এক পাড়াতেই থাকে। একজনের নাম বঙ্কু। আর একজনের নাম গঙ্গা। কিছুদিন হলো বঙ্কু গঙ্গাকে এড়িয়ে চলছে। গঙ্গা ফোন করলে বঙ্কু ফোন করে না। এমনকী রাস্তায় দেখা হলে ভালো করে কথা বলে না। ‘ব্যস্ত আছি’—বলে চলে যায়।গঙ্গা অবাক হয়। ভাবে, বঙ্কু তো এমন ছিল না। আগে দেখা হলে কথা বলত। রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে চিকেন রোল খাওয়াতো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়াতো। ফোনে একঘণ্টা ধরে কথা বলত। এখন আর সেই বঙ্কু নেই। বঙ্কু বদলে গেছে। কী হলো বঙ্কুর? নতুন কোনও বান্ধবী জোগাড় করেছে? করতেই পারে। ছেলেদের মতিগতি বোঝা ভার। কখন কী ভাবে, কী করে বোঝা যায় না। না গেলেও গঙ্গা সহজে বঙ্কুকে ছাড়বে না।
একদিন গঙ্গা অনেক ভেবেচিন্তে বঙ্কুদের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলো। বঙ্কুর মা দরজা খুলে দিলেন। গঙ্গাকে তিনি ভালোভাবেই চেনেন। গঙ্গা অনেক বার এই ফ্ল্যাটে এসেছে। অনেক সময় কাটিয়েছে। তাই মুখে হাসি এনে বঙ্কুর মা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?
গঙ্গা বলল, আমি একরকম, আপনি কেমন আছেন?
—আমিও একরকম আছি।
—বঙ্কু ঘরে আছে?
—আছে।
—ওর সঙ্গে একটু দরকার ছিল। ও কি খুব ব্যস্ত আছে?
—তা বলতে পারব না। গিয়ে দেখো কী করছে।
আজ রবিবার। বঙ্কুর অফিস নেই। ল্যাপটপে সিনেমা দেখছিল। গঙ্গা ঘরে ঢুকতেই বঙ্কু ল্যাপটপ বন্ধ করে গঙ্গার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, তুমি! কী ব্যাপার?
—তোমার সঙ্গে কথা ছিল। —বলে, গঙ্গা একটা চেয়ার টেনে পাশে বসল।
বঙ্কু জিজ্ঞেস করল, কী কথা?
গঙ্গা বলল, আমি ফোন করলে তুমি ফোন ধরো না কেন?
—তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।
—তাই রাস্তায় দেখা হলে ব্যস্ত আছি বলে এড়িয়ে যাও?
—ঠিক। এই কারণেই তোমাকে নিয়ে আর রেস্তোরাঁয় যাই না। রাস্তায় দাড়িয়ে ফুচকা খাই না। ফোনে তোমার সঙ্গে বকবক করি না। সত্যি বলছি, তোমাকে আমার আর ভালো লাগে না।
কথাটা শুনে গঙ্গার চোখ ফেটে প্রায় জল চলে এলো। অভিমান ভরা গলায় জিজ্ঞেস করল। ‘আমাকে ভালো লাগে না কেন? আমি কী করেছি?’
—তুমি করোনি কিছু।
—তাহলে?
—সত্যি কথাটা শুনবে?
—শুনব। তুমি বলো।
বঙ্কু একটু থেমে বলতে লাগল, তুমি যখন কথা বলো তখন তোমার মুখ দিয়ে গন্ধ বেরোয়। তুমি যখন হাসো তখন তোমার দাঁতের মাড়ি দেখা যায়। তুমি ভুল সুরে রবীন্দ্রসংগীত গাও। তোমার চুলে উকুন আছে। তুমি একটু মোটা। এসব ছাড়া তুমি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারো না। বাংলা বলতে গিয়ে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ হিন্দি শব্দ ব্যবহার করো। তুমি এখনও সঙ্গে না না বলে সাথে শব্দ ব্যবহার করো। আমি এসব পছন্দ করি না। এসব খুব গ্রাম্য। বুঝতে পেরেছ?
—পেরেছি বলে গঙ্গা উঠে পড়ল। জল-ভর্তি চোখে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এলো। বঙ্কুর মা-র চোখে তা ধরা পড়ল।
২.
সারাদিন বঙ্কুর মা কিছু বললেন না। সন্ধে বেলা সোফায় বসে বঙ্কুকে ডাকলেন। পাশে বসালেন। তারপর বললেন, তোর বয়স হয়ে গেছে। এখনও মেয়েদের সম্মান করতে শিখলি না?
বঙ্কু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, এ কথা বলছ কেন?
—তুই সকাল বেলা গঙ্গাকে কী বলেছিস?
—কেন?
—আমি দেখলাম সকাল বেলা চোখ-ভর্তি জল নিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় আমার সঙ্গে একটা কথাও বলল না। কী হয়েছে? কী বলেছিস গঙ্গাকে?
—বলেছি ওর মুখ দিয়ে গন্ধ বেরোয়।
—সেটা ডাক্তার দেখালেই ঠিক হয়ে যায়। এছাড়া আর কী বলেছিস?
—বলেছি হাসলে ওর দাঁতের মাড়ি দেখা যায়।
—এটা ওর দোষ নয়। আর কী বলেছিস?
—বলেছি ও ভুল সুরে রবীন্দ্রসংগীত গায়।
—ভালো শিক্ষিকার হাতে পড়লে সেটাও ঠিক হয়ে যাবে। আর কী বলেছিস?
—বলেছি ও শুদ্ধ বাংলা বলতে পারে না। হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা বলে।
—ওটাও শুধরে নেওয়া যায়। আর কী বলেছিস?
—বলেছি ও এখনও সঙ্গে না বলে সাথে বলে।
—এটাও ওর দোষ নয়, বাড়ির দোষ। আর কী বলেছিস?
—ওকে গ্রাম্য বলেছি।
—এ তোর অন্যায়, ভীষণ অন্যায়।
—অন্যায়!
—হ্যাঁ অন্যায়। এর জন্যে ওর কাছে তোর ক্ষমা চাওয়া উচিত।
—ক্ষমা!
—হ্যাঁ, ক্ষমা। আমি অবাক হয়ে ভাবছি ওর গুণগুলো তোর চোখে পড়ল না। ওর বিনয়, ওর ভদ্রতাজ্ঞান শেখবার মতো। এছাড়া ওর চোখ দুটো কত সুন্দর। ওর নাকটা কত সুন্দর। ওর শরীরের গঠন কত সুন্দর। এছাড়া ও লেখাপড়ায় কত ভালো। কত ভালো চাকরি করে। এতটুকু অহংকার নেই। এমন মেয়েকে তুই গ্রাম্য বলতে পারলি! ছি! ছি।
—আমি মানছি আমার অপরাধ হয়েছে। ওভাবে আমার কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কিন্তু কথাগুলো বলা আমার উচিত ছিল। নইলে ও শোধরাতো না।
—কথাগুলো তো ভালোভাবেও বলা যেত। তুই তা না বলে খারাপভাবে কথাগুলো বলেছিস। লেখাপড়া শিখে তুই ঠিকমতো মানুষ হোসনি। তোর বাবা এসব জানতে পারলে ভীষণ রেগে যাবে।
বঙ্কু তা শুনে নরম হয়ে বলল, তুমি বাবাকে কিছু বোলো না।
তা বলব না। তবে গঙ্গার কাছে তোকে ক্ষমা চাইতে হবে।
—ঠিক আছে তাই হবে।—বলে বঙ্কু মা-র পাশ থেকে উঠে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল।
বঙ্কু সারাদিন এনিয়ে কিছু ভাবেনি। মা-র কথা শুনে বুঝতে পারল যে একটা বড়ো অন্যায় করে ফেলেছে। এখন উপায় কী? মা গঙ্গার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছে। কিন্তু ক্ষমা চাওয়া কি এত সহজ! আর ক্ষমা চাইলেই যে গঙ্গা তাকে ক্ষমা করবে তার মানে নেই। উল্টে তাকে অপমানও করতে পারে। সেটা তার পক্ষে হজম করা সহজ হবে না। অথচ মা-র কথা ফেলা যাবে না। মা-র কথা তাকে শুনতেই হবে। কিছু করার নেই। অতএব ক্ষমা তাকে চাইতেই হবে। কিন্তু কীভাবে চাইবে?
প্রথমে গঙ্গার মোবাইলে একটা ফোন করা যেতে পারে। দেখা যাক। ও কী বলে।
বঙ্কু গঙ্গাকে ফোন করল।
ফোন বেজে গেল। গঙ্গা ফোন ধরল না।
বঙ্কু আবার ফোন করল। এবারেও ফোন বেজে গেল। গঙ্গা ফোন ধরল না। বঙ্কু তৃতীয় বার ফোন করল। এবারেও ফোন বেজে গেল। গঙ্গা ফোন ধরল না। এরকম তো আগে কোনওদিন হয়নি। হয় ও বাথরুমে কিংবা অন্য কোথাও গেছে। সঙ্গে মোবাইল নিয়ে যায়নি। কিংবা গঙ্গা তার ওপর ভীষণ রেগে গেছে। তাই মোবাইলের স্ক্রিনে নামটা দেখে ফোন ধরেনি।
তাহলে এখন কী করবে সে?
আরো পড়ুন: তাজমহল । শাহীন আখতার
৩.
বঙ্কু প্রথমে ভাবল সে গঙ্গার সঙ্গে ফ্ল্যাটে দেখে করবে। করতে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু গঙ্গা যদি তার সঙ্গে দেখা না করে? আর দেখা করলে গঙ্গা তার সঙ্গে কথা না-ও বলতে পারে। তাঁর মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে পারে। তখন কী করে সে ক্ষমা চাইবে! মুখ ম্লান করে তাকে ফিরে আসতে হবে। সেই অপমান তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে। এখন বুঝতে পারছে গঙ্গার সঙ্গে যে ব্যবহার সে করেছে তা অন্যায় হয়েছে। এমন কাজ সে কেন করতে গেল! এটাকে মতিভ্রম ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অথচ গঙ্গাকে সে যে ভালোবাসে না, তা নয়। তাহলে? তাহলে সে এরকম কেন করল তা তার মাথায় এলো না।
এখন একটাই প্রশ্ন: গঙ্গার কাছে কীভাবে ক্ষমা চাওয়া যায়? ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা করে ক্ষমা চাইলে কাজটা সহজ হতো। কিন্তু এতে যেহেতু অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই তাকে অন্য উপায় ভাবতে হবে। গঙ্গা ফোন ধরছে না, তার ফ্ল্যাটেও যাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে ফোনে মেসেজ পাঠালে কেমন হয়? এতে আর যাই হোক অপমানিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। বঙ্কু ভেবে দেখল, ক্ষমা চাওয়ার এই পদ্ধতিটা অনেক নিরাপদ।
বঙ্কু প্রথমে এই মেসেজ পাঠালো:
আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি আমাকে ক্ষমা করো।—বঙ্কু।
কিন্তু এই মেসেজের কোনও উত্তর এলো না।
বঙ্কু দ্বিতীয় বার এইরকম মেসেজ পাঠালো:
আমি তোমাকে অপমান করে অন্যায় করেছি। তুমি এর জন্য যে শাস্তি আমাকে দেবে তা আমি মাথা পেতে নেব। তুমি শুধু আমাকে ক্ষমা করো।—বঙ্কু।
কিন্তু এই মেসেজেরও কোনও উত্তর এলো না।
বঙ্কু তৃতীয় বার এইরকম মেসেজ পাঠালো:
আমি তোমার সামনে কান ধরে একশো বার ওঠবোস করব। তুমি শুধু আমাকে ক্ষমা করো।—বঙ্কু।
বঙ্কু চতুর্থ বার এইরকম মেসেজ পাঠালো:
তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না করো তাহলে আমি গলায় দড়ি দিয়ে কিংবা গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব। তার জন্যে তোমাকে দায়ী করে যাব। তবে যদি ক্ষমা করো তাহলে এসব আমি কিছু করব না।—বঙ্কু।
কিন্তু এই মেসেজেরও কোনও উত্তর এলো না।
বঙ্কু পঞ্চম বার এইরকম মেসেজ পাঠালো:
আত্মহত্যা করব ভেবেও আত্মহত্যা করলাম না। করলাম না শুধু তোমার ক্ষমা পাওয়ার আশায়। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে না? আমি কি তোমার ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই?
এবার গঙ্গার কাছ থেকে একটা মেসেজ এলো। মেসেজটা এইরকম:
আমি মরে গেলেও তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না। তুমি অতি অসভ্য, ইতর, ছোটোলোক।—গঙ্গা।
বঙ্কু এর জবাবে লিখল:
মানলাম আমি অসভ্য, ইতর, ছোটোলোক। তাই বলে আমি তোমার ক্ষমা পাব না কেন? সব অপরাধীর ক্ষমা আছে। আমার অপরাধাধের ক্ষমা নেই?—বঙ্কু।
গঙ্গা লিখল:
না, তোমার অপরাধের ক্ষমা নেই।—গঙ্গা।
বঙ্কু আবার লিখল:
ঠিক আছে ক্ষমা করতে হবে না। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। সেটা কী সম্ভব হবে?—বঙ্কু।
সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো:
না।—গঙ্গা।
৪.
বঙ্কু চুপ করে গেল। গঙ্গার সঙ্গে আর যোগাযোগ করল না। মাকেও এ নিয়ে কিছু বলল না। ভাবল, আর কিছু জিজ্ঞেস করবে না। আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ভুলে যাবে।
কিন্তু মা ভোলেননি। একদিন বঙ্কুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, গঙ্গার সঙ্গে কথা হয়েছে?
—হয়েছে।
—ক্ষমা চেয়েছিস?
—চেয়েছিলাম। কিন্তু ও আমাকে ক্ষমা করবে না। আমার ওপর ভীষণ রেগে আছে।
—রেগে থাকারই কথা।—বলে মা বললেন, তুই একদিন ওদের ফ্ল্যাটে যা।
—ও যদি অপমান করে?
—গঙ্গা এত অভদ্র নয় যে তোকে অপমান করবে।
—আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
—হোক অস্বস্তি। তুই ওর সঙ্গে দেখা কর। ব্যাপারটা মিটিয়ে নে।
—ও কি মেটাবে?
—মেটাবে। মেয়েদের রাগ কোনওদিন থাকে না। দুটো মিষ্টি কথা বললে মেয়েরা সব ভুলে যায়।
—সত্যি বলছ?
—হ্যাঁ।
এরপর আর কিছু করার নেই। মার পরামর্শ শিরোধার্য। গঙ্গাদের ফ্ল্যাটে গিয়েই ক্ষমা চাইবে সে। কিন্তু বঙ্কু ভেবে পেল না সে গঙ্গাকে কী কী মিষ্টি কথা বলবে, যা শুনলে গঙ্গা খুশি হবে। সব রাগ পড়ে যাবে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করল যেসব দোষ দেখিয়ে গঙ্গাকে অপমান করেছিল, সেই দোষগুলোকেই প্রশংসা করবে। করে ক্ষমা চাইবে। বলবে সেই সময় তার মাথার ঠিক ছিল না, তাই ওইসব বলেছে। ওইসব কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। কিন্তু গঙ্গা কি এই যুক্তি মানবে? ভাববে, আমি তাকে খুশি করার জন্য একথা বলছি। এটা আমার মনের কথা নয়। গঙ্গা যদি এরকম ভাবে তাহলে করার কিছু নেই। তবে মা-র কথাও ফেলা যায় না। গঙ্গার কাছে গিয়ে দেখা যাক কী হয়। শোনা যাক গঙ্গা কী বলে। আগে থাকতে এত চিন্তা করার মানে হয় না। আচ্ছা, গঙ্গাকে জানিয়ে গেলে কেমন হয়? তাহলে কোনও সমস্যা থাকে না। কিন্তু ফোন করে যাবার কথা বললে গঙ্গা যদি বলে, না, আসতে হবে না, তাহলে কী করবে সে? তারপরও কি তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যায়? সেটা সম্ভব নয়। তাহলে? তাহলে ফোন করার দরকার নেই। সে এক রবিবারের সকালে হুট করে গঙ্গাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হবে। ডোর বেল বাজিয়ে ভিতরে ঢুকবে। তারপর যা হবার হবে। তাকে গঙ্গা বড়োজোর গালমন্দ করবে। বড়োজোর বলবে, কী করতে এসেছ? বেরিয়ে যাও। মারধর তো করবে না। কথাটা ভেবেই বঙ্কু হেসে ফেলল।
৫.
ডোর বেল বাজাতেই গঙ্গার মা দরজা খুললেন। বঙ্কুকে দেখেই বললেন, তুমি এসেছ, খুব ভালো হয়েছে।
বঙ্কু একটু চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন? কিছু হয়েছে নাকি?
—কী হয়েছে তা বলতে পারব না।
—তাহলে?
—কিছুদিন ধরে ও ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে। বিউটিশিয়ানের কাছে যাচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে কিছু বলে না। হঠাৎ দেখছি ও রূপচর্চার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়েছে। কেন তা জানি না। আগে তো ওর এসব রোগ ছিল না। এইসঙ্গে আর একটা জিনিস দেখছি। ও তোমার নাম সহ্য করতে পারছে না। তোমার নাম করলে ভীষণ চটে যাচ্ছে। তোমার নাম মুখে আনতে বারণ করছে। তোমাদের মধ্যে কী কোনও ঝগড়া হয়েছে?
—ঝগড়া কিছু হয়নি।
—তাহলে ও হঠাৎ বদলে গেল কেন?
—জানি না।—বলে বঙ্কু জিজ্ঞেস করল গঙ্গা কি ঘরে আছে?
—আছে।
—কী করছে?
—বলতে পারব না।
—দেখছি, কী করা যায়।—বলে বঙ্কু গঙ্গার ঘরে ঢুকল। গঙ্গা খাটে শুয়েছিল। বঙ্কুকে দেখে উঠে বসল। ক্রুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে? কী চাই তোমার?
—তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।—বলে, করুণ মুখ করে বঙ্কু গঙ্গার মুখের দিকে তাকালো। তাকিয়ে অবাক হলো। সে গঙ্গা আর নেই। এখন গঙ্গাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে।
গঙ্গা বলল, আমি তোমাকে জীবনে ক্ষমা করতে পারব না। তুমি এখন যাও।
বঙ্কু বলল, আমি যেতে আসিনি। আমাকে তুমি ক্ষমা করবে, তারপর যাব।—বলে জিজ্ঞেস করল, বসতে পারি?
—বোসো।
এই কথায় বঙ্কু বুঝতে পারল, গঙ্গা একটু নরম হয়েছে। তাই ইতস্তত না করে একটা চেয়ার টেনে গঙ্গার পাশে বসল। বসেই বলল, তোমাকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে। এত রূপ তোমার ছিল কোথায়?
গঙ্গা বলল, এর জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে।
বঙ্কু বলল, চিন্তা নেই। টাকাটা আমি তোমাকে দিয়ে দেবো।
গঙ্গা রেগে গিয়ে বলল, থাক, তোমার সাথে—পর্যন্ত বলে নিজেকে শুধরে নিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না। কারণ অনেক।
—কারণগুলো জানতে পারি?
—তুমি আমাকে শুধু অপমান করেছ বলে নয়, তুমি যখন কথা বলো তখন তোমার মুখ দিয়ে থুতু ছিটকোয়। তুমি যখন হাসো তখন সে হাসিতে প্রাণ থাকে না। তুমি পনেরোটার বেশি রবীন্দ্রসংগীত জানো না। তোমার চুলে খুসকি আছে। তুমি বড়ো রোগা। তুমি শুদ্ধ হিন্দি বলতে পারো না। হিন্দি বলতে গিয়ে তুমি বাংলা বলে ফেলো। তুমি ওখনও লুচি না বলে নুচি বলো। সবচেয়ে বড়ো কথা তুমি ভীষণ চিংড়ি মাছ খেতে ভালোবাসো। আমি এসব একদম পছন্দ করি না।
বঙ্কু এবার হেসে বলল, তুমি যদি নিজেকে বদলে নিতে পারো, আমিও নিজেকে বদলে নিতে পারব। তবে ইলিশ মাছ খেতে আমার ভালো লাগলেও খেতে অসুবিধে হয়। খুব কাঁটা।
—আমি শিখিয়ে দেবো।
—তাহলে তো চিন্তা নেই। কিন্তু তোমার সঙ্গে যদি সম্পর্ক না থাকে কী করে শেখাবে?
—সেটাই চিন্তার। দেখি কী করা যায়। তুমি এখন আসো।
—আসো নয়, এসো।
—ভুল হয়েছে। আর হবে না।—বলে গঙ্গা বলল, যাবার আগে চা খেয়ে যাও।
—তার মানে তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ। তাই তো?
—আপাতত করলাম।
উৎসাহিত হয়ে বঙ্কু জিজ্ঞেস করল, আমাদের আবার দেখা হবে কবে?
গঙ্গা বলল, সামনের রবিবার।
—কোথায়?
—নন্দন চত্বরে।
—কখন?
—বিকেল চারটেয়।
—চারটের সময় আসতে পারব না। পাঁচটা করো। চারটের সময় একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
—আমার জন্যে তার সঙ্গে দেখা করবে না। তোমাকে ঠিক চারটেয় আসতে হবে।
—সম্ভব নয়।
—সম্ভব নয় বললে হবে না। তোমাকে রবিবার ওই সময় আসতেই হবে। আমি তোমার কোনও কথা শুনব না।
—এরকম জেদ কোরো না। মেয়েদের এত জেদ ভালো নয়।
—কী বললে? আর একবার বলো।
—না, মানে বলছিলাম…..
পাঠক, এই ঝগড়ার মধ্যে আমাদের না থাকাই ভালো। আজ তাই বিদায় নিচ্ছি পরে আবার অন্য গল্প হবে। নমস্কার।
সংগ্রামী মা মাটি মানুষ পত্রিকা ২০১৭ পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত
