গল্পপাঠ শুরু হবে। সভাঘর পূর্ণ। সঞ্চালক সামান্য ভূমিকা করে এবার গল্পপাঠে অংশগ্রহণকারী গল্পকারদের নাম ঘোষণা করলেন। দেখলেন, আটজনের মধ্যে পাঁচজন হাজির সেই মুহূর্তে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এ ব্যাপারে সবাই নিয়ম মানেন না। কেউ কেউ একটু দেরি করে আসেন, কেউ আসেন না আমন্ত্রণ সত্ত্বেও। যাই হোক, এবার শুরু করতেই হয়। কারণ, এর পরেই কবিতাপাঠের আসর বসবে। সঞ্চালক গল্পপাঠের নিয়মাবলী এবং ধার্য সময়সীমা বলে দিলেন। আট মিনিটের মধ্যে একজনের পাঠ শেষ হলে ভাল হয়। তখন একটা সতর্কীকরণ ঘণ্টা বাজবে। তারপর সর্বোচ্চ আর দু’মিনিট সময় দেওয়া যেতে পারে। তখন অন্তিম ঘণ্টা বাজবে। আর সময় দেওয়া যাবে না। ঘোষণা অনুযায়ী পরবর্তী গল্পকার শুরু করবেন তারপর।
প্রথমজন শুরু করলেন গল্পপাঠ সামান্য ভূমিকা করে। এটা অনেকে করে থাকেন, কিন্তু না-করলেও চলত। তবে সবই ওই আট-দশ মিনিটের মধ্যে। আট মিনিটের মাথায় একটা ঘণ্টা বাজল। গল্পকার সতর্ক হলেন। এবার দশ মিনিটের মাথায় অন্তিম ঘণ্টা বাজল। একি! এখনও শেষ হচ্ছে না! সঞ্চালক উশখুশ করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, কী করা উচিত। এবার হ্যান্ড মাইকটা হাতে নিলেন কিছু বলার জন্য। ঠিক তখনই গল্পপাঠ শেষ হল। সঞ্চালক অভিনন্দন জানালেন গল্পকারকে। তবে একথাও বললেন শেষে, দশ মিনিটের পরেও আরও তিন মিনিট সময় নিয়েছেন তিনি। এবার পরবর্তী গল্পকারদের অনুরোধ করলেন সঞ্চালক – এটা করবেন না প্লিজ, কারণ, আরও গল্পকাররা আছেন, তাঁরা যেন সময় পান। কথাগুলো বলে সঞ্চালক দ্বিতীয়জনের নাম ঘোষণা করলেন। তিনি একজন প্রবীণ গল্পকার। মঞ্চে উঠে প্রথমেই তিনি বললেন, গত তিরিশ বছরে তিনি প্রায় পাঁচশো গল্প লিখেছেন কিন্তু তাঁর গল্প বেশ সুদীর্ঘ। তিনি নাকি আট-দশ মিনিটের গল্প লিখে উঠতে পারেননি এতদিনেও। সভাঘরে উপস্থিত গল্পকাররা এবং শ্রোতারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। সঞ্চালক এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসেছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে একটু হতাশ দৃষ্টিতে তাকালেন প্রবীণ গল্পকারের দিকে। তবে প্রবীণ মানুষ, বলার ধরনই অন্যরকম। পরক্ষণেই তিনি আশ্বস্ত করলেন এই বলে – এই অনুষ্ঠানে গল্পপাঠের জন্য তিনি জীবনে এই প্রথম আট-মিনিটের উপযোগী একটা গল্প লিখেছেন। উপস্থিত সকলের মুখে হাসি ফুটল। সঞ্চালক স্বস্তির হাসি হাসলেন।
আরো পড়ুন: গল্প: সুরত মিয়ার হাল হকিকত । মাহমুদ সানা
গল্পপাঠ শুরু করলেন প্রবীণ গল্পকার। আট মিনিটের ঘণ্টা বেজে গেল। তারপর দশ মিনিটের ঘণ্টা একইভাবে। সভাঘরে উপস্থিত সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন পরস্পরের দিকে। গল্পপাঠ চলতে থাকল। সঞ্চালক অসহায়। নিজের ঘড়ির দিকে চট করে একবার তাকিয়েই আবার তাকালেন সামনের দিকে, তারপর গল্পকারের দিকে তাকালেন সঞ্চালক। প্রবল অস্বস্তিতে তিনি চেয়ারে বসেই নড়েচড়ে উঠছেন মাঝে মাঝে। মুখে কিছু বলতে পারছেন না। প্রবীণ মানুষ। কীই বা বলবেন! সবসমেত পনের মিনিট লাগল গল্প শেষ হতে। বোধ হয় মন দিয়ে গল্প শোনার চাইতে সময়ের কথা ভাবছিলেন অনেকে।
এর পরের গল্পকার বেশ ভালোই পড়লেন এবং নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ করলেন।
এবার চতুর্থ গল্পকার। সঞ্চালক বেশ হতাশ হলেন এই চার নম্বর গল্পকারকে দেখে। তিনি হাতে বেশ একতাড়া কাগজ নিয়ে উঠেছেন। না জানি, তাঁর গল্প কত দীর্ঘ হবে। তক্ষুনি একটা বুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়। তিনি সভাঘরে উপস্থিত গল্পকারদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “কারা এখনও গল্প পড়েননি হাত তুলবেন প্লিজ!” চারজন হাত তুললেন। অর্থাৎ পরে আরও তিন জন এসে গেছেন। এবার চতুর্থ গল্পকারকে উদ্দেশ্য করে সঞ্চালক বললেন, “আপনি কিন্তু ঠিক আট মিনিটের বেশি সময় নেবেন না। তার কমে শেষ করতে পারলেই ভালো হয়। বুঝতেই তো পারছেন, আপনার পরে আরও চারজন আছেন।“ গল্পকার হেসে বললেন, “না, না, আমি কাটছাঁট করে সংক্ষিপ্ত আকারে বলব।“ সঞ্চালক মনে মনে ভাবলেন, সে আবার কীরকম! আচ্ছা, দেখাই যাক! আরও কত দুর্ভোগ লেখা আছে কপালে, কে জানে!
চতুর্থ গল্পকার কাগজ না দেখে গল্প বলা শুরু করলেন। এটাকে কি গল্পপাঠ বলা যায়! যাই হোক, এখন সংক্ষিপ্ত সময়ে যা হয় তাই ভালো। সময়টা বেশি জরুরি এখন। মনে মনে ভাবলেন সঞ্চালক, ইনি তাহলে বেশ সমঝদার মানুষ। এইভাবেই শেষ করবেন তাহলে। কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন সঞ্চালক। গল্পকার বলে চলেছেন। তারপর থামলেন একটু। এবার বলে উঠলেন, “একজন মত্ত স্বামী নেশার ঘোরে তার বউকে মারধোর করে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে গভীর রাতে। বুঝুন, মেয়েটির মনের অবস্থা কিরকম হয় … এবার পড়ে শোনাচ্ছি আমি।“ কথাগুলো বলেই গল্পকার তার হাতে-ধরা কাগজের তাড়া থেকে একটা কাগজ বার করে পড়া শুরু করলেন। সঞ্চালক তখন ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সর্বনাশ! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন প্রায় আট মিনিট অতিক্রান্ত। ঘণ্টা পড়ল। গল্পকারের ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি পড়ে চলেছেন। এবার দশ মিনিটের ঘণ্টা। গল্পকার দৃপ্তকণ্ঠে পড়ে চলেছেন। সঞ্চালক তখন হাতঘড়ি দেখছেন, চাঞ্চল্য সারা শরীরে। হাতের সামনেই ঘণ্টা। কিন্তু, আর তো বাজানো যাবে না। নিয়ম নেই। ওদিকে আরও চারজন বসে আছেন। গল্পকার পড়ে চলেছেন তার তিন নম্বর পাতা। ততক্ষণে পরবর্তী অনুষ্ঠানের জন্য কবিরা আসতে শুরু করেছেন এক এক করে। সঞ্চালক গল্পকারকে একবার কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে মঞ্চের উপর একটু হাঁটলেন, আবার বসে পড়লেন। তার চিত্তচাঞ্চল্য বাইরের অঙ্গসঞ্চালনে প্রকাশ পাচ্ছে। হঠাৎ অসাবধানে নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে তার হাত ঘণ্টাতে লেগে গেল। ঘণ্টা বেজে উঠল। তিনি নিজেই একটু অপ্রস্তুত হলেন ঘণ্টার আওয়াজ শুনে। এটা তো নিয়ম বহির্ভূত ব্যাপার হয়ে গেল তার দিক থেকে। কিন্তু, গল্পকার নির্ভীক। ঘণ্টার আওয়াজে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি তখন চার নম্বর পাতায়। সঞ্চালক এবার রেগে উঠে বললেন, “আপনি থামুন এবার।“ গল্পকার ডান হাতের ইশারায় সঞ্চালককে যেন আশ্বাসবাণী দিলেন, অর্থাৎ এইবার তিনি থামবেন, আর, বাহাতে ধরা কাগজটি পড়ে চললেন আগের মত। সভাগৃহে ততক্ষণে গুঞ্জন কোলাহলের পর্যায়ে চলে গেছে। সঞ্চালক বেশ অপমানিত বোধ করলেন গল্পকারের এহেন ব্যবহারে। আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না তিনি। উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে, তারপর ‘প্লিজ স্টপ’ ‘প্লিজ স্টপ’ বলে সজোরে টেবিল চাপড়াতে লাগলেন। গল্পকার তড়িতাহতের মত থেমে গেলেন মুহূর্তে। সভাগৃহ স্তব্ধ হয়ে গেল। তখন পিন পড়লেও আওয়াজ শোনা যেত। কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ। সঞ্চালক উত্তেজনায় কাঁপছেন। তিনি কোনো কথা বলছেন না। শুধু কাঁপছেন। সবাই তখন তাঁর দিকে তাকিয়ে। তারপর কী হল কে জানে! তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে রইল। তিনি নির্বাক, নিঃস্পন্দ। মঞ্চের আশপাশে যারা ছিলেন তাদের দু’একজন ছুটে গিয়ে সঞ্চালককে বলতে থাকলেন,
“কী হল স্যার? কী হল?”
কোন সাড়াশব্দ নেই। উপস্থিত গল্পকারদের মধ্যে একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক তাঁর আসন ছেড়ে ছুটে গেলেন মঞ্চের দিকে। তাঁর গল্পপাঠ তখনও বাকি ছিল। তিনি আবার পেশায় ডাক্তার। সবার উদ্দেশে সেই গল্পকার ডাক্তার একরকম চিৎকার করেই বলে উঠলেন,
“প্লিজ সরুন আপনারা। আমাকে একবার দেখতে দিন।“
কথাগুলো বলেই তিনি সঞ্চালকের হাতটা টেনে নিয়ে পালস দেখতে লাগলেন। রুদ্ধনিঃশ্বাসে সবাই তাকিয়ে আছেন সঞ্চালকের দিকে। মিনিটদুয়েক বাদেই ডাক্তার গল্পকার নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন,
“ওহ্ মাই গড! হি হ্যাজ এক্সপায়ারড!”
সভাগৃহ স্তব্ধ হয়ে গেল। উপস্থিত সবাই উঠে দাঁড়ালেন মাথা নিচু করে। সেভাবেই দু-তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেন সবাই। পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু হল যথারীতি নিয়মমাফিক।
৫ জানুয়ারী ১৯৫৩ কলকাতায় জন্ম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা। নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নিয়ে পি এইচ ডি। ১৯৯১ – ২০০২ কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বিষয়ে তারাতলার ইন্সটিটিউট অব হোটেল ম্যানেজমেন্টে অধ্যাপনা। ২০০২ – ২০১৩ কলকাতার নেতাজীনগর ডে কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে অধ্যাপনা। তারপর প্রথাসম্মত অবসর। অবসরের পর পাঁচ বছর ধরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট লেকচারার। কলেজ জীবন থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথমদিকে কবিতা, তারপর নিয়মিত গল্প লেখা (ছোটোগল্প, অণুগল্প) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় (যেমন কথাসাহিত্য, শতানীক, মৈত্রীদূত, নবাবী, দিবারাত্রির কাব্য, ইরাবতী ওয়েব ম্যাগাজিন, অভিব্যক্তি আড্ডা নিউ জার্সি, অপার বাংলা ওয়েব ম্যাগাজিন ইত্যাদি)। পাশাপাশি প্রবন্ধ লেখা, ভ্রমণ (অবসর, নিউ জার্সিতে প্রকাশিত), বিদেশি গল্পের অনুবাদ (ইরাবতী, অব্যয় এবং মৈত্রীদূত-এ প্রকাশিত) রম্যরচনা এবং বইয়ের রিভিউ তো করতেই হয়। এখন পুরো সময়টা কাটে সাহিত্য চর্চায়। এছাড়া কোভিডের সময় থেকে সাড়ে তিন বছরের ওপর হয়ে গেল, গুগল মিটে “ফোনগল্পের আসর” নামে একটা অনলাইন গল্পের আসর চলছে আমার সঞ্চালনায়। প্রত্যেক মাসে একটি করে। দেশ-বিদেশের প্রচুর গল্পকার আমাদের এই অনুষ্ঠানে গল্পপাঠ করে থাকেন। বছরে দুটি করে এই আসরের তরফ থেকে শুধুমাত্র গল্প নিয়ে পাঁচটি ডিজিটাল সংখ্যা এবং তিনটি মুদ্রণ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। আসন্ন পুজো সংখ্যা ১৪৩১-এর (মুদ্রণ) কাজ চলছে এই মুহূর্তে।
নিজের রচনায় ‘কণিকামাত্র’ এবং ‘অণুরেণু’ অণুগল্পের দু’টি সংকলন। ‘গল্প পঞ্চদশ’ পনেরোটি ছোটোগল্পের একটি সংকলন। খুব সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সেরা একুশ’ একুশটি ছোটোগল্পের সংকলন। এছাড়া রয়েছে একটি উপন্যাস ‘কোভিডের দিনগুলি’।