| 8 মে 2024
Categories
কবিতা সাহিত্য

পান্ডুলিপির কবিতা : দ্রাঘিমালণ্ঠন । সাজ্জাদ সাঈফ 

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
প্রারম্ভিকা
রাস্তায় পিছল খাচ্ছে রোদ। শিশুগুঞ্জন। ঘরে এসে বাঁক নিচ্ছে আলো। মেঘতর্জমা। হাতের ওপর হাত অথচ বিশ্বাস ঠিক আগের জায়গায় নেই। কলাকুশলী গাছ। আত্ম-জিজ্ঞাসা। তুমি গান জানো৷ সে’ও বিষাদমাখা। যেন ফড়িঙ ছুঁতে ফিরে আসছে শৈশব। বাবার শাসন। বেতারে স্বাধীন বাংলা। হৃদয়ে অনিশ্চিত সুর। কারা আজ বিকল ঘড়ির মতো থেমে থেমে হাঁটে রাজপথে? চিনে রাখো হৈ-হুল্লোড়। চিনে রাখো অসমর্থ জনপদে রাজসিক আতসবাজি। তোমাকে না ডেকেও কি যে ডাকি ভিতর ভিতর। রক্তে ঝোড়ো হাওয়া বয়। যারা মুছে দেবে তোমাকে যথাযথ নয় তারা। বিন্দাস। ক্ষত যদি তা-ধিন হয় তবে ক্ষতই ভালো। অবহেলা নিরাময়যোগ্য রোগ৷ কাব্য লিখো। ফসিল কেটে লিখো মহেঞ্জোদারো হাম্মামখানা। সুর ঢেলে জিকির লিখো। সামনে ঝড়। ঝুম বৃষ্টি। হৃদয় লিখো। ক্ষুধার্তকে লিখো। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার নাম ক্ষুধা। যারা কানে শুনছে না তা, যারা দেখে দেখছে না, তারা কেউ যথার্থ নয় আজ।
১.
মিথ্যাকে হাসতে দেখে রেলে কাটা মানুষের মত ছটফট করি নিজের ভিতর। এত ধুলাবালি ওড়া গ্রামের আবহ ছেড়ে, এত হাসাহাসি খোলা শহর-বকুল ফেলে, লোহার গোধুলি, দুর্মূল্য, বন্ধু ও স্বজন-বাঁধন ফেলে চলে যাব বলে সত্য ও নীতির মূল্য আমি কি জানি না ভাবো?
২.
সামনে বনহিজলী, সামনে ধান গোছাচ্ছে মানুষ। হৃদয়ে তাজিংডং। আকাশে মেঘের পত্রপাঠ। কতদূর হাঁটলো মানুষ,  হেঁটে এলো বনশ্রী। হৃদয় উজাড় করে হাসে কুসারের মাঠ। সব ছবি প্রতীকী নয়। যেমন ভ্রমণ। কারো কাছে রাতই বিছানা। কারো চোখে অরণ্যবন্দর। তবু এই পথ চলা থাক। খাতার পাতায় থাক মেঘালয়। ভীড়ের ভিতর তুমি কাউকে আলাদা ভাবছো না, এটা জানতে না চাইবার ফল, আর কি আছে জানার, ফলত জ্ঞানে বিরক্তি এসে গিয়ে পায়ের সাঁকোটি সরে যাচ্ছে, টের পাও?
৩.
আমি নগর ছেড়েছি। জীবন্ত নিবাস ছেড়েছি, বাপের নজর আর মায়ের স্নেহকে ছেড়েছি। বুকের সাথে আটকে থাকা মেহেদি গাছ, তোমার বাড়ির ঠিক ঠিকানা, হৃদয়ের পাসপোর্ট ছেড়ে এসেছি অনেক বছর। তবু ধাক্কা সরে যায়নি, আঘাত সরে যায়নি, মৃত্যু সরে যায়নি আমার শরীর হতে। এতসব খরচাপাতি নিকেশ করতে জীবন সারাদিন বিচ্ছেদী গায়। হয়তো গ্রীষ্মের ছুটি পেয়ে আজ রাজা হাওড়ে যাবেন। হয়তো ভোরের থানচি কুয়াশা ভেদ করে ডাকবে তোমাকে। রক্ত সজল করা নিঝুম পাহাড়। বিমান ভ্রমণ। অনেক সেলফি। উজ্জ্বল ফেসবুক। এইখানে কোনো ম্রো আদিবাসী নেই, জুমখেত নেই, বৃষ্টিপাত নেই। আছে পায়ে পায়ে ক্ষতের সেলাই, সেই ক্ষত নিয়ে কবিতা লিখলে পাথর ক্ষয়ে যাবে ফসিল ঝরে যাবে গভীরতা হেরে যাবে রাঙা প্রাণ অগ্ন্যুৎপাতে। অথচ তখনও কাছেই শালুক তুলবে কেউ, ট্রেনেই ঘুমিয়ে পড়বে তুমি, আর সে আমাকে ধারালো ছুরির ফলায় তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে ক্রমশঃ, এমনই মানুষ।
৪.
বৃষ্টি বাদলে কেমন প্রাসঙ্গিক তুমি আজও, মেহগনি পাতা, এইখানে ভেসে এসেছিলে, পান্থজনে কৃপা করেছিলে সেইদিন। 
এখনো একটি বাগান, ফুল-জলে টইটুম্বুর, তোমাকে দেখাব বলে কবে থেকে ভিজে আছি প্রাণ, গন্তব্য প্রেমসম্ভবা, বয়সকে রুখে দিয়ে যেই প্রেম এলবাম, যেই প্রেম যুবক যুবতীবেলা!
৫.
ভাবো একা হয়েছিলো মাঠ
ছোট কোনো মেঘমুখে থেমে গিয়েছিলো চাঁদ
তুমি একা হয়েছিলে, এইদিকে ঘুরে চেয়েছিলে!
পাশে এক ছাইয়ের সরা, সারারাত কয়েল জ্বলেছে।
এর মত রাত জেগে কতকাল তুমি ছাই, লোকেরা মিছাই আর সব ধুলাবালি জড়ো করে ময়লা করছে তোমার জীবনী, তারা এটুকু জানে না ক্ষতই যার থাকবার ঘর তাকে আর কতটা আঘাতে হেস্তনেস্ত করা যায়! 
তারচেয়ে বরং যে মফস্বল তুমি জীবনকে দিলে, লড়াইয়ে উসকে দিয়েছো মগজ, সেইসব ঘামঝরা স্বর ব্যঞ্জনে জারী রাখো দৈনন্দিন।
এত ঘাস বুনেছিলো মন, এত তাল ঝুমুর কাকনে
যেন ফুরানো সুরের ঝিরি, পিছুটান-ধান ভানে স্মৃতির কৃষাণে!
০৬.
দেখতে দেখতে আবারও সরে গেছি ভিড় থেকে, হাততালি থেকে, যেখানে ঢেউটিনে ঠোকরায় মহাজাগতিক পাখি, যেখানে পিঠ থেকে ঝরে অবুঝ পালক পাখির, যেখানে সুবর্ণবোধে নেমে এসে হৃদয়ের হাত রপ্ত করে ইশারাশৈলী আজকে সেখানে এসে আবার খুলেছি তারাভরা টালিখাতা, মাঠভরা ঘাসফড়িং, ঘরভরা গেরস্থালি আর যেন আমি ভুলে গেছি তোমার কথাও।
দেখতে দেখতে বাংলা কবিতার মজমা ছেড়ে বহুদূর এসে গেছি। শন-খড়ি পোড়ানো জ্বালে ফুটন্ত কেতলির চায়ে, চুমুক দিচ্ছি নিখোঁজ মানুষের মত, চারদিকে চেনাজানা কেউ নাই!
এখানে গ্ল্যামার নাই, আর নাই বহুছাপা হবার মোহ-
কেউ শোনে নাই যেই ভাষার ঝনন আজকে সেই ধ্বনিচত্বর  থেকে শুরু করেছি হাঁটা!
০৭.
পথের অনেক রূপ, কথার অনেক পিঠ আর সব বর্ণবৃত্তান্তের শেষে বহুভাষী পথকে আপন ভেবে এই দূরযাত্রা আমাদের। যেন বৃষ্টি এসে গেছে আর মাছ ধরা টেটা বিঁধে বাঘাড়ের বুক ধড়ফড় বাড়ছে ক্রমে;
জ্বরপট্টির মত নরম একটা দিঘি আমাদের পথের সামনে থামে৷ যেন হাই তোলে রোদ, আমরা আত্মপীড়ন থেকে সরে এসে একত্রে হাঁটছি আবার। এই পথে কাঁটার পত্রালি, এইখানে কোনো গাছ ‘কাছে ডাকা’ বোঝে; 
বহুদূর ঘুরেফিরে স্মৃতির কাছেই যে কেন এসে বারবার নত হও, এইবার বোঝা গেলো!
কেউ শোনেনি যেসব হাওয়ার ঝর্নাধারা, আজ সেই হাওয়াধর্মে এসে বসে আছি একা। ধ্বনিসুর চিরে ছুটে আসছে তেপান্তর, ঘনিষ্ঠ ছায়ারা, শ্যাওলামাখা দেয়াল ধরে উঠে আসছে অনন্তগাছ, আর হৃদয়ে নববী পেয়ে অভ্রান্ত হেরা পর্বত ছুঁড়ছে গোধূলি!
০৮.
নিমেষে বৃষ্টির দান নরোম করছে দালানকোঠা, তীক্ষ্ম করছে কান। এভাবে তুলশিগঙ্গা নদী, এভাবে শ্লেটে আঁকা উদ্যান ছুয়ে নেমে যাচ্ছে লেক, এভাবেই বুকের ব্যথারা নিজেদের পক্ষে ব্যাখ্যা তৈরি করছে রাতভর, হৃদয়ে আসন বুঝে নিচ্ছে অমিল মাত্রাবৃত্ত। 
তুমি ঝিরিলাগা রক্তকরবী, আমাকে অনুগ্রহ করো।
ঘাট পেয়ে উড়াল থামানো পাখি, পরজন্মে আলোর পেখম মেলে?
এরপর ফিরে যাওয়া চলে এই পুলিশ আক্রান্ত সমাজের ডেরা ছেড়ে।
আর হ্যাঁ প্রফুল্লতা, কতই না খুঁজেছি তোমাকে, রেললাইন পারি দিয়ে ঘুপচি ঘরের আলোরা তদ্রূপ দীর্ঘ, দরদালানে চাপা পড়া ফুটবল মাঠ আর গলায় বিঁধে যাওয়া মাছের কাঁটার অস্বস্তি নিয়ে তোমাকে কতই না খুঁজে হয়রান হলো মন! তুমি আজ রাত্রিদিবস গ্লানি, সমাজের নাকের সমান উঁচু সব বিলাসিতা নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছো বোধ আর সব ভোঁতা বুদ্ধির ভারে থেঁতলে যাচ্ছে মানুষ, তোমার কি বুক কাঁপে না বলো?

আরো পড়ুন: ইফফাত জাহান সিরিজ । সাজ্জাদ সাঈফ


০৯.
বুক ভরে যাচ্ছে পাথরে, একটা বুক হু-হু করা দুপুর আঁছড়ে পড়ছে পাথরে, পাশেই আলতাগাঙ, সাঁকোয় বসেছো তুমি, কতকাল এই বসে থাকার ভিতর তুমি আলো, ফিনফিনে লতার নাচনে হেলে আসা ডাল-
এত যে পাথর ও প্রমাদের ভীড় বুক ধড়ফড় তীব্র করে!
এত যে স্মৃতির আঘাত আসে, ফেলে আসা বাইসাইকেল বেয়ে! তার ভিতর অগোছালো তুমি, আর খুব বৃষ্টি হবে এমন সব দুরু হাওয়ায় হেলান দিয়েছে মেঘ;
দিকবিদিকশুন্য হাওয়ার ভিতর পেঁচিয়ে যাচ্ছে হাওয়া, পেঁচিয়ে যাচ্ছে মানবজন্মের ঠাট্টা ও কৌতুক!
 ১০.
পথ ফুরালে এখানে ফুলেরা গা থেকে ফু দিয়ে সরায় বিকালের নিজস্ব ঘ্রাণ, কিছুটা অন্য রকম লাগে, গোধূলিপ্রান্তে জেগে ওঠে আরণ্যক মন্দির, ঝিঁঝিদের খোশমেজাজে শান্ত দেখায় অদূর পুকুর। হয়তো আত্মপ্রকাশের ভাষা ভুলে গেছো তুমি হুইসেল মিস করা শৈশবের মতন, এখানে সে চিন্তা নেই, বরং গাবের খোসা ফেলে যাওয়া বানরের মত সব চাঞ্চল্যে শব্দের পর শব্দে পেয়ে যাবে অবাধ পয়ার। নগরীর ওয়াইফাই তোমাকে বুঝবে না জেনে এতটা দূর যে এলে তার কিছু মূল্য তুমি পাবে। ভেসে আসে মাগরিব। তোমার প্রিয় রঙে জ্যান্ত হচ্ছে আকাশ। তুমি লিখো। বুকের যমুনা কান পেতে শোনো। এখানে হৈ চৈ নাই। কুৎসা ও গরীমার বাড়বাড়ন্ত নাই। তুমি লিখো সাজ্জাদ।
১১.
তবুও পিছন ফিরে চাই
যেন গানের নাটাই হতে সুতা ছেড়ে দিয়ে এই কলোনীর ঘরগুলি তৈরি, মানুষ ড্রয়ারে এখনো জমাচ্ছে ডাকটিকিট।
তবুও তোমার দিকে চাই
যেন হাত বাড়িয়ে থেমে আছে নদী এইখানে, মাছের বুকের পাথর সরিয়ে কেউ লিখে দিবে ঢেউ, জ্যান্ত হবে মৃতপ্রায় নদীর সনেট!
১২.
অজ্ঞাত সম্রাট তার গ্রীস্মের ছুটি পেয়ে
জীবন্ত নেমে এলো গানে ও গসপেলে
আর দেখো কলমে জমেছে রাত, শান্ত ও সুরভিত চোখ;
এতো ধান স্বপ্নে বেড়ে ওঠে, এতো স্মৃতি প্রশান্ত করেছে মুখ;
এত সমস্ত শিল্পসন্ন্যাসে বসে কারো মনে পড়ে নাকি আগজন্মের মুখ? কারো শুধু বিদ্রূপ ভারী করে অন্তর!
ঘুরে আসে ডুমুর কুড়ানো বিল, মেঘনাচারিনী মেঘ, সব কথা লিখিত কিতাবে পাবে।
সারারাত্রি, বেতফল ঝরে নাকি বুকে? 
এমন বিধুর পথ মেলে আছে তোমার অক্ষর; 
বনমালী বাস করে সেই পথের ধারে, রাত জেগে পালাগান বাঁধে কেউ।
এতসব প্রশ্নের মুখে চুপ থাকে একাকীত্ব, করোটি জাগিয়ে রাখি ত্রিবলিরেখায়, প্রিয় সব নামের অক্ষর খুলে সাফ করে দিই বিক্ষতদাগ!
১৩.
বাস্তবিকই সত্য হতে দূরে দূরে আছে আমাদের ঘুম, লতা-পাতা-জঙলের ডোবায় কেউ দেখে ফ্যালে ডোরাকাটা সাপ, বারান্দায় বৃষ্টি ঢুকেছে, খাঁচার ভিতর ডুকরে ওঠে রাঙাঠুঁটি পাখি-
এখন তিনটা বেজে দশ, দুয়ার খোলা রাত; বাতাস উত্তরে গেছে, রুহের মধ্যে উইঢিঁবি আর ইঁদুরের উৎপাত নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখছে মানুুষ৷
আমার লেখার গোচরে ঝরে আছে কুল বরইয়ের পাতা, রোদ লেগে স্বপ্নগুলা খলবল করে, যেন এক্ষুণি পাতাসি মাছের পোনা আইলের গলি উপচে এসে ভাসবে হৃদয়ে, লেখাগুলা বিদ্যুতে কম্পমান, স্বভাবে বাদকধ্বনি৷
চিত্তরূপ ভায়োলিন থেকে সুর পেয়ে ঘাসে ঢেকে যাচ্ছে বসন্ত, তার ধারে সুবিল, তার ধারে শোকগ্রস্ত মানুষের চোখ একযোগে ঝলসে উঠছে প্রায়ই৷
১৪.
মনে হয় শেকড়-বাকড় হয়ে মাটিতে ডুবিয়ে রাখি বুক।
একটা শ্যাওলাবর্ণ পুকুর সামনে নিয়ে সারাদিন বসে আছি আর ফুল ধরেছে বলে সে আনন্দে হাসবে তুমি এক সবুজ চাহনি ছুঁড়ে, ছড়াবে অনুপ্রাস-
তোমার সামনে এসে সমস্ত চিতার আগুন বুকে বসে আছি।  সমস্ত কল্পনাকে জড়িয়ে ধরেছে অসুখ, আর আমার
কেবলই কানে এসে বাজে মার্বেল ফেলার শব্দ ও মাটির ঝিরি, যত দূর থেকে সাইরেন শুনে ফেলে বাস্তুহারা শিশু, তত দূর রুগ্ন প্রবাসে মা আমি ডাকছি তোমাকে, শোনো?
যেন কতদিন স্কুলছুটি নেই, মাঠ নেই, ঘুঘুঅলা নেই। 
খাঁচার দরোজা খোলা। জ্বর গায়ে নিয়ে একটা শালিক হাঁটে!
মনে হয় সমস্ত দিন পুরনো প্লেয়ার ছেড়ে
তোমাকে শুনিয়ে যাবো কান্নাভর্তি স্বরবৃত্ত!
শরতে শর্তহীন হাওয়ার বৃত্তে বসে কত না প্রশ্ন তুমি 
করবে আমাকে, মা!
১৫.
জোছনা ছুঁতে চেয়ে এলোপাতাড়ি উড়ছে জোনাই, এই দৃশ্যে মানুষ নেহাৎই পুতুল, যে-রকম সবকিছু অদেখা ঈশারায় প্রাঞ্জল।
এতসব খরতপ্ত দিনে আমাদের বিশ্রাম নেই কারো, অবিশ্রান্ত খোদাও! 
পায়ায় টেবিল দাঁড়াচ্ছে না, পথের পাথর ভুল বলেনি, পথিক হতে পাথর মনের বিকল্প নেই!
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত