ইরাবতী ধারাবাহিক:ফুটবল (পর্ব-১৫) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
অষ্টম শ্রেণির দুই বন্ধু রাজ আর নির্ঝর। রাজ আর অনাথ নির্ঝরের সাথে এইগল্প এগিয়েছে ফুটবলকে কেন্দ্র করে। রাজের স্নেহময়ী মা ক্রীড়াবিদ ইরার অদম্য চেষ্টার পরও অনাদরে বড় হতে থাকা নির্ঝর বারবার ফুটবল থেকে ছিটকে যায় আবার ফিরে আসে কিন্তু নির্ঝরের সেই ফুটবল থেকে ছিটকে যাবার পেছনে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নির্ঝরের জেঠু বঙ্কু। কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বঙ্কু ও তার ফুটবলার বন্ধু তীর্থঙ্করের বন্ধুবিচ্ছেদ। কিন্তু কেন? সবশেষে নির্ঝর কি ফুটবলে ফিরতে পারবে? রাজ আর নির্ঝর কি একসাথে খেলতে পারবে স্কুল টিমে? এমন অনেক প্রশ্ন ও কিশোর জীবনে বড়দের উদাসীনতা ও মান অভিমানের এক অন্য রকম গল্প নিয়ে বীজমন্ত্রের জনপ্রিয়তার পরে দেবাশিস_গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন কিশোর উপন্যাস ফুটবল আজ থাকছে পর্ব-১৫।
একটু পরে ঘন্টা পড়ল।স্যার চলে যাবার পর সে ঘরে ঢুকল। ইমনরা তখনও তাকে দেখে ফিকফিক করে হাসছে। তা নিয়ে এখন সে আর ভাবল না ।সাইকেল-অভিযাত্রীর জন্য সে এখন উত্তেজিত। সে নিজের সীটে বসে পাশে বসা প্রান্তিককে বলল, “এই লোকটা এসে গেছে। জানিস?”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।এই তো দেখলাম।সাইকেলটা মনে হল একটু অন্যরকম।
আরো দু-একজন ক্লাসরুমের বাইরে উঁকি মারল। প্রথম বেঞ্চে বসা বর্নিক মাথা ঘুরিয়ে বলল,“ মনে হচ্ছে আর ফোর্থ পিরিয়ড হবে না। কোনো স্যার স্ট্যফরুম থেকে বেরোন নি।“
সুজয় চেঁচিয়ে উঠল।“ ইয়া!”
সত্যিই ফোর্থ পিরিয়ড হল না! দু-চারজন ছেলে স্টাফরুমের কাছে দৌড়ে গেছিল।তারা দেখে এসেছে দিবাকর-বাবুকে নিয়ে টিচাররা ঘিরে ধরে আছেন। দিবাকর-বাবুর অভিজ্ঞতা জানতে চাইছেন। স্যাররাও এখন তাদের মত তুমুল আগ্রহী। ব্যাপারটা তো কম বড় নয়। কত দেশ তিনি ঘুরেছেন! রাজ ভাবতে লাগল।
সেসময় প্রান্তিক বলল,“আজও এল না তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড।“
নির্ঝর আজও আসে নি। ওআসে নি বলেই তার পাশের জায়গায় প্রান্তিক বসেছে।তাই জন্যই সে তাকে বেষ্ট ফেন্ডের খোঁচা দিল। তবে প্রান্তিক খুব ভালো ছেলে।তাকে ওর ভালোই লাগে।সে চমৎকার গান করে। স্কুলের যে কোনও অনুষ্ঠানে ও গান গাইবেই। স্যাররা ওকে এসব কারণে পছন্দও করেন।
সে বলল,“হু।“
“খোঁজ নিয়েছিস?“
“দুর! ওর জেঠু ফোনই ধরছে না। আজ দেখি যাব।“
“চিনিস ওর বাড়ি।“
“অনেকদিন আগে ওর বাড়ি গেছিলাম।“
“ও।“
আনন্দের মধ্যে মনটা খারাপ লাগল তার। তবে আজ সমস্যার সমাধান হবে তা সে জানে। স্কুল শেষ হবার পর মা আসবেন। তারপর তারা দুজন মিলে নির্ঝরের বাড়ি যাবে। মা তাই বলে রেখেছেন।মায়ের সন্দেহ, নির্ঝর বোধহয় পড়াশুনা চালাতে পারছে না। ভেবেই মন খারাপ হয়ে যায় রাজের। সে জিজ্ঞেস করেছিল,“ওর জেঠু যদি তেমনই বলে মা। তুমি কি করবে?”
মা বলেছিলেন,“আগে যাই। দেখি ওর কি সমস্যা।“
রাজ খুশী হয়েছিল। মা যখন ভাবছেন সমস্যা ঠিক মেটাতে পারবেন। যে কোনো সমস্যা মেটাতে মায়ের জুড়ি নেই।তবে এ বিষয়টা বাবা অপছন্দ করছেন। কিন্তু রাজ জানে মা ঠিক ম্যানেজ করে নেবেন। সে বলেছিল,“তোমার কথা ও ঠিক শুনবে।“
“কেন?
“ওরে বাবা! এমনিতে জানো কথা কম বলে! কিন্তু তোমার কথা বললেই খুব খুশি হয়।তোমায় খুব ভালবাসে।“
মা বলেছিলেন,“খুব দু;খী ছেলে তো! মা নেই। বাবা থেকেও নেই।কষ্ট লাগে।আজ যাই ওকে খুব বকব।“
আরো পড়ুন: ফুটবল (পর্ব-১৪) । দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
তালেগোলে আরো কিছুক্ষন সময় গেল। রাজের খিদে পেয়েছিল। মিড ডে মিল সে মাঝেমাঝে খায় আবার মাঝেমাঝে সে টিফিন নিয়ে আসে। এখন সে ব্যাগ থেকে টিফিন বার করে খেয়ে নিল। অনুষ্ঠান হবে তিনতলার ছাদে। ওখানে স্কুলের একটা অডিটোরিয়াম আছে। দিবাকর-বাবু নাকি শুধু মুখে বলবেন না। তিনি পর্দাতেও তাঁর দেশ ভ্রমনের ছবিও দেখাবেন।
খাওয়াদাওয়ার পর রাজ হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগল। বাঁক নিতেই সে দেখল ইমনরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। সে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। কালকের পর সে আর কথা বলে নি।সিঁড়িটা সরু। দুজনের পক্ষে যাওয়া অসুবিধেজনক।ওরা না সরলে তার যাওয়া সম্ভব নয়।ওরা গার্ড করে আছে যাবার জায়গাটা। রাজ কঠিন স্বরে বলল, “সর।“
ইমন বলল, ”এই তো সরেছি। যা।“
ইমন সরেনি। রাজ বুঝল ওরা ইচ্ছে করে তার সাথে ঝামেলা পাকাতে চাইছে।রাগ হলেও সে নিজেকে সংযত করল । সে বলল, “ইমন, সর। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।“
“যা না। “
ইমন ইচ্ছাকৃত সরছে না। ওকে ঠেলেই তাকে রাস্তা করে নিতে হবে।ওদের না সরিয়ে যেতে সে পারবে না। সে ঠেলার জন্য তৈরী হল।আর যাই হোক তার গায়ে জোর কম নেই।কিন্তু ওরা তিনজন, সে একজন। তবু যা থাকে কপালে রাজ গায়ের জোরে ওদের ঠেলতে শুরু করল।
“এই! কি হচ্ছে এখানে? যাও উপরে যাও!”
সিঁড়ি দিয়ে সরোজ স্যার আসছেন। তাদের হট্টগোল দেখে ধমক দিয়ে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইমনরা শান্ত হয়ে গেল। রাজকে সে চাপা স্বরে বলল,”বেঁচে গেলি।“
“তুইও।“
ইমনরা সরে যেতে রাজ দৌড়ে সিঁড়ির মাথায় চলে গেল। স্যার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেন। স্যার চলে যেতে ইমন পেছন থেকে উঁচু গলায় বলল, “তোর বন্ধু স্কুল খেলা সব ছেড়ে দিল কেন রে?”
“তোর তাতে কি!”
ইমন চুকচুক করে বলল,”খোঁজ নিবি না? দ্যাখ কোথায় ভ্যান-রিক্সা চালাচ্ছে নাকি! সে নাকি বিরাট প্লেয়ার।ছোঁ!”
অন্য ছেলেগুলো হেসে গড়িয়ে পড়ল।
রাজ একবার ওদের দিকে তাকিয়ে আবার দৌড়াল। অডিটরিয়ামের দরজা বন্ধ করে দিলে আর ভেতরে ঢোকা যাবে না। সে পৌঁছে দেখল বসার জায়গা নেই। ইতিমধ্যেই অনেক ছাত্ররা এসে জায়গা নিয়েছে। দেয়ালের এক প্রান্তে সে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।এখান থেকে মানুষটাকে পরিস্কার না দেখা গেলেও তাঁর কথা শোনা যাবে।
প্রথমে অমিতাভ স্যার কিছু বললেন। তিনি সঞ্চালক। স্যার তাদের সঙ্গে সাইকেল-অভিযাত্রী দিবাকর সরকারের পরিচয় করিয়ে দিলেন।তাকে অনুরোধ করলেন তার কথা বলতে।একটু পরে দিবাকর সরকার তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করলেন ।রাজ তন্ময় হয়ে সে কথা শুনতে লাগল।

দেড় দশক ধরে সাহিত্যচর্চা করছেন। পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। ‘কাঠবেড়ালি’ নামে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : ‘চার অঙ্গ’, ‘তিথির মেয়ে’, গল্পগ্রন্থ : ‘গল্প পঁচিশ’, ‘পুরনো ব্রিজ ও অন্যান্য গল্প’। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বীজমন্ত্র’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন।