| 6 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৬) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট


পিৎজা বেকিং !

আমেরিকার অ্যাপার্টমেন্টের একফালি বারান্দায় বসে বসে রাণীয়া ভাবে তার নিজের দেশের কথা। তাদের বাবার কর্মসূত্রে বেড়ে ওঠা বিহারের ইস্পাতনগরী তে। প্রাণের বন্ধু অর্পিতা কে টকাটক টাইপ করে লম্বা হোয়াটস্যাপ মেসেজ লেখে ল্যাপটপে ।  

কী সব দিন ছিল আমাদের! তোর নতুন সংসার পাতার গল্প সেখানেই। অথচ আমি সব ফেলে এখন বিদেশের মাটিতে। যদি কোনোদিনও বিদেশ থেকে ফিরি ওখানেই যেন সেটল করি। আজও খুব মিস করি জামশেদপুর স্টিল সিটি কে।

রাণীয়াদের ফ্ল্যাট থেকে দরজা খুললেই দলমা পাহাড়ের ঘন সবুজ।  তার মধ্যে কোনও কোনোদিন শীতের রাতে দাউদাউ দাবানল জ্বলতে দেখার লোভ ছিল। সন্ধের পথ হেঁটে মায়ের সঙ্গে সাকচী বাজারের টাটকা মাছ কিনতে যাওয়া ছিল। কোনও কোনও দিন বেলার দিকে আবারও মাছওয়ালি কুন্তীর মাছের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে “মাছ লিবে” বলে মিষ্টি হাঁক ছিল। ফ্ল্যাটের দোরে আরও সবাই ল্যান্ডিয়েং এ এসে কুন্তীর কাছ থেকে জ্যান্ত মাছ কিনে নিত। বাঙালীর পারশে মাছ কে কুন্তীর মুখে “পারশে বাটা” শুনে খুব হাসি পেত ওদের। একেকদিন ছোটোখাটো পটলাক ফিশ পার্টি হয়ে যেত ফ্ল্যাটের বাঙালি মাসীমা, কাকীমাদের মধ্যে।  
মাঝেমধ্যেই রাণীয়ার মায়ের আদিবাসী কাজের মেয়ে হিমানীর মায়ের লাগাতর হাঁড়িয়া খেয়ে কাজে নাগা দেওয়ায় অতিষ্ঠ হওয়া ছিল। তবুও প্রতিবার শীতে মকর সংক্রান্তির টুসু পরবে তাদের লাগামহীন ছুটির ঘটায় ওরা কোলকাতা পালাতো। ঠাম্মার কাছে। দিদার কাছে।
দ্বারভাঙ্গা ডেয়ারী থেকে বাবার মাসকাবারি বাজারের ব্যাগ থেকে লাইম জ্যুস কর্ডিয়াল হাতে পাওয়ার উত্তেজনা ছিল। বাবা উইকেন্ডে মাঝেমধ্যে খেতেন ভদকা দিয়ে।মা আর তাঁর দুই মেয়ে খেত এমনি এমনি। রোববারের ভোরে তার মায়ের জুবিলি পার্ক নার্সারি তে মাত্র দু-একটাকায় পাতাবাহার গাছের চারা কেনার ধুম ছিল । সেই সঙ্গে লেকের জলে কেউ হয়ত পেল্লায় গলদা চিংড়ি ধরছে সেগুলো কেনার লোভ হত রাণীয়ার। বাবার কাছে আবদার করত। ফেরার পথে হঠাত রাস্তায় আদিবাসীদের কাছ থেকে টেরাকোটার পট কেনার লোভও সামলাতে পারতেন না অনসূয়া।
আরও কত কিছু ছিল।
রাণীয়ার মায়ের সাকচী বাজারের প্রিয় শাড়ির দোকান পরিধান থেকে ফিনফিনে সূতির কোটা কেনা ছিল। মাঝেমধ্যে উইকেন্ডে অটোয় চেপে বিষ্টুপুর অভিযান ছিল। ব্যুটিক শাড়ির দোকান প্রিন্সেস থেকে কেনা হত মায়ের শাড়ি, দুই মেয়ে রাণীয়া আর মিঠির তসর সিল্কের ড্রেস মেটিরিয়াল। হ্যাঁ, জামশেদপুরে একমাত্র পিওর ভাগলপুরী তসর রাখত ওরাই। পুজোর আগে হঠাত বাজার দোকান সেরে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় ডিনার খেয়ে আত্মহারা হওয়া ছিল।

শীতকালে টাটা স্টীলে রুশি মোদির বড়াখানা ছিল। যেন টাটা কোম্পানির মেয়ের বিয়ে। সারা টাউনশিপের বড় সাহেব, ছোটো সাহেব সবার বউরা, মেয়েরা সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকত সারাটা বছর, সাজুগুজু করবে বলে।
রাণীয়ার বাবার ছিল বেলডিহি ক্লাবের মেম্বারশিপ। মেয়েরা তাদের স্কুল কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে ইউনাইটেড ক্লাবে বসে সুইমিং, গুলতানি, এইসবে মেতে থাকত। বেলডিহি ক্লাবে সিনেমা দেখানো হত। সেখানে একদিন মেন্যু থাকত হরেক কিসিমের দোসা। আলু বাদ দিয়ে ডিম কিম্বা চিকেনের পুর দেওয়া আমিষ দোসা বানানো তবে থেকেই শিখে নিয়েছিল রাণীয়া। শনিবারে ক্লাবের পুল সাইড মেন্যু থাকত চাউমিন। ভাজা চপ স্যোয়ের  কিম্বা এগ ড্রপ চিকেন সুইট কর্ণ স্যুপে সে চুমুক দিয়েই ক্লাবের শেফের কাছ থেকে রাণীয়া টুক করে শিখে নিয়েছিল চাইনিজ রান্নার রেসিপি।কলেজের ছুটিতে বাবার গাড়ী নিয়ে উইকেন্ড মেতে উঠত ডিমনা লেক অভিযানে অথবা হাইওয়ের ধাবায়।
এই জামশেদপুরেই রাণীয়ার আরেকজন বন্ধুর উৎসাহে একদিন শুরু হয়েছিল যৌথ উদ্যোগে হোমমেড পিতজা পার্টি। সেই বন্ধু এই অর্পিতা।  

“মনে পড়ে অর্পিতা? তোর বিয়েটা তাড়াতাড়ি হল বটে কিন্তু গরমের ছুটিতে বাড়ি এলেই তুই আমি আবারও সেই রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতাম। সেবার আমার আর তোর মায়ের সেই মান্ধাতা আমলের অ্যালুমিনিয়ামের কেক বানানোর দুটি আভেন নিয়ে আমাদের  সেই ব্রেড বেকিং? তারপরে একদিন আমরা ভাবলাম ব্রেড বানাতে পারলে পিতজা পারবো না কেন? আমরা কেমন দুজনে মিলে চুপিচুপি বাজার করে এনে বাবা মায়েদের পিতজা বানিয়ে তাক লাগিয়েছিলাম সেবার । তুই নীচের ফ্ল্যাট থেকে ওপরে উঠে এসেছিল তোর ছেলে সমেত বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে। তারপর ময়দা, ডিম, টক দই, বেকিং পাউডার দিয়ে মেখে তেল হাত করে রেখে দিয়ে দুজনের গপ্পো। বাবা মায়েদের আসার সময় হয়ে গেছিল সেই সন্ধের পার্টিতে। আমরা টপিং রেডি করে দুটি আভেনে দুটি পিতজা বানিয়েছিলাম সেদিন। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব দিনগুলো!
জানিস? এতদিন বাদে ইউএসএ’ র মাটিতে যেখানে পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে পিতজা জয়েন্ট সেখানেও আবার পিতজা ডো বাড়িতে বেক করে বেশ কনফিডেন্ট লাগছে। আমাদের সেবার তখন ইউটিউব ছিলনা। এখন সুবিধে হল তাই। ফাইনালি আভেনের সুবিধে এখানে খুব। ছবি পাঠালাম তোকে।”    

সন্ধের ঝুলে কুশল অফিস থেকে ফিরেই বলল, কী রে? চুপচাপ এখানে বসে আছিস? আবার মনের নিম্নচাপ?
রাণীয়া বলল, না না, পিতজা বানানোর প্ল্যান হচ্ছিল তাই অর্পিতা কে অনেক দিন বাদে পিং করলাম। খুব মনে পড়ছিল জানিস? জামশেদপুরের কথা। কুশলের গলা জড়িয়ে দুহাত পিছন দিকে বাড়িয়ে রাণীয়া বলল, কুশ, তুই ওখানে অ্যাপ্লাই কর না? বড্ড ভালো ছিল আমার স্টিল সিটির লাইফ রে! আই বেগ অফ ইউ। ইউ উইল নেভার রিপেন্ট। আই প্রমিস ইউ কুশ।
কুশল বলল, আরে! কম্পানির প্রজেক্ট ম্যানেজার আমি। সবে একবছর হল আমার । এভাবে সব ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়? প্রজেক্ট শেষ হলে দেশে ফিরে যাবো তো বলেছি তোকে।
ঠিক ফিরব তো আমরা? রাণীয়ার চোখে চিন্তার ছাপ।
কেন তোর বিশ্বাস হয়না আমাকে? আমিও কী তোর মত দেশে ফিরতে চাই না?

রাণীয়ার সত্যিই ভয় হয়। কেউ তো আজকাল বিদেশে একবার গিয়ে পড়তে পারলেই যেন হাতে চাঁদ পায়। কেন কিছুই কী নেই তাদের দেশে? তার দিদি মিঠির সাজানো সংসার ব্যাঙ্গালোরে। কোলকাতায় কুশলের বাবা মা। রাণীয়ার মামাবাড়ি তে দিদা। বাবার বাড়িতে ঠাম্মা। সবাই এখন বেঁচে। সবাই রাণীয়ার জীবনে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে।
জামশেদপুরে রাণীয়ার বাবা মা একটা ছোট্ট বাগান সমেত ডুপ্লেক্স বাংলো। কিনেছেন অবসরের পরে। সুবর্ণরেখা নদীর ধারে। সেই বাংলো তে তার তেমন করে থাকাই হয় নি আর। বিয়ে হয়ে চলে গেছিল তাই। মন কেমন করে মায়ের হাতে লাগানো সব বাহারি ক্রোটন, ঝোলানো সাকুলেন্ট এর ছবি দেখলে! একফালি গ্রিন হাউজে রকমারি ক্যাকটাস আর ফার্ন। কেমন আছে কে জানে সেই মেডেন হেড ফার্ন! ডিমনা লেকের ধার থেকে মা তুলে এনে লাগিয়েছিল। আর সবচাইতে বড় কথা হল জন্মসূত্রে বেড়ে ওঠা এ শহর । ঝকঝকে, ছিমছাম লৌহনগরীর জীবন যাত্রায় যে কী মধু তা যে পেয়েছে সেইই একমাত্র জানে। আমেরিকা আর কী দেখবে সে? এই লৌহ নগরীতে ট্যাপ ওয়াটার তখনও ড্রিংকেবল। সেখানে উদয় অস্ত রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া হয় তাই একটাও কাক নেই। কারণ সেখানে জঞ্জালের ভ্যাট নেই।

কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি এসে কাক দেখে খুব ভালো লেগেছিল রাণীয়ার। ঠিক রোজ বিকেলে নিয়ম করে ছাদের প্যারাপেটে একদল কাকের মিটিং করতে আসা দেখে সে চমকে উঠেছিল বিয়ের পরে। ছোটবেলায় কলকাতায় দিদার বাড়ির পর এভাবে এমন করে আর কাক দেখেনি সে জীবনে।
এখানে আমেরিকার অ্যাপারটমেন্টের নীচে তবু নিয়মিত নিজেদের ট্র্যাশ ফেলতে গিয়ে প্যাকেট ভর্তি জঞ্জাল চোখে পড়ে বৈকি। তবে কাক বিরল।

বিদেশে রাণীয়ার সারাদিন বাড়িতে একা একা থাকার কথাটা ভেবে কুশল মেপে নেয় বউয়ের মনের টানাপোড়েন। এইজন্যই বিশেষতঃ এখানে মেয়েদের চাকরী করাটা খুব প্রয়োজন । আত্মীয় পরিজন নেই। এখনও ওদের কোনও ইস্যু নেই। কিন্তু রাণীয়ার স্পাউস ভিসায় ওয়ার্ক পারমিট পেতে অনেক কাঠখড় পোড়ানি আছে। এইচ ওয়ান বি ভিসা পেলে তবেই পার্মানেন্ট কাজ করতে পারবে। তবে দু তিন বছর এদেশে থেকেই তো তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার কথা। তারপরেই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এনগেজড হয়ে পড়বে হয়ত রাণীয়া।


আরো পড়ুন:  রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-৫) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


কুশল বলে ওঠে আজ নতুন কী পাব্লিশড হল তোর পডকাস্ট চ্যানেলে?
বুদ্ধিমতী রাণীয়া বুঝতে পারে। তার কুশ তাকে ভালো রাখার জন্যই এসব বলছে।
সে বলে, হ্যাঁ, করব আবার কাল। এবার পিতজা নিয়ে বলব। আজ বড় নস্ট্যালজিক হয়ে পড়েছিলাম রে নিজের শহর নিয়ে। আজ আর ভালো লাগছে না। জাস্ট রিল্যাক্সিং।
কুশল বলে আজ ফ্রাইডে। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। লেটস সেলিব্রেট দ্যা উইকেন্ড। আজ কোনও বন্ধুবান্ধব না। শুধু তুই আর আমি। হয়ে যাক তবে ক্যান্ডেল লাইট বিয়ার পার্টি ।
রাণীয়া বলে, আর ডিনারে? আমি কিন্তু কিছু রাঁধিনি আজ।  
কুশল বলে ঠিক আছে। আজ আমি বানাবো তবে। বলেই সে কিচেনের দিকে যায়। তারপর এলোমেলো কিচেন স্ল্যাব, খোলা ক্যাবিনেট দেখে বোঝে রাণীয়া আজ নিশ্চয়ই কিছু সারপ্রাইজ দিচ্ছে তাকে। ফ্রাইডে বলে কথা তায় আবার সেদিন থার্টিন্থ অফ দ্যা মান্থ। এমন রাজযোটক সচারচর পড়েনা।

রাণীয়া গোধূলির গোলাপি আলো মাখছে তখনও বারান্দায় হেলানো আরামকেদারায় বসে। এদেশের তুষারপাতের পর সেদিন গোধূলি দেখলো সে। কিন্তু এখানে গোরু দেখেনি। তাই তাদের পায়ের খুরে ধুলো উড়িয়ে ঘরে ফেরার প্রশ্নই নেই।  তবুও গোধূলি গোলাপি আভা ছড়ায় দিগন্তে। কানে ইয়ার ফোন গুঁজে গান শুনছে সে নিজের মনে।

গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা…
বারান্দায় এসে কুশল বলে, তা আজ কী সারপ্রাইজ দিচ্ছিস শুনি? তারপর কিছু একটা অর্ডার করব সেই বুঝে।
রাণীয়া ইয়ার ফোন খুলে একগাল হেসে বলে এইজন্যেই তোকে এত্ত ভালোবাসি আমি। জানিস? আজ আমি ফর দ্যা ফার্স্ট টাইম বিদেশের মাটিতে পিতজা বেক করব। বলে কুশলের হাত ধরে টানতে টানতে তাকে নিয়ে আসে ফ্রিজের সামনে। তারপর সুদৃশ্য টপিং দিয়ে সাজানো, ধবধবে মোতজারেল্লা চিজের ডেকরেশনে একটা হার্ট শেপের বিশাল পিতজা দেখিয়ে বলে, কাল কত তারিখ মনে আছে স্যার?
কুশলের মাথায় থাকেনা দিনক্ষণ। সে বলে এ মাসে তো আমাদের বিয়ে, জন্মদিন কোনটাই নয়।
রাণীয়া বলে কিন্তু সারা বিশ্ব তোলপাড় ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে মশাই । তাই এই পিতজা তোর জন্যে।
কুশল মিটিমিটি হাসে। সে বউয়ের থেকে আরও বড় চালাক। ভালোবাসা এখন পণ্য। ল্যাপটপের ব্রাউজার খুললেই স্পেশ্যাল দিন ভুলে যাবে কার সাধ্যি? ভান করে যেন ভুলেই গেছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে। অতএব ছোট্ট একটা হার্ট শেপের পেন্ডেন্ট অর্ডার দিয়েই রেখেছে আগেভাগে। পাছে ভুলে যায়। বলে ওঠে, এ বাবা! দ্যাখ, আমি আবারোও…

রাণীয়া আবার কুশলের এক কাঠি ওপরে। বলে, ভুলে মোটেও যাস নি। আমার ফোন নাম্বার দিয়ে রেখেছিলি অর্ডার দেবার সময় সেটা ভুলে গেছিস। আমি অলরেডি নোটিফিকেশন পেয়েছি। কিছু একটা গিফট আসছে। এনিওয়ে পিতজা কখন আভেনে দেব বলিস।

সেই যাত্রায় দুজনে হোম বেকড পিতজায় কামড় দেয়। বিগলিত চিত্তে আগজ্বলন্ত মোতজারেল্লা চিজের সুতো মুখের ভেতর কাটতে কাটতে আত্মহারা হয়ে আগাম ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন করে ফেলে।
পরদিন যথাসময়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডের উপহার হিসেবে এক বাক্স চকোলেটের সঙ্গে এসেছিল একটা ইউএসবি মাইক্রোফোন। বউয়ের পডকাস্ট রেকর্ডিং এর জন্য। সেটা হাতে পেয়ে রাণীয়া সঙ্গে সঙ্গে বসে গেছিল কথা বলে টেস্ট করতে। সোশ্যালমিডিয়ায় তার ফ্যান ফলোয়ার রা অনুরোধ জানিয়েছে। আজকাল এসব ছোটোখাটো খুশি গুলো রাণীয়া কে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারে অনাবিল শান্তি দেয়।
কখনও সেজেগুজে নিজের লিভিং কাম ডাইনিং রুমে এক পাক নেচে নেয় খানিক মনের সুখে। ফোনে চালিয়ে দেয় রবিঠাকুরের গান।
সেদিন রাতেই পিৎজা প্রেমে বিগলিত চীজে গদগদ হয়ে রাণীয়া বসে পড়েছিল পডকাস্ট করতে।  
“হ্যালো বন্ধুরা! আজ জানাবো আমাদের সবার প্রিয় পিতজার কথা।
এখন বেকারী বা কফিশপে যে ফোকাসিয়া ব্রেড আমরা কিনি সেগুলি আসলে রোমান ফ্ল্যাট ব্রেড যেগুলির ওপর পছন্দের টপিং ছড়িয়ে বেক করে খাওয়া হত। সেদিক থেকে বিচার করলে পিতজা কে বলা যায় ফোকাসিয়া ব্রেডের উত্তরসূরি। এখন যে পিতজা আমরা খাই তা অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইতালির নেপলসে আবিষ্কৃত একই ধরণের ফ্ল্যাটব্রেড। তখনকার দিনে সেইজন্য এর নাম ছিল নেপোলিটান পাই।  নানাবিধ পছন্দের আমিষ, নিরামিষ টপিংয়ের বাহারে তা হয়ে উঠতে পারে মুখরোচক এক স্ন্যাক্স বা কমপ্লিট মিল।
কারো মতে, পিৎজার উৎপত্তি রোমান জিউসদের খাবার পিজ্জারেল থেকে।
ইউরোপীয় পিতজার সঙ্গে ভারতীয় নান, পরোটা, উত্তাপমের আকৃতিগত মিল থাকায় এখন ভারতীয় এইসব রুটির ওপরেও নানারকমের টপিং দিয়ে খাওয়ার চল হয়েছে। চীজ,সস, টমেটো, পেঁয়াজ কুচি, অলিভ কুচি, অলিভ ওয়েল, ক্যাপসিকাম এসবই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পিৎজার ক্ষেত্রে সাধারণত মোৎজারেলা চীজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া চিংড়ি মাছ, মুরগীর মাংসের কুচি, মাশরুম, বেবিকর্ণ, আনারসের টুকরো, স্যুইট কর্ণ এর মত বৈচিত্র্যময় টপিং দিয়ে আরও বাহারি করা হয়। পিতজায় ব্যাবহৃত ইটালিয়ান সিজনিং এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ওরেগ্যানো আর চিলি ফ্লেক্স।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইতালির নেপলস শহর গড়ে ওঠে এক গ্রীক উপনিবেশে। এই নেপলস স্বাধীন একটি রাজ্য ছিল, কিন্তু এখানকার মানুষগুলো ছিল হত দরিদ্র তায় শহরে কোনও কাজ জুটত না তাদের। ফলে লোকজন বাইরে কাজ করে জীবিকা চালাত। তাদের প্রয়োজন ছিল চটজলদি এবং সস্তা এমন কিছু খাবার। রাস্তার ধারে উন্মুক্ত আকাশের নীচে ছোট ছোট মোবাইল ভ্যান দোকানে তখন থেকেই শুরু হয় ফ্ল্যাট রুটির উপর বিভিন্ন টপিংস দিয়ে তৈরি পিজ্জা।
নেপলসের তথা সারা বিশ্বের প্রথম পিজ্জার দোকান ‘অ্যান্টিকা পিজ্জারিয়া পোর্ট-অ্যালবা’।
নেপলসের পিজ্জাগুলোর রুটিটি অনেক নরম হয়। রোমে আবার পাতলা কড়মড়ে রুটির পিজ্জা বেশি জনপ্রিয়।
তবে পিজ্জার উৎসমূলে কিন্তু  নেপলসের সেই অনুন্নত দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষরা তা ভুলে গেলে চলবে না আমাদের।  
পরবর্তীকালে অনেক মডিফিকেশন এবং ভ্যারাইটি এসেছে পিতজার টপিংয়ে। যেমন কানাডার বিক্রিত ‘হাওয়াইয়ান পিতজা’য় টপিংস হিসেবে আনারস এবং মাংস ব্যবহার করা হতো।
১৮৬১ সালে ইতালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি একত্রিত হবার পরে রাজা প্রথম আম্বারটো এবং রানী মার্গারিটা ইতালি ভ্রমণে বের হন এবং ১৮৮৯ সালে নেপলসে আসেন। কথিত আছে, এই রাজদম্পতি তাদের একঘেয়ে ফরাসি খাবারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আদেশ দেন শহরের এক পিজ্জারিয়া থেকে পিজ্জার উপকরণ সংগ্রহ করে পিজ্জা বানানোর জন্য।
রাফায়েলে এস্পোসিটো নামের এক রুটির কারিগরকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল পিজ্জা বানানোর জন্য।ইতালির পতাকাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে রাফায়েলে বিশেষ ধরনের এক পিজ্জা তৈরি করে রাজারাণী কে তাক লাগিয়েছিলেন। সাদা মোৎজারেলা চীজ, লাল ট্যোমেটো সস এবং সবুজ পুদিনা পাতা দিয়ে টপিংস দেয়া এই পিজ্জা খেয়ে রানী এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে সর্বস্তরে পিজ্জার প্রসারের কথা বলেছিলেন। সেইথেকেই এই টপিং দেওয়া পিজ্জা ‘মার্গারিটা পিজ্জা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
সেই সময়ে মার্গারিটা পিজ্জা ছাড়াও জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ম্যারিনারা পিজ্জা’। এই পিজ্জা বানাতেন এক নাবিকের স্ত্রী লা ম্যারিনারা নামে এক মহিলা। সমুদ্রযাত্রা শেষে সেই নাবিক বাড়ি ফিরলে ম্যারিনারা তাকে এই পিজ্জা বানিয়ে দিতেন। এই পিজ্জায় টপিংস হিসেবে টমেটো, পেঁয়াজ, অরেগ্যানো এবং বেশি করে জলপাই তেল থাকত।
মেডিটেরেনিয়ান কুইসিনের মুখ্য কথাই হল অলিভ অয়েলে তৈরী সহজপাচ্য খাবার। ইতালি জলপাইয়ের দেশ, অলিভ অয়েল ওদের কুকিং মিডিয়াম। তাই পিতজার শয়নে স্বপনে জাগরণেও এক্সট্রা ভার্জিন জলপাই তেল। তা বলাই বাহুল্য।
সাগর পাড়ি দিয়ে এই পিজ্জা নেপলস শহর থেকে চলে যায় আমেরিকায়।

আমার কাছে অবিশ্যি স্থান-কাল-পাত্র লাগেনা। চার ইঞ্চি থেকে ষোলো ইঞ্চি, যেমনই হোক তার সাইজ, গোল কিম্বা চৌকো, যাই হোক তার আকার, পিতজা হল পিতজাই আর তা খাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় লাগেনা।
বাড়িতে নুন চিনি দেওয়া ঈষদুষ্ণ দুধে ভেজানো সফট ইস্ট দিয়ে তেল হাত করে ময়দা মেখে ঢেকে রেখে বেশ কিছুক্ষণ ফুলিয়ে নিতে হবে। তারপর বেলে নিয়ে তার ওপর ইচ্ছেমত্ টপিং  দিয়ে  আভেনে বেক করে দিব্য বানানো যায় পিতজা। এই বেকিং শুধু সময়সাপেক্ষ। আজকের মত এটুকুই। থ্যাংকস টু অল অফ ইউ। স্টে টিউনড হ্যাপি বেকিং! ”  

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত