| 2 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

প্রবন্ধ: বিদ্রোহী কবিতা আত্মজাগরণ ও আত্মশুদ্ধির বয়ান । নাহিদা আশরাফী

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সামনে এলে একটা বিস্ময় দানা বাঁধে। এক অলৌকিক আনন্দ-আলো খেলা করে আত্মার পরতে পরতে। মানুষ চির বিস্ময়ের, চির আকাঙ্ক্ষার। আত্মার শক্তি আর জীবনের জয়গান এই কবিতায় এমনভাবে গীত হয়েছে যা শুনবার সাথে সাথে জগতের সকল শৃঙ্খল টুটে যায়। সত্য ও সমতা যেন সব পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করে। ২০২১ সাল ছিলো ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শত বছরপুর্তি। এই একটি কবিতা যা ১০০ বছর ধরে সমান জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক।

‘বিদ্রোহী’ কবিতা ১৯২১ সালে লেখা। যদিও এর রচনার সময় নিয়ে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে। ভেবে অবাক হতে  হয়, একটি কবিতা আজ কতটা উচ্চকিত হলে, কতটা ঐন্দ্রজালিক হলে, কতটা প্রভাব বিস্তারি হলে এর জন্মমুহূর্ত, দিনক্ষণ, কবে কোথায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছে এসব নিয়ে এত আলোচনা ও গবেষণা হয়। শুধু কী তাই? প্রতিটি পঙক্তি, শব্দ, ভাষার ব্যবহার কোনকিছুই আজ আর ব্যবচ্ছেদ করতে বাদ রাখেননি সাহিত্য বিশ্লেষক ও গবেষকগণ। সাহিত্যানুসন্ধানী ব্যাক্তিবর্গ ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার সময়কাল ১৯২১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ধরে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘শান্তিনিকেতন থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে নজরুল ও মুজফ্ফর আহমেদের ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ঘটনা ঘটে। একটি হলো ভারতের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠন। অপরটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা। তালতলা লেনের এ বাড়িতে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং নজরুলের ‘ভাঙ্গার গান’ ও ‘বিদ্রোহী’ রচনা একই বাড়িতে একই সময়ের ঘটনা।’১  একই প্রতিধ্বনি পাই আমরা কমরেড মুজফফর আহমদ এর ‘প্রসঙ্গঃ বিদ্রোহী’ শিরোনামের প্রবন্ধে। তার ভাষ্যমতে – ‘আসলে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচিত হয়েছিলো ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে।…আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। তার ঘুম সাধারণত দেরীতেই ভাঙতো , আমার মত তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙতো না। এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুল কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারবার কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সঙ্গে তার হাত তাল রাখতে পারবে না। এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল ।‘ ২ এ প্রসঙ্গের সাথে সাথে এই দাবীও অগ্রাহ্য নয় যে কমরেড মুজফফরই প্রথম যিনি কবিতাটি কবির কন্ঠে শুনলেন।

এবার আসা যাক কোন পত্রিকায় লেখাটি প্রথম প্রকাশ পায়।১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ,  বাংলা ২২ পৌষ ১৩২৮ তারিখ শুক্রবার  কবিতাটি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। প্রকাশের পরপরই কবিতাটি পাঠক হৃদয়ে আত্মজাগরণের যে তীব্র স্রোত তৈরি করে সে  কারণেই  পত্রিকাটি পুনর্মুদ্রণ করতে হয়। দুই মুদ্রণে পত্রিকাটির  মোট ২৯০০০ কপি ছাপা হয়েছিলো যা সেসময়ের  একটি অত্যাচার্য ঘটনা বলা যেতে পারে । কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার রচিত ‘নজরুলের শিল্প  সিদ্ধি  ও বিদ্রোহী’ গ্রন্থে বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরবর্তী বাঙালির আবেগ তুলে ধরেছেন এভাবে-

‘বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা কবিতাটি পাঠ করেন, অনেকে কণ্ঠস্থ করেন।ঠিক এই সময়ে প্রায় দুই লক্ষ লোক কবিতাটি পাঠ করেন বলে অনুমিত হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো কবির অন্য কোনো কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা, আমাদের জানা নেই। সে সময় ঘরে ঘরে, হাটে-ঘাটে, মাঠে-তটে, শহরে-বন্দরে, গঞ্জে-গ্রামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পঠিত হয়। কবিতায় বিমুগ্ধ ভারতজাতি সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর ভারতবাসী আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ কাঁপানো কবিতা পেয়েছিল। যেটি আবৃত্তি করে অর্ধচেতন জাতিকে সর্বচেতন করা যায়।’৩

এবার আসা যাক পরবর্তী আলোচনায়। কবিতাটি প্রথম কাকে দেয়া হয়েছিলো, কোন পত্রিকা প্রথম ছেপেছিলেন। ‘মোছলেম ভারত’ নাকি ‘বিজলী’? তবে এই বিতর্কেরও অবসান ঘটিয়েছেন মুজফফর আহমদ। মুজফফর আহমদ এর বয়ানে –

‘সামান্য কিছু বেলা হতে ‘মোছলেম ভারতে’র আফজালুল হক সাহেব আমাদের বাড়িতে এলেন। নজরুল তাকেও কবিতাটি পড়েআফজালুল হক সাহেব শোনাল। তিনি তা শুনে খুব হইচই শুরু করে দিলেন। আর বললেন, এখনই কপি করে দিন কবিতাটি আমি সঙ্গে নিয়ে যাব’ পরম ধৈর্যের সহিত কবিতাটি কপি করে নজরুল তা আফজালুল সাহেবকে দিল। তিনি ঐ কবিতাটি নিয়ে চলে গেলেন। আফজালুল হক সাহেব চলে যাওয়ার পরে আমিও বাইরে চলে যাই। এরপরে বাড়িতে ফিরে আসি বারোটার আগে। আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানালো যে, অবিনাশ দা এসেছিল। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, ‘তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বা’র হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও ‘বিজলী’তে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সে পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।’৪

তার বয়ানে এটা সুস্পষ্ট যে কবিতাটি প্রথম দেয়া হয়েছিলো ‘মোছলেম ভারত’ এর আফজালুল  সাহেবকে। কিন্তু ছাপার অক্ষরে আমরা প্রথম পাই ‘বিজলী’তে। সে কথার প্রমাণও আমরা পাই মুজাফফর আহমদের বক্তব্যে।

 ‘আফজাল সাহেব কার্তিকের ‘মোছলেম ভারতে’র জন্য যখন কপি নিয়ে গিয়েছিলেন তখন ছিল পৌষ মাস। আমার ধারণা, তার কার্তিক সংখ্যা ফাল্গুন মাসের আগে বা’র হয়নি। ‘মোছলেম ভারত’ নিয়মিত বা’র হতো কিনা সেটা আজ যারা নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন তারা কি করে বুঝবেন? তারা দেখতে পাচ্ছেন কার্তিক (১৩২৮) মাসের মোছলেম ভারতে ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হয়েছিল। আর ছাপা হয়েছিল ২২ শে পৌষে (১৩২৮) বিজলীতে। কাজেই তাদের পক্ষে এটাই ধরে নেয়া হিসাব সঙ্গত যে, মোছলেম ভারতেই ‘বিদ্রোহী’ প্রথম ছাপা হয়েছিল। আসলে কিন্তু পৌষ মাসের (ডিসেম্বর ১৯২১) আগে নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী কবিতাটি রচনাই করেননি। কাজেই, বিদ্রোহী প্রথম ছাপানোর জন্য সম্মান সাপ্তাহিক বিজলীরই প্রাপ্য। তবে কবিতাটি কার্তিক সংখ্যার মোছলেম ভারতে ছাপানোর জন্য নজরুল প্রথমে আফজালুল হক সাহেবকে দিয়েছিল। সেই জন্যে এই কার্তিক সংখ্যার মোছলেম ভারতের নামোল্লেখ করছি। ‘বিজলী’ কবিতাটি প্রথম ছেপেছিল যদিও কার্তিক মাসের মোসলেম ভারত কখন ছাপা হবে তা কেউ সেই পৌষ মাসেও জানতেন না।’ অতএব কবিতাটি ১৯২২ এর ৬ জানুয়ারি বাংলা ২২ পৌষ,১৩২৮ তারিখ শুক্রবার ‘বিজলী’তেই প্রথম ছাপা হয়।‘৫

আমরা সকলেই জ্ঞাত সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কাব্যের ভাষা উপমায়, অলংকারে, প্রতীকে, শব্দে, বাক্যে কতটা সংবেদি ও ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠতে পারে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শব্দসম্ভার যদি আত্নার নিড়ানি দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখি তবে বুঝতে দেরি হবার কথা নয় যে কবিতায় বহুভাষার শব্দ প্রয়োগ, বাক্যের গতি, চেতনার দীপ্তি, প্রতিনিয়ত নিজেকেই নিজে অতিক্রমের তেজ, সংস্কারমুক্তির আন্দোলন, তারুণ্যের হুঙ্কার, ছন্দালংকার এতটাই তীব্র ও সুস্পষ্ট যে কবিতাটি সমাজ ও দেশ সংস্কারের এক অমিত শক্তির মূলমন্ত্র হয়ে জাতীয় জীবন ও বোধকে জাগ্রত করেছে। কবিতায় আত্মপ্রসঙ্গ যতবার এসেছে ততবারই নিজেকে এক আবরণ থেকে ছিন্ন করে নব আবরণে যুক্ত হবার বাসনা প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের আধ্যাত্মিকতা, মরমিয়া সুর, মিথের মাধুর্য ও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও যুক্তিবোধহীন চিন্তার বাইরে গিয়ে কাব্যময়তার সৌন্দর্যপ্রকাশ; সব দিক বিবেচনায় নজরুলের এই বিদ্রোহী স্ফুরণ জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসির মতই। এ প্রসঙ্গে মিডলটন মারির একটা কথা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়, ‘ Style is organic, not the cothes a man wears, but the flesh, bone and blood of his body.৬ কেউ এখানে মারিকে রীতিবিদ বলতেই পারেন কিন্তু আমি তাকে দেখেছি এক শাশ্বত পথের ধর্মযাত্রী হিসেবে। একইভাবে কাজী নজরুলকে তার বিদ্রোহী কবিতার মধ্য দিয়ে ধর্মকে উপেক্ষাকারী, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কারী বলতেই পারেন  কিন্তু ভগবান  বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিলেই কেউ ধর্ম অবমাননাকারী হয়ে যায় না। তিনি সর্ব ধর্মের সর্বজনীন রূপকেই ধারণ, লালন ও পালন করতে চেয়েছেন তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়।

সমৃদ্ধ শব্দসম্ভার আর বিশ্বভাষার উন্নত ভান্ডার থেকে তিনি একটি একটি করে মণি-মুক্তা তুলে এনেছেন। বাংলা শব্দের পাশাপাশি আরবি, ফারসি শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহার তার বিদ্রোহী কবিতাকে নিয়ে গিয়েছে এক কালোত্তীর্ণ ও কাঞ্চনমন্ডিত উচ্চতায়। এর পাশাপাশি পুরাণের বিবিধ চরিত্র ও বিষয়বস্তুর উজ্জ্বল উপস্থিতিও আমরা দেখতে পাই। কবিতার কয়েকটি লাইনে দৃষ্টিপাত করা যাক- 

১- মহা প্রলয়ের আমি নটরাজ 

২-… আমি টর্পেডো আমি ভীম ভাসমান মাইন

৩- আমি ধূর্জটি 

৪- আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি

৫- আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড

৬- আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী 

আরো অনেক লাইনেই আমরা ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্র ও চুম্বকীয় বিষয় খুঁজে পাই। এবার ভারতীয় পুরাণের বাইরে এসে একটু প্রাচ্য বা আরবি পুরাণের দিকে দৃষ্টি দেই। যেমন- 

১- খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,

২- বোররাক আর উচ্চেঃশ্রবা বাহন আমার

     হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!

৩- স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি!

৪- ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! 

৫- আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুস্পের হাসি! 

আর এখানেই কবির জয়জয়কার। তিনি ধর্ম আর বর্মের কবি হননি। হয়েছে সর্বধর্মের উর্ধ্বে ওঠা এক মানুষ কবি। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এক প্রবন্ধে লিখেছেন,’ তিনিই আমাদের প্রথম বিপ্লবী কবি।বিদ্রোহী নন, আসলে বিপ্লবী। সমাজ ও রাষ্ট্রে একটা বিপ্লব চেয়েছেন।অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়, পৃথিবীটাকে সুন্দর করার উদ্দেশ্যে। সেজন্যেই তিনি একই সঙ্গে প্রেমিক ও বিপ্লবী।’ ৭

শোষিত, নির্যাতিত, লাঞ্চিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের কথা ভেবে যার হৃদয় উৎসারিত শব্দমালার গাথুনি তৈরি হত, সমাজ চেতনায়, মুক্তিকামী বাঙালির উন্মাদনায় যার কবিতা বৃটিশদের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় ঢাল হয়ে যেত, পরাধীনতার শিকল কাটতে যার কবিতা এক ধারালো কুঠারের মত কাজ করতো সেই কবি তার কবিতায় অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করবেন এটাই তো স্বাভাবিক। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মের চেয়ে যুক্তি ও বুদ্ধির দুরদর্শিতায় সত্যকে উদঘাটন সহজ হয়। তাই আত্মশক্তির অন্বেষণ আর আমিত্ববোধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই মানুষ নিজেকে প্রহেলিকা ও প্রলোভন থেকে দূরে রাখতে পারবে। তাই বিদ্রোহী কবিতার ‘আমি’ এক শিল্পসিদ্ধ,সর্বংসহা, স্বাধীন স্বত্বার বহিঃপ্রকাশ। যেন রেনে দেকার্তের সেই অমিয় বাণীর মত, ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।’ 

এই আমি যে শতধারায় প্রবাহিত, এই আমি যে কন্যা-জায়া-জননী থেকে আপামর ভারতবাসীকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিতে জাগিয়ে তোলা তার প্রমাণ মেলে কবিতার ছত্রে ছত্রে। 

                                        আমি       মৃন্ময়, আমি চিন্ময়

                                     আমি       অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।

                                     আমি       মানব দানব দেবতার ভয়,

                                                   বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়

জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,

                     আমি      তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্য!

                                   আমি  উন্মাদ,         আমি উন্মাদ!!

    আমি        চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!–

আমি      পরশুরামের কঠোর কুঠার,

নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!

আমি      হল বলরাম-স্কন্ধে,

                     আমি      উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।

নজরুল গবেষক অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এর মতে, ‘প্রতিকূলতায় ভরা ওই জীবনের মধ্য দিয়েই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তৃণমূলের মানুষ ছিলেন নজরুল ইসলাম। যে পথ দিয়ে তিনি গেছেন, যে প্রকৃতিতে তিনি লালিত হয়েছেন, যে পারিপার্শ্বিকতায় তিনি বেড়ে উঠেছেন,সেগুলো তাঁর অজান্তেই তাঁর ওপর ছাপ ফেলেছে।তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাঁর গানে ও কবিতায়।’ ৮

মানব মর্মে যে কবিতা তুলেছিল এক অনন্ত ঢেউ সেই কবিতাকেও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছিল। নজরুলের একাধিক কবিতার প্যারোডি তো হয়েছিলই, বাদ পড়েনি অসাধারণ বিদ্রোহী  কবিতাটিও। বিজলী, সওগাত, মোসলেম ভারত, মিল্লাত, প্রবাসী বিভিন্ন পত্রিকা  বিদ্রোহী কবিতাকে যে উচ্চাঙ্গে অবস্থান দিয়েছে, তেমনি তাকে নিন্দার কাটা আর বিদ্রুপের বানও কম সহ্য করতে হয়নি। তার কিছু উদাহরণ রইলো আপনাদের সামনে।

শনিবারের চিঠি ৪ঠা অক্টোবর ১৯২৪ সংখ্যায় ‘আমি বীর’ শিরোনামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি রচিত হয়েছিল রচনা করেছিলেন স্ত্রী অবলানলিনীকান্ত হাঁ, এম-এ, এ-জেড।মোহিতলাল মজুমদার ‘দ্রোণ-গুরু’ শিরোনামে আরেকটি প্যারোডি রচনা করেন। সেটিও শনিবারের চিঠি ২৫শে অক্টোবর ১৯২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই বিরোধিতার রূপ এতটাই নিম্নমানের ছিলো যে তাতে বিদ্রোহী কবিতার ভাবধারা কতটুকু ক্ষুন্ন হয়েছে জানা নেই তবে কিছু সম্পাদক ও তাদের নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা এবং অই পত্রিকার কিছু পোষা লেখকের কদর্যতা সুস্পষ্ট ফুটে বেরিয়েছে। এদের মধ্যে সজনীকান্ত দাস অশোক চট্টোপাধ্যায় নীরদ সি চৌধুরী মোহিতলাল মজুমদার এর নাম কে না জানে। 

মাসিক মোহাম্মদীতে কবিকে ইসলামের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ইসলাম দর্শন পত্রিকা বলা হয়–

‘এই উদ্দাম যুবক যে ইসলামিক শিক্ষা আদৌ পায় নাই, তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইয়াছে। হিন্দুয়ানী মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ।… খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকিলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূলবিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডপাত করা হইত নিশ্চয়।’ 

সমালোচনাকারীদের বিদ্রুপে ত্যক্ত হয়ে অবশেষে নজরুলকেও কলম ধরতে হয়। তিনি লিখলেন–

বাপ রে বাপ! মানুষের গাল দেবার ভাষা ও তার এত কর্তব্যও তগাকতে পারে, এ আমার জানা ছিলো না। ফি শনিবারের চিঠি!… এই গালির গালিচাতে বোধহয় আমি এ-কালের শাহানশাহ। বাংলায় রেকর্ড হয়ে রইলো আমায়-দেওয়া গালির স্তুপ।’ ৯ 

আজ একশত বছর পরও আমি বিভ্রান্তিতে পড়ি। যারা কবিতাটি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন তারা কেউই সাহিত্যবোধহীন নন। তাহলে কেন তারা এমন করেছিলেন? সত্যিই কী কবিতাটি বোঝেননি নাকি বিপরীত বক্তব্যের বানে ভাসিয়ে তারাও কবিতাটি আলোচনায় রাখতে চেয়েছেন? আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এ বড় বিপদজনক ভাবনা। তারচেয়ে গুণীজনের ভাবনায় বিদ্রোহী কবিতা কেমন তার রেখাপাত করা যাক–

অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় মনে করেন এক হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে তার মতো অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি। তার পরিচয় ছিল মানুষ হিসেবে। উনার লেখার মধ্যে কখনই তিনি হিন্দু না মুসলমান তার প্রবল হয়ে দেখা দেয়নি। আমার জানামতে তিনিই একমাত্র কবি যিনি সমানভাবে হিন্দু ও মুসলমানদের বিশ্বাসের কথা, তাদের জীবনাচরণের পদ্ধতির কথা,  তাঁর কাব্য সাহিত্যে মধ্যে তুলে ধরেছিলেন।’

শেষ করব নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ণনা দিয়ে যিনি নজরুলকে ‘অন্ধ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের ভালোবাসা থেকে উঠে আসা তাদের বিদ্রোহ ও আত্ম উপলব্ধির কথা তাদের চিৎকারও চেতনার কথা যে কবিতার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে সেই কবিতা ও কবিতার স্রষ্টাকে আমাদের প্রণতি। ১২১ বার ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহার করে কবি যেন সেই আমিকেই তুলে এনেছেন যেই আমি শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও লাঞ্চিত। আবার সেই ‘আমি’ই যেন এক তেজোদিপ্ত অহংকার। আত্মশক্তির প্রতীক। বাংলার জয় গান গাওয়া এমন বিদ্রোহী কবি বাংলা সাহিত্য আবার কত শতাব্দী পরে আসবে অথবা আদৌ আসবে কিনা আমাদের জানা নেই। 

তথ্যসূত্র-

১- কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন-  অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম

২- প্রসঙ্গঃ বিদ্রোহী (প্রবন্ধে) – কমরেড মুজফফর আহমদ

৩- নজরুলের শিল্প  সিদ্ধি  ও বিদ্রোহী-  কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা

৪- প্রসঙ্গঃ বিদ্রোহী (প্রবন্ধে) – কমরেড মুজফফর আহমদ

৫- প্রসঙ্গঃ বিদ্রোহী (প্রবন্ধে) – কমরেড মুজফফর আহমদ

৬- The problem of style, page 122

৭- নজরুলঃ দুর্গম পথের দুঃসাহসী যাত্রী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী 

৮- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিঃ বিবিসি বাংলার জরিপে তৃতীয় স্থানে কাজী নজরুল ইসলাম, অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি শীর্ষক বিবিসি বাংলার রিপোর্ট, ১৫-০৩-২০

৯ ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ , আত্মশক্তি, ৩০ ডিসেম্বর ১৯১৭

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত