আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট‘অই, মইরি বুজির বিয়া দ্যাকতে যাবি না? কত মজা অইতাছে!’
খইমুড়ি সই ময়না আমাকে খবর দিতে এসেছে।
ও কথাগুলো বলে ফিসফিস করে, গাবের আঠার মত রস আর কষ মাখিয়ে,
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেখানে পল কাটে। রঙের ছিটা দেয়। ঝিলিমিলি বাদলা কাগজ লাগিয়ে দেয়।
তাতে মইরি বুজির বিয়ের পুরো রাত্রি আমার শরীরে বাদ্যবাজনার হাট বসিয়ে দেয়।
আমি সারাদিন ফালুক ফুলুক করেছি। মার কাছে অনুমতি আদায় করার জন্য।
মা না-বলতেই ঘরের সব কাজ করেছি। কিন্তু মা আগেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছে,
‘ডাঙ্গর মাইয়াগো রাইত কইরা আর এক পাড়ায় বিয়াবাড়ি দেখতে যাওন লাগবো না।
বিয়াবাইত্যে নানাপদের মানুষ আহে। জুয়ান পোলারা নানা তালে থাকে।
হ্যাশে একটা ঘটনা ঘইট্টা গেলে হেইডা আর ঘইস্যাও উডানো যাইবো না।
আবিয়াত ডাঙ্গোর মাইয়া পালতে অইবো বহুত সাবধানে।’
ময়না ফিস ফিস করে। ‘চাচীআম্মারে আমি কমুনে। তুই জলদি রেডি অ।
ল, তরতরি যাই। মইরি বুজিগো বাইত্তে হেজাগ জ্বলতাছে। আট্টু পরে চলন আইবো।
যেহেনে জামাই বহাইবো হেই ঘরডা কি সোন্দর কইরা হাজাইছে!
হিন্দু পাড়ার থনে দেওদার পাতা আইনা ঝালর বানাইছে।
আর ঘুড্ডির কাগজের চিকোন চিকোন ফালা দিয়া ছিকল।
হেই ঘরের মিদে বুইধ্যার দাদি কমর ঢুলাইয়া নাচতাছে।
ভাবিরা হমানে গীত গাইতাছে। আমি দেইক্যা আইছি। সই, ল যাই!’
ময়নার কথার সাথে সাথে আমার দেহ ঘিরে দেওদার পাতার ঝালর ঝুলতে শুরু করে।
খেজুর-পাতা বেণিতে নাচন লাগে। কোমরে ঢুল ওঠে। গীতের ধূয়া ধরে আমার ঠোঁট।
আমার গালের চামড়ার ওপর হেজাগের আগুন জ্বলে ওঠে।
আমার গলা বুঁজে আসে ‘মায় তো যাইতে দিব না! আগেই কইয়া থুইছে!’
ময়না চোখ মটকায়। ‘একটা কতা হুনছি। হোনলে না যাইয়া থাকতে পারবি না।’
‘কী কতা?’ মইরি বুজির বিয়ার হগল কতা হোনতে আমার ইচ্ছা-ইচ্ছা করে।
আমি জানি, ময়নারও মইরি বুজির বিয়ার সব কতা কইতে ইচ্ছা ইচ্ছা করে।
ময়না মুখ আরও নামিয়ে আনে। গলার ভিতরে সাপ-খেলা খেলায়। ফিসফিস করে,
‘মইরি বুজির জামাই বলে ধজেগজে হেমুন সাই-জুয়ান?
নয়নতারা ভাবি কইছে, বাসর রাইতে বুজির গলা দিয়া জিবলা বাইরাইয়া আইবো!
হি হি হি! বোজছছ ক্যান?’ ময়না চোখ মটকায়। ওর চোখে নিষিদ্ধ কথার ঝাঁঝ ঝিলিক মারে।
আমি যেন শুনেও শুনি না। আর একবার বলুক ময়না,
কেন সাই-জুয়ান জামাই হইলে মইরি বুজির গলা দিয়া জিবলা বাইরাইয়া আইবো।
আমি যেন বুঝেও বুঝি না। ময়না আর একবার বুঝিয়ে বলুক।
ময়নার জিভ থেকে টস টস করে রসের ফোঁটার মত কথাগুলো ঝরে ঝরে পড়–ক।
আমার জিভ ভয় পেয়ে যাক। রসে বিষে জড়িয়ে যাক। বুঝে না বুঝে ঠোঁট চাটুক।
আবার দুষ্টু সাপের বাচ্চার মত ফণা তুলে হিল হিল করুক। কেমন ভালো লাগে। সুখ লাগে।
‘আর একটা কতা! কমু? আমার উপ্রে কলাম রাগ করতে পারবি না!’
আমি ময়না-সইয়ের কথায় কপট রাগ দেখাই।
‘রাগের কতা অইলে রাগ করুম না, তরে খির-ভোজানি করুম?’
‘ ইছ, আমি ক্যান তর খির-ভোজানি লমু! আমি কি পুরুষপোলা নি?
তর ইয়েরে তুই খির-ভোজানি করা গিয়া। হ্যায়ও আইবো।
তরে লইয়া যাইতে কইছে। লগে চিডির উত্তরও লইয়া যাইতে কইছে।’
ময়না আমার বুকের কাছে দাঁড়িয়ে ঘন নিঃশ্বাসে আর একটা পাগলা কথা বলে।
হেই কথাডা আমার কানের ভিৎরে মধুর লাহান ঘন অইয়া লাইগ্যা থাকে।
আবার গরম ত্যালের লাহান কানের ছিদ্রি জ্বালাইতে জ্বালাইতে নামতে থাকে।
‘তুই হ্যারে চিডির উত্তর লেহছ নাই ক্যান সই?
হেল্লেইগাই তো কইছে, তরে পাইলে নিজের আতে উত্তর কাইড়া লইব।
তুই চিডির উত্তর কই থোছ, তর ডাক বাকসো কোনডা হেইডা কলাম হ্যায় জানে!’
এয়না আস্তা একটা শয়তানের আড়া। আমার বোকের ভিৎরে কী তুফান লাগাইয়া দিলো।
কেমুন থরথর কাঁপতে লাগলো জামার তলে সব কিছু। কেমুন যে শিরশিরানি!
ময়না মার কাছে থেকে অনুমতি আদায় করতে গেছে।
মা ময়নার সাথে রাগ করছে। আমি শুনতে পাচ্ছি। ময়নাকে মা সবক দিচ্ছেন।
‘তরা বড় অইয়াও কিছু বোজছ না। পোলাপাইনের লাহান বিয়া দেহনের ঝুল ধরছ।
এইসব বিয়া বাড়িতে রাইতে জুয়ান মাইয়ারা গেলে নানা ঘটনা ঘটে।
ভিড়ের মইদ্যে কে কোনহানদা বোকের মইদ্যে আত দিবো
কি আন্দারে কিছু একটা কইরা দিবো, কিছু কওন যায়!
মাইয়া গো শইল্যে কোনো বদলাম লাইগ্যা গেলে হেই দাগ জীবনে ওডে?’
শেষ পর্যন্ত মা অনুমতি দেন। জলদি জলদি ফিরে আসার শর্তে অনুমতি দেন মা।
আমার মন-পাখি ফিনফিনা পাখনা মেইলা খুশির আসমানে চক্কর দিয়া আহে।
আহ সোনা-মা, আমার ময়না-মা, আপনে কত ভালো!
মইরি বুজির বিয়া দেহনের লেইগা আমার মনডা ছুইট্টা যাইতাছিল।
মইরি বুজির সাই জুয়ান জামাইরে দেহনের লেইগা আমার চক্কু দুইডা ফাল পাড়তে আছিল।
ইয়েরে দেহনের লেইগা আমার বোকের ভিতরে কইলজাডায় কেমুন যে ঢেকির লাহান শব্দ অইতাছিল।
মায় যদি আমার মনের ভিতরের এইসব কতা জানতে পারে
তয় আমারে ঢেঁকিতে কুইট্টা চালুইনে চাইল্লা ঘাটলায় নিয়া ধুইয়া আনবো।
আমি আর ময়না এক দৌড়ে বেরিয়ে আসি।
আমরা দুজন মইরি বুজির বিয়া দেহনের লেইগা দৌড় পাড়ি।
ডাহুক পইকের লাহান লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফালাইয়া বড় বড় কাইক দিয়া যাইতে থাকি।
‘হ লইছি।’ ময়নারে চিডির কতা কইতে আমার শরম লাগে। তাও কইতে হয়।
ময়না-সই আমার হগল কতা জানে। আমিও সইয়ের হগল কতা জানি।
আমরা অন্ধকার মেঠো পথ পেরুতে থাকি।
জইল্যার মার লাউ-কুমড়ার জাংলা পেরিয়ে আসি।
মাইজ্যা দাদির নাইরকল গাছ আলা পুগইরের পাকার ঘাটলা পার হয়ে আসি।
মইরি বুজিগো বাড়িত্থনে গীতের বাইদ্য ভাইসা আসতাছে। হেজাগের ফকফকা
আলোর টুকরাগুলান নাইরকল পাতার ফাঁকে ফাঁকে টুক পলান্তি খেলা খেলতে আছে।
আমার শইল্যের ভিতরে আলো আর আন্ধারের টুক পলান্তি খেলা শুরু অয়।
কেমুন খুশি-খুশি লাগতে থাকে। কেমুন পরী-পরী মনে হয় আমারে!
মইরি বুজিগো ঘরের পিছে একটা খ্যাড়ের পালা।
‘তুই আয় সই। আমি গেলাম।’ কতা দুইডা কানা-কুয়ার শিসের লাহান
বাতাসে ভাসায়া দিয়া, ময়না আমারে পিছে ফালায়া,
ঘুড্ডিডার লাহান উড়াল দিয়া, বিয়া বাড়ির ভিৎরে ঢুইক্যা গেল
আর লগে লগে কে য্যান আইসা আমারে আগইচ্চা ধইরা খাড়ইল।
‘মাগো, ক্যাডায় রে!’ আমার কইলজাডা লাফ দিয়া মোখের ভিতরে উইট্টা আহে।
আমি চিক্কইর দেওনের আগেই আামার মোখ চাইপা ধরলো কেউ
কয়, ‘আমি! ইয়ে। ডরাইছ না। আমি তর ইয়ে!’
ইয়ে আমারে এক টানে মাডির থনে আলগা কইরা ফালাইছে।
আমি চিক্কইর দিতে পারি না। আবার ইয়ের আত থনে পলাইতেও পারি না।
ইয়ে চকলেডের লাহান মিডা মিডা কতা কইতে কইতে আমারে লইয়া
আরও আন্দারের মিদে ঢুইকা যায়।
‘তর লেইগা কতক্ষন ধইরা মশার কামড় খাইতে আছি, জানছ? অহন এট্টু মিডাইর চাকা খাই!
আমার শরীলডা ইয়ের দুই আতের মিতে একটা পাতলা কলাপাতার লাহান কাঁপতে থাকে।
ইয়ে আমার মিডাইর চাকা কামুড় দিয়া খাইতে থাকে।
আমার ডর লাগতে থাকে। আমার ভালোও লাগতে থাকে।
আমি কই, ‘ছাড় ছাড়। আমার ডর করে।’ আমি হাত পাও ছাডাছাডি করি।
আবার আমার শইল নিজেই আটকা পইড়া থাকে। কেমুন জানি লাগে। হায় আল্লা!
‘এইবার দেহি তর পোস্টাফিসের বাকসোডা। আমার চিডি আছে নিহি!’
ফড়াত করে ডাক বাকসের ঢাকনা খুলে ফেলে ইয়ে।
চিঠি খোঁজে। গোপন কৌটোর ভেতরে চিঠি।
চিঠি খুঁজতে গিয়ে কী জানি মন্ত্র পড়ে ইয়ে। কী জানি মন্তর। আমার শইল কাঁপতে থাকে।
আমার অজ্ঞান-অজ্ঞান লাগে। আমার নিশা-নিশা লাগে। আমার মরা-মরা লাগে।
আমার শইলডা মরার লাহান ঢইলা পড়ে। পানির লাহান টইলা পড়ে।
মায় জানি কী কইছিল…। মা… চিঠির বাকসো খোলা দেখলে মা আমাকে মেরে ফেলবে।
মইরি বুজির বাড়ি থেকে গীতের বাইদ্য আসতে থাকে।
আমি নিশা লাগা বাজনার হাটে অন্ধকারে মরে যেতে থাকি।

কথাসাহিত্যিক, কবি। চল্লিশ বছরের অধিক সময় লেখালিখির সাথে জড়িত।
গল্প উপন্যাস কবিতার পাশাপশি লেখেন প্রবন্ধ নিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, নাটক। যাপিত জীবনের সুখদুঃখ আনন্দবেদনা, সমাজের সংকট সমস্যা, নারীজীবনের দুঃখবঞ্চনা, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইত্যাদি তাঁর লেখার বিষয়। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৬০। তাঁর একাধিক গল্প ও কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন মর্যাদাসম্পন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই: গল্প: ঘুম-মাছ ও এক টুকরো নারী, স্বর্ণতরবারি, অগ্নিতা, কৃষ্ণপক্ষের ঊষা, পেরেক, জাদুবাস্তবতার দুই সখী, বিপ্রতীপ মানুষের গল্প, বিষঁপিপড়ে, Dawn of the Waning Moon (অনুদিত গল্প ), তপতীর লাল ব্লাউজ, জলপরী ও নূহের নৌকা, সমাধি প্রাঙ্গণে দুই বোন। উপন্যাস: ভাঙতে থাকা ভূগোল, পিতলের চাঁদ, কাকজোছনা। কাব্য: জল ও গোলাপের ছোবল, ঝরে পড়ে গোলাপি গজল, চন্দ্রদহন, উড়ন্ত ভায়োলিন, হরিৎ রেহেলে হৃদয়।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, বাংলা।
মা: রহিমা বেগম, বাবা: মোঃ মোফাজ্জল হোসেন, গ্রামের বাড়ি: কেওয়ার, মুন্সিগঞ্জ। জন্ম: ২৮ জুন, ১৯৫৯।
কথাসাহিত্যে প্রাপ্ত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার:
বাংলাদেশ পরিষদের একুশে সাহিত্য পুরস্কার (ছোটগল্পে) ১৯৮০
অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ১৪২৭
রাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য পুরস্কার ২০২০
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১
Related