুতীক্ষ্ণ নখের প্রবল চাপে। মনটা বলে ওঠে – ‘মা! তুমি কোথায়?’
কৌস্তভের নিজের মা-র কথা মনে পড়ে যায় হঠাৎই। মনটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। ঠিক বেঠিক, ভালো মন্দর দোলাচালে ভাসতে থাকে তার আপন সত্ত্বা। বাঁশের চালিতে শুয়ে থাকা কাকিমার মুখে কয়েক মুহূর্তের জন্য মা-র মুখের ছায়া দেখে চমকে ওঠে সে। বুঝতে পারে কৌস্তভ শ্মশান-ই সেই জায়গা যেখানে নিজেকে আবিষ্কার করা যায়। পাপ পুন্যর হিসাব সেখানকার আবহাওয়ায় প্রকট হয়ে ওঠে। মুখোশের আড়ালের মুখটা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে চিতার আগুনের লেলিহান শিখার প্রচণ্ড তাপে, চামড়া পোড়ার কটূ গন্ধে আর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া চুল্লীর চিমনী নির্গত কালো ছাইয়ের উড়ন্ত অবশিষ্টাংশে।
(২)
পায়ে পায়ে কৌস্তভ নদীর ধারে এসে দাঁড়াল। জোয়ারের জল ঢুকছে। নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। ঢেউয়ের রেশ কৌস্তভের বুকের গভীরে।
কিছুক্ষন আগে কাকিমাকে ইলেকট্রিক চুল্লীর জ্বলন্ত গহ্বরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। দরজা বন্ধ হবার আগে শেষ বারের মত কাকিমার মুখটা চোখে পড়েছে কৌস্তভের। যদিও ক্ষণিকের তরে; পরক্ষনেই দুধার থেকে অগ্নি গ্রাস করেছে – চিতাতেই সব শেষ।
সত্যি এই তো জীবন। জন্ম আর মৃত্যু। মাঝের দিনগুলো শুধু স্বপ্নের খেলাঘর। চামড়া পোড়া কটূ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। চুল্লীর চিমনী দিয়ে ছাই আর কালো ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। কাকিমার শরীরটা ক্রমশঃ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে। বাস্তবে এরপর শুধু সত্যি হয়ে থাকবে কাকিমার ছবি। নামের আগে বসবে ঈশ্বর। আর থাকবে কিছু মূল্যবান স্মৃতি। অনেক দিন পর সেটাও হয়ে যাবে ক্ষীন, অস্পষ্ট।
চাকরী পাওয়ার পর বিয়ে হয়েছিল কৌস্তভের, মার পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে । তারপর সংসার নদীতে হাবুডুবু, চাকরীতে পদোন্নতি, সন্তানের দায়িত্ব। এসব সামলাতে সামলাতে স্ত্রীর ইচ্ছায় পৈত্রিক ভিটেতে ফ্ল্যাট বাড়ী। বাবার তৈরী বাড়ীর বাঘের খাঁচা ছেড়ে পায়রার খোপে জীবন যাপন, স্ট্যাটাস বজায় রাখতে। সঙ্গে উপরি পাওনা শ্বাশুড়ী বৌয়ের মনকষাকষি, টেলিভিশনের আধুনিক বাংলা সিরিয়ালের স্টাইলে। সবশেষে শেষ সিদ্ধান্ত – বৃদ্ধাশ্রম।
ছোটো ফ্ল্যাটে জায়গা সঙ্কুলান। অভিযোগ, পুরাতন মানুষের অ্যাডজাষ্টমেন্টের অভাব। ওখানে আরও ভালো থাকার প্রতিশ্রুতি সমবয়সীদের সখ্যতায়। তাই গর্ভধারিনীর ঠাঁই নাড়া অবস্থা পুরাতন আসবাবের মতন।
মা মেনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন – “তোরা যদি সুখি হোস তাহলে তাই হবে। আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমি ভালোই থাকব”।
সেদিন মা-কে দেখে মনে হয়নি মার মনে কোন কষ্ট হচ্ছে। তিনি হাসিমুখে সবাইকে আশীর্ব্বাদ করে ছেড়ে গিয়েছিলেন স্বামীর ভিটে। শুধু কৌস্তভের ছেলে অয়ন বলেছিল – “বাবা, ঠাম্মার আমাদের ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে না? ঠাম্মা একা থাকতে পারবে?”
প্রতিষ্ঠিত বাবা কৌস্তভের তার ছেলের সেই প্রশ্ন তখন কানের পর্দায় আঘাত করেনি। নতুন গিন্নী সর্বানীও গ্রাহ্য করেনি তার সন্তানের বাস্তব সংলাপ। মা গিরিবালাকে জীবনের শেষ দিনের জন্য গৃহত্যাগী হতে হয়েছিল এভাবেই।
অন্তরাল থেকে স্বামী অংশুমান তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন কিনা তা অবশ্য গিরিবালা বুঝতে পারেন নি একবারের জন্যও তবে স্বামীর একটা কথা মনে পড়েছিল – “আমি না থাকলে তোমার খোকাই তোমায় আগলে রাখবে। তুমি তো খোকা অন্ত প্রাণ। আর তাছাড়া খোকাই তো আমাদের একমাত্র সন্তান”।
আরো পড়ুন: গল্প: অচ্ছেদ্য । পার্থ ঘোষ
(৩)
বৃদ্ধাশ্রমে মুখোমুখি কৌস্তভ আর তার মা। শ্মশান থেকে সোজা মায়ের কাছে এসেছে সে। সে তার মায়ের দুটো হাত ধরে বলল – “মা, বাড়ী ফিরে চল। এখানে আর তোমায় থাকতে হবে না। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে”।
গিরিবালা ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। শান্ত স্বরে বললেন – “আমি তো এখানে ভালোই আছি। ফিরে গেলে তোদের অসুবিধা হবে। বৌমা হয়ত সেটা পছন্দ করবে না”।
- “না মা, তুমি আমার সঙ্গেই যাবে। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। খালি হাতে ফিরব না। আমি আসার পথে সর্বানীকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি; সংসার আমার, সেখানে আমার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। আমি বাড়ীর কর্তা। এই একটা ব্যাপারে আমি যা বলব তাই হবে। আমার মা আমার কাছেই থাকবে”।
- “কিন্তু তাতে সংসারে আশান্তি হতে পারে। তোর টেনশন বাড়বে। তুই কষ্ট পাবি”।
- “তুমি এত কিছুর পরেও আমার কথা ভাবো মা?”
- “মায়েরা সব সময়ই সন্তানের ভালোটাই চায় খোকা”।
- “না মা আমি তোমাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবই। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপাতত তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তারপর আমি অফিস থেকে লোন নিয়ে পাশের ফ্ল্যাটটা নেব, কিংবা অন্য কোন বড় ফ্ল্যাট; যেখানে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব। তুমি কিছু চিন্তা করো না। সব গোছগাছ করে নাও”।
- “কিন্তু!” দ্বিধান্বিত বোধ করেন গিরিবালা।
- “কোন কিন্তু নয় মা। আমি আমার ভুল শোধরাতে চাই। আমার জ্ঞান চক্ষু খুলে গেছে। মোহ কেটে গেছে। আমি ভুল করেছিলাম। মানুষ মাত্রেই তো ভুল করে মা। আর মানুষই সেই ভুল শোধরায়, তাই নয় কি? আমার ভুল আমি না শোধরালে আমার ছেলে কি শিখবে মা? সে ও তো ভুল করবে, এটাই স্বাভাবিক, তাই নয় কি? তুমি তো ছোটবেলায় আমার অনেক ভুল ক্ষমা করে দিতে, পারবে না মা এই বড় ভুলটাকে শেষবারের মত ক্ষমা করতে? দেখ, আমি আর কখনও ভুল করব না। বড় হলেও আমি তো এখনও তোমার কাছে ছোটোই, মা। তোমার সেই খোকা। কি পারবে না মা আমায় ক্ষমা করতে?”
গিরিবালা ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলোতে থাকেন সেই ছোটোবেলার মতন। কৌস্তভ চুপচাপ সেই আদর খেতে থাকে মায়ের বুকে মাথা রেখে। তার দু’চোখ বেয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। তার মনে হয় এই অশ্রু শুধু চোখের জল নয় । তার মনের ভেতরে জমে থাকা ভুল গুলো গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। সে অনুভব করে মা-র চোখের জলও তার মাথায় আশীর্ব্বাদ বর্ষন করছে। সে বুঝতে পারে মা তাকে ক্ষমা করেছে। মা তার খোকাকে মাপ করেছে।
শ্মশানের নদীর ধারে দাঁড়িয়েই মনস্থির করে ফেলেছিল কৌস্তভ। কাকিমার চিতাভষ্ম যখন অসিত জল দিয়ে নেভাচ্ছিল আর সেই জ্বলন্ত গরম চিতাভষ্ম জলের স্পর্শে ছ্যাঁক্ শব্দে আর্তনাদ করে উঠেছিল সঙ্গে গরম ভাপ ছুটে এসেছিল একঝলক, তখনই কৌস্তভের মনে পরিবর্ত্তন এসেছিল। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছিল। অনুভব করেছিল – মা হারালে মা পাওয়া যায় না। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী জিনিসকে সে যে হেলায় হারাচ্ছে এই অনুভূতি তার সারা শরীর মন ছেয়ে ফেলেছিল শ্মশানের সেই শান্ত পরিবেশে। চিতাভষ্মের ‘ছ্যাঁক্” শব্দে হৃদপিণ্ডে ছ্যাঁকা খেয়েছিল সে। নিজেকে শক্ত করে নদীর ধারে এসে মোবাইলে সর্বানীকে রিং করে বলেছিল – “আমি শ্মশান থেকে ফেরার পথে মা-কে নিয়ে বাড়ী ফিরব। আমাদের ছোটো ঘরটা মার বসবাসের উপযুক্ত করে রেখো”।
সর্বানী জিজ্ঞেস করেছিল – “হঠাৎ! কিন্তু, এখানে মা কি করে থাকবে?”
কৌস্তভ বলেছিল – “যেভাবে আমরা থাকি, মা সেভাবেই থাকবে। পরের ব্যাপারটা পরে ভাবা যাবে। যাতে অসুবিধা না হয় তার ব্যবস্থা করব খুব শিঘ্রই। তুমি না করো না। আমায় ভুল শুধরোতে দাও। দেখো আমাদের ভালোই হবে”।
এরপর আর সর্বানী কোন কথা বলেনি। কৌস্তভ ফোন কেটে দিয়েছিল। তারপর সোজা ট্যাক্সি ধরে চলে এসেছিল বৃদ্ধাশ্রমে।
মা ছেলের স্নেহের বন্ধনে বেশ কিছুটা সময় কেটে যাবার পর কৌস্তভ মার চোখের জল মুছে দিল তার দু’হাতের তালু দিয়ে। মুখে বলল – “মা, তুমি সব কিছু গুছিয়ে নাও। আমি কাগজপত্রে সই-সাবুদ করে আসি অফিস ঘরে গিয়ে”। মার মুখের হাসি অনেকদিন পর কৌস্তভকে আনন্দ দিল।
(৪)
মাকে নিয়ে ট্যাক্সি ছুটে চলছে রাজপথ ধরে কৌস্তভের ফ্ল্যাটের দিকে। বহুদিন পর মা আর ছেলে পাশাপাশি। মা এখন অনেকটা আগের মত। গাড়ীর জানলা দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে অনেক কথা, অনেক গল্প, অনেক খবর আদানপ্রদান হচ্ছে দুজনের মধ্যে। ছেলে খুশি। খুশি মা। নাতি তো ঠাম্মাকে দেখে খুশি হবেই। শুধু সর্বানীকে যদি একটু বোঝান যায় তাহলেই সংসারে সুখের হাট বসবে। একটু সুখের জন্য এই শক্ত কাজটার দায়িত্ব সে নিজেই নেবে। তাকে নিতেই হবে। সবাই যদি এভাবে তার বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখতে পারে তবে একদিন বৃদ্ধাশ্রম বলে কিছুই থাকবে না। বয়স্করাও কষ্ট পাবেন না, তাদের ও আর নিজের লোকদের ছেড়ে থাকতে হবে না।
কৌস্তভের আজকের আনন্দমাখা মনটায় এখন পুরাতন হিন্দি সিনেমার সেই বহু প্রশংসিত ডায়লগ বারংবার উচ্চারিত হয়ে উঠছে – “মেরে পাস মা হ্যায়”।

স্কুল জীবন থেকেই লেখার শুরু। ছোট, বড়, মাঝারি ও অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি। লেখাকে পেশা হিসেবে নয়, নেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরে, লেখায় মগ্ন থাকাই ভালোবাসা। ভালো লাগে শব্দ সাজিয়ে সাহিত্যের মালা গাঁথতে। ভালোলাগে নানান ধরনের বই পড়তে । ছোটগল্প বা অণুগল্প খুব প্রিয়।