১. জামের সোয়াদ
বিক্রমপুর অঞ্চলের কোন এক “পুকুরপাড়” নামের গ্রামে মিঞাবাড়ির মেজো ছেলের জন্ম হয়।
অজ্ঞাত কারণে এই পরিবারের সকলের ডাকনাম দেওয়া হয়ে থাকে ফুল ও ফলের নামে। এই নব্য শিশুটির বোনদের নাম ফুলের নামে রাখা হয়েছে – শেফালি, লিলি, হাসনা হেনা। বড় ভাইয়ের নাম ফলের নামে – আপেল। মেজো ছেলের পরে ভবিষ্যতে আরো দুটি ভাই জন্ম নেবে। তাঁদের নাম রাখা হবে যথাক্রমে ডালিম এবং আঙ্গুর।
ফুল ফলের এইসব লিঙ্গভিন্নতার কারণ বের করা এখন কঠিন হবে। কারণ মিঞাবাড়ির আর কোন ফলফুল বর্তমানে বেঁচে নেই।
মিঞাবাড়ির মেজো ছেলের যেদিন জন্ম হয়, সেদিন তার বাবা মেজো মিঞা পারিবারিক গোরস্থানের লাগোয়া জমিতে পুকুরের কাছে একটি জামগাছ রোপণ করেন।
পুকুর পাড় ভর্তি ফলফুলের গাছ।
এক সারিতে শেফালি, লিলি, হাসনা হেনা। অন্য সারিতে আপেল, আঙ্গুর, ডালিম গাছ। দুই সারির মাঝখানে শক্ত বাকল, পুরুষ্টু লতাপাতাডাল নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে একটা মাঝারি উচ্চতার জামগাছ।
মাটি ও আবহাওয়ার কারণে কিনা কে জানে, নাকি প্রশিক্ষিত যত্নের অভাবে, লিলিফুলের গাছ আর আপেলফলের গাছটা তেমন বাড়ে না।
কিন্তু ততদিনে আঙুরের লতা তড়তড় করে বাড়ে। ডালিম গাছে ছোট ছোট কমলা হলুদ রঙের ডালিম হয়। আর হাসনা হেনা ফুলের তীব্র মদির গন্ধে গ্রীষ্মবর্ষার রাতে বাদামী কালো সাপ আসে বুকে হেঁটে।
“জাম, জাম, আরে যমন মিঞা- ওদিকে যাইস না বাপ।
সন্ধ্যা বেলা সাপে কাটবে।”
জামের মা শরবরী খাতুন ভাঙা গলায় ডাকতেই থাকেন।
জামবালককে খুঁজতে ভরসন্ধ্যায় আপেল, শেফালি, লিলি, হাসনা হেনা সবাই ব্যস্ত। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
হঠাৎ আপেলের মাথার উপর টপাটপ জামের বীচির বৃষ্টি
হয়। কোনটা খাওয়া, কোনটা আধখাওয়া।
“ওরে শয়তান, দাঁড়াও তোমার একদিন কি আমার একদিন,” বলে আপেল লুঙ্গি কাছা করে সড়সড় করে উঠে যায় জামগাছে।
কান টেনে মাটিতে হিচড়ে ছোটভাইকে মায়ের সামনে হাজির করায়।
শরবরী খাতুন ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলেন:
“একটা জামও তোর জন্য পাকতে পারে না। কাঁচাপাকা জাম খাইয়া কয়দিন পর পর পেটের সুখ। কই মুখ খোল। জিভ বের কর। দেখি কত জাম খাইলে তোর পরান ভরে।”
জামবালক মারধর আর গালি খেয়ে মুখ খোলে।
জিভের রঙ জাম খেয়ে বেগুনী ও কালো।
এত জাম খেয়েও তার আশা মিটে নাই।
২. জামকাঠ
মিঞাবাড়ির গোরস্থানের জন্য আরো জায়গা লাগবে বলে গ্রামের বাড়ির জামগাছ কাটা হয়। মিঞাবাড়ির মৃত মুরুববীরা জায়গা পেয়ে খুশি।
কাটা জামগাছের কাঠ সঙ্গে নিয়ে জামবালক নৌকা চড়ে মুন্সিগঞ্জ শহরে পৌঁছায়। সেই কাঠ দিয়ে নতুন বাড়ির দরজা জানালা তৈরি হয়।
প্রায় অর্ধশতাব্দী গত হয়ে সেই জামকাঠের বাড়ি একদিন বিক্রি করার প্রয়োজন পড়ে। জামবালক গ্রাম ছেড়ে অনতিদূরে এক জামশূন্য রাজধানী শহরে থাকতে শুরু করে।
ব্যবসায়ী ব্যস্ততায় জামগাছে উঠে জাম খাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
জামফল খেয়ে জিভ বেগুনী ও কালো হবে। দেশ-বিদেশে জরুরী মিটিং হলে সেই জিভ দেখে কে কি বলবে।
জামবালক জাম খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
৩. জামজিভ
জামবাড়ির মেজো ছেলে আশি বছর বয়সে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে উত্তরের মহাদেশে যায়।
কেন এই বয়সে সে পরবাসী হয়, সেই প্রশ্নের উত্তর জানে তাঁর একমাত্র জীবিত সন্তান আর পরলোকগত স্ত্রঈ।
একাকিত্ব ও শীতে কাবু কুঁজো হয়ে সে যখন তাঁর মুখে কোনো কিছুর আর স্বাদ পায় না, গন্ধ হারায় –
অকস্মাৎ অর্ধশতক সময় পার করে জামগাছের বড় পুষ্টু জামের মিষ্টতা প্রাচীন জামবালকের পুরাতন জিভে মনে আসে।
বাইরে যত বরফ পড়ে পুরু হয়, তত তার ঠোঁট জিভ মুখ।
কি এক চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা রসে ভিজে উঠে।
কোন এক বিপন্ন সন্ধ্যায় জামবালক শুনতে পায়:
“জাম, জাম, আরে যমন মিঞা- ওদিকে যাইস না বাপ।
সন্ধ্যা বেলা সাপে কাটবে…
মুখ খোল। জিভ বের কর।
দেখি কত জাম খাইলে তোর পরান ভরে…”
জামবালকের শরীর বাইরে ঝরতে থাকা তুষার ঝড়ের মতন বরফঠান্ডা হতে শুরু করে।
তাঁর জিভ কিন্তু জামের রসে সড়সড় করতেই থাকে।
***
ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট সই করার আগে পরবাসী অশীতিপর বৃদ্ধের জিভ দেখে আশ্চর্য হয়।
জিভের রঙ অতিরিক্ত জাম খেয়ে বেগুনী ও কালো।
প্রবাসী লেখক। পেশায় গবেষক, শিক্ষক, নৃবিজ্ঞানী।
প্রথম গল্পগ্রন্থ “আরেকটি মৃত্যুর আগে”, প্রথম কাব্যগ্রন্থ “নির্বাসন: উত্তর দক্ষিণ” (পাঠক সমাবেশ, ঢাকা)।