| 6 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গদ্য: তৃণার তৃতীয় বাড়িটা । শংকর লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 29 মিনিট

সে-পাখিডাকে না কেন?কাল কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। হয়তো রাতের গভীরেও ছিল কিছু শব্দহীন ঝিরিঝিরি। আজ ভোরের আচ্ছন্ন হিম হিম আবেশে শ্রাবণ যখন শেষ হ’তে আর দেরি নেই, তখন সে হঠাৎই কোন আড়াল থেকে জানান দিলসে আছে। আমি ভাবতাম, সে-পাখি ডাকে না কেন? কোথায় সে থাকেসারাটা বছর? কেমনে, কোন ঘুমঘোরে,এই মৌনতা তার রাত্রিদিন! সে কি দুঃখে, বিষাদে, ধিক্কারে, শোকে–নাকি আনন্দে বিহ্বল হ’য়ে আপন মনেই তার ওড়াউড়ি। পাতায়, ডালে, আকাশের অলিন্দে ;নিশ্চুপ, সুরহীন, বোবা, ব্যতিক্রমী। সে কি তবে শুধুই বসন্তের? আজ সকালবেলারবৃষ্টিভেজা ক্ষয়াটে লাল ইঁটের ওপরে যখন সবুজ মস ও ছত্রাকের মসলিন চাদরটা সবে বিছানো হয়েছে, তখনসহসা ডাক দিয়েছে সেইপাখি।নগরীর প্রসন্ন চলমানতাকেথমকে দিয়ে, বাতাসকে শিহরিত ক’রে, শববাহকের পায়ে বিষধর টরানটুলার স্পর্শের মতো চমক এনে। আমার জানালার কাছেই কোথাও, সে কোকিল।

তিন্নিও কোকিলকন্ঠী। তিন্নি অথবা, তৃণা, যে নামেই ডাকি না তাকে। বিশেষতঃ সে যখন উঁচু ডাল থেকে ডাক দেয়, চারতলার জানালা দিয়ে। পথচারীদের চকিত চাহনি ঊর্ধ্বপানে, গুলমোহর গাছের ফুলের গভীরে, পাতার আড়ালে। অলস বিষণ্ণ দুপুর সহসা ঝমঝম ক’রে ওঠে সেইসুরেলা ঝঙ্কারে।

কবে একবার সিকিমে, গ্যাংটক থেকে ছাঙ্গু লেক যাওয়ার পথে, আমরা দাঁড়িয়েছিলাম একটা পাহাড়ি ঝর্নার ধারে,অবিরাম জলশব্দে। কুয়াশায় সিক্ত সেই রূপসী ও আমি।তার দুই করতল ছিল বিস্মিত হওয়ার মতো গাঢ় গোলাপী, ফ্যুশিয়া, রক্তিম।তার ঠোঁটের হাল্কা পাউট, আই-লাইনার, ফেডেড-ব্লু জিন্স, তসর সিল্কেরশর্ট-স্লিভ টপ, পায়ের আঙুলে রূপোর চুটকি।সহসা মেঘের ভাঁজ খুলে নরম রোদের কয়েকটা আঙুলনেমে এসে ছুঁয়েছিল তার রেশমী চুল, তার উন্মুক্ত কেশদাম। আমার মনে পড়েছিল এলিয়টের ‘লা ফিলিয়া কে পিয়ঞ্জে’-কবিতারসেই তরুণীর কথা। এলিয়ট লিখেছেন: ‘Weave, weave the sunlight in your hair– / Clasp your flowers to you with a pained surprise—’।

তৃণার হাতে তো কোনো ফুলের গুচ্ছ ছিল না, তার দুই করতল ন্যস্ত ছিল তারই জলসিক্ত উন্নত দুই বুকে। ক্রমে আমি লক্ষ করি গাছপালার ফাঁক দিয়ে নেমে আসা নরম রোদের তুলি কিছু একটা আঁকছে তার শরীরে, জলবাস্প জড়িয়ে রয়েছে যে শরীর। সহসা সে তার দুবাহু দুপাশে ছড়িয়ে,পাহাড়, সড়ক, বৃক্ষ, অর্কিডের ফুল, দুটো চমরি গাই, এবং আমাকে ও পাহাড়ি ঝর্নাকে শুনিয়ে গেয়ে উঠলো—‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই / আলোর মতন, হাসির মতন / কুসুমগন্ধরাশির মতন / হাওয়ার মতন, নেশার মতন / ঢেউয়ের মতন এসে যাই’। শতজলঝর্নার ধ্বনির সাথে ভেসে গিয়েছিল তার কন্ঠস্বর।

সেই প্রথম আমি তাকে গাইতে শুনেছিলাম। সেই প্রথম আমাকে হাওয়া, জল, আলো, হাসি, সুর ও কুসুমরাশি একত্রে জড়িয়ে ধরেছে। সেদিন সারা বাগান জুড়ে শুধু অর্কিডের ফুলের সমারোহ। যেন জান্নাতুল ফেরদৌসে ফুলের উৎসব। অর্কিডের ফুল থেকে জলকণারা টুপ টুপ ঝ’রে পড়ছিল। সেদিন তৃণার অভিযোগ–অনুমতি না নিয়েই আমি তার জলসিক্ত ছবি তুলেছি। -কিন্তু আমি তো অর্কিডের ফুলেরও অনুমতি নিইনি। বলিনি তো, অর্কিডের ফুল, আমি তোমার ছবি নিতে চাই। তৃণা বললো, ফুল তো কথা বলতে পারে না। আমি বললাম, কিন্তু তারা তো আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।

প্রান্তরের কুয়াশায় একলা একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। বহুদূর থেকে বোঝা যায় না কাক, না কোকিল। না ডাকলে কিছুতেই তো বোঝা যায় না কাউকে। সম্ভবই নয়। সেই কবে যেন, কাকে যেন, ‘কে এক রূপসী এসে ডাকিল আমারে, বলিল তোমারে চাই’—সেইমতো ডাক। পথ চলতে চলতে সহসা থেমে,সেইডাক, সেইধারাস্নানেরসিক্ত আহ্বান, সেই হোল জলঝর্নার অন্তরের প্রকৃত সঙ্গীত। তবে তা অবগাহন নয়, তার জন্য একদিনতৃণা আমাকেনিয়ে যাবে আরওগভীরে। –জনমানবহীন খেয়াঘাট, কোথাও কোনো নৌকো নেই, আলো নিভে আসছে।

পদ্মা, ইছামতী, ধানসিড়ি, ধলেশ্বরী— সমস্ত নদীই জানে সাগরের পথ, যেখানে তার সঙ্গম। তৃণা তখনও নদী হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতি তাকে সাজিয়ে রেখেছে তার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে; ‘তুমি মাঠে মাঠে চলো বিহরি, তৃণ উঠুক শিহরি শিহরি’! ক্রমশঃ সে স্রোতা, স্রোতস্বিনী; আরো পরে একদিন নদী হ’য়ে সাগরসন্ধানে।

সমস্ত মানুষের ভিতরে, উদ্ভিদের ভিতরে, জড়ের ভিতরে সৃষ্টির মূল সুত্রগুলো এক। শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর। –শহর ও সংসার ত্যাগ ক’রে, একটাপ্রাচীন জাম গাছের নিচে ধ্যানে ব’সে দীর্ঘ তপস্যার পরে এ’কথা জেনেছিলেন কবি বিনয় মজুমদার। সেই তাঁর নির্বাণ। তপস্যা শেষ হ’লে কোনো রমণী তাঁকে পায়েস খাওয়াতে আসেনি তো। বিনয়কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পাভলভ হাসপাতালে, মনোবিদদের কাছে, যারা কোনোদিন কবিতা লেখেনি।

ছুটির দিনে স্নান সেরে, তৃণা যখন বাথরুম থেকে বেডরুমে ঢোকে, পদপ্রান্তে প’ড়ে থাকে সিক্ত তোয়ালে, আর মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে তার প্রিয় পাউডার। প্রতিবার শাড়ি অথবা কুর্তি পরার আগে সে, তৃণা, আমার কাছে এসে পিছন ফিরে দাঁড়ায়, ব্রায়ের হুক লাগিয়ে নিতে। আমি ভাবি অন্য দিনগুলোয় কীভাবে সামলায়। প্রশ্ন করার আগে সে নিজেই কলকল ক’রে ওঠে— নিজে নিজেও পরতে পারি, সামনের দিকে ঘুরিয়ে এনে হুক লাগিয়ে, কিন্তু তুমি যখন ঘরেই আছো, তাই। –এখনই সে আসবে আমার কাছে, পেছন ফিরে দাঁড়াবে;যেন সমগ্র মানবসভ্যতা আমাকে বিশ্বাস ক’রে কাছে এসে দাঁড়াবে, একটু প্রেম ও সাহায্যের জন্য।

তখনও তার স্কিন-কালারের ‘৩৪-সি’ ব্রেসিয়ারটা বিছানার ওপরে প’ড়ে আছে, লক্ষ করি আমি। তিন্নি এতদিন তার ব্রায়ের মাপ নিতে জানতো না ; কীভাবে মাপতে হয় তার ব্যান্ড-সাইজ আর কাপ-সাইজ। বাঁদিকে ঝুঁকে বিছানা থেকে ব্রেসিয়ারটা সে তুলে নেবার আগেই তাকে, তৃণা বা তিন্নিকে, ঝটিতি কাছে টেনে দুহাত দিয়ে তার সকল নগ্নতাকে আমি জড়িয়ে ধরি, মুখোমুখি। হার্টবিট সহসা দ্রুততর। খুব ধীরে, টিকোলো নাকের খুব কাছে, নাকছাবিটির নিচে ফুটে ওঠা স্বেদবিন্দুদের মাঝে, আমি তার নিঃশ্বাসে হাল্কা ফেরোমোনের গন্ধ পাই। ক্রমশঃ ঠোঁটে ঠোঁট। সর্বাঙ্গে শিহরণ ওঠে। ঘরময় ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। তার সদ্যস্নাত হিম স্তনযুগল ধরা পড়েছে আমার দুহাতে। তারা করুণ শঙ্খের মতো দুধে আর্দ্র নয়, বরং যেন যাদুকরী, যে পারে কবির চিত্তে সে-প্রেমের সংক্রাম জোগাতে…। সেদিন তৃণা আমাকে ‘পাগোল’ ব’লে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার আগে বলেছিল–আমি জানি, কী ভাবছো। বোদল্যেয়রের কবিতায় একটা লাইন আছে, যা তোমার প্রিয়। –তৃণার সুডৌল ভারি স্তন, শীর্ণ সুঠামবাহুবল্লরী। আমি বললাম, কবিতায় আরও কত কি আছে, যা হয়তো তুমি জানো না।

কতবার তৃণার স্তনবৃন্তে অথবা, দুই স্তনের মাঝে মুখ রেখে আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম, সেখানে কোনো মারণবীজ নেই, আছে শান্তি ও আশ্রয়। এখনও এই পৃথিবীতেই আছে শান্তি ও আশ্রয়!! সত্যিই শান্তি আছে এই বিপুল বিশ্বে? আমারইনাগালের কাছে, এই সামান্য ৩৪-সি পরিসরটুকুর মধ্যেই?–আমি ভাবি। প্রকৃত প্রস্তাবে তৃণার শরীরের স্পর্শই আমাকে ক্রমশঃ নক্ষত্রচেতনা এনে দিয়েছিল।বিনয়ের কবিতার সেই লাইন— ‘হাতে হাতে নাড়া যায় বিশ্বের জ্যামিতি’। আমার মনে পড়ে আকাশগঙ্গার কথা।ষোড়োশো শতাব্দীর ইতালিয়ান চিত্রকর টিন্টোরেট্টোর আঁকা সেই অপার ক্যানভাস–‘দা অরিজিন অফ দা মিল্কিওয়ে’।দেবী জুনোর স্তন থেকে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছে যে দুধের ফোয়ারা, তার প্রতিটি বিন্দুই ক্রমে এক একটি নক্ষত্র।

সেদিন মহাকাশ থেকে অবিরাম নিউট্রিনোর প্রবাহ তীব্র বেগে ব’য়ে যাচ্ছিল আমাদের দু’জনের শরীর ভেদ ক’রে। নিউট্রিনোরা তো সংবাদ বহন করে না, আমরা হয়তো তাই জানতে পারি না পরস্পরের শরীরের অন্তরের কথা।কীভাবে অন্তরে অন্তরে ক্রমশঃ সৃষ্টি হয় ব্যবধান, বিছানায় শরীর ক্রমে স’রে যায় শরীর থেকে। নিউট্রিনোরা তাই কোনও কাজে আসে না মানুষের। আমাদের প্রাণে প্রেম এনে দিতে পারে শুধু ঈশ্বর-কণারা। তারাই পারে ভোরের আকাশকে গানে গানে ভ’রে দিতে।

সাইরেন বেজে যাচ্ছে সারারাত। এই অবিরামবিশ্বযুদ্ধে প্রতিদিন কত দিক থেকে কত মিসাইল এসে আছড়ে পড়ছে বন্দরে, উপত্যকায়, মালভূমিতে।তাদের নিরন্তর আঘাতে ও বিস্ফোরণে সৃষ্ট কত গহ্বরে আশ্রয় নিয়েছেমানুষ। ভাবছে, এখানেই রয়েছে বুঝি শান্তি, প্রেম, আশ্রয়। অথচ গহ্বরবাসী মানুষ বোঝে না তার পার্শ্ববর্তিনীকে। কেন যে কারো কান্না পায় ভোরবেলা, তাও সে জানে না। সে ভাবে এমনই বুঝি হয় ব্রাহ্মমুহূর্ত। সে সূর্যকে প্রণাম করে, একদিননক্ষত্র হ’তে চায়।

বিছানার কালো চাদরের ওপরে তখনও তিন্নি অথবা তৃণার সেই ব্রা। সেদিকে আমার দৃষ্টি যেতে, নিমেষেই মনে প’ড়ে গেল এক মহাজাগতিক দৃশ্যের কথা,কয়েক বছর আগে যার ছবি তুলে এনেছিল পৃথিবী থেকে আশি হাজার কিলোমিটার ওপরের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান ‘চন্দ্র এক্সরে অবজারভেটরি’। দৃশ্যটি রচিত হয়েছিল গভীর মহাকাশে, ‘কমা বেরেনিসেস’ নামের নক্ষত্রপুঞ্জে। খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে, রানি দ্বিতীয় বেরেনিস (Berenice II) ছিলেন মিশরের সম্রাজ্ঞী। তাঁর স্বামী ‘তৃতীয় টলেমি’ (Ptolemy III)তখন যুদ্ধক্ষেত্রে।স্বামীর সুরক্ষার জন্যে আশীর্বাদ প্রার্থনা ক’রে নিজের চুল কেটে, রানী বেরেনিস সেই কেশদাম অর্পণ করেছিলেন দেবী আফ্রোদিতিকে। বেরেনিসেস নক্ষত্রপুঞ্জ তাই যেন রাতের আকাশে সারিবদ্ধ নক্ষত্র দিয়ে আঁকা সুন্দর একগুচ্ছ চুলের মতো, যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, সঙ্গীত রচনা করেছেন বিংশ শতাব্দীর অনেক কবি, চিত্রকর, ভাস্কর ওসঙ্গীতশিল্পী ;স্প্যানিশ কম্পোজার, বলিভিয়ান কবি, এমনকি আইরিশ কবি ইয়েটস-ও।

তৃণার বেডরুম থেকে ২৯ আলোকবর্ষ দূরে, সেই ‘কমা বেরেনিসেস’ নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে আছে এক অতিকায় কৃষ্ণ গহ্বর, যার খুব কাছাকাছি কীভাবে যেন ভুল ক’রেচলে এসেছিল সূর্যের চেয়ে তিনগুণ বড় একটা নক্ষত্র। অতিকায় সেই কৃষ্ণ গহ্বরের তীব্র মাধ্যাকর্ষণের টানে অসহায় তারকাটি নিমেষেযেন স্পাগেটির মতো দীর্ঘ প্রলম্বিত হ’য়ে পালাতে চাইছে আগ্রাসী মৃত্যুর হাত থেকে, কিন্তু নিরুপায়।–আমার মনে হ’ল, যেন বিছানার কালো চাদরের ওপরে তৃণারইশরীর থেকে তার ব্রায়ের একপ্রান্তের স্ট্র্যাপ ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে নিতে চাইছে কালোমুখোশধারীএক বলবান দুর্বৃত্ত। তৃণা তার হাতের মুঠোয় প্রাণপণে ধরে রেখেছে অপর প্রান্তটি! Clasping her brassiere with a pained surprise!–এরকমটা কেন মনে হোল আমার!! আমি অবাক বিষ্ময়ে সেই ভয়াবহমহাজাগতিক দৃশ্য-স্মৃতির প্রবল অভিঘাতে বিহ্বল হয়েছি।


[নক্ষত্রমন্ডলকে গ্রাস করছে এক অতিকায় কৃষ্ণ গহ্বর]

সমগ্র নক্ষত্রমন্ডলকে ভক্ষণ করার পরে, এক বিপুল উদ্গারে সেই কৃষ্ণ গহ্বরের দুই মেরু থেকে মহাকাশে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তার উদ্বৃত্ত অপাচ্য অংশটুকু। কয়েক আলোকবর্ষ দূর অব্দি তার তেজস্ক্রিয় এক্স-রে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল মহাকাশে। একে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন ‘টাইডাল ডিস্‌রাপশান’ জনিত দুর্ঘটনা। মহাকাশে এমন আরো কুড়িটা সম্ভাব্য দুর্ঘটনাকে তাঁরা তালিকাভুক্ত ক’রে নজর রেখে চলেছেন, আমি জানিয়েছিলাম তৃণাকে। কিছুক্ষণ চুপ ক’রে ভেবে তৃণা হেসে ফেললো, টোল পড়লো তার গালে। বললো, আমাকে গ্রাস করা অত সহজ নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো নয়ই। -তৃণা কি জানতো তার জোয়ার ভাটার কারণগুলোকে, সম্ভাব্য কোনো টাইডাল ডিস্‌রাপশানকে?অনেক পরে, একদিন,আমি এই নিয়ে ভেবেছি।

এই সংসারে হাজারো মানুষের ভিড়ে, প্রিয় অপ্রিয়, শত্রু বন্ধু, দুর্বল ও ক্ষমতাবান অজস্র শক্তির সাথে মিশে, নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও সন্তুলান বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা ক’রে যে জীবন আমরা যাপন করে চলেছি, খুঁজে চলেছি আমাদের নিরাপদ ‘ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্টগুলো’, তার মধ্যেও এমন ব্যাঘাত তো ঘটে যায়, ঘটে যেতে পারে।একদিন তৃণা যখন এ-কথা বুঝতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কী এক অদ্ভুত আকর্ষকের টানে, অথবা অসতর্কে, মতিভ্রমে, সে পৌঁছে গিয়েছিল এমনই এক বিশাল কৃষ্ণ গহ্বরের খুব কাছে, যেখান থেকে তার মতো তারকারও বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তৃণার কক্ষপথের বহু দূর থেকে,একদিন রাতের আকাশকে সহসা প্রবল বিকিরণে আলোকিত হয়ে উঠতে দেখে, শিহরিত হয়েছিলাম একা আমি নভোচারী।

আকাশের গভীর নীলে, সাদা দাগ কেটে চলে যাচ্ছে একটা জেট প্লেন। এই এরোপ্লেন জিনিষটা আমাকে চিরকাল আনন্দ-বিস্ময়-শিহরণে চুবিয়ে রেখেছে। প্রথম প্লেনে চড়েছিলামশ্রীনগর থেকে জম্মু।মনে আছে, কবেকার সেই ছোট্ট প্লেনটির কেবিনেবাতাসের চাপ কমে গিয়ে, কানে তালা লেগে, বমি পেয়ে, তৃণার কিভীষণ দুরাবস্থা। ফলে, প্লেনে চড়াটা ভীতিপ্রদ হয়ে রইলো। একটা ফোবিয়া, যার উৎস ছিল সম্ভবতঃ বালক বয়সে বইয়ে পড়া ‘কাশ্মীর প্রিন্সেস’ নামে চার্টার্ড প্লেনটা।বম্বে থেকে হংকং হয়ে সে জাকার্তা যাচ্ছিল, তার কল-সাইন ছিল ‘ডেল্টা ইকো পাপা’। সেই যাত্রায় নাকি চীনের প্রধান মন্ত্রী‘চৌ-এন-লাই’কে বিস্ফোরণে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি যাত্রা স্থগিত রাখেন। –প্লেনটা সশব্দে ভেঙে পড়েছিল দক্ষিণ চীন সাগরে। আগুন ধ’রে গিয়েছিল তার ইঞ্জিনে। পুড়ে আংরা হ’য়ে সমুদ্রের নীচে পড়েছিল যাত্রীদের দেহ।সমুদ্রের গভীর সবুজ অন্ধকার থেকে উদ্ধার করা হয় তার ‘ব্ল্যাক বক্স’, যাতে ছিল ধ্বংস আসন্ন জেনে পাইলটের আর্ত এস-ও-এস… ‘ডেল্টা ইকো পাপা কলিং’ !

যেকোনো দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়ার খবর খুবই বিমর্ষ করতো তৃণাকে। কারণ সে অনেক কাছ থেকে দেখেছে দহনের ভয়াবহতা। একবার অগ্নিকান্ডে পরিচিত কয়েকজন যখন আগুনে পুড়ে মৃত্যুশয্যায়,তখন সে হাসপাতালে তাদের বিছানার পাশেকতবার রাত জেগেছে।কম্পিত, শিহরিত; পোড়া মাংসের গন্ধে নাকে রুমাল বাঁধা। তীব্র বেদনায় সারারাত আহতের চীৎকার, আর্তনাদ, নার্সদের ছুটোছুটি।এইভাবে কতদিন কেটে গেছে। বিনিদ্র, ক্লান্তিহীন, সারারাত শুশ্রুষা। ক্রমে অশ্রুজলে একে একে বিদায় জানানো মৃতদের।

সেই প্রথম ফ্লাইটেরঅনেক দিনপরে, একবারআমাকে অফিসের কাজে যেতে হবে মুম্বাই। সেটা ছিল বড় বোয়িং বিমান, চল্লিশ হাজার ফুট উচ্চতাতেও যার কেবিন-প্রেসার, যন্ত্রপাতি সব ঠিকঠাক ছিল।মুম্বাই থেকে ফেরার আগের দিন বিকেলে একলা জুহুবীচে গেছি। সৈকতে, সান্ধ্য ভীড়ের মাঝে,তখন ঊর্ধাকাশে ঘন কালো মেঘ। কাছেই সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্ট। প্রতি এক-দেড় মিনিট অন্তর একটা করে প্লেন যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে যাচ্ছে আকাশে। একে একে উড়ে এসে, সমস্ত ফ্লাইট সোজা আমার মাথার ওপর দিয়ে মেনল্যান্ড ছেড়ে আরব সাগরের ভেতর দিকে ঘন মেঘের গভীরে ঢুকে যাচ্ছে।এবং কিছু পরেই ভয়ংকর বাঁক নিয়ে ফিরে আসছে তার নির্ধারিত গন্তব্যের উড়ানপথে–দিল্লী, কলকাতা বা চেন্নাইয়ের দিকে। আমার ভীষণ ভয় ধ’রে গেল, কারণ পরের দিনই সন্ধায় আমার কলকাতা ফেরার ফ্লাইট।আমাকেও তাহ’লে অমন উত্তাল আরব সাগরের মাথায়, ঘন মেঘের আঁধার গহ্বরে ঢুকে ওইভাবে ভয়ংকর বাঁক নিতে হবে? এর চেয়েবরং সহজ হোতউত্তাল সমুদ্রের গভীরে সেই এক বৃদ্ধ মৎস্যশিকারীর সাথেপাল-তোলা নৌকোয় চ’ড়ে অতিকায় মার্লিন মাছ শিকারেযাওয়া;দা ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দা সী।

ছোটবেলায় স্কুলে আমার নাম ধৃতিমান কে দিয়েছিল আমিজানি না। তখনখেয়াল হয়নি, কিন্তু পরে এই নিয়ে মাঝে মাঝে ভেবেছি, যখন বাবা মা কাকা পিসি জ্যাঠা মামা কেউ কোথাও বেঁচে নেই যে জিগ্যেস করবো। নিজের এতদিনের নামটাকে, এই ধৃতিমান চক্রবর্তীকে, আজকাল নিজের কাছেই সহসা অতিশয় ভারি ও অপরিচিত মনে হয়। ধৃতিমান নামের এই বেঢপ চটের থলেটার মধ্যে আজও বসে রয়েছি কী করে, ভাবি আমি। আমার শ্বাসকষ্ট হয়। তৃণা বলতো– কেন, ভালোই তো নাম। এর চেয়ে অন্য কী আর পছন্দ হ’তো তোমার? চাইলে আমি তোমায় ‘আর-টু-ডি-টু’ নামেও ডাকতে পারি, অথবা প্রুশিয়ান ব্লু, কিংবা ইউরেনিয়াম। কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমি বললাম- তার মানে আমার বিকিরণ তুমি সহ্য করতে পারো না। তৃণার সেদিন কী যে হয়েছিল, সহসাই সে অসহিষ্ণু,কর্কশ। বললো, যাকে তুমি বিকিরণ বলো তা আসলে ক্যান্সারাস, তোমার এবং আমার, উভয়ের কাছেই।

আমার মনে হ’ল, তৃণাকেহয়তো আজকাল অন্য কিছু আকর্ষণ করছে। হয়তো রাজহংসীকে টানছে অন্য কোনো তোর্সা নদীর চর, ভার্জিন জলাভূমি।মনে পড়লো, ডি’বোনো তাঁর ‘আয়াম রাইট, ইউ আর রং’ বইতে লিখেছেন, আমাদের মস্তিষ্কের চিন্তাপদ্ধতিতে একটি ‘নাইফ এজ’-এর কথা, যেমনটা থাকে দাঁড়িপাল্লার ঠিক মাঝখানে। সেই ‘নাইফ এজ ডিস্ক্রিমিনেশন’-এর বশে আমরা অজ্ঞাতেই খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। সামান্যতম একটা সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরেই আমাদের মন অবচেতনে তার নির্বাচন সেরে ফেলে, যদিও তা হতে পারে সম্পূর্ণ ভুল, অপরিণামদর্শী, বিপর্যয়কর।

তৃণা চ’লে যাবার পরে আমার মনে হয়েছে, হয়তো কখনোতাকে ভালো করে জানাই হয়নি; পেশাগতভাবে, কিংবাখেলার ছলেও। শিল্পে, কবিতায়, গানে, সুইমিং পুলে, জীমে, রাতের বিছানায়। অথবা এমনি কোনো অলস বেলায়,আমরা যখন পাশাপাশি। ডায়েরিতে লিখেছি সেই কথা।– আমাদের দুজনেরই ভেতরে একটা কম্পন ছিল, যা গাছের মধ্যে নেই, পাথরের মধ্যেও নেই। যদিও তার ফ্রিকোয়েন্সি ও অ্যামপ্লিচিউড ছিল ভিন্ন। কিন্তু কী প্রবল আকাঙ্ক্ষায়সে আমাকে বিছানায় কাছে টেনে নিয়েছে তো। কখনো সোফায়, হ্যামকে, রকিং চেয়ারে। ভরা পূর্ণিমায় নদীতে জোয়ার এলে, বন্দর থেকে জাহাজের ভোঁ শোনা যেত। দ্বিপ্রহরে অথবা গভীর রাতে কত তাড়াতাড়ি তাকে অর্গাজমে পৌঁছতে দেখেছি তো আমি। অল্প সময়ের মধ্যেই একাধিকবার, সে যেমন জানিয়েছে। অনেক পরে, রাত ভোর হ’লে বহুদূর থেকেযখন সে সুরেলা ডাক দিত, মনে হোত আমরা বুঝি কোনোভাবে হাত ধরাধরি ক’রে চিরকাল থেকে যাব এই বিপুল ব্রহ্মান্ডব্যাপী কোয়ান্টাম ফিল্ডের সর্বদা কম্পমান সময়-চাদরে, আদরে, পাশাপাশি দু’জন। মৃত্যু আমাদের রূপাত্মাকে,এই সংহিতাকে, বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।

কখনো তৃণা আমাকে জানাতো তার বদ্ধ জীবনের ক্ষোভ। এই মহাপৃথিবীর সাথে ক্রমশঃ কীভাবে যেন তার এক আশ্চর্য গভীর চেনা-পরিচয় গড়ে উঠেছিল, যা অনন্ত সন্ধানী, যা আমি জানতে পারিনি।কেন ও কী ভেবে, মানুষ এসেছে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে!হয়তো তার অন্তরে ক্রমশঃ জেগে উঠছিল অন্য কোনও অভাববোধ। তৃণা বলতো– ঘরে ব’সে মুখ গুঁজে শুধু কবিতা লিখে যাও, কী হয় কবিতা লিখে? কূপমন্ডুকরা নিজেদের মুর্খামি দিয়ে কবিতা লেখে, যা অন্যান্য মন্ডুকরা প’ড়ে মুর্খের মতো হাউমাঁউ করে। কুয়োর মধ্যেশুধু হিংসা, ভয় আর টেনশান।অসূয়া এবং আগ্রাসন।নিজের সাথেও মিথ্যাচার। কার কী হয় এতে? শান্তি আসে? প্রেম আসে? স্থিরতা আসে মনে? কোনো সুগন্ধ পাও? তৃণার শ্বাস প্রশ্বাস ক্রমে দ্রুততর দেখে,আমি বলতাম– পাই আর কোথায়!কোথায় সুগন্ধ, সুগন্ধ কোথায়, জল ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নীল ফুল!

তৃণা ভালোবাসতো আদিম পৃথিবীর কথা, ডাইনোসর আর গুহা-মানবের কথা। মহাজাগতিক সঙ্গীত। টোটেম দেবতা। বজ্রপাত, বরফ, ধুমকেতু, আর সারারাত তারা খসে পড়া।যাযাবরদের জীবন। অশ্বারোহী যুবক যুবতী। প্রাচীন তাম্রপাত্র, পটারী, স্টেইন্ড গ্লাস, ক্যালিগ্রাফি।এত কিছু স্থান ক’রে নিয়েছিল তার মনোজগতে! তৃণার নানারকমের টেনশান ছিল, ভয়ও ছিল মনে। অজানা ভয়। রাতে সে ঘুমিয়ে পড়তো তাড়াতাড়ি। উঠতো খুব ভোরে, আমার অনেক আগে। কখনো অনেক রাতে, মৃদু নীলাভ আলোয়, বিছানায় ঘুমন্ত তৃণার দিকে আমি তাকিয়ে থেকেছি। মনে পড়েছে, সিয়েরা লিমা-র লেখাসেই কবিতাটা—“যখন সবাই ঘুমায় / বিছানায় পালঙ্কে দোলনায়, বেতের ঝুড়ির ভেতরে / ঘুমোয় তারা মশারির নীচে, নির্জন দালানে /হ্যামকে, ছাদে আর সিঁড়িঘরের কোণায়; / ঘুমিয়ে পড়ে হুইলচেয়ারে, খালি গায়ে / লেপের নীচের লাল অন্ধকারে, চাদরে / তারা ঘুমোয় হাসপাতালে আর বাঙ্কারে / গরমজলের কালভার্টে আর ট্রলিতে / ঘুমিয়ে পড়ে খড়ে / ইঁটে রবারে আর নিউজপেপারে।/ তখনও একজন জাগে, / যে বর্জন করে কফির কাপ / আগুন আর হুইস্‌ল; /ভালো লাগে তার সারি সারি নিদ্রিত মুখ। / শুধু সে-ই দেখে / কীভাবে ঘাম নামে শরীরে /কীভাবে পাশ ফেরে মানুষ–/ ঘামে মুখ ভিজে যায়, ফুলে ওঠে / আর মুখ থেকে ঝরে যায় মুখের বাসি চামড়া।/ ভোরবেলা / মানুষ যখন জাগে তার নতুন মুখ নিয়ে / আবার বাজায় তার বিউগ্‌ল, / তখন আর তাকে দেখা যায় না”।

তৃণাএকদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখেছিল, একটা কফিনের মতো বাক্সে শুয়ে আছে, আর তার গায়ে ঢেলে দেওয়া হয়েছে এক বালতি আরশোলা আর বড় বড় কয়েকটা মাকড়শা;লোমশ মোটা ‘টরান্টুলা’।গভীর রাতে স্বপ্ন ভেঙ্গে জেগে উঠে, ঘর্মাক্ত কম্পিত সে জড়িয়ে ধরেছিল আমাকে। জানালায় তখন মাঝরাতেরশুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। পর্দা সরিয়ে সেদিন তাকে চিনিয়ে দিয়েছিলাম চাঁদের গায়ের রুক্ষ শুকনো অঞ্চলগুলোর নাম, তৃণা যাদের কলঙ্ক বলেই জানতো।ঝড়, মেঘ, বৃষ্টি, উর্বরতা, সৌন্দর্য, মধু, আর প্রশান্তি নামক জলশূন্য বিশাল চন্দ্র-সাগরগুলো।সি অফ ট্রাঙ্কুইলিটি, সি অফ স্টর্ম,সি অফ সেরেনিটি।

প্লেনের ভয় আমার কেটে গিয়েছিল, যখন আমি আর তৃণা ল্যাপটপে মাইক্রোসফ্‌টের ‘ফ্লাইট-সিম্যুলেটর’-এরনেশায় মেতেছি। আমি বেছে নিতাম ছোট ‘সেসনা’-জাতীয় প্লেন। আর দেশ-বিদেশের নামকরা এয়ারপোর্টগুলো। এভাবেই একবার নিউইয়র্ক থেকে টেক-অফ ক’রেহাডসন নদীর ধার ঘেঁষে উড়ে গিয়ে, ম্যানহাটনের আকাশে এসে হঠাৎই সেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উঁচু উঁচু টাওয়ার দুটোর মুখোমুখি, এবং অচিরেই তার সাথে কলিশন ও বিস্ফোরণ। প্লেনটা কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়লো জলে। সেই প্রথম! তখনো রিয়েল লাইফে টুইন টাওয়ারে কোনো জঙ্গী-প্লেন গিয়ে আছড়ে পড়েনি।

তো, বারবার এরকম ক্র্যাশিং-এর পরে আমি আকাশে কিছুটা উড়ে, বাঁক নিয়ে, ফিরে এসে অটো-পাইলটের সাহায্য নিতাম। এটা ছিল দৃশ্যতঃ দারুণ সুন্দর।অলস বিকেলে আমি কখনো তৃণাকে ডাক দিতাম—দেখে যাও, আমি একটু পরেই সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবো। অথবা কখনো হয়তো ঝলমলে সন্ধ্যায় আমস্টারডামের শিফল এয়ারপোর্টে নামবো ব’লে তৃণাকে ডেকেছি। কতবার তৃণা শুধু এই অংশটা দেখবে ব’লে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়াতো।তার ‘থার্টিফোর সি’-র সবটাদিয়ে সে ছুঁয়ে আছেআমাকে। পেছনেতাকালে দেখা যায়, দু’চোখে তার গভীর কালো কাজল,ঘন কুন্তলভার অযত্নে নত।

আমি হাত গুটিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে বসে আছি, আর বহুদূর থেকে প্লেনটা বেকনের সাহায্যে পথ চিনে চিনে ঠিক সময় বাঁক নিয়ে, অল্টিচিউড কমিয়ে কমিয়ে, ধীরে ধীরে এসে, একদম আলো ঝলমলে মসৃণ দীর্ঘ রানওয়ের ওপরে কিভাবে আস্তে ঝাঁকিয়ে উঠে, অবশেষে টাচ-ডাউন! তৃণা শিহরিত হোত। আমার মনে হ’ত, জীবনে এইরকম স্মুথ ল্যান্ডিং শেখাটা ভীষণ জরুরী, যা এরকমই সুন্দর। এইভাবে পথ চেনা, ঠিক সময়ে বাঁক নেওয়া। এইরকম ধীরে ধীরে অল্টিচিউড কমানো। –মাঝে মাঝে নেমে এসে মাটিকে ছুঁয়ে থাকা ভীষণ জরুরী।

কতরকম পরিস্থিতিতে, কত অভিজ্ঞতায়, এই ধৃতিমানের এতগুলো বছর কেটে গেছে, ভাবি আমি।যাবতীয় লেখালিখি ও কবিতার অন্তরালে এইসব নানা কাহিনীর ইম্প্রিন্ট, নানা ছিন্নভিন্ন ছবি। কেরুয়াক নাকি একবার আমেরিকার আইওয়া-শহরে,কবিদের এক রেসিডেন্সিতে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাতলে দিয়েছিলেন উপন্যাস লেখা শুরু করার সহজ উপায়। লেখাটা শুরু করতে হবে কয়েক মাস, বছর বা, কয়েকদিন আগের যেকোনো একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে।যেমন ধরা যাক, একদিন সন্ধ্যেবেলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেইউনিভার্সিটি গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় একটা  অ্যাপ ক্যাব থেকে নামলো তৃণা, সাথে একজন অপরিচিত সুদর্শনবন্দুকধারী।-ওরা কি একসঙ্গে, না কি আলাদা?বিবাহিত, নাকি আনুষ্ঠানিক? তো, এই প্রশ্ন থেকেইশুরু করতে হবে। কাহিনী এগিয়ে যাবে, যেদিকে যেতে চায় লেখক ও তার কলম। চল্লিশ-পাতা লেখাকেও সম্পাদক চাইলে উপন্যাস বলে ছেপে দেবেন। আর যদি ৩০০ পাতার হয়, তবে দুবছর ধ’রে ধারাবাহিক। পরে বই। এবং প্রকাশকের কেরামতিতে অবশ্যই বেস্টসেলার।

তৃণা বলতো–চার-পাঁচ পাতার বেশি বড় লেখা হ’লে এখন আমি আর পড়িনা, ছোটবেলায় অবশ্য অনেক পড়েছি। এখন মনে হয়, সব গল্পই তো লেখা হয়ে গেছে, কবেই। বাদাবনের গল্প, দেশভাগের গল্প, মঙ্গলগ্রহের নীলরঙের এলিয়েনদেরসাই-ফাই গল্প, ড্রাগ, লেসবিয়ান আর হোমোসেক্সের গল্প, হানাবাড়ির ভূতুড়ে গল্প।এছাড়াওযতক্লান্তিকর গোয়েন্দা গল্পগুলো– যা অনেক সিরিয়াল কিলার, ভাঁড়, আর ফ্যান্সিসেটিং দিয়ে পরিবেশন করলেওপড়তেইচ্ছে করে না।রোজ এত এত জেনুইন ক্রাইম চারদিকে, এত তার রিপোর্টাজ যে, আজ আর থ্রিলার ব’লে কিছু হয় না। আমি বললাম, তুমি তাহলে খুবই ব্যতিক্রমী।

তৃণা বললো—হতেও পারে। তবে, এবার তুমিওন্যারেটিভিটি ছাড়ো– টেক্সট, ডিসকোর্স, যাই বলো না তাকে,সব ছাড়ো।অবুঝ গাড়লের মতো লিখো না আর। অন্তত আমার মতো পাঠকদের জন্যে। গিভ আস এ ব্রেক।–এর চেয়ে বরং গান গাও। সোনাও কিছু বিশুদ্ধ রাগসঙ্গীত। শুধু কিছু আলাপ শোনাও তো, মালকোষ রাগে অথবা দরবারীতে, আমি এক ঘন্টা ধ’রে শুনবো।

আমি বললাম– গান তো আমার আসে না, তবে আমিও তো অক্ষর থেকে মুক্তি চাইছি সেই কবে থেকে। তৃণা বললো– কেন, অক্ষর কী দোষ করলো? অক্ষর আছে বলেই কি একঘেয়ে গল্প লেখা শুরু করে দিতে হবে? অক্ষর দিয়েও তো সুস্বাদু কত কিছু লেখা যায়। অন্ততচিঠি লেখো আমাকে।আমার প্রিয় আইসক্রিম আর ফ্রুট স্যালাড তুমি জানো? আমি বললাম, এটা কেমন হ’ল, একই বাড়িতে বসে তোমাকে চিঠি লিখবো? তৃণা বললো— আচ্ছা বেশ, আমার জন্যে লিখতে হবে না। নিজের যা ভালো লাগে তাই লেখো। তবে আগে চারপাশটা ভালো করে দেখ, ভাবো। ভাবতে শেখো। যতদূর এতদিন দেখেছ, তার চেয়েও অনেক অনেকগুণ বিশাল এই বিশ্ব। মুক্তমনে তাকে দেখ, আবিষ্কার করো, আর ভাবো। চুপ করে ভাবো। লেখা তো অনেক পরের কথা, যেটুকু না লিখলেই নয়। আমি বললাম, গোদারের একটা ছবিতে আছে, ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ইস দা হাউস ম্যান লিভস ইন’। তৃণা বললো, তবেই দেখ, ম্যান-এর কথা বলেছে, উওম্যান তো বলেনি। আমার তো মনে হয় ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ নয়, কথাটা হবে ‘আইডিয়া’। উই লিভ ইন আওয়ার আইডিয়াজ। মেন অ্যান্ড উইমেন।

চুপ করে রইলাম। ভাবলাম তৃণাকে বলি, অপ্‌রা উইনফ্রে-কে বলা পাওলো কোয়েলহো-র সেই কথাটা। কিন্তু বললাম না। সত্যিই তো, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া, ভ্যালু অ্যাডিশান ছাড়া, কিছু না বলাই তো ভালো। কেবলই নেম ড্রপিং আর উদ্ধৃতি আমার না-পছন্দ। তৃণা বললো, কিছু ভাবছেননাকি, স্যার?– মাঝে মাঝে তৃণা আমাকে আপনি বলে। কেন বলে, এটা নিয়ে গভীরে ভাবিনি কখনো। আমি বললাম, আসলে লেখকরা আজকের মানুষের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করার রাস্তা খুঁজে পায় না। যেখানটাকে অন্তর ভাবা হয়, সেটা নিতান্তই ধুপধুনো সহযোগে একটা সাপলুডো খেলার বোর্ড, যার সাথে বিশ্বাত্মার কোনো যোগ নেই। নতুন কোনো উন্মোচন নেই।

অপ্‌রা উইনফ্রেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাওলো কোয়েলহো বলেছিলেন, নিজের গভীর অন্তরের কথা শোনো।কেননা অন্তর সব জানে, তার সাথে বিশ্বাত্মার যোগ আছে। তৃণা বললো, আসলে আমাদের গভীরে এক বিশাল আকাশ আছে, তাকে তুমি নিজেও জানো না।তার সাথে যোগ আছে নিখিল বিশ্বের। খলিল জিব্রানের ‘প্রফেট’ বইয়ের সেই লাইনটাআবার পড়ো :‘অ্যালোন ইউ মাস্ট সীক দা ইথার’। –আমি ভাবলাম, এই লাইনটা তো আমি আগেই পড়েছি। তবে ‘অ্যালোন’ শব্দটা আমায় বিষণ্ণ করে। সেদিন অনেক রাতে আমার মনে হোল, এই তৃণাকেই তো আমি চাই, এই তো আমাদের ‘কমন মিনিমাম’। তৃণার বাবা-মার যখন বিচ্ছেদ হয়েছিল, তৃণা তখনও কার্সিয়াংয়ে বোর্ডিং স্কুলে। তৃণার মা বোস্টন শহরে পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। তৃণার দাদু ছিলেন ডুয়ার্সে চা বাগানের ম্যানেজার। কাঠের বাংলো, বন্দুক ছিল ঘরে। –কখনো আকাশভরা তারার দিকে তাকিয়ে তৃণার মনে হয়েছে, এই নিখিল বিশ্বে আমরা কি সত্যিই একাকী?

আমার মনে হোল,কিছুদিন কলম বন্ধ থাক। নতুন করে তৈরি করতে হবে একটা ল্যান্ডস্কেপ, এক নতুন ভূখন্ড। এবং কেরুয়াকের কথামতো যেকোনো লেখাইতবে তৃণাকে নিয়েও তো শুরু করা যায়। মনোজগতের গভীর অবচেতনে নিয়ে যেতে হবে তাকে। আরো গভীরে, কোয়ার্ক সমুদ্রে ঘনিয়ে ওঠা মেঘে।বজ্রগর্ভ মেঘের মধ্য দিয়ে ফিরে ফিরে আসা কতসব শব্দ, বর্ণ, দৃশ্যমালা।সেই ভূখন্ডে পৌঁছতে চাই আমি,যেখানে শুধু দু’জনের মধ্যে কথা। অথবা,শুধু আমার সাথে আমারই। আমিই বসে আছি টেবিলের দুই প্রান্তে, আমারই মুখোমুখি। আমাদের এক পাশেআছে আউশুইৎজ কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প, গুয়ান্তানামো বে, গুলাগ বন্দীশালা।আমাদের অন্য পাশে আছে ভয়ঙ্কর গিরিখাদ, গ্রান্ড ক্যানিয়ন। জাম্বেজি নদী। আমাদের ঘিরে আছে আকা পিগমিরা, তারা গান গাইছে পলিফোনিক সুরে। আমরা বসে আছি দু’দিকে মুখ করে। আমি এবং আমি। আর আছে ‘ওরা’, যারা বেঁচে থাকার গান গাইছে, আর ‘ওরা’, যারা হত্যাকারি। ‘সে’ ব’লে তবে কি কেউ নেই? তবে আর কাকে তুমি বলে ডাকি?–রাতের আকাশ থেকে একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড সশব্দে লাফিয়ে নেমে এলো দূরের অরণ্যে, দাউ দাউ ক’রে জ্বলে উঠলো আদিম মহাদ্রুম। বনাঞ্চল আলোকিত!

এই যে আজ আমি কলকাতা শহরের এক প্রান্তে একা ঘরে বসে লিখছি, ঠিক এখনি হয়তো বিশ্বের কোথাও ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি অসহায় মানুষ, যাদের দু’হাত বাঁধা, চোখ ঢাকা কালো কাপড়ে।হয়তো এখনি কোথাও মাইন বিস্ফোরণে কারও নিম্নাঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।অন্য দিকে, হয়তো এখনি সেই ‘জাম্বেজি’ বা, ‘যায়রে’নদীতে কোনো ভেসেল বিষুবরেখাকে ক্রশ করছে, যাকে ‘ক্রসিং দা লাইন’ বলে। জাহাজের ডেকের ওপরে মদের বোতল খুলে, বেলুন উড়িয়ে, যাত্রীরা সেলিব্রেট করছে এই ঘটনাকে। জাহাজ দেখে জঙ্গলের ভেতরের গ্রামগুলো থেকে ড্রাম বাজিয়ে বেরিয়ে আসছে অনেক মানুষ। ঠিক এখনিহয়তো। কোলের শিশুকে পিঠে বেঁধে, মাথায় কোঁকড়া চুলে পিগটেল বাঁধা মেয়েরা হইহই করে ক্যানয় চ’ড়ে এসে ঘিরে ধরেছে জাহাজকে। তারা বিক্রি করতে এনেছে, পাকা কলা, টাটকা মাছ, মদের হাঁড়ি, জ্যান্ত ছাগলের পাল, আর দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা ছোট ছোট কুমির। এখনই নিশ্চই সেখানে ঘটছে এইসব। –বিষুবরেখা থেকে দেখা যায় অদ্ভুত বিশাল গোলাকার সূর্যাস্ত। কমলা-গোলাপি-রক্তিম-ফ্যুশিয়া।আজ তৃণা থাকলে, চাইতো এক্ষুনি সেখানে পৌঁছে যেতে।

চারতলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায় সারি সারি দেবদারু আর গুলমোহর গাছ। অন্য দিকে, সীমানার ওপারে, বিস্তীর্ণ ঘাসের জঙ্গলে শরতের কাশ ফুটেছে। আমি লক্ষ করি, সকালের রান্না শেষ করে পরিচারিকারা চলে গেলে, তারপরে তৃণা যখন একা ঘরে কাজ করে, স্টোররুমে, রান্নাঘরে, এমনকি কখনো তার স্টাডিতেও দেখেছি, তার প্রিয়মভ অথবা পার্পল রঙের কুর্তি অথবা টিউনিককে সে নাভির কিছুটানিচেগুটিয়ে এনে বেঁধে রাখে। পায়ে স্লিপার্স, প্যান্টি পরেনি, তাই নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ নগ্ন। মসৃণ সুঠাম জঙ্ঘার ওপরে, দুই উরুর মাঝখানে যেখানে তার পিউবিক হেয়ার।–শীর্ণা নদীর সোনালী বালুচরে ঈষৎ কালো রঙের নুনিয়া ধানে খেত ভরে আছে, হাওয়া দোলা দেয়।– কত স্বচ্ছন্দে সে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ায়। এই অভ্যাসটি সম্ভবত সে পেয়েছে গোদারের ‘ফার্স্ট নেম কারমেন’ ছবিটা থেকে। ছবির নায়িকা ছিল হুবহু এ’রকম।

স্নানের সময় বাথরুমে আমি অনেক সময়ই কবিতা বা কোনো গদ্য নিয়ে ভাবতে থাকি। সেদিন একটু বেশি দেরি হ’য়ে গেলেশুনতে পাই,তৃণা দরজার ওপার থেকে নিচু গলায় বলছে—যুবক, নষ্ট কোরো না বীজ। আমি বললাম, আজকাল উৎপল বসুর পুরী সিরিজ পড়ছো বুঝি?

কোনোদিন স্নানের পরে তৃণা হয়তোস্কার্ট অথবা শাড়ি পড়বে,ওপরে শুধুই ব্রা অথবা,চোলি। এসব সবাইকে মানায় না।তৃণার স্তনসৌষ্ঠব জান্নাতের হুরিদেরও ঈর্ষণীয়। জন্মদিনে তারা দখিনা বাতাসে ফুল পাঠাতোসেই স্তনযুগলকে; জান্নাতুল ফেরদৌসের শ্রেষ্ঠ ফুলগুলো–জুনাইরাহ, জারাহ, মিনাহিল। সেই দুই স্তনের মাঝে মুখ রেখে আমি কতদিন কত দুঃখ ভুলেছি। সুগন্ধে ভরা সেই আমার ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’, আমার ব্যক্তিগত স্বর্গোদ্যান। বিছানায় অস্ফুটে বলেছি— ‘অগর ফিরদৌস বর রু-এ জমীন অস্ত্‌, হামীন অস্ত-ও হামীন অস্ত-ও হামীন অস্ত্‌।’

মনে পড়ে, একদিন আমরা দু’জনে। তোর্সার চরে সেদিন হাওয়া বইছে। এদিকে নুনিয়া ধান তখনও সেজে ওঠেনি। হলং বনবাংলো ছেড়ে, চিলাপাতা জঙ্গলের দিকে যাওয়ার সময় এক জায়গায় আমরা থামলাম। শরবনের মাঝখানে শুঁড়িপথ দিয়ে একটা গন্ডার চলে গেছে কিছু আগে, গাইড বললো। জিপের চাকার পাশে, ভিজে বালির ওপরে তার পায়ের ছাপ। এলোমেলো কয়েকটা ফিঙে পাখি উড়ছে ঘাসের জঙ্গলে। জলে নেমেছে কয়েকটা বুনো হাঁস। বহুদিন পরে তৃণা আমার হাত ধ’রে হাঁটছে। আমরা যাচ্ছি ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। আজ সারা রাস্তায় অনেক ধুলো ঢুকেছে পোশাকে, শরীরে।

ফিরে এসে, বনবাংলোয় একটা বিরাট বাথটাবে স্নান করছে তৃণা। আমি শুনতে পাচ্ছি জলঝর্ণার আওয়াজ। একটু পরেই সে আমায় ভেতরে ডাকলো। সেই প্রথম। স্নানঘরে গীজারের উষ্ণ জলে, সাবানের ফেনায়, কুয়াশার মতো অস্পষ্ট সব কিছু। তৃণা আমায় ডেকেছে, তার পিঠের নীচের দিকে যেখানে তার হাত পৌঁছয় না সেই দুর্গম অঞ্চলটা লুফা দিয়ে ঘষে দিতে হবে। বাথটাবে শুয়ে আছেযেনওফেলিয়া, ফেনায় কুয়াশায়।কাছে ডাকছে সে!! –চকিতে আমার শরীরে শিহরণ, কারণ এই পাখিটাকে আমি কতদিন ধ’রে খুঁজেছি, দেখতে চেয়েছি। চারিদিকে ঘন কুয়াশা, উপরিভাগে সাদা মেঘের স্তর জমে আছে, তার মধ্য থেকে জেগে আছে শুধু দুটো পাহাড়ের চূড়াটুকু। পাখিটার নাম প্যারাডাইস ফ্লাই ক্যাচার। প্রায় দুফুট লম্বা সুদৃশ্য লেজ ঝুলিয়ে সে সামনের গাছের ডালে এসে ক্ষণিক বসেছে, হয়তো এখুনি উড়ে যাবে। এক মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে আমি ক্যামেরার জুম লেন্সে হাত রেখেছি। নিমেষে ঘটে গেল ব্যাপারটা—আমি একটা পাথরে পা ফসকে ডানদিকে পড়েছি, আর পাখিটাও তখুনি উড়ে গেছে জঙ্গলের গভীরে। আমারহাঁটুতে কেটে গেছে, কিন্তু খুব সামলে নিয়েছি সেদিন। কুয়াশায় খেয়াল করিনি, যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার নীচেই ছিল গভীর খাদ। কীভাবে বাঁচলাম জানি না। হৃৎকম্প তখনও।

*

আজকাল তৃণা মাঝে মাঝেই আমার ওপর রেগে যায়, আমি লক্ষ করি।আজ সেএকজন সাইক্রিয়াটিস্টকে ডেকে এনেছে, আমাকে কাউন্সেলিং-এর জন্যে। আমার নাকি নানা ধরণের অবসেসন আছে, কমপ্লেক্স আছে, আমি নাকি পজেসিভ, নার্সিসাস।–তৃণা কি তবে একটা সাইকো-পেস্টহয়ে উঠছে নাকি? হঠাৎই আমার মনে হোল,এবার বুঝি আমরা একটা অন্ধকার ভ্যাপসা সুড়ঙ্গেরপুতিগন্ধের ভেতরে ঢুকে যেতে চলেছি। এই প্রাচীন শহরের নীচ দিয়েকত অন্ধকার স্যুয়ার লাইন চলে গেছে; বিষাক্ত গ্যাসে, পাঁকে, কাদায়, মলমুত্রে পরিপূর্ণ। সেই জব চার্ণকের আমল থেকে হয়তো পরিষ্কার করা হয়নি, আলো ঢোকেনি কখনো। রাজপথেআমাদের পদচিহ্নের ঠিক নীচেই তো। -কেন যে হঠাৎ এমনটা মনে হোল আমার! মস্তিষ্কের ভেতরে এই সেই ‘নাইফ এজ’, যা মুহূর্তে নির্বাচন করে নেয়। যেদিকটা একচুল বেশি ভারি, সেদিকেই পাল্লাটা দ্বিধাহীন সটান ঝুঁকে পড়ে। অজান্তেই।

তৃণা ভালোবাসে নন-ফিকশান। খুব প্রিয় বই হ’লে, নিজে তার অনুবাদ করে ইংরিজি থেকে বাংলায়। সোফার পাশে কফি-টেবিলের ওপরেইরয়েছে যে বেস্টসেলার বইটা, ‘হু মুভড মাই চীজ?’–তৃণা তার বাংলা অনুবাদ করেছে ‘আমার আনন্দনাড়ু কে সরালো?’।বইটার সারার্থ হোল– সময় দ্রুত বদলে যেতে পারে, নিজের পরিচিত ও আরামদায়ক কমফর্ট জোন থেকে তখন বেরিয়ে আসতেই হবে। জীবনের আনন্দনাড়ুগুলো চিরকাল একইভাবে থাকবে না। অন্যেরা তাতে ভাগ বসাবেই একদিন। আসবে নতুন প্রতিযোগীরা। এইজন্যে সময় থাকতে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, বেরোতে হবে নতুন আনন্দনাড়ুর সন্ধানে। –জীবন নাকি এরকমই, একদিন সেআমায় বলেছিল। –আজ তৃণা প্লামকেক বানিয়েছে আভেনে। সারা ঘর ভ’রে আছে বেকারির গন্ধে। এই গন্ধ তৃণার প্রিয়। আর প্রতিবার আমার মনে পড়ে যায় এরিক রোমারের ‘দা বেকারি গার্ল অফ মঁস্যো’-মুভিটার কথা।

ড্রয়িং রুমে মনোবিদটির চেহারা দেখে প্রথম ঝলকে আমার জিরাফের কথাই মনে হয়েছিল। তৃণার পাশের সোফাতে সে বসেছে। জিরাফের মুখে স্মিত হাসি এবং গায়ে সস্তা ডিওডোরান্টের গন্ধ। আমিই প্রথমে কথা বললাম। জিগ্যেস করলাম, আপনি কি বাস্কেট বলও খেলেন? উত্তরে সে, সাইকি,অনভ্যস্ত বাংলায় আমাকে জিগ্যেস করলো, আপনার নাম কী? আমি বললাম– যা জানেন না,তেমন কিছু প্রশ্ন করুন।

এর পরে তৃণা আর সাইকির মধ্যে কিছুক্ষণ নিচু গলায় আলোচনা হোল। কখনো মনে হোল, ওরা কোনো ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলছে, কিংবা কোনো মেক্সিকান রেসিপি। মাঝে মাঝেই হরমোন,ক্যাপ্সিকাম, ডিএনএ,লেটুস, অরিগানো, অ্যাটিচিউড, ফ্রয়েড, ন্যারেটিভ—এইসব টুকরো শব্দগুলো। আমি তখন কফিতে মন দিয়েছি। ভাবছি, আমার অবস্থানটাই হয়তো ভুলে ভরা। আমাকে এবার একটা ‘এল-টু পয়েন্ট’ খুঁজে নিতে হবে, যা সূর্যমুখী নয়।উজ্জ্বল তারকার বিপরীত দিকে, নিজের জন্য একটা স্থায়ী আশ্রয়। লাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট-টু। যেখান থেকে গাঢ় অন্ধকারের সুদূর গভীরে আমার চোখ খুঁজে বেড়াবে কবেকার ক্ষীণতম আলোর ছেঁড়া সুতোগুলো। এই বিশ্বের সেইসব সুদূর নিস্প্রভ ম্লান আলোকবর্তিকার সামান্য একটু উত্তাপের অপেক্ষায় আছি আমি, যারা বহুকাল আগে আমারই উদ্দেশে রওনা দিয়েছে, কিন্তু এখনো কাছে এসে পৌঁছয়নি। এসো আলোকমালা, এসো, কথা বলো। মৃদু শুদ্ধ উচ্চারণে, বাংলা ভাষায়।

সাইকি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে— কবিতা লেখেন বুঝি? আপনি কবি? আমি বললাম, আমি কবি নয়। বোধহয় আমাকে আরও উৎসাহ দিতেই সাইকি বললো, আমিও তো লিখি।কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ।অবশ্য ইংরিজিতে। পড়তেও হয় কত।দান্তে, দেরিদা, প্রুস্ত, লাকাঁ, ফ্রয়েড। আমি বললাম- বাঃ, ঈর্ষণীয়। সাইকি এবার তার ব্রিফকেস থেকে নিজের সদ্য প্রকাশিত একটা বই বের ক’রে আমার হাতে দিল। ছিয়ানব্বই পাতার পেপারব্যাক, ইংরিজি। বইয়ের নাম ‘দা স্পাইরালিং ডায়ালেমা’। কভারে পিকাসোর আঁকা একটা ন্যুড স্কেচ।

বইটা হাতে নিয়ে কী করবো, কী করা উচিত আমার, বুঝতে না পেরে আমি বই খুলে সরাসরি ৬৭ পাতার দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে, নিচু স্বরে সাইকিকে শুনিয়েই, কয়েক লাইন পড়লাম—

‘Decadence of writers in mythical and totemistic epic frame of the counter point of synthesis to prosthesis of words in nuclear fusion of the incomprehensible spontaneousdeconstructive and anti-totalistic structure in dualism of signifier-signified ……’।

এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।

সাইকি বললো, কবিরা মনে হয় একটা কল্পজগতে থাকে, কী বলেন? আমি বললাম, আমার তো মনে হয় মনোবিদরাও এক ধরণের মনোরোগী, কী বলেন? …আবার কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।

সাইকি রেগে গেল না। জিগ্যেস করলো, বামপন্থী কবিতা আপনার কেমন লাগে? আমি বললাম, ই-এম-বাইপাসের কবিতা আপনার কেমন লাগে? সাইকি বললো, এটা আবার কেমন কথা! আমি বললাম, কবিতার বামডান, প্রাচ্যপাশ্চাত্য, ম্যাস্কুলিনফেমিনিন, অ্যাক্টিভিস্ট অ্যানার্কিস্ট, হয় না।কবিতা কবিতা-ই। যদি সেটা কবিতা না হয়, তবেই সেটা অন্য যা-কিছু হ’তে পারে। সাইকি এবার অন্য প্রসঙ্গে গেল। বললো, আপনি কখনো কাশ্মীরে গেছেন, ভূস্বর্গ কাশ্মীরে? আমি বললাম, গিয়েছি তো, গুলমার্গ পাহালগাম কোকরনাগ গিয়েছি। তবে আমার কাছে ওর চেয়েও ভালো স্বর্গ আছে, কাছেই আছে। সাইকি বললো, সত্যি? কোথায়? কীভাবে যেতে হয়? আমি বললাম, সব স্বর্গই তো পাব্লিক প্লেস নয়। মনোজগতে‘স্বর্গ’ খুবই ব্যক্তিগত একটা স্থান, যার একটা নিজস্ব কম্পন আছে। আমার যেমনআছে,একটাগোপন ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। তার গভীরে কিছু একটা কাঁপে।

চারতলার খোলা জানালা দিয়ে একটা ভ্রমর ঢুকেছিল, তারই পাখার আওয়াজ ঘরময়; ড্রোনের মতো, হামিং বার্ডের মতো। সাইকি তাকে লক্ষ ক’রেসোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।আড়চোখে জিগ্যেস করলো— কবিতা, না সিনেমা, কোনটা বেশি ভালো লাগে? আমি বললাম— কবিতার মতো যে সিনেমা।যা শুধুই অক্ষরে লেখা নয়। হ্যান্ডলুম, পটারি, রেড ওয়াইন, প্লাঁ-এয়ারপেইন্টিং, প্রাচীন পার্চমেন্ট, ফেরোমোন পারফিউম—এই সবও কবিতা। পিয়ানো, মোহনবাঁশি,রুদ্রবীণা, বেহালা,যাকিছু সঙ্গীত সৃষ্টি করে। একটা আদিম ফসিল, বালি হাঁসের নীলাভ ডিম,শুকনো ঝাউপাতা। একটা থেমে যাওয়া পুরোনো স্টীম ইঞ্জিনওকবিতার মতো সম্ভাবনাময়।

এরই মধ্যেভ্রমরটা জানালা দিয়ে উড়ে গেছে, এবংসাইকি আবার সোফায় বসে পড়েছে। আমাকে একবারও সে থামালো না, মাথা নিচু করে শুনে গেল। এবারে সেতার হাতের আইফোনটি দেখিয়ে বললো, আচ্ছা এটাও কি তবে কবিতা? আমি দেখলাম বহু ব্যবহৃত, স্ক্রিনের একদিকে চোট লাগা, ফোনটাকে। আমি বললাম,হতে পারে, যদি আপনার তেমন মনে হয়। আমি তো কবিতার কোনো নতুন সংজ্ঞা তৈরি করছি না। যার কাছে যা ভালো লাগে, যা সম্ভাবনাময়, তা-ই কবিতা;কসাইয়ের কাছে একটা রক্তমাখা ছুরিও। কবিতা খুবই অন্তর্গত একটা বোধ, একটা ইন্টিগ্রেশন, যাকে ঠিক সজ্ঞানে সম্পুর্ণনির্ণয় করা যায় না। সাইকি আবারও চুপ করে শুনলো। আমি বললাম, একটা পোষা ল্যাব্রাডোরও কবিতার মতো। পড়েননি, আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুরের মতো ব’সে থেকে, দেখেছি তার অন্তরের কুকুরকে? সাইকি বললো, ওই অন্তরের কুকুরটা নিশ্চয় সেই‘কবিতার মতো’ল্যাব্রাডোর নয়। হো হো হো হো। নিজেই হাসলো।জিগ্যেস করলো—আপনি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেন?একই স্বপ্ন, বারবার? আমি বললাম— দুঃস্বপ্নের কথা জানতে চাইছেন? মৃত্যুভয়, যৌনতা,বিষাক্ত ছোবল,প্রবল অন্ধকার,মরণ ঝাঁপ, হারিয়ে যাওয়া– যেগুলো ফ্রয়েড এবং ইয়ুং দু’ভাবে ব্যাখ্যা করেন? সাইকি বললো– হতেই পারে। আমি বললাম– ‘অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চাওয়া’-কে কি আপনি দুঃস্বপ্ন বলেন? মনোরোগ?

তৃণা ওয়াশরুমে গিয়েছিল। ফিরে এলে সাইকিতাকে, তৃণাকে, তার জাজমেন্ট শোনালো। বললো, আমার তো মনে হয় ওঁর বিশেষ কোনো সমস্যাই নেই। হয়তো আপনারই কোনো…।তৃণা চুপ করে শুনলো। কিছুই বললো না। সে কি খুশি হোল, নাকি বিস্মিত, হতাশ? তৃণা কি শুনেছে আমাদের কথা?তবে প্লামকেক খেয়ে সাইকি খুশি হোল। বললো, আমি কাল তিন মাসের জন্যে জার্মানিতে যাচ্ছি, ফিরে এসে আবারকেক খাবো।এমনভাবে বললো, যেন দুদিনের জন্য মধ্যমগ্রামে মামার বাড়ি যাচ্ছে।–কোনো মনোবিদের সাথে সেই আমার একমাত্র সাক্ষাৎকার। এনকাউন্টার অফ দা ফার্স্ট কাইন্ড।


আমার মনে হয়েছে, নারীকে জানতে হলে শহরে নয়, তাকে নিয়ে যেতে হয় প্রকৃতিতে। তৃণাকে নিয়ে কত নদীপথ, সাঁকো, চা-বাগান, ধানক্ষেত পার হয়েছি। কত ওয়াচ টাওয়ার, বনবাংলো, পাহাড় টিলা, শিকারি ঝর্ণা, সল্ট লিক, ওয়াটার হোল, ডার্ট রোড!!জঙ্গল সাফারিতে যেতে হয় ভোরবেলা, অথবা পড়ন্ত বিকেলে। আমরা দু’বেলাই গিয়েছিলাম। ওই সময়েই বন্যপ্রাণীরা জল খেতে আসে নদীতীরে, হ্রদে, অথবা জঙ্গলের ভেতরের ছোট ছোট পুকুর, বা ওয়াটার-হোলে। ভোরবেলায় হ্রদের ওপরে কুয়াশা জমে আছে। তৃণা একটা শাল জড়িয়েছে গায়ে। কাল রাতে ট্যুরিস্ট লজে কেন যে আমার ওপর রাগ ক’রে পাশ ফিরে শুয়েছিল!রাগ হলেই সে কথা বন্ধ করে দেয়। তবেআজ ভোরবেলার সাফারিতে বেশ ফ্রেশ লাগছে তাকে। চুল উড়ছে হাওয়ায়। জিপসিতে আমার বাঁ হাতটা সে জড়িয়ে ধ’রে বসেছে। আমাদের সামনে সিটে দুজন ডাচ তরুণ তরুণী, তারা এসেছে আমস্টার্ডাম থেকে। ধুলো ওড়ানো ডার্ট রোডের ওপরে,আমাদের জিপের পাশাপাশি উড়ে চলেছে একজোড়া পাখি। গাইড বললো, এগুলোকে বলে ‘রেড ওয়াটল্‌ড ল্যাপউইং’। পাখিদুটো পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে সমস্বরে ব’লে চলেছে— ‘ডিড-হি-ডু-ইট? ডিড-হি-ডু-ইট?’ আমি তৃণার কানের কাছে মুখ এনে বললাম—শোনো,পাখিরা তোমাকেই জিগ্যেস করছে মনে হয়।


[হ্রদের জলের ওপরে উড়ছে সেই ল্যাপউইং পাখি]

সাফারিতে অনেকানেক নিয়মের মধ্যে আছে—কোনও উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরা, বা কোনও পারফিউম ব্যবহার করা চলবে না। কথা বলা যাবে খুব নীচু স্বরে, ফিসফিস ক’রে, এবং কখনোই গাড়ি থেকে নীচে নামা চলবে না। মদ, সিগারেট, দেশলাই, আগ্নেয়াস্ত্রএকদম নিষিদ্ধ। অনেক বছর ধ’রে জঙ্গল সাফারি ক’রে এসব আমাদের জানাছিল। কিন্তু আমাকে তাজ্জব করেকোন বিশেষ ক্ষমতায়, চলন্ত জীপ থেকে ড্রাইভার বা গাইড (এঁরা ট্রেইন্ড ‘ন্যাচারালিস্ট’) গভীর জঙ্গলের ডালপালার আড়ালে কোথাও কোনও জানোয়ারকে এক ঝলকে ঠিক দেখতে পেয়ে যান।অথবা, কোথায় কোন উঁচু গাছের মগডালে একটা সার্পেন্ট ঈগল বসে আছে, এবং মুহূর্তেই গাড়ি থামিয়েছেন ঠিক সেই স্পটে!একবার বাঘের খোঁজে মাটিতে পাগমার্ক দেখে আমরাগাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ ক’রে কান পেতে আছি, কাছে-দূরে কোথাও কোনও ‘কল’ শোনা যাচ্ছে কিনা। বাঘকে কাছেপিঠে দেখলেই এই ‘কল’ দিয়ে ডাকে বার্কিং ডিয়ার, লেঙ্গুর, ময়ূর ইত্যাদি প্রাণীরা। আমরা বার্কিং ডিয়ারের ‘কল’ শুনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম, তবে বাঘের দেখা পাইনি। যেদিন সত্যিই দেখা পেলাম, সেদিন কোনও ‘কল’ ছিলনা, শুধু জীপ-রাস্তায় পাগমার্ক ছিল অনেক দূর অব্দি;ক্রমে তা জঙ্গলের গভীরে, শুঁড়িপথে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সেই পথ দিয়েই সে বেরিয়ে এলো। আমাদের জিপের সামনে দিয়েই আড়াআড়ি রাস্তা পেরিয়ে চ’লে গেল জঙ্গলের আরেক দিকে।

শহরে ফিরে আসার পর থেকে তৃণাকে আবার কিছুটা অন্যমনস্ক মনে হয়েছে। তার এই ঘন ঘন মুড স্যুইং আমাকে হয়রান ক’রে তোলে। কখনোনারাজ-ও। তৃণাএখন অন্য ঘরে শোয়, তাতে নাকি ভালো ঘুম হয়। আমার মনে পড়ছিল, অরিত্র-র সংগ্রহে ইতালো কালভিনো-র ‘ইনভিজিবল সিটিজ’-বইটার কথা। কালভিনো সেখানে লিখছেন— ‘It’s about the inferno where we live every day, that we form by being together. There are two ways to escape suffering.The first is easy for many: accept the inferno and become a party.The second is risky: seek and learn to recognize who and what, in the middle of hell, is not hell, then make them endure, give them space.’

সকালবেলা ব্রেকফাস্টের সময় টিভিতে খবরের চ্যানেলখুলে আমরা বিভ্রান্ত, অস্থির, ক্রুদ্ধ ও বিমর্ষ হয়েছি কতদিন। চীনামাটির প্লেটে ফল,রুটি-সবজি, অথবা ওমলেট,ব্রেড-টোস্ট, তার সাথে স্ক্রিন জুড়ে সাইবার ক্রাইম, গ্যাং রেপ, চলন্ত ট্রেনে আগুন, ফসল হারানো চাষির বিষপান, ব্যাঙ্ক ডাকাতি, প্লাবনে ভেসে যাওয়া সংসার, পরকীয়া ও খুন, দুধের শিশুকে কুয়োয় নিক্ষেপ,শপিং মলে শ্যুট আউট, এটিএম লুট, সমবায় ব্যাঙ্কে তছরুপ, বিষাক্ত মদে মৃত্যু, মোমবাতি মিছিল, জামতাড়া গ্যাং…শুধুই এইসব! কত রকমের ব্রেকিং নিউজ, কখনো অন্ত্যমিল সহযোগে!তারই ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন, জিংগ্‌ল্— টিএমটি স্টিল, এসইউভি,ডিওডোরান্ট,চ্যাট জিপিটি। এবং কত রকমের কনডোম–সুগন্ধী,সুস্বাদু।চেরি, স্ট্রবেরি, কোকো, পাইন্যাপেল।এই বিস্তীর্ণরঙ্গভূমিতে সার বেঁধে চলেছে কত গন্ডার, সরীসৃপ, বাদ্যকর ও কবি। দরবারি কবি, বামন কবি, দীর্ঘাঙ্গী কবি। নানা রঙের নিশান। কত বাজিকর। কত রকমের ঘড়ি। কোনোটা দ্রুত চলছে, কোনোটা খুব ধীরে। কোনোটা বহুকাল ধরে স্থির, মৃত, হিম।ঘড়ি বলছে—আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে, তোমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে, তাহার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে…। কী বিশ্বাসে কে বলছে, কারে, ভালো হবে দিনকে দিন, দিনকে দিন !!

সন্ধ্যেবেলায় আমি যখনআগামী বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছি, তৃণা তখন টিভিতে মগ্ন। সেখানে তখন আমাজনের বর্ষাবন অথবা, আফ্রিকার বিস্তীর্ণ সাভানা।…সাভানা বলতেই আজও আমার শোভনার কথা মনে পড়ে যায়, সে আছে কাজাখস্তানে। আমার মত তারও প্রিয় পশু ঘোড়া। বিকেলের আলো প’ড়ে এলে, খামার বাড়ির জানালা দিয়ে দূরের তৃণপ্রান্তরে সে তার আস্তাবলের ঘোড়াটিকে যেমন তীব্র সুরেলা ডাক দেয়—জিইইইইই… নোওওওওওও!

সন্ধে থেকে তৃণার চোখে কেবলই অ্যানিমাল প্ল্যানেট।কেবলই আফ্রিকা।পাইথন, লেমুর, মিরক্যাট, স্লথ বেয়ার, জেব্রা অথবা হাতির ঝুঁন্ড। উইল্ডেবিস্টের মাইগ্রেশান। বার্কিং ডীয়ারের মেটিং কল। হরিণের পেছনে ছুটন্ত চিতা, একটু পরেই যে টুঁটি চেপে আছড়ে ফেলবে একটা সম্বরকে। সঙ্গমরত দুটো লেপার্ড। মৃত বাইসনের পেটের নাড়িভুঁড়ি ও মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে সারামুখে রক্তমাখা একদল হাইনা। তৃণার খুব পছন্দ পশুশাবকদের। মা-চিতার পেছন পেছন চলেছে তার চারটে কচিকাঁচা; জুতোমোজা আর উলের সোয়েটার পরা, গুটি গুটি। অথবা হাতির পালের ভেতরে, ভারি ভারি থামের মতো পাগুলোর মাঝখানে, একেবারে নিচে চোখ পড়লে দেখা যায় একটা পুঁচকে শাবককে, হয়তো তার বয়স মাত্র কয়েক সপ্তাহ। অথবা ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে একটা ম্যাজেস্টিক রাজহাঁস, তার পেছন পেছন লাইন দিয়ে চলেছে তার দশ-বারোটা ছানা। আমার মনে পড়লো সেই বিখ্যাত ‘লিডা অ্যান্ড দা সোয়ান’-ছবিটার কথা; গ্রীক পুরাণে বর্ণিত রাজা জিউস একটি রাজহাঁস হয়ে ধর্ষণ করেছিলেন স্পার্টার রানি লিডা-কে।সেই কাহিনী নিয়ে ছবি এঁকেছে কত চিত্রকর! কিন্তু তৃণা এখন পুরাণের গল্প শুনবেই না, তার চোখ শুধু ওইসব শাবকদের দিকে। কিছুক্ষণ পরে সে আমাকে ডেকে দেখালো, তিরিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে কয়েক হাজার সাইবেরিয়ানবুনো হাঁসের একটা বিশাল ঝাঁক রাতের অন্ধকারে উড়েচলেছেসাইবেরিয়া থেকে কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায়, একটু উষ্ণতার খোঁজে। এই পথেই তোআসে যায় আমুর বাজপাখিরাও, আমি বললাম। তৃণা বললো, সে যখন বোস্টনে কম্প্যারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়ছিল, তখন ওদেশেও এরকম রাত্রিকালীন বার্ড মাইগ্রেশনের কথা শুনেছে। ক্যাম্পাসের সব আলো আগে থেকে সময় জানিয়ে,নিভিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়া হোত।


[লিডা এবং রাজহাঁস]

এইসব দৃশ্য চলতে থাকবে আমাদের ডিনার টেবিল পর্যন্ত। কোথাও বিস্তীর্ণ অরণ্য পুড়ে যাচ্ছে দাবানলে, কখনো সাইবেরিয়ায় তুষারপাত, আর্কটিকের রাতের আকাশে সবুজ আলোর মেরুপ্রভা। আর্কটিক সার্কেলের আরও ওপরে, টার্কোয়াজ রঙের একটা বিশাল আইসবার্গের একাংশ সহসা ভেঙে পড়লো জলে। এই ভয়ঙ্কর ও সুন্দর মহাপৃথিবীর একপাশে বসে কত রাত আমরা দুজনে সামান্য বাটার টোস্ট আর স্যুপ খেয়েছি ; পোর্সেলিনের বাটিতে গরম সুইট কর্ন স্যুপ। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। শেয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শেডের নীচে দাঁড়িয়ে আছে ক্যানিং লোকালের বৃষ্টিভেজা জবথবু যাত্রীরা। আবর্জনার পাশে,বড় গোল হিউম পাইপের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে ভিখারি মা ও শিশু। জলের ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে প্লাস্টিকের হাতা খুন্তি পুতুল। 

তৃণা চলে যাওয়ার পরে কোনোভাবেই আমি আর তার সন্ধান পাইনি। কোনো ঠিকানা সে দিয়ে যায়নি, ফেসবুকেও নেই, ফোন সুইচড অফ। হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রাম, ট্যুইটার, কোত্থাও পেলাম না তাকে। সে শুধু বলেছিল—দেখবে, একদিন ভোরে উঠে চলে যাব, ব’লে যাব না। সেইমতো একটা বড় স্যুটকেস নিয়ে সে বেরিয়ে গেছে। আমি তখন গহন ঘুমের ঘোরে। সেদিনও কি ভোরের আকাশ গানে গানে ভরা ছিল?

অফিসের কাজ এখন অনলাইনে অনেকটাই সারা যায়। মোবাইল অফ ক’রে,পরদিন সারাদিন আমি ঘুমোলাম। আজ পরিচারিকারও ছুটি। তৃণা মাঝে মাঝে তার দিদির বাড়ি যেত বেহালায়। ফোন করে জানা গেল, সেখানে যায়নি সে। তবে সে গেল কোথায়! তার এক কাজিন নাকি থাকে পুণায়।আমাকে না জানিয়ে অচেনা কার কাছে, কিসের আকর্ষণে, কত দূরে চলে গেল সে? কেমন সেই অজানা অদ্ভুত আকর্ষক,আমি যাকে এতদিন জানতেও পারিনি!

সে কি তবে আবার বোস্টনে ফিরে গেল?বলেছিল, আরেকবার যেতে হবে। প্রথমবার যখন সেখানে তিন বছর ছিল, তখনো তার সাথে আমার আলাপ হয়নি। দেশে ফিরে, আমার সাথে থাকতে শুরু করার অনেকপরে,তৃণা একদিন আমাকে বোস্টনের ছবি দেখিয়েছিল। ছবিতেতার এক সহপাঠী, রেহান নামের এক তরুণ স্কলার, যাকে নিয়ে সে ছুটিতে ঘুরতে যেত। –ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের ওপরে তৃণা আর রেহান। চারিদিকে ঝ’রে প’ড়ে আছে নানা রঙের মেপল পাতা; কমলা, হলুদ, লাল, বেইজ, পার্পল, সিয়েনা, হানি! সেই ছবি রয়ে গেছে আমার স্মৃতিতে।

মনে পড়ে না কোথায় প’ড়েছি, সম্ভবত গোদারের ‘ন্যুভেল ভেগ’ সিনেমায়— ‘স্মৃতিই আমাদের একমাত্র স্বর্গ, যেখান থেকে কেউ কখনো নির্বাসিত করতে পারবে না আমাদের’। –তৃণা যদি কখনো ফিরে আসে, তবে আবার তাকে নিয়ে অরণ্যে যাবো আমি, আলোকঝারি পাহাড়ে, বাঁশ আর হরজাইয়ের জঙ্গলে। অথবা কোনো হিল স্টেশনে। রাতে যখন শিশির পড়বে, আমরা কাঠের আগুনের পাশে বসে গান গাইবো মৃদুস্বরে, যে গানটা আমরা দুজনে মিলে একদিন লিখেছিলাম, সুর দিয়েছিলাম।

আমার যেমন প্রিয় গানডালিয়া লাভির গলায় ‘এল কন্ডোর পাসা’, অথবা, বেলাফন্টের ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’,তৃণার তেমনি ভালো লাগতো কার্পেন্টার্সদেরসেই বিখ্যাত গানটা–‘ইয়েস্টারডে ওয়ান্স মোর’। একবার হিল-স্টেশনে, ক্যান্ডল-লাইট ডিনারের শেষে খুব আস্তে সে গেয়েছিল গানটা; একটু দূরে ব’সে, জানালা দিয়ে বাইরে আঁধার রাতের দিকে মুখ ক’রে, সজল চোখে– “Those were some happy times and not so long ago, …But they are back again Just like a long-lost friend… Every Sha-la-la-la, every Wo-o-wo-o still shines…” ।গান শেষ হ’লেতৃণানীরবে কেঁদেছিলএকটু।তার হাতের মুঠোয় ধরা ছিলগোলাপি রঙের একটা শুকনোপনসেটিয়া ফুল, সজল চোখে যা সেআমার হাতে দিয়েছিল।সেইসব স্মৃতিরা আজ ভিড় করে আসছে মনে। একদিন সে একটা মেট্রো স্টেশনের কথা বলেছিল– নিউটাউনে, নতুন হয়েছে নাকি, স্টেশনের নাম ‘স্বপ্নভোর’।

তৃণাহীন ঘরের বাইরেএখন সন্ধ্যার আকাশে একটু একটু ক’রে তারকারা দেখা দিচ্ছে। ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে, জান্নাতের সব ফুল বুঝি। রাত বাড়লে, হঠাৎই ঝোড়ো হাওয়া আর মেঘের ডাক। উল্লম্ব মেঘের মাঝে পারমাণবিক চুল্লী থেকে আমাদের কার্পেটের ওপরে ঝলসে উঠলো ফিরোজা রঙের প্রচন্ড বিদ্যুৎ। সহসা দরজায় যেন কার ভয়ঙ্কর লেজের ঝাপট আর কড়কড় বাজ! বৃষ্টি নামলো। –এই জীবনে কতরকম মেঘের মউজের মধ্য দিয়েই তো গিয়েছি আমি। কখনো তারা পেঁজা তুলো, ক্ষীর সমুদ্র, উড়ন্ত শিফন। কখনো কালো পাথরের বিশাল চট্টান, আর ভারী দুর্গের মতো বজ্রগর্ভ, ঝলকানো মেঘ।

অনেক রাত অব্দি আমি একা,রাগ মালকোষ শুনে কাটালাম। কাঁদলাম কখনো।উস্তাদ রাশিদ খান গাইছেন- ‘আজ মোরে ঘর আয়ে না বালমা’।–কেন বারবার আমার সাথে এরকম হবে, ভাবতে ভাবতে কখনযেন ঘুমিয়ে পড়েছি।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নের ভেতরে কে যেন নাম ধরে ডেকেছে।আজ আমার হঠাৎ মনে হোল, ধৃতিমান নামটা তো ভালোই। কিন্তু এর অর্থ কি আমি জানি? বিছানায় শুয়েই, জীবনে এই প্রথমবার নিজের নাম গুগলে চেক ক’রে দেখলাম, ধৃতিমান শব্দের অর্থ :যে সহিষ্ণু, যার চিত্ত স্থির, যার ধৈর্য আছে, সঙ্কল্প আছে। –হে ঈশ্বর, বাঁচালে আমাকে, মৃত্যু অব্দি তবে এই নামটাই থাকুক আমার। এতক্ষণে বিছানা থেকে নেমে নতুন একটা দিনের জন্য তৈরি হয়ে উঠলো আমার শরীর ও মন। কী যে আমাদের চালিত করে জীবনে, আমি আজও জানি না।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে আজ আমি একা।আজ কিছুতেই টিভি খুলতে ইচ্ছে হোল না। আমি জানি, আমার ব্রেকফাস্টের সময়টুকুর মধ্যেই, আজও,মুর্শিদাবাদ আর মালদহে কোথাওগঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে যাবে নদীপাড়ের আরো কুড়িটা বাড়ি, তিনটে মুদি দোকান, একটা গোটা প্রাইমারি স্কুল, একটা সমবায় ব্যাঙ্কের একাংশ। রোজ রোজ অসহায়ের মতো চেয়ে দেখতে হবে এইসব!রাম রহিমেরএই দেশ ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে জাহ্নবীর জলে। অনেকদিন পরে আজ ডায়েরিতে লেখা সেই কবিতাটা মনে পড়লো: …উঠোনে দোলনা বাঁধা, হাঁড়িতে কিছুটা মদ ছিল / দরজায় লেখা ছিল সাতশো ছিয়াশি / মাটির দেওয়ালে আঁকা ছিল / মালা হাতে সীতা, পাশে অতিকায় ধনুর্ধারী রাম। –এই সবই গতকাল ছিল, আজ তারা নদীগর্ভে।

তৃণা চলে যাওয়ার পরে, আজ আমার প্রথম মনে পড়লো কলেজে পড়া ‘জোহারি জানালা’-র কথা।মনোবিদদের কল্পনায় প্রত্যেক মানুষের মনের ভেতরে যেন চারটে জানালা আছে। অথবা, তারা যেন পৃথক চারটে বাড়িই। সকলের মাপ বা আয়তন সমান নয়; কোনো বাড়ি বড়, কোনোটা কিছু ছোট। 

১। প্রথম বাড়িটারমানে সেইসব, যা একজন মানুষ তার নিজের সম্বন্ধে জানে, এবং তার সম্বন্ধে সেইসবই জানে তার পরিচিত আত্মীয় বন্ধু সহকর্মীরাও। যেমন তৃণা জানে সে মেধাবী, আকর্ষণীয়, মিশুকে, চঞ্চল, মুক্তমনা। এবং তার পরিচিতরাও তাকে সেরকমই ভাবে। –যেকোনো মানুষের সাথে আমরা মিলিত হই মনের এই বাড়িতেই।

২। দ্বিতীয় বাড়িটার মানেনিজের সম্বন্ধে সেইসব, তৃণাযা নিজে জানে না, কিন্তু অন্যরা জানে, যেমনটা তারা মনে করে তাকে। তার বদভ্যাস, মুদ্রাদোষ, কুসংস্কার, বা শঠতাগুলো, যা অন্যরা কখনো টের পেয়েছে, আড়ালে যা নিয়ে আলোচনাও করে, কিন্তু তৃণা তা জানে না।জানলে সে বিস্মিত, আহত হোত।

৩। তৃণার তৃতীয় বাড়িটাই এখন আমার কাছেসবচেয়ে জরুরী। হয়তো এইটাই তার সবচেয়ে বড় বাড়িটা,যেখানে রয়েছে তার জীবন, মন ও চরিত্রের সেইসব কথা, যা শুধুমাত্র সে-ই জানে, কিন্তু অন্য কেউ তার এই দিকগুলো জানে না। কেউ না। এই বাড়িতে ঢোকার বায়োমেট্রিক চাবি আছে শুধু তৃণার নিজের কাছে।

৪। আর চতুর্থ বাড়িটা সবদিক দিয়েবন্ধ, যার সম্বন্ধে তৃণানিজে, বা বিশ্বের অন্য কেউ, কিছুই জানে না। সকলের অজ্ঞাতে এমন একটা বাড়ি, যার কোনো দরজা নেই, জানালাও নেই! ভেতরে আলো না অন্ধকার, কিছুই জানার উপায় নেই।সেখানে কারো প্রবেশ অসম্ভব, তৃণারও। কোনো জাগ্রত চেতনা নেই সেখানে। অথচ, বাড়িটা তৃণার। এই ঘরের সামান্য আন্দাজ হয়তো পেতে পারেন মনোবিদরা। মনের গভীর নির্জনে, এই বাড়িটার সাথেই নাকি যোগ আছে বিশ্বাত্মার।

প্রায়ই আমার মনে হয়েছে তৃণারতৃতীয় বাড়িটার কথা। তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই হয়তো অজানা র’য়ে গেছে, যা শুধু সেই তৃতীয় বাড়িটা জানে। তৃণার কি অন্য কোনো পরিচয় আছে? সে কি কোনো গোপন কাজে যুক্ত? কোনো ডার্ক ওয়েব? আন্তর্জাতিক স্পাই? সিক্রেট এজেন্ট? –অসম্ভব। আমি প্রবল অবিশ্বাসে বিছানায় আছড়ে পড়ি। বিছানার চাদর যেন আজ উত্তাল সমুদ্র। জাহাজডুবির এক নাবিক যেন ভেসে আছে ভাঙা মাস্তুলের কাঠ ধ’রে।


প্রায় দু’বছর পর আজ রূপক এসেছিল দেখা করতে। রূপক আমার স্কুলের বন্ধু। সেই শ্যামপুকুর স্ট্রীট, সেই হাতিবাগান। তৃণার সাথেও ওর আলাপ হয়েছিল। তবে তৃণার চলে যাওয়ার কথা জানতো না। চুপ করে শুনলো। রূপক বললো, চল, একটা নতুন প্রোগ্রামে নিয়ে যাব তোকে। রাজারহাটের কাছে মেট্রোর একটা স্টেশন আছে, যার নাম স্বপ্নভোর। সেই স্বপ্নভোর স্টেশনে একটাদারুণ পানশালা খুলেছে– ‘ক্যাবারে ভলতেয়ার’। আমি বললাম, জুরিখের সেইটা? ডাডাইজম, ত্রিস্তান জারা, সেই? রূপক বললো—হ্যাঁ, একই নাম। ওখানে একজন আমন্ত্রিতবিদেশী ঔপন্যাসিক তাঁরআগামী বইয়ের পান্ডুলিপির তিন-পাতা টেক্সট লিখবেন, বড় পর্দায় তারই লাইভ স্ট্রীমিং। কীভাবে লেখাটা তৈরি করছেন, এডিট করছেন, শব্দ কাটছেন, বদলাচ্ছেন, যতিচিহ্ন দিচ্ছেন, ভাবছেন, আবার লিখছেন–সব দেখা যাবে, লাইভ। বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রত্যেক মঙ্গল আর শনিবারে হয়, দেড় ঘন্টা। শোয়ের নাম ‘থ্রি পেজেস’। দুদিন আগে থেকে টিকিট বুকিং করতে হয়। মাত্র তিরিশটা সিট।আজ আছেন একজন মেক্সিকান লেখক, বুকার প্রাইজের জন্য নমিনেটেড।


[ক্যাবারে ভলতেয়ার]

ভেতরে ঢুকে দেখলাম, একধারে কয়েকসারি বুকর‍্যাক। অনেক বই সাজানো রয়েছে। অক্সফোর্ড, পেঙ্গুইন, রূপা, হার্পার কলিন্স। এবং তাদেরই মধ্যে তৃণার লেখা সেই বইটাও;পলিনেসিয়া দ্বীপপুঞ্জের মাওরিদের সংস্কৃতি, উপাসনা, বিবাহ পদ্ধতি এইসব নিয়ে তার প্রিয় গবেষণা। খুব সুন্দর বই। আমি পড়েছি।

তৃণার ইচ্ছে হয়েছিল, একদিন আমরা বন্ধুবান্ধব ডেকে দুজনে রেজিস্ট্রি করবো। এবং বিয়ে হ’তে পারে মাওরিদের প্রথানুসারে। খাওয়াদাওয়া, হইচই। বন্ধুরা মাওরি ভাষায় আশীর্বাদ করবে—‘কিয়া হোরাহিয়া তে মারিনো; কিয়া কানাপা তে মাতা ও তে মোয়ানা আনো হি পৌনামু…’ ইত্যাদি।বাংলায় যার সরলার্থ—‘তোমাদের জীবনে শান্তি ছড়িয়ে পড়ুক; সংসার-সাগরের উত্তাল জলরাশিচিরদিন ঝলমল করুক সবুজ পান্নার মতো; আজ থেকে তোমাদের চলার পথে অবিরাম বয়ে চলুক বসন্তবাতাস’। –মাওরিদের নিয়েতৃণার লেখা এই বইটা আজও আমার কাছে আছে।আজ ক্যাবারে ভলতেয়ার-এ ঢুকেসেই বইটাই আবার মনে পড়িয়ে দিল, তৃণা নেই।

আরও কিছু বই রয়েছে র‍্যাকে। সুদৃশ্য পেপারব্যাক, হার্ডবোর্ড, নভেলা, ফিকশন। ‘হেভিওয়েট’ লেখকদের বাংলা থেকে ইংরিজি অনুবাদও। কয়েক পাতা ওল্টাতেই বোঝা গেল বেশিটাই হাবিজাবি, গার্বেজ।রূপক বললো— ইফ দে কান্ট ডিস্ক্রিমিনেট বিটুইন লিট অ্যান্ড শিট, হোয়াই শুড উই ডার্টি আওয়ার হ্যান্ডস !!

তৃণা মাওরিদের ভাষা শেখেনি। তবে সে স্প্যানিশ শিখেছিল; গোলপার্ক, নাকি পার্কস্ট্রীটের কোনো এক জায়গায়। আমি কখনো ক্ষুব্ধ হলে, বা রাগ করলে, সে চুপ করে থাকতো। কিছুক্ষণ পরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে স্প্যানিশে বলতো— ‘আই কোরাজন, সুয়েনা এন সিলেন্সিও’। অর্থাৎ, ‘হে হৃদয়, নিঃশব্দে বাজো’। বলেই একবার জোরে ফুঁ দিত আমার কানে।  

সেই তৃণা আমাকে কিছু না ব’লে হঠাৎই কোথায় চলে গেল! শুধু ড্রেসিং টেবিলের ওপরে তাজ হোটেলের একটা ছোট্ট কাগজে সে লিখে রেখে গেছে- ‘ভালো থেকো’। এই সেই কাগজ– গেস্ট স্টেশনারি– ওপরে লেখা‘হোটেল তাজ কোন্নেমারা’, চেন্নাই। একবার তৃণাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়ে একরাত ছিলাম সমুদ্রতীরের সেই হোটেলে। সেদিন রাতে নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে, সৈকতবালুতে,তাজের বার-বি-কিউ ডিনার। অদূরে অন্ধকারে ঢেউয়ের শান্ত উচ্ছ্বাস। মাঝে মাঝে আমাদের পায়ের খুব কাছে চ’লে আসছিলফেনিল জলস্রোতের প্রান্তিক উজ্জ্বল রেখাগুলো।সমুদ্র ফসফরাস।

সেই হোটেলেরইছোট্ট একটা প্যাড,স্যুভেনির ভেবে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল তৃণা। সেইকাগজেইআমাকে লিখে গেছে- ‘ভালো থেকো’।আমি তার ঠিক নিচেলিখে দিয়েছি, কবেকার ইমেজিস্ট কবি এমি লোয়েলের লেখা একটা কবিতার লাইন: ‘যদি জোনাকিদের সবুজ আলোর লন্ঠনটি আমি পেতাম, হয়তো একটা চিঠি লিখতে পারতাম তোমাকে’।-তৃণা যদি কোনোদিন আমার কাছে ফিরে আসে আবার, তবে সে দেখবে লেখাটা।

ড্রেসিং টেবিলে,ওয়াশরুমে,আয়নার কাচে ইতস্ততলেগে আছে তার কপালের কয়েকটা বিন্দি। বাথরুমের শেলফেপ’ড়ে আছে ব্যক্তিগত সুগন্ধী, শাওয়ার জেল, লুফা, শ্যাম্পু। কেবল টুথব্রাশটা নেই।তৃণা ভালোবাসতো ফলের গন্ধ, স্ট্রবেরি, অরেঞ্জ, পাইন্যাপেল। তার সেই বোস্টনের বন্ধু রেহান একবারকাজাখস্তান থেকে তাকে একটা পারফিউম পাঠিয়েছিল, যার নাম– রেশমি পথের গান, ‘সাগা অফ দা সিল্ক রুট’।কোনো কোনো বিশেষ দিনে, যেমন মাল্টিপ্লেক্সে ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটা দেখার দিন, তৃণা এটা পরেছিল।

এই পারফিউমটা বেশ জটিল, রাত বাড়লে এর আবেদনও বাড়ে। এর টপ নোটে যেমন গোলমরিচ ও  সম্ভ্রান্ত ওয়ার্মউডের গন্ধ আছে, তেমনই হার্ট নোটে মিশেছে রেড ওয়াইন, দারুচিনি এবং পাচৌলিরসুগন্ধ। আর গভীরে, বেস নোটে আছে রোজউড, স্যান্ডালউড,অ্যাম্বার ও রেজিন।পারফিউমটার রচয়িতা- সারা ম্যাকার্টনি।এই পারফিউমের গন্ধ আমার ভেতরে একটা অস্থির চঞ্চলতা এনে দিত। মনে হোত,এর মধ্যেআছে বুঝি মির্জা গালিবের শায়েরি, বিসমিল্লার সেহনাই, মসজিদের আজান, নূপুরের নিক্কন…। বিভ্রান্তি ক্রমে অবশ ক’রে আনতো আমাকে। মন বলতো, রেহান এটা উপহার দিয়েছে তৃণাকে। যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই।

তৃণার সাথে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল গোর্কি সদনে।সে যখন বোস্টন থেকে ফিরে এসেছে। হিসেব ক’রে দেখলাম, মাত্র সাড়ে তিন বছর সে আমার সাথে ছিল। অথচ মনে হয় যেন কতদিন আমরা দুজনে একসাথে! একদিন তাকে বলেছিলাম, কাজাখস্তানের টিয়ান-শান পাহাড়ের আপেল বনের কথা। ‘টিয়ান-শান’ শব্দের অর্থ,স্বর্গীয় পাহাড়। সেখানকার বুনো আপেলই নাকি বিশ্বের সমস্ত আপেলের পূর্বপুরুষ, এখান থেকেই ছড়িয়েছে সারা পৃথিবীতে; আপেলের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি জানিয়েছেন জিনোম-বিজ্ঞানীরা। দারুণ নাকি তার স্বাদ ও গন্ধ।বাইবেলে কথিত আদম আর ইভ নাকি এই আপেল খেয়েই শাপগ্রস্ত হয়েছিলেন।তৃণা বলেছিল– এই তবে সেই স্বর্গীয় উদ্যান? আমরা তাহলে টাকা পয়সা জমিয়ে একবার যাবো সেখানে, শাপমুক্ত হ’তে। যাবে তো?


‘ক্যাবারে ভলতেয়ার’-এ শো চলছে। স্ক্রিনে লক্ষ করলাম, কলম থেমে আছে কিছুক্ষণ। লেখক যেন কী ভেবে আগের প্যারায় ফিরে গেলেন, যেখানে লিখেছিলেন– জানালায় আজ কোনো পাখি আসেনি। কেটে লিখলেন, জনমানবহীন নদীতীর। আবার থামলেন। এবার নদীতীর বদলে লিখলেন খেয়াঘাট। জনমানবহীন খেয়াঘাট, কোনো নৌকো ছিল না কোথাও। কয়েক মুহূর্ত ভেবে, দ্রুত হাতে আবার সাজালেন লাইনটা– জনমানবহীন খেয়াঘাট, কোথাও কোনো নৌকো ছিল না। আসলে উনি লিখছিলেন ইংরিজিতেই। কিন্তু সেটা সেই মুহূর্তেই বাংলায় অনুদিত হয়ে আমাদের স্ক্রীনে চলে আসছিল! -আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ওপেন এ-আই!এমন জিনিস আমি এই প্রথম দেখলাম। দিনকাল কত দ্রুত পালটে যাচ্ছে।

আমাদের প্লেটে ছিল গ্রিলড স্যান্ডউইচ এবং মাগ ভর্তি বীয়ার। সব টেবিলেই খাওয়াদাওয়া চলছে, নিচু স্বরে কথাও। মাঝে মাঝে পর্দায় টেক্সটে দুএকটা এডিট অথবা, দারুণ নতুন কোনো লাইন দেখলে দর্শক সমস্বরে—আহা, ওয়াহ, ওঃ !হলঘরের বাঁদিকে একটা অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড, সাত-আটজন পুরুষ। ফাঙ্কি ড্রেস, ঝাঁকড়া চুল, দুজন আফ্রিকানও। তারা তৈরি হচ্ছে। মেক্সিকান লেখকের পরেই বোধহয় তাদের প্রোগ্রাম।

একসময় স্ক্রিনে দেখা গেল, লেখকের ডায়েরির পাতা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কালো কালো পিঁপড়ে। পাঁচটা, দশটা, ক্রমে আরও অনেক। ক্লোজ-আপে দেখা যাচ্ছে তাদের দাঁড়া। আমি বললাম, এরপরে হয়তো একটা ছুরি বের করে উনি কাটতে যাবেন চোখের মণিটা। রূপক বললো, কী কান্ড! বুনুয়েলের সেই ‘আন্দালুশিয়ান ডগ’ ছবিটার মতো নাকি?চল, আমরা উঠি।

*

শ্যুটিং ক্রু এবং ক্যামেরা এবার পানশালার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ছবির নাম— ‘তৃণার তৃতীয় বাড়িটা’।আজ ছবির শেষ দৃশ্যের শ্যুটিং। বাইরে তখন বসন্তের হাওয়া। সন্ধ্যা নেমেছে, তারা ফুটেছে আকাশে। কালপুরুষের বাম কাঁধে উজ্জ্বলহলুদ ‘বেটেলজিউস’ নামের নক্ষত্রটা; যেকোনো দিন সে সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে। রূপক আর ধৃতিমান এগিয়ে যাচ্ছে পার্কিং লটের দিকে।ক্যামেরা ও ব্যুম তাদের ফলো করছে। মায়াবী আলোয় ভাসছে শহর।

ধৃতিমান বললো–ভাবছি, আজ বাড়ি ফিরে আকাশের সব নক্ষত্র মিশিয়ে একটা পানীয় বানাবো আমি, রঙীন কাঁটাওয়ালা বিরাট নক্ষত্ররা ; অথবা লাল কিংবা বেগুনি রঙের ছোট্ট তারাগুলো; শান্ত, হিম, সবুজ…। যেমনটা কবিতায় লিখেছিলেন এমি লোয়েল।

ক্যামেরা এবারটিল্ট-আপ ক’রে দেখছে সন্ধ্যার আকাশের প্যানোরামা। শহরের উজ্জ্বলতা পেরিয়ে, সুদুর আকাশ যেখানে প্রুশিয়ান ব্লুয়ের ওপরে একটা কালো রঙের শাল জড়িয়ে নিয়েছে, সেখানে এখন অনেক তারকা। ক্যামেরা সেই ক্যানভাসকে ধরেছে। নির্মেঘ আকাশ, কোথাও কোনও মেঘ নেই। একটা তারা খসে পড়লো দিগন্তের কাছে।এবার ওরা দুজনে গাড়িতে ঢুকেছে। গাড়ি চালাচ্ছে রূপক, পাশে ধৃতিমান। একটা হুডখোলা জিপে চ’ড়ে ক্যামেরা ওদের পাশাপাশি চলেছে।

বিশ্ববাংলা সরণি এখন ঝলমল করছে আলোয়। ট্রাফিকের ভীড়। কত রকমের গাড়ি এখন শহরে। হ্যাচব্যাক, সিডান, বাইক, জীপ, এসি বাস, এসইউভি। ধৃতিমানদের গাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল একটা দ্রুতগামী‘হার্লে ডেভিডসন’ বাইক। যুবকের মুখ হেলমেটে ঢাকা। পিলিয়ন সীটের তরুণী এক ঝলক মুখ ফেরাতেই ধৃতিমানের হৃৎকম্প, মনে হোল তৃণা !! পরক্ষণেই মনে হোল, না, তৃণা নয়, তবে অনেকটাই তৃণার মতো।   

গাড়িতে রূপক জিগ্যেস করলো ধৃতিমানকে :বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো?

ধৃতিমান বললো, এ তো বোদল্যেয়রের কবিতা।

রূপক বললো, তা হোক, তুমি বলো। কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো? তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, অথবা ভগ্নীকে?

ধৃতিমান:পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী—কিছুই নেই আমার।
রূপক: তোমার বন্ধুরা ?
ধৃতিমান:ওই শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।
রূপক: তোমার দেশ?
ধৃতিমান:জানি না কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান।
রূপক (ভেবে): সৌন্দর্যময়ী তৃণা ?
ধৃতিমান:পারতাম বটে তাকে ভালোবাসতে—রহস্যময়ী সেই দেবী।
রূপক: বলো তবে, অদ্ভুত অচেনা মানুষ, কী ভালোবাসো তুমি?
আকাশের নির্মেঘ আঁধারের দিকে চেয়ে ধৃতিমান বললো: আমি ভালোবাসি মেঘ… চলিষ্ণু মেঘ… ওই উঁচুতে… ওই উঁচুতে…। আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত