| 6 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২৬) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


ট্রেকিঙে গেলে না কেন?’

‘ এমনিই।’

‘ পয়সাগুলি জলে গেল।’

‘জানি।’

ট্রেকিঙে যাওয়া দলটিকেবিদায়দিয়েসকালবেলা আমি বাইরেরস্টোভটা  জ্বালিয়েছিলাম। লগকেবিনটারবাইরের খোলা চালা একটির নিচে ইট দিয়ে বানানো স্টোভটা। ধোঁয়া যাবার জন্য ইট  দিয়ে তৈরি একটি চিমনিও আছে। খড়ি  জ্বালিয়েস্টোভটা জ্বালানো হয়। কয়লাও জ্বালানো যেতে পারে। আমরা কিন্তু সাধারণত খড়ি দিয়ে জ্বালাই। যদিও কেবিনের ভেতরে কেরোসিনের একটি চুলো আছে এই স্টোভটা জ্বালাতে ভালো লাগে। গরম জল করতেও সুবিধা।

লগ কেবিন মানে কাঠের সাধারণ একটি ঘর। তিনটি ছোটো ছোটোরুম এবং সামনের দিকে একটি বারান্দা। দেওয়াল গুলি কাঠের তক্তার। একটা রুম অফিসের জন্য। সেখানে টেবিল চেয়ার এবং একটা তক্তপোষ  রয়েছে। বাকি দুটি রুমে চার চারটি দেওয়ালে লাগানো কাঠের বিছানা আছে। বাংকবেড। বিজলি বাতি নেই। হিটারের ব্যবস্থাও  নেই। সোলার হিটিঙের ব্যবস্থা নামেই— কাজে কিছুই নেই। আসলে সেরকমই আদিম ব্যবস্থা। অফিসের লোহার আলমারি একটার নিচের খাপে দুটো লেপ কম্বল কিছু ভরিয়ে রাখা থাকে। বিছানার চাদরও আছে। ঘরটা কিন্তু পরিষ্কার ।বেসক‍্যাম্পটার  দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা চৌকিদার এবং তার স্ত্রী সমস্ত কিছু সাজিয়েগুছিয়ে রাখে। বছরের কয়েকটি মাস ঘরটি ব্যবহার করা হয়। ঠান্ডার দিনগুলি তো বন্ধই থাকে। ভাগ্য ভালো এই জায়গাগুলোতে চুরি-চামারিহয় না। বিদেশিট্রেকারগুলি দু এক রাত থাকতে অপছন্দ করে না।

পাহাড়ি একটি গ্রামের কাছে বেস ক্যাম্পটা। গ্রামের মানুষগুলি ট্রেকার, পোর্টার,গাইডের কাজ করে। বেস ক্যাম্পের দেখাশুনাও করে। এখন তিনটি ট্রেকিং ট্রেভেল কোম্পানির বেস ক্যাম্প এখানে রয়েছে। মোটামুটি কিছু ব্যবসা হয়। সেই দুর্গম বেস ক্যাম্পের কাছের গ্রামটিতে দুটি দোকান আরম্ভ হয়েছে। মানুষের বাড়িতে। সেখানে বোতলের মিনারেল জল থেকে টয়লেট পেপার পর্যন্ত অনেক জিনিসই আজকাল পাওয়াযায়। 

স্টোভটার ওপরে জলের কেটলিটা বসিয়ে দিলাম। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,’ ট্রেকিঙে  যাওয়া উচিত ছিল। এই ট্রেকটিরমতো সুন্দর ট্রেকনেই।একেবারে ঘন সবুজ থেকে ক্রোধীশুকনো রুক্ষশিলাময় পর্বত পর্যন্ত সবই  পেত।  বরফও পেত।  লাদাখসীমান্তের সেই জায়গাগুলি যে কত সুন্দর কল্পনা করা যায় না। খুব মিস করলে। শরীরটা এখনও খারাপ লাগছে নাকি?

 ‘একটু একটু।  কালকের চেয়ে অনেক ভালো।’

‘ হঠাৎ কি হয়েছিল?’

 ‘শরীরটা খারাপ লাগল।বললামই তো। সে হঠাৎ বলল।

 আমি চুপ করে রইলাম।  মেয়েটিহয়তো কথাটা আলোচনা করতে চাইছে না। আমিও এভাবে জিজ্ঞেস করে ঠিক করিনি। বিরক্ত হতে পারে। আমি কেটলিটার জলে চা পাতা দেবার জন্য বের করে নিলাম।

‘জল গরম হয়েছে? চা পাতা দিতে যাচ্ছেন যে?’

 আমি তার কথায়হয়তো খারাপ পেয়েছি বলে ভাবল; সে কাছে চলে এল। আমি ওর দিকে তাকালাম—একটু উদ্বিগ্নতার সঙ্গে সে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চশমার পেছনে তার চোখ দুটো গভীর কুয়ো বলে মনে হল।

‘সোঁসোঁকরে শব্দ করছে। চা পাতা দেওয়া যাবে নাকি?’

‘ একটু অপেক্ষা করুন,জল আরও একটু গরম হোক।’

 আমি উনুনের আগুনটা ভালো ভাবে জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি বের হল। উনুনের চিমনিটার পথের মুখে ধোঁয়াগুলি ঘন জাল সৃষ্টি করল। রাতের শিশিরে খড়িগুলি ভিজেছিল।

‘ দেখি স্টোভটার কাছ থেকে সরে যান। আমি চা করছি।

     ‘আমি চা খারাপ বানাই না,’ আমি দুর্বলভাবেহেসে বললাম।

 ‘লক্ষণ কিন্তু ভালো দেখছিনা।’

 চায়ের কেটলিতে জল ফুটতে লাগল। সে চা পাতা দিল, চিনি দি্‌ল,কনডেন্স মিল্কের ডিবি থেকে দুধ দিল।চায়ের সুন্দর একটা গন্ধ স্টোভের কাছে ছড়িয়েপড়ল।

 সকাল ছয়টারসময় অন্ধকার হয়ে থাকতেই ট্রেকিং দলটা যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল এবং পোর্টারগুলি চারটা বাজতেই এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে আমাকে জাগিয়েদিয়েছিল। সাহেব মেম,ভারতীয়রা ঘুম থেকে উঠে দ্রুত তৈরি হয়ে নিচ্ছিল। তাদের প্রতিটি কাজেই এখন থেকে সময়েরঘড়িঘন্টায় বাঁধা থাকবে।এতটুকুসময়ের ভেতর এতদূর হেঁটে যেতে হবে, অমুক জায়গায়ব্রেকফাস্ট,  তমুকজায়গায়লাঞ্চ ইত্যাদি।কোলাপসেবল বন্ধ করে রাখতে পারা টেন্টগুলি এবং রসদ গুলি ঠিকঠাক করে নিল। কিছু ট্রেকিং দলে পোর্টারনেয় না, কিছু লোক আবার গাইডও নেয় না। সব কিছু নিজেরাই করে, নিজেরাই নেয়।ট্রেকিঙসিজন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের কোম্পানিতে কনফার্মডবুকিং থাকা এটাই শেষ বিদেশিটিম। তাই পোর্টারদেরর আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে ।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২৫) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


       ‘ আপনিও আমাদের সঙ্গে ট্রেকিঙে যাবেন নাকি?’ গতকাল পথে আসার সময় সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল।

‘ না যাব না। আপনারা যাবেন।আমিবেস ক্যাম্পে আপনাদের ঘুরে আসার জন্য অপেক্ষা করব।’

‘ ছয় দিন?’

‘ ক্যাম্পটাকে গোটাতে হবে। এখন তো সিজন শেষ হয়ে গেছে। দিন পনেরোর মধ্যে বৃষ্টি আরম্ভ হবেই।’

সকালবেলাটিমটা যাবার জন্য প্রস্তুত হতেই আমার মনে হয়েছিল সে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল যদিও বড়োযান্ত্রিকভাবে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল। তাকে দেখে আমি ভেবেছিলাম এর জন্যই হয়তো এখন আরম্ভ করতে দেরি হবে।

‘ হঠাৎ মেয়েটি আমার কাছে এসে বলেছিল,’ বেস ক্যাম্পে এই জায়গাটিতে থাকার কোনো ব্যবস্থা আছে কি? মানে হোটেল।’

‘ এখানে ?বেস ক্যাম্পে ?হোটেল ?’আমি অবাক হয়েছিলাম ।’এখানে তো কিছু নেই।’

‘ গ্রামটিতেপেয়িংগেস্টের কোনো ব্যবস্থা আছে?’

‘ আমার জানামতে নেই। কিন্তু কেন?’

সে কোনো উত্তর দিল না।

‘ এই কেবিনটাতে আমি থাকতে পারব কি? টিমটা ফিরে না আসা পর্যন্ত? আমি পয়সা দেব।’

‘ এখানে থাকতে পারবে। পয়সাও লাগবে না।ট্ৰেকিঙেৰপেমেন্ট করাই আছে এবং আমার অন্য কোনো কনফার্মডবুকিংও নেই। কিন্তু কেন?

‘ ধন্যবাদ তাহলে টিমটা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকতে চাই। সে খুব ধীরে ধীরে বলেছিল। কিছু একটা চিন্তায় যেন হঠাৎ ডুবে গিয়েছিল। বারান্দা থেকে সে দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল।কুয়াশায় ধূসর হয়ে এসেছিল দিগ্বলয়। চোখে না পড়া সূক্ষ্ম একটা সুতোর জাল যেন আকাশ থেকে ঝুলে ছিল।

‘ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। ছয়দিন আমি হাঁটতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’ সে ধীরে ধীরে বলেছিল।

আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। বিপদ! মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে এখানে ডাক্তার কোথায় পাব? মহা বিপদ। গাড়িটা সকালে চলে যাবে। ছয় দিন পরে আবার আসবে।

‘ কী ধরনের শরীর খারাপ লাগছে?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

‘ শরীরটা ভালো লাগছে না।’ ছয় দিন পর্বতে হেঁটে চৌদ্দ হাজার ফুট উঠতে পারব কিনা সেই সম্পর্কে আমার নিজেরই সন্দেহ আছে বলে মেয়েটি আবার বলেছিল।

‘গাড়িটা আজ ফিরে যাবে। আমরা কি ফিরে যাব নাকি? এখানে ডাক্তার…

‘ লাগবেনা,’ সে দ্রুত বলেছিল। আমি এখানেই থাকতে চাই। ডাক্তারের কোনো প্রয়োজন হবে না।’

‘ ঠিক আছে।আপনার ইচ্ছা।’আমি বলেছিলাম।

‘ আপনি আছেন বলেই আমি থাকতে সাহস করছি,’ সে বলেছিল।

এই কথার আর কী উত্তর দেওয়াযায়? আমি চুপ করে রইলাম। সে সঙ্গীদের কী বলেছিল বলতে পারি না, কিন্তু একটা কথা লক্ষ্য করেছিলাম যে তার ট্রেকিঙে না যাওয়া কথাটা নিয়ে, বা শরীর যে ভালো নয় তা নিয়ে যেন বিশেষ উদ্বিগ্ন নয়। মেম দুজন বিদায়নেবারসময় তার দুগালে ফটাফট চুমুখেয়ে হাত নাড়িয়ে  গেল। দলটা ট্রেকিঙে যাবার পরে সে অনেকক্ষণ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল।সেওদের দিকে তাকিয়ে ছিল না এমনিতেই শূন্য দৃষ্টিতে ওদের যাবার পথে তাকিয়ে ছিল সে কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সারিবদ্ধভাবে দলটা গ্রামের দিকে এগিয়েগিয়েছিল। সেখানে ওরা সকালের আহার করবে। গরম রুটি ,সিদ্ধ ডিম ,আলু সিদ্ধ ইত্যাদি দিয়ে সকালের আহার খেয়েওদের ট্রেকিং আরম্ভ হয়ে যাবে ।ছয় দিন ওরাধৌলাধার পর্বতের চারপাশে ঘুরে বেড়াবে।

মেয়েটিকে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি কেবিনে ফিরে এসেছিলাম। এসেই বাইরেরস্টোভটা জ্বালাতে শুরু করেছিলাম।স্টোভটা জ্বালাতে সময় লাগে। কাজটাতে আমি খুব একটা দক্ষ নই। রাতের বেলা শিশিরে ঠান্ডা হয়ে থাকা স্টোভটা এবং খড়িগুলি সহজে জ্বলতেচায় না। আগুন ধরানোরসময়ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে লক্ষ করেছিলাম— মেয়েটি তখনও রাস্তার পাশে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীল জিন্সের ওপরে পাতলা নীল জ্যাকেট, মাথায় একটি গাঢ় নীল রঙের উলের টুপি। হাত দুটি সে জ‍্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়েরেখেছিল। আমি স্টোভজ্বালানোর শুরু থেকেই  তার দিকে তাকিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে নাড়াচাড়া করল, ঘুরল, হাত দুটি পকেটে ঢুকিয়ে রেখেই  ধীরে ধীরে ফিরে আসতে লাগল। কাঁধ দুটি সে কুঁচকে রেখেছিল, গলাটা ছোটো করে যেন কিছুটা বুকের ভেতর ঢুকিয়েনিয়েছিল। তার পেছনদিকে ভোরের গাঢ় কুয়াশাকুন্ডলীপাকিয়ে আকাশে পাক খাচ্ছিল। ভোরের আলো বেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেকুয়াশা গুলি যেন বেশিগাঢ় হয়ে উঠছিল,অস্থির হয়ে পড়ছিল ।মেঘের মতো গভীর কুয়াশা গুলি অশান্ত হয়ে ধৌলাধারপাহাড়ের দিকে দ্রুত সরে যাচ্ছিল।

আর সেই কুয়াশার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরেমেয়েটিরবেস ক্যাম্পের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছিল। এত নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল তাকে। একা ,নিঃসঙ্গ এবং অসহায়। অসহায়এবং ঠুনকো। আমার বুকের মধ্যে হঠাৎ সেই মেয়েটির প্রতি একটা দরদ জন্ম নিয়েছিল। দরদ এবং অনুকম্পা। হ্যাঁ মেয়েটিবড়ো একা, নিঃসঙ্গ। আগামী ছয় রাত আমরা দুজন এই ঘরটিতে থাকব। হয়তো তখন তাকে ভালোভাবে জানতে পারব। জানতে পারব তার নিঃসঙ্গতার কারণ।

মেয়েটি এসে স্টোভটার কাছে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার স্টোভজ্বালানোটা সে লক্ষ করেছিল। তাকে কী বলব, কী ধরনের কথা বলব, কীভাবে কথা আরম্ভ করব সে কথা আমি অনেকক্ষণ বুঝতেই পারিনি। তারপরে আরম্ভ করেছিলাম,’ ট্রেকিঙে গেলে না কেন?’

চিনামাটিরমগটাতে চা করে সে আমার দিকে এগিয়েদিয়েছিল।

স্টোভের আগুনের উষ্ণতানিয়ে আমরা দুজন কাছাকাছি বসে ছিলাম এবং আমাদের মধ্যে ঝুলছিল নিঃসঙ্গতার এক স্বচ্ছ পর্দা।

 সেই পর্দার মধ্য দিয়ে আমি তাকে দেখছিলাম।পর্দা তুলে কাছে যেতে পারছিলাম  না… 

আমরা নীরবে চা খাচ্ছিলাম এবং আমাদের সামনে নিঃশব্দে সকালের কুয়াশার পর্দাটা উঠতে শুরু করেছিল।দূরের পর্বতমালা  গাছগুলি  সামান্য স্পষ্ট হয়েছিল। সকালের ঠান্ডার মধ্যে গরম চায়ের কাপ বেশ ভালো লাগছিল—এমনকি হাতের মধ্যে ধরে থাকা চায়ের গরম পেয়ালাটারউষ্ণতাটুকুও। অনেকক্ষণ নীরবে থাকার পরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—‘শরীরটা এখনও খারাপ লাগছে নাকি?’সে মাথা নেড়েছিল না।

     আমি আরও এক কাপ চা ঢেলে নিয়েছিলাম। চা খেতে থাকা সময়টুকুতে এবারও আমি বিশেষ কোনো কথা বলিনি। সে বেশির ভাগ সময়ই নীরব হয়েছিলবলে আমিও কথা বলিনি। আমি চা খেয়ে উঠে গিয়েপাতকৃতঃ করে বেরিয়ে আসার সময় সে একইভাবেস্টোভের  সামনে বসে ছিল।স্টোভের আগুন নিভেগিয়ে উত্তাপ  কমে এসেছিল।

 আমি আগুনটা জ্বালিয়েদিয়েছিলাম।

আকাশটা আলোকিত হয়ে এসেছিল। রোদ উঠবে। রোদ উঠলে ট্রেকিংয়ে যারা গিয়েছে অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাবে।কখনওধৌলাধার  কুয়াশা এবং মেঘে ঘিরে থাকে।

 ‘দিনটা কী করে কাটাবে?’

আরাম চেয়ার একটা দেখেছি। সেটা বের করে রোদে বসব।

 কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে বলেছিল আর বই পড়ব ।মেকলডকগঞ্জ থেকে দুটি বই  কিনে এনেছি।

কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব হয়ে রইলাম।

 ‘আমি গ্রামটিতে  যাব’  আমি তাকে বলেছিলাম।  এখানেএকা একা বসে কি করবে, চল না হলে দুপুরের খাবারটা সেখানে খাব। আমাদের সঙ্গে কাজ করা  একজন  পোর্টারের মা বানিয়ে দেয় তাকে বলে আসব এখানে এসে আমাদের খাবার বানিয়েদিয়ে যাবে। না হলে এই প্রকাণ্ড স্টোভটিতে খাবার বানানো খুব একটা সহজ কাজ নয়।’

     তার চোখ হঠাৎ চকচক করে উঠেছিল.‘লোকাল খাবার পাওয়া যাবে?’

 লোকেল খাবার মানে ভাত,ডা্‌ল, আলু সিদ্ধ, শাক ভাজা। মাংস পাওয়া যাবে না বোধহয়— আগে থেকে বলা হয়নি যে। ডিম সিদ্ধ করে দিতে পারবে।’

     ‘খুব ভালো হবে, কতদিন ধরে ইচ্ছা করছিল এই ধরনের খাবার খাওয়ার।’

 সে বসা থেকে উঠে হাত দুটি মুছে যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল। বিষন্ন হয়ে থাকা মেয়েটির এই পরিবর্তন দেখে আমার মনটাও ভালো লাগল। এই ছয় দিন  এই মেয়েটির সঙ্গে থাকতে হবে ।মন খারাপ করে বসে না থাকলে ভালোভাবেইসময় কেটে যাবে। 

মেয়েটি ভেতর থেকে গিয়ে এল একবার ।দরজার সামনে দাঁড়িয়েজিজ্ঞেস করেছিল ‘দরজাটা তালা মেরে যেতে হবে না?’

 ‘মারব,তালা মেরে যাওয়াই ভালো হবে।’

     ঘরটা বন্ধ করে আমরা দুজনে বেরিয়ে এসেছিলাম। কাঠের ছোট্ট গেটটা বন্ধ করে রেখে আমরা প্রায় ভেঙ্গেখসে যাওয়া পাকার রাস্তাটার উপর দিয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলাম। বেস ক্যাম্পের ঘর থেকে গ্রামটা দেখা গেলেও আঁকাবাঁকা পথে আধ কিলোমিটার দূরে গ্রাম।সংকীর্ণপাহাড়েরসুরঙ্গএকটার মধ্য দিয়ে পার হয়ে যাওয়া পথের দুপাশে ত্রিশটি বিভিন্ন ধরনের ঘর। দুই তিনটা  ঘর দোতলা বাকিগুলি একতলা। পর্বতের পাথর,চুনশিলা এবং কাদামাটিদিয়ে তৈরি ছোটোছোটো ঘর। সামনের দিকে একটি করে বারান্দা। সেখানেই ছোটোছোটো দোকান।কয়েকটিশাকসব্জি,বিস্কু্‌ট, প্রসাধন সামগ্রীর দোকান।ট্রেকিঙ চলে থাকার সময় দোকানগুলি চলে অন্য সময় কেবল গালামালের দোকানগুলি চলে।সেটাই একমাত্র স্থায়ী দোকান।

     ‘এত সংকীর্ণজায়গায়ঘরবাড়ি কেন বানিয়েছে? এত গায়েগায়ে একেবারে রাস্তার ওপরেই।গাড়ি একটা কদাচিৎ যেতে পারে এদিকে।’

     ‘কথাটা আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম।’ 

‘ কী জানতে পারলেন?’

‘ প্রাকৃতিক কারণে।’

‘ প্রাকৃতিক কারণে?’

‘ হ্যাঁ, প্রাকৃতিক কারণে।ধৌলাধার পর্বত থেকে হুহু  করেঠান্ডা বাতাস বয়। বিরাট ঠান্ডা হিমেল বাতাস। এই জায়গাটা বাতাস থেকে নিরাপদ। পর্বতের বাতাস কত ঠান্ডা আর জোরদার হতে পারে আপনার বোধহয় ধারণাই নেই।’

‘ আপনার আছে?’

‘ একবারের অভিজ্ঞতা আছে।’

‘ ব্লিজার্ভ?’

‘ ঠিক ব্লিজার্ড নয় বোধহয়। ব্লিজাৰ্ডটা তুষার রেখার ওপরে বয়—যেখানে বছরের সব সময় বরফ থাকে, সেখানে।ধৌলাধার পর্বতের একেবারে শৃঙ্গে কিছু কিছু বরফ গরমের দিনে থাকে। তারও উত্তরের দিকে থাকা পিরপাঞ্জালসর্বত মালা বা লাদাখেরহিমালয়েরজায়গায়জায়গায় সারা বছর বরফ থাকে। বরফে আবৃত সাদা মাঠের মতো জায়গা আছে সেখানে। আমি দেখিনি।’ 

‘ আমি দেখেছি।’

‘ কোথায়?’

‘ আমেরিকায়?’

‘ সেখানে তো বরফ পড়েই।’

‘ ব্লিজাৰ্ডের কী হল—আপনার দেখাটা।’ ব্লিজার্ডের লেজের কোবখেয়েছিলামহয়তো আমি। ইস কি ভয়ংকর ঝড়। ভেতরেরহাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।’

আমরা পোর্টারের মা রেঁধেদেওয়া ভাত ,ডাল, আলু ,ডিম সিদ্ধ এবং শাকের ভাজা খেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল সে একটু তেল চাইল এবং গরম আলু এবং ডিমটা একসঙ্গে মিশিয়ে মাখা করে নিল। আমি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।

‘ কী দেখছেন?সেজিজ্ঞেস করেছিল।

‘ আলু আর ডিম মাখা আমাদের রাজ্যের মানুষ খেতে খুব ভালোবাসে ।’

সে হেসেছিল। কিছুই বলেনি।

পোর্টারের মা রান্না করে দেওয়াঠিক করলাম, আমার কাজ ছিলপোর্টারদেরহিসেব করে পয়সা পরিশোধ করা এবং বৃষ্টির পরে আরম্ভ হওয়া আগত ট্রেকিঙ সিজনটার জন্য আগে থেকে কথা-বার্তা বলে ঠিক করে নেওয়া।তার জন্য সামান্য একটা অগ্রিম টাকা দিতে হয়।দুশো টাকা মাত্র।সব সময় ভালো পোর্টার এবং গাইড পাওয়া কঠিন—ভরসা করতে পারার মতো।বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের যার তার সঙ্গে পর্বতের মাঝে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া যায় না।মেয়েটিকে আমি এই সমস্ত কথা বলেছিলাম। আর কী কথা বলব, সময়কাটানোর জন্য এই সমস্ত কথাই তাকে বললাম। কথা বলতে থাকায় কিন্তু আমার কাজগুলো হল না।

‘ এই লাইনে কাজ করার আপনার কত বছর হল?’

‘ দুই বছর হয়েছে।’

‘ দুই বছর আপনি হিমালয়ের মধ্যে আছেন!’

‘ দুই বছর।’

‘ আপনি বেশ লাকি দুটি বছর আপনি হিমালয়ের এই সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলিতে থাকার সুযোগ পেয়েছেন কিন্তু এতদূর অসম থেকে আপনি এই হিমাচল প্রদেশ, কাশ্মীরে কিসের জন্য এসেছেন।’

আমি চমকে উঠলাম ।’অসম মানে?’

‘ আপনার উপাধিটা তো একেবারে অসমিয়া উপাধি। অন্যদের মধ্যে তো নেই।’

‘ আপনি কীভাবে জানলেন?’

‘ এটা অসমিয়া উপাধি বলে আমি জানি। আমাদের স্বাগত জানানোরসময় আপনি নাম উপাধি বলেছিলেন।’

‘ আপনিও তো ভারতীয়— কোথাকার কোন রাজ্যের?’

‘ আমি তো একজন আমেরিকান। এখন আমেরিকার নাগরিক।’

‘ সেটা অবশ্য ঠিক কিন্তু হলেও আপনি তো ভারতীয় মূলের।’

সে মাথা নাড়ল। তাৰ চোখে মুখে কৌতুকের হাসি ছড়িয়েপড়ল। চশমার পেছনে চোখ দুটি তিরবির করে উঠল; বললেন আমি ও অসমিয়া।’ অসমিয়াতে বললেন।

‘ ডিম আলু মাখা খেতে দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। কোথাকার?’

‘ সেসব পরে বলব। আমার প্রশ্নটির উত্তর দেননি।’

‘কী প্ৰশ্ন?’

‘ এখানে কেন এবং কীভাবে এলেন?’

‘ কীভাবে এলাম তার উত্তর হল রেল এবং বাসে, কেন এসেছির উত্তর হল চাকরি করার জন্য।’

‘ সেটাই কি উত্তর?’

‘ সন্দেহ আছে নাকি?’

‘ সন্দেহ নেই। কিন্তু হয়তো সম্পূর্ণ উত্তর নয়।’

‘ কীভাবে জানলেন?’

‘ অসমিয়া ছেলেরা এত দূরে আসে না।’

‘ আজকাল আসে।’

‘ আজকাল কেন আসে?’

‘ অসমে কী করবে?’

‘ করার মতো সেখানে কোনো কাজ নেই?’

‘ কাজ হয়তো আছে। পরিবেশ নেই। চারপাশে গোলাগুলি, মারপিট, মিলিটারি,আন্ডারগ্রাউন্ড‐অভারগ্রাউন্ড।আমেরিকায়থেকেআপনারাতোকোনোকিছুইখবরপাননাবোধহয়।’

‘ পাই ।কিছু কিছু পাই। সত্যিই অসম অনেক বদলে গিয়েছে তাই না?’

‘ চেনাযায় না। একেবারে চেনাযায় না।’

‘ কি পরিবর্তন হল— মানুষ?’

‘ আসলে অসমে সরলতা এবং ইনসেন্সের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। বলতে পারেন এন্ড অফ ইনসেন্স… 















error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত