কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের জন্মতিথিতে ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শ্রদ্ধা ও নিরন্তর শুভ কামনা।
জয়তুন বেওয়ার জীবন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর আগে দিনগুলো একরকম ছিল। এখন অন্যরকম হয়েছে।
আগে পদ্মা নদী ওর কাছে একটি নদীমাত্র ছিল। এখন সেটা ওর কাছে আশ্রয়ের মতো। নদীর পাড়ে বসে দিনের খানিকটুকু সময় কাটালে বুঝতে পারে স্বামীর মৃত্যুশোক একটু লাঘব হলো। জয়তুন বেওয়ার জীবনে এভাবেই একজন মানুষের চলে যাওয়ার হিসেবনিকেশ শেষ হয়। ও নতুন সময়কে আঁকড়ে ধরে।
মাঝে মাঝে জয়তুন বেওয়া নিজেকে বুঝতে পারে না। যে নদী স্বামীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, পরে খুঁজে পাওয়া যায় তার লাশ, সেই নদীকে আপন ভাবা কেন? আবার ভাবে, নদী তো তার স্বামীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি, তার কাছে ফিরিয়ে এনেছে। জীবিত ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এনেছে মৃত।
এই ভাবনায় তার বুক ভেঙে যায়।
চিৎকার করে ওঠে, ওহ নদীরে—
বিলাপ করে কাঁদে জয়তুন বেওয়া।
কোনও কোনও দিন দিনের শুরুতে কান্না আসে। সামনে থাকে অনেক কাজ। বাড়িতে দুটো গরু আছে। দুধ দুইয়ে গোয়ালাকে দিতে হবে। হাঁস-মুরগি আছে। খোঁয়াড় থেকে বের করতে হবে। খুদকুঁড়ো দিতে হবে। উঠোন ঝাড়ু দিতে হবে।
সব কাজ ফেলে রেখে কাঁদতে থাকে জয়তুন। নইলে দুই পা মেলে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে। মাকে এই অবস্থায় দেখলে রাগ করে জয়তুন বেওয়ার কিশোরী মেয়ে সেউতি। বাবা তো মরেই গেছে তারজন্য সব কাজ ফেলে কান্নাকাটি করতে হবে কেন? বাবা তো আর কোনওদিন ফিরবে না। ওরও তো বাবার কথা মনে থাকে, বাবার স্মৃতিতে ওর আনন্দ আছে, বাবা না থাকায় চোখ ভিজে যায়। কিন্তু তাই বলে কাজকর্ম বাদ দিয়ে বসে বসে কাঁদতে ও একদমই চায় না।
আজও মায়ের কাছে এসে বসে। মায়ের হাত ধরে। ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, কেঁদে কী হবে? আব্বা কী ফিরে আসবে?
মেয়ের কথায় সাড়া দেয় না জয়তুন বেওয়া।
জীবনের বোঝা যে কত কঠিন এটুকু মেয়ে তা বুঝবে কী করে? দুহাতে চোখের পানি মুছে জয়তুন বেওয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, দুঃখের বোঝা ঘাড়ে থাকলে কাঁদতে তো হয়ই।
ঘাড়ে না রেখে ঝেড়ে ফেলো।
কাকে? দুঃখকে?
হ্যাঁ, তাই। একজন মানুষ আর একজনের জন্য সারা জীবন বসে থাকে না।
আমি তোর মতো কঠিন নারে মেয়ে।
ছুটতে ছুটতে আসে বারো বছরের আল আমীন।
মা খিদা লাগছে, ভাত দে।
একমুহূর্ত মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তুই রোজ রোজ কাঁদলে আমি গরু নিয়ে পদ্মা নদীতে নামব।
না, না বাজান।
জয়তুন বেওয়া ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
না, তুই নামবি না। আমার মাথা ছুঁয়ে বল যে নামবি না।
না, তোর মাথা ছুঁতে পারব না। তুই আমাকে ভাত দে।
আয়। জয়তুন বেওয়া উঠে দাঁড়ায়।
এখনও তেমন বেলা হয়নি। রোদে ভেসে থাকছে না উঠোন। আলতু আর ফরিদ এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ওরা উঠলে জয়তুন বেওয়ার কাজ বাড়বে। কাজ শেষ হলে ওদের নিয়ে নদীর ধারে যাবে। ছোটো ছেলে-মেয়ে দু-জনই নদীর ধারে যেতে চায়। ছুটোছুটি করে। জয়তুনের চেয়ে বেশি কে জানে যে ওরা কিছুদিন ছুটোছুটি করবে তারপর উপার্জন করতে নামবে। মানুষের বাড়িতে গরু চরানোর কাজ, খেতখামারে দিনমজুরি/ আম বাগানে পাহারাদারি/ঘরের কাজের বুয়া/করতে করতে একদিন ওরা বড় হবে/নিজেদের সংসার হবে। সংসারের ঘানি টানতে-টানতে–টানতে…। জয়তুন বেওয়া বুঝে যায় যে ও নিজের জীবনে পৌঁছে গেছে। ও আর আলতুর ছায়ায় নেই।
জয়তুন পদ্মা নদীর পাড়ে এসেছে।
শৈশব থেকে এই নদীর পাশাপাশি বড়ো হয়েছে জয়তুন। ওর বাবার বাড়ি তারাপাশা। স্বামীর বাড়ি মোহনপুর। পদ্মা নদীর পাড়ের গ্রামে। অপর পারে ইন্ডিয়া। ছোটোবেলায় একদিন রুস্তুমকে বলেছিল, মনে হয় নদীটা সাঁতার দিয়ে ওই পারে চলে যাই।
ওখানে গিয়ে কী করবি?
জঙ্গলে ঘুরে দেখব ফলপাকুড় কী আছে। ফুল পেলে বেনিতে লাগাব। আর খরগোশের বাচ্চা পেলে ঘাস দিয়ে মাথায় বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসব।
রুস্তুম দাঁত কেলিয়ে হে – হে করে হেসে বলেছিল, নদীর ওই পার আমাদের দেশ না।
তবে কার দেশ?
অন্যদের দেশ। ওই দেশের নাম ইন্ডিয়া। ওখানে গেলে তোকে পুলিশে ধরবে।
কেন? ধরবে কেন? আমি তো আবার চলে আসব। আমি তো থাকব না। একদিনও না।
আমি বেশি কথা জানি না। শুধু জানি অন্য দেশে যেতে হলে পাসপোট লাগে।
পাসপোট? সেইটা আবার কী?
ধুর বোকা, শুধু শুধু কথা বলিস না। আমিও বেশি কিছু জানি না। শুধু জানি পুলিশের হাতে ধরা পড়লে মার খেতে হবে। মারের চোটে মরেও যায় কেউ কেউ।
বিস্ময়ে থ হয়ে গিয়েছিল জয়তুন। সেই বিস্ময় নিজের জীবনে এসে ঠেকেছে। এজন্যই আবদুল হান্নানের মৃত্যুর ঘোর কাটছে না। ইন্ডিয়ার জলপুলিশের হাতে মার খেয়েই তো মরে গেল হান্নান। ওর দুঃখ শৈশবের সঙ্গে যৌবনের এক হয়ে যাওয়া—ওর দুঃখ শৈশবের বিস্ময়ের সঙ্গে মৃত্যুর এক হয়ে যাওয়া। ওর মনে হয় এই ঘোর থেকে ও সারা জীবনে আর বের হতে পারবে না।
মাঝে মাঝে গাঁয়ের কেউ ভুল সংশোধন করে দিয়ে বলে, যারা মেরেছে তারা ইন্ডিয়ার পুলিশ না। ওরা বিএসএফ। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।
আমি অত কিছু বুঝি না। আমার শুদ্ধ করে বলারও দরকার নাই। তোমরা আমাকে শেখাতে এসো না।
দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীরা মাথা নাড়ায়।
ওনাকে এত পড়ালেখা শেখাতে হবে না। ওই লোকগুলো পুলিশ হোক আর বিএসএফ হোক মানুষটাকে তো মেরে-পিটিয়ে শেষ করে দিয়েছে।
এখন নদীর ধারে বসে আবার কাঁদতে শুরু করে জয়তুন। চোখ মোছার সময় মনে পড়ে আবদুল হান্নানের কথা।
বলেছিল, দিনমজুরির কাজে শরীর বাঁকা হয়ে আসেরে বউ। আর পারি না।
কী করবে তাহলে?
গরুর নদী পারের কারবারিতে ঢুকব।
পদ্মা নদী সাঁতরায়ে গরু আনবে?
তাইতো। গরু আনা কারবারিতো এই নদীপথেই হয়।
নদীতে স্রোত অনেক না?
হ্যাঁ, অনেক তো।
ডর লাগে না?
লাগলে কী করব, পেট ভাত চায় তো। চায় না?
জয়তুন মাথা নেড়ে বলেছিল, চায়। পেট তো একটা না, ছয়টা।
আবদুল হান্নান হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার মনে হয় মজাই লাগবে। নদী সাঁতরে ইন্ডিয়ার মালদহে যাব। আবার গরুর লেজ ধরে ভাসতে ভাসতে এপারে আসব। তুমি নদীর ধারে দাঁড়ায়ে থাকবে বউ।
জানব কেমন করে যে তুমি কখন আসবে?
আবদুল হান্নান মাথা নেড়ে বলেছিল, তা জানা যাবে না।
সেই রাত দুজনে খুনসুটি করে কাটিয়েছিল। সংসারে অভাব থাকলেও মানুষটাকে নিয়ে জয়তুন বেওয়ার কোনো অভিযোগ ছিল না। দিন তো বেশ কেটে যাচ্ছিল।
পরদিন মহাজনের সঙ্গে দরদাম ঠিক করে আবদুল হান্নান নদী সাঁতরে মালদহ সীমান্তে পৌঁছে গেল। এক জোড়া গরু বা মহিষ আনতে পারলে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পাওয়া যায়। হান্নান নতুন বলে পাঁচ হাজার টাকায় দরদাম ঠিক হয়। মনের আনন্দে পদ্মা সাঁতরে অপর পারে যেতে কোনও অসুবিধে হলো না। ওপারের দালালরা মহাজনের গরু ঠিক করে দিলো।
এপার থেকে যাওয়ার সময় আবদুল হান্নান জেনে গিয়েছিল কীভাবে নদীপথে গরু আনে মহাজনেরা। তারা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল ওকে যে কীভাবে গরু আনতে হবে। তাছাড়া যারা এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের কাছেও শুনে অনেক কিছু জেনে নিয়েছিল। আবদুল হান্নান ধরে নিয়েছিল যে এই কাজটি করা তার জন্য কঠিন হবে না। গরু বা মহিষ কেনার কাজ হবে ভারতের সীমান্তের ভেতর। গরু বিক্রি করবে ওরা, ভারতের লোকেরা। কিনবে বাংলাদেশের লোকেরা। গরু নিয়ে ওদের আসতে হবে বাংলাদেশের ভেতর। বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা দেশে গরু আনার জন্য ট্যাক্স নেবে। টাকা আদায় হলে ওরা গরু-মহিষের গায়ে সিল দেবে। তখনই এগুলোকে দেশে আনার কোনও বাধা থাকবে না। আনা হবে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী। বৈধভাবে।
সমস্যা হলো নদীপথ।
গরু আনতে হয় নদীপথে। ভুল করে নদীপথে ভেসে ভারতের সীমান্তে চলে গেলে ভারতের জলপুলিশ ওদের ধরে। ধরে মারধোর করে। কখনও জেলে পাঠিয়ে দেয়। গরুর কোনও খোঁজ থাকে না।
এই পথে টাকা রোজগারের পাশাপাশি বিপদও আছে। এই বিপদের কথা জয়তুন বেওয়া জানতো। একবার ওদের গাঁয়ের একজন গরু আনতে গিয়ে পদ্মা নদীতে ভেসে গিয়েছিল। কেউ আর ওর খোঁজ পায়নি। দুঃখিনী হাসমত বেগম এখনও কপাল চাপড়ায়। বলে, বেশি টাকার লোভে পড়ে লোকটা ওই পথে গেল। এরচেয়ে দিনমজুরি করাই ভালো ছিল। দিনমজুরিতে মরণের পথ খোলা থাকে না।
আবদুল হান্নানকে এই কথা বললে ও বলে, গরিবের মরণের পথ সবখানে খোলা। বেশি কথা বলবে না বউ। আগে তো বাঁচা, তারপর মরণ। নদীর পানিতে ভাসার মধ্যে সুখ আছে। দিনমজুরিতে সুখ নাই। কেবল কষ্ট।
যে মানুষের জীবনে কষ্ট প্রবল তাকে কেন সুখ পেতে বাধ সাধবে জয়তুন বেওয়া? তার কী সাধ্য কষ্ট দূর করার? কপালে যা আছে তাই হবে, এমন প্রবাদ বাক্যটি মেনে জয়তুন বেওয়া দেখেছিল আরও কয়েক জন মানুষের সঙ্গে নদীপথে যাত্রা করে আবদুল হান্নান।
ফিরেও এসেছিল পাঁচ দিন পরে।
সঙ্গে এনেছিল এক জোড়া মহিষ।
মহাজন পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল। খুশি মনে বাড়ি ফিরে জয়তুনের হাতে টাকা দিয়ে বলেছিল, হিসাব করে খরচ করবে। এই কাজ সারা মাস থাকবে না। টাকা শেষ হলে আমাকে দিনমজুরির কথা বলবে না।
একটু জিরিয়ে আবার বলেছিল, ওই কথা বললে আমার যেইদিকে দুই চোখ যায়, সেইদিকে যাব।
জয়তুন হাসতে হাসতে বলেছিল, না, আমি তোমাকে দিনমজুরির কথা বলব না। দরকার হলে আমি খেতে ধান লাগানোর কাজ করব। তুমি চুলা সামাল দিও।
কী, কী বললে? আমি চুলা সামাল দিব?
দুচোখ কপালে তুলেছিল আবদুল হান্নান।
জয়তুন হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। ওর বাঁধ-ভাঙা হাসির তোড়ে আবদুল হান্নান কথা বলতে পারেনি। জয়তুনের স্বভাবই ছিল এমন। যখন হাসতে ইচ্ছেমতো সময় নিয়ে হাসতো। কেউ ওকে থামাতে পারতো না।
সেদিন হাসি থামলে জয়তুন দুচোখে ঝিলিক তুলে বলেছিল, আমি খেতের কাজ পারলে তুমি চুলার কাজ পারবে না কেন গো?
ঠিকই বলেছিস বউ। আমিও পারব।
তারপর বড়ে করে শ্বাস ফেলেছিল। বলেছিল, চুলার কাজও দিনমজুরি। কষ্টের।
সেদিন আবদুল হান্নানের জন্য খুব মায়া হয়েছিল জয়তুন বেওয়ার। মানুষটা অনেক বুঝদার ছিল।
পরে আরও একদিন বলেছিল, বউ টাকাগুলো জমাও। যদ্দুর পারো অদ্দুর জমাও। কোনদিন পদ্মার স্রোতে ভেসে যাব, কে জানে! নদীরে বিশ্বাস নাই। শোনো নাই নদী একূল ভাঙে ওকূল গড়ে।
সেদিনও জয়তুন বেওয়া প্রাণখুলে হেসেছিল। হাসতে হাসতে আকাশ-পাতাল ভরিয়ে ছিল।
আবদুল হান্নান হাঁ করে ওকে দেখেছিল। অবাক হয়েছিল। বিব্রতও। তারপর জয়তুনকে বলেছিল, বউরে গরিবের ঘরে এত হাসি মানায় নারে।
হাসি আল্লাহর দান। হাসিতে তো কোনো খরচ লাগে না।
দপ করে নিভে গিয়েছিল জয়তুনের হাসি। গরিবের হাসি মানায় না—কথাটি ওর বুকে খুব বিঁধেছিল। কেন মানায় না, এমন প্রশ্ন ও আবদুল হান্নানকে করেনি।
আজ সকালে পদ্মার ধারে বসে কাঁদতে কাঁদতে ওর সময় কাটে। দুশ্চিন্তা ওকে ঘিরে রাখে। ছেলে মেয়েদের ভাবনায় ম্রিয়মাণ থাকে—ওর বুক থেকে হাসি শুকিয়ে গেছে। পদ্মায় যেমন বালু পড়ে, চর জাগে তেমন ওর অবস্থা। ভয়ে ওর বুক শুকিয়ে গেছে।
দুই ছেলে মেয়ে কাছে এসে দাঁড়ায়।
মা বাড়ি চলেন।
যাব। তোরা খেল।
ভাত রাঁধবেন না?
রাঁধবো তো।
দেরি হলে খিদা লাগবে।
নারে, রাঁধতে দেরি হবে না। যা, আর একটু খেলে আয়।
আজ কী রাঁধবেন মা?
দেখি কী রাঁধি।
তাইলে বাজারে চলেন। রুই মাছ কিনবেন।
বড়ো একটা হাঁসও। মা বাজারে চলেন।
বাজার!
জয়তুন ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব অসহায় বোধ করে। কখন তো এত নিচুকণ্ঠে কথা বলেনি ও। আজ ওর কী হলো? কোথায় জোর চলে গেল?
ছেলে মেয়েরা আবার জিজ্ঞেস করে, মা বাজারে যাবেন না?
জয়তুন চুপ করে থাকে।
মাগো, আপনের কাছে টাকা নাই? আপনি চুপ করে আছেন কেন?
আমার কাছে টাকা আছে বাবা। আমি তোমাদের জন্য রুই মাছ কিনব। হাঁস কিনব। চল বাড়ি যাই।
বাড়িতে যাবেন কেন?
টাকা আনতে যাব।
আচ্ছা চলেন।
বাড়ি ফেরার পথে পা ভেঙে আসে জয়তুনের। টাকা জমাতে বলেছিল আবদুল হান্নান। জয়তুন ওর কথা শুনেছিল। ও মাটির হাঁড়িতে টাকা জমাতো। টাকাগুলো খড় দিয়ে ঢেকে রাখতো। চট করে কেউ বুঝতে পারতো না যে হাঁড়ির মধ্যে কী আছে।
ওই হাঁড়ি থেকে টাকা নিয়ে হাঁস কিনে আনবে ছেলে মেয়েদের জন্য। বছরের দু-চারটা দিন ভালো খাবার না দিলে ওরা শক্তি পাবে কোথা থেকে? আনন্দই বা পাবে কোথায়? বাপ নেই বলে তো ছেলে মেয়েরা একদম এতিম হয়নি। মা-তো আছে। কিন্তু সে থাকা কী থাকা? জয়তুনের বুক থড়ফড় করে। আবদুল হান্নানের কথা মনে হয়—গরিবের এত হাসি মানায় না। জয়তুন চোখ মুছতে মুছতে বাজারে যায়।
রাতে হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খায় সবাই।
আল আমীন খেতে খেতে বলে, রোজ রোজ হাঁস রাঁধতে পারেন না? নইলে গরুর গোস্ত?
সেউতি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, বল নইলে খাসির গোস্ত, মুরগি, কবুতর, রুই মাছ, কোরাল মাছ, পোলাও-কোর্মা, পায়েস-জরদা?
তোমার এত রাগ কেন?
আমি তো পরের বাড়ি কাজ করি। বাড়ি আসার সময় এক গামলা ভাত দেয়। খাটতে খাটতে আমার আর বাঁচার ইচ্ছা হয় না। আমি একদিন নদীতে ডুবে মরব।
ঢং, আমি কাজ করি না? আল আমীন ভাতের থালা ঠেলে দেয় সামনে। আমি রোদে ঘুরে গরু চরাই না? ঘাস কাটি না? গোয়াল সাফ করি না? গোবর ঘাঁটি না? আমারও মরতে ইচ্ছা হয়।
ছোটো দুজনের মুখে কথা নেই।
আলতু কাদো কাদো স্বরে বলে, আর কয় বছর পরে বুবুর মতো আমারও কাজ করতে হবে।
ফরিদও একই ভঙ্গিতে বলে, আমিই বা কত বড়ো হব? কাজ করার জন্য আর কত বড়ো হব?
জয়তুন দেখতে পায় হাঁসের মাংসে ভীষণ মাছি। মাছির ঠেলায় বন্ধ হয়ে গেছে খাওয়া-দাওয়া। ওর বুকে দম ধরা স্তব্ধতা।
সেউতি আবার জোরে জোরে বলে, বাবা যে কেন মরে গেল!
ও বাবাগো—বলতে বলতে আল আমীন দুহাতে মুখ মোছে।
জয়তুন মাথায় হাত দিয়ে বলে, ভাত খা বাবা।
আল আমীন হাত গুটিয়ে বসে থাকে।
সেউতি ছোটোদের মাথায় হাত রেখে বলে, ভাত খা। তোরা না হাঁসের মাংস খেতে চেয়েছিলি।
হাঁসের মাংস ভালো না। আমরা খাব না।
আলতু বলে, হাঁসের মাংসে পচা গন্ধ। জয়তুন দেখতে পায় কুপির মিটিমিটি আলো থাকার পরও ঘর জুড়ে অন্ধকার। হাঁসের মাংস অন্ধকারের স্তূপ হয়ে সব কিছু আড়াল করেছে। মানুষগুলোকেও। ও সেউতির মাথায় হাত দিয়ে বলে, ভাত খা মা। কত কষ্ট করে হাঁসটা রাঁধলাম—
রাঁধছেন কেন? গরিবের এত কিছু খাওয়া সাজে না।
জয়তুনের বুক ধক করে ওঠে। ঠিক বাপের গলায় কথা বলছে মেয়েটা। আসলে কোথাও কিছু নেই। শুধু আবদুল হান্নানের স্মৃতি। এই স্মৃতি ওদের জীবনে এখন গাঢ় অন্ধকার।
জয়তুন আল আমীনের প্লেট থেকে একমুঠো ভাত নিয়ে ওর মুখে দেয়। ও মুখ ঘুরিয়ে বলে, লাগবে না। আমি নিজে খাবো।
ছোটো দু-জনকে ভাত দিতে গেলে ওরা বলে, হাঁসের মাংস শক্ত। চাবাতে পারি না।
সেউতি ধমক দেয়, কে বলেছে শক্ত? খা বলছি। শুধু মিছা কথা।
দু-জনে ভয়ে হাঁসের মাংসের টুকরো কামড়ে ধরে। জয়তুন আবার চোখ মোছে। সেউতির ভয়ে কাঁদতে পারে না।
আল আমীন থালার ভাত শেষ করে বলে, এই দিনমজুরির কাজ আর করব না। এক বছরের মাথায় নদীপথে গরু আনব। কামাই বাড়বে।
কামাই!
আল আমীন মায়ের দিকে তাকায় না। উঠে দাঁড়ায়।
সেউতি বলে, কী বললি? কামাই!
হে-হে করে হাসতে হাসতে আল আমীন বলে, কামাই তো! রোজ রোজ হাঁস খাওয়ার কামাই।
ও এক লাফে ঘরের চৌকাঠ পার হয়ে বাইরে যায়। চিৎকার করে গান গায়—ও বন্ধুরে, পীরিতের এত জ্বালা—। গান গাইতে গাইতে ও বাড়ির বাইরে চলে যায়। ওর কণ্ঠস্বর আর শোনা যায় না।
সেউতি হাসতে হাসতে বলে, আপনার ছেলে পেকেছে মা। সামাল দিতে কী পারবেন?
জয়তুন বেওয়া চুপ করে থাকে। মেয়ের দিকে তাকায় না। মুখ নিচু করে রেখে বলে, তোকে আর এক চামচ ভাত দি?
সেউতি ঘাড় কাত করে থালা এগিয়ে দেয়।
জয়তুন ওকে দুই-তিন চামচ ভাত দেয়। দু-টুকরো মাংস আর আলুও দেয়। সেউতি ফিক করে হেসে বলে, মায়ের আদর মিঠা পানি। বাপের মরণ নোনা পানি।
মেয়েটা মাঝে মাঝে এমন করেই কথা বলে। ফরিদ আর আলতুর খাওয়া হয়েছে। ওরা উঠে চলে যায়।
আপনিও খান মা।
সেউতির কণ্ঠস্বর বুঝি নদীর বাতাস বয়ে আনে। চোখ ছলছল করে জয়তুনের।
মাগো, আমি আপনার থালায় ভাত দেই।
না, মা। খিদা নাই। ভালো লাগে না।
সেউতি কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, খিদা আছে। মিছা কথা বলেন কেন আম্মা? আমি সব বুঝি। আমারও পাকার বয়স হয়েছে।
জয়তুন নিজের থালা বাড়িয়ে দেয়। সেউতি হাঁড়ি থেকে ভাত তুলে দেয় মায়ের থালায়। থালা ভর্তি করে ভাত দেয়। ওর মনে হয়, মায়ের পেটে আজ অনেক খিদে। হাঁসের মাংস আলু ঝোল দিয়ে ভরিয়ে দেয় ভাতের সবটুকু।
এত দিলি?
পারবেন, খান।
তারপর নিজের থালার দুই লোকমা ভাত খেয়ে ঢকঢকিয়ে পানি খায়। থালা হাতে করে উঠে যেতে যেতে বলে, আমি গেলাম। পুরা পাকঘর আপনার আম্মা। আপনি আব্বার কথা মনে করে কাঁদবেন আর ভাত খাবেন। খেতে খেতে রাত হলে ক্ষতি নাই।
সেউতি বের হয়। রান্নাঘরের দরজার ঝাঁপ টেনে দেয়। বাড়িতে কেউ নেই। গরু না। হাঁস-মুরগিও না। ফরিদ-আলতুও বের হয়েছে। ও কী কোথাও যাবে? না। ও বারান্দায় বসে থাকে। ভাবে মায়ের জন্য কারও অপেক্ষা করা উচিত। বাড়িতে তো ও একাই আছে।
জয়তুন ভাত খায়। টের পায় খুব খিদে পেয়েছে। দুই-চার লোকমা খাওয়ার পরে চারদিক অন্ধকার লাগে। ভাতের থালার ওপর হাত আটকে যায়, যেন ওর ডান হাতটা আবদুল হান্নান হয়ে পদ্মা নদী সাঁতরাচ্ছে। জয়তুনের কাছে এটি এখন আগস্ট মাসের এক রাতের গল্প। বিভিন্ন জনের কাছে নানাভাবে শুনতে শুনতে গল্প এখন রূপকথা।
আগস্ট মাস। বর্ষাকাল। শ্রাবণ মেঘের মাস। ফুলেফেঁপে প্রমত্ত পদ্মা কীর্তিনাশার চেহারায় গর্জন করে ছুটছে। তারপরও নদীকে ভয় নেই। বাতাসের অনুকূলে ভাসতে থাকলে ঠিকঠাক মতো পোঁছে যাবে মনোহরপুর ঘাটে। ভয় নেই আবদুল হান্নানের। এরমধ্যে বেশ কয়েক বার পারাপার করা হয়েছে তার। নিরাপদে এক দেশের সীমান্ত থেকে আর এক দেশের সীমান্তে পৌঁছে গেছে।
রাতের অন্ধকার মাথায় নিয়ে নদীতে নেমে পড়েছিল আবদুল হান্নান। দু-হাতে ধরে রেখেছিল দুই গরুর লেজ। গরুর লেজই নদীপথ পাড়ি দেয়ার একমাত্র ভরসা। ভাসতে-ভাসতে-ভাসতে… আবদুল হান্নান অনেক দূর চলে আসে। একদম মাঝনদীতে। কোথা থেকে কী হয় বুঝতে পারে না। দেখতে পায় স্পিডবোট নিয়ে তাকে তাড়া করছে ভারতীয় জলপুলিশ। একসময় তাকে ধরে ফেলে ওরা। ও গরুর লেজ ছেড়ে দেয়। তাতেও রক্ষা নেই। পুলিশ তাকে বোটের ওপর ওঠায়। মারতে থাকে। মারতেই থাকে। ওরা কী ভাষায় কথা বলে তা ও বুঝতে পারে না। মার খেয়ে অচেতন হয়ে যায় ও। একসময় লাথি দিয়ে ফেলে দেয় নদীতে।
নদী তাকে কোথায় নিয়ে গেছে তার খোঁজ কেউ জানে না। তার কবর হয়নি এ বাড়িতে। ওর দাদা-দাদি, বড়ো চাচা, বাবা-মায়ের কবর আছে বাড়ির একদিকে। সময়-সুযোগ মতো কবরে গিয়ে দোয়া পড়ে জয়তুন। ভাত খাওয়া হয় না। মাংস আর আলু খেয়ে ভাতে পানি ঢেলে দেয়। সকালে পান্তা খাবে। শুকনো মরিচ পুড়িয়ে পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা খেতে ওর ভালোই লাগে। মনে হয় বুকের ভেতর শীতল হয়ে গেল। গরম ভাতে এমন অনুভব হয় না। সেটা শুধুই পেট ভরানোর জন্য। হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার পরও আনন্দ নাই। ওর যত আনন্দ পান্তাভাতে। শৈশব থেকে এই আনন্দ নিয়ে ওর এতটুকু জীবনে পৌঁছানো। জয়তুন কুপির দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে দৃষ্টি কাউকে খুঁজছে। কিংবা বাইরে থেকে কারও পায়ের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে, যে উঠোন পার হয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে, সেউতির মা ভাত হয়েছে?
মানুষটার বুকভরা মায়া ছিল। মেজাজ কম ছিল। রাতে খাওয়ার পরে বারান্দায় বসে গান গাইত। কোন রাতে গান না গেয়ে ঘুমুতে গেছে এমন স্মৃতি জয়তুনের নেই। মনে পড়ে সেউতি হওয়ার সময় তিন দিন ওর ব্যথা ছিল। সে সময় নাকি গান গাইতে পারেনি আবদুল হান্নান। এটা তার কাছ থেকে শোনা কথা। জয়তুন এ কথা শুনে মজা পেয়েছে। এ কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাঁকুনি দেয় ও।
শুনতে পায় উঠোনে ছেলে-মেয়েদের পায়ের শব্দ। আল আমীন জোরে জোরে বলে, মায়ের এখনও খাওয়া হয়নি?
সেউতির কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ও জিজ্ঞেস করে, তুই কোথায় গিয়েছিলি আমীন?
দূরে না, কাছেই।
কোথায়?
বিড়ি টানতে।
বিড়ি! সেউতি চেঁচিয়ে ওঠে।
আস্তে, মা শুনবে।
তুই, তুই—
তোতলাস কেন? তুই জানিস না ছেলেদের কথা? আমার বয়সি কামলা ছেলেরা সবাই বিড়ি টানে।
কবে ধরেছিস?
মাস দুয়েক হলো।
কাশি আসে না?
আসে। সেইজন্য বাইরে যাই।
তুই তো বেশ পেকে গেছিস রে আমীন।
হো-হো করে হাসতে হাসতে ও বলে, যাদের বাপ থাকে না তারা আরও তাড়াতাড়ি পাকে।
সেউতি মন খারাপ করে না। ভাবে, ও নিজের মতো করে বড়ো হতে শিখছে, শিখুক। বখে না গেলে হয়।
তুই বখে যাবি না তো আমীন?
না, না খারাপ ছেলে হবো না। মন দিয়ে সবাইকে দেখাশোনা করব।
খোদার কসম, তুই খারাপ কিছু করবি না?
খোদার কসম, এই তোমাকে ছুঁয়ে বললাম, করব না। তুই ভয় পাস না বুবু।
তুই কিছু করলে আমার খুব দুঃখ হবে।
আবার হাসতে হাসতে একছুটে রান্নাঘরে আসে আল আমীন। ফরিদ আর আলতুও রান্নাঘরে এসেছে।
মা, আপনার ভাত খেতে এত দেরি হয় কেন?
আমি যে অনেক ভাত খাই।
কয় থালা ভাত খান?
পাঁচ-ছয় থালা।
হি -হি করে হাসে আলতু আর ফরিদ।
আমি কোনওদিন আপনাকে এত ভাত খেতে—
দেখিসনি তো?
হ্যাঁ, দেখিনি।
আমার সঙ্গে যে জিন-পরিও ভাত খায়।
এবার সবাই মিলে হাসে। হাসিতে বাড়ি ভরিয়ে দেয়। জয়তুনের মনে হয়, এদের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে। আর এই বাড়ির সবখানে আবদুল হান্নান আছে। কবর নাই তো কী হয়েছে, আছে তো!
জয়তুন হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন গুছিয়ে একদিনের পাট চুকিয়ে ফেলে। একটা দিন তো গেল, রাতের বাকিটুকু কোনও না কোনওভাবে কাটবে। হয় ঘুমিয়ে, না হয় অর্ধেক রাত অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে।
দিন গড়িয়ে ছেলে- মেয়েরা বড়ো হয়।
রোজার মাসের শেষ দিকে একদিন দুপুর বেলা ভাত খাওয়ার সময় আলআমীন বলে, আমি ঠিক করেছি ইদের দুই দিন আগে গোস্ত আনতে চরে যাব।
চরে? চরে কেন?
ওখানে ইন্ডিয়ার গরু জবাই হবে। দাম কম পড়বে।
টাকা কোথায় পাবি?
ইদের দিন মা পোলাও-মাংস রাঁধবে বলে আমি একটু একটু করে টাকা জমিয়েছি। ফুর্তি করব, ফুর্তি।
টাকাগুলো আমাকে দে। আমি তোদের জন্য জামাকাপড় কিনব।
না, তা হবে না। আপনার টাকা দিয়ে আপনি আমার জন্য একটা কালো রঙের হাফ প্যান্ট কিনবেন।
জয়তুন ভুরু কুঁচকান।
কালো না, আমি নীল রঙের হাফ প্যান্ট কিনব।
সেউতি হাসতে হাসতে বলে, তোর গায়ের রঙ কালা, তুই কালা রঙ চাস কেন? আমি মাকে বলব তোকে লাল রঙের প্যান্ট কিনে দিতে।
তোরা যদি লাল-নীল প্যান্ট কিনিস সেটা আমি নদীতে ভাসিয়ে দেব।
আচ্ছা, আচ্ছা, তুই যা চাইবি। তা হবে। ভাত খা এখন।
আল আমীন গপগপিয়ে ভাত খেয়ে বাইরে চলে যায়। জয়তুন খুশি হয়ে বলে, ছেলেটা আমাদের জন্য ভাবে। সবাইকে মাংস খাওয়াবে বলে, টাকা জমিয়েছে। বেশ করেছে।
তুমি খুব খুশি না মা?
হ্যাঁরে, খুব খুশি। খুশি হব না?
ও আব্বার মতো হয়েছে আম্মা। আব্বা ইদের আগে আমাদের জন্য গোস্ত জোগাড় করতেন।
জয়তুন মাথা নাড়ে।
আপনি পোলাও রান্না করতেন।
হ্যাঁরে, মনে আছে।
আব্বাও কালো রঙের জামা পরতো। যেদিন আব্বা গরু আনতে গেল সেদিনও তার গায়ে ছিল কালো রঙের জামা।
জয়তুন চোখ বড়ো করে তাকায়। মেয়েটা ঠিকই মনে রেখেছে।
আমার জন্য আপনার জামা কিনতে হবে না আম্মা। সেই টাকা দিয়ে আপনি জিলাপি কিনবেন। গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের জিলাপি খাওয়াবেন। তাহলে আমি ইদে বেশি আনন্দ পাব।
তোর জন্য একটা জামা কিনব না মাগো?
না আম্মা, কাজের বাড়ির খালাম্মা বলেছে জামা কিনে দেবে।
জয়তুন বেওয়ার মন খারাপ করে। বুঝতে পারে মেয়েটি বাপের জন্য কাঁদে না। কিন্তু ওর বুক জুড়ে বাপের স্মৃতি নিশ্চুপ নেই। স্মৃতি কথা বলে।
ইদের কয়দিন আগে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আল আমীন। জয়তুন সারা গাঁয়ে খুঁজে ওর হদিস করতে পারে না। চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ থেকে দু-দিন বাদে বাড়ি ফেরে ঘাটের লোক। মুন্সী আল আমীনের নিখোঁজ হওয়ার খবর শুনে চমকে ওঠে।
বলেন কী? ও ফিরে আসেনি?
জয়তুন ঘাড় নাড়ে।
ও তো আমাকে বলল চরে গোস্ত আনতে যাবে। আমি দেখলাম ও গরুর লেজ ধরে নদীতে নামল। তারপর—কথা বলতে পারে না মুন্সী। জয়তুন শুকনো মুখে বাড়ি ফেরে। গুণগুণ করে কাঁদে সেউতি। ঘরে থাকলে কাঁদে, রাস্তায় হাঁটার সময় কাঁদে, অন্যের বাড়িতে কাজের সময় কাঁদে। ওর কান্না দেখে সবাই মন খারাপ করে।
শুধু চোখে পানি নেই জয়তুনের। ও বোবার মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেউতিও সবদিকে তাকায় শুধু ভিজে চোখে। ও বুঝতে পারে পুরো নদীটা ওর চোখে ভর করেছে। বাবার মৃত্যুর পরে নদী ওর মায়ের চোখে ঢুকেছে। ভাই নিখোঁজ হওয়ার পরে ঢুকেছে ওর চোখে। আল আমীনের প্যান্ট খুঁজে দেখেছে। ঘরে ওর পুরোনো প্যান্ট দুটো আছে। মায়ের কেনা নতুন কালো প্যান্টটা পরেই ও নদীতে নেমেছে। ও বুকে ইদের খুশি নিয়ে গেছে। শুধু মাংস নিয়ে ফেরেনি। অপেক্ষায় রেখে দিয়েছে বাড়ির সবাইকে।
ইদের আনন্দ ফুরিয়ে গেছে। আবার দিনের শুরু। অন্যের বাড়ি থেকে দেয়া নতুন জামাটি পরা হয়নি সেউতির। আল আমীন ফিরলে পরবে এমন আশায় প্রতিদিন নদীর ঘাটে যায় বাড়ির সবাই।
আগে নদীর ঘাটে যেত জয়তুন একা। স্বামীর শোকে কাতর হয়ে যেত। এখন যায় বাড়ির সবাই। ফরিদ আর আলতু আগে যেত খেলতে, এখন সবার সঙ্গে চুপ করে বসে থাকে নদীর পাড়ে। কখনও নদীতে গরু ভাসতে দেখলে দৌড়ে ঘাটে গিয়ে দাঁড়ায়।
কাকু, ওই নদীর লেজ ধরে কী আমীন ভাই আসবে? সেই তো কবে গোস্ত আনতে গেছে, আসে না কেন?
মুন্সী ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলে আলতু বলে, কাকু, আমার ভাই মাঠে গরু চরাতো। ভাই বলেছে, আমাদেরই ইদের দিন গোস্ত খাইয়ে তারপরে নদীতে রাখালের কাজ করবে। নদী তো মাঠ না কাকু। নদীতে কী রাখালের কাজ করা যায়?
মুন্সী ওদের কাছে টেনে বলে, এরপর ঘাটে আসলে ছিপ নিয়ে আসবি। আমার কাছে বসে তোরা মাছ ধরবি।
দুই ভাই-বোন হাততালি দিয়ে বলে, কী মজা, কী মজা! কাকু খাবে মাছ ভাজা।
দু-জনে লাফাতে লাফাতে আবার ছুটে যায় মায়ের কাছে, বোনের কাছে।
আমাদের একটা বড়শি বানিয়ে দেবে বুবু?
সেউতি মাথা নেড়ে বলে, না।
কেন না? আমরা মাছ ধরব।
মাছ ধরার মতো তোমরা বড়ো হওনি। আম্মা বাড়ি চলেন।
কথা শেষ করেই সেউতি হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে কাঁদে। প্রায় পনেরো দিন পরে মনোহরপুরে লাশ ভেসে আসে আল আমীনের। দেখে চেনার উপায় নেই। জয়তুন আর সেউতি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ওর কালো রঙের প্যান্টের দিকে। ওকে বোঝার চিহ্ন এটুকুই। অবিশ্বাস্য মনে হয় জীবনের জলরঙ।

জন্ম জুন ১৪, ১৯৪৭ সালে। তিনি একজন প্রখ্যাত নারী ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব্ব সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দু’ বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৪ ই জুন, ১৯৪৭, রাজশাহী শহরে। তাঁর পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রাম। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন এবং মা মরিয়মন্নেসা বকুল। তিনি পিতা মাতার চতুর্থ সন্তান।
সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা অ্যাকাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে দু’টো চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি পান। একটি বাংলা অ্যাকাডেমিতে অন্যটি পাবলিক সার্ভির্স কমিশন থেকে সরকারি কলেজের জন্য। বাংলা অ্যাকাডেমীর চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন বাংলা অ্যাকাডেমির তৎকালীন পরিচালক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল্লাহ আলমুতি শরফুদ্দিন প্রমুখ। এর পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরকারি কলেজের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বোর্ডে শহিদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে পান। কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলি প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ এবং ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা অ্যাকাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরি থেকে অবসর নেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ উৎস থেকে নিরন্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ভ্রমণ তাঁর নেশা। তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা ২১টি, গল্প গ্রন্থ ৭টি এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৪টি। বহু পুরস্কার পেয়েছেন সেলিনা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ইত্যাদি।