| 6 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: ডোম জনগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাস ও পূজাপার্বন

আনুমানিক পঠনকাল: 22 মিনিট

ইংরেজি Religion যার অর্থ উপসনা, ধর্ম। শব্দটির উৎপত্তি লাতিন religionem থেকে (nom. religio) যার অর্থ “পবিত্র বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা বা ঈশ্বরদের প্রতি নিষ্ঠা”। অর্থাৎ আদিম সমাজে নির্ধারিত বস্তু, প্রাণি বা আত্মাকে পবিত্রজ্ঞানে শ্রদ্ধা করার ভেতরই ধর্মের অর্থ সীমাবদ্ধ ছিল। একেশ্বরবাদী ইহুদীদের হিব্রু ভাষায়ও আধুনিক ধর্মের অর্থ নিরূপনকারী কোনো সমার্থক শব্দ নেই। তাদের ভাষায় ধর্ম হচ্ছে হারাখা বা পথ। আইন হিসাবেই এটি বেশি পরিচিত। সংস্কৃত শব্দ ‘ধার্মা’ অর্থ ‘উপাসনা ধর্ম’ হলেও এর অন্য অর্থ হচ্ছে আইন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের আইনগুলো সাধারণত অপরিবর্তনীয় কেননা সেগুলো লিখিত আকারে প্রকাশিত। কিন্তু আর পাঁচটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা আদিম জনজাতির ধর্মাচারগুলো অলিখিত বলে তা অঞ্চল ভেদে বা গোত্র ভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ। ডোম সমাজের গোত্রভিত্তিক ধর্মবোধ ও বিশ্বাসের ভিন্নতা ঐ জাতির জাতীয় জীবনাচরণেও পার্থক্যের সূচনা করেছে। আবার দীর্ঘদিন দরে বিভিন্ন জনজাতির সঙ্গে বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাসের ফলে তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মের আচার সংস্কারের কিছু মিশ্রণ ঘটেছে। তবে হিন্দু ধর্মের নানা পূজা পার্বনে তারা অংশগ্রহণ করলেও কিংবা হিন্দুদের কোনো কোনো পূজা নিজেরা করলেও ডোমরা তাদের নিজের প্রাচীন আচার সংস্কার ও বিশ্বাস থেকে সরে আসতে পারেনি। সম্ভবত একারণেই রিজলে বলেন-‘ ডোমদের মধ্যে ধর্মীয় সংগঠনের ঐক্য খোঁজার বিষয়টি স্পষ্টতই প্রশ্নের বাইরে।’ তবে একথা সত্য যে প্রাকবৈদিক যুগে বাংলাদেশে আদিম অধিবাসীদের মধ্যে ধর্মের সাংস্কৃতিকধারা অনুসৃত হত। অর্থাৎ অস্ট্রিক-দ্রাবিড় নৃগোষ্ঠীর ধর্ম বিশ্বাসই ছিল এ অঞ্চলের আদিমতম ধারা। বিভিন্ন কোমের ধর্ম বিশ্বাস তাদের টোটেম কেন্দ্রিক ছিল। তবে কৃষিজীবী অস্ট্রালরা নবোপলীয় যুগে প্রথম লিঙ্গ ও পৃথিবীপূজার প্রচলন করে। এই সময়ই প্রথম কৃষিকাজের সূচনা হয়। তাই প্রথম ফসল তোলার সময় তারা নবান্নের আয়োজন করে এবং লিঙ্গরূপী পাথরের পূজা করে যা দিয়ে তারা জমি চাষ করেছিল। আর তারা বিশ্বাস করতো যোনীরূপী পৃথিবী হচ্ছে শক্তির আধার যেখানে উৎপন্ন হয়েছে কাঙ্খিত ফসল। অস্ট্রিকভাষাভাষীর লোকেরা একাধিক জীবনেও বিশ্বাস করতো। তারা মনে করতো কারো মৃত্যু হলে তাদের আত্মা পাহাড়, গাছ, কোনো পশু-পাখি বা অন্য কোনো জীবে আশ্রয় গ্রহণ করে। একারণে তারা মৃতদেহ কাপড় বা গাছের ছালে জড়িয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখতো বা মাটিতে কবর দিয়ে কবরের ওপর পাথর দিয়ে রাখতো। পুরুষের কবরে বড় পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দেওয়া হতো এবং নারীর কবরে তা লম্বালম্বি ভাবে শুইয়ে রাখা হতো।১ অষ্ট্রিকদের লিঙ্গপূজা দ্রাবিড়ীয় সভ্যতায় শ্মশান- প্রান্তর ও পাহাড়ের রক্ত দেবতা হয়ে উঠেছিলেন। কেননা দ্রাবিড় ভাষায় শিবন্ অর্থ লাল বা রক্ত এবং শেম্বু অর্থ তাম্র বা তামা । কালক্রমে দ্রাবিড়দের শিবন্ হয়ে যায় শিব আর শেম্ভু হয়ে যায় শম্ভু বা রুদ্ররূপী শিব। অন্য দিকে অস্ট্রিকদের শক্তিপূজা দ্রাবিড়দের যোনি পূজায় রূপান্তরিত হয় আর মাতৃকাপূজা ও সর্পপুজা রূপান্তরিত হয় শক্তিপূজায় ও মনসাপূজায়।২ দ্রাবিড়রা পূজার জন্য মন্দির নির্মান করতো, দেবতাদের উদ্দেশ্যে পশু বলি দিত। এরা মৃতদেহ কবরস্থ করতো আবার খানিকটা পুড়িয়ে হাড়গুলি কবরস্থ করতো।৩ প্রাক-আর্য যুগের বঙ্গের অধিবাসী হিসেবে বাঙালিরা তাই একটি মিশ্র সংস্কৃতি রপ্ত করে ফেলেছিল। এভাবে বাঙালির চড়ক, গাজন উৎসবও প্রাক- আর্য যুগ থেকেই বাংলায় প্রচলিত হয়। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে উলুধ্বনি দেওয়া, আল্পনা আঁকা, বিয়েতে হাতে শাঁখা পরা ইত্যাদি বাঙালির প্রাক-আর্য বৈশিষ্ট্য। একারণে বলা হয় : ‘এই আদি অস্ত্রাল, দ্রাবিড় ও আলপীয় নরগোষ্ঠীর লোকদের সংমিশ্রণেই বাঙলার নৃতাত্ত্বিক বনিয়াদ গঠিত হয়েছিল’।৪ বাঙালির লৌকিক দেবতাদের মধ্যে এই সময় উল্লেখযোগ্য ছিলো- রক্ষা কালী, ওলাইচন্ডী, শীতলা, ধর্মঠাকুর প্রভৃতি। এইসব দেবতার কোনো মূর্তি এই সময় ছিল না। বিশেষ একটি থানে পাথর রেখে বা কোনো টোটেম সদৃশ পাথর রেখে পূজা করা হতো। সন্তান কামনা ও নানা ধরনের রোগ ব্যাধী থেকে মুক্তি পেতে এই সব পূজা করা হতো। দেবতাদের জন্য থান নির্দিষ্ট হতো নদীর ধারে, গাছতলায়, ক্ষেতের আলে। আজও বাংলাদেশের ডোমদের কোনো নিজস্ব পূজা মন্দির নেই। ঘরের বাইরেই তারা দেতবার পূজা করে এবং পশুবলি দেয় এবং তার মাংস খায়।

বর্তমানে ডোমদের প্রাচীনতম ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও তাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্ম সংস্কৃতি আদি অস্ট্রিকদের ধর্ম সংস্কৃতির ধারাই অনুসরণ করে থাকে। রিজলের বর্ননা থেকে জানা যায় যে-বাঁকুড়া এবং পশ্চিমবঙ্গের ডোমরা বৈষ্ণবধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তবে তারা জৈষ্ঠ্যের শেষ দিনে চালের ভোগ দেয় এবং মাছের লেজ বিশিষ্ট পুরুষ দেবতার পূজা করে। একে তারা ধর্ম বা ধর্মরাজের পূজা বলে। তারা গুড় কলা এবং চিনি দিয়ে সূর্যদেবতার আশীর্বাদ কামনা করে যাতে ভালো ফসল তারা পেতে পারে। এছাড়া প্রতি বছর বৈশাখ মাসে তারা তাদের পূর্বপুরুষ কালুবীরের উদ্দেশ্যে ছাগল বলি দেয় এবং ফল ও মিষ্টি নিয়ে জঙ্গলে যায়। দুর্গা পূজার সময় বাজুনিয়া ডোমরা ঢোলের পূজা করে। মধ্য বাংলায় ডোমরা কালীকে তাদের প্রিয় দেবী বলে মনে করে। পূর্ব বাংলায় অনেক ডোম পন্থ, বা সুপাট, সুপন বা শোভন ভগতের পথ অনুসরণ করে। তারা সুপথ ভগৎকে একজন গুরু হিসেবে মান্য করে থাকে। অন্যরা আবার নিজেদেরকে হরিশ্চন্ডিস বলে দাবি করে। রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাছ থেকে বিশেষ আশীর্বাদ পেয়েছিল বলে তারা নিজেদের হরিশ্চন্দ্রের অনুসারি হিসেবে দাবি করে। মূলত যে সকল স্থানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিন্দুদের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেও সংস্পর্শে এসেছে সেই সব স্থানে তারা হিন্দুদের পৌরানিক দেবদেবীর সঙ্গে নিজেদের জন্য বিশেষ মিথ তৈরি করে নিয়েছে। রিজলে জানান-পূর্ব বাংলায় ডোমদের প্রধান উত্সব হল শ্রাভানিয়া পূজা। পূজায় তারা একটি শুকর বলি দেয় এবং একটি পেয়ালায় তার রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এই পেয়ালার রক্ত, দুধ নারায়ণকে নিবেদন করা হয়। আবার, ভাদ্রের (আগস্ট) এক অন্ধকার রাতে তারা একটি পাত্রে দুধ দেয়, একটি তাজা নারকেল, তামাকের একটি পাইপ, এবং হরিরামকে একটি ছোট ভারতীয় শণ উৎসর্গ করে। এর পরে শুকর জবাই করে উতসব উদযাপন করা হয়।
ডোম সম্প্রদায়ের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মাচার নিয়ে রিজলের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলো-‘ It is clearly out of the question to look for any unity of religious organization among the Doms. In Bankura and Western Bengal generally they seem on he whole to lean towards Vaishnavism, but in addition to Rádhá and Krishna they worship Dharam or Dharma-ráj in form of a man with a fish’s tail on the last day of Jaishtha with offerings of rice, molasses, plantain, and sugar, the object of which is said to be to obtain the blessing of the sun on the crops of the season. Every year in the month of Baisákh the members of the caste go into the jungle to offer sacrifices of goats, fruits, and sweetmeats to their ancestral deity Kálubir; and at the appointed season they join in the worship of the goddess Bhádu, described in the article on the Bágdi caste. At the time of the Durga Puja, Bájuniá Doms worship the drum, which they regard as the symbol of their craft. This usage has clearly been borrowed from the artisan castes among the Hindus. In Central Bengal Káli appears to be their favourite goddess; and in Eastern Bengal many Doms follow the Panth, or path of Supat, Súpan, or Sobhana Bhagat, who is there regarded as a guru rather than as the progenitor of the caste. Others, again, call themselves Haris Chandís, from Rájá Haris Chandra, who was so generous that he gave away all his wealth in charity, and was reduced to such straits that he took service with a Dom, who treated him kindly. In return the Rájá converted the whole tribe to his religion, which they have faithfully followed ever since.” The principal festival of the Doms in Eastern Bengal is the Srávannia Puja, observed in the month of that name, corresponding to July and August, when a pig is sacrificed and its blood caught in a cup. This cup of blood, along with one of milk and three of spirits, are offered to Nárayan. Again, on a dark night of Bhádra (August) they offer a pot of milk, four of spirits, a fresh cocoanut, a pipe of tobacco, and a little Indian hemp to Harí Rám, after which swine are slaughtered and a feast celebrated..’৫ অন্যদিকে বাংলার ডোমদের সঙ্গে বিহারের ডোমদের ধর্মাচারে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। সেখানে ডোমদের প্রধান দেবতা হলেন- শ্যাম সিং।৬ একে কেউ কেউ ডোমদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করে। এছাড়া আছে রাকাত মালা, ঘিবাল বা গোহিল, গোরাইয়া । দেওরিয়া ও দারভাঙ্গায় শ্যাম সিংয়ের মন্দির রয়েছে। শ্যাম সিং সহ অন্যান্য দেবতাদের মতো বাড়ির ভেতরে গাছের নীচে বা গোবর দিয়ে একটি গোলাকার জায়গায় থান স্থাপন করা হয়। সেখানে শুকনো একটি মাটির পিন্ড রাখা হয়। এখানে পূজা শেষে শূকর বলি দেওয়া হয় এবং মদ উৎসর্গ করা হয়।৭ পরিবারের শান্তি, রোগবালাই ও বিভিন্ন ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে এই পূজা করা হয়। বিহারের মাগাহিয়া ডোমরা সাপের কামড়ে মৃত মানুষের আত্মাকে সাম্পেরিয়া হিসাবে পূজা করে।৮ তারা মনে করে এই পূজা না করলে মৃত ব্যক্তি ফিরে এসে খারাপ স্বপ্ন দেখাবে। তাই যে সাপ তাকে কাড়ছে ডোমরা সেই সাপেরও পূজা করে যাতে ঐ মৃত ব্যক্তির পরিণতি তাদের বরণ করতে না হয়। এছাড়া মঘাহিয়া ডোমরা সানসারি মা নামে একজন দেবীর পূজা করে থাকে। দেবীর জন্য আলাদা করে কোনো থান থাকে না, কোনো ঘট বা মাটির পিন্ডও রাখা হয় না। একটি জায়গা বেছে নিয়ে গোবর দিয়ে নিকানো হয় এবং একটা বৃত্তের মাঝে স্প্যান আঁকা হয়।৯ এর সামনে বসে উপাসক ছুড়ি দিয়ে বাম হাত কেটে বৃত্তের মাঝে রক্তের পাঁচটি দাগ দেয় এবং প্রার্থনা করে।
বাংলাদেশের ডোম সমাজের আরাধ্য দেবতা হচ্ছেন- সিয়ামসাম, বাওয়াও আলা, মা গেহিল প্রভৃতি। তবে ডোমদের ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে ভিন্ন ভিন্ন দেবতা পূজায় অগ্রাধীকার পেয়ে থাকে। ডোমদের পূজায় কোনো ব্রাহ্মণ থাকে না। যে কোনো ব্যক্তি উপবাস থেকে পূজা সম্পন্ন করতে পারেন।তবে ডোম সমাজে সামাজিক ভাবে বিয়ে হলেই কেবল পুরুষগণ শ্বশুড় বাড়ির পুজায় অংশ নিতে পারেন। কিন্তু যদি বিয়েটি ভালোবাসার বিয়ে হয় তবে তারা তাকে অর্দ্ধি বলে। এই ধরনের বিয়ে হলে পুরুষটি তার শ্বশুর বাড়ির পূজা-পার্বনে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

বাওয়াওআলা পূজা:১০ উত্তরাইয়া ডোমদের মধ্যে বাবাওয়ালা পূজা বা বাবা পূজার প্রচলন রয়েছে। বাওয়াওআলা দেবতা মূলত বন রক্ষাকারী দেবতা। তিনি শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সাহায্য করেন এবং বিপদ আপদে দিশা দেন। বাওয়াওআলা পূজার থান তৈরি হয় ঘরের বাইরে। ফাল্গুন মাসের যে কোনো মঙ্গলবার এই পূজার আয়োজন করা হয়। নির্দিষ্ট জায়গায় কোনো গাছের নিচে গোবর দিয়ে নিকানো হয়। সেখানে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ছোট্ট একটা ঘর নির্মাণ করা হয়। সেই ঘরের ভেতর নতুনএকটা গামছা পেতে মুড়ি খই মিষ্টি, গুড়, বাতাসা রাখা হয়। আর লাড্ডুগুলো ঘরের ভেতর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এর পাশে আর একটি স্থানে খোলা জায়গায় কলাপাতায় একই রকম পূজার উপকরণ রাখা হয়। পূজায় উৎসর্গ করার জন্য একটি শুকর ধার্য করা হয় কোথাও আবার প্রধান শুকরটির সঙ্গে দুইটি বা তিনটি বাচ্চা শুকর ধার্য করে। ঐদিন দুপুর ১২টার সময় পূজা শুরুর আগে শুকরগুলো গোসল করানো হয় এবং গোসল শেষে থানে রাখা কাসাঁর লোটা থেকে গঙ্গা জল শুকরগুলোর শরীরে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। বাওয়াওআলা পূজার পৌরহিত্য যিনি করবেন তিনি আগের দিন রাত বারোটা থেকে উপবাস থাকেন। তিনি থানের সামনে বসে বিভিন্ন ফুল পাতা দিয়ে পূজা শেষ করেন। পূজা শেষ হলে সেখানে শুকর লোহার ধারালো শিক গেথে মারা হয়। একে থানে শুকর চড়ানো বলে। শুকরের মাংস ও অন্যান্য খাবার রান্না হলে বিকালে বাওয়াওআলা দেবতার থানে কোথাও একটি কলাপাতায় আবার কোথাও মাটির পাত্রে আতপ চালের ভাত , সব্জি, ডাল ও শুকরের মাংস ভোগ বা নৈবেদ্য হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। এই সময় সঙ্গে রাখা হয় দারু বা মদ, একটি কালো মুরগি ও একটি সাদা কবুতর। কবুতরটির কপালে মেটে সিঁদুরের তিলক এঁকে দেওয়ার পরে সেটি উড়িয়ে দেওয়া হয় আর কালো মুরগিকে থানে বলি দেওয়া হয়। কোথাও কোথাও মুরগির ব্যবহার নেই। বাওয়াওআলা দেবতা পূজায় সন্তুষ্ট হলেন কিনা তা জানতে উপসক মন্ত্র পড়তে থাকেন। একজন সাহসী ব্যক্তি কাসাঁর লোটা মাথায় নিয়ে দাড়িয়ে থাকে।কাসাঁর লোটার মধ্যে একটি লাঠি রাখা হয়। এই লাঠিকে বাবা নাথের লাঠি বা নীর বলে। উপাসক লোটার মধ্যে চাল রেখে মন্ত্র পড়লে লোটার মধ্যে লাঠিটি ঘুরতে থাকে। এরপর কাসাঁর লোটাটি নামিয়ে থানের সামনে রেখে চারজন সেই লোটা ধরে রাখেন। পূজারি পুণরায় মন্ত্রপূত চাল ছড়িয়ে দিলে লোটাটি ফের ঘুরতে শুরু করে। পূজারি নির্দিষ্ট সময় পর মন্ত্র পড়লে লোটাটি থেমে যায়। যদি পূজার সময় লোটাটি না ঘোরে তা হলে ধরে নিতে হবে- দেবতা সেই পূজা গ্রহণ করেন নি। এই পূজার থানে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ। বাওয়াওআলা পূজা কেবল মাত্র পুরুষেরাই করে থাকেন। এই পুজার প্রসাদ কেবল পুরুষ ও যে কোনো অবিবাহিত মেয়েরা গ্রহণ করতে পারবে। বিবাহিত নারীরা এই পুজার প্রসাদ গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে শুকরের মাংস বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রান্না করলে সকলেই খেতে পারবে।
ঘোড়ি পুজা:১১ আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার যে কোনো মঙ্গলবার এই পূজা করে থাকে উতরাইয়া ডোমরা। এটা মূলত হনুমানের পূজা। এই পূজা করেন একজন বিবাহিত মহিলা। পূজার আগের দিন রাত ১২টার পর থেকে তিনি উপবাস রাখেন। সন্ধ্যার সময় ফুল ,বেলপাতা, দুর্বা, টিকলা( হুকার কলকে) এবং মদ দিয়ে এই পূজা সম্পন্ন করা হয়। এই সময় ডোম পাড়ায় আধাঘন্টার জন্য আলো নিভিয়ে রাখা হয়। এই পূজার মূল উদ্ধেশ্য হচ্ছে সুস্থতা ও রোগ ব্যধি থেকে মুক্তি।

ছট পূজা বা ছাইট্যা পূজা:১২ কার্তিক মাসে উত্তরাইয়া ডোম ও বাঁশফোর ডোমরা এই পূজা করে থাকে। কালী পূজার দুই দিন পর ছট পূজার আয়োজন হয়। যে বাড়িতে ছট পূজার মূল আয়োজন হয় সেই বাড়িটি লক্ষ্মী পূজার পর ধোঁয়া মোছা করে পবিত্র করা হয়। উঠানে গোবর দিয়ে নিকানো হয়। ঘর বাড়ি সামর্থ অনুযায়ি সাজানো হয়। এই সময় মাটির হাড়িতে মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া, হাঁস, মুরগির প্রতিকৃতি, খই, বাতাসা সহ একটা স্থানে মোমবাতি জ্বেলে রাখা হয়। এটা রাখা হয় বাচ্চাদের জন্য। বাচ্চারা এখান থেকে খই বাতাসা খাবে এবং পুতুলগুলো নিয়ে খেলবে। যারা মারা গেছেন তাদের জন্য শ্মশানে আগরবাতি জ্বালানো হয় এবং যে ব্যক্তি যা খেতে পছন্দ করতো সেই সব পছন্দের খাবার তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। এরপর সেখান থেকে স্নান সেরে বাসায় এসে মুরগী বা খাসির মাংস রান্না করা হয় যা সকলে খায়। এর পরদিন পরিবারে মাছ রান্না করা হয়। কালী পূজার পর ১১ টার আগে সকলে রাতের খাবার খেয়ে নেবেন এবং ১২টার দিকে মুখ ধুয়ে ঘুমাতে যাবেন। পরদিন নিরামিষ রান্নার আগে সমস্ত কিছু ধুয়ে মুছে পবিত্র করা হয় এবং নিরামিষ রান্ন করা হয়। তবে এই নিরামিষের সময় কেউ কচুর মুখি, বরবটি, শাক, মূলা, বেগুন ও লাউ খাবেন না। তবে পটল, আলু ধুন্দল ও করলা চলবে। এই দিন পরিবারের মধ্য থেকে সক্ষম এক বা দুইজন উপবাস থাকবে। সবাই দুই দিন নিরামিষ খাওয়ার পর পরিবারে লাউ ভাজি করা হয় এবং তেঁতুল ও ধনেপাতা দিয়ে চাটনি ও লাউ দিয়ে ডাল রান্না করা হয়।পরিবারে যিনি উপবাস করেন তিনি বা পরিবারের গৃহকত্রী এই সময় স্নান সেরে এক ঘটি জল এনে ছট্ দেবতা, সত্ততেনি ও দিননাথের পূজায় বসবেন। তার আগে তিনি মাথায় তেল দিয়ে মাথা আচরাবেন, লাল পাড়ের হলুদ শাড়ি পরবেন কোনো ভাবেই কালো বস্ত্র পরা যাবে না। ঘরের ভেতরে তিনি একটি থানে কলাপাতায় তিন মুঠ ভাত রাখবেন এর সঙ্গে রাখবেন লাউ ভাজি, লাউয়ের ডাল,তেঁতুল ধনেপাতার চাটনি, মুড়ি ও রং চা। এরপরে তিনি ধুপ ও দীপ জ্বালাবেন। এ সময় ঘরের বাইরে থাকবে এবং ঘরের দরজা বন্ধ থাকবে। পূজারি তখন সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করবেন। প্রার্থনা শেষ হলে তিন ভাগে রাখা খাবার থেকে একটু একটু একটু নিয়ে নিজে খাবেন। এরপর পূজা শেষ হলে তিনি বের হয়ে এসে অন্যান্য সময়ের মতো কাউকে প্রণাম করবেন না এমনকি গুরুজনদেরও না। তিন দিন তিনি কাউকে প্রণাম করতে পারবেন না। পূজারি বের হয়ে আসলে অপেক্ষমান সকলে ঘরে ঢুকবে এবং থানে প্রণাম করে প্রসাদ গ্রহণ করবে। যে ঘরে পূজা হয় সেই ঘরে পূজারি ছাড়া কেউ রাত্রি যাপন করতে পারেন না। রাতে খাবার খেয়ে তিনি আগে থেকে পেতে রাখা বিছানায় তিন দিন ঘুমাবেন। বিছানার চাদর নতুন হতে হবে এরং লাল, সাদা আর হলুদ রঙের হতে হবে। প্রথম দিন রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে সকল সদস্যদের ঘুম থেকে তুলে দেবেন পূজারি এরপর একটি কাঠি দিয়ে দাঁতের ময়লা বের করে ফের ঘুমিয়ে পড়বেন সবাই। ভোরে উঠে কলাগাছ কেটে, নতুন মাটি, বেলপাতা এনে ঘরের মধ্যে নতুন চুলা বানানো হবে। পরিবারের সবাই নিরামিষ খাবেন কিন্তু যিনি পূজা করবেন তিনি কিছু খাবেন না। তিনি কলা দুধ আটা ঘি খড়ি কিনে আনবেন এই সময় পুকুরে গিয়ে তিনি স্নান করে ১ ঘটি জল নিয়ে আসবেন এবং নতুন চুলায় দেবতার জন্য ক্ষীর, রান্না করবেন, রুটি বানাবেন এবং তা দিয়ে ভোগ প্রস্তুত করবেন। পাটায় সিঁদুর ফোটা দেবেন, বেলকাটা, গুড়, আতপ চাল, আমের পাতা দিয়ে সেই সব উপকরণ সাজানো হবে। এরপর আবার চৌকা করে থান বানাতে হয় এবং জলের ঘটটি সেখানে রেখে জয় বাবা দীন নাথ বলে স্থাপন করা হয় এবং একটি কলাপাতা দিয়ে তা ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর দিন তিনি নদীতে গোসল সেরে নদীর পানি বাড়িতে ছিটিয়ে দেবেন। পর দিন সারাদিন উপবাস থাকার পর রাত এগারোটায় তিনি ঘরের ভেতরে ‘খান্না’ পূজায় বসবেন। ‘খান্না’ দেবতার কোনো মূর্তি বা প্রতীক সেখানে থাকে না। ঘরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কলাপাতায় রুটি, পান সুপার, গুড় দিয়ে তৈরি ক্ষীর দিয়ে রাত বারোটায় তিন খান্না পূজা দেবেন। এই পূজায় দুধ ব্যবহার করা যায় না। এই সময় ঘরে মধ্যে কেউ উপস্থিত থাকতে পারবে না। সকলে বাইরে নিঃশব্দে অপেক্ষা করবে। দশ মিনিটের মধ্যে এই পূজা শেষ করে পূজারি প্রসাদ খেয়ে নেবেন। এরপর তিনি সকলের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করবেন।
পরদিন সারা সকাল থেকে রুটি ও পিঠা তৈরির কাজ চলতে থাকে। ১০টি কুলা, ১০টি ডাব ১০টি জাম্বুরা সাজিয়ে রাখা হয়। প্রতিটি কুলায় আটা গুড় দিয়ে তৈরি পাঁচটি করে ঠেকুয়া পিঠা রাখা হয়। সঙ্গে রাখা হয় বিভিন্ন রকম সব্জি, গুড়, লাল সুতা, আট রকম ফল এবং মানতের স্বর্ণ, মিষ্টির প্যাকেটসহ কুলায় সিঁদুরের পাঁচটি তিলক এঁকে বাইরে কুলাগুলো সাজিয়ে রাখা হয়। এই কুলা বা উপকরণসমুহ তিনটার আগেই সাজিয়ে রাখা হয়। সূর্য যখন পাটে বসে তখন ঢোলবাদ্য বাজিয়ে মহিলারা মাথায় কুলো নিয়ে নদীর ঘাটে যায়। নদীর ঘাটে আখ পুঁতে সাজিয়ে রাখা হয়। এই পূজার মূল পূজারি লোটা থেকে কুলোর উপর দুধ ঢেলে দিয়ে কুলো সুর্য দেবতাকে দর্শন করান। এভাবে সবগুলো কুলো সুর্য দেবতাকে দেখানোর পর পূজা সম্পন্ন হয়। পরদিন সকালেও একই ভাবে নদীর ঘাটে সূর্য দেবতার পূজা সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে ছট পূজা শেষ হয়। এই পূজা মূলত মহিরারাই করেন। অত্যন্ত ব্যয় বহুল এই পূজা এখন বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। তবে যশোরে এই পূজা এখনও জাকজমক ভাবে সম্পন্ন হয়। মহিলাদের পূজা হলেও পুরুষেরা এই পূজায় অংশ নিতে পারে।

মা গেহিল পূজা:১৩ মা গেহিল মূলত উত্তরাইয়া ও মঘাইয়া ডোমদের গৃহ দেবতা। তিনি মূলত আদি রক্ষা দেবী কিন্তু এই দেবতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। উত্তরাইয়া ডোমদের গৃহ মন্দিরে এর কোনো মূর্তি থাকে না। কোথাও কোথাও পাথর বা নোরায় পূজা পান। মঘাইয়া ডোমরা মাছের লেজের মতো তিনটি মাটির মূর্তি তৈরি করে এই দেবীর পূজা করেন। এই গৃহ দেবতার জন্য প্রতিটি ঘরে থান পাতা হয় যাকে বলা হয় সিরা বা সিরকি। এই সিরা বা সিরকিই এক পরিবারের সঙ্গে আর এক পরিবারের মা গেহিল দেবতার পার্থক্য নির্ধারন করে। অনেকে একে গাহির মা, গাহিল মা বলে ডাকেন , অনেকে গিহাল কিংবা গিবাল বলেও ডেকে থাকেন। এই দেবতা মূলত নারী দেবতা। সিরা তৈরির সময় সিরার দেওয়ালে পরিবারের মৃত সদস্যদের নামে একটি করে সিঁদুরের লম্বা দাগ দেওয়া হয়। এই লম্বা দাগ দেখে বোঝা যায় পরিবারে এ যাবত কত জন সদস্য মারা গেছেন। মূলত এই মৃত ব্যক্তিদের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করেন গিহাল দেবতা। আত্মাসমূহের অপশক্তি দূর করে দিয়ে পরিবারকে নিরাপদ রাখা এবং এই আত্মাকে শান্ত রাখাই গেহিল দেবতার কাজ। সকল ধরনের সামাজিক কাজের আগে মা গেহিলের পূজা সম্পন্ন করতে হয়। পূজার দিন সিঁদুর, লাল চুড়ি, খই , মুড়ি, দুধ, বাতাসা , পাঁচটি মাটির পাত্র, লাল সুতো, জবা ফুল ও দুটো সাদা কবুতর দরকার হয়। ভোগ নিবেদন করে গিহাল মায়ের নামে সিরার সামনে শুকর চড়ানো হয় বা শুকর মারা হয়। দুটি কবুতরকে ঘরের সামনে এনে চাল, ফুল ও গুড় খেতে দেওয়া হয় এবং এরপর সেখানে তাদের মারা হয়। এটি করা হয় কবুত্রা দেবের উদ্দেশ্যে এর পর দুটো বাচ্চা শুকর ঘরের দরজায় খারমা ও গরদার উদ্দেশ্যে চড়ানো হয়। গেহিল মায়ের পুজা হলেই তিনটি শুকর চড়াতেই হবে। ডোমদের বিশ্বাস র্খামা , গিরদার ও কবুত্রা হচ্ছেন গিহাল মায়ের সহচর, সহচরী অনেকে মনে করেন তার সন্তান। কাজেই তার পূজা করার সময় এদের পূজা করতে হয়। আগে আলাদা আলাদা পূজা হলেও এখন এক পূজায় ভোগ নিবেদন করে পূজা সম্পন্ন করা হয়। একটি পরিবারে মা গেহিল দেবতার নামে উৎসর্গ করা প্রসাদ অন্য পরিবারের সদস্যরা গ্রহণ করতে পারেন না কারণ সিরকিতে মৃত সদস্যদের নামে দেওয়া সিঁদুরের দাগ ও সংখ্যার কারণে এক একটি পরিবারের গৃহ দেবতা হিসেবে গেহিল দেবতা আলাদা হয়ে যান। তাই এক পরিবারের গেহিল মায়ের পূজার প্রসাদ অন্যরা গ্রহণ করে না । তবে পূজার উদ্দ্যেশে রান্না করা মাংস সকলেই খেতে পারেন।

সিয়ামছিম বা সিয়ামছাম পূজা:১৪ এই দেবতা ডোমদের পূর্বপুরুষ বলে অনেকে মনে করেন। কাজেই সিয়ম ছিন অনেকের কুলদেবতা। এই দেবতারও কোনো মুর্তি হয় না। বাড়ির ভেতরের আঙিনায় যে কোনো গাছের নিচে নিকানো থানে শুকনো মাটির ঢিবিতে পুজো করা হয়। পূজা শেষে দেবতার উদ্দ্যেশে শুকর বলি দেওয়া হয়। এই দেবতার পূজার সঙ্গে দারভঙ্গেও শ্যাম সিংএর পূজার মিল রয়েছে।

বাবানাথ বা বাবা পুজা:১৫ রোগ বালাই ও বিপদ আপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাবানাথের পুজা করা হয়। এই দেবতারও কোনো মূর্তি নেই। মাটির ঢিবি বা কোনো শিলাপাথরে এই দেবতার পূজা করা হয়। তবে সব ডোম এই দেবতার পূজা করেন না। ইনি যাদের কুলদেবতা তারাই এই দেবতার পূজা ঘটা করে করে থাকেন। মূলত মঘাইয়া ডোমরাই এই পূজা করে থাকেন। বাংলাদেশের সকল মঘাইয়া ডোমদের কুল দেবতা বলে বাবানাথ ঠাকুর পরিচিত। তবে উত্তরাইয়া ডোমরা বাবাওয়ালা পুজার সঙ্গেই তার পুজা করে থাকেন। সেক্ষেত্রে বাবা নাথের জন্য কোনো মন্দির তৈরি করা হয় না। বাবাওয়ালা পুজার মন্দিরের পাশে খোলা জায়গায় গোল করে নিকানো স্থানে কলাপাতা পেতে তাতে বাবাওয়ালা পুজার সকল প্রসাদ রেখে দেওয়া হয়।

কুলদেবতা:১৬এছাড়া ডোম সমাজের সদস্যদের নির্ধারিত কিছু কুলদেবতা আছে। প্রতিটি পরিবারে দুজন করে কুলদেবতা থাকেন আবার কোনো কোনো পরিবারে একজন দেবতাই কুল দেবতা হয়ে থাকেন। এই কুলদেবতার মধ্যে আছেন বাহত-কালিকা, বাহত-মহাপ্রব, পিরু-তিয়া, লুক-কালিকা, সম্মে- কলিকা ইত্যাদি। এই সব দেবতাদের কোনো মূর্তি বা আকৃতি নেই। পূজার প্রয়োজন হলে কল্পিত পাথরে বা মাটির ঢিবিতে সিঁদুরের ফোটা দিয়েই পূজা করা হয়। এই কুল দেবতা অনুসারে নির্ধারিত হয় কোন পরিবারে বিয়ে হবে বা হবে না। যেমন- ধরা যাক সুজন নামক এক যুবকের বিয়ের কথা চলছে। প্রথমেই জেনে নিতে হবে তার কুল দেবতা কে? সুজনের কুলদেবতা যদি হয় বাহত-কলিকা তবে কোনো ভাবেই একই কুলে অর্থাৎ কোনো মেয়ের কুলদেবত যদি বাহত-কলিকা হয় তবে সেখানে বিবাহ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আদিবাসী সংস্কৃতি অনুযায়ি একই কুলের ছেলে মেয়ে পরস্পর পরস্পরের ভাই বোন। কিন্তু সুজনের জন্য যদি এমন একটি মেয়ে দেকা হয় যার কুলদেবতাদের একজনের সঙ্গে মিল আছে কিন্তু অপরজনের সঙ্গে মিল নেই তবে সেখানে বিবাহ সিদ্ধ হবে। ধরা যাক মেয়েটির পরিবারের কুলদেবতা লুক-কলিকা তাহলে মেয়েটির সঙ্গে বিবাহ সিদ্ধ। মেয়েটি বিবাহের আগে পিতৃকুলের দেবতার পূজা করতে পারলেও বিয়ের পরে সে স্বামীর কুলের অধীন হয়ে যায় । ফলে সে পিতৃকুলদেবতার পূজা করার অধিকার হারায়। তবে পুরুষটি বিয়ের পরে শ্বশুড় বাড়ির কুলদেবতার পূজাসহ সকল ধরনের আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নিতে পারে। ডোম সমাজের এই রীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে অতীতে তারা মাতৃপ্রধান পরিবারেরই সদস্য ছিল।

লুক-কালিকার পূজা:১৭ লুক-কালিকা বাঁশফোর ডোমদের কুল দেবতা। তিনি মূলত দেবী। এই পূজা যে কোনো মাসের পূর্ণিমা তিথিতেই করা যায়। কুলদেবতার পূজায় পিতৃবংশীয় সকল ব্যক্তির উপস্থিতি দরকার হয়। সাধারণত কোনো পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু করতে হলে কুল দেবতার পূজা করে শুরু করতে হয়। লুক-কালিকার পূজায় এমন একটি মাদী শুকর দরকার যেটি এখনো বাচ্চা প্রসব করেনি। শুকরটি হতে হবে কালো রঙের। কোনো স্পট বা কালো রঙের মধ্যে কোনো সাদা রঙ কিংবা অন্য কোনো রঙ থাকলে তা পূজায় ব্যবহার করা যাবে না। এর সঙ্গে একটি যে কোনো রঙের একটি পুরুষ শুকরও রাখা হয়। পূজার সকল আয়োজন করবে পরিবারের নতুন বৌ। রাতে দরজার সামনে উঠোনে নির্দিষ্ট জায়গা নিকানো হয়। কলাগাছের ডোগা ছিঁড়ে তা দিয়ে জবা ফুলের মালা তৈরি করা হয়। ধুপ দিয়ে আরতি করার পর জল ছিটিয়ে শুকর দুটিকে পবিত্র করার পর জবাফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর একটি পাত্রে অচ্ছত রাখা হয়। অচ্ছত হচ্ছে আতপ চাল, লবণ, মদ দিয়ে তৈরি এক প্রকার মিশ্রণ। এই অচ্ছত মাদী শুকরকে খাওয়ানোর পর শুকর ছানাটি জবাই করে ধর থেকে মাথাটি আলাদা করা হয় এবং নিকানো থানে মাথাটি রেখে পুনরায় ধুপ দিয়ে জল ছিটিয়ে অচ্ছত খাওয়ানো হয়। এরপর এর রক্ত নিয়ে সকলে কপালে তিলকের ফোটার মতো ফোটা দেয়। কাটা মাথাটি নিয়ে যাওয়া হয় ঘরে। ঘরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যেখানে দেবতার আসন পাতা থাকে উঁচু মাটির ঢিবির মতো তাকে বলা হয় দেউকুড়ি। এই দেউকুড়ির সামনে কাটা মাথাটি রেখে পুনরায় পূজা করা হয় এবং অচ্ছত খাওয়ানো হয়। অন্যদিকে মাদী শুকরের মাংস শুধু মাত্র পিতৃবংশের সকলের জন্য রান্না করা হয়। এই মাংস পিতৃকুলের লোক ব্যতীত কারো খাওয়া বারন তবে এই মাংস পরিবারের বিবাহিত মেয়ে খেতে পারবে না কিন্তু মেয়ের জামাই খেতে পারবে। পরিবারের মেয়ে যার অন্যত্র বিয়ে হয়েছে এবং অন্যান্য প্রতিবেশীর জন্য রান্না করা হয় পুরুষ শুকরটি। এই ধরণের মাংসকে পূজার প্রসাদ বলা হয়।

সর্প পূজা:১৮ হিন্দুধর্মেও প্রচলিত নিয়মে ডোমরা সর্পপূজা করে না। হিন্দুদের মতো মূর্তিও ব্যবহার নেই এমন কি কোনো ঘটে বা পটেও পূজা হয় না। তারা শ্রাবণ মাসের নাগপঞ্চমীর আগের দিন বাড়ি ঘর পরিস্কার করে। নাগপঞ্চমীর দিন সকালে যে গাভী বাচ্চা দেয়নি এমন গাভীর গোবর সংগ্রহ করে। সেই গোবর পানিতে গুলে ঘরের বাইরের চার দেওয়ালে বন্ধনী দেয়। এরপর প্রধান দরজার ওপরের দেওয়ালে চর্তুভূজ এঁকে তার ভেতরে কোনাকুনি ক্রস চিহ্ন দেওয়া হয়। চতুর্ভূজের চার কোণে চারটি ফোটা এবং মাঝখানে একটি ফোটা দেওয়ার পরে এর নিচে দুটো জোড়া সাপের চিত্র আঁকা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই চিহ্ন দেখে সর্পদেবতা পরিবারের কোনো সদস্যের ক্ষতি করবে না। এরপর কাঁঠাল পাতায় করে খানিকটা দুধ ও খই বাড়ির আশেপাশে রেখে আসা হয়। শ্রাবণ মাসব্যপী কোনো ডোম দুধ, পায়েস, শাক, মুড়ি,খই, এগুলো খাবে না। মনে করা হয় এগুলো সাপের খাবার।বাঁশফোর ডোমগণ এই পূজা করতো। বর্তমানে এই প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাইরি পূজা:১৯ একে গ্রাম পূজাও বলা হয়। এই পূজার দেবতাও নিরাকার তবে পাথরেও এই পূজা হয়ে থাকে। যে কোনো মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই পূজা হতে পারে। গ্রামের মঙ্গলের জন্য গ্রামের পুরুষের বছরে একদিন চাঁদা তুলে গ্রামের বাইরে খোলা মাঠের মধ্যে এই পূজা করে থাকে। এই পূজায় জবা ফুল, মদ ও শুকর দরকার হয়। এ পূজায় নারীরা অংশ গ্রহণ করতে পারে না।

ডি-সার:২০ ডি-সার মূলত পুরুষ দেবতা। এই দেবতা মূলত ডোমদের বসতি অঞ্চলকে রক্ষা করেন এবং তাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন। এক সময় যখন ডোমরা বনে জঙ্গলে বাস করতো তখন তারা নিরাপত্তার জন্য এই দেবতার পূজা করতো। এই দেবতার পূজা যে কোনো মাসের পূর্ণিমা তিথিতে করা হয়। পূজায় জবা ফুল, মদ ও শুকর দরকার হয়।

কালী পূজা:২১ কালী হচ্ছে ডোমদের আদি দেবতা। কোথাও কোথাও মূর্তি দেখা গেলেও ডোমরা আদিতে কখনো মূর্তির পূজা করেনি। আশ্বিন মাসের অমাবস্যার পরে চাঁদের বয়স যখন তেরো দিন তখন প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবীকে আহ্বান করা হয়। কুষ্টিয়ার খোকসা জানিপুর বাজারের কালী মন্দিরে বড় অনুষ্ঠান হয়। সেখানে মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার আগে অমাবস্যায় কালী পূজা করা হয়। কালী পূজা শুরুর আগে সেখানে হিরাউন ডোমের পূজা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে সেখানে প্রায় দুইশো বছর আগে হিরাউন ডোম নামে একজন প্রথম কালী পূজা শুরু করেন। তাই তার স্মরণার্থে কালীপূজা শুরুর আগে তার পূজা করা হয়। এই পূজায় হিন্দুদের উপস্থিতি থাকলেও ডোমদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

ভাঁজই কুমারী:২২ বীরভূমের দুবরাপুর থানায় জামথলি গ্রামে ডোম সম্প্রদায় বরাহ দ্বাদশীতে মুরগী ও পাঠা বলি সহ ভাজই কুমারীর পুজা দেন।

মহাদানা দানা চোরদানা:২৩
বীরভূমে এই দেবতা সাপের রূপ ধরে ঘুরে বেড়ান বলে মনে করা হয়। সেখানকার ডোম সম্প্রদায় মুরগী বলি দিয়ে এই দেবতার পুজা করে থাকে।

কালুবীরের পুজা:২৪
বীরভূমে ইসলামবাজারের জয়দেব কেন্দুবিল্বেও পূর্ব দিকে ‘লাউসেন তলায়’ ডোমরা তেরোই বৈশাখ কালু বীরের পূজা দিয়ে থাকে। কালুবীর মুলত ধর্মমঙ্গলের বিখ্যাত কালু ডোম যে লাইসেনের সেনাপতি ছিল। এছাড়া বাকুড়ায়ও কালু ডোমের পুজা হয়। বারানসির শ্মশান ঘাটে মৃত দেহ পোড়ানোর আগে সেখানকার ডোমরা কালু ডোমের পূজা দিয়ে থাকে।

খার্মা গিরদার পুজা:২৫
খার্ম গিরদর মূলত মা গেহিল পুজার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হয়। ঘরের মধ্যে সিরা বা সিরকির স্থানে এই পূজা হয়ে থাকে। ডোমদের যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু, বাচ্চার অন্নপ্রাশনের সময় এই পূজা বাধ্যতা মূলক। মা গেহিল পুজার পরে খারমা গিদারের উদ্দ্যেশে দুটি বাচ্চা শুকর ঘরের দরজার সামনে মারা হয় বা চড়ানো হয়। শুকর ছানাটিকে মারার আগে তাকে গোসল করানো হয় তারপর তাকে গুর,চাল ও ফুল খেতে দওয়া হয়। যদি শুকর ছানাটি খাবার খায় তবে বুঝতে হবে দেবতা তুষ্ট হয়েছেন এবং এরপরেই শুকরটিকে চড়ানো হয় খারমা গিদরের নামে। মূলত অপ শক্তির হাত থেকে বাঁচতে এই পূজা দেওয়া হয়।

মা কবুত্রা পুজা:২৬
মূলত মা গেহিল পুজার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হয় মা কবুত্রার পুজা। ইনি দেবতা না কি দেবী তা বলতে পারেন না কেউ। জানতে চাইলে তারা বলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা এর পুজা করে আসছেন তাই আমরাও করি। ঘরের মধ্যে সিরা বা সিরকির স্থানে এই পূজা হয়ে থাকে। ডোমদের যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু, বাচ্চার অন্নপ্রাশনের সময় এই পূজা বাধ্যতা মূলক। এই পূজার জন্য দুটো সাদা কবুতর দরকার হয়। কবুতর দুটোকে তারা চাল, গুর ও ফুল খেতে দেয়। খাওয়া শেষ হলে এই দুটি কবুতর জবাই করা হয়।

নিরঞ্জন বাবার পুজা:২৭
মা গেহিল পূজার সময় সিরার কাছেই এই পূজা হয়ে থাকে।মা গেহিল পূজার সময় মাটির ঢাকনায় দুধ ও গুর আলাদা করে রাখা হয় মুলত নিরঞ্জন বাবার উদ্দেশ্যে। পূজা শেষ হলে পূজারি পুকুরে গিয়ে বুক জলে নেমে মাটির ঢাকনায় রাখা দুধ ও গুর জলে ঢেলে দেবেন। এর উদ্দেশ্যে কোনো শুকর চরানো হয় না।

বাবা দিননাথ:২৮
বাবা দিননাথ মুলত পুরুষ দেবতা। তিনি সূর্য দেবের পিতা বলে পরিচিত। বাবাওয়ালা পুজার সময় যে বাবানাথের পুজা করা হয় অনেকে তাকে সূর্যেও পিতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। উত্তরাইয়া ডোমরা যখন ষট্ পূজা করেন তখন বাবা দিননাথের পূজা করা হয়। ষট্ পুজার আগে ডোমরা পটল, আলু, ধুন্দল ও করলার নিরামিষ খাওয়া শুরু করেন মুলত দিননাথ দেবতাকে তুষ্ট করতে। এই সময় ডোমদের কচুর মুখি, বরবটি, শাক, মুলা, বেগুন, লাউ খাওয়া নিষেধ। নিরামিষ খাওয়ার দিন বাড়ির সকল জিনিস ও আসবাব পত্র ধোয়া হয় এবং নিরামিষ রান্না করা হয়। নিরামিষ খাওয়ার পর বাড়ির একজন বা দুইজন দিননাথের উদ্দেশ্যে উপবাস থাকেন। এই উপোস ভাঙ্গা হয় লাউ ভাজি, লাউয়ের ডাল, তেঁতুল ধনেপাতার চাটনি দিয়ে। উপোস ভাঙ্গার আগে যে পূজা করবেন তিনি স্নান করে পবিত্র হবেন এবং একঘটি জল এনে ঘরে দেবতার আসনে রাখবেন। অসনে কোনো মুর্তি বা পাথর থাকে না। সেখানে লাউ ভাজি, লাউয়ের ডাল, তেঁতুল ধনেপাতার চাটনি, রঙ চা দিয়ে প্রসাদ দেওয়া হয়। পূজা শেষে পূজারি সেখান থেকে খাবার মুখে তুলে নেবেন এবং উপবাস ভাঙবেন। এই সময় প্রসাদ হিসেবে কলাপাতায় যে তিনমুঠো ভাত দেওয়া হয় তার একটি দিননাথের উদ্দেশ্যে রাখা হয়।
মা সত্ততেনি:২৯
ইনি মুলত দেবী। ছট্ পূজার সময় বাবা দিননাথ ও পুত্র সূর্যের সঙ্গে ইনিও পূজা পেয়ে থাকেন। ডোমরা মা সত্ততেনিকে সূর্যের মাতা ও দিননাথের স্ত্রী বলে বিশ্বাস করে থাকে। যে আসনে দিননাথের পূজা হয় সেই একই আসনে সত্ততেনির পুজা হয়ে থাকে। পূজারি প্রসাদ হিসেবে কলাপাতায় তার উদ্দেশ্যে একমুঠো ভাত, লাউ ভাজি, লাউয়ের ডার, চাটনি ও রঙ চা দিয়ে থাকে। বাবা দিননানাথ ও মা সত্ততেনির পূজা আলাদা ভাবে করা হয় না। ছট্ পুজার সময় তাদের পূজা করা হয়। অনেক ডোমরা ছট্ পুজার সময় প্রসাদ গুলোকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে পূজা দেয় কিন্তু অনেকই এর কারণ বলতে পারেন না। তারা মনে করেন এই তিন ভাগ করে তারা ছট্ দেবতার পূজাই করেন আসলে বিষয়টি তা নয়। তিনজন দেবতার উদ্দেশ্যেই এই প্রসাদ আলাদা আলাদা ভাবে উৎসর্গ করা হয় আর তারা হলেন ছট্ দেবতা, বাবা দিননাথ, ও মা সত্ততেনি।

নাওমি পুজা:৩০
জৈষ্ঠ্যমাসের মঙ্গলবার নওমি পুজা হয়। পুজার আগের নয়দিন ডোমরা মাছ মাংস খায় না, তেল সাবান ব্যবহার করে না। দশম দিনে  স্নান সেরে ঘরের দুয়ারে নিকানো হয়। সেখানে সরিষার তেল, হলুদ, ৭টি রুটি, ৭টি শসা, পান, সুপারি, কলা একটা কলাপাতায় ভোগ দেওয়া হয়। তার আগে সব উপকরণে সিঁদুরের তিলক দেওয়া হয়। এরপর ধুপ দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়। এরপর একটি শুকর মারা হয় এবং এর মাথা এখানে রেখে ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় আর বাটির সরিষার তেল নিয়ে উপস্থিত সকলকে দেওয়া হয় এবং হলুদের টিপ দেওয়া হয়। এ সময় ডোম নারীরা নওমি মায়ের গান গেয়ে থাকেন।

শীতলা পূজা:৩১
ফালল্গুন মাসে এই পূজা করা হয়। ডোমদের এই পূজায় কোনো দেবীমূর্তি নেই। তারা বিশ্বাস করে মা কালীরা সাত বোন। এই সাত বোনের একজন হচ্ছে শীতলা। কিন্তু পূজার সময় শুধু শীতলার উদ্দেশ্যেই পূজা হয় এমন নয়। সাত বোনের উদ্দেশ্যেই ভোগ দেওয়া হয় সাতটি পিন্ড। যশোর পুরানো পৌরসভা এলাকার ডোম পাড়ায় সাতটি সূচালো পাথর রাখা আছে যাকে শীতলার থান বলা হয়। সাধারণত নিম গাছের নিচেই হয় তার থান। উত্তরাইয়ারা শীতলা পূজা উপলক্ষ্যে পাড়ার মহিলারা মিলে পূজার দিন ধার্য করার পাশাপাশি সকলের কাছ থেকে নির্ধারিত চাঁদা তোলে। মঙ্গলবার অর্থাৎ পূজার আগে তারা নিরামিষ খান কেউ তিন দিন, কেউ আড়াই দিন কেউবা সাত দিন। এ সময় তারা ভিক্ষা চাইতে নামেন পূজার জন্য। ভিক্ষার চাল আর টাকা এক জায়গায় জমা করা হয় এবং সোমবার সবাইকে ডেকে সব কিছুর হিসাব করে একজনকে বাজারে পাঠানো হয়। পূজার দিন শীতলা মায়ের ভক্ত নিরামিষ খান। এই দিন তিনি পূজার সমস্ত আয়োজন করেন। তিনি এক ঘটি জল, ধুপ, লং, এলাচি সন্দেশ ভোগ হিসেবে রাখেন। মাটি বা কাসার পাত্রে জল রাখেন। এই সময় ঢোল বাজে এবং গান হয়। এই সময় শীতলা মায়ের ভক্তের সঙ্গে উপস্থিত নারী কুল নয়টা বা সাতটা দেশওয়ালী ভাষায় অর্থাৎ ডোমাই ভাষায় গান গায়। এই গানের মধ্যেই পূজারি ভার আসেন। বিশ্বাস করা হয় যে যদি দেবী পূজায় সন্তুষ্ট হন তবে পূজারি ভক্ত ভার আসবে এবং ভার অবস্থায় তিনি যে নির্দেশ দেবেন সেই মতো দেবীর পূজা অর্চনা করা হবে। এরপর দিন দুধ, ডাব, মিসরি, তুলসি পাতা সোনা রূপার জল দিয়ে সাতটি পিন্ডকে স্নান করানো হয়। এরপর চিনি দুধ ঘি দিয়ে আটা মাখিয়ে সাতটি ধোকলা বানানো হয় এবং চৌদ্দটি লুচি তৈরি করা হয়। রান্না করা হয় পায়েস। এরপর একটি লুচির ওপর একটি ধোকলা ও একটু পায়েস রেখে এর ওপর আর একটি লুচি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এর সঙ্গে থাকে সিঁদুর দেওয়া সাতটি পান, সাতটি সুপারি সাতটি বাতাসা, সাতটি ঠুঁটো কলা। এই ভোগ দেবীর থানে নিবেদন করা হয়। নিবেদনের সময় ঘন্টা বাজে। তারপর সাতজন বিবাহিত নারী দেবীকে অঞ্জলি দেয়। এই সময় উপস্থিত নারীদের মধ্য থেকে পাঁচজন আবার গান গেয়ে থাকে এবং এই গানের সময় পূজারি ফের ভার আসে । এই ভারে বসা অবস্থায় তিনি অসুস্থদের রোগ বালাই সারার নিদান দেন, অসুস্থদের ঝাড় ফুঁ দেন, পানি পড়া দেন এবং অনবরত মায়ের থানে আরতি করতে থাকেন। এভাবেই শেষ হয় ডোমদের শীতলা পূজা।

ধর্মঠাকুরের পুজা:৩২
বীরভূমে ডোম সম্প্রদায় বৈশাখি পূর্ণিমায় ধর্মঠাকুরের পূজা করে থাকে। সেখানে ধর্মের আসনে পাথর রেখে পূজা করা হয়। কোথাও কচ্ছপের আকৃতির পাথর যাকে কুর্ম বলে তাকে ধর্মঠাকুর হিসেবেও পুজা করা হয়। ডোমরাই এই সব পুজার পৌরোহিত্য করেন। ধর্মঠাকুরের উদ্দেশ্যে এসময় মুরগী ও শুকর বলি দেওয়া হয়।

নৃবিজ্ঞানীরা জানান অস্ট্রিকভাষীরা বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ, পাথর, পাহাড়, ফলমূল, ফুল কোনও বিশেষ স্থান, বিশেষ বিশেষ পশু, পক্ষী ইত্যাদির উপর দেবত্ব আরোপ করে তার পূজা করত।৩৩

এসব বিশেষ বিশেষ পূজা ছাড়াও উত্তরাইয়া ডোমদের মধ্যে পরগণা ভিত্তিক পূজার কিছু আচারানুষ্ঠানে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে উত্তরাইয়া ডোমদের যে সব ভাগে ভাগ করা হয় সেইগুলোকে তারা পরগণা বলে থাকে। বাংলাদেশে উত্তরাইয়া ডোমরা নয়টি পরগণায় বিভক্ত। মূলত আচারানুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্য দিয়ে এদের চেনা যায়। এরা হলেন-

বাইশ ভগিয়া:৩৪  এরা পূজায় লেবু ডিম, ভেড়া, পাঠা ইত্যাদি বাইশ রকম উপাচারে সিরা পূজা বা মা গেহিলের পূজা করে থাকে। পূজা শেষ হলে পূজার উপকরণগুলো ঘরের মধ্যে গর্ত করে মাটির নিচে পূতে রাখে। সিরাজগঞ্জ হরিজন কলোনীতে ১২ ঘর বাইশ ভগিয়া পরগণার উত্তরাইয়া ডোম আছে।

ইংলিশিয়া:৩৫ এরা ঘরে সিরকির স্থানে শুকর বলি দেয়। কবুতর, গুর, প্রভৃতি পূজার উপকরণ বাইশ ভগিয়াদের মতো ঘরে পূতে রাখে না বরং তারা তা জলে ফেলে দেয়। পূজায় মারা শুকর বা কবুতরের মাংস ঘর বা ঘরের বাইরে সকলে খেতে পারে। যশোর ও মণিহার সিনেমা হলের কাছে ঢাকায় ইংলিশিয়া উত্তরাইয়া ডোম রয়েছে।

ডাকনা:৩৬ এরা মুলত দক্ষিণা নামে পরিচিত। সিরা পূজা ব্যতিত সকল পূজার আসন ঘরের বাইরে উঠানে হয়ে থাকে। পান, সুপারি, লাড্ডু, ফুল দিয়ে পূজা হয় এবং পূজা শেষে শুকর মারা হয় ছেলে মেয়ে হলে তারা সিরা পূজা করে না এ সময় তার মোরগ কাটে। যশোরে এদের ৬টি পরিবার আছে।

সারিদার:৩৭ এরা মূলত পঞ্চায়েত বিচারকের দন্ড বিধান অনুযায়ী যারা অপরাধিকে শাস্তি প্রদান করতো তাদের সম্প্রদায়কে সারিদার বলা হয়। মণিহার সিনেমা হলের কাছে এদের ৪টি পরিবার আছে।

মলকি বলিয়া:৩৮ এরা ইংলিশিয়াদের মতো সকল পূজাই করে তবে শুধুমাত্র কবুত্রা পূজা করে না। মা গেহিলের পূজায় নিয়ম মেনেই শূকর মারে। যশোরে মোট দশটি পরিবার আছে মলকি বলিয়াদের।

গিয়াসপুরী:৩৯ এরা সন্তান জন্মেও এক দেড়মাস পর গাহিল পূজা করে। কবুত্রা পূজা করে না। এদের সিরা বা মন্দির ঘরেই থাকে। যশোরে ২ ঘর গিয়াসপুরী উত্তরাইয়া ডোমাই আছে।

এছাড়া আছে ভাত বরিয়া, পাঁচ মল মলকি, ও সারাইসা ডোম। এরা উত্তরাইয়াদের আলাদা আলাদা দুটি পরগণা। যশোরে তিন ঘর পাঁচ মলমলকি এবং একটি পরিবার আসে সারাইসা এদের সকলের পূজা পদ্ধতি কিঞ্চিৎ হলেও অন্যদের থেকে আলাদা। সারাইসারা সিরার স্থানে ভেড়া বলি দেয়। এর চামরা, পা ও মাথা ঘরে গর্ত করে পূতে দেয়। শুধু বিয়ের দিন সিরা পূজা করে।

এখনও খাসিয়া, মুন্ডা, সাঁওতাল, শবর ইত্যাদি কোমের লোকেরা এমনটা করে থাকে। একই ভাবে ডোম জাতির মানুষও নিম গাছ ও বট গাছকেও দেবতা জ্ঞানে মান্য করে,নিরাকার শক্তির পূজা করতে গিয়েও তারা কখনো কখনো পাথরের পূজা করে থাকে বা মাটির ঢিবি দিয়ে তৈরি দেবতার পূজা করে থাকে।। তারা নিম গাছকে শিতলা দেবী ও বট গাছকে শিব জ্ঞানে পূজা করে থাকেন। প্রায় সকল ডোম পাড়ায় বট কিংবা নিম গাছ দেখতে পাওয়া যাবে। চৈত্র ও বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের নবম দিনে নিমগাছে লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হয়। উড়ানো হয় লাল নিশান। থানে দেওয়া হয় পুরি, পায়েস, ফল, মধু ও কর্পূর। সাধারণত মহিলারাই এই পূজা করে থাকেন। রোগ বলাই থেকে বাঁচতে এই পূজার আয়োজন করা হয়। এসময় মহিলারা শীতলা দেবীর উদ্দেশ্যে গান গেয়ে থাকেন। অন্য দিকে শ্রাবণ মাস জুড়েই চলে শিব পূজা। শিব পূজার জন্য ডোমদের নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ লাগে না। বটগাছের নিচের থানে ধুপ দীপ জ্বেলে জবা অথবা ধুতরা ফুল দিয়ে পূজা করা হয়। থানে রাখা হয় ত্রিশূল, একখন্ড পাথর আর শঙ্খ। এছাড়া ‘আমাদের নানা আচারানুষ্ঠানে, ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, ধানের গুচ্ছ, দূর্বা, কলা, হলুদ, সুপারি, নারিকেল, পান, সিন্দুর, কলাগাছ প্রভৃতি অনেকখানি স্থান জুড়ে আছে। এর প্রতিটিই অস্ট্রিক ভাষাভাষীজনদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ।’৪০ সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে ডোম জাতিতে ধর্মীয়, সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত সকল উপকরণ অষ্ট্রিক ভাষী জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই সাদৃশ্য পূর্ণ। তাছাড়া নৃবিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন যে, মাতৃদেবীর পূজা ও সূর্যপূজার কারণ যুক্ত হয়েছে ভূমিচাষের সঙ্গে। প্রাচীন বঙ্গ দেশে মাতৃকা দেবীর পূজার সঙ্গে সূর্যের সম্পর্ক লক্ষ করা যায়।৪১ বলা হয়ে থাকে সিন্ধু উপতক্যায় মাতৃদেবী ও সূর্য পূজার প্রচলন ছিল। বর্তমানে যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায় পুরুষ মূর্তি তৈরি করে সূর্যপূজা করে থাকে। এই প্রকার পূজা বৈদিক আর্যদের সংস্কৃতি।৪২ তবে নৃবিজ্ঞানীগণ জানান নবোপলীয় যুগে কৃষি কাজের সঙ্গে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন শুরু হয় আর সেইযুগে আর্যদের মতো পুরুষ মূর্তিতে সূর্য পূজা করা হতো না, তিনি নিরাকার দেবতা হিসেবেই অনার্যের মাধ্যমে পূজিত হতেন। ডোমদের ছট্ বা সূর্য পূজাও তেমন ভাবে করা হয়ে থাকে। পূজার উপকরণগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এগুলো সম্পূর্ণ একটি বাঙালি কৃষক পরিবারে ব্যবহৃত উপকরণ। শুধু তাই নয়, ডোম সমাজে সূর্যের পাশাপাশি খান্না দেবীর পূজাও হয়ে থাকে যিনি কিনা একজন মাতৃকা দেবী। এই ‘খান্না’ দেবী সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা যায় যে তিনি ডোমদের আদি মাতৃকা দেবী যিনি এখনও নিরাকার দেবী হিসেবে পূজিত হন। প্রগার্য যুগে বঙ্গের মানুষ জনই যে শুধু মাতৃদেবীর পূজা করতেন এমন নয়। সুমের অঞ্চলে যে মাতৃ দেবীর পূজা হত তার নামছিল ‘ এ-নান্না’।৪১ কে বলতে পারে এই দেবী ই এখানে বিবর্তীত হয়ে ‘খান্না’ দেবী হয়ে উঠেছেন কি না!

তবে আধুনিক যুগে এসব আচার অনুষ্ঠান শিক্ষিত ও শহরের মানুষ খুব বেশি পালন না করলেও সামাজিক ভাবে মফস্বলে এর প্রচলন বেশি। ডোম সমাজের মানুষ নিজেদের দেবতার পাশাপাশি হিন্দুদের লক্ষ্মী, কালী, শিব, দূর্গা প্রভৃতি দেব-দেবীকে মান্য করে।বর্তমানে এই সব পূজা অর্চনায়ও অনেকে ভক্তি সহকারে অংশগ্রহণ করে।

তথ্যসূত্র
১. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, দেশ পালিশিং হাউস, কলকাতা- ৭ম সং. ১৪১৬, পৃ: ৫৪-৫৫।
২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৫৬।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ:৫৬।
৪. অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালীর সমাজ ও সংস্কৃতি, সাহিত্যালোক, কলকাতা-২০০৮, পৃ: ৩৩।
৫. H.H Resly, The Tribes and Castes of Bengale: Ethnographic- vol-1, পৃ: ২৪৫।
৬. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৪৭।
৭. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৪৭।
৮. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৪৭।
৯. প্রাগুক্ত, পৃ: ২৪৭।
১০. বিমল ডোম, বাবা: সুবলাাল ডোম, মাতা: সীতারানী ডোম, শ্যামপুর, পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট ডোম কলোনী। সাক্ষাৎকারের তারিখ: ২৭শে মে,২০২২ এবং দিলীপ কুমার ডোম, পিতা: গনেশ ডোম, মাতা: শ্রীমতি দিপালী ডোম, রাঙামাটি, জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যারয়, সাভার ঢাকা। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: ১৭ই মে, ২০২২।
১১. প্রাগুক্ত।
১২. রাজালাল ডোম, পিতা: শ্রীদুলাল ডোম, রাঙামাটি, জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যারয়, সাভার ঢাকা। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: ১৭ই মে, ২০২২। এবং নরেশ বাশফোড়, পিতা : পরমেশ^ও বাঁশফোড়, মাতা: ভগবানীয়া, রূপালী হাউজিং, রোড ৩, কমার্স কলেজ, মিরপুর -১। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: ২০ সেপ্টেম্বও ২০২১।
১৩. প্রাগুক্ত।
১৪. প্রাগুক্ত।
১৫. প্রাগুক্ত।
১৬. পান্না লাল বাঁশফোর, পিতা: গণেশচন্দ্র বাঁশফোড়, গ্রাম: শেরকান্দি, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। সাক্ষাৎকার গ্রহণ: স্থান:Ñ মিরপুর-১ সুইপার কলোনী, এবং নরেশ বাশফোড়, পিতা : পরমেশ^ও বাঁশফোড়, মাতা: ভগবানীয়া, রূপালী হাউজিং, রোড ৩, কমার্স কলেজ, মিরপুর -১। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ ও সময়:- বিকাল ৪টা, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১।
১৭. পান্না লাল বাঁশফোর, পিতা: গণেশচন্দ্র বাঁশফোড়, গ্রাম: শেরকান্দি, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। সাক্ষাৎকার গ্রহণ: স্থান:Ñ মিরপুর-১ সুইপার কলোনী।
১৮. প্রাগুক্ত।
১৯. প্রাগুক্ত।
২০. প্রাগুক্ত।
২১. প্রাগুক্ত।
২২. অমলেন্দু মিত্র, রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর, ফার্মা কে এল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১৯৫৭, পৃ: ৩২।
২৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ৩৩।
২৪. প্রাগুক্ত, পৃ: ১২৩।
২৫. সুখিয়া রাণী ডোম, পিতা: ভোলুয়া ডোম মা:দূর্গা ডোম, ঠিকানা : পুরাতন পৌরসভা, হরিজন কলোনী, (ডোম পাড়া), যশোর। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ ও সময় : ২৬শে আগস্ট, ২০২৩, বিকাল ৪টা।
২৬. প্রাগুক্ত।
২৭. প্রাগুক্ত।
২৮. প্রাগুক্ত।
২৯. প্রাগুক্ত।
৩০. প্রাগুক্ত।
৩১. প্রাগুক্ত।
৩২. অমলেন্দু মিত্র, রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর, ফার্মা কে এল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১৯৫৭, পৃ: ৩২।
৩৩. নীহার রঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস, দেশ পালিশিং হাউস, কলকাতা- ৭ম সং. ১৪১৬, পৃ: ৫৫ ।
৩৪. সুখিয়া রাণী ডোম, প্রাগুক্ত।
৩৫. প্রাগুক্ত।
৩৬. প্রাগুক্ত।
৩৭. প্রাগুক্ত।
৩৮. প্রাগুক্ত।
৩৯. প্রাগুক্ত।
৪০. অতুল সুর, বাঙলা ও বাঙালির বিবর্তন, সাহিত্যালোক, কলকাতা-২০০৮, পৃ: ৮৫।
৪১. অতুল সুর, বারতের নৃতাত্তি¡ক পরিচয, সাহিত্যলোক, কোলকাতা- ২০০৮, পৃ: ৪৮।
৪২. প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৩।
৪৩. প্রাগুক্ত, পৃ: ৪৩।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত