নীলিম কুমারের গুচ্ছ কবিতা । অনুবাদক বাসুদেব দাস
সর্বহারা ঈশ্বর
অরণ্যটির মাঝখানে
ছোটো একটি মন্দিরে
এতদিন সুখেই ছিলেন ঈশ্বর
মাঝেমধ্যে তার কাছে কেউ যেত বহুদিন পরে
দেখেছিল_ শুকিয়ে যাওয়া লাল জবা ফুল,
নিভে যাওয়া প্রদীপ, শুকনো সলতে এবং
জ্বলে শেষ হওয়ার ধূপের কাঠি গুলির মধ্যেও
ঈশ্বরের কোনো অসন্তোষ ছিল না
কিন্তু গতরাতের ঝড় বৃষ্টিতে
মন্দিরটা ভেঙে ঈশ্বরের গায়ে পড়ল।
মাটির ঈশ্বরের দুটো পা ভাঙল ,
গলা থেকে ছিটকে গেল মাথাটা,
হাত দুটো ছিঁড়ে গেল!
নিজের শরীরটা হারিয়ে
সর্বহারা হয়ে পড়ল ঈশ্বর
কিন্তু
ঈশ্বরের একটা কথাই আমার ভালো লাগে যে
সর্বহারা হয়ে পড়লেও
মানুষকে আশীর্বাদ দেওয়া থেকে ঈশ্বর বিরত হয় না!
দেখুন_
আমাদের ঈশ্বরের হাত দুটি
ছিঁড়ে পড়ে থাকলেও
আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতেই ছিঁড়েছিল
ধুতুরা ফুল
সকালবেলা বাগানের মধ্য দিয়ে যাবার সময়
কেউ আমাকে ডাকল
নারীর চেয়েও কোমল কণ্ঠস্বরে_
‘এই যে কবি, কোথায় যাচ্ছেন’?
এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখলাম,
কেউ নেই
কেবল একটু দূরে দেখলাম
একটা ধুতুরা ফুলের গাছ
হেলে দুলে যেন আমাকেই ডাকছে
কাছে যাওয়ায়
একটা ধুতরা ফুল ডাকল_
‘আমিও কবিতা পড়ি হে কবি, তোমার চেয়েও বেশি।’
প্রত্যেক কবি কবিতা লিখেছে
শেফালি, গোলা্প, পদ্ম,বকুল
রজনীগন্ধা, হাসনুহানা, কেতকী, টগর,
নাহর, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কাশ,পারিজাত।
জবা,নার্জি,চম্পা, মালতী, কপৌ, অপরাজিতা এবং যেখানে
যত ফুল আছে শয়নে সপোনে সবাইকে নিয়ে
কেউ বাকি নেই কেবল আমি ছাড়া…
আমি কেন বাকি রয়ে গেলাম
বলতো কবি?
জীবনে এই যেন প্রথম দেখলাম ধুতুরা ফুল
অভিমানে হয়ে উঠেছে এত সুন্দর
আমি বললাম_
কবি সবাইকে বাদ দাও বোন
কবি কখনও সত্য কথা বলে না
তুমি তো রয়েছ সেই অস্থির যাযাবর শিবের
শিরে উঠে
এসো, আমার বুকের বাগিচায়
ফুটে থাকবে
সবচেয়ে বেশি তুমিই
হেলে দুলে
হেলে দুলে!!
টীকাঃ-
কপৌ-এক ধরনের অর্কিড
পচন
পচে পচে আধার মতো থাকতেই
আমি কোনোমতে আবর্জনার মাঝখান থেকে
আমাকে বের করে আনলাম,
এবং ধুয়ে মুছে উঠে দাঁড়ালাম।
এখন কি কাপড় পরব—
তা নিয়ে দ্বিধায় পড়লাম।
মরচে ধরা স্মৃতির বাক্স খুলে আমি
খুঁজে বের করলাম কী কাপড় পরেছিলাম
একজন মানুষের সঙ্গে ফোটো তোলার সময়!
তখনই দেখলাম আমার একটি আঙুল
আবার পচতে শুরু করেছে।
বুঝতে পারলাম—স্মৃতি থেকেই আরম্ভ হয় পচন।
স্মৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য
যা পাই তাই করে গেলাম।
সামনে হোটেল একটা ঢুকে গেলাম
লোকেরা যা খাচ্ছে।তাই খেলাম।।
পয়সা দিতে না পেরে মার খেলাম।মার খেয়ে
বড়ো আনন্দ পেলাম।। শরীরটা সতেজ হয়ে উঠল
আমার শরীর থেকে পচা পচা ভাবটা সরে গেল।
আমার হাতে থেকে গেল একটু ক্লান্ত স্মৃতি
আমার নখগুলির মধ্যে আত্মহত্যা করার জন্য
সুযোগ ছিল না স্মৃতিগুলির।
নখ এবং চুলগুলি বাড়তে থাকার পর থেকেই
আমরা জানতে পারলাম যে আমাদের ভেতরে
অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলি বেঁচে থাকে।
দুঃখগুলি নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বলে ভেবে ভেবে
স্মৃতির কাছে গিয়েছে
প্রদীপ
জ্বলছিস হয়তো তুই
পোড়ানোর জন্য আমার বুকের অন্ধকার?
তোর অর্ধেক জীবন গেল
একটুও অন্ধকার দূর হল না
জ্বলে জ্বলে এখন দেখছি
তুই শেষ হবি
নিজে দেখছি ডুবে যাবি অন্ধকারে
কেবল ঈশ্বরই তোর খোঁজে আসবে
তিনি তো খুঁজে পাবেন না
এত অন্ধকারে তোর আত্মা
তোর খোঁজে পুনরায়
তোকেই জ্বালাবে ঈশ্বরও
ওহে অবোধ প্রদীপ
অন্ধকারও দুঃখী
তোকে দেখে
কীভাবে বলি শুভ দীপাবলী???
এই শহরে আপনি আছেন বলেই
এই শহরে আপনি আছেন বলেই
ফাগুন আসে এই শহরে।
আপনার আঁচল ধরেই
আপনার আঁচল ধরেই
আসে ফাগুন
আপনার আচলটা কাঁপছে না কি?
ফাগুন কাঁপছে আপনার আঁচলে
ফাগুন কাঁপছে ফাগুন কাঁপছে
কৃষ্ণচূড়াকে দেবার জন্য
আপনার ঠোঁট থেকে
লিপস্টিকের রং চুরি করে ফাগুন
ফাগুন চুরি করে
আপনার নখ থেকে নেইল পালিশ।
এই শহরকে ধুলোর পোশাক পরানোর জন্য
আপনার মেহেন্দি চুল থেকে
বাতাস নামে।
মানুষের চেয়ার ,টেবিল এবং আলমারিতে
দরজা জানালা এবং বারান্দার ধুলোগুলোতে
ফাগুন রেখে যায়
আপনারই তেজস্বী অস্তিত্ব
যে ধুলোতে নাম লিখতে পারি প্রেমে
এই শহরে আপনি আছেন বলেই
একজন কবি আছে এই শহরে
আর তিনি ধুলোতে লেখেন
আপনার নাম
আপনার চলার তালে তালে
ফাগুন সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়
আপনার বিউটি পার্লারে
ফাগুন চায় আরশি
আপনার অকৃত্রিম হৃদয়ের চারপাশে
আপনার বুকের সুগন্ধি বাগিচায়
ফাগুন ফুটে উঠে টকটকে লাল
আপনার নির্জন ভাবনায়
আপনার বিহ্বল চেতনায়
শিমুল তুলোগুলি এই শহরে ঘুরে বেড়ায়
উড়ে বেড়ায় উড়ে বেড়ায় এই শহরের
দরজায় জানালায় ঝলমলে দুপুরগুলোতে
এই শহরে আপনি আছেন বলেই
ফাগুন আসে এই শহরে
আপনি এই শহরে না থাকলে
ফাগুন উড়ে চলে যেত
এই শহর ছেড়ে অন্য শহরে
পড়ে থাকত এই শহর মর্মাহত রঙহীন।
আপনি না থাকলে আপনি না থাকলে এই শহরে
একজন কবি চলে যেত এই শহর ছেড়ে অন্য শহরে।
লাল জামা
এখনও সম্রাটের মতোই তিনি আসেন
তাঁর লাল জামাটা
একটা পাথরের খোড়লে ছেড়ে রেখে আসেন
তিনি এলে এখন আর
কেউ সেতার বাজায় না
গাছগুলি বিছিয়ে দেয় না চাঁদোয়া
কেউ কোথাও পেতে রাখেনা সবুজ কার্পেট
বাটিতে কেউ ঢেলে দেয় না
রক্তের মদিরা
পাথরগুলির মধ্য দিয়ে তাঁর ক্লান্ত ঘোড়াটা
নেমে আসে রঙ্গিন হয়ে
বিষণ্ণ আকাশের নিচে তিনি যখন দাঁড়ান
তার রাজন্যবর্গ তাকে চিনতে পারেন না
কারণ
তিনি লাল জামাটা পরে আসেননি।
অনুবাদক