| 9 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: ঝড়ের সংবাদ কিংবা মনের অসুখ । বিশ্বজিৎ চৌধুরী

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

যুগপৎ বিস্ময় ও বেদনায় ডুবে একরাতে সে আবিষ্কার করে মিলনের সময় পরস্পরের প্রতি দেহ ও মনে যতটা নিবদ্ধ থাকে নারী-পুরুষ, তার কিছুই যেন নাই তার স্বামীর মধ্যে। তখন একটিমাত্র জিরো পাওয়ারের সবুজ আলো জ্বলছিল ঘরে। ঘন রাত্রি তা খানিকটা তরল করেছে মাত্র। এমন কিছু আলো নয় যাতে অন্যের মুখে অভিব্যক্ত ভাষার পাঠোদ্ধার সম্ভব। কিন্তু সেই স্বপ্নালোকিত ঘরের বিছানায় দেহলগ্ন পুরুষটির দিকে তাকিয়ে যাকে বলে যষ্ঠেন্দ্রিয় তা দিয়েই যেন সে অনুভব করেছিল এই সত্য-নির্মমতা। তাতে সমস্ত প্রস্তুতিই ভেঙে পড়েছিল কিংবা দৈহিক প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তাও নয়। কেননা মানুষ দীর্ঘকালের নিয়মে যা কিছু রপ্ত করে, যেমন আহার, পরিধান বা অন্যান্য প্রাকৃতিক কর্মাদি; দাম্পত্য যৌনতাও কখনও কখনও অভ্যাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তারই মতো।

শাহরিয়ারের চোখে সেই বিশেষ মুহূর্তে কি দেখেছিল নাজনীন; শুধু কি চোখে ? সেই স্বপ্নালোকিত ঘরে চোখের আলোতে কতটুকুই বা প্রকাশিত ছিল মন ? বরং মনের গভীরের গোপনতাই তো উদ্ধার করতে পেরেছিল সে সেদিন। অন্তর্যামী সে নয়, তবু অন্যের অন্তর্লোকের অপ্রকাশিত বিষয়কে স্পর্শ করতে পারার এই দুর্লভ শক্তি, তা কি এই কারণে যে, মানুষটি সে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে চেনে বিয়ের আগে ও পরে চারে দুয়ে ছয় বছর ধরে ?

নাজনীন দেখেছিল, বলা ভালো অনুভব করেছিল, শাহরিয়ারের চোখে ভাসছে অন্য কেউ। তীব্র আবেগে যাকে টেনে নিচ্ছে নিজের দেহের ভেতর। নাজনীন নয়, সে অন্য কোনও নারী। যেন সেই অন্য নারীর অনুপস্থিতিকে ভুলে থাকার, তার সান্নিধ্যকে কল্পনায় উদযাপন করার জন্যই হাতের কাছে পাওয়া আপাতত এই সুলভ সান্ত্বনার নাজনীনের দেহ।

আশ্চর্য! এই নির্মম উপলব্ধি বা আবিষ্কারের পর তার প্রথম যে মানসিক প্রতিক্রিয়া তা কোনওভাবেই প্রতারিত মানুষের বোধ নয়, বরং এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা। সোজাসাপটা কথায় অন্য নারীর জন্য স্থান করে দিতে তার নিজের স্থানচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা। একটি মাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে আশ্রয়চ্যুত হওয়া কিংবা ভবিষ্যতের গন্তব্যহীনতার বিশাল দুশ্চিন্তা যেন গ্রাস করে ফেলেছিল তাকে। এই শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে এমনকি বিবাহপূর্ব উত্তাল প্রেমময় চার বছর এবং আরও দুবছরের দাম্পত্যজীবনে তাদের ভালবাসার অঙ্গীকারও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তীব্র ঝড়ের মুখে বিপন্ন বৃক্ষের কাছে যতটা বেমানান পুষ্প-পত্র-পল্লবের স্বপ্ন কিংবা স্মৃতি।

বিশেষ এক মুহূর্তে নাজনীনের যে আবিষ্কার বা উপলব্ধি তা বড় একতরফা হয়ে গেল না ? একটি ধারণা থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অন্তত কয়েকটি ধাপ কি পেরিয়ে আসতে হয় না ? অন্য কোনও দিক থেকে কিংবা অন্য কোনও ধরনের সম্ভাবনা বা যুক্তির সঙ্গে কি যাচাই করা হয়েছে নিজের ধারণা ? এসব প্রশ্ন নিজের কাছেই করেছিল নাজনীন। কিন্তু ওই যে মন; মন সম্পর্কে বলা হয় দুর্গম সেই অঞ্চলে প্রবেশের জন্য যুক্তিবিচারের ধাপ অতিক্রমের প্রয়োজন নাও হতে পারে। মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকা অন্ধকার একটি মাত্র টর্চের আলোতে, এমনকি ত্রসরেণু রেখাতেও উন্মোচিত হয়ে পড়তে পারে নিমেষে। নাজনীন যা দেখেছে জেনেছে বা ভেবেছে ওই বিশেষ মুহূর্তে। সে নিশ্চিত, তা-ই সত্য। তার এই উন্মোচন নিয়ে নিশ্চিত হতে কোনও সংশয়ের কষ্টিপাথরে ঘষা দেবার দরকার আদৌ নেই।

তবে সে জানে না আসলে ঘটনাটি হুবহু কী রকম। কতটা বিস্তৃত হতে পারে সম্পর্কটি, পতঙ্গের মতো শুধু যৌনতায় পুড়ে মরার আকাক্সক্ষা ? যা নিজেই একসময় নিভে আসে প্রকৃতির নিয়মে, নাকি কোনও প্রতিশ্রুতিও আছে এর পরিণতি বিষয়ে ? কত দীর্ঘ দিন ধরে শাহরিয়ার সম্পর্কিত ওই নারীর সঙ্গে ? কেন সে বিশিষ্ট শাহরিয়ারের কাছে ? অপেক্ষাকৃত আকর্ষক সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্বের টান, তুলনামূলক কম বয়সের সহজাত লাবণ্য কিংবা একঘেয়ে দাম্পত্যজীবনের ক্লান্তির মধ্যে যে কোনও ধরনের নতুনত্ব বা বৈচিত্র্যের হাতছানি ?

শাহরিয়ারের এই নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, অবৈধ বা পরকীয়া যে নামেই তাকে চিহ্নিত করা হোক, সত্যিকার অর্থেই নড়বড়ে করে দিয়েছে এই সংসারে নাজনীনের অবস্থান। এমনকি এই বিপর্যস্ত মুহূর্তে একে অস্তিত্বের সংকট বলেও মনে হচ্ছে তার। অস্থির হয়ে পড়লেও ধৈর্য না হারানোর প্রস্তুতি নিতে হয় তাকে। কেননা সত্যিই যদি তার মানসিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটে আচরণে, কোনও নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়, এতে শাহরিয়ার যদি দোষী সাব্যস্ত হয় কিংবা নিজেই সে স্বীকার করে তার দুর্বলতা, তাতে কি আরও বিপদের মুখে গিয়ে পড়ছে না নাজনীন ? ধরা যাক তর্ক ও চাপের মুখে শাহরিয়ার স্বীকার করে বসলো তার গোপন সম্পর্কের কথা। সম্পর্কের জন্য অপরাধ মেনে নিয়ে নীতি-নৈতিকতার দিক বিবেচনা করে নাজনীনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ অর্থাৎ বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব করে বসল সে, তখন কি করবে নাজনীন ? সুতরাং তার প্রথম কাজটিই হচ্ছে, সে যে জানে এ কথা জানতে না দেওয়া।

‘রান্নাটা একদম বাজে হয়েছে। মুখে তুলতে পারছি না, তুমি খাবে কি…’

‘না, ঠিকই আছে খারাপ লাগছে না তো।’

খারাপই যদি না লাগবে তবে টুংকি যেটুকু খায় তার চেয়েও কম নিয়ে নাড়াচাড়া করছো কেন―খুব স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন উঠতে পারত। কিন্তু নাজনীন যাবে না সেদিকে। এমনকি এই অভিমানের ধারেকাছেও সে যেতে চায় না। কাজের বুয়ার হাতে ছেড়ে না দিয়ে এখনও রান্নাটা যে সে নিজেই করে যাচ্ছে সে তো শাহরিয়ারের জন্যেই। সমঝদারি না হোক ন্যূনতম মনোযোগও কি সে আশা করতে পারে না ? বরং লাঞ্চ আওয়ারে অফিস থেকে বেরিয়ে পূর্বনির্ধারিত কোনও নির্জন রেস্তোরাঁয় দেখা করার জন্য কিশোর-সুলভ উত্তেজনা, দেখা হওয়ার পর একান্তের কথোপকথন কিংবা শুধুই মুখোমুখি যতটা সম্ভব সময়কে দীর্ঘায়িত করার জন্য বসে থাকতে থাকতে একটু স্যুপ গেলা বা কিছু একটা চিবোতে হলে আর ক্ষুধা না থাকারই কথা। তাছাড়া সেই সদ্য স্মৃতির জাবর কাটা যদি চলতেই থাকে তাতে অমৃতে অরুচি হওয়ার কথা। নাজনীনের নিজের হাতের রান্না তো আর বেহেশতের নেয়ামত নয়। এসবই নাজনীনের ধারণা। যেভাবে সে কল্পনা করছে ঘটনার ধারাবাহিকতার মধ্যে তার উনিশ-বিশের গরমিল থাকতে পারে, তবে ধারণাটি মোটেই অযৌক্তিক হয়ে যাচ্ছে না তাতে।

এই যেমন সেদিন কক্সবাজার যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে নাজনীনের ঔদাসীন্যে শাহরিয়ার নিজেই যখন বিস্মিত তখনও সংযম ধরে রেখেছে সে। রীতিমতো অনুশীলনলব্ধ স্বাভাবিকতার অভিনয় করে সফল যে হতে হয়েছে তাকে, তার একটাই কারণ কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার ভয়।

‘তুমি জানতেই চাইলে না কেন যাচ্ছি কক্সবাজার।’

‘কোনও, কারণ ছাড়া কি আর যাচ্ছ।’

‘কারণটা জানার কৌতূহলও নেই ?’

‘নিশ্চয়ই ব্যবসার কাজে।’

 ‘অ্যাকজাক্টলি, আমাদের কজন বিদেশি বায়ার আসছেন, তাদের নিয়ে যেতে হচ্ছে…। ওই শালাদের প্লেজার ট্রিপ আর আমার জন্য ডিউটি। ওই যে পৌষমাস আর সর্বনাশের গল্প আছে না…’

‘কী আর করা, মোটে তো দুদিন।’

‘সমুদ্রতীরে গেলে আমি তোমাকে ভীষণ মিস করি নাজু’―বলে বাম হাতটা নাজনীনের পিঠে রেখে তাকে সামনের দিকে একটু টেনে নেয়। নাজনীনের কোলে থাকা টুংকির গালে একটা চুমু খেয়ে বেরিয়ে পড়ে শাহরিয়ার।

এই ধরনের মুহূর্তগুলোই বরং এড়িয়ে চলতে চায় নাজনীন যা তার সংযমকে পর্যন্ত টালমাটাল করে তোলে। প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে কৌশলী হওয়ার নিয়মগুলো বড় কষ্টে রঙ করছে সে। সেক্ষেত্রে কখনও স্বপক্ষ ত্যাগ করে নিজেই যদি আসে শাহরিয়ার এবং তার চেয়েও নিপুণতার সঙ্গে স্ত্রী বা সন্তানের প্রতি প্রেম-স্নেহ আর দায়িত্বের মধ্যে টানাপোড়েনের অভিনয় করে যায় তখন দ্বিধাগ্রস্ততা জন্মে, সত্যমিথ্যা নির্ণয়ের দোলায় দুলতে থাকে। যেন বিশ্বাস করতে পারলে ভালো হতো। যেন তার দাঁড়ানোর যে জায়গাটুকুকে চোরাবালি মনে হয়েছে, পায়ের নিচের শক্ত জমি হয়ে উঠছে তা। এমনকি আরও একবার যদি সে বিশ্বাস করতে পারত সেই রাতে মিলন মুহূর্তের সেই আকস্মিক উপলব্ধি ভুল তো বটেই, বরং তারপর থেকে শাহরিয়ারের ধারাবাহিক অসঙ্গতিগুলো জড়ো করলে যে ছবিটি দাঁড়ায় তাও ভুল। কিন্তু বাস্তবতাটা নাজনীন জানে। প্রেমিকাকে নিয়ে কক্সবাজার দু দিন কাটিয়ে আসার জন্য যদি বিদেশি বায়ারের গল্পটা না ফাঁদত, যদি শাহরিয়ার নিজেই সত্যিটা উচ্চারণ করত মুখের ওপর, কী করার ছিল নাজনীনের ? অধিক শোকে পাথর কিংবা পাথর ভেঙে জল ? মেয়েকে নিয়ে চলে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার হুমকি, খোরপোষ দাবি করে মামলা কিংবা আরও যা কিছু নাটক তৈরি করা সম্ভব তার কোনওটাই কি অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক, বর্তমান অবস্থানের চেয়ে ? এভাবে হয়তো মিথ্যাটাই অনেক সময় স্বস্তিকর হয়ে ওঠে সত্যির চেয়ে। কক্সবাজার যাওয়ার জন্য যখন তৈরি হচ্ছিল, বাথরুমে ছিল শাহরিয়ার তখন ফোন এসেছিল একটা।

‘স্নামালেকুম ভাবি, স্যার কি বাসায় আছেন ?’

‘হ্যাঁ, বাথরুমে…’

‘স্যারের তো বায়ারদের সঙ্গে কক্সবাজার যাওয়ার কথা। আমাকে বলে রেখেছিলেন ওয়েক আপ কল দিতে…’

‘ও তো আগেই উঠে পড়েছে। রেডি হচ্ছে। কে বলছেন আপনি ?

‘জি আমি অফিস থেকে বলছি। আমার নাম আনিকা। স্যারকে বলবেন। রাখি ভাবি। স্লামালেকুম…।’

আনিকা নামটা আগে কোথাও শুনেছে। ভাবতে হচ্ছিল তাকে। অনেক পরিচয়, পরিচিতি ও স্মৃতির অনুষঙ্গ ঘেঁটে পাওয়া গেল অবশেষে। ঘুমের মধ্যে প্রায় স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলার অভ্যাস আছে শাহরিয়ারের। আনিকা নামটা নিদ্রিত স্বামীর মুখেই নানা সময়ে শুনেছে নাজনীন। তবে এসব নিয়ে খুব কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। কারণ ঘুম বা তন্দ্রার মধ্যে শাহরিয়ার প্রায় অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের মতোই প্রচুর কথা বলে। সেখানে ড্রাইভার, বয়-বাবুর্চি, কলিগ বা স্ত্রী-কন্যার নাম উচ্চারণও বাদ পড়ে না। কখনও উত্তেজিত উচ্চস্বরে, কখনও গোপন গম্ভীর নিম্নস্বরে। হঠাৎ অপরিচিত কারও কাছে রীতিমতো অস্বাভাবিক মনে হবে কিন্তু নাজনীনের জন্যে এটাও দ্ইু বছরের অভ্যস্ততার অংশ। মেয়েটাই কি সে, যার প্রতি প্রচণ্ড প্রতিশোধস্পৃহ হওয়া উচিত নাজনীনের ? তার বর্তমানকে অসুখী এবং ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলেছে এই আনিকা ? কিংবা মেয়েটা নয় আদৌ, অন্য কেউ ? আসলে কিছুতেই কিছু আসে যায় না। আনিকা না হয়ে সোনিয়া বা শাহানা বা যে কোনো নামের যে কেউ হলেও ঘটনার মাত্রার তারতম্য হবে না কিছুই। ফলে আনিকা সম্পর্কে আগ্রহ বা অনুসন্ধিৎসা তৈরি হয় না নাজনীনের মনে।

আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগে পড়তে এসে সহপাঠীর প্রেমে যে পড়েছিল নাজনীন তা ছিল প্রায় করুণা থেকে উৎসারিত ভালোবাসা। গ্রামের কলেজ থেকে আসা শাহরিয়ারের অসাধারণ মেধার পাশাপাশি সারল্য বা গ্রাম্যতার বৈপরীত্য খুব চোখে পড়ার বিষয় ছিল, তদুপরি দারিদ্র্য। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মেয়ের সফিস্টিকেশন ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা হয়তো প্রাচুর্যও আকর্ষণ করে থাকবে শাহরিয়ারকে। তার অবয়ব বা দৈহিক সৌন্দর্যকে যেমন, তেমনি চলনবলন বা অনায়াসের অপব্যয়কেও মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেছে শাহরিয়ার, নিজের সীমানা ও অক্ষমতার হিসাব নিয়ে গুটিয়ে পড়েছে আরও। কিন্তু এই দৃষ্টিকে, সোজাসাপটা করে বললে তার কাঙালপনাকেই উপভোগ করতে করতে বিচারবোধ হারিয়ে ফেলেছিল নাজনীন। গ্রাম্য যুবকটির প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে, প্রাপ্য ও প্রাপ্তির হিসাব গরমিল করে দিয়ে গড়ে উঠেছিল সম্পর্কটি। এতে বিচারপতি দুঃখ পেলেও বাধা দেননি এবং শেষতক অসম্ভব উদ্যমী ছেলেটির বৈষয়িক সাফল্যে সম্ভবত মৃত্যুর পূর্বে স্বস্তিও বোধ করতে পেরেছিলেন একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

প্রেমে পড়ে নিজের ওপর সবচেয়ে বড় যে অবিচারটি করেছিল নাজনীন তা ছিল পড়াশোনা বা ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্ত ভাবনা শিকেয় তুলে কেবল একটি সংসার সম্পর্কে স্বপ্ন রচনা করা এবং সমস্ত স্বপ্নসম্ভবের ভার প্রেমিকপুরুষটির হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা। এভাবে শাহরিয়ার যখন নিরন্তর সঞ্চয় করছে তখন নিজের সম্ভাবনাগুলো অনায়াসে অপব্যয় করে, মাঝপথে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে অদ্ভুত সব পরিকল্পনা তৈরি করে আপাত প্রতিযোগিতাহীন গৃহিণী জীবনকে গ্রহণ করেছিল নাজনীন। স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে সুখী গৃহকোণের মধ্যযুগীয় ধারণাটি কী করে আধুনিক ধ্যানধারণায় বেড়ে ওঠা মেয়েটার মাথার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল! কেনইবা যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সংসার ছাড়া যাবতীয় উচ্চাকাক্সক্ষাই অর্থহীন মনে হয়েছিল তার, সেটা কিছুতেই ভেবে কূল করতে পারেননি একমাত্র সন্তানটির বিচারপতি পিতা।

শাহরিয়ারের অন্য সম্পর্ক বিষয়ে যতটা জেনেছে তাকে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে ঝালাই করে নেওয়ার চেষ্টা সে যেমন করেনি, তেমনি অন্য কারও কাছে তার সাম্প্রতিক দুর্বহ অভিজ্ঞতার কথা বলার চেষ্টাও করেনি কখনও। বরং এখন যেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে পড়ছে এই ঘটনা যতটা সম্ভব আড়াল করার চেষ্টায়। এমনকি শাহরিয়ারও যেন না জানে যে সে জানে।

এই যেমন কিছু দিন আগে এক বিয়েতে তার দীর্ঘকালের বন্ধু নীপা যখন ঠাট্টা করে বলেছিল, ‘পুরুষদের একদম বিশ্বাস করতে নেই। তোর হাজব্যান্ডকেও খুব ডিপেন্ডেবল ভাবিস না যেন… সবগুলো এক গোয়ালের গরু…’ ইত্যাদি তখন হঠাৎ করে কী একটা ভয় যেন রক্তের মধ্যে চোরাস্রোতের মতো মাথা থেকে পায়ের দিকে বয়ে গিয়েছিল। ভারসাম্য হারানোর আগে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই যেন রূঢ় হয়ে উঠেছিল সে, ‘আমার হাজব্যান্ডকে আমার চেয়ে বেশি তো চেনে না কেউ। হি ইজ সেন্ট পার্সেন্ট ডিপেন্ডেবল। অ্যাট লিস্ট আই অ্যাম নট অ্যাফ্রেইড অফ মাই হাজব্যান্ড।’ বন্ধুকে আহত করে হলেও এই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া নাজনীনকে দেখাতে হয়েছে আসলে এক ধরনের ভীতি থেকে, শাহরিয়ারের ঘটনাটা দশ কান হলো কি না এবং দশ জনের কথার চাপে এই সম্পর্ককে সে স্বীকৃতি দিয়ে বসে কি না সেই ভয়।

অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া কি আসলে তার স্বামীকেও দেখায়নি সে অন্যভাবে ? কক্সবাজার থেকে ফিরে শাহরিয়ার নিজেই বলছিল, ‘চলো নাজু দিনকয়েক ঘুরে আসি কোথাও, এই চাকরি-বাকরির হ্যাপা আর সামলাতে পারছি না, বোর হয়ে গেছি…।’ অভিমানে গলা বুজে আসছিল তখন। এমনকি কিছুটা কড়া পাকের জনপ্রিয় উপন্যাসের নারীচরিত্রের মতো শাহরিয়ারের বুকের কাছে মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে ওঠার আবেগও তৈরি হয়েছিল ভেতরে কিন্তু বেশ কষ্টে ব্যাপারটা সামাল দিতে পেরেছিল নাজনীন। এমনিতেই অনেক দিন ধরে নিজেকে নিতান্তই অনুগ্রহভোগী মনে হচ্ছিল। ভালোবাসা ছাড়াও স্ত্রীকে মেনে নেওয়া তো আসলে অনুগ্রহই। নতুন করে আর করুণা গ্রহণ করতে সায় পাচ্ছিল না সে নিজের ভেতর থেকে।

এর মধ্যে শাহরিয়ারের সঙ্গে এক পার্টিতে গিয়ে আনিকা নামের অল্পবয়সী সুশ্রী তরুণীর সঙ্গে আলাপ হলো তার। যাকে শাহরিয়ারের পাশে দাঁড় করিয়ে ভাবলে নিঃসন্দেহে ঈর্ষার উদ্রেক হতে পারে। নইলে তারুণ্যসুলভ উচ্ছ্বলতার পাশাপাশি সৌজন্য বা বিনয়ের জন্য ওর প্রতি আকৃষ্ট হবে যে কেউ।

আলাপের শুরুতেই―‘ভাবি আপনার সঙ্গে ফোনে আলাপ হয়েছিল একবার।’

(ওই মাত্র একবার আলাপের কথাটাও মনে রেখে দিয়েছে মেয়েটা!)

কিছুক্ষণ পর―‘আমি কিন্তু অন্যরকম ভেবেছিলাম ভাবি। আপনি তো দেখছি খুবই সুন্দরী…।’

(কেন, অন্যরকম ভেবেছিল কেন, তার কি ধারণা স্বামীর অন্য অবৈধ সম্পর্কের একমাত্র কারণ হতে পারে রূপে-গুণে স্ত্রীর একটা বড় ধরনের ঘাটতি ?)

বিদায়ের পূর্ব মুহূর্ত―‘আপনার সঙ্গে কথা বলে সত্যি খুব ভালো লাগল ভাবি’।

(ভালো লাগল কারণ তোমার ধারণা ছিল নাম শুনে বা তোমাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ব আমি। নিতান্তই তা সম্ভব না হলে কড়া-ধারাল কথার ফলায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেওয়া তো অসম্ভব কিছু ছিল না)।

কদিন ধরে কোনও অজ্ঞাত কারণে স্ত্রীর প্রতি খুব কেয়ারিং হয়ে উঠেছিল শাহরিয়ার। আর তাতে আরও সতর্ক হয়ে উঠতে হচ্ছিল নাজনীনকে। মেয়ের তো আর তার মায়ের মতো সম্পর্ক জটিলতা বা পিতার আচরণ নিয়ে ভাবার বয়স নয়। সে বরং বাড়তি মনোযোগ বা আদরটা উপভোগ করছে অনেক বেশি। চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে বলে চাওয়াও বেড়ে গেছে অনেক। নাজনীনকে এ ধরনের সময়ে এতটাই সতর্ক হতে হয় যে, তার স্বামীর ডালে ডালে চলার আঁচ পেলে নিজে সে পাতায় পাতায় বিচরণের জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রাখে। শাহরিয়ার বাসায় থাকলে কোনও ফোন সে রিসিভ করে না পারতপক্ষে। বাসায় না থাকলে নারীকণ্ঠের কোনও ফোন পেলে গলা পরিবর্তন করে বুয়া পরিচয় দিয়ে অপরপক্ষকে বাঁচিয়ে দিতে চায় বিব্রত হওয়ার হাত থেকে। কিন্তু তার মনোভাব কিছু কি আঁচ করছে শাহরিয়ার ? সে কি একটা ফয়সালায় আসতে চায় ? না হলে নাজনীন নিজেই যেখানে স্বামীর ব্যস্ততা বা অন্য কোনও কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনও প্রশ্ন না তুলে তাকে নির্বিঘ্ন রাখতে চায়। পক্ষান্তরে নিজেকে রাখতে চায় নিরাপদ, সেখানে শাহরিয়ার কেন ব্যস্ততা কমিয়ে আনছে নিজের। হঠাৎ করে মনোযোগী হয়ে উঠছে সংসারের প্রতি ? এর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত আচরণ যেটা মনে হয়েছে শাহরিয়ারের তা হলো নাজনীনকে নিয়ে হঠাৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রস্তাব, তাও বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে।

‘পশ্চিমা দেশগুলোতে আজকাল লোকজন কোনও কারণ ছাড়াই এ ধরনের ডাক্তার, আই মিন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায়। যাবে একবার নাজু ?’

আঁতকে উঠেছিল সে, ‘আমি ? বাট হোয়াই ? ডু ইয়ু ফাইন্ড অ্যানি অ্যাবনর্মালিটি ?’

‘নো, নট অ্যাট অল। এমনিতেই…, ভাবছিলাম ইদানীং তোমাকে একটু ডিপ্রেসড দেখায়…’

এরপর থেকে নিজের অভিনয়ক্ষমতার প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না নাজনীন। কোনও না কোনওভাবে নিশ্চয়ই তার আচরণে ভেঙে পড়ছে অন্তর্গত যন্ত্রণার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা কঠিন আড়াল।

‘যাবে নাজু ?’

‘যেতে পারি, তুমি বলছো যখন।’

‘দ্যাটস লাইক আ গুড গার্ল’―বলে গালে আঙুলের টোকা।

এই টোকাতে গাছের পাতার ওপর জমে থাকা জল টলমল করে উঠতে চায়, এমনকি ঝরে পড়তেও কিন্তু নাজনীনকে তো হতে হবে বরফ এবং কঠিন শীতল।

কিছু দিন আগে একবার আর একটি বাচ্চা নেবার প্রস্তাব করেছিল শাহরিয়ার। টুংকির নিঃসঙ্গতার কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছিল সে। কোনও জবাব দেয়নি, শুধু হিপোক্রেসির বাংলা প্রতিশব্দটা যেন কী মনে করার চেষ্টা করছিল। তবে শাহরিয়ারের কথায় যুক্তি ছিল। পিতামাতার একমাত্র সন্তান কতটা নিঃসঙ্গ ও অন্তর্মুখী হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ তো নাজনীন নিজে। এমনকি পিতার মৃত্যুর সময়ও তার মনে হয়েছে প্রকৃত অর্থে এই নির্দিষ্ট বেদনা একই রকম তীব্রতায় অনুভব করার অংশীদার কাউকে পেল না সে। বিয়ের আগে সবসময় ভেবেছে অন্তত চার সন্তানের মা হবে। এখন হাসি পায়! একজন অবিশ্বস্তের দায় বহন করার নাম আর যাই হোক মাতৃত্ব তো হতে পারে না।

শাহরিয়ারের সঙ্গে অবশেষে সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে যেতে হয়েছে। একা সে মুখোমুখি হয়েছে ডাক্তারের।

‘এমন কোনও কথা কি আপনি চেপে রেখেছেন মনের ভেতর যা অবিরাম দগ্ধ করছে আপনাকে ?’

‘না।’ (এই ডাক্তার নিশ্চয়ই শাহরিয়ারের পূর্ব পরিচিত)।

‘দেখুন, দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি নানা অভিযোগ থাকেই। এটা আমার যেমন আছে আপনারও আছে… স্বামী সম্পর্কে এ রকম কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কি আপনার আছে ?’

‘না, সেরকম সুনির্দিষ্ট কিছু নেই।’ (ডাক্তারকে শাহরিয়ার পূর্ব ধারণা কিছু দিয়ে রেখেছে নিশ্চয়ই কিন্তু আমি তো এ বিষয়ে কিছুই বলব না)।

‘আচ্ছা, এবার অন্য একটি বিষয়ে প্রশ্ন করি। একস্ট্রা ম্যারিটাল কোনও অ্যাফেয়ারে কি জড়িয়ে পড়েছেন আপনি ? ধরুন, বিয়ের পর স্বামীর কাছে যা পাননি, সেই না পাওয়া ভরিয়ে দিয়েছে কোনও পুরুষ…, এ রকম তো সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে, তাই না ?’

‘না, সেরকম কিছু নেই।’ (শাহরিয়ার তাহলে আজকাল তাকেও সন্দেহ করতে শুরু করেছে)।

‘দেখুন, আমি কিন্তু ডাক্তার। আমার কাছে সংকোচ করার কিছুই নেই। কেননা আপনাদের যে কোনও কথার গোপনীয়তা রক্ষা করা আমার দায়িত্ব…’

(মনে হচ্ছে সে রকম কোনও সম্পর্ক থাকলেই বরং ভালো হতো। বিষয়টা নিয়ে কিছু আলাপ করে নির্ভয়ে হালকা হওয়া যেত)।

‘আপনি তো কিছুই বলছেন না। আরে আপনার স্বামী তো আর ফেরেশতা আদমি নন। তার সম্পর্কে আপনার কোনও অভিযোগ নেই, তা কী করে হয় ?’

‘আসলেই তেমন কোনও অভিযোগ নেই।’

‘লাকি হাজব্যান্ড। তবে একটা কথা বলি। সত্যি যদি মনের মধ্যে কিছু একটা গোপন করে দীর্ঘকাল তা বহন করতে থাকেন; এটা কিন্তু আপনাকে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে… সত্যি কথা বলতে কী, মেন্টাল ডিসএবিলিটির কারণও হতে পারে এটা…’

শেষের কথাটা আমূল কাঁপিয়ে দেয় নাজনীনকে। সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে পড়তে চায় যেন। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক হয়ে থাকে সে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে তার সমস্ত কথা খুলে মেলে ধরার মানে এই ব্যাপারে তাকে মধ্যস্থ মেনে নেওয়া। মধ্যস্থতার সুষ্ঠু উদ্যোগ অর্থাৎ সম্মানজনক সমাধান মানেই তো বিচ্ছিন্নতা বা বিবাহ বিচ্ছেদের পথে যাওয়া। এই সমাধানের ভাবনা আগাগোড়া নিরাপত্তাহীনতার বোধে আক্রান্ত করে তাকে। তার চেয়ে বরং এই ভালো নয় কি নাজনীন কোনও একসময় মানসিক ভারসাম্য হারাবে। সচেতন ভাবনার ধারাবাহিকতা থাকবে না বলেই এই দুঃসহ পরাজয় বা বিষাদ বহন করতে হবে না তাকে নিরন্তর।

ডাক্তারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার পর বাইরে অপেক্ষমাণ শাহরিয়ার এগিয়ে এসে কেন জানি অসুস্থ রোগীর মতো নাজনীন কে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে দরজার দিকে। ক্লান্ত নাজনীনেরও খুব ইচ্ছে করে মাথাটা স্বামীর কাঁধে এলিয়ে দিতে  কিন্তু নির্ভর করে নির্ভার হওয়ার মতো মনের জোর কোথায় পাবে সে ?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত