অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-২৫) । ধ্রুবজ্যোতি বরা
ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।
অনুবাদকের কথা
কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।
এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।
বাসুদেব দাস,কলকাতা।
আমি তাকে প্রথমবার দেখার সময় সে একটা পাথরের ওপরে একা বসেছিল। তার মুখটা ছিল নিষ্প্রাণ কিন্তু কালো চোখ জোড়া ছিল অত্যন্ত জীবন্ত। চোখের জলের একটি তরল আস্তরণ ঘিরেথাকা একজোড়া চকচক করতে থাকা চোখ! পাথরটাতে বসে, দুই হাঁটুতে হাতের কনুই দুটো রেখে হাতের ওপরে থুতনিটা রেখে সে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল।মেয়েটির হাত পা গুলি লম্বা লম্বা। সাধারন ভারতীয়মেয়েদেরমতো গড়ন নয়। গাঢ় নীল উলের টুপি এবং গাঢ় নীল হাতমোজা পরা হাতের লম্বা লম্বা আঙ্গুলগুলি তার বিষন্ন মুখটাকে যেন একটি ফ্রেমে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। টুপির নিচ দিয়েবেরিয়ে আসা কয়েকটি অবাধ্য চুলের কুণ্ডলি বাতাসে উড়েউড়ে তাকে বিরক্ত করছিল। সে কিন্তু চুল গুলিকেসরিয়ে দিচ্ছিল না।
তাকে দেখেই আমার কেন জানি মনে হয়েছিল এই মেয়েটি এত ঠুনকো—এত ভালনারেবল!
সে একটি বিদেশী ট্রেকিং দলের সঙ্গেএসেছিল।
দলটির সঙ্গে একসঙ্গে এলেও সে একটু নিঃসঙ্গ থাকতে শুরু করেছিল। দলের বাকি কয়েকজন ওই যে ঘাসের ওপরে বসে নিজের নিজের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করে রোদ পোহাচ্ছে। আর সে কাছে, কিন্তু একা বসে আছে।ওদেরকথাবার্তায়মেয়েটি অংশগ্রহণ করছে না।
আমি হাতঘড়িটারদিকে কিছুটা অধৈর্য ভাবে তাকালাম। ভাড়ায়নেওয়াটাটা সমুগাড়িটাপনেরো মিনিট আগেই এসে যাওয়া উচিত ছিল। এখনও কোনো খবর নেই। না, এই তিব্বতীদেরসময় জ্ঞান নেই,সময়দিয়েএরা কখনওসময় রাখতে পারে না। এই সাহেবের দল সকালবেলা নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে হাজির।ওদেরকে আমাকেহিমালয়েট্রেকিংয়ের জন্য বেস ক্যাম্পে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের নিজস্ব ক্যাম্প এবং অফিস আছে। প্রায় আট হাজার ফুট উচ্চতায় সেই বেস ক্যাম্প। সেখান থেকে ১৪ হাজার ফুট পর্যন্ত ট্রেকিংয়ের পথ।
নেই, মানুষগুলির কোনোউদ্বিগ্নতা নেই।সময়ের কথা নিয়েওরা যেন খুব বেশি চিন্তিত নয়। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলায়ওরামশগুল।দলটি আমেরিকা থেকে এসেছে। দুটি ভারতীয় ছেলে।একজনের বান্ধবী ভারতীয়,অন্যজনেরমেম।বাকিরা সাহেব-মেম। এই দলটির সঙ্গে সাত নম্বর হয়েএসেছে এই মেয়েটি।ভারতীয়মেয়ে। সে দলের সঙ্গে একসঙ্গে এসেছে কিন্তু ওদের সঙ্গে থেকেও যেন সে সঙ্গে নেই। একটু নিজের মতো করে রয়েছে, একটু নিভৃতে একটু দূরে সরে।
আমি ওদের কিছুটা দূর থেকে লক্ষ্য করলাম।
অমসৃণমেম দুজনের গঠন মেয়েদেরচেয়েছেলেদের মতোবেশি।সাহেবটিও লম্বা।ভারতীয় ছেলেগুলি গোলগাল চেহারার, এদের সঙ্গে মিলে না। আর এই মেয়েটি তো একেবারেই মেলে না।বড়োফ্রেজাইল বলে মনে হল তাকে।পাহাড়ের শীতল বাতাস থেকে বাঁচার জন্য পরা গায়ের আকাশী-নীল নাইলনেরজ্যাকেটটাফুলে থাকার জন্য সে কতটা শক্তপোক্ত ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কিন্তু দুর্বল—সে দুর্বল।কয়েকটি স্তরে গরম কাপড় এবং ফুলে থাকানাইলনেরজ্যাকেটটার নিচে তার শরীরটা যে দুর্বল এবং ভালনারাবেল হবে সেই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সে যেভাবে হাত পা গুটিয়ে বসেছে তার দিকে তাকিয়ে সে খুব একটা অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে মনে হল আমার। কেন, ঠিক বলতে পারি না, মনে হল আর কি। আমি তার কাছে গেলাম, নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললাম,‘গাড়িটা আসতে একটু দেরি হচ্ছে।’
মেয়েটি নিজের ঘড়িটার দিকে তাকাল এবং মাথা নাড়ল ।
‘একটু দেরী হয়েছে তাই না?’ আমাকে জিজ্ঞেস করার চেয়ে সে যেন নিজেকেই প্রশ্নটি করল।
আমি মাথা নাড়লাম। আর ঠিক সেই সময়েইরাস্তায় বাঁক ঘুরে টাটা সুমোগাড়িটার আসা আমার চোখে পড়ল।‘এসেছে,গাড়িটা এসেছে।’ আমি তাকে বললাম।সে গাড়িটার দিকে তাকাল কিন্তু সে পাথর থেকে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখাল না।
‘গাড়ি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।’ সাহেব মেমদের আমি চিৎকার করে বললাম। ওরা মাটিতে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়াল।গায়েরকাপড়চোপড়ঝেড়ে একটা পাথরের ওপরে রেখে দেওয়া ভারীবেকপেক এবং ট্রেকিং সরঞ্জামের থলে গুলি হাতে তুলে নিল।টাটাসুমোএসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেওরা উপরের ক্যারিয়ারে জিনিসগুলি তোলার জন্য তাড়াহুড়ো লাগাল।মেয়েটিও এবার উঠে দাঁড়াল। নিজের বেকপেকটা সেও গুটিয়েনিল। লম্বা সাহেবটাটাটাসুমোর উপরে উঠে জিনিসপত্র গুলি ঠিকঠাক করায় লেগে গেল।মেয়েটি নিজের বেকপেক আর থলেটি গাড়ির কাছে নেওয়ার জন্য তুলে নিল।
পেকটা দেখতে খুব ভারী বলে মনে হল। সঙ্গে আনা থলেটাও। আমি এগিয়েগিয়েমেয়েটির কাছ থেকে বেকপেক এবং থলেটা হাতে নিয়ে নিলাম এবং সুমোটারওপরের ক্যারিয়ারটায় তুলে দিলাম।মেয়েটি অনুচ্চকণ্ঠে ধন্যবাদ জানাল। হুলুস্থুল করে সবাই গাড়িটিতে উঠল। সামনের সিটটাতে সাহেব মেমরা বসল। মাঝ খানের সিটটাতে ভারতীয় দুজন।শেষ্রসিটটাতেআমি এবং মেয়েটিবসলাম। ভারতীয় ছেলে একটির সঙ্গে আগত মেমও উঠে এসে আমাদের সঙ্গে পেছনে বসল।
‘ সেই সিটটাতে চারজন বসলে বড়োচাপাচাপি হবে,’মেয়েটি বলল।
টুরিস্টদের জন্য এই সুমোগুলি তিন সারি সিটদিয়ে সুন্দর করে বানানো। প্রতিটি সারিতে ড্রাইভারকেনিয়েতিনজন করে নয় জন মানুষ আরামে যেতে পারে।
বেস ক্যাম্পে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হল।
প্রতিটি দলকে নিয়মমাফিক দেবার মতো এই দলটিকে আমি একটি স্বাগত সম্ভাষণ জানালাম। নিজের পরিচয়দিয়ে বিশাল হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বললাম। বললাম হিমালয়েরট্রেকিংয়েরচ্যালেঞ্জের কথা।বেস ক্যাম্পে তাদের আপ্যায়নের জন্য আমরা কী ধরনের সুন্দর ব্যবস্থা করে রেখেছি সেসব বললাম। বললাম আমাদের এগুলি নতুন ট্রেকিং রেঞ্জ—হাজার হাজার টুরিস্টদেরআবর্জনায় এখনও এইসব প্রদূষিতহয়নি। প্লাস্টিক প্যাকেট এবং নোংরা জিনিসের স্তূপ নেই।হিমালয়ের নির্মলসৌন্দর্য এখনও এইসব জায়গায় উপভোগ করতে পারা যায়। লোভী বণিক নীতিহীনব্যবসায় এখনওএই জায়গাগুলিক্লেদাক্ত করে তুলতে পারেনি ।আমি তাদের এই ট্রেকিং রূটটা এবং আমাদের কোম্পানিকে নির্বাচন করার জন্য অভিনন্দন জানালাম।
বেস ক্যাম্পে আপনাদের সুবিধার জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা আছে। তিনটি ঘরের একটি লগকাবিন আছে।বাংকবেডের ব্যবস্থা আছে। আধুনিক স্যানিটারির ব্যবস্থা আছে। গরম জলের জন্য হিটারের ব্যবস্থা আছে। সাধারণ রান্নাবান্নার জন্য রয়েছে খড়িরস্টোভ। এক রাত সেখানে থাকার পরে আমাদের অভিজ্ঞ গাইড আপনাদেরকে নিয়ে যাবে বিশাল ধৌলধার পর্বতের সুউচ্চট্রেকিংয়ের পথে। জীবনের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা লাভ করবেন আপনারা।
আমেরিকান সাহেব মেমেরানানান ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। পথের প্রতিটি ডিটেইল তারা জানতে চায়। এতদিন ট্রেকারদেরসঙ্গে কারবার করে আমি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি। তাদের বললাম,‘সমস্ত কথা আগে জেনে গেলে আকস্মিক আবিষ্কারের আনন্দের কিছুই বাকি থাকবে না।’
গাড়িতে হাসির ফোয়ারা উঠল।ভারতীয়রা শান্ত। বিশেষ কোনো কথাবার্তা নেই। ধৌলাধারের বিশাল উচ্চতায় অনিশ্চিত ট্রেকিংয়েরচিন্তায় তারা হয়তো সামান্য জড়োসড়ো হয়ে পড়েছে। সমস্ত ভারতীয়দের এই চরিত্র। সাহেবদের মতোঅজানারপ্রত্যাহ্বানে মুক্ত মনে, আগ্রহের সঙ্গে ভারতীয়রা গ্রহণ করতে পারে না,এনআরআই হলেও।
অসমিয়াসুরে হলেও এই সাহেব-সুবোদের সঙ্গে থেকে আমি ভালোইইংরেজি বলতে পারি। আজকাল আমি ইংরেজি সাহেব বলার মতোইংরেজি বলতে চেষ্টা করি না। আগে করতাম। দেখলাম বিভিন্ন দেশের মানুষ বিভিন্ন ধরনের ইংরেজি বলে।কনভেন্ট স্কুলের একসেন্টে কেউ বলে না। আমিও সেই চেষ্টা বাদ দিলাম।জাপানি, জার্মানি,স্প্যানি্স, আমেরিকান কেউ ব্রিটিশ সাহেবের মতোইংরেজি বলার চেষ্টা করেনা,একমাত্রভারতীয়রাছাড়া।ব্রিটিশরাওকরেনা।স্কটিশ,আইরশের উচ্চারণ আলাদা। আর এই শুদ্ধ উচ্চারণের কায়দা করা ইংরেজি বলাছেড়ে দেবার পরে আমি ভাষাটা আরও দ্রুত সাবলীল ভাবে বলতে শিখলাম। ভাষা সত্যিইকেবল ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। ভাষার বিশুদ্ধতার বিশেষ করে উচ্চারণের শুদ্ধতার বিচার বোধ করি খুব প্রয়োজনীয় নয়।
গাড়িটাপাহাড়ের একটা বাঁক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে উন্মুক্ত হয়ে পড়ল দূরে বিশাল ভারতের সমভূমি।শিবালিক পর্বতমালা ধাপে ধাপে ছোটো হতেহতে পাঞ্জাবেরসমভূমির দিকে নেমে গেছে। আমি গাড়িরাখলাম। এটা একটি অতি সুন্দর ভিউপয়েন্ট। সমস্ত ট্রেকারকে আমি এখানে গাড়িদাঁড় করিয়ে প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যরাজি দেখাই।আজ পর্যন্ত মুগ্ধ না হওয়া কোনো মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
গাড়িটি থেকে সবাই নেমে পড়ল। রাস্তার কাছে সবাই এসে দাঁড়াল। অনেক সময়প্রত্যেকেই নীরব হয়ে রইল। মানুষেরকল্পনাতীত সুন্দর এক দৃশ্য—পেছনে হিমালয়ের সুউচ্চঅবস্থিতি—চোখে না দেখা গেলেও প্রতিনিয়ত যাকে স্নায়ুর রন্ধ্রে রন্ধ্রেউপলদ্ধি করতে পারা যায়।আর সামনে শিবালিক পর্বত ধাপে ধাপে নেমে গিয়ে বিশাল ভারতের সমভূমি অঞ্চলে মিশে গিয়েছে।সহস্রজলধারায়বিধৌতসেই সমভূমির মধ্যে মানব নির্মিত পংবান্ধের কৃত্রিম হৃদেরজলরাশি একটি দুর্মূল্য স্ফটিকের মতোতিরবির করছে।
আমি অনেকবার এই দৃশ্য দেখেছি। তথাপি প্রতিবারহওয়ারমতো সেদিনও বিমুগ্ধ নয়নে সেই দৃশ্য নিজের অজান্তেই অনেকক্ষণ ধরে দেখছিলাম। কখন যে মেয়েটি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে আমি বুঝতেই পারিনি।
‘এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখলে কেন জানি আমার মরতে ইচ্ছা করে।’
তার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কী বলছে মেয়েটি? এত সুন্দর দৃশ্য দেখলে মরতে ইচ্ছা করে!‘মরতে ইচ্ছা করে?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।‘কেন?’
‘সব কথার কারণ থাকে না,’মেয়েটি বলেছিল।
আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলাম।বাকিরাফটোনিচ্ছে, নিজের মধ্যে কথা বলছে।তারপরে যাবার জন্য গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে।
‘ওখানে একটা সাগর ছিল।’ আমি বললাম। হঠাৎ কেন জানি বলে ফেললাম।
‘কোথায়?’
‘পাহাড়েরনিম্নভূমিতে ওই বিশাল সমভূমিতে।’
‘সাগর?’
‘টেথীজ সী—টেথীজ সাগর।’
‘সেই জন্যই হয়তো এত বিষন্ন।’
‘কী?’
‘সাগরে নেমে যাওয়া এই পর্বতগুলি—পুরো দৃশ্যটা।’
‘সাগর বিষন্ন নাকি?
‘সাগর বিষন্ন’, বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে মেয়েটি বলল।‘সমস্ত সাগরই বিষন্ন।’
আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। সে খুব পাতলা ফ্রেমের এক জোড়া চশমা পরেআছে।চশমার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই বিষন্ন সাগর—টেথীজসাগর।প্রতিফ্লিত হচ্ছে শিবালিক পর্বতমালার নেমে যাওয়া সারিগুলি,নিচেরকাঈমূরপাহাড়,স্ফটিকস্বচ্ছ নীল আকাশ এবং নিচের সমতলের বিশাল বিষণ্ণ সাগর—টেথিজ সাগর।
কী সাগর বলেছিলে? সেই সাগরটার নাম?’
‘টেথীজ সাগর’
‘সেই সাগরের নাম আমি কখনওশুনিনি।’
‘সেই সাগর ৫৭০ নিযুত বছর আগে ছিল। এখন নেই।’
‘কী?’
‘হ্যাঁ। তার হয়তো একাংশ এখনও ভূমধ্যসাগর হিসেবে বেঁচে আছে।বাকিটুকু নেই। নাই হয়ে গেছে।
গল্প বলছ।বানিয়েবানিয়ে বলছ?’
‘একদম বলছি না। সত্যি কথা এসব।
তাহলে সাগরটা কোথায় গেল?’
‘বসে গিয়ে মাটি হয়ে গিয়েছে।’
মেয়েটি চোখ জোড়াবড়োবড়ো করে তাকাল। চোখে অপার বিষ্ময়।
‘অতি প্রাচীনকালের কথা,’আমি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলাম। ভারতবর্ষ তখন আফ্রিকার নিচের অংশে লেগেছিল।তারপরে এটা ফেটে ক্রমশ উত্তর দিকে এবং পূব দিকে ভেসে উঠতে লাগল,আফ্রিকা সরে গেল দক্ষিণ এবং পশ্চিমে।সরতেসরতে ভারতটা এশিয়া মহাদেশের ভূখণ্ডে ধাক্কা মারল। প্রথম ধাক্কাটা মারল সাগরের নিচ দিয়ে।এশিয়ার প্লেটের সঙ্গে ভারতীয়প্লেটের সাগরের নিচেধাক্কা লাগল। এই দুই ভূমিখণ্ডের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রইল একটি বিশাল সাগর—পশ্চিম থেকে পূর্বে। নীল ঘন লবণাক্ত জলে পরিপূর্ণ একটি সাগর।সেই সাগরের জলে বিভিন্ন মাছ, কাছিম, জন্তু বিচরণ করত। এটাই টেথিস সাগর।
‘তারপরে’
‘পড়ে নয় সেই সময়েই…’
‘সেই সময়ে কি?’
‘প্লেট দুটি ধাক্কা মারার ফলে একই সময়যেভাবে একটি সাগর দুই বৃহৎ ভূমিকম্পের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলসেভাবেই প্লেট দুটি ধাক্কা খাওয়ার জায়গায়–এশিয়া প্লেটের দক্ষিণ দিকে দুটি প্লেট ভাঁজখেয়ে উপর দিকে উঠে গিয়েছিল।’
‘জানি।’
‘কী জান?’
‘এভাবেই সৃষ্টি হয়েছিলহিমালয় পর্বতের।’
‘তারপরে?’
‘পাঁচ মাইল,পাঁচমাইলউচ্চতায় উঁচু হয়ে উঠে গিয়েছিলহিমালয়।’
‘তারপরে?’
‘দুটি প্লেটের ধাক্কায় বিশাল হিমালয় পর্বতমালা ওপরের দিকে উঠে যেতে থাকল—আর সঙ্গে সঙ্গেভেঙ্গে যেতে থাকল।’
‘ভেঙ্গে যেতে থাকল?’
‘বালির ঢিবি একটা তৈরি করলেও নির্দিষ্ট একটা উচ্চতার পরে খসেপড়েভাঙতে শুরু করে না কি?’
‘করে।’
‘সেভাবেহিমালয়ও নির্মাণ হতে থাকল।হয়তোখসে পড়ার আগেই হিমালয় আজকের চেয়ে অনেক উঁচু ছিল,হয়তো দ্বিগুণ ছিল।
‘কত দিন লেগেছিল?’
‘কে জানে, কত শত নিযুত বছর লেগেছিল?’
‘তারপরে?’
‘একসময়খসে পড়া বন্ধ হল।হিমালয় তার নিজস্ব রূপ এবং আকৃতি লাভ করল। সেটাওহয়তো অনেক নিযুত বছরের আগে।’
‘খসে পড়া বন্ধ হল।’ সে পুনরায় বলল।
‘খসে পড়া বন্ধ হল,’ আমি পুনরায় বললাম।হিমালয়ের সেই উত্তুঙ্গ উচ্চতা থেকে বিশাল বিশাল প্রস্তর খন্ড,তুষা্র,হিমপ্রবা্হ,অগ্নিময় গলিত লাভা এইসব নিচে এসে স্তূপীকৃত হল।
‘স্তূপীকৃত হল?’
‘কী?’
‘আমরাশিবালিকপর্বতমালায় বসে আছি। হিমালয় পর্বত সৃষ্টির সময়েখসে পড়া শিল, বালি, তুষার; হিমপ্রবাহ বহন করে আনা আবর্জনা এসব নিচে স্তূপীকৃত হয়ে শিবালিক পর্বতমালারসৃষ্টি করেছে। এই যে আমরা উঠছি— এই শিবালিক পর্বতমালার।’
সেদুরান্তের দিকে তাকাল।আট হাজার ফুট উচ্চতার এই বেসক্যাম্পটিতে শিবালিক পর্বতমালার রূপই আলাদা। এখানে পর্বত অধিক খাড়াই, শিলাময়, শুকনো, রুক্ষ। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তুষারাবৃত হয়ে পড়ে এই অঞ্চল।সবুজ কোমল আলপাইন পর্বতেরতৃণভূমির চিহ্ন এখানেকম।
‘হিমালয়ের পাথর গড়িয়ে এসে সৃষ্টি করেছে এই পর্বতমালাকে?’
‘হিমালয়েরপাথর গড়িয়ে এসে সৃষ্টি করেছে।’
‘ শিবালিক পর্বতকে?’
‘ শিবালিক পর্বতকে।’
তার দু চোখে জলীয়বিস্ময়!
‘ আর সাগরটা?’
‘টেথীজ সাগর?’
‘ সাগরটার কী হল?’
শুধুমাত্রতো পাথর গড়িয়েআসেনি। বিশাল বিশাল প্রস্তর খন্ডের সঙ্গে হিম প্রবাহ এবং তুষার বহনকরে এনেছে। তার চেয়েওবেশি পরিমাণে মাটি বালি আদির আবর্জনা। তুষারাবৃতশৃঙ্গ থেকে,হিমপ্রবাহেরথেকে সৃষ্টি হল সহস্র সহস্র নদীর। এই নদীর স্রোত বহন করে আনল অভাবনীয় পরিমাণের পলিমাটি, কাদা, বালি। নদী গুলির সঙ্গে এই সমগ্র আবর্জনা এবং পলিমাটি এসে পড়েছেটেথীজ সাগরে।
‘টেথীজসাগর!’
‘ আর টেথীজসাগরটা ক্রমে ক্রমেঅগভীর হয়েএসে একটা সময় সম্পূর্ণভাবে মাটির নিচে বসে গেল।’
‘ বসে যাবার পরে ?’
বসে যাবার পরে টেথীজ সাগরটা নাই হয়ে গেল এবং এশিয়ার সঙ্গে ভারতের মাটি অংশ যুক্ত হয়েগেল। সৃষ্টি হল সিন্ধু গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের বিশাল সমভূমি উপত্যকা অঞ্চলের।’
সেদূর দূরান্তের– শিবালিক পর্বতমালার চূড়াগুলির মধ্য দিয়ে, ধূসর হয়ে পড়া দিগ্বলয়েকোথাও টেথিস সাগরের এক টুকরো দেখতে পেয়ে নাকি দেখতে থাকল। বিষন্ন সাগরটা আসলে তখনএসেছিল তার চোখের মনির মধ্যে।

অনুবাদক