| 27 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য প্রবন্ধ: বাঁকুড়া জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম । ভজন দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

বাঁকুড়া জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রামে হরিহর মুখোপাধ্যায় ও রামদাস চট্টোপাধ্যায়ের অবদান 

বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলা যে বাংলার বিপ্লববাদের আঁতুড়ঘর সেকথা হয়তো অনেকেই জানেন কিংবা জানেন না ! না জানলে বাঙালির মহাভারত কিছু অশুদ্ধ হয়ে যায় না । ‘ ইতিহাস বিস্মৃত জাতি’-র কলঙ্ক আমাদের কপালে ! ইতিহাসের ধার যদি আমরা  ধারতাম তাহলে  বাঙালির ইতিহাস অন্য খাতে বইতে পারত ! আমাদের স্মৃতি খুব দুর্বল । নতুন  একটা হুল্লোড় বা হুজুগ পেলে আমরা তাই নিয়ে মেতে যাই, তখন পুরাতনকে জীর্ণ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে আমরা দ্বিধা করি না – এরকম বাস্তব এবং  অপবাদও যে আছে, তা আমরা অস্বীকার করতে পারি কি ! 

বাদ দিন, ধান ভানতে যেটুকু গুনগুন করার দরকার ছিল হয়ে গেছে।  যে কথা আলোচনা করার জন্য  এই লেখা, সে কথাই ধরুন না , আমরা কতজন জানি বৃটিশ শাসিত ভারতে প্রথম ভারতীয় হিসেবে হরিহর মুখোপাধ্যায়

 ( ১৮৩৮ – ১৯০২ ) টানা পনের বছর (১৮৮৫ -১৯০০) যে বাঁকুড়া পৌরসভার পৌরপ্রধান হিসাবে হিসাবে ছিলেন ! 

              কে ছিলেন এই হরিহর মুখোপাধ্যায়, আসুন তবে একটু জেনে নেওয়া যাক। ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের কাছে মণিরামপুরের মধুসূদন মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর পিতা । পিতা ছিলেন ব্যারাকপুরের একজন কন্ট্রাক্টর । ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের সময় হরিহরের বয়স ছিল  ১৮ । সেনা বিদ্রোহ সেখান থেকে শুরু হয়ে সারা ভারতে আগুনের মত কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার সূচনা ও পরিণতি  তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন । বছর আঠারোর হরিহরের মনে এই ঘটনার ছাপ পড়াই স্বাভাবিক। ব্রিটিশ শক্তিদের পরাস্ত করার জন্য  এই বুঝি সেই মুক্তির পথ, এরকমটা মনে আসাও আশ্চর্যজনক নয় ! সিপাহি  বিদ্রোহের আগুন থেকে দূরে থাকার জন্য পরিবারটি কি চলে এসেছিল সেই সময়ের  আপাত শান্ত বাঁকুড়ায় ! জানা যায়, সিপাহি বিদ্রোহের সময় সাখাওয়াতি সৈন্যদল বাঁকুড়ায় অবস্থান করছিল । এছাড়াও ছোটনাগপুর থেকে সংগ্রহ করা সৈন্য নিয়ে গঠিত রায়গড় লাইট ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ান বরাবর বাঁকুড়ায় মোতায়েন থাকত । তারা সামান্যতম অশান্তিও যাতে সৃষ্টি করতে না পারে তার জন্য  সিপাহি বিদ্রোহের শুরুতেই সাখাওয়াতি সৈন্য দিয়ে ওদের অন্য জায়গায় পাঠিয়ে বিদ্রোহের সামান্যতম সম্ভবনাকেও অঙ্কুরেই বিনাশ করে ধুরন্ধর শাসক । সিপাহি বিদ্রোহের আগুন বাঁকুড়ার পাশে পাঁচেট , পুরুলিয়া , রাণীগঞ্জে ছড়িয়ে পড়লেও বাঁকুড়া ছিল “চুপচাপ ও শান্ত’ । সুতরাং ব্যরাকপুর থেকে বাঁকুড়ায় আসা শান্তি ও নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক  কারণে  । 

                     বাঁকুড়া শহর তখন সেই গড়ে উঠছে। ১৮৩২-এ ‘গঙ্গানারায়ণ সিংহের হাঙ্গামা’র পরিপ্রেক্ষিতে, ১৮৩৩এ ‘জঙ্গল মহল’ জেলাটির অবলুপ্তি ঘটানো হয়েছিল। বাঁকুড়া শহরকে সদর হিসেবে নতুন একটি প্রশাসনিক এলাকা গঠন করা হয় ‘সাউথ ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি’ নাম দিয়ে। এই সময় থেকেই পরিষ্কার  বোঝা যায়, ব্রিটিশ সরকার বিষ্ণুপুর নয় বাঁকুড়াকেই জেলা সদর হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন। যার ফলে জেলার বাইরে থেকে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবার, ব্যবসায়ীরা বাঁকুড়ায় এসে ভিড় করতে শুরু করেন ।  বর্তমান বাঁকুড়া জেলার সমগ্র পশ্চিম অংশ তখন ‘মানভূম’ জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল। অনেক ভাঙাগড়ার পরে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া জেলা গঠন সম্পূর্ণ  হয়। সে বছরই শহরে পৃথক একটি জজের আদালত গঠিত হওয়ার একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসাবে বাঁকুড়ার পথে চলা শুরু হয়। 

                        স্থান পরিবর্তনে হরিহরের  উঠতি বয়সে লাগা মনের আগুন কি নিভল ! প্রথম প্রেমের মতোই আজীবন কি তিনি সেই আগুনকে গোপনে সযত্নে লালন করে গিয়েছেন !  ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার শাসনভার তুলে নেওয়ার পর ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের সামনে আরও সুযোগ সৃষ্টি হল। সরকারের নানান কাজে নিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি তারা সামাজিক নানান কাজে অংশ নিতে শুরু করে। ১৮৬৫ থেকে  স্বায়ত্তশাসনের জন্য ‘টাউন কমিটি’-তে এরাই সরকার মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে রইলেন। ইংরেজ অনুগত বলেই তাদের মনে করা হত। কারণ, অধিকাংশই তাই ছিলেন। কিন্তু হরিহর মুখোপাধ্যায় এদের মধ্যে ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

                         বাঁকুড়া শহরের মাচানতলা থেকে মসজিদকে বাঁহাতে রেখে  চৌমাথার মোড়ে বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট সেন্ট্রাল কোপারেটিভ ব্যাঙ্কের সামনে নেতাজির মূর্তিকে ডানহাতে রেখে, আবার বাঁদিক বরাবর রামপুরের দিকে গেলে পড়বে বাঁকুড়া গার্লস হাইস্কুল। স্থানীয় মানুষ বলেন কালীতলা গার্লস। বাঁকুড়া শহরে একটি বড় কালীতলা ও আরেকটি ছোট কালীতলা আছে। এই বড় কালীতলাতেই সেই ঐতিহাসিক বিপ্লবী বাড়িটি আজও বর্তমান। এই পথে যেতে যেতে মানুষজন শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখেন, সেখানে  লেখা আছে , ’বৈপ্লবিক বাড়ী’ । একদিন এই বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হরিহর মুখোপাধ্যায় । তার নাম দিয়েছিলেন হরিহর লজ। 

                   হরিহর মুখোপাধ্যায় পেশায় ছিলেন সরকারি আইনজীবী। বাঁকুড়া শহরে টাউন কমিটি গঠিত হলে পরের দিকে তিনি সেই কমিটির ব্রিটিশ সরকার মনোনীত প্রতিনিধি ছিলেন। পৌর প্রশাসক হিসেবে তাঁর জনমুখী কর্মসূচির মধ্যে  ছিল শহরের জলকষ্ট নিবারণ, রোগ,মহামারী জর্জরিত বাঁকুড়ায় ত্রাণের ব্যবস্থা করা, শহরের পয়ঃপ্রণালি পরিকল্পনা রূপায়ণ, দাতব্য চিকিৎসালয়, মোরামের রাস্তায় জল দেওয়ার ব্যবস্থা, ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাঁকুড়া শহরে  ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে গৃহহীন মানুষদের পৌরসভা থেকে বাড়ি নির্মাণের জন্য সাহায্য করা, বাঁকুড়া ও রাজগ্রামে বাজার তৈরি করা, ১৮৯৭-এর দুর্ভিক্ষে নিরন্ন মানুষের জন্য অন্নসত্র ইত্যাদি কাজ তিনি অনেকটাই করতে পেরেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। যে সময় ব্রিটিশরা স্বায়ত্তশাসনের নামে দেশীয় প্রজাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করার কৌশল হিসেবে মিউনিসিপালিটিকে ব্যবহার করতো সেই সময় তাঁর এই ভূমিকা উল্লেখ করতেই হয়। 

                   হরিহর মুখোপাধ্যায়  সরকারি উকিল, পৌরপ্রধান। সরকারি পদের আড়ালে তিনি বিপ্লবী আখড়ার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বাঁকুড়া জেলায় বিপ্লববাদের আঁতুড়ঘর নির্মাণে তিনি একটি একটি করে ইট গেঁথেছেন। তাঁর বসতবাড়ির পাশেই যে  ‘রাম দাসের আখড়া’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জেলার আরেকজন প্রাতঃস্মরনীয় ব্যক্তি রামদাস চক্রবর্তীর (১৮৭৬-১৯৪৭) নাম। তাঁর পৌত্র ডাঃ গিরীন্দ্রশেখর চক্রবর্তী, যিনি নিজে একজন গবেষক, ‘খেয়ালী’ পত্রিকার সম্পাদক, তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, পারিবারিক সুহৃদ হিসেবে হরিহর মুখোপাধ্যায়  তাঁকে  বিষ্ণুপুর মহকুমার কানাইপুর গ্রাম (পাঁচালের পাশে)  থেকে তুলে এনে মাচানতলার মসজিদের পিছনে মহম্মদ ইসমাইলের বাড়িতে ভাড়ায় রেখে পড়াশোনা করতে সাহায্য করেছেন। বামুনের ছেলেকে, মসজিদের পিছনে  মুসলমানের বাড়িতে রাখতে তিনি দুবার ভাবেননি। সেই সময় কতটা সাহস থাকলে এটা করা যায় পাঠক একবার ভাবুন। বিশেষ করে বাঁকুড়ার মতো একটি অনগ্রসর স্থানে! এই থাকার ক্ষেত্রে  আবার রামদাসেরও কোনো অস্বস্তি হয়নি। হরিহর মুখোপাধ্যায়ের  উৎসাহেই তাঁর  বাঁকুড়া ফ্রি স্কুলে ( বর্তমান জেলা স্কুল)  ভর্তি হওয়া। কিন্তু অকালে পিতামাতাকে হারিয়ে এবং পুঁথিগত বিদ্যার প্রতি অনীহার কারণে রামদাস  পড়াশোনা না করে শরীর চর্চায় মনোনিবেশ করেন।

                    ১৮৮৭ থেকে রামদাসের সঙ্গে  হরিহর মুখোপাধ্যায়ের যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়, তা আজীবন ছিল। রামদাসের শরীর চর্চায় তাঁর উৎসাহ ছিল। নিয়মিত শরীর চর্চার ফলে  অচিরেই রামদাস চক্রবর্তী, ‘রামদাস পালোয়ান’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। এই রামদাস ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে পুলিশের চাকরি নিয়ে চলে যান উড়িষ্যার বালেশ্বরে। এর পিছনেও কি কোনো পরিকল্পনা ছিল! পুলিশের প্রশিক্ষণ ও কর্মপদ্ধতি জেনে তা পরবর্তী কালে কাজে লাগানো! রামদাস চক্রবর্তী ১৮৯৭-এ পুলিশবাহিনিতে ভারতীয়দের চরম অপমান ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদে চাকরিতে  ইস্তফা দিয়ে বাঁকুড়ায় ফিরে আসেন। ১৮৯৮-এ আবার বাঁকুড়া  কালেক্টরেটে চাকরিতে যোগ দেন। সেখানেও এক সাহেবের সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে ঐ চাকরিতেও ইস্তফা দেন। এরপর আর কোনোদিকে না তাকিয়ে তিনি আখড়া গঠনে মন দেন। এই আখড়াই পরবর্তী কালে বাংলার  বিপ্লবীদের আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের অন্যতম বিশিষ্ট কেন্দ্রে পরিণত হয়। যাঁরা হেমচন্দ্র কানুনগোর লেখা ‘বাংলায় বিপ্লববাদ প্রচেষ্টা’ গ্রন্থটি পাঠ করেছেন তাঁরা দেখবেন( প্রথম সংস্করণ, পৃঃ ৩৩), তিনি লিখেছেন, ‘তারপর  বাঁকুড়াতে এক খ্যাতনামা ভদ্রলোকের নাকি  একটি দল ছিল। তাঁরা নামেমাত্র আমাদের সমিতির সহিত পরে যোগ দিয়েছিল।’ 

এই খ্যাতনামা ভদ্রলোকটিকে আমাদের চিনে নিতে কি খুব অসুবিধা হয়! বিপ্লবীদের কাজের পদ্ধতিতে গোপনীয়তা ছিল অন্যতম শর্ত। সব কথা কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না। একদিন  এই আখড়ার সন্ধানেই ছুটে আসতে হয়েছিল চার্লস টেগার্টের গোয়েন্দা বাহিনীকে। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে থেকে তাদের চোখে ধুলো দিয়ে  অগ্নি প্রজ্জ্বলনের যে ব্যবস্থা হরিহর মুখোপাধ্যায় করে গিয়েছিলেন আমরা তার পরিণতি দেখতে পাই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর। 

                         পৌর প্রধান এবং সরকারি উকিল হিসেবে তাঁর খ্যাতির কথা ছিল সর্বজনবিদিত। সেই খ্যাতি, আড়াল ও সরকারি বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বাঁকুড়া জেলাব্যাপী একটা নেটওয়ার্ক কি তিনিই তৈরি করে দিয়েছিলেন! তা না হলে তাঁর পরিবারের এতজন কীভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন! রামদাসের আখড়ায় হরিহর বাবুর ছেলেরা ( উমেশচন্দ্র , রাজচন্দ্র  ও ডাঃ হরমোহন মুখোপাধ্যায়,ভ্রাতুষ্পুত্র অমরেন্দ্রনাথ ছাড়াও ধরণী ঘোষ, শৈলেন ঘোষ, সুরেন্দ্র মণ্ডল (পালোয়ান), ডাঃ নটবর মিত্রের দুই পুত্র গোকুল মিত্র ও ডাঃ বৈকুণ্ঠ মিত্র। ডাঃ বৈকুণ্ঠ মিত্র পরবর্তী কালে মা সারদার কাছে দীক্ষা গ্রহন করে স্বামী মহেশ্বরানন্দ নামে পরিচিত হন।) ও অন্যান্যরা সুস্থ সবল শরীর ও মন গঠনের জন্য শারীরিক নানান কসরতের সঙ্গে সঙ্গে  লাঠিখেলা, তরোয়াল ও ছোরাখেলা , মুষ্টিযুদ্ধ , বন্দুক ছোঁড়া ইত্যাদির অভ্যাস করত বলে জানা যায়। রামদাস চক্রবর্তী পুলিশের প্রশিক্ষণ না নিলে কীভাবে বন্দুক ছোড়া শেখাতে পারতেন! বিপ্লবীদের নৈতিক চরিত্র গঠনের জন্য যেমন  গীতা ও উপনিষদ পাঠ করতে হত,রামদাসের আখড়াতেও এটি অন্যতম কর্মসূচি ছিল। বিপ্লবীদের কর্মধারা যেমন, ঠিক সেরকমটিই এখানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 

হরিহর মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন রামদাস। হরিহর লজ ও রামদাস পালোয়ানের আখড়ার মধ্যে একটি নিবিড় সংযোগ ছিল যার মূল কাঠামোটি সচেতন ভাবে  তৈরি করে দিয়েছিলেন হরিহর মুখোপাধ্যায়। 

                     হরিহর লজে আগ্নেয়াস্ত্র আছে , এই ধারণা পুলিশের যেমন ছিল, তেমন অনেক বিপ্লবীরও সেরকমই ধারণা ছিল। ধরণীধর মুখোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতি চারণায় লিখেছেন,

 ‘১৯০৬ সালে বিপ্লবী বিভূতিভূষণ সরকার , বারীণ ঘোষের একটি চিঠি নিয়ে বাঁকুড়ায় আসেন এবং রামদাস চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করেন। চিঠিতে বলা ছিল,হরিহর লজে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থাকলে তা যেন বিভূতি বাবুর সঙ্গে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে ঐ জাতীয় কিছু পাওয়া গিয়েছিল কি না তার কোনো প্রমান পাওয়া যায় না।’ 

স্বাধীনতা সংগ্রামী ধরণীধর মুখোপাধ্যায়, ‘বাঁকুড়া জেলায় বিপ্লববাদ ও স্বদেশী আন্দোলনের এক স্মরণীয় অধ্যায়’ শিরোনামে এক লেখায় লিখেছেন (বাঁকুড়া হিতৈষী, শারদ সংখ্যা -১৯৯১), খাতড়া থানার মসিয়াড়া গ্রামের কাছে হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের জমিদার গোস্বামীদের সিমলাবাঁধ ইত্যাদি জায়গায় কয়েকটি মৌজা ছিল। এই জমিদারি দেখতে নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী মাঝে মাঝেই বাঁকুড়া আসতেন। তিনি কি এখানেই বিপ্লববাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন! এই নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী যখন আলিপুর বোমা মামলায় রাজসাক্ষী হয়েছিলেন তখন তাকে জেলের ভেতরই হত্যা করা হয়। ধরণীধর মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,   ‘লোকশ্রুতি যে পিস্তলটি প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠানো হয়, তা হরিহর লজ থেকেই সংগৃহীত হয়েছিল। কালীতলা মুখার্জী পরিবারের সঙ্গে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও নরেন গোস্বামীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল ।”  উল্লেখ্য যে রাজসাক্ষী নরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে প্রেসিডেন্সি জেলে পিস্তল দিয়েই হত্যা করা হয় ।

                        বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় সারা বাংলা যখন স্বদেশী আন্দোলনে আলোড়িত তখন বিপ্লবীরা তাদের পরিকল্পনামাফিক এই জেলায় গুপ্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার কাজটি সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হরিহর মুখোপাধ্যায়ের সাহায্য সহায়তা সমর্থন ছাড়া যা সম্ভব ছিল না । তাঁর মৃত্যুর পর (১৯০২) তাঁর পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও বিপ্লবীদের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন অম্বিকানগরের জমিদার রাইচরণ ধবলদেব। এই যে যোগাযোগ, এ কি হঠাৎ করেই গড়ে ওঠা! রাইচরণ সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসেন বিপ্লবীদের সাহায্য করার জন্য । রানীবাঁধ থানার অন্তর্গত ছেঁদাপাথরের জঙ্গলে বিপ্লবী বারীন ঘোষ, নরেন গোস্বামী, বিভূতি সরকার,মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের সক্রিয় অংশগ্রহন ছিল। বিপ্লবীরা সেখানে সংগৃহীত অস্ত্র রাখার জন্য ভূগর্ভে একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করিয়েছিলেন। এখানে বোমা তৈরি, পরীক্ষা , ব্যবহার ও তার সাজসরঞ্জাম রাখা হত বলে জানা যায় । দেশের সর্ব কনিষ্ঠ শহিদ , ব্রিটিশরা যাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে শান্তি পেয়েছিল, সেই ক্ষুদিরাম বসুকে এখানেই বোমা ছোড়ার প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছিল বলে জনমানসের ধারণা । ছেঁদাপাথরের স্থানীয় মানুষেরা এই গোপন সত্যকে দীর্ঘদিন ধরে বহন করে আসছেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল, কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে দুজন ব্রিটিশ রমণী মারা যান। এই ঘটনার পর সারা বাংলা জুড়ে যে খানাতল্লাশি শুরু হয় তার প্রভাব আমরা বাঁকুড়া জেলাতেও দেখতে পাচ্ছি। ১৯০৮-এর জুন মাসে চার্লস টেগার্টের নেতৃত্বে গোয়েন্দা বাহিনি এসে উপস্থিত হয় বাঁকুড়ায় হরিহর মুখোপাধ্যায়ের বাসভবনে ।  হরিহর লজ ও রামদাসের আখড়া ছিল বিপ্লবীদের সংযোগ কেন্দ্র, এই খবর তখন তারা পেয়ে গেছেন । হরিহর মুখোপাধ্যায়ের এক পুত্রের নাম, রাজচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর ‘ভারত ভাণ্ডার’ নামে একটি স্বদেশী কাপড়ের দোকান ছিল । জানা যায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুপারিশে তিনি বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলের এজেন্সি পেয়েছিলেন।এই দোকানটিও বিপ্লবীদের একটি গোপন কেন্দ্র ছিল । 

                     এসব অনালোকিত দিক আলোর প্রত্যাশা করে। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের সাড়ম্বরে  উদযাপন শেষ। এবার,   গবেষকরা যদি এদিকে আলোকপাত করেন, তাহলে জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসও সমৃদ্ধ হবে। 

——-

তথ্যসূত্র –

১.হেমচন্দ্র কানুনগোঃ বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, কোলকাতা, ১৯২৮, প্রথম সংস্করণ, পৃঃ ৩৩

২. Bankura District Gazetteer – Amiya Kumar Bandopadhyay (Ed) WB Government – 1968

৩ . অমলেশ ত্রিপাঠী – ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব , আনন্দ , নবম মুদ্রণ

৪. বাঁকুড়া পরিচয়, তৃতীয় খণ্ড,  প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স -২০১২

৫. বাঁকুড়া জেলায় স্বাধীনতা সংগ্রাম – ভজন দত্ত, লেখক সমবায় সমিতি, ২০১৫

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত