| 29 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

উপেক্ষিত নায়ক জীবনানন্দ–১২৫ বছরে ফিরে দেখা । রুমকি রায় দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

গত পর্বের পরে

এরপর চলে আসি বিখ্যাত সেই কবিতা ‘বোধ’ এর বিষয়ে। কবিতাটিকে শনিবারের চিঠির সার্জিক্যাল ডিপার্টমেন্টে করা হল কাটাছেঁড়া। শনিবারের চিঠির শ্রাবণ সংখ্যা, ১৩৩৬, লেখা হল এই পোস্টমর্টম রিপোর্ট। লেখা হল—পৃথিবীপলাতক জীবনানন্দ দাশ আছেন, যিনি নিজেকে স্বপ্নের হাতে তুলে দিয়েছেন। ‘পৃথিবীপলাতক’ শব্দের মধ্যদিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিতে লেখা হল—“তবে কি জীবনানন্দবাবু আর নাই! আহা! ”

জীবনানন্দ নিজেকে যে স্বপ্নের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন বলে লেখা হল, সেই স্বপ্নের স্বরূপ হিসেবে বোধ কবিতার যে লাইন ক’টি তুলে ধরা হল—

“সকল লোকের মাঝে ব’সে                                                                 

আমার নিজের মুদ্রা দোষে

আমি একা হতেছি আলাদা? ”

তারপর স্বপ্নের স্বরূপ থেকে মুদ্রাদোষ শব্দটিকে তুলে নিয়ে লেখা হল কবিতার যে লাইনগুলো—

“জন্মিয়াছে যাঁরা এই পৃথিবীতে / সন্তানের মত হ’য়ে–/ সন্তানের জন্ম দিতে

যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময় / কিম্বা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়

যাহাদের; কিম্বা যারা পৃথিবীর / বীজ ক্ষেতে আসিতেছে চ’লে / জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে

তাদের হৃদয় আর মাথার মতন / আমার হৃদয় না কি? /

তাদের মন

আমার মনের মতো না কি?—

–তবু কেন এমন একাকী? / তবু আমি এমন একাকী!

কবি একটা সাধারণ প্রশ্ন-উত্তরের খেলায় পৃথিবীর বীজক্ষেতে জন্ম দিতে আসা মানুষের হৃদয় আর মাথার সাথে নিজের হৃদয় আর মাথার তুলনা করে, নিজেকে সধারণ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন।তিনি একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা কিছু নয়,তবু সবার মাঝে থেকে তিনি একা! এক আশ্চর্য বোধ তাঁকে কি বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে? এই ভবানার অদ্ভুত এক ব্যাখা করা হল শনিবারের চিঠিতে। লেখা হল–

“ মাথার মতো হৃদয়! হৃদয়ের সহিত গোবরের তুলনা এই প্রথম। কবিতাটি যেমনই হউক মুদ্রাদোষটি কিন্তু ভালো নয়”।

প্রশ্ন হল ‘গোবর’ এই শব্দটির প্রয়োগ যদি সঠিক ধরতে হয়, তবে মেনে নিতে হবে, এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া ও জন্ম দেওয়া প্রতিটি সাধারণ মানুষের মাথা ও হৃদয়ে গোবর ভরা আছে। শনিবারের চিঠির লেখকগণ কি এই সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা কোনো প্রজাতি? যদি না হন, তবে এই ধরনের সমালোচনা অহেতুক অমূলক-ই শুধু নয়, এমন অর্থহীন সমালোচনা যে নেহাৎ-ই জীবনানন্দকে উপেক্ষা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না।

সমালোচনার নামে যে কতটা হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল শনিবারের লেখক গোষ্ঠী এই কবিতার পরের অংশ নিয়ে সমালোচনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

“ ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়ে মানুষেরে,

অবহেলা করে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে।

ঘৃণা করে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;”

এই লাইন তিনটি নিয়ে বলা হল—“ কবি সব করিয়াই দেখিয়াছেন, শুধু বিবাহ করিয়া ‘মেয়ে মানুষেরে’দেখেন নাই। দেখিলে ভাল হইত, গরীব পাঠকেরা বাঁচিত”।

আশ্বিন ১৩৩৬, (শনিবারের চিঠি, পৃঃ ২৩৮) আবার আক্রান্ত হলেন কবি জীবনানন্দ তাঁর ‘বোধ’ ও ‘আজ’ কবিতার অযৌক্তিক সমালোচনায়। মূলত পূর্ববঙ্গীয় সাহিত্যকে লক্ষ্য করলেও আক্রমণের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠলেন জীবনানন্দ।

লেখা হল—‘বাংলার জনগণ খবর রাখেন কি না বলিতে পারি না, সম্প্রতি কিছুকাল হইতে “ পূর্ব্বঙ্গীয় সাহিত্য” নামক এক নতুন সুবৃহৎ এবং সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছে……’। এই সাহিত্যের হুইটম্যান বলে ব্যঙ্গ করা হল জীবনানন্দকে।

“ এই নব হুইটম্যান জীবনানন্দ ( জীবানন্দ নয়!) দাশের কিছু বাণী আমাদের মর্মস্পর্শ করিয়াছে। এই সকল বাণীর প্রচার আবশ্যক।

১। দেখিবে সে মানুষের মুখ?

   দেখিবে সে মানুষীর মুখ?

   দেখিবে সে শিশুদের মুখ?

   চোখে কালোশিরার অসুখ,

   যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে…

   নষ্ট শশা—পচা চাল-কুমড়ার ছাঁচে

   সে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে

   — সেই সব

কবির হৃদয়ের মাংসে যে কুঁজ ও গলগণ্ড ফলিয়াছে তাহা স্বীকার করা—বাণী বৈ কি!”

নামকরণ নিয়ে লেখা হল—“ কবিতাটির নামকরণে বোধহয় কিছু ভুল আছে, ‘বোধ’ না হইয়া কবিতাটির নাম ‘গোদ’ হইবে। চাল-কুমড়া ফলার মতো ইহা মাংস ফলার কবিতা”।

২। প্রগতি পত্রিকায়, আশ্বিন, ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত আজ কবিতার ৪০টি স্তবক বিশিষ্ট ৩২১ লাইনের কবিতার বিভিন্ন স্তবকের ঠোঁট ও চুমু সংক্রান্ত লাইন গুলিকে আলাদা করে নির্বাচন করে প্রকৃত অর্থের বিশ্লেষণ না করে অস্বাভাবিক স্থূলবোধ সম্পন্ন মানসিকতা নিয়ে অপব্যাখ্যা করে লেখা হল নানা মন্তব্য—

আজ কবিতার সাঁইত্রিশ নং স্তবকের প্রথম দুটি লাইন–

“এবার নতুন মাংসে তোমার পৃথিবী ফেলো ভরে,

রক্তের হাড়ের বীজ বিছায়ে দিতেছ তুমি পথে;”

লেখা হল— “রক্তের হাড়ের বীজ এবং নতুন মাংস! বাবা! এ যে একেবারে হাঁউমাউ কাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ”  কবিতাটির এই স্তবকের আটটি লাইন যদি কোনো পাঠক পাঠ করে থাকেন, বুঝতে পারবেন কবি কী বলেছেন,আর তার কী ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শনিবারের লেখকগণের এই ধরনের চটুল রসিকতা যে জীবনানন্দের মতো কবির জন্য একেবারেই বেমানান,সেটা বোঝার মতো সরল বোধ যাঁদের ছিল না, তাঁদের কবিতার বিষয়ের বোধ নিয়ে সত্যিই সংশয় জাগে।

পরের লাইন গুলি দেখে নেওয়া যাক—

“কুয়াশার ঠোঁট শুধু কুয়াশার ঠোঁটে গিয়ে মেশে;

“তোমার ঠোঁটের চুমা তাহার ঠোঁটের তরে নয়!”

“ঠোঁটের উপরে ঠোঁট চুমোর মতন আছে লেগে!”

“ প্রেমিকের মতো চুমো এবার সে ঠোঁট থেকে ঝরে

মৃত্যুর ঠোঁটের পরে;”

ষোলো নং স্তবকের সাত নং পঙক্তির শেষ অংশ—“ আমাদের মুখে ঘাম মাছি (আছি)!” শনিবারের চিঠির সনালোচনায় ‘মাছি’ শব্দের বদলে ‘আছি’ শব্দের প্রয়োগ অনিচ্ছাকৃত ভুল, না ইচ্ছাকৃত জানা নেই।(শনিবারের চিঠি)

“ যে ঠোঁটে আগুন আছে—যেই ঠোঁটে নাই কোনো জল”

“ জেনেছ কাঁটার চুমা,—কাঁটায় নাইক তার কিস্‌

তাহার ঠোঁটের’পরে কার ঠোঁট রয়েছে, দেখ তা”।

এই যে বেঁছে বেঁছে তুলে আনা ঠোঁট ও চুমু প্রসঙ্গ কবিতাটিকে বিকৃত রুচির আধুনিক কবিতা প্রমাণের যত না চেষ্টা, তার থেকেও বেশি চেষ্টা যেন ব্যক্তি জীবনানন্দের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। সমালোচনায় লেখা হল—“ আরো চাই? আহা, ঠোঁটের যদি ‘জান’ থাকত!”

সত্যিই বলতে ইচ্ছা হয়, ঠোঁটের যদি জান থাকত, তবে উপেক্ষা সহ্য না করে ঠোঁট নিজেই নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করত।    প্যারোডি রচনা শনিবারের চিঠির লেখকদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও তাঁরা জীবনানন্দের কবিতার প্যারোডি না করে ব্যক্তি আক্রমণের চরম সীমা অতিক্রম করতে শুরু করল। শনিবারের চিঠির ঐ সংখ্যাতেই লেখা হল হুইটম্যানের কাল্পনিক সংলাপ —‘ সেদিন প্ল্যানচেটে হুইটম্যানকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল,আপনি এখন কোথায় আছেন? অনেক সাধ্য-সাধনার পর জবাব পাওয়া গিয়াছিল, কোথায় বাড়ি বলিতে পারিব না কিন্তু সম্প্রতি বড় লজ্জায় পড়িয়াছি। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন, তোমাদের দেশের লেখকরা শ্রীজীবনানন্দ ( জীবানন্দ নয়!) দাশগুপ্তের ও আমার নাম একত্র করিয়া আমাকে বড়ই লজ্জিত করিতেছে। তিনি মহাপুরুষ! তাহার মাথার ভিতর ‘বোধ’ কাজ করে—আমি সামান্য ব্যক্তি। তাহাদিগকে বারণ করিয়া দিলে ভালো হয়”।

সমালোচনা এখানেই স্তব্ধ হল না, বোধ কবিতা লেখার জন্য জীবনানন্দকে ‘নির্বোধ’ আখ্যাও দেওয়া হল।কবি কখনও এ সবের প্রতিবাদের কথা ভাবেননি,কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শনিবারের চিঠির প্রতি বিরক্ত হয়ে,প্রতিবাদ স্বরূপ ডাকযোগে আসা ‘শনিবারের চিঠি’ অগ্রাহ্য করে ফেরত পাঠিয়েই খান্ত হননি। তিনি ‘প্রবাসী’ শর্ত দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রেস থেকে শনিবারের চিঠি ছাপানো বন্ধ না করলে,তিনি প্রবাসীকে লেখা দেওয়া বন্ধ করে দেবেন। তাহলে কি এটা ধরে নেওয়া যায়, যে জীবনানন্দ প্রতিবাদী সুর তোলার মতো মানসিক ভাবে বলিষ্ঠ ছিলেন না! নাকি, তিনি নীরবে এ সব সহ্য করে আসলে আত্ম উপেক্ষা করেছেন। হ্যাঁ, আত্ম উপেক্ষা যে তিনি করেননি, এমন নয়,সে প্রসঙ্গে আসার আগে বলা দরকার, তিনি প্রতিবাদ কিন্তু করেছিলেন,তবে সে প্রতিবাদ জনসমক্ষে তাঁর জীবদ্দশায় আসেনি।

১৯৩৮ সালে পরিচয় পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় কবি জীবনানন্দের ‘ক্যাম্পে’ নামক কবিতাটি প্রকাশিত হলে, সেই কবিতাও শনিবারের চিঠির অপারেশন টেবলে নির্লজ্জ কাটাছেঁড়া হয়। কবিতাটিকে চূড়ান্ত অশ্লীল আখ্যায় ভূষিত করে লেখা হয়—

“ বনের যাবতীয় ভাই-হরিণকে তাহাদের হৃদয়ের বোন ঘাই হরিণী ‘আঘ্রাণ’ও ‘আস্বাদের দ্বারা তাহার পিপাসার সান্ত্বনার জন্য ডাকিতেছে। পিস্তুতো মাস্তুতো ভাইবোনেদের আমরা চিনি।হৃৎতুতো বোনের সাক্ষাৎ এই প্রথম পাইলাম”।

জীবনানন্দ এর একটা ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন,ও লিখলেন—“ হৃদয়ের বোন’ শব্দ-বন্ধটির জন্য তিনি শেলীর “soul’s sister” অভিব্যক্তির কাছে ঋণী”। এর পর বিরক্তি প্রকাশ করে লিখলেন—“ বাংলাদেশে সজনে গাছ ছাড়া আরো ঢের গাছ আছে”।

কিন্তু এই প্রতিবাদ ও ব্যাখ্যা তিনি অপ্রকাশিতই রাখলেন, ঠিক যেমন রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা জবাবী চিঠি। এর মধ্যে ১৩৩৯ এর শেষের দিকে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শনিবারের চিঠির দ্বন্দ্বের ফলে শনিবারের চিঠির লেখকগোষ্ঠীর কিছুটা বোধদয় ঘটলে,পত্রিকার মূল ফোকাস শুধুমাত্র ব্যঙ্গ থেকে কিছুটা সরে এলেও জীবনানন্দের পিছু কিন্তু তাঁরা ছাড়লেন না। ১৩৪৫, শনিবারের চিঠির কার্তিক সংখ্যায় ‘চতুরঙ্গ’ আশ্বিনে প্রকাশিত কবিতা ‘ফুটপাথে’ নিয়ে লেখা হল—“ কবি জীবনানন্দ ( জীবানন্দ নহে) চতুরঙ্গের (চৌরঙ্গীর?) ফুটপাথে বসিয়া পড়িয়াছেন। জীবনানন্দ বাবুর ( জীবানন্দ নহে) বরাত ভাল,খাঁটি জায়গার সন্ধান তিনি পাইওয়াছেন। জীবনানন্দের ( জীবানন্দ নহে) অরিজিনালিটি অস্বীকার করা চলিবে না”।

জীবনানন্দের অরিজিনালিটি বলতে? জীবনানন্দ ফুটপাথের কবি? নাকি ফুটপাথের চটি বইয়ের লেখক? কী এমন লিখেছিলেন তিনি এই কবিতায়? দেখে নেওয়া যাক।

“ অনেক রাত হয়েছে—অনেক গভীর রাত হয়েছে;

কলকাতার ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে—ফুটপাথ থেকে ফুটপাথে—

কয়েকটা আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো এই-যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে

পায়ের তলে,সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব ক’রে হাঁটছি আমি”

পরের একটা লাইন উল্লেখ করলে বোঝা যাবে কবি ঠিক কী বলতে চেয়েছেন—

“পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন—মাথার ওপরে

অসংখ্য জটিল তারের জাল

শাসন করছে আমাকে”।

পুরো কবিতাটি পাঠ করলে বোঝা যাবে আসলে কবি কলকাতায় থেকে, তাঁর ফেলে আসা বাংলার গ্রামের হারানো সব অনুভূতিকে ছুঁতে চাইছেন। এখানে অশ্লীলতা কোথায়? আধুনিক প্রকাশ-ই কি তবে ব্যক্তি আক্রমণের কারণ? কিন্তু কেন? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরও দুটি সমালোচনার কথা জেনে নেওয়া যাক। ‘কবিতা’ পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় ১৩৪৫, প্রকাশিত কবিতা ‘স্থির প্রেমিকের নিকট—কোনো উদ্দীপীতা’ নিয়ে লেখা হল—“ ধবল কুষ্ঠ জানতাম, কিন্তু জীবনানন্দ দাশ ( জিহ্বানন্দ নহে) সম্প্রতি ‘ ধবল শব্দ’ শুনিতেছেন। কবিরাজ মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি শাস্ত্র ঘাঁটিয়া বিশেষ সংকোচের সহিত বলিলেন, ফেরঙ্গ-রোগ পর্যায়ে এ একটা কঠিন ব্যাধি। ‘ রক্ত গোধিকার লালের’ সহিত ‘ কৃষ্ণ কর্ণমর্দনের’ নিয়মিত প্রয়োগ ব্যতিরেকে এই ব্যাধি সারিবার নহে”। ধবল শব্দ নিয়ে পঙক্তিটি ছিল—“ ভাদ্রের জ্বলন্ত রৌদ্রে তবু আমি দূরতম সমুদ্রের জলে / পেয়েছি ধবল শব্দ—বাতাসতাড়িত পাখিদের”।

‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতা নিয়ে লেখা হল—“ গোধূলি সন্ধির নৃত্য দেখিয়াছেন? চৈত্রের ‘পরিচয়ে’ দেখিতে পাইবেন। নাটোরের বনলতা সেঙ্কে বিস্তৃত হইয়া কবি জীবনানন্দের (জিহ্বানন্দ নহে) এই টারানটেলা নাচ! যদি নাচ না হইয়া সোয়ান সঙ হইত”।

 ১৩৪৪, শনিবারের চিঠির অঘ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘হৈমন্তিকা’ কবিতার সমালোচনায় লেখা হল—প্রেয়সীকে এতকাল আমারা হৃদয়ে পাইতাম, ভালোবাসিতাম। এইবার প্রেয়সীর হৃদয়ে চরিবার দিন আসিল। একসঙ্গে দেহের আহার ও মনের ওষুধ—এ সম্ভাবনার কথা কে কল্পনা করিতে পারিয়া ছিল?’

এই প্রবন্ধের একটা দীর্ঘ অংশে আমি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি, সমালোচনার নামে শনিবারের চিঠিতে যা লেখা হত, আসলে তা উপেক্ষার-ই নামান্তর। কিন্তু, এই উপেক্ষার শিকার তৎকালীন অনেক লেখক কবিই হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা কেউ সময়ের নিরিখে জীবনানন্দের মতো অতি আধুনিক নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি, এবং তাঁদের কাউকেই এতটা নিকৃষ্ট বা ঘৃণ্য উপায়ে আক্রান্তও হননি। কিন্তু কেন? সেই উত্তর খুঁজতে হলে শনিবারের চিঠির লেখকগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও ভাবনার বিষয়টা তুলে না আনলে, লেখার মধ্যে একটা অস্বচ্ছতা থেকে যায়। প্রথমেই জানা দরকার শনিবারের চিঠির লেখকগোষ্ঠী ভাবনা-চিন্তা। আত্মজীবনীতে সজনীকান্ত সেন লিখেছেন—“ আমাদের জেহাদ ঘোষতি হয়েছিল ভানের বিরুদ্ধে,ন্যাকামির বিরুদ্ধে,দুর্বল ও অক্ষমের লালায়িত সৃক্কণীলেহনের বিরুদ্ধে”।

যদিও অনেকে সেইসময় মনে করত শনিবারের চিঠি অশ্লীলতার বিরুদ্ধে। জীবনানন্দ সমসাময়িক সব কবি লেখকরাই বিশ্বাস করতেন মানুষ ও তার প্রতিবেশ-পরিমণ্ডল নিয়েই কবিতা /সাহিত্য। আর মানুষের প্রতিবেশ পরিবর্তিত হলে, তার প্রভাব সাহিত্যে পড়বেই, কিন্তু সজনীকান্ত ও তাঁর অনুগামীরা মনে করতেন, আধুনিক কবি সম্প্রদায়ের এই পরিবর্তন,সার্বিক অর্থে মেকি ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অণুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। বাস্তবের সাথে এইসব ব্যবহৃত শব্দ অপ্রচলিত উপমা, সম্পূর্ণভাবে যোগসূত্রহীন। সমস্যাটা এখানেই। আধুনিকতা আসলে কী? সময়ের সাথে ঘটে চলা পরিবর্তনকে স্বীকার করাটাই প্রকৃত অর্থে আধুনিক মনষ্কতা। তৎকালীন কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে জীবনানন্দই ছিলেন যুগের থেকেও এগিয়ে। তাঁর কল্পনাশ্রিত শব্দ প্রয়োগ, তাই শনিবারের চিঠির লেখকগণের কাছে সব থেকে বেশি চক্ষুশূলের কারণ হয়ে দাঁড়াল,এবং তাঁর প্রতিভাকে চিনতে না পেরে অথবা স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রচেষ্টায় উপেক্ষার দাবানলে তাঁরা দগ্ধ করতে লাগলেন কবি জীবনানন্দকে।

তাঁর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এই উপেক্ষা যে কেবল শনিবারের চিঠির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, সামাজিক ও কর্মজীবনেও তিনি নানা ভাবে উপেক্ষিত হতে থাকলেন। তেমনই কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে চাকুরিরত থাকাকালীন, তিনি কিছু সহকর্মীদের দ্বারা উপহাসিত হতেন, তাঁর কবিতার জন্য। এই বিদ্রুপের মূলে যে ব্যক্তি তিনি জীবনানন্দের সহকর্মী নরেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও হেরম্ব চক্রবর্তী। এঁদের দুজনের উদ্যোগে ‘নীল জলে সিঙি মাছ’ নামক ব্যঙ্গ কবিতা প্রকাশ করে তাঁকে তীব্র আক্রমণও করা হয় নির্মমভাবে। হেরম্ব চক্রবর্তীর “ জীবনানন্দকে যেমন দেখেছি”প্রবন্ধে একথা স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়, এসব ব্যঙ্গ তাঁকে যথেষ্ট ব্যথিত করত।তিনি লিখেছেন-‘ প্রথমে তাঁর চোখে ফুটে উঠত সলজ্জ, অপ্রতিভ কাতর ভঙ্গি’। তিনি আরও লিখেছেনে বেত্রাহত বালকের মুখের করুণ অসহায়তা, তাই দিয়ে তিনি বিরুদ্ধবাদীকে নিরস্ত করতেন। কলেজে ঢুকতেন পিছনের দিক দিয়ে। ক্লাসে শান্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে পড়াতেন; অবসরকালে কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো বিশ্রামকক্ষের কোণে বসে থাকতেন।  তাঁর ছাত্র কালাম শামসুদ্দীন—এর লেখা থেকে আরও জানা যায়, কলেজে আই. এ ও বি. এ ক্লাসের যে বই গুলো অত্যন্ত নিরস ও কঠিন,যে সব বই পড়ে ছাত্ররা কোনো আনন্দ পেত না, তেমন বই গুলো বেছে  বেছে তাঁকে পড়াতে দেওয়া হত। ফলত তিনি কলেজে কোনোদিনই সর্বজনপ্রিয় হতে পারেননি।

বয়স তখন তাঁর চল্লিশ। কবিতাভবন ‘বাংলা কাব্য সংকলন’ প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলে, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে সংকলনটি সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হয় দুজন অকবি মানুষ আবু সয়ীদ ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের হাতে। এই সংকলনে খুব সংকীর্ণ পরিসরে স্থান দেওয়া হল কবির চারটি কবিতাকে ‘ পাখিরা’, ‘শকুন’, ‘বনলতা সেন’, ‘নগ্ন নির্জন হাত’। কিন্তু ততদিনে কবির আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। এই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিচারণায় জানিয়ে ছিলেন নিজের অপ্রসন্নতার কথা। তিনি লিখেছিলেন—“ আমার পক্ষে সবচেয়ে বড়ো বেদনার কারণ জীবনানন্দ—যাঁর ধূসর পাণ্ডূলিপির পরেও আরও অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা বেরিয়ে গিয়েছে ততদিনে, অথচ যিবি স্থান পেয়েছিলেন সংকীর্ণ! আমি বহু তর্ক করেও বোঝাতে পারিনি যে জীবনানন্দ শুধু ‘বর্ণনাধর্মী’ লিপিকার নন, অতি গভীর ভাবনা ঋদ্ধ এক কবি; আমাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান”।

এই সব সামাজিক উপেক্ষা তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীদের ব্যথিত করলেও সেই সময়ে তাঁর প্রতিভাকে উপেক্ষা করার মানুষের অভাব ছিল না। কর্মক্ষেত্রে শুধু ব্যঙ্গ নয়, তাঁর যোগ্যতার প্রশ্ন তুলেও তাঁকে অপমান করা হয়,তখন তাঁর বয়স আটচল্লিশ বছর। সালটা স্বাধীনতার বছর। তিনি বরিশাল ছেড়ে চলে এসেছেন কলকাতায়, চাকরিহীন। সেইসময় সত্যপ্রসন্ন দত্ত, হুমায়ুন কবির ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সহযোগিতায় ১০ ক্রিক রো-তে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ‘স্বরাজ’ পত্রিকা। পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন্দ্রকুমার মজুমদার। সত্যপ্রসন্ন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও হুমায়ুন কবিরের সহায়তায়.১৯৪৭ সালের ২৬শে জানুয়ারী এই পত্রিকার রবিবাসরীয় সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত হলেন কবি জীবনানন্দ। কথা হল যতদিন স্বরাজ থাকবে ততদিন জীবনানন্দ থাকবেন, কিন্তু পরবর্তী সাত মাসের মধ্যেই সেই চাকরি হারালেন কবি। সেই সময় যদিও এটা প্রচলিত হল যে, আর্থিক সংকটের কারণে স্বরাজের কাজ ছেড়ে দেন তিনি, কিন্তু আসল সত্য ছিল অন্য। খোদ স্বরাজ সম্পাদক তাঁকে সাতচল্লিশ সালের সেপ্টম্বর মাসে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। শুধু তাই নয়, তাঁর উদ্দেশ্যে অপমান জনক বাক্য ব্যবহার করে, তাঁকে সম্পাদনার অযোগ্য বলেও প্রতিপন্ন করেন তিনি। কিন্তু কেন ঘটল এই ঘটনা? কী-ই বা বলেছিলেন স্বরাজ সম্পাদক সত্যেন্দ্রকুমার মজুমদার?

সমস্যার মূল উৎপত্তি হয় নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধকে ঘিরে। নজরুলের কাব্যসিদ্ধি বিষয়ক জীবনানন্দের মূল্যায়ন অপছন্দ হয় সত্যেন্দ্রকুমার মজুমদারের। কী এমন লিখেছিলেন ‘ নজরুল ইসলাম’ শিরোনামের এই প্রবন্ধে?  তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন আপাত দৃষ্টিতে এত বড়ো প্রবল উৎস বলে মনে হয় যে নজরুলি রচনা কে, তা কি বড়ো সাহিত্য সৃষ্টি করবে না একদিন? তিনি নিরাশ না হয়ে আশা রাখলেও এই প্রবন্ধে নিজের পরবর্তী মূল্যায়নে বুঝতে পেরেছিলেন, নজরুলের লেখায় সেই প্রসাদগুণ নেই। তিনি স্বরাজ পত্রিকার নজরুল ইসলাম বিশেষ সংখ্যায় লিখলেন—“ ক্রমে ক্রমে বুঝতে হল যে, নজরুল ইসলামের লেখায় মহাকবিতার গভীর প্রসাদ নেই, তার প্রতিশ্রুতিও কম”।তিনি আরও লিখলেন—“ নজরুলের কবিতায় অর্থ সারল্য আছে, ওজসও রয়েছে এক হিসাবে,কিন্তু অর্থগভীরতায় এসব কবিতা আধুনিককালের প্রাজ্ঞ আত্মজিজ্ঞাসু মনকে ক্বচিৎ তৃপ্ত করে”। তিনি এও লেখেন, “কাব্যের সুর এক আশ্চর্য বৈদেহী পবিত্রতায় নিজের ধ্রুবলোকে পৌঁছেছে, এরকম দাবি নজরুল ইসলামের কবিতা সম্পর্কে করা যায় না। যে কবিতা সমাজ, স্বদেশ ও নরনারী সম্পর্কে যথেষ্ট স্পষ্টবাদীতায় বলতে চেয়েছে, নজরুল সেই কাব্য সম্পর্কে কথা-নিরপেক্ষ, প্রায় নির্বিকল্প-সুর-বিশুদ্ধতার দাবি অসংগত, নজরুলের কবিতা বিশেষ একটা মাত্রার দেশে তার অতীতের ভিতরে পরিসমাপ্ত,এ কবিতা পড়ে—আবৃত্তি করে সময় কেটে গেলে আধুনিক হৃদয় মনের অতলস্পর্শিতার ক্ষোভ তৃপ্ত হত চায় না। মন বিষয়ান্তর খোঁজে দিকনির্ণয়ী মহৎ কবিদের”।

সেই সময় নজরুলের পরিচিতি বিশাল তুঙ্গে। এই প্রবন্ধ প্রুফ আকারে সম্পাদকের টেবিলে গেলে, ক্ষিপ্ত হন সম্পাদক। এই লেখা প্রকাশ হলে বিরোধীতার আশঙ্কায় অপ্রকাশিতই থাকে, কিন্তু লেখাটির জন্য তিরস্কৃত হন কবি। পত্রিকার অন্যতম স্বত্তাধিকারী রমেশ বসু তাঁকে ডেকে ভৎসনা করে বলেন—“ জার্নালিজম তো জানেন না আপনি, জার্নালিজমের কী জানেন? কিছু জানেন না, শোনেন না। আমার কথার ওপর কথা বলবেন না…এটা সাহিত্য না, এটা প্রফেসরি না। সাহিত্যিকরা prostitute.” ( হরিশংকর জলদাস)।

এই অপ্রত্যাশিত অপমান তাঁকে বিদ্ধ করেছিল। তিনি যে সংবাদ পত্রের কাজের যোগ্য নন, এই কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। ভাবলে আশ্চর্য লাগে, নজরুল ছিলেন তাঁরই সমবয়সী। সমসাময়িক এক তৎকালীন বিখ্যাত কবির সম্ভাবনা নিয়ে তিনি শুধু নিজের ভাবনার কথাটাই ব্যক্ত করেছিলেন মাত্র, এই সামান্য করণে বরখাস্ত একপ্রকারের অজুহাত ছাড়া আর কী হতে পারে। অথচ কালের নিময় কত আশ্চর্য! যে কবিকে এত সহজেই উপেক্ষা অপমান ছুঁড়ে দিতে পেরেছিল এই স্বল্প আয়ুর পত্রিকা, আজ সেই পত্রিকা বিখ্যাত শুধুমাত্র সেই কবির কারণেই।মাত্র কয়েক মাস জীবনানন্দ এই পত্রিকার সাথে জুড়ে থেকে স্বরাজকে আজও জীবিত করে রেখেছে।হয়তো এই অপমানের একটা যোগ্য জবাব তিনি দিতে চেয়ে নতুন একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রয়াস করেছিলেন,কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হন তিনি।

 শুধু সমাজ-সংসার দ্বারাই যে উপেক্ষিত হয়েছিলেন তা নয়,সামাজিক অবজ্ঞা, সাংসারিক অস্থিরতা, আর্থিক অনটনে জর্জরিত হয়ে, কখনও কখনও তিনি যে দুর্বল চিত্তের মানুষে পরিণত হয়ে আত্মউপেক্ষা করেননি এমন নয়। প্রাসঙ্গিকভাবে এই আত্মউপেক্ষার বিষয়টি আমি যেভাবে বলতে চাইছি, তার প্রেক্ষিতে লেখক শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের (আমি ও আমি) প্রবন্ধের একটি অংশ তুলে ধরছি। এই প্রবন্ধে তিনি তুলসী দাসের একটি দোঁহা উল্লেখ করে লিখেছেন—“ (তুলসী যব জগমে আয়ো তুলসী রোয়ে জগ হাসে / তুলসী যব জগ সে যায়ো তুলসী হাসে জগ রোয়ে)। কী আছে আমার? আমার একটা আমি আছে। তুমি কি তাকে ভালোবাসো?  আমার আমিটাকে আমি কি ভালোবাসি? আমি কি যত্ন করি? আমি কি তাকে শ্রদ্ধা করি? আমি কি তার মূল্য বুঝি? না খুচরো পয়সার গাদায় আমি একটা চাকতি! এখানেই সেই মজাটা লুকিয়ে আছে। এই আমি যদি অনুভব করে সে রাজা উজির সম্রাট—তাহলে সে তাই। আর যদি সে মনে করে সে একটা কেঁচো, সে একটা কীট, তাহলে সে তাই”।

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের এই প্রবন্ধের প্রসঙ্গ এনে আমি একথা বলতে পারি না যে, তিনি নিজেকে কেঁচো মনে করতেন, তবে তিনি যে রুখে দাঁড়েতে পারতেন না, ও সামাজিক অবমাননা যে, তাঁকে আত্মমূল্যায়ন করতেও কখনও কখনও কমজোর করে তুলেছিল, তার কিছু কাজে সেই প্রমাণ স্বষ্ট। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে সজনীকান্ত পর্যন্ত সমস্ত অবমাননার বিরুদ্ধে গোপনে মাথা তোলার চেষ্টা করেও যে সফল হতে পারেননি এই প্রমাণ আমরা পূর্বে পেয়েছি। তাঁর জীবন কাহিনি থেকে তাঁর আত্ম সম্মানের বিভিন্ন ঘটনা আমার জানি, অথচ সেই মানুষ যে সময়ের কাছে হার মেনে উপঢৌকন দিয়ে চাকরি পেতে চাইতে পারেন, এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। খড়্গপুরের চাকরি চলে গেলে তিনি যখন চরম আর্থিক অনটনের শিকার, তখন জঙ্গিপুর কলেজে চাকরির জন্য তৎকালীন কান্দী মহকুমা কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট ডেপুটি সেক্রেটরী অনিল বিশ্বাসকে নিজের আত্মজীবনতে তাঁকে অমর করার প্রলভন দিয়ে বসলেন। কিন্তু সে প্রলভনে কাজ হল না।

তিনি লেখার সাম্মানিক নিয়েও কম্প্রোমাইজ করেন। ‘জলার্ক’ পত্রিকার সম্পাদক সুরজিৎ দাসগুপ্ত পত্রিকায় প্রকাশের জন্য লেখা চাইতে গেলে, জীবনানন্দ তাঁকে জানান—‘ একটি কবিতার জন্য আমি সাধারণত ২৫/ ৩০ থেকে ৫০ পর্যন্ত পাই। তোমরা ২০ দিও’। যেখানে তাঁর কনিষ্ঠ বুদ্ধদেব বসু সে সময়ে প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থ দাবি করেন সুরজিৎ দাসগুপ্তের কাছে, সেখানে কবি জীবনানন্দের একটি নতুন কবিতার জন্য সর্বকম মূল্য কুড়ি টাকা দাবি করা আত্ম উপেক্ষারই সামিল বলে আমার মনে হয়।
আসলে একটি মিথ্যাকে বারবার সত্য বলতে বলতে মানুষ যেমন নিজেরই অজান্তে মিথ্যাটাকেই সত্য বলে ভাবতে শুরু করে, হয়তো অন্তির্লীন এই মানুষটিও  তাঁর সৃষ্টির প্রতি সামাজিক অবিচার, অভাব, অনটন ও কঠিন জীবনযুদ্ধের কাছে মনে মনে পরাজিত হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর জীবনের শেষের পর্যায়ে। এই উপেক্ষা যে তাঁকে সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করে তুলছিল সে সম্পর্কে জানা যায় সঞ্জয় ভট্টাচার্যের এক চিঠিতে–  “ তিনি একাডেমি প্রাইজের উমেদার নন। তিনি নিঃসঙ্গও না—বন্ধু সন্ধানী। কিন্তু তাঁর সঙ্গে বন্ধুর পথে চলবে, তেমন বন্ধু কেউ নেই”।

সারাজীবন তিনি উপেক্ষিতই থেকে গেলেও তিনি ছিলেন নায়ক। যে নায়ক জীবনের কাছে হার মানলেও মৃত্যু তাঁকে উপেক্ষা করেনি। এই পৃথিবীর ঘাস তাঁকে উপেক্ষা করেনি। যদিও তাঁর দুর্ঘটনার খবর,কাগজে বেশ কিছুদিন পর প্রকাশিত হয়, কিন্তু হাসপাতালে তাঁর শেষ যাত্রায় ফুল বা সঙ্গীর অভাব হয়নি। তিনি বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় নায়ক জীবনানন্দ। তাঁকে নিয়ে উৎসব হয় না, তবু সময়ের কালো স্রোত তাঁর কৌলিন্যকে ম্লান করতে পারেনি। তাই আজ, তাঁর জন্মের একশ পঁচিশ বছর পরও তাঁর সৃষ্টি, তাঁর জীবন একইভাবে আলোচিত। এ ধারা আগামী একশ পঁচিশ বছরেও অব্যাহত রইবে এ আশা করা যেতেই পারে।

তথ্যসূত্রঃ ১। ‘জীবনানন্দ’ গোপালচন্দ্র রায়

         ২। পত্রালাপঃ জীবনানন্দ দাশ সম্পাদনা প্রভাত কুমার দাস

          ৩। জীবনানন্দ ও তাঁর কাল হরিশংকর জলদাস

          ৪। জীবনানন্দ রচনাবলি

        ৫। শনিবারের চিঠি




 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত