| 8 মে 2024
Categories
দেশান্তর ভ্রমণ

ভ্রমণ গদ্য: ব্লুনোজের দেশে ক্যাবটের ট্রেইলে । জিললুর রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

প্রথমবার কানাডা গিয়েছি ২০১২ সালে। তখন টরন্টো, অটোয়া, মন্ট্রিয়েল, ক্যালগেরি, বানফ,ভ্যাঙ্কুবার, ভিক্টোরিয়া, আলবার্টা, কুইবেকসহ অনেক জায়গায় বেড়ালেও আটলান্টিকের পাড়ে বেড়ানো হয়নি। এবার তাই ২০১৯-এ কানাডা ভ্রমণের সময় ছোটভাই জিয়াকে আগেই বলে রেখেছিলাম, অন্যরকম কোনো একটা ট্যুরের আয়োজন করতে। জিয়া জানিয়ে রাখলো, এবার তবে নোভা স্কোশিয়া যাব। আমি তো মহাআনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। এবার আমি আবার সপরিবারে ভ্রমণ করছি।

 

২৭ সেপ্টেম্বর টরন্টো হয়ে কিচেনার পৌঁছে গেলাম। ২৮ তারিখ ছিল নায়াগ্রা দেখার পালা। যদিও গতবারও নায়াগ্রা দেখা হয়েছে, তারপরও এই বিশাল জলস্তম্ভের পতন স্তম্ভিত হয়েই দেখতে হয়। মনে হয় এদেখা কখনও পুরনো হবার নয়। তারপরে যখন সন্ধ্যার দিকে বোট ক্রুজে গেলাম, তখন নায়াগ্রার পানির উপর ফেলা বিভিন্ন রঙের আলো যে অতীন্দ্রীয় পরিবেশ তৈরি করলো তাতে নয়ন মন জুড়িয়ে গেল। নায়াগ্রার রূপ দেখতে দেখতে বেশ রাত হয়ে গেল। যখন ফিরতি পথ ধরেছি ড্রাইভিং সীটে জিয়া ছাড়া প্রায় সকলেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। পরদিন ভোরে আবার দীর্ঘ যাত্রা।

 

১) হ্যালিফ্যাক্স, পেগি’র খাঁড়ি, লুনেনবার্গ: ২৯.৯.২০১৯

 

২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে হ্যালিফ্যাক্স বিমানবন্দরে নেমেই আমরা ছুটলাম পেগি’র কোভ লাইট হাউসের দিকে। এটা আমাদের কুতুবদিয়ার মতো মাটিময় কোনো স্থান নয়। গাড়ি থেকে নেমেই বিস্ময়ের সাথে অনুভব করলাম পাহাড়সমান পাথরগুলো প্রকৃতিরই এক অসামান্য খেয়ালে তৈরি হয়েছে। এই পাথুরে পাহাড় বেয়ে নিচের দিকে নামলেই আটলান্টিকের জলের উচ্ছ্বাস আমাদের দিকে ছলকে ছলকে ছুটে এসে তীরে আছড়ে পড়ছে সফেন। তবে, কক্সবাজার বালুকাবেলার সেই অফুরন্ত ঊর্মিরাশি এখানে নেই। পানি অসম্ভব শীতল, এখানে কেউই পানিতে নামার কোশিশ করছে না। একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ডের মাঝখানে শ্বেতশুভ্র বাতিঘর দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার দ্বার রুদ্ধ। পাশে স্যুভেনিরের দোকান থেকে লাইট হাউসের মিনি প্রতিকৃতি কিনে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

 

কয়েক শতাব্দী ধরে, নোভা স্কটিয়ার বাতিঘরগুলি যারা উপকূলে এসে পৌঁছেছে এবং যারা এখানকার পানিতে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের রক্ষা করতে সহায়তা করেছে।  আমেরিকার সর্বাধিক প্রাচীনতম ওয়ার্কিং বাতিঘর – নোভা স্কটিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বহু-চিত্রিত পেগির কোভ লাইটস্টেশন সহ আজ নোভা স্কটিয়া জুড়ে ১৫০ টি বাতিঘর রয়েছে। এই বীকনগুলি নোভা স্কটিয়ার সমুদ্র ইতিহাস এবং সামুদ্রিক চেতনার উপর আলোকপাত করতে সহায়তা করে। পেগিস কোভ বাতিঘর একটি আইকনিক কানাডিয়ান চিত্র।  পেগির কোভ, নোভা স্কটিয়া প্রদেশের অন্যতম ব্যস্ত পর্যটক আকর্ষণ বাতিঘরটি সেন্ট মারগারেটস বে এর পূর্ব প্রবেশদ্বার চিহ্নিত করে।

চারপাশের অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ছোটভাই জিয়া ডাক দিল ফিরে যাবার জন্যে।

তারপর শুরু হলো লম্বা গাড়িভ্রমণ। চারপাশের অপরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যাই অনেক দূরের ছোট্ট শহরতলী লুনেনবার্গ। ছবির মত এই এলাকায় রয়েছে সমুদ্রভ্রমনের নানান বিজ্ঞাপন। তিমি, মারমেইড এমনকি নাবিকের সমূর্ত অবস্থান। এখানে ছিল প্রাচীন জলযানের মিউজিয়াম।ব্লুনোজ জাহাজের মিউজিয়ামে ঘুরেফিরে বেড়লাম।

ব্লুওনোজ হ’ল ফিশিং এবং রেসিং গ্যাফ রিগ স্কুনার ১৯২১ সালে কানাডার নোভা স্কটিয়াতে নির্মিত।  অ্যাঙ্গাস ওয়াল্টার্সের কমান্ডে ব্লুয়েনোজ একটি বিখ্যাত রেসিং শিপ এবং ফিশিং জাহাজ, নোভা স্কটিয়ার প্রদেশীয় আইকন এবং ১৯৩০-এর দশকে কানাডার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়েছিল, ১৯৪৬ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবধি কর্মক্ষম থেকে দায়িত্ব পালন করেছে। পরে ১৯৬৩ সালে উত্তর আটলান্টিকের রাণী হিসেবে খ্যাত এই ব্লুওনোজের স্মারক রেপ্লিকা নির্মিত হয় এবং এটি ব্লুনোজ-২ নামে উন্মুক্ত মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ১৮ শতকের শেষদিকে নোভা স্কোশিয়ার ডাকনাম ছিল ব্লুওনোজ।

 

এদিকে সাগরের শীতল বাতাসে আমদের ক্ষুধা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা বসে গেলাম ‘ওল্ড ফিশারম্যানস ডেক’ নামের একটি পুরনো রেস্তোঁরায়। অত্যন্ত উপাদেয় সব মৎস্যনির্ভর খাবারের আয়োজন এদের মেনুতে পেয়ে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই অবস্থা। কেউ লবস্টার চাইলে কেউ চাইলাম হেডক মাছ, আর কারও বা চাহিদা ফিস এন্ড চিপস।

খাবার খেতে খেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নেমে এল। আমাদের রাতের যাত্রা শুরু হ্যালিফ্যাক্সে হোটেলের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে শুধু দশ মিনিটের যাত্রাবিরতি দিলাম শব্দশিল্পী ফারজানা নাজ-এর বাসায়। তাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা এবং আগে থেকেই তৈরি করে রাখা খাবার কিছুই তেমন করে উপভোগ করতে পারলাম না, সাগরপাড়ে পেট ভরে খেয়ে আসার কারণে। আমার কাব্যগ্রন্থ ‘ডায়োজিনিসের হারিকেন’ উপহার দিলাম। তিনি উপহার দিলেন তাঁর বই। বাচ্চারা গাড়িতে গভীর নিদ্রামগ্ন ছিল বলে দ্রুত ছুটলাম হোটেল হোমউড হিলটনে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি হোটেলটিও বেশ মনেমুগ্ধকর।

 

২) কেইপ ব্রেটন, ক্যাবট ট্রেইল এবং ইনগনিশ: ৩০.৯.২০১৯

 

কানাডার নোভা স্কোশিয়ায় কেইপ ব্রেটন দ্বীপটির উত্তর সীমান্তরেখায় যে ১৮৫ মাইল দীর্ঘ মহাসড়ক রয়েছে তাকে বলে ক্যাবট ট্রেইল। এটা উত্তর আমেরিকার একটি প্রধান দর্শনীয় উপকূলীয় মহাসড়ক। পথের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে এর গতিপথ নির্দেশনার বোর্ড। পুরোটা লুপ ঘুরতে লাগবে প্রায় ৮ ঘণ্টা। পাহাড় কেটে তৈরি করা আঁকাবাঁকা, ঢালু, উঁচু-নিচু মনোরম এই পথটি কখনো জলের ধার ধরে, কখনো উঁচু পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ আর আনন্দ একসঙ্গে মাখামাখি করে থাকা ভ্রমণের এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর এত রূপ যে কানাডার এই মহাসড়কে লুকিয়ে আছে তা না গেলে কেউ বুঝতেই পারবে না।

 

২ক) এন্টিগনিশে মধ্যাহ্নভোজন:

৩০ সেপ্টেম্বর সকালে হ্যালিফ্যাক্সের তাপমাত্রা একটু শীতলতর হয়ে গেল। তবু হালকা রোদ্দুরে হোটেলের সামনে ছবি তুললাম। তারপর যাত্রা শুরু হলো হ্যালিফ্যাক্সের অন্যতম দর্শনীয় স্থান সিটাডেল দেখতে। সিটাডেল হিল একটি পাহাড় যা কানাডার নোভা স্কটিয়ার হ্যালিফ্যাক্সের একটি জাতীয় ঐতিহাসিক স্থান।  ১৭৪৯ সাল থেকে চারটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে এবং এটি ফোর্ট জর্জ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল — তবে কেবলমাত্র তৃতীয় দুর্গটির (১৭৪৯ থেকে ১৮০০ এর মধ্যে নির্মিত) আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ফোর্ট জর্জ।  ২০ই অক্টোবর, ১৭৯৮ এর জেনারেল অর্ডার প্রিন্স এডওয়ার্ডের পিতা কিং তৃতীয় জর্জের নামে নামকরণের আদেশ দেয়।  প্রথম দুটি এবং চতুর্থ এবং বর্তমান দুর্গ, সরকারীভাবে হ্যালিফ্যাক্স সিটাডেল নামে পরিচিত ছিল। শেষটি একটি কংক্রিট তারকা দুর্গ। যাই হোক ঠাণ্ডা হাওয়ায় বেশীক্ষণ বাইরে থাকা দুষ্কর বিধায় দু’একটি ছবি তুলে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়লাম। সিটাডেল থেকে বেরিয়ে আমরা পাহাড়ে বসিয়ে রাখা হ্যালিফ্যাক্সের ঘড়ি দেখতে হেলাম। তেমন বড় কোনো ঘড়ি নয়, তারপরও তার অবস্থান এবং উপস্থাপনা মনোমুগ্ধকর। তারপর পাহাড় থেকে নেমে এসে এগিয়ে গেলাম সাগরপাড়ে, ওয়াটার ফ্রন্ট এলাকায়। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। কানটুপি খোলাই কঠিন হয়ে পড়ছিল। তবু ছবি তোলার খাতিরে দু’একবার টুপি খুলেছি। বেশ বিশালীকৃতি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। জেটির ভীষণ ঠাণ্ডা বাতাসে টুপি খুলে ছবি তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। বেশীক্ষণ দাঁড়ানো গেল না আর। জিয়ার গাড়ি ছুটে চললো কেইপ ব্রেটনের দিকে।

এর মধ্যে রুমির আবদার তার বান্ধবীর সাথে একটু দেখা করতেই হবে। আমি একটু মনক্ষুণ্নই হলাম, কত দূরের পথে যেতে হবে। এখন এসব দেখাসাক্ষাৎ খাবারের আয়োজন ইত্যাদি কতো সময়ই না নষ্ট করে দেবে। জিয়া বললো, অসুবিধা নাই, যাওয়া যাক তবে। ওনার বাসা তো কেইপ ব্রেটন যাবার পথেই পড়ে। আমি পুরোটা আস্বস্ত হতে না পারলেও রুমির আকাঙ্ক্ষায় সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দুপুর নাগাদ আমরা এসে পৌঁছি সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সদর দুয়ারে।

সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কানাডার নোভা স্কটিয়ার অ্যান্টিগনিশে অবস্থিত একটি পাবলিক স্নাতকোত্তর উদার শিল্পকলা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি পূর্ব কানাডার মূলত স্নাতক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটি গ্রুপ, ম্যাপল লীগের সদস্য।

সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের কলেজ ১৮৫৩ সালে নোভা স্কটিয়ার আরিচ্যাটে রোমান ক্যাথলিক ডায়োসেসন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরিচ্যাট কলেজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরিচাট কলেজটি অ্যান্টিগনিশের বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয় এবং ১৮৫৫ সালে সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার কলেজ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬৬ সালের ৭ই মে সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার কলেজটিকে সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। ১৮৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রথম ডিগ্রি প্রদান করে। এই প্রাচীন এবং বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতেই মনটা ভরে গেল প্রশান্তিতে। সাথেসাথেই আমি অদিতাকে বললাম, তুমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পার কিনা দেখ। সে স্বভাবসিদ্ধ মুচকি হাসি দিয়ে চুপ করে রইল। এতক্ষণে রুমি জানালো তার বান্ধবী এবং বান্ধবীর স্বামী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছোট ছোট ছিমছাম বাড়িগুলো এক একে পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি জিপিএস-এর নির্দেশনায়। অবশেষ একটি সুন্দর বাড়ির সামনে ঘোষিত হলো আমাদের গন্তব্যে পৌঁছার খবর। রুমির বান্ধবী ডক্টর নাফিসা’র সে কী প্রাণবন্ত ও আনন্দমুখর উচ্ছল আবাহনে আমরা আপ্লুত ও অভিষিক্ত হলাম। পেছন ভাবগম্ভীর ডক্টর হোসেনের স্মিতহাস্য অভ্যর্থনা প্রাণ জুড়িয়ে দিল। তবু আমি বারবার তাঁদের বুঝাতে চাইলাম এতদূর থেকে এসেছি এই দেশটি দেখতে। আমার শঙ্কা প্রকাশ গোপন থাকলো না যে, খেতে গিয়ে না কেইপ ব্রেটনের সৌন্দর্য অবলোকন মিস করি। দুই সজ্জন অধ্যাপক আমাদের খুব ধৈর্যের সাথে আস্বস্ত করলেন যে, যথেষ্ট সময় আছে। জানতে পেলাম, তাঁরা দু’জনেই পদার্থবিজ্ঞানী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে এখানে এসে পিএইচডি করে শিক্ষকতায় আছেন। পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাথে আমার সংযোগের কথা জেনে তাঁরাও বিস্মিত হলেন। আমি যে মেডিকেল ফিজিক্স এর অধীনে পিজোইলেকট্রিক ওয়েভের আল্ট্রাসনোগ্রাম, মেমোগ্রাম এবং এফএনএসির মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার নিয়ে কাজ করেছিলাম রশিদুননবী স্যারের অধীনে, তা জেনে তাঁরা বেশ বিস্মিত হন। তারপর তো অনেক কথাই হলো। তবে বহুদিন পরে দেখা হওয়ায় রুমি ও নাফিসা যেন শৈশবে ফিরে গেল। কথা তো আর থামেই না। একসময় আমাদের ডাকা হলো বেসমেন্টে। দেখি প্লেট আগে থেকেই সাজানো। নিজেদের বড়শিতে ধরা স্ট্রাইপ বাষ মাছ রান্না করে খাওয়ালেন তারা। তাদের মাছধরার খুব সখ। আর আটলান্টিকের পাড়ে থেকে মাছ ধরবেন নাইবা  কেন। চমৎকার পরিবেশনায় গলাপর্যন্ত ভুড়িভোজন করে শরীর যেন আর নড়তে চাইছে না। কোথায় চলে গেল সেই তাড়াহুড়া! মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই — এমন অবস্থা। যাই হোক, একসময় আমরা দলবেঁধে বের হলাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখতে। বিভিন্ন ভবন ঘুরে যখন বিদায় নিতে যাব, এক বাদামী বর্ণের ছাত্র দূর থেকে আমাদের আলাপ শুনে কাছে এসে জানতে চাইল আমরা বাঙালি কিনা। সে এবং অধ্যাপকদ্বয় যুগপৎ বিস্ময় প্রকাশ করলো, এই অন্চলে কোনো বাঙালির দেখা তো সহজে মেলে না। আমরা ছাত্রকে শিক্ষকদের হেফাজতে রেখে বেরিয়ে পড়লাম দূরের যাত্রায়।

 

২খ) গ্রাহামবেল মিউজিয়াম:

সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ পেরিয়ে জিয়ার স্টিয়ারিং ক্যাবট ট্রেইলের পথ দিয়ে ধেয়ে চললো। দুই পাশে ম্যাপল এবং অ্যাপল গাছের ঘন বন। আপেল ধরে লাল হয়ে আছে বুনো আপেলের গাছে। কেউ পাড়ছে না, কেউ খাচ্ছে না। একসময় অস্থির হয়ে গাড়ি থামাতে বাধ্য করলো রুমি। রাস্তার একপাশে আপেল গাছের ঝাড়ের পেছনে লোকজন বড়শি বাইছে। রুমি গিয়ে গাছ থেকে আপেল পাড়তে লাগলো, কিছু মাটিতে পড়ে থাকা আপেলও কুড়িয়ে নিল। জিয়া বললো, এসব বুনো আপেল এখানকার লোকেরা এমনিতে খায় না, তবে অনেকগুলো আপেল নিয়ে আচার বানিয়ে খায় কেউ কেউ। যাই হোক, আবার পথ চলা। দুইপাশে গাছের পাতাগুলো লাল হলুদ নানা বর্ণ ধারণ করে এমন এক অভূতপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি করলো যে, মনে হলো যেন চারদিকে আগুন লেগেছে। গাছের পত্রপল্লব যেন আগুনের গনগনে শিখা। রবিঠাকুরকে মনে পড়ে গেল—“শীতের হাওয়ায় লাগলো নাচন, লাগলো নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে”। এমন চলতে চলতে আমরা একজায়গায় দেখি স্নিগ্ধ জলাশয়, আর অপরপাশে পাহাড়ী টিলার উপরে একটি স্থাপনা। দেখলাম, এটা আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল মিউজিয়াম।

আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ৩ মার্চ, ১৮৪৭ স্কটল্যান্ডেক এডিনবার্গে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্কটিশ-বংশোদ্ভূত উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, এবং প্রকৌশলী, যিনি টেলিফোন আবিষ্কারের জন্যে প্রসিদ্ধ।  তিনি ১৮৮৫ সালে আমেরিকান টেলিফোন এবং টেলিগ্রাফ সংস্থা (এটিএন্ডটি)-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা।

 

টেলিফোন বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। টেলিফোন বিভিন্ন পথপরিক্রমায় আজকের মোবাইল ফোন। টেলিফোন মানুষের মুখের কথা প্রেরণ ও গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যার মাধ্যমে একে অপরের থেকে বহু দূরে অবস্থিত একাধিক ব্যক্তি মৌখিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন। সারা বিশ্বে শত শত কোটি টেলিফোন যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। টেলিফোনের মাধ্যমে হাজার হাজার মাইল দুরের  মানুষের সাথেও কথা বলা যায়।

আলেকজান্ডার গ্রাহাম টেলিফোনের অন্যতম আবিষ্কারক। গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করে তিনি প্রথম যে কথাটি বলেন, তা হলো ‘হ্যালো’। সেই থেকেই হ্যালো শব্দটি বিশ্বজুড়ে টেলিফোন ব্যবহারকারীদের কাছে একটি প্রিয় শব্দ। আজকাল আমরা রিসিভার তুলেই ‘হ্যালো’ বলে সম্বোধন করি অপরপ্রান্তে থাকা বাবা-মা, ভাইবোন, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুদের সঙ্গে। ফোন কানে তুলেই উচ্চারিত Hello শব্দটি প্রথম উচ্চারিত হয়েছিল আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের মুখেই। হ্যালো তার বান্ধবীর নাম। পুরো নাম মার্গারেট হ্যালো।  ১৮৭৬ সালে টেলিফোন আবিষ্কারের পর তিনি তার বান্ধবী হ্যালো কেই প্রথম ফোনটি করেছিলেন। যদিও এ ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। মানুষ গ্রাহাম বেলকে ভুলে গেলেও কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটিকে ভুলেনি। টেলিফোন নামক যন্ত্রটি যতদিন থাকবে ততদিন মার্গারেট হ্যালো বেঁচে থাকবেন মানুষের মুখে মুখে।

গ্রাহাম বেলের মা এবং স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন বধির। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্যই তিনি শ্রবণশক্তি সম্পর্কিত ডিভাইস নিয়ে কাজ করেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি টেলিফোন অবিষ্কার করেন। জীবদ্দশায় আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার প্রতিভার ছাপ রেখেছেন। যা মানব কল্যাণের ইতিহাসে স্মরণীয় থাকবে। পরবর্তী জীবনে বেল আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন যার মধ্যে রয়েছে উড়ো নৌকা এবং বিমানচালনবিদ্যা। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বেল। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন যে টেলিফোন, সেটিকেই তিনি এক উটকো ঝামেলা জ্ঞান করতেন। এজন্যেই নিজের গবেষণা ও অধ্যয়ন কক্ষে কোন টেলিফোন রাখতেন না। গ্রাহাম বেল ৭৫ বছর বয়সে ২ আগস্ট, ১৯২২ নোভা স্কোশিয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। বেল মারা যাওয়ার পর আমেরিকার সকল টেলিফোনে এক মিনিটের জন্য অবিরাম রিং বাজানো হয়। মার্কিন প্রশাসনের ভাষ্য মতে যে মহান ব্যক্তি মানুষে-মানুষে যোগাযোগের এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তাকে উপযুক্ত সম্মান দেখানোর জন্যই এমনটি করা হয়েছে।

গ্রাহাম বেলের নানান আবিষ্কারের মডেল, ছবি, এমনকি প্রামাণ্য চিত্র দিয়ে অসামান্য স্থাপত্যের এই মিউজিয়ামটি সাজানো। আমরা যখন মিউজিয়াম দেখে বেরিয়ে এলাম, এর বাইরের অনুপম ঘাসের গালিচায় অরণি অনেকটা সময় ধরে গড়াগড়ি খেল। তারপর আবার বেরিয়ে পড়া।

 

২গ) ইনগনিশ: ৩০/৯/১৯—০১/১০/১৯

মিউজিয়াম থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যাগগন রক্তিম হয়ে এসেছে। আমরা ছুটলাম আমাদের রাতের আশ্রয়ের দিকে। আরও অনেক দীর্ঘ যাত্রার পরে ছোট একটি গ্রাম ইনগনিশের দেখা মিললো। এখানে রাস্তার একপাশে একটি কটেজ হোটেল স্কাইলাইনের দেখা মিললো। কোনোরকমে লাগেজ রেখে আমরা বেরিয়ে এলাম ডিনারের সন্ধানে। এখানে কটেজে খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই রাস্তার অপর পারে মেইন স্ট্রিট রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। এখানের খাবার মানেই নানারকম মাছ। নোভা স্কোশিয়াতে শুধু মাছ আর মাছ। আমরা যে ক’দিন এখানে কাটালাম। এখানে লবস্টার এবং হেডক মাছের রাজত্ব। স্যামনও আছে। এখানে ছবি তোলার সময় একটু হাসার জন্যে স্মাইল বা চিজ না বলে লবস্টার বলা হয়। আমরা ডিনার করলাম হেডক, লবস্টার আর স্যামন মাছের বিভিন্ন উপাদেয় পরিবেশনা দিয়ে। খাবার পরে রাতে আর চোখ খুলে রাখা কঠিন ছিল। সারাদিনের ক্লান্তি এসে ভর করলো চোখে। যখন ঘুম ভাঙলো, তখন সকাল ৭টা।

বেশ আয়েশ করে আলসেমী ভেঙে সকাল দেখতে বের হলাম। কটেজের সামনে ছবি তুললাম। তারপর ছুটে গেলাম রাস্তার ওপারের রেস্তোরাঁয়। সকালের নাশতা খেলাম লবস্টার ওমলেট দিয়ে। তারপর কফি খেয়ে আবার ছবি তোলা। তারপর ফের ছুটে চলা ক্যাবট ট্রেইলে।

 

৩) ইনগনিশ, ন্যাশনাল হেরিটেজ পার্ক, স্কাইলাইন ট্র্যাকিং : ০১.১০.২০১৯

 

ইনগনিশের স্কাইলাইন কটেজ থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই আটলান্টিকের পাড়। বেশ বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাথুরে পাড়ে। কিন্তু সাগরপাড়ে আয়েশ করে বসার তেমন জুৎসই জায়গা মিললো না। পরে আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে আরেক পাশের রাস্তায় গেলে দেখি সেই পথে টিকিট করে ঢুকতে হয়। বিস্তীর্ণ এলাকাটি সরকারীভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে “ন্যাশনাল হেরিটেজ পার্ক” নামে। প্রথমে ছুটে গেলাম সাগরপাড়ের দিকে। সুন্দর পাথরে সাজানো বেড়ীবাঁধ তুল্য পাড়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। এখানে  আটলান্টিকের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাথরগুলোর পদপ্রান্তে। উল্টাদ্কে তাকাতেই একটি সবুজ সাজানো বাগানতুল্য এলাকা শিশুদের খেলার আর বয়স্কদের বসার আয়োজনও রয়েছে। আর তার পরে স্থির শীতল মিঠাপানির লেক। কিছুক্ষণ টুলে বসে দুই পাশের দুইরকম জলরাশির বাস্তবতাকে অনুভব করার প্রয়াস পেলাম। তারপর একসময় বাচ্চাদের তাগাদা পেয়ে উঠে পড়ি পরের গন্তব্যের লক্ষ্যে।

এর পরে পাহাড়ের গা বেয়ে সর্পিল রাস্তা ধরে ওঠা আর নামা। কখনও ঘন জঙ্গল, কখনও সাগরের পাড়, এভাবে বিপুল বিস্ময়ের সাথে দেখে যাচ্ছি প্রকৃতির অপরূপ লীলা। মাঝে মাঝে ছবি তোলা চলছে। এদিকে চারপাশের গাছে যেন আগুন লেগেছে দেখে রুমি তো অস্থির হয়ে গেল। বারবার নেমে নেমে আমরা ছবি তুললাম। একসময় পৌঁছালাম লেকি’স হেড নামের একটি জায়গায়। এখানেও বাতিঘর, সাগর পাড়। যথারীতি ছবি তুলে আবার পথ চলা। ক্যাবট ট্রেইলের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চলতে চলতে ক্ষুধার্ত হয়ে গেলাম সকলে। পথিমধ্যে একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবারে আবার সেই হেডক আর লবস্টার নিলাম। উদরপূর্তির পর পরই আবার ছুটে চলা ক্যাবট ট্রেইলে— যেন “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো”। আর সত্যিই পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ এখানে। যখন গাড়ি থামলো, সর্বোচ্চ পাহাড়টির চূড়ায় এসে পৌঁছালাম। এখান থেকে শুরু হবে হাঁটা, পাহাড়ীপথ ধরে স্কাইলাইন ট্র্যাকিং। ভেবেছিলাম একটা ভয়াবহ পাহাড়ী পথে হাঁটার অভিজ্ঞতা হবে। যেমন সব শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে বান্দরবান অন্চলের বিভিন্ন অভিযানে। কিন্তু পরে বুঝলাম, এটা বয়স্ক টুরিস্টদের মনোরন্জনের ট্র্যাকিং, এডভেন্চারের কিছু নয়। তবু চারপাশের বৃক্ষরাজির রংবেরঙের সাজসজ্জায় সুন্দর পাহাড়ী পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনো কখনো দূরের সড়কের দৃশ্য, কখনও আবার আটলান্টিকের জলরাশি আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছে। চলার পথে বিশ্রামের ব্যবস্থা, শৌচাগার সবই রয়েছে। ট্রেইলের মাঝখানে একটি বেশ বড় এলাকা ঘেরা দিয়ে সংরক্ষিত করে গবেষণা চালানো হচ্ছে বিশালাকৃতি মুজ-এর বিচরণ ব্যাকিরেকে বনায়নে কি প্রাকৃতিক প্রভাব পড়ে তা দেখা হচ্ছে। শুনেছিলাম এখানে চলার পথে কখনও সখনও মুজ দেখা যায়, আমি বোধহয় ততটা পূন্যবান নই, মুজ দেখার সৌভাগ্য আমার হলো না। যাই হোক ট্র্যাকিং শেষ করে ক্লান্ত সকলে যখন ফিরতি পথে তখন একটু বৃষ্টির ছিটে এসে আমাদের দৌড় করিয়ে ত্রস্ত গাড়িতে পৌঁছে দিল। এবার সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুম্ নেতিয়ে পড়লেও জিয়া প্রবল নিষ্ঠার সাথে গাড়ি চালিয়ে গেল। তার চোখে ঝিমুনি আসছে কিনা এই ভেবে আমি বেশ শঙ্কিত ছিলাম, কিন্তু প্রকাশ করার সাহস পেলাম না।

রাত আটটা নাগাদ আমরা একটি গ্যাস স্টেশনে থামলাম। সেখানে রাতের খাবারও খেয়ে নিতে হলো, সেই হেডক মাছ আর লবস্টারের মেনু দিয়ে। তারপর আবার পথ চলা ট্রুরো শহরের দিকে। অবশেষে জিপিএসের কল্যাণে গাড়ি থামলো উইলো বেন্ড মোটেলে। এখানে নেমেই বেশ দ্রুত সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম টিপটিপ বৃষ্টি তাপমাত্রা কমাতে থাকলেও আমরা তা টের পেলাম না। পরেরদিন মোটেলে ফ্রি ব্রেকফাস্ট আছে, তাই আর কোনো চিন্তা নেই।

 

৪) বার্নকোট হেড পার্ক: ০২.১০.১৯

 

সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে রওনা দিলাম আরেকটি রহস্যময় অন্চলের উদ্দেশ্যে।

আটলান্টিকের তলদেশ জলশূন্য হয়ে পড়ে ফান্ডি উপসাগর এলাকায়। এখানে ভাটার সময় ৪৫ ফুট পানি নেমে যায়। ফলে সাগরের তলদেশে হাঁটাচলা করা যায়। অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের দেখা মেলে। এমনকি ছোট ছোট দ্বীপের তলা ও গোঁড়া উন্মুক্ত হয়ে যায়। আবার জোয়ার এলে এই গভীর সমূদ্র চিরচেনা অথৈ জলধিতে পরিণত হয়। এ এক অপরিসীম বিস্ময়!!!

ফান্ডি বে’র তলদেশ দেখার জন্যে যে জায়গাটা দিয়ে নামতে হয়, সেই স্থানটির নাম বার্নকোট হেড পার্ক। জানা যায়, ১৭৯৫ সালে কোনো নাবিকের কোটে আগুন ধরে গিয়েছিল এই জায়গায়। যাই হোক নামের সাথে এর কাজের কোনো মিল পেলাম না। এখানে ভাটার সময় একটি বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে জল সরে যায়। দেখলাম, জল শূন্য খাঁড়ি, ৪৫ ফুট জল নেমে গেছে; উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে সমূদ্রের তলদেশ। কিন্তু সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ থেকে যায়। এরা জানে একটু পরেই জোয়ার এলে আবার জলে ভরে যাবে পুরো এলাকা। জল নেমে গেলে ছোট ছোট দ্বীপগুলোর তলা বেরিয়ে পড়ে। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি ঘটে বলে শুনিনি। জায়গাটার নাম কোটপোড়া না হয়ে কোটভেজা হলেই হয়তো বেশী মানাতো।

১৭৯৬ সাল থেকে এই অন্চল দর্শনীয় স্থান হিসাবে প্রসিদ্ধ হওয়ায় এই এলাকা হেরিটেজ প্রপার্টি হিসাবে ঘোষিত হয়েছে।

বলা হয়ে থাকে যে ১৬০ মিলিয়ন টনেরও বেশি জল প্রতিদিন ফান্ডি উপসাগরের বাইরে এবং বাইরে চলে যায়, প্রতিদিন দু’বার। এটি আমাদের গ্রহের স্বাদুপানির সমস্ত মিলিত প্রবাহের চেয়ে বেশি।  গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে এখানে বিশ্বের ১২টিরও অধিক প্রজাতির তিমি রয়েছে এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ জোয়ারের রেকর্ড ধারণ করা হয়েছে।  এই অসাধারণ ঘটনাটি এবং এটি যে অনন্য সিস্কেপ তৈরি করেছে তা না দেখে নোভা স্কটিয়া সফর সম্পূর্ণ হয় না।

ফান্ডির জোয়ার পুরো আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সুযেগ আমাদের হয়নি। কারণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছেকে হবে সময়ের আগে। তবে মনে রাখা দরকার বার্নকোট হেড পার্ক এলাকায় অনেক ফসিল পাওয়া গিয়েছে এবং এখনও বিভিন্এন সময় ফসিল মেলে। এখানে একটি মিউজিয়ামও রয়েছে এসব সংরক্ষণের জন্যে।

সাগরের তলদেশে হাঁটার সময় অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদের দেখা মেলে। এমনকি ছোট ছোট দ্বীপের তলা ও গোঁড়া উন্মুক্ত হয়ে যায়। আবার জোয়ার এলে এই গভীর সমূদ্র চিরচেনা অথৈ জলধিতে পরিণত হয়। এ এক অপরিসীম বিস্ময়!!! নিম্ন জোয়ারে সমুদ্রের তলে হাঁটতে পারা এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ জোয়ারের ঘটনা জানা, ফান্ডি উপসাগরের বার্নকোট হেড পার্কটি ঘুরে দেখতে দেখতে মন চলে যাচ্ছে প্রাগৈতিহীসিক যুগের কোনো কালে, যেখানে জীবাশ্মগুলো জীবন্ত হয়ে যায়। এখানে রয়েছে স্বতন্ত্র পাথর এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদ, নানা প্রজাতিক শামুক, জেলিফিশ, আরও কতো কি!

সাগরের তলদেশে হেঁটে আসার পরে আর কোনো নতুন অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই মনে করি। আর কোনো নতুনের ধাক্কায় এই আপ্লুত অবস্থার ভাব গাম্ভীর্য কমে যাক এ আমি চাই না। তারপরও দুপুরের দিকে হারবার ভিউ রেস্টুরেন্টে থামতে হলো। এখান থেকেও জোয়ারের জল বেড়ে ওঠা দেখা যায়। দেখা যায় নিকটবর্তী একটি বাতিঘর। এখানেও আমরা নানারকম মাছের তৈরি থাবারে রসনাতৃপ্ত করলাম। তারপর সরাসরি ছুটে গেলাম ট্রুরো বিমানবন্দরের দিকে। এবার ফিরতে হবে টরন্টো হয়ে কিচেনার, জিয়ার বাড়িতে।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত