| 26 এপ্রিল 2024
Categories
ইতিহাস লোকসংস্কৃতি

লোকসংস্কৃতি: চড়ক গাজনের ইতিকথা । রানা চক্রবর্তী

আনুমানিক পঠনকাল: 19 মিনিট
বাংলার লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে গাজন এক উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্ম কেন্দ্রিক উৎসব নয়, এর জনপ্রিয়তা একে এক যথার্থ লোক উৎসবের মাত্রা দান করেছে। বাংলার গ্রামীণ জীবনের জনপ্রিয় ‘লোকউৎসব’ হল গাজন অনুষ্ঠান। বাংলার কৃষক সমাজের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয় এই লোকউৎসব। গাজন সে অর্থে কৃষিকর্মের অংশ নয়, এটি যে সময় পালন হয় তখন মাঠের ফসল ঘরে তোলা হয়ে গেছে তাই তাঁদের কাছে অঢেল সময় আর এই সময় কাটাতেই তাঁরা বেছে নেন এই লোকউৎসবকে। মূলতঃ বাংলার ‘রাঢ় অঞ্চলের’ ‘দুর্গাপুর’, ‘আসানসোল’, ‘অজয় ও দামোদর নদীর তীরের বীরভূম অঞ্চল’, ‘মানভূম’, ‘বর্ধমান’, মুর্শিদাবাদে’ও পালিত হয় এই লোকউৎসব। পশ্চিমবঙ্গ বিভিন্ন ধর্মের মিলনস্থল হওয়ায় এখানকার বিভিন্ন উৎসবেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়, গাজনও তার ব্যাতিক্রম নয়। আর সেই জন্যই ‘বৌদ্ধ’, ‘জৈন’, ‘হিন্দু ধর্মের’ বিভিন্ন রীতির প্রতিফলন দেখা যায় এই উৎসবে। সারা বছরের বিভিন্ন সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তরে গাজন পালিত হয়ে থাকে। শিবের গাজনের সাথে সাথে ‘নীলের গাজন’, ‘ধর্মঠাকুরের গাজন’ও সমানভাবে জনপ্রিয়। এর জনপ্রিয়তা যে কতটা তা আমরা বিভিন্ন সাহিত্যে এর উল্লেখ দেখেই আন্দাজ করতে পারি। ’শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের’ অনেক উপন্যাসেই পল্লীচিত্রের বর্ণানায় এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের’ ‘পঞগ্রাম’ উপন্যাসেও এর উল্লেখ আছে। ‘দীনেন্দ্রকুমার রায়’ তাঁর ‘পল্লীচিত্র’ জাতীয় একাধিক স্মৃতিকথায় সেকালের গাজনের এক জীবন্ত চিত্র নথিবদ্ধ করে গেছেন, যা বর্তমান গবেষকদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে গণ্য হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী ‘হরকালী’র সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা ‘বরযাত্রী’ হিসেবে অংশ নেন। অন্যদিকে, ‘ধর্মঠাকুরের গাজন’ হল ‘ধর্মঠাকুর’ ও ‘দেবী কামিনী-কামাখ্যা’র (বাঁকুড়া জেলা), ‘দেবী মুক্তি’র বিবাহ উৎসব। ‘রাঢ়বঙ্গের শৈব-সংস্কৃতি’র একটি বিশেষ অঙ্গ হচ্ছে ‘গাজন’। গাজন অর্থে (‘গাঁ’ = ‘গ্রাম’, ‘জন’ = ‘জনগণ’) গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসব। ‘নবদ্বীপ মহিমা’র লেখক ‘কান্তিচন্দ্র রাঢ়ি’ ‘গাজন’-কে ‘ধর্মগাজনের অপভ্রংশ’ বলেছিলেন। গাজন বিষয়ে ভারতকোষকার জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের লৌকিক উৎসব। ইহা নিম্নশ্রেণির লোকের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। … বাংলাদেশে ইহা নানা পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নামের সহিত যুক্ত হইয়াছে, যেমন শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন, আদ্যের গাজন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য এবং তাহার পত্নী বলিয়া কল্পিত পৃথিবী। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য। চৈত্র মাস হইতে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও সুবৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করিয়াছিল। গ্রাম্য শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করিয়া এই উৎসবের অনুষ্ঠান হয়।’’ যে শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের কদিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পূজা গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা অবহেলা নেই। এ কদিন সবাই সমান মর্যাদায় সমাসীন। এখানেই শৈব সংস্কৃতির সঠিক উত্তরণ। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে ‘গণদেবতা’। গাজন যে মূলতঃ শিবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয় তা আগেই বলা হয়েছে। তবে বাংলায় অতীতে জৈন ধর্মের অস্তিঃত্ব থাকায় শিব ছাড়াও আরও অনেক দেবতা পূজিত হন। তাঁদের মধ্যেই একজন হলেন ‘ধর্মঠাকুর’। যিনি সূর্যের দেবতা হিসেবে পূজিত হন। প্রাক্‌ দ্রাবিড় যুগ থেকেই রাঢ় অঞ্চলে ধর্মঠাকুরের পূজা হয়ে আসছে। লোকবিশ্বাস ধর্মঠাকুরের পূজা প্রসঙ্গে বলা চলে, বাংলার বহু গ্রামে নরনারী রোগ থেকে সুস্থ হবার জন্য, নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান লাভের আশায় এবং চাষীরা অনাবৃষ্টিতে বৃষ্টি হওয়ার আশায় এই পূজা করে থাকেন। একটি নিরাকার পাথরকে, গাছের মাঝখানে বা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা হয়। সারাবছর ধরে পূজিত হন ধর্মঠাকুর। পূর্ণিমাতে বিশেষ পূজার আয়োজন ও করা হয়। তবে অনেক স্থানে ‘কূর্মমূর্তি’, ‘চৌকো’, কোথাও বা একাধিক শিলাখন্ড কে পূজা করা হয়ে থাকে। ধর্মঠাকুরের পূজারী মূলতঃ ‘ডোম’, ‘বাগদী’, ‘জেলে’ হলেও অনেক স্থানে ব্রাহ্মণ পূজারীও রয়েছেন। ‘ধর্মরাজের বাৎসরিক পূজা বা গাজন-উৎসব’ সাধারণতঃ ‘বৈশাখী বুদ্ধ পূর্ণিমা’, ‘জৈষ্ঠ পূর্ণিমা’, ‘পৌষ সংক্রান্তি’ বা কোন নির্ধারিত দিনে (যা ‘আপন-গাজন’ নামে পরিচিত) অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ধর্মরাজের গাজনেও শিবের গাজনের মতো ‘বাণফোঁড়া’, ‘কাঁটাঝাঁপ’, ‘ধুনা পোড়ানো’, ‘বটিঁ ঝাঁপ’ ইত্যাদি হয়ে থাকে। বর্ধমান জেলায় শতাধিক ধর্মঠাকুরের পূজা-উৎসব, অনুষ্ঠান বিভিন্ন রীতি বা পদ্ধতিতে, বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন সম্প্রদায় কতৃক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ধর্মঠাকুরের বাৎসরিক পূজা ও উৎসব উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন স্থানে মেলা ও বসে। যার মধ্যে জামালপুরের মেলাটি সব থেকে বড়। ওদিকে শিব বা মহাদেব ‘নীল’ নামেও পরিচিত। ‘নীলের বিবাহ’ হচ্ছে ‘পার্বতী’র সাথে। তাঁদের বিয়ে উপলক্ষেই এই গাজন পালিত হয়ে থাকে। বিশেষতঃ বিবাহিত মহিলারা শিবকে পূজা করে থাকেন। সারাদিন উপবাস যাপন করার পর তাঁরা শিবের মাথায় দুধ ঢেলে উপবাস ভেঙে থাকেন। সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই পূজা করা হয়ে থাকে। এই গাজন ও চৈত্রমাসে হয়ে থাকে।
ভারতের যে সকল প্রাগৈতিহাসিক দেবতা পরবর্তীকালে হিন্দু সমাজেও নিজেদের প্রতিষ্ঠা স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের মধ্যে শিব সর্বপ্রধান। এটা থেকে স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায় যে, এই দেশের তৎকালীন প্রাগ-বৈদিক সমাজে শৈবধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিল। মহেঞ্জোদাড়োর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকেও এই বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায়। সেই কারণে গবেষকরা মনে করেন যে, বর্তমানে ভারতের যে অঞ্চলে আর্যেতর জাতির লোক বেশি সংখ্যায় বাস করেন, সেই অঞ্চলেই শৈবধর্মের ও যে অঞ্চলে আর্যভাষী জাতির বংশধরগণ অধিক পরিমাণে বাস করেন, সেই অঞ্চলেই বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। আদতে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বঙ্গদেশ থেকে বহুদূরবর্তী অঞ্চলে উদ্ভূত হয়েছিল, কালক্রমে তা বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হবার পূর্বেই তাকে প্রাগার্য (Pre-Aryan) শৈবধর্মের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল। অতএব বঙ্গদেশে প্রথম থেকেই যে শৈবধর্মের প্রচার হয়েছিল, তার সঙ্গে আর্যেতর সমাজের উপাদান আগে থেকেই মিশ্রিত ছিল। শুধু তাই নয়, অনার্য দেবতা শিব ইতিপূর্বেই আর্য সমাজে একটি বিশিষ্ট স্থান লাভ করে স্বকীয় মহিমায় স্বয়স্প্ৰতিষ্ঠ হয়েছিলেন। বৈদিক রুদ্র দেবতার মধ্যেই অনার্য উপকরণ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। অতএব, দেখতে পাওয়া যায় যে, বৈদিক দেব-সমাজের মধ্যেই এই অনার্য দেবতা নিজের জায়গা করে নেবার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তী পৌরাণিক সাহিত্যে রুদ্র দেবতার এই বৈদিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানী বুদ্ধের অনুকরণে তাঁর এক শান্ত সমাহিত শিবমূর্তির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। মহেঞ্জোদাড়োতে আবিষ্কৃত শীলমোহরগুলির মধ্যে যোগাসনারূঢ় এক দেবমূর্তির পরিচয় থেকে মনে করা হয় যে, যোগীন্দ্র শিবের পরিকল্পনা প্রাগার্য (Pre-Aryan) সমাজ থেকে সৃষ্টি হয়েছে; এবং কালক্রমে সেটাও পৌরাণিক কল্পনার মধ্যে এসে সন্নিবিষ্ট হয়। এইভাবে ভারতীয় পৌরাণিক সমাজ, রুদ্র, শিব ও যোগীর চরিত্রের মধ্যে কোন প্রকার সামঞ্জস্য স্থাপন করার চেষ্টা করেছে। সেই জন্য একদিকে এই দেবতা যেমন ঘোর, ভৈরব ও রুদ্র, আবার অন্যদিকে তেমন অঘোর, শিব ও দক্ষিণ – আবার তিনিই যোগীশ্বর ও যোগীন্দ্র। পৌরাণিক সাহিত্যের মাধ্যমেই প্রধানতঃ আর্যধর্ম বঙ্গদেশে প্রচারিত হয়েছিল বলে এই দেবতার চরিত্রগত ভিন্নমুখী এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রথম থেকেই এই বঙ্গদেশে প্রচার লাভ করেছিল বলে গবেষকরা মনে করেন – কোথাও তিনি মঙ্গলকারী দেবতা আবার কোথাও তিনি ভয়ানক রুদ্র। শিবের এই দুটি প্রধান চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের উপরেই বাংলার লৌকিক শৈবধর্মের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। বাইরে থেকে আগত শৈবধর্ম বঙ্গদেশের সমাজের উচ্চস্তরেই সর্বপ্রথম প্রচারিত হয়েছিল, এবং সেখান থেকেই ক্রমে তা নিম্নতর সমাজেও প্রসার লাভ করে। কিন্তু নিম্নতর সমাজের মধ্যে প্রচারিত হয়ে এই শৈবধর্ম তার পৌরাণিক আদর্শ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। নিম্নতর সমাজ নিজস্ব সংস্কারের ভিত্তির উপরে উচ্চতর সমাজ থেকে সর্বদা তার সব বিষয়ে প্রেরণা লাভ করে থাকে, কিন্তু প্রকৃত মানসিক শিক্ষার অভাবে যে সকল উপকরণ উচ্চতর সমাজ থেকে তাতে গৃহীত হয়, তার মধ্যে যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হতে পারে না – নিম্নতর সমাজের সংস্কার অনুসারে তারা নতুন রূপে পুনর্গঠিত হয়। অনেক সময়ে তারা এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় যে, তাদের মৌলিক পরিচয় উদ্ধার করাই কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। পৌরাণিক শৈবধর্ম যখন উচ্চতর হিন্দুসমাজ থেকে ক্রমে নিম্নতর সমাজের মধ্যেও প্রচার লাভ করল, তখন এই ভাবেই তা নতুন রূপ লাভ করল – তা বঙ্গদেশের সর্বত্র যে অভিন্ন হল তা নয়; কারণ বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় অবস্থার উপরে ভিত্তি করেই এই নতুন পরিকল্পনার সৃষ্টি হয়েছিল। এরজন্য এর মধ্যে আদর্শগত অনৈক্যও অনেক সময়ে তৈরি হয়েছিল। ক্রমে মূল পৌরাণিক আদর্শ থেকে এই সকল স্থানীয় পরিকল্পনা অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। বঙ্গদেশে আর্যসভ্যতা বিস্তৃতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, উত্তর বিহার বা মগধ থেকে এর সংলগ্ন অঞ্চল উত্তরবঙ্গেই আর্যসভ্যতা সর্বপ্রথম বিস্তৃতিলাভ করেছিল এবং উচ্চতর সমাজ থেকে তা তদানীন্তন উত্তরবঙ্গের অধিবাসী নিম্নতর সমাজের মধ্যেও প্রচারিত হয়। শৈবধর্ম বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করার আগেই উত্তরবঙ্গের সাধারণ জনসমাজের মধ্যে প্রচারিত হয়ে সেই অঞ্চলে একটি স্থানীয় রূপ লাভ করেছিল। এই পরিকল্পনা অনুসারে শিব ছিলেন একজন কৃষক। বলা বাহুল্য যে, উত্তরবঙ্গের সাধারণ কৃষক সমাজেই শিবের এই অভিনব পরিকল্পনা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কৃষক হলেও প্রত্যক্ষ কৃষিকাজে তাঁর অসীম অনাসক্তি। অবশ্য এই অনাসক্তির ভাবটুকু তাঁর চরিত্রের উপরে পৌরাণিক চরিত্রেরই প্রভাবের ফল বলতে হয়। কৃষিকাজে ঔদাসীন্যের জন্যই তিনি নিত্য-সাংসারিক অভাব অনটনের যন্ত্রনা ভোগ করে থাকেন। এই অস্বচ্ছলতার জন্য তিনি কৃষিকাজে মনোযোগী না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে থাকেন। এইভাবে বাংলার কৃষকগণ একদিকে যেমন কৃষিকার্য দেববৃত্তি বলে নির্দেশ করে এর উপরে এক অপরূপ গৌরব দান করেছিল, আবার অপর দিকে তেমনি ভিক্ষা করাকেও দেব-বৃত্তি বলে উল্লেখ করে নিষ্ক্রিয় জীবনের মহিমা কীর্তন করেছিল। পৌরাণিক অকিঞ্চন শিবের পরিকল্পনার উপরেই ভিক্ষুক শিবের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, অবশ্য এর মধ্যে বৌদ্ধধর্ম থেকে আগত ভিক্ষুজীবনের আদর্শও কিছুটা কার্যকরী হয়েছিল বলে গবেষকরা মনে করেন। বলা বাহুল্য, এদের সঙ্গে শিবের কৃষক চরিত্রের কোন রকমের সামঞ্জস্য স্থাপন করা যায় না। কৃষিকাজ ছাড়াও বঙ্গদেশের শিব চরিত্রের উপরে আরও কয়েকটি গুণ আরোপ করা হয়েছিল – তা তাঁর ভাঙ ও গাঁজায় আসক্তি। শিবের বিষপানের পৌরাণিক কাহিনীকে সেকালের বাঙালি কৃষকগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও রুচি অনুসারে এইভাবে রূপান্তরিত করে নিয়েছিল; এইভাবে দেখতে পাওয়া যায় যে, বঙ্গদেশের শিব একদিকে একজন অলস কৃষক, আবার অন্যদিকে তিনি গাঁজা-ভাঙে প্রবলভাবে আসক্ত।
বঙ্গদেশে আর্যসভ্যতা বিস্তারের পূর্বে উত্তরবঙ্গে কোচ নামে এক জাতি বাস করত। তাঁদের প্রধান বৃত্তি ছিল কৃষিকাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক আদিম জাতির ইতিহাস আলোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, যে সকল জাতির মধ্যে কৃষিকাজ প্রচলিত আছে, তাঁদের মধ্যে কৃষিকাজের জন্য এক দেবতার পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে। কোন কোন জাতির মধ্যে আবার তিনি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির দেবতা (Fertility God) বলে পূজিত হয়ে থাকেন। তিনি কখনও স্ত্রী-রূপে আবার কখনও পুরুষ-রূপে পরিকল্পিত হন। উক্ত কোচ জাতির মধ্যেও এই শ্রেণীর এক দেবতা ছিলেন বলে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা মনে করেন। এখনও উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে দিনাজপুর জেলার সদর মহকুমায় কৃষকদের মধ্যে ‘মহারাজা’ বলে এক দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে। অগ্রহায়ণ মাসে নবান্নের সময়ে স্থানীয় কৃষকগণ নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে বারোয়ারীভাবে এই দেবতার পূজা করে থাকেন। তাঁদের বিশ্বাস, এই মহারাজের আশীর্বাদেই তাঁরা কৃষিকাজে সুফল লাভ করতে পারবেন। অতএব তিনি উক্ত ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির দেবতা ব্যতীত আর কিছুই নন। তাঁর মহারাজ নামকরণ হয় অনেক পরে। গবেষক ও ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, এই অঞ্চলে আর্য সভ্যতা বিস্তৃতির পরে স্থানীয় কৃষকদের এই উর্বরতা বৃদ্ধির দেবতা (Fertility God) কোন কোন জায়গায় মহারাজা বলে উল্লেখিত হলেও, ব্যাপকভাবে শিব বলেই পরিচিত হতে থাকেন। এইকারণেই প্রাচীন বাংলার কবিগণ শিবকেই সর্বত্র কৃষিকাজের সহায়ক বলে বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে উত্তরবঙ্গে এই মহারাজা ঠাকুর ও পশ্চিমবঙ্গের শিব ঠাকুরের মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। তাঁদের মধ্যে পূজা উপলক্ষে প্রায় অভিন্ন লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়ে থাকে। কোচ কৃষক সমাজেই বাংলার লৌকিক শৈবধর্মের প্রথম ভিত্তির স্থাপন হয়েছিল বলে গবেষকরা মনে করেন। কারণ, বঙ্গদেশের বহুদূরবর্তী অঞ্চলের প্রাচীন সাহিত্যেও শিবকে কোচ রমণীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলার সর্বত্র প্রচলিত শিবের ছড়ায় কোচনী রমণীর প্রতি শিবের আসক্তির বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। অতএব মনে হয়, কোচজাতীয় কৃষকদের সমাজেই পৌরাণিক শিব সবার প্রথমে এসে প্রবেশ করেন, তারপরে সেখানেই তাঁর চরিত্র স্থানীয় কোচেদের সামাজিক জীবনের উপাদানে মিশ্রিত হয়ে একটা স্থানীয় ও লৌকিক রূপ ধারণ করে, কালক্রমে সেটাই বাংলার সর্বত্র প্রচার লাভ করে। কিন্তু বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে তা প্রচারলাভ করবার পরেও কোচ-সংশ্রবের লোক-রুচিকর উপকরণগুলি কখনও তার মধ্যে থেকে পরিত্যক্ত হয়নি। বিশেষতঃ সংস্কৃত শৈবপুরাণগুলির মধ্যেও শিবচরিত্রের অনুরূপ দুর্নীতিপরায়নাতার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্কন্দপুরাণে বর্ণিত হয়েছে, দিগম্বর শিব এক ঋষির আশ্রমে প্রবেশ করার পরে ঋষির স্ত্রীরা তাঁর সঙ্গে ‘অশ্লীল রসপরিহাস’ করছেন (স্কন্দপুরাণ, মহেশ্বর খণ্ড, কেদার খণ্ড, অধ্যায়-৬, শ্লোক: ১৮-১৯, বঙ্গবাসী, ১৩১৮ বঙ্গাব্দ)। অতএব তাঁর সঙ্গে উক্ত কোচ রমণীর সম্পর্কের পরিকল্পনায় কিছুটা পৌরাণিক প্রভাব থাকাও আশ্চর্যের নয়। কোচ রমণীর সঙ্গে শিবের সম্পর্কের অর্থ এই যে, হিন্দুধর্মের মধ্যস্ততায় শৈবধর্মের প্রভাব যখন কোচ সমাজের উপরে যখন বিস্তার লাভ করেছিল, তখনও কোচ সমাজের মাতৃতান্ত্রিক ভিত্তি শিথিল হয়ে যায় নি – সামাজিক ও পারিবারিক পূজাপার্বণে কোচ পুরুষদের পরিবর্তে কোচ নারীরাই পৌরহিত্য করত। এখনও উত্তর-বঙ্গের পূর্বসীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল গারো ও খাসি অঞ্চলে যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তাতে পুরুষদের পরিবর্তে নারীরাই পৌরহিত্য করে থাকেন। উড়িষ্যার শবর জাতির মধ্যে পুরোহিত এখনও নারীই, পুরুষ নয়। কোচ নারীরা আর্যেতর দেবতা শিবের পূজায় বিশেষ উৎসাহ দেখাত, এ থেকেই শিবের সাথে কোন নারীর সংশ্রবের কথা কল্পনা করা হয়ে থাকে। মাতৃতান্ত্রিক কোচ সমাজে নারীর নৈতিক আদর্শ খুব উচ্চ ছিল না বলেই এই সম্পর্কের সূত্র ধরে শিব-চরিত্রেও নৈতিক বিচ্যুতির কথা এসেছে। পারিবারিক জীবনের সহস্র বন্ধনের মধ্যে নিবিড় সুখ উপভোগ করতে বাঙালি চিরদিন অভ্যস্ত। দুঃখ-দারিদ্র ও ঐহিক অসচ্ছলতা কিছুতেই তাঁর এই বন্ধন শিথিল করতে পারে না। বঙ্গদেশের নারীজীবনের আদর্শও স্বতন্ত্র। সহস্র দুঃখ-দারিদ্র অভাব-অসন্তোষের মধ্যে তাঁদের দাম্পত্য জীবন অশিথিল থেকে যায়। শিবের মতন স্বামীই নারীর আশৈশব জীবনের কাম্য। নিজের স্বামীর মধ্যে এই আদর্শের প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা নারী জীবনের আকাঙ্খা চরিতার্থ করে। সেইজন্য ব্যক্তি হিসেবে স্বামী যাঁর যেমনই হোক না কেন, তার জন্য কারও মনে তেমনভাবে ক্ষোভ হয় না। বাঙালি কবিগণ শিবকে দাম্পত্যজীবনের আদর্শ স্বামী বলে কল্পনা করেছেন। গৃহধর্মের আদর্শই বাঙালির কাছে সবচেয়ে বড়, সেইজন্য তাঁর পরিকল্পিত দেবতা আদর্শ গৃহধর্মে প্রতিষ্ঠিত। পৌরাণিক শিবের মতন তিনি প্রমথনাথ হয়ে শ্মশানবিহারী নন, বরং তিনি তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত – তিনি স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত একজন গৃহী মানুষ। যদিও তাঁর আবাস কৈলাস বলেই উল্লেখিত হয়, তবুও অনুভব করা যায় যে, এই কৈলাস বাংলারই এক নিভৃত পল্লী ছাড়া আর কিছুই নয়। দুই পুত্র, দুই কন্যা ও এক সর্বাংস্বাহা স্ত্রী নিয়ে এই পল্লীতে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের বাস। কবিগুরু বলেছেন, ‘‘কৈলাস ও হিমালয় আমাদের পানাপুকুরের ঘাটের সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছেন এবং তাঁহাদের শিখররাজি আমাদের আমবাগানের মাথা ছাড়াইয়া উঠিতে পারে নাই। যদি তাঁহারা নিজ নিজ অভ্রভেদী মূর্তি ধারণ করিবার চেষ্টা মাত্র করিতেন তাহা হইলে বাংলার গ্রামের মধ্যে তাঁহাদের স্থান হইত না।’’ (গ্রাম্য সাহিত্য, রবীন্দ্র রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬৪৮) ১৯৪০ সালে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্যের ভূমিকা গ্রন্থে শ্রী নন্দগোপাল সেনগুপ্ত, বাংলার হর-গৌরী বিষয়ক কাহিনী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘এ দেবাদিদেব মহেশ্বর ও জগন্মাতা পার্বতীর কৈলাস জীবন নয়, এ অতীত বাংলার কোন শিবদাস ভট্টাচার্য এবং তথ্য ভার্যা পার্বতী ঠাকুরানীর জীবন কাহিনী।’’ গৃহধর্ম পালনের মধ্যেও যে আধ্যাত্মিক চরিতার্থতা সার্থক হতে পারে এ’দেশের কবিগণ তাঁদের লৌকিক শিবের পরিকল্পনায় তা প্রমাণ করেছেন, অতএব, বাংলার শিব পৌরাণিক আদর্শ অনুযায়ী যোগী নন, তিনি গৃহী। কৃষকের কল্যাণকর দেবতারূপে উত্তরবঙ্গের কোচ সমাজে যে শিবচরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, বঙ্গদেশের পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পরিকল্পিত শিবের চরিত্রে তার ব্যক্তিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এর মূল কারণ, এই দুই অঞ্চলের অধিবাসীদিগের মধ্যে মৌলিক জাতিগত পরিচয়ে পার্থক্য আছে। বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল সাধারণতঃ রাঢ় অঞ্চল নামে পরিচিত। এই অঞ্চলে প্রাচীন কাল থেকেই মৃগয়াজীবী কোল-মুণ্ডা জাতির এক শাখা বসবাস করত। উত্তরবঙ্গের কোচ জাতীয় অধিবাসীদের মতন তাঁরা কৃষিজীবী ছিলেন না। সেইজন্যই স্বভাবতঃ, কৃষিকাজের কোন সহায়ক দেবতারও তাঁদের মধ্যে কোন স্থান ছিল না। এই কোল-মুণ্ডা জাতির প্রধান দেবতার নাম ছিল ‘মরাং বুরো’, তিনি ছিলেন পর্বতের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তিনি ছিলেন মানুষের মহা অনিষ্টকারী, উপযুক্ত পূজা না পেলে তিনি নানা দুর্বিপাক সৃষ্টি করে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করে ফেললেন। কালক্রমে হিন্দুধর্ম যখন এই কোল-মুণ্ডা জাতি অধ্যুষিত বাংলার এই পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিস্তার লাভ করল, তখন স্বভাবতই বঙ্গদেশে এই অনার্য-জাতি প্রভাবিত আদিবাসীরা হিন্দুসমাজের অন্যতম প্রধান দেবতা শিবকে এই প্রকার রক্তপিপাসু ও ভয়ঙ্কর বলে কল্পনা করে ফেলল। অতএব, তাঁকেও তাঁরা তাঁদের মরাং বুরোর মতন পশুবলি দিয়ে পূজা করে পরিতৃপ্তি বোধ করতে লাগল। এমনকি এই অঞ্চলে পরবর্তীকালে আর্যসভ্যতার প্রভাব অধিকতর হওয়া সত্বেও সাধারণের মধ্যে শিব সম্পর্কিত এই মনোভাবের বিশেষ কোন ব্যতিক্রম ঘটল না। বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম – এইসব অঞ্চলের বহু জায়গাতেই আজ পর্যন্ত বার্ষিক শিবপূজা বা চৈত্র-সংক্রান্তির সময়ে শিবের সম্মুখে পশুবলি দেওয়া হয়। এইসব অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক গ্রাম্য শিবমন্দিরের আঙিনার মধ্যেই ‘ভৈরব থান’ নামে একটি জায়গা আছে। বর্তমান সময়ে ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রভাব বশতঃ অনেক জায়গায় শিবের সামনে পশুবলি না দিয়ে ঐ ভৈরব থানে এনে পশুবলি দেওয়া হয়। দক্ষিণ ভারতে তামিলভাষীদের অঞ্চলেও হিন্দুপ্রভাব বশতঃ বর্তমানে গ্রাম্য দেবতাদের সম্মুখে পশুবলি দেবার প্রথা প্রায় উঠে গিয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় দেবতার সামনে একটি পর্দা টেনে দিয়ে, আবরণ করে, দেবতাদের উদ্দেশ্যে এখনও বলি দেওয়া হয়ে থাকে। বঙ্গদেশে ভৈরব শিবের আবরণ দেবতার জায়গা নিয়েছেন। বীরভূম জেলার বারমল্লিকা, পাইকর, দক্ষিণ গ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে এখনও শিবের সামনেই প্রতিবছর বলির ব্যবস্থা করা হয়। শিবচরিত্রের এই অভিনব পরিচয় কেবলমাত্র পৌরাণিক শিবধর্মের বিরোধী শুধুমাত্র নয়, এরকম বঙ্গদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে নজরে আসে না। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এদেশে প্রচার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের বহু উপাদান এসে লৌকিক শিবধর্মের সাথে মিলিত হতে শুরু করে। পৌরাণিক শিবের পরিকল্পনাও বুদ্ধদেবের চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত, অতএব বাংলার তদানীন্তন বৌদ্ধ সমাজ শিবের চরিত্রের মধ্যেই নিজের আদর্শের সন্ধান পেয়েছিল। জৈন তীর্থঙ্করদের জীবনাদর্শ গৌতম বুদ্ধ ও পৌরাণিক শিব থেকে বিশেষ স্বতন্ত্র নয় বলেই গবেষকরা মনে করেন। এইজন্যই কালক্রমে তদানীন্তন বাংলার বিরাট বৌদ্ধ ও জৈন সমাজ নিজেদের ধর্মীয় উপকরণ দ্বারা এই দেশের শৈবধর্মকে অভিনবরূপে পুনর্গঠন করে নিয়েছিল। তদানীন্তন বঙ্গদেশে আরেকটি ব্যাপক প্রচলিত ধর্ম ছিল ‘নাথধর্ম’। শৈব কিংবা বৌদ্ধ ধর্মের বাইরে এর উদ্ভব হলেও শৈবধর্মের ব্যাপক প্রসারবশতঃ কালক্রমে এর মধ্যে গিয়েও শৈবধর্মের উপকরণরাশি প্রকাশ লাভ করল। কালক্রমে নাথসিদ্ধাগণও শিবকে নিজেদের গুরু বলে স্বীকার করে নিলেন। ক্রমে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, নাথ ও অনার্য – এই সকল ধর্মমত থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে বঙ্গদেশের লৌকিক শিবধর্ম এক অভিনব সঙ্কর রূপ ধারণ করে।

আরো পড়ুন: বাঙালী ও পঞ্জিকা । রানা চক্রবর্তী


একটা প্রাগৈতিহাসিক লৌকিক ধর্মানুষ্ঠান কালক্রমে এ’দেশের কোন কোন অঞ্চলে শৈবধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল – সেটা ‘গাজন’ নামে পরিচিত। শৈবধর্ম প্রভাবিত অঞ্চলে এটি ‘শিবের গাজন’, ধর্মঠাকুর প্রভাবিত অঞ্চলে এটি ‘ধর্মের গাজন’ ও বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত অঞ্চলে এটি ‘আদ্যের গাজন’ নামে পরিচিত। কোন কোন অঞ্চলে এটি ‘নীলের গাজন’ নামেও কথিত। শিবের একটি পৌরাণিক নাম হল ‘নীলকন্ঠ’, সেই থেকেই সংক্ষেপে ‘নীল’ হয়েছে বলে জনসাধারণের বিশ্বাস। কিন্তু ‘নীল’ শব্দের অন্য কোন তাৎপর্য থাকাও সম্ভব বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। আবার কোন কোন জায়গায় এই অনুষ্ঠানের নাম ‘দেলপূজা’, ‘দেউল’ বা ‘মন্দির’ শব্দটির থেকে ‘দেল’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন – কিন্তু এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে ‘দেউল’ বা মন্দিরের এমন কোন সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায় না যার জন্য এর নাম ‘দেলপূজা’ বলা যেতে পারে। গবেষকদের অভিমত, ‘দেল’ শব্দটিও স্বতন্ত্র কোন সাংস্কৃতিক ধারা থেকে এসেছে। মালদা জেলায় প্রায় অনুরূপ একটা অনুষ্ঠান হয়, তার নাম ‘আদ্যের গম্ভীরা’। গবেষকদের কাছে ‘গম্ভীরা’ শব্দের অর্থটি খুব একটা স্পষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গের ধর্মঠাকুরের আসন তৈরির জন্য এক ধরনের কাঠ ব্যবহার করা হয়, যার নাম ‘গামার কাঠ’, একে ‘গম্ভীরা কাঠ’ও বলা হয়। ওদিকে উড়িয়া ভাষায় গম্ভীরা শব্দের অর্থ হল ‘ক্ষুদ্র নির্জন কক্ষ’। পুরীতে কাশী মিত্রের গৃহে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যে ক্ষুদ্র কক্ষটিতে বাস করতেন তাকে বলা হয়েছে গম্ভীরা, এই অর্থেই উড়িয়া ভাষায় গম্ভীরা শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু মালদার আদ্যের গম্ভীরার ক্ষেত্রে এই একই কোন অর্থ প্রযুক্ত হতে পারে কিনা, তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায় না। ছোটনাগপুরের ‘ওঁরাও মুণ্ডা’ জাতির মধ্যে একই ধরণের ধর্মানুষ্ঠান প্রচলিত আছে, সেখানে এটি ‘মাণ্ডা পরব’ নামে পরিচিত। উড়িষ্যার কোন কোন অঞ্চলেও এই একই শ্রেণীর অনুষ্ঠান দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে এর নাম ‘সাহী যাত্রা’। ওদিকে কর্ণাটকের মহীশুরের সাত ভগিনী মারীর (বা মারী সাত ভগিনীর) বাৎসরিক উৎসবের নাম ‘মারী যাত্রা’, মাঘ মাসে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠান বঙ্গদেশের গাজনের অনুরূপ। শিবের গাজনের মধ্যে শিব সম্পর্কিত কয়েকটি লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়ে থাকে। সাধারণ লোকের হাতে পড়ে শিবের চরিত্র এতেও এক অভিনব রূপ ধারণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্রই যে গ্রাম্য শিবমন্দির আছে, তার সংলগ্ন উঠানে সাধারণতঃ চৈত্র-সংক্রান্তির দিন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যাঁরা বিশেষভাবে পূজায় যোগ দেবার জন্য প্রতি বছর পূজায় মানসিক বা মানত করেন – তাঁদের বলা হয় ‘সন্ন্যাসী’। এঁদের মধ্যে একজন মূল সন্ন্যাসী হন। তাঁর নির্দেশেই অন্যান্য সন্ন্যাসীগণ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অঙ্গ পালন করে থাকেন। শিবমন্দিরের দরজা খোলা থেকে আরম্ভ করে তিনদিন পর অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত শিব-সম্পর্কে কতকগুলি ছড়া আবৃত্তি করা হয়। এদের মধ্যে যে শিবের ছড়া গীত হয়ে থাকে তাতেও শিবের কৃষক-চরিত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার লাভ করা যায়। কোন কোন গীতের বিষয়বস্তু নেই। শিব কার্পাস তুলার চাষ করে থাকেন। সেই কার্পাস তুলা দিয়ে গঙ্গাদেবী সুতো কেটে দেন, শিব নিজেই সেই সুতো দিয়ে তাঁতে নিজের জন্য কাপড় বুনে নেন। আনকোরা কাপড়টি নেতা ধোপানী ক্ষীরসমুদ্রের জলে কেচে দেয়। গাজন উপলক্ষে গ্রাম্য শিবতলা থেকে ‘বড় তামাশা’র যে শোভাযাত্রা বের হয়, তাতে ‘গাজুনে শিব’ নামে একখণ্ড কাঠ বা পাথরকে বাদ্যভাণ্ড সহকারে গ্রামান্তরের শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই শোভাযাত্রার মধ্যে নৃত্যগীত সহকারে শিব-সম্পর্কিত বিবিধ লৌকিক গীত গাওয়া হয়ে থাকে। কোন কোন বিষয় অভিনয় করেও দেখানো হয়। যেমন শিবের কৃষিকাজের সাথে যুক্ত থাকার বিষয়টি কোন কোন জায়গায় এভাবে অভিনয় করে দেখানো হয় – একজন বীজ ছড়ায়, একজন লাঙ্গল দিয়ে মাটি চাষ করে, দুই ব্যক্তি হালের বলদের অভিনয় করে জোয়াল কাঁধে নিয়ে টানে, কোন ব্যক্তি পাকা ধান কাটার অভিনয় করে; তাতে মূল সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করেন, ‘‘বলি শিবঠাকুর কত ধান হলো?’’, উক্ত ব্যক্তি তার একটা জবাব দেয়, তা থেকেই সকলে সেই বছরের উৎপাদিত ধানের পরিমাণ বুঝে নেয়। সাঁওতালদের মধ্যে ‘ফাল্গুন-চৈত্র’ মাসে যে ‘বহা পরব’ অনুষ্ঠিত হয়, তা সম্বন্ধে ১৯১০ সালের বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটে লেখা হয়েছিল – ‘‘On arriving at the Jahen, Jaherera sweeps the thanas, the naeka asis the bongas, i.e. those personating the Gods, for the things they have brought, and places them on a mat. He next proceeds to ask them questions, a proceeding which probably was originally an attempt to find out something about the coming year.’’ (Bengal District Gazetteer, Santhal Parganas, page: 128, 1910) এছাড়া গৌরীর শঙ্খ পরিধানের একটি লৌকিক কাহিনীও গাওয়া হয়। তৃতীয় দিনে এই অনুষ্ঠান শেষ হয়। এই উপলক্ষে ‘গাজুনে বাসুল’ বা পুরোহিত এসে শিবপূজা করেন, সন্ন্যাসীগণ শিব-গৌরী-ভূত-পিশাচ ইত্যাদি সেজে মন্দির প্রাঙ্গণে নৃত্য করেন, তারপরে বাদ্যভাণ্ড সহযোগে নর্তকের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। কোন কোন স্থানে চরক হয়, চরকের পরে এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষতঃ হুগলী, হাওড়া ও উভয় ২৪ পরগণা জেলায় ভাগীরথীর উভয় তীরে ‘পাঁচুঠাকুর’ নামে এক দেবতার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। ‘পেঁচো’ নামে কোন এক বৃক্ষবাসী অপদেবতা থেকে তিনি ক্রমে পাঁচুঠাকুর ও অবশেষে ‘পঞ্চানন ঠাকুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে বর্তমানে শিবরূপে পূজিত হচ্ছেন। এইসব অঞ্চলে ‘ভূতে পাওয়া’ অর্থে ‘পেঁচোয় পাওয়া’ কথাটি আজও প্রচলিত আছে। সংস্কৃত ও বাংলা কবিতায়, এই দেবতার মাহাত্ম্যসূচক কয়েকটি গল্প রচিত হয়েছিল। এদের মাধ্যমে শিবের সঙ্গে তাদের অভিন্নতা সম্পাদনের প্রয়াস প্রায় সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়।
গাজনের রীতি অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির ১০/১৫ দিন আগেই গ্রামীণ পুরোহিতের উপদেশে কয়েকজন স্নান করে পুরোনো বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র ও উত্তরীয় ধারণ করেন। নিজস্ব গোত্র ত্যাগ করে শিবগোত্র ও ধারণ করেন। এরা হলেন গাজনের সন্ন্যাসী। গাজনের এই সন্ন্যাসীদের ‘ভক্ত্যা’ বা ‘ভক্তিয়া’ বলা হয়। এই সন্ন্যাসীরা যে কোন সম্প্রদায় থেকে আসতে পারেন। ‘ব্রতপালন’, ‘সংযমরক্ষা’, ‘হরিষ্যন্ন ভোজন’, ‘ব্রহ্মচর্য পালন’, ‘চুল ‘দাড়ি না কাটা’ ইত্যাদি নিয়ম পালন করে থাকেন। এদের মধ্যে একজন থাকেন ‘মূল বা প্রধান ভক্ত্যা’। তাঁর নির্দেশেই বাকিরা এই সব নিয়ম পালন করে থাকে। গাজন পর্বের শুরুতেই ভক্ত্যারা বানেশ্বর কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে বেড়ান। এই সময় তাদের বাড়ির বা পরিবারের কারোর সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না রাখার নিয়ম নেই। বাড়ি যাওয়া বা বাড়ির অন্নজল গ্রহন করার নিয়ম নেই। গাজনের অন্যতম অঙ্গ হল কৃচ্ছ কর্ম সাধন। সন্ন্যাসীরা নিজেদের বিভিন্ন ভাবে শারিরীক কষ্ট দিয়ে তা করে থাকেন। ‘বাঁণফোড়া’, ‘কাটান’, ‘ঝাঁপান’ ইত্যাদি হল এর অংশ। পেরেক বা সূচ দিয়ে নিজের শরীর কে বিদ্ধ করা, একটি উঁচু বাঁশের মাথা থেকে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া এ সবই এই গাজনের অংশ। চড়ক পূজা গাজন উৎসবের একটি অঙ্গ। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। ‘লিঙ্গপুরাণ’, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পূর্ণ পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘গোবিন্দানন্দের’ ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ ও ‘রঘুনন্দনের’ ‘তিথিতত্ত্বে’ও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে ‘পাশুপত সম্প্রদায়ের’ মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। জনশ্রতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘সুন্দরানন্দ ঠাকুর’ নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। কথিত আছে, এই দিনে শিব-উপাসক বাণরাজা দ্বারকাধীশ কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মহাদেবের প্রীতি উৎপাদন করে অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষায় ভক্তিসূচক নৃত্যগীতাদি ও নিজ গাত্ররক্ত দ্বারা শিবকে তুষ্ট করে অভীষ্ট সিদ্ধ করেন। সেই স্মৃতিতে শৈব সম্প্রদায় এই দিনে শিবপ্রীতির জন্য উৎসব করে থাকেন। ‘গম্ভীরাপূজা’ বা ‘শিবের গাজন’ এই ‘চড়কপূজা’রই রকমফের। ‘চড়ক পূজা’ চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। এ পূজার বিশেষ অঙ্গের নাম ‘নীলপূজা’। পূজার আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা (‘শিবের পাটা’) রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো ‘কুমিরের পূজা’, ‘জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর দিয়ে হাঁটা’, ‘কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো’, ‘বাণফোঁড়া’, ‘শিবের বিয়ে’, অগ্নিনৃত্য’, ‘চড়কগাছে দোলা’ এবং ‘দানো-বারনো’ বা ‘হাজরা পূজা’ করা। এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। ‘চড়কগাছে’ ‘ভক্ত্যা’ বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তাঁর পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তাঁর গায়ে ফুঁড়ে দেয়া হয়। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে। পূজার উদ্যোক্তা ‘ভক্ত্যা’ বা সন্ন্যাসীরা চড়ক পূজার কয়েকদিন আগে থেকে কঠোর ব্রত ও সংযম পালন করেন। একজনকে সাজানো হয় হনুমানের মত লম্বা লেজ দিয়ে, তার মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল; স্থানবিশেষে রামায়ণ কাহিনির হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত আনার দৃশ্য অভিনীত হয়, একে বলে ‘গিরি সন্ন্যাস’। এরপর সন্ন্যাসীরা মহাসমারোহে আমগাছ থেকে একাধিক ফলসমেত একটি শাখা ভেঙে আনেন, এর নাম ‘বাবর সন্ন্যাস’। চড়কপূজার আগের দিন ‘নীলচণ্ডিকার পূজা’ হয় (যা মূলতঃ ‘নীলপূজা’ নামে পরিচিত), এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু’জন সখী। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। তাঁদের ‘দেল’ বা ‘নীল পাগলের দল’ও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। এদিন রাতে ‘হাজরা পূজা’ হয় এবং শিবের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি ও শোলমাছ নিবেদিত হয়। মাঝরাতে শিবের আরাধনার সময়ে দু’একজন সন্ন্যাসী প্রবলবেগে মাথা ঘুরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন; এই অবস্থাকে দেবতার ‘ভর’ বলা হয়। এসময় তাঁরা দর্শকমণ্ডলীর প্রশ্নের যা যা উত্তর দেয় তা অভ্রান্ত বলে সাধারণ বিশ্বাস করে। চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে। এছাড়া, দেবতার অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তাঁরা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার উপর ঝাঁপ দেন কিংবা পা’দুটি উপরে মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন। এগুলি যথাক্রমে ‘বঁটি-ঝাঁপ’, ‘কাঁটা-ঝাঁপ’ ও ‘ঝুল-ঝাঁপ’ নামে পরিচিত। আরো আত্মনির্যাতনের জন্য আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহশলাকা সারাদিন জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেওয়া হয়, এর নাম ‘বাণ-সন্ন্যাস’। পিঠের দুদিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়াকে বলে ‘বেত্র-সন্ন্যাস’। আর চড়ক গাছটি চড়কতলায় প্রোথিত করে তার মাথায় আরেকটি কাষ্ঠখণ্ড মধ্যস্থলে ছিদ্র করে স্থাপন করা হয়, যাতে চড়কগাছকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠখণ্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। এর একপ্রান্তের ঝোলানো দড়িতে একজন সন্ন্যাসী (আগেকার সময়ে সন্ন্যাসীরা পিঠের চামড়া ভেদ করে শিরদাঁড়াতে বঁড়শির মত বাঁকানো একটি লোহার কাঁটা গেঁথে ঝুলে থাকতেন) কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে ঝুলে থাকেন, অপরপ্রান্তে কাষ্ঠখণ্ডটিকে চক্রাকারে চরকির মত ঘোরানো হয়; এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘বড়শি সন্ন্যাস’।
বাংলায় একটা সুপরিচিত প্রবচন আছে, ‘‘ধান ভানতে শিবের গীত’’, এটা থেকেই এ’দেশের একটা লৌকিক শিব-গীতকার অস্তিত্ব সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু সমগ্র ভাবে এই গীতকা আজ পর্যন্ত কোন জায়গা থেকে আবিষ্কৃত হয়ে মুদ্রিত হয়নি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন স্থানে এই শিব-গীতকার কোন কোন অংশের সঙ্গে আজও পরিচয় লাভ করতে পারা যায়, কিন্তু খ্ৰীস্টিয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও যে বাংলার সমাজে এর একটা স্বয়ং-সম্পূর্ণ রূপ বহুল প্রচলিত ছিল, সে যুগের বাংলা সাহিত্যে তার উল্লেখ রয়েছে। প্রসিদ্ধ চৈতন্যচরিতকার কবি ‘বৃন্দাবন দাসের’ ‘চৈতন্যভাগবত’ খ্ৰীস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর বাংলার সামাজিক ইতিহাসের তথ্যে পরিপূর্ণ। তার বর্ণনায় পাওয়া যায় –
‘‘একদিন আসি এক শিবের গায়ন।
ডমরু বাজায় – গায় শিবের কথন।।
আইল করিতে ভিক্ষা প্রভুর মন্দিরে।
গাইয়া শিবের গীত বেড়ি নৃত্য করে।।
শঙ্করের গুণ শুনি প্রভু বিশ্বম্ভর।
হইলা শঙ্কর মূর্তি দিব্য জটাধর।।
একলাফে উঠে তার কান্ধের উপর।
হুঙ্কার করিয়া বলে মুই যে শঙ্কর।।
কেহো দেখে জটা শিঙ্গা ডমরু বাজায়।
‘বোল’, ‘বোল’ মহাপ্রভু বোলয়ে সদায়।।
সে মহাপুরুষ যত শিবগীত গাইল।
পরিপূর্ণ ফল তার একত্র পাইল।।’’
(চৈতন্যভাগবত, বৃন্দাবন দাস, বসুমতী, ৪র্থ সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৩২-১৩৩)
এথেকেই বুঝতে পারা যায় যে খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত, এই শিবের গীত মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসছিল। শৈব বলে পরিচিত এক শ্রেণীর ভিক্ষুক এই গীত গেয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়াত। এই শিবের গীত সমাজের নিম্নতর স্তরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই শিব-গীতকার পূর্ণাঙ্গ রূপ কি ছিল, তা উদ্ধৃত অংশ থেকে জানতে পারা যায় না। অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রংপুর জেলার কৃষকদের মধ্যে শিব সম্পর্কে কতগুলো ছড়া আজও প্রচলিত আছে। যোগীসম্প্রদায়ভুক্ত কৃষকরাই সাধারণতঃ এই গান গেয়ে থাকেন। একসময় নাথ যোগীগণও শিবকে নিজেদের গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, এই সূত্রেই তাঁদের রচিত লোক-গীতকায় শিবের মহিমা-কীর্তন করা হয়ে থাকে। মনে করা হয়, সেকালের সমাজে এই শ্রেণীর গানই শৈব ভিক্ষুকেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গেয়ে বেড়াত। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক –
‘‘চণ্ডী বলে শুন গোঁসাই জটিয়া ভাঙ্গেড়া।
তোমার সঙ্গে আও করিলে নাগিবে ঝগড়া।।
চার ছেইলার মাও হৈলাম তোমার দ্যাবের ঘরে।
দয়া করি চারখানা শাঁখা নাই পিন্ধাইস্ মোরে।।
ভাসুর আইসে শ্বশুর আইসে রণ্ন আন্ধি দ্যাওঁ তারে।
আমার হাত মুড়া, গোঁসাই, তা নজ্জা নাগে তোরে।।
শিব বলে, ‘শুন চণ্ডী, দক্ষরাজার বেটি।
শাঁখা দিবার না পাইন আমি যাক বাপের বাড়ী।।’
এ কথা শুনিয়া চণ্ডী আনন্দিত মন।
নাইওর লাগিয়া চণ্ডী করিল গমন।।
কার্তিক গণেশ নিল ডাইনে বাঁয়ে সাজাইয়া।
অগ্নিপাটা শাড়ী নিল পরিধান করিয়া।।
নাইওরক নাগিয়া চণ্ডী যায় ত চলিয়া।
পালঙ্কেতে বুড়া শিব আছে শুতিয়া।।
নারদমুনি ডাকে তারে ‘মামা, মামা’ বলিয়া।
‘ওহে মামা, ওহে মামা, তুমি বড় আসিয়া।।
পাকা দ্যাড় পহর বেলা আছে পালঙ্কে শুতিয়া।
ঝগড়া নাগাইয়া চণ্ডী যায় গোসা হইয়া।।’
নারদ ভাইগ্না তাকে ডাকায় কান্দিয়া কাটিয়া।
‘ওহে মামী, ওহে মামী, কার্তিক গণেশের মাও।
এক পাও আগাইবা যদি মামী, কার্তিকের মুণ্ডু খাও।।
ফির পা আগাইবা যদি গণেশের মুণ্ডু খাও।
ফির পা আগাইবা মামী আমার মাথা খাও।।’
নারদ ভাইগ্নার বাক্যেতে মহল ফিরিয়া গেল।
মহল যাইয়া চণ্ডী মাতা কামের ব্যাখ্যা দিল।।’’
(গোপীচাঁদের গান, সঙ্কলক – বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় খণ্ড, ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৩৬-৩৭, ১৯২৪)
উত্তরবঙ্গের প্রচলিত আরও একটি শিবের ছড়া এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। লক্ষ্যনীয় বিষয়, একই বিষয়বস্তু ভিন্ন অঞ্চলে কিভাবে ভিন্ন রূপ নিয়েছে –
‘‘আমার জাতের কথা শিব তুই কলু ভাঙ্গিয়া।
তোমার জাতের কথা কইলে নাগিবে ঝগড়া।।
ভাসুর আইসে শ্বশুর আইসে রণ-পরশুম তাকে।
হাতে শাঙ্কা নাই দ্যান গোঁসাই নজ্জা পাছু তাতে।।
শাঙ্কা কিনিয়া দ্যাও হে মদন মুরলী।
দশ হাতে দশ মুট শাঙ্কা কানে মদন কড়ি।।
শাঙ্কা না পাইলে তবে যাব বাপের বাড়ী।
বাপের বাড়ী যাব দুর্গা ভাইয়ে বাড়ী যাব।
কাটানি কাটিয়া তবে দুই ছেইলকে পালিব।।’’
(গোপীচাঁদের গান, সঙ্কলক – বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় খণ্ড, ভূমিকা, পৃষ্ঠা: ৩৯, ১৯২৪)
‘ধর্মমঙ্গল সাহিত্যে’ ‘রামাই পণ্ডিত’ সংকলিত ‘শূণ্য পুরাণ’ নামে একটা বই প্রকাশিত হয়েছিল – তাতে, ধর্মপূজা উপলক্ষে যে গাজন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, তার বিবিধ অনুষ্ঠানের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা আছে। এই গাজন উপলক্ষে শিবের চাষ বিষয়ক একটা অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এই বিষয়ে নীচের ছড়াটি ‘শূণ্য পুরাণ’ থেকে উল্লেখ করা হল, গবেষকরা মনে করেন এটিও প্রাচীন শিব-গীতিকার একটা অংশ –
‘‘যখন আছেন গোসাঞ হইয়া দিগম্বর।
ঘরে ঘরে ভিখা মাগিয়া বুলেন ঈশ্বর।।
রজনী পরভাতে ভিকখার লাগি যাই।
কুথাএ পাই কুথাএ না পাই।।
হর্তুকী বএড়া তাহে করি দিন পাত।
কত হরস গোসাঞ ভিকখাএ ভাত।।
আহ্মার বচনে গোসাই তুহ্মী চষ চাষ।
কখন অন্ন হএ গোসাঞ কখন উপবাস।।
পুখরি কাদাএ লইব ভূমখানি।
আরসা হইলে ছিচএ দেব পানি।।
আর সব কিষান কাঁদিব মাথায় হাত দিয়া।
পরম ইচ্ছায় ধান্য আনিব দাইআ।।
ঘরে অন্ন থাকিলেক পরভু সুখে অন্ন খাব।
অন্নর বিহনে পরভু কত দুঃখ পাব।।
কাপাস চষহ পরভু পরিব কাপড়।
কত না পরিব গোসাঞ কেওদা বাঘের ছড়।।
তিল সরিষা চাষ কর গোসাঞ বলি তব পাএ।
কত না মাখিব গোসাঞ বিভূতিগুলো গাএ।।
মুগ বাটলা আর চষিহ ইখু চাষ।
তবে হবেক গোসাঞ পঞ্চামর্ত্তর আশ।।
সকল চাষ চষ পরভু আর রুই ও কলা।
সকল দব্ব পাই যেন ধর্ম পূজার বেলা।।
এতেক সুবিধা হর মনে ত ভাবিল।
মন পবন দুই হেলএ সিজন করিল।।
সুনার যে লাঙ্গল কৈল রূপার যে ফাল।
আগে পিছু লাঙ্গলেতে এ তিন গোজাল।।
আগে জোতি পাশ জোতি আভদর বড় চিন্তা। (!)
দুদিগে দুসলি দিআ জুআলে কৈল বিন্ধা।।
সকল সাজ হৈল পরভুর আর সাজ চাই।
গটা দশ কুআ দিয়া সাজাইল মই।।
তাকর দুভিতে চাই দুগাছি সলি দড়ি।
চাষ চষিতে চাই সুনার পাচন বাড়ি।।
মাঘ মাসে গোসাঞ পিথিবি মঙ্গলিল।
যতগুলি ভূম পরভু সকলি চষিল।।’’
(শূন্য পুরাণ, রামাই পণ্ডিত, সম্পাদনা – চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা: ১৮২-৮৫, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দ)
এর সঙ্গে ‘মৈথিল কবি’ ‘বিদ্যাপতি’র রচিত নিম্নলিখিত পদটির তুলনা করা যেতে পারে –
‘‘বেরি বেরি অরে শিব মোয়ে তোকে বোলয়ে
কিরিষি করিয় মন লাই।
বিনু সমরে হর ভিখিএ পত্র মাগিয়
গুণ গৌরব দূর জাই।।
নিরধন জন বোলি সবে উপহাসএ
নাহি আদর অনুকম্পা।
তোহেঁ শিব পাওল আক ধুথুর ফুল
হরি পাওল ফুল চম্পা।।
খটগ কাটি হরে হর যে বাঁধাওল
ত্রিশুল ভাঁগয় করু ফারে।
বসহা ধুরন্ধর হর লএ জোতিঅ।
পাএট সুর সরিধারে।।
ভণই বিদ্যাপতি সুনহ মহেশ্বর
ই জানি কইলি তুঅ সেবা।
এতএ জেবরু সে বরু হোঅও
ওতএ সরন দেবা।।’’
(বিদ্যাপতি ঠাকুরের পদাবলী, সম্পাদনা – নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, পৃষ্ঠা: ১৮২-৮৫, ১৩১৬ বঙ্গাব্দ)
অর্থাৎ, ‘‘হে শিব, বার বার তোমাকে আমি বলি, কৃষিকার্য কর; হে হর তুমি নির্লজ্জ হইয়া ভিক্ষা মাগ, তাহাতে তোমার গুণ-গৌরব দূর হয়। নির্ধন বলিয়া সকলে উপহাস করে, সমাদর কিংবা অনুকম্পা প্রকাশ করে না; হে শিব, তুমি আকন্দ ও ধুতুরা ফুল পাইলে, হরি চাঁপা ফুল পাইল; হে হর, খট্টাঙ্গ কাটিয়া লাঙ্গল বানাও, ত্রিশূল ভাঙ্গিয়া ফাল কর। হে হর, ভাল দেখিয়া (ধুরন্ধর) বৃষ জুতিয়া দাও, তোমার জটায় যে গঙ্গার ধারা আছে তাহা দিয়া (ক্ষেতের) পাট কর। বিদ্যাপতি বলে, শুন মহেশ্বর, এই জানিয়া তোমার সেবা করিলাম। ইহলোকে যাহা হইবার তাহা হউক, পরলোকে শরণ দিও।’’ এথেকে বুঝতে পারা যায় যে, শিব একজন চাষী, এই সম্পর্কিত বিশ্বাস মিথিলা থেকে উত্তরবঙ্গের পথ ধরে বঙ্গদেশের সর্বত্র প্রচার লাভ করেছিল; কিংবা প্রাচীন বঙ্গদেশ থেকেও এর মিথিলা যাওয়া অসম্ভব নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সুধীর কুমার মজুমদারের’ সম্পাদনায় ‘বিদ্যাপতির শিবগীত’ নামে যে বইটি প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে এই শ্রেণীর আরও অনেক গীত উদ্ধৃত করা হয়েছিল। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গাজন উৎসব প্রচলিত আছে, তাতে শিবের বিষয়ে যেসব গীত গাওয়া হয়, সেগুলো এক ও অভিন্ন নয়। বাখরগঞ্জের একটি গীত এরকম –
‘‘শিব চইলাছেন বিয়ার বেশে নারদ বজায় বীণা।
পাড়াপড়শী দেখতে এল বিয়ার কথা শুইনা।।
টিপ্ টিপ্ ডম্বুরা বাজে শিঙায় গুন গুন করে।
খৈস্যা পড়ল মৃগ চর্ম শিব ল্যাঙটা হইয়া নাচে।।
মেনকা সুন্দরী এল জামাই দেখিবারে।
পাগলা জামাই দেখ্যা সবে আউয়া ছিয়া করে।।
কিবা আকৃতি জামাইর কিবা জামাইর রূপ।
দুইটা চক্ষু ফুট্যা রইছে পঞ্চখানি মুখ।।
না দিব গৌরারে বিয়া কার বা বাপের ডর।
ডঙ্কা মাইরা পাগল জামাই বাড়ির বাইর কর।।’’
এই সম্পর্কে শিবের বিয়েতে এয়োগণের গীত, শিবপূজার জন্য পুষ্প চয়নের গীত, ভগবতীর শাঁখা বা শঙ্খ পরিধান বিষয়ক গীত ও শিব সম্পর্কে আরও নানা ধরণের গীত গাওয়া হয়। ভগবতীর শঙ্খ পরিধানের কাহিনীটি বাংলার সর্বত্র প্রচলিত। পূর্ববঙ্গের বরিশাল অঞ্চলের প্রচলিত গীতটি নিম্নরূপ –
‘‘শঙ্খ পরিতে গৌরাইর মনে বড় সাধ।
করযোড়ে কন কথা শিবের সাক্ষাৎ।।
‘বৃদ্ধ হইয়াছি গৌরাই কখন যেন মরি।
কিসের লাইগ্যা কর বেশ দক্ষের-সুন্দরী।।
কুচনী নগরে আছে তোমার বাপভাই।
সেইখানে যাইয়া পর শঙ্খ আমার কিছু নাই।।
বৃদ্ধ হইয়াছি গৌরাই আমি লড়ি করি ভর।
ভিক্ষা মাগি যাই আমি দেশ দুরান্তর।।’
নারদ বলে, ‘মামা আমার কথা রাখ।
যৌবন কালে স্ত্রীলোক নাইওর পাঠাও কেন।।’
শিব বলে, ‘শুন ভাইগনা আমার কথা রাখ।
শঙ্খ বণিক হইয়া গৌরাইর মন বুঝিতে যাও।।’ …’’
উপরে শিবের বিষয়ে যে সকল বিচ্ছিন্ন ছড়া গীতকা ছাড়াও অধিকাংশ মঙ্গলকাব্যের শুরুতে সুসংবদ্ধ শিব-কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যাবে। শিব সম্পর্কে ছড়া ও বিবিধ লোকগীতকা থেকে প্রধানতঃ উপাদান সংগ্রহ করে তার সঙ্গে পৌরাণিক উপাদান মিশ্রিত করে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিষয়ক মঙ্গলকাব্যের মধ্যে এই ধরণের শিব-কাহিনী সঙ্কলিত করা হয়েছিল। শৈবধর্মের ধ্বংসস্তূপের উপরে যেমন পরবর্তী লৌকিক ধর্মের দেউল গড়ে উঠেছিল, তেমনি শিব কাহিনীর উপরেই অন্যান্য লৌকিক দেবতার কাহিনীমূল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেবলমাত্র লৌকিক দেবতার কাহিনীমূলেই যে শিব-কাহিনী বর্ণনা করা হত, তা নয়, সমাজে এই শিব গীতকার প্রভাব এত ব্যাপক হয়ে পড়েছিল যে, কৃত্তিবাস ওঝা রচিত রামায়ণ কাব্যের মূল কাহিনীর সঙ্গেও নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে টেনে এনে শিব কাহিনীকে যুক্ত করা হয়েছিল। তৎকালীন বাংলার সমাজে একমাত্র সুপ্রতিষ্ঠিত দেবতাই ছিলেন শিব। সেই জন্য বিভিন্ন লৌকিক দেবতাগণও সমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শিবের সঙ্গে একটা সম্পর্কের কল্পনা করে নিতেন। এছাড়াও আনুপূর্বিক শিবকাহিনী নিয়েও পরবর্তীকালে কয়েকটা ‘শিবমঙ্গল কাব্য’ রচিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র:
১- বাংলার লৌকিক দেবতা, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু, দে’জ পাবলিশিং (২০১৫)।
২- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য, এ. মুখার্জি এন্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড (২০০০)।
৩- লোকসংস্কৃতির আলোকে বাংলা মঙ্গলকাব্য: একটি তুলনামূলক পথ, দীপঙ্কর মল্লিক, দিয়া পাবলিকেশন।
৪- বাংলার ব্রত ও আলপনা, কমল চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং।
৫- বাংলার ব্রত ও অন্যান্য ব্রত কথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীপায়ন।
৬- গাজন, মনোজিৎ অধিকারী, দে’জ পাবলিশিং।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত