| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শারদ সংখ্যা’২২

শারদ সংখ্যা গল্প: মরণ রে তুহু মম । সোমজা দাস

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

সকাল সকাল বিছানা ছাড়ার অভ্যেস রবির বহুদিনের। সেই কোন ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন ‘আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ’ এর আপ্তবাক্য, সেটাই আজ অব্দি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে রবি। শুধু বাবাই নন, পরেশদাও একই কথা বলে সব সময়। পরেশদা বলে, “দ্যাখ রবি, আমাদের কাজটা হল মাথার আর হাতের কাজ। তোর ব্রেন যত অ্যালার্ট হবে, কাজ তত পরিচ্ছন্ন হবে। হাত স্মুদলি চলবে, চোখের পাতা কাঁপবে না, মন দুর্বল হবে না। তাই রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে হবে। টানা সাত ঘন্টা ঘুমোতে হবে। এর বেশীও নয়, কমও নয়। ব্রেনের বিশ্রামের জন্য এই সাত ঘন্টা হল তোর গিয়ে যাকে বলে পার্ফেক্ট টাইমিং। সকাল সকাল বিছানা ছাড়বি, আলসেমিকে প্রশ্রয় দিবি না।”

এরকম আরও অনেক কিছু বলে পরেশদা। রবি খুব শ্রদ্ধা করে পরেশদাকে। রবি আজ যেখানে পৌঁছেছে, সবই পরেশদায় দাক্ষিণ্যে। নইলে গ্র‍্যাজুয়েশন করে চাকরি খোঁজে জুতোর শুকতলা ক্ষইয়ে ফেলেও যখন চাকরিবাকরি কিছুই হল না, একটা রদ্যিমার্কা সেলসের কাজ নিয়ে শহরের পথে পথে ফ্যা ফ্যা করেই তো ঘুরছিল রবি। রোদ ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে অফিসে অফিসে ঘুরে পেটের চর্বি কমানোর বেল্ট, শুয়ে শুয়ে জগিং করার মেশিন বেচে বেড়াত। কমিশন বেসিসে কাজ। বিক্রি করতে পারলে তুমি মহারাজ, নইলে ভিখিরি। এরকম সময়েই দেখা হয়েছিল পরেশদার সাথে। সেদিন সারাদিন ঘুরে ঘুরে একটা বেল্টও বিক্রি করতে পারে নি রবি, এসপ্ল্যানেডের ফুটপাতে বিমর্ষমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইসময় পাশে এসে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত রেখেছিল পরেশদা, মাথাতেই হাত রেখেছিল বলা যায়। সেদিনের পর থেকে রবির জীবনটা বদলে গিয়েছিল।

সকালে উঠে ধ্যান, প্রানায়াম সেরে রোজ স্নান করে নেয় রবি। তারপর ঢোকে পুজোর ঘরে। পরেশদা বলে, “আর যাই করিস রবি, পুজোটা নিজের হাতে দিবি। পুণ্যিটুকু সঞ্চয়ে রাখা ভালো।” তাই রবি নিজের হাতেই পুজো করে, বেস্পতিবারের লক্ষ্মীর পাঁচালি অব্দি নিজেই পড়ে। অবশ্য সে ছাড়া আর কেই বা করবে? বীথি বেলা এগারোটার আগে ঘুম থেকেই ওঠে না। সারারাত মোবাইল ফোনে খুঁটখাট করে শেষ রাতে ঘুমোয় বেচারি। সকালে উঠবেই বা কী করে? রবি ওকে তাই ঘুমোতে দেয়। পুজো সেরে বেরিয়ে নিজেই রান্না বান্না সেরে নেয়। ডাইনিং টেবিলের উপর সব রান্না করা পদগুলো গুছিয়ে রাখে রবি, ফ্লাস্কে গরম কফি, ক্যাসারোলে ফ্রেঞ্চটোস্ট বা পরোটা ভরে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। বীথি রান্নাবান্নার ঝামেলা পছন্দ করে না। তাই রবিই দায়িত্ব নিয়ে বীথির ঘুম ভাঙার আগেই সব সেরে রাখে। জানে, ঘুম ভেঙেই গরম ব্ল্যাক কফি না পেলে বীথির মাথা ধরে, তাই কফির ফ্লাস্কটা আর কফিমাগ বেডসাইড টেবিলে রাখতে ভোলে না রবি।

একা একা টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে খবরের কাগজের পাতা ওল্টায় রবি। তার পেশায় এটা খুব জরুরি। ভেতরের পাতাতে সাধারণত তার কাজের সবিস্তার রিপোর্ট থাকে। সেগুলো পড়তে পড়তে রবির ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির রেখা ফুটে ওঠে। নাই বা থাকল তার নামের উল্লেখ, তার কাজটা লোকে দেখছে, পাঁচজনে জানছে, সেটাই বা কম কিসে? রবির ছোটবেলা থেকে খুব শখ ছিল, সে গোয়েন্দা পুলিস হবে। সেই শখ তো আর এ জন্মে পূরণ হবার নয়। কিন্তু পরেশদা বলে, “আমাদের কাজটাই বা পুলিসের চেয়ে কম কী? অ্যাডভেঞ্চার বললে অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দাগিরি বললে গোয়েন্দাগিরি। একেকটা মিশনে কতটা থ্রিল ভাব তো? আমাদেরও পুলিশের মতই ভিকটিমকে ফলো করতে হয়, আটঘাট বেঁধে নিখুঁত প্ল্যান করে কাজে নামতে হয়। পুলিসের চেয়ে আমাদের কাজে রিস্কও বেশি। তাহলে?”

সত্যিই তো! এভাবে কখনও ভাবে নি রবি। পরেশদা সত্যিই জিনিয়াস। নিজের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় রবির। পরেশদা বলে,”নিজের কাজটাকে শ্রদ্ধা করতে হবে, বুঝলি রে রবি? কাজটাকে ভালবেসে করতে পারলে বুঝবি, এটাও একটা সামাজিক কাজ। এই দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা কী, বল দিকিনি?”
রবি একটু ভেবে উত্তর দেয়, “অশিক্ষা, বেকারত্ব, করাপশন…”
“হুম, কিন্তু ভেবে দ্যাক, এই যে সমস্যাগুলোর কথা তুই বললি, এগুলোর রুটকজ কী?” গম্ভীরমুখে বলতে থাকে পরেশদা, “সব সমস্যার মূল সমস্যা হল পপুলেশন, অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। পাবলিক চিন্তাভাবনা না করে গাদা গাদা বাচ্চা পয়দা করছে। তাতে কী হচ্ছে? না, দেশের জনসংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় সরকারি স্কিমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জনগন নিশ্চিন্তে জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। এদিকে মেডিক্যাল সায়েন্স উন্নত হয়ে মৃত্যুহারও গিয়েছে কমে। আশি বছরের আগে কেউ মরার নামই নিচ্ছে না। আগেকার দিনে যুদ্ধবিগ্রহ হয়ে কত লোক মরত। ফলে জনসংখ্যার ব্যালেন্স বজায় থাকত। দুর্ভিক্ষ মহামারী তো ছিলই। আর এখন? মানুষ জন্মাচ্ছে, কিন্তু মরছে না। পরিস্থিতির গুরুত্বটা রিয়ালাইজ করতে পারছিস? এরকম করে চলতে থাকলে আগামী একশো বছরে জনসংখ্যার চাপেই মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।”

রবি মন দিয়ে শোনে, যত শোনে তত মুগ্ধ হয়। ভাবে সত্যিই তো, পরেশদার মত করে সে কেন ভাবতে পারেনা। রবির মনের যৎসামান্য দ্বিধাদ্বন্দ্বটুকু মুছে যেতে থাকে। পরেশদা বলে চলে, “আমাদের কাজটাও সমাজসেবা, বুঝলি রবি? জনসংখ্যার ব্যালেন্সটা ধরে রাখার জন্য আমরা আমাদের স্বল্প সাধ্য দিয়ে যেটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাচ্ছি। মানুষ না মরলে নতুন মানুষের জন্য জায়গা খালি হবে কোত্থেকে? এবার প্রশ্ন হল, শুধু সমাজসেবা করলে আমাদের সংসার চলবে কী করে? এখানে আমরা প্রায় সবাই ফ্যামিলিম্যান। তেল ছাড়া কি আমাদের সংসারের চাকা ঘুরবে? ঘুরবে না। তাই এই সেবামূলক কাজের পরিবর্তে আমরা কিছু সার্ভিস চার্জ নিয়ে থাকি আমাদের ক্লায়েন্টের কাছ থেকে। আর পাঁচটা সার্ভিসের মতই এটাও একটা সোশ্যাল সার্ভিস। এভাবে ভাবলে দেখবি, কাজ করার সময় হাত কাঁপবে না।”

এভাবেই ভাবা অভ্যেস করেছে রবি। আজকাল তাই আর হাত কাঁপে না তার। পরেশদার এজেন্সিতে কর্মীরা সকলেই পেশাদার, একেবারে কর্পোরেট কায়দায় কাজ হয় এখানে। ক্লায়েন্টের গোপনীয়তা সুরক্ষিত থাকে পুরোপুরি। ক্লায়েন্ট নিজে সামনে না এসেও কাজ করাতে পারেন। নিজেকে গোপন করে ভিক্টিমের নামধাম লিখে সীল করা খামে যে কেউ পোস্টবক্স নম্বরে চিঠি পাঠাতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে সাথে টাকাটা অ্যাডভানস নেওয়া হয়। কারণ কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্লায়েন্ট টাকা দিতে অস্বীকার করলে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। তবে পরেশদার এজেন্সির মার্কেটে খুব সুনাম, তাই ক্লায়েন্টরাও অ্যাডভান্স দিতে আপত্তি করে না। কারণ সবাই জানে এই এজেন্সিতে প্রোজেক্টের একশো শতাংশ সাফল্য নিশ্চিত। ভিকটিমের পরিচয় আগে থেকে জানা যায় না। সীল করা খামে ছবি ও সমস্ত তথ্য থাকে। সেই খাম মুখ বন্ধ অবস্থাতেই পরেশদা তুলে দেন সেই এক্সিকিউটিভের হাতে, যে কাজটা করবে। এমনকি পরেশদা নিজেও জানে না ভিকটিমের পরিচয়। একবার খাম হাতে নেওয়ার পর কাজ করতে অস্বীকার করা চলবে না। এই সব নিয়মকানুনের ব্যাপারে পরেশদা খুব কড়া।

প্রথম প্রথম রবির খুব ভয় করত। রবি কোনদিন নিজের হাতে মুরগি অব্দি কাটেনি। রক্ত দেখলেই মাথা ঘুরত, গা গোলাত, শরীর খারাপ লাগত। একটা সময় তো হালই ছেড়ে দিয়েছিল। ভেবেই নিয়েছিল যে তার দ্বারা হবে না। সে নিজে বিশ্বাস হারালেও পরেশদা কিন্তু রবির উপর থেকে বিশ্বাস হারায় নি। সবসময় পাশে থেকেছে, সাহস দিয়ে গেছে। বলেছে, “প্রথম প্রথম সবারই অমন হয় রে। একবার অভ্যেস হয়ে গেলে দেখবি, মশা মারা আর মানুষ মারার মধ্যে পার্থক্য কিছু নেই। বরং মশার চেয়ে মানুষ মারা সহজ, মানুষ উড়ে পালাতে পারে না যে”, বলে স্বভাবসুলভ হো হো করে হাসত পরেশ দা। খুব যত্ন নিয়ে সবকিছু হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন রবিকে। আর এখন? গত দুই বছর ধরে রবি এখন এজেন্সির স্টার পারফর্মার। বছর বছর প্রমোশন হচ্ছে, এছাড়া কাজ পিছু কমিশন তো আছেই। দুই বছর হল বীথিকে বিয়ে করেছে রবি। গত বছর বাইপাসের ধারে একটা ফ্ল্যাটও নগদ টাকা দিয়ে বুক করেছে। রবি এখন জানে, তাদের পেশায় বেশি বয়স অব্দি হাতে করে কাজ করা যায় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রিফ্লেক্স কমে যায়। তাই হাতে সময় কম। ভবিষ্যতের সঞ্চয় সুরক্ষিত করতে হবে। এর পরে বাচ্চাকাচ্চা হবে, সংসার বাড়বে। আরও অনেক টাকা চাই তার। তাছাড়া আজকাল খুন করাটা কেমন যেন নেশা হয়ে গেছে রবির। গরম তাজা রক্তের গন্ধ নেশা ধরায়। এক নিপুন টানে গলার নলি কেটে ফেলার পর ফিনকি দিয়ে ছোটা রক্তের ধারায় যে কী অপূর্ব সৌন্দর্য আছে, তা একমাত্র রবির মত জাত মৃত্যুশিল্পীরাই অনুভব করতে পারে। প্রতিটি প্রোজেক্ট সফলভাবে শেষ করার মধ্যে যে তৃপ্তি, যে গর্ব আছে, তা একমাত্র রবিই জানে। আজ অব্দি রবি কখনও কোন কাজ হাতে নিয়ে ব্যর্থ হয় নি, এটা রবির গোপন অহংকারের জায়গা।

ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে দরজার ল্যাচ টেনে রবি বেরোলো। রোজই এভাবেই বেরোয়, বীথি ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমন্ত বিথীর কপালে চুমো খেয়ে নিঃশব্দে কাজে বেরোয় রবি। মাঝে মাঝে নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস হয়না রবির। বীথির মত সুন্দরী, আধুনিকা মেয়ে তার স্ত্রী হবে, কোনদিন ভাবতে পেরেছিল সে? বিয়েতে যে তার অনিচ্ছা ছিল, তা তো নয়। একা মানুষ রবি। কে উদ্যোগ নিয়ে তার বিয়ে দেবে? মা বেঁচে থাকলে না হয় ধরে বেঁধে যেমনই হোক একটা বউ ঠিক গলায় ঝুলিয়ে দিতেন। কিন্তু সেই বুড়িও বছর পাঁচেক আগেই গত হয়েছেন। একটা বোন অবশ্য আছে, রবির চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। বোনটাকে খুব ভালবাসত রবি। তা সেও বহু বছর আগে নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছে। ছেলেটির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। এখন যোগাযোগ তেমন নেই বললেই চলে। তিনকুলে আর কেউ ছিল না রবির, তাই বিয়েটাও আর হয়ে ওঠে নি। অবশ্য মা থাকলেও কি আর বীথির মত একটি বউ খুঁজে এনে দিতে পারত রবিকে? বড়জোর একটি একগলা ঘোমটা টানা গাঁয়ের বধূ জোগার করে দিত।

বছর দুয়েক আগে এক বিকেলে এক ভিকটিমকে শ্যাডো করতে করতে হঠাৎই সাউথের দিকে একটা শপিং মলে ধীরেনের সাথে দেখা; স্ত্রী ও শ্যালিকাকে নিয়ে শপিংয়ে এসেছিল সে। ধীরেন রবির কলেজ জীবনের বন্ধু। রবিকে দেখে টেনে হিচরে চা স্যান্ডউইচ খাওয়াতে নিয়ে গেল ফুড কোর্টে। ভিকটিম মহিলাকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে রবিকে তাদের সাথে যেতে হল। আপত্তি রবি করতেই পারত, কিন্তু করল না। ধীরেনের শ্যালিকাটি ততক্ষণে রবির মনের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। রবির মনে হল, এত সুন্দরী হওয়াটা ঘোরতর অন্যায়। এই মেয়ের মুখোমুখি হলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, হৃদয়ের গতি দ্রুততর হতে থাকে। রবির চিত্তবৈকল্য সেদিন ধীরেনের দৃষ্টি এড়ায় নি। পরের রবিবারেই নিজের বাড়িতে চায়ের নেমন্তন্ন করল তারা রবিকে। সবাই জানে, রবি বড় কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরি করে, মাস গেলে মোটা টাকা রোজগার তার। পাত্র হিসেবে লোভনীয় সন্দেহ নেই। এ হেন পাত্রের হাতে ঘাড়ের উপর চেপে থাকা শ্যালিকাটির ভার স্থানান্তরিত করার সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না বুঝে নিয়েছিল ধীরেন। মাসখানেকের মধ্যে খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই বিয়েটা হয়ে গেল। তাড়াটা ধীরেনদের তরফেই বেশি ছিল। বীথির মতামত রবি জানতে পারেনি। বিয়ের আগে ইচ্ছে থাকা সত্যেও বীথির সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ পায়নি রবি। বীথিও আগ্রহ দেখায় নি, অথবা তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি।

বীথি ঠিক সংসারী মেয়ে বলতে যা বোঝায়, তেমনটি নয়। বড়লোকে আদুরে মেয়ে সে। হঠাৎই বাবা মাকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে দিদি জামাইবাবুর সংসারে এসে পড়েছিল কদিনের জন্য, তারাও সেই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেছে। রবির সাথে বিয়ের পর ধীরেন ও তার স্ত্রী তাদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি তেমনভাবে। বীথির মধ্যেও দিদি জামাইবাবুর প্রতি তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি। সম্পর্কের সুতোটা আলগা হতে হতে ছিঁড়ে গেছে। রবির প্রতি বীথির মনোভাব বোঝা যায় না। নিজের বন্ধুবৃত্তের মধ্যে যতটা হাসিখুশি থাকে বীথি, রবির সামনে ততটাই গম্ভীর। কথা বরাবরই কম হত দুজনের মধ্যে। ঝগড়াঝাটির তাই প্রশ্নই ওঠে না। রবি বোঝে, অমন ‘ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে’ বলে তাড়াহুড়ো করে ওকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, ওকে সময় দেওয়া দরকার। সেই অপেক্ষার ফল পেয়েওছে রবি। মাস দুয়েক ধরে বীথি যেন হঠাৎই বদলে গেছে। খুব হাসিখুশি থাকে, রবির সঙ্গেও ভালভাবে কথাবার্তা বলছে আজকাল। নিজেও জোর করে রবিকে সিনেমায় নিয়ে যাচ্ছে, দুজনে শপিং মলে একসঙ্গে শপিং করতে যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে ডেকে বিবাহবার্ষিকীর পার্টি দিচ্ছে। বীথির এই আকস্মিক পরিবর্তনে রবি যতটা না খুশি হয়, তার চেয়ে অবাক হয় বেশি।

রবিকে কাজের খাতিরে প্রায়ই গোয়েন্দাগিরিও করতে হয়। কাজ কর‍তে করতে রবির ষষ্ঠেন্দ্রিয় এখন অনেক বেশি প্রখর হয়ে উঠেছে। ভিকটিমের উপর নজর রাখতে হয়, ফলো করতে হয় খুনের পরিকল্পনা বানানোর জন্য। ক্লায়েন্টদের পরিচয় গোপন থাকলেও মাঝে মাঝে রবি নিজেই বুঝে যায় কে তাদের এজেন্সিকে অ্যাপোয়েন্ট করেছে ক্লায়েন্টকে খুন করার জন্য। এই খুনে কার লাভ হতে পারে। মোদ্দা কথা হল, কন্ট্রাক্ট কিলিং রবির পেশা হলেও রবি নিজেকে একজন গোয়েন্দাই ভাবে। আর একজন প্রকৃত গোয়েন্দা কি সন্দেহের নিরসন না হওয়া অব্দি শান্তিতে থাকতে পারে?

রবিও বেশি দিন সন্দেহটা চেপে রাখতে পারল না। বীথির হঠাৎ পরিবর্তন রবিকে পীড়িত করছে। বীথির উপর তো কোনদিন কোনরকম জোর খাটায়নি রবি, স্বামিত্বের অধিকার ফলাতে যায় নি। বীথির মত সুন্দরী একজন মেয়ে তার সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকে তার পাশে, এতেই রবি খুশি ছিল। তাহলে হঠাৎ এই সুখী দাম্পত্যের নাটক কেন? বীথির হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ কী? বীথি যদি রবিকে ভালবাসত, তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু তা তো নয়। প্রেম তো লুকিয়ে রাখা যায় না। রবি জানে, বীথি তাকে ভালবাসে না। তাহলে কেন এই নাটক? রবির গোয়েন্দাসত্ত্বা তৎপর হয়ে ওঠে। রহস্য উদঘাটন না হওয়া অব্দি শান্তি পায় না সে। এতদিন ধরে তার শিকারদের অনুসরণ করতে করতে এই ব্যাপারে রবি এখন যথেষ্ট দক্ষ। সামান্য একটু ছদ্মবেশেই বাজিমাত হল, শপিংমলে বীথির সামনে দিয়ে ঘুরে এল বার কয়েক, বীথি চিনতেও পারল না তাকে। উল্টো তার চোখের সামনে দিয়েই প্রেমিকের হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াল, পাশের সিটে বসে সিনেমা দেখল, সিনেমা হলের অন্ধকারে প্রেমিকের বক্ষলগ্না হয়ে তাকে চুমু অব্দি খেল।

এই অব্দি তো বোঝা গেল। বীথির একটি গোপন প্রনয়ী রয়েছে, হয়তো বিয়ের আগে থেকেই ছিল। সে যাক গে। অত সুন্দরী মেয়ের প্রেমিক না থাকাটাই বরং অবিশ্বাস্য। আর বিয়ের আগের প্রেমিকের বিয়ের পরেও থাকতে বাধা কী? কোন শাস্ত্রে লেখা আছে, বিয়ে হওয়া মাত্র পুরনো প্রেমিকের প্রতি যাবতীয় প্রেম চুকে বুকে গিয়ে মনের ভেতরটা সদ্য কেনা স্লেটের মত ঝকঝকে হয়ে যেতে হবে? তাই কি হয় কখনও, না হওয়া সম্ভব? সেসব নিয়ে রবি অত ভাবে না। কিন্তু যে ব্যাপারটা তাকে ভাবাচ্ছে সেটা হল, প্রেমিকটি যখন দিব্যি পাশেই রয়েছে, তবে বীথি আজকাল রবির সঙ্গে অমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? কেন সারা দুনিয়ার সামনে স্বামী স্ত্রীর মধ্যেকার মধুর সম্পর্কের মিথ্যে নাটক করছে সে?

সারাটা দুপুর, বিকেল বীথিদের আশেপাশেই রইল রবি, সেইদিন ও পরবর্তী কয়েকটা দিন। নিঃসন্দেহ হল বীথি ও তার প্রেমিকের মধ্যে সম্পর্কটা অত্যন্ত গভীর। বীথি প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে চোখে জল ফেলে। প্রেমিক তার কপালে চুমো খেয়ে সযত্নে সেই জল মুছে দেয়। আহা, বীথির কষ্ট দেখে রবিরও চোখে জল আসে। শত হলেও তার বিয়ে করা বউ বীথি। তাকে কষ্ট পেতে দেখলে রবির কষ্ট তো হবেই। যেটুকু বোঝা গেল, প্রেমিকটি ট্যাঁকের জোরের দিক থেকে রবির কাছে দশ গোল খেয়ে বসে আছে। সেই পরাজয়ের কারণেই বীথির মত কন্যারত্ন তার হাতছাড়া হয়েছে। প্রেমিকপ্রবরটি বীথির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ভেবো না সোনা, আমার উপর ভরসা রাখো। সব ঠিক করে দেব আমি?”

বীথি সুচিত্রা সেনের মত ঘাড় ঘুরিয়ে টলটলে দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলে, “কিভাবে করবে? আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”

প্রেমিকটি এবার চারপাশে তাকিয়ে বীথির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে কিছু বলে। বীথি চোখ বড় বড় করে বলে, “কোনও বিপদে পড়ব না তো? যদি ধরা পড়ে যাই?”

প্রেমিকটি অসুরের মতন হেসে বলে, “কিচ্ছু হবে না প্রিয়ে। ভাল করে খোঁজ খবর নিয়েই সব প্ল্যান করেছি। কোনও রিস্ক নেই। রাজত্ব ও রাজকন্যা দুইই আমার। আর তারপর…”

বীথি আদুরে বেড়ালের মতন প্রেমিকে বুকে ঘেঁষে আসে। গুনগুন করে বলে, “যাহ্, অসভ্য”। আরও অনেক কিছু বলে, বলতেই থাকে। রবি আর দাঁড়ায় না সেখানে। প্রেমিক প্রেমিকার একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে গোপনে এভাবে চোখ রাখাটা অসভ্যতা।

অতঃপর এর অব্যবহিত পরেই একদিন বিয়ের দুই বছর পর বীথি শয্যায় রবির কাছে আসে। বুকের উপর আঙুল বোলাতে বোলাতে জানতে চায়, রবি কোথায় চাকরি করে, কত টাকা মাইনা পায়, কতটা সঞ্চয় আছে, কোথায় আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। রবির বুকের ভিতরে কুলকুল করে আবেগের নদী বয়ে যায়। আহা, এমন সুন্দরী মেয়ে কাছে এলে কেমন অনুভূতি হয়, তা এই তিরিশ বছর বয়স অব্দি অজানাই রয়ে গেছিল তার। স্বপ্নের মতন রাত কেটে যায়। মোবাইল ফোনে খুটখাট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে বীথি। রবি জেগে থাকে সারাটা রাত।

ভোর হতে বিছানা ছেড়ে ধ্যান ও প্রানায়াম করে রবি রোজকার মতন। তারপর স্নান সেরে পুজোর ঘরে ঢোকে। আজ অনেকটা বেশি সময় নিয়েই পুজো করে রবি। পারানির কড়ি সঞ্চয় করতে হবে তো। পুজো শেষ করে রান্নাঘরে ঢোকে। রান্না করতে করতে বেসুরো গলায় আজ গুনগুন করে গান গায় রবি। নিজের মনেই ফিকফিক করে হাসতে থাকে। কালো কফি ফ্লাস্কে ঢেলে বিছানার পাশের ছোট টেবিলে গুছিয়ে রাখে, আর বাকি সব রান্না করা পদ রাখে ডাইনিং টেবিলে। বীথি আজ তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে। জীবনে প্রথমবার রবির সাথে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেছে সে। রবির ভালো লাগে। কাজে বেরোনোর আগে বীথির কপালে চুমো খায় রবি রোজকার মত। বীথি মিষ্টি করে হাসে।

রাস্তায় বেরিয়ে সোজা পোস্ট অফিসে যায় রবি। একটা বড়সড় সীল করা খয়েরী খাম ব্যাগ থেকে বার করে রেজিস্ট্রি ডাকে দেয়। হাসিমুখে বেরিয়ে আসে পোস্ট অফিস থেকে। অফিসে ঢুকতেই পরেশদার কেবিন থেকে ডাক আসে। অর্থাৎ নতুন কোনও প্রোজেক্ট এসেছে। কেবিনে ঢুকতেই ধবধবে সাদা সীল করা একটা খাম এগিয়ে দিল পরেশদা।

“ধর রবি, নতুন কাজ এসেছে। আজকাল কাজের প্রেশার খুব বেড়ে গেছে জানি। তোর উপরেও তাই এক্সট্রা চাপ পড়ছে। আমি ভাবছি, তোর কমিশনটা বাড়িয়ে দেব। এই কাজটা করে নে। তারপর এই নিয়ে কথা বলছি”, বলল পরেশদা।

পরেশদা লোক বড় ভাল। তার বদান্যতা অভিভূত করে রবিকে। মাথা নেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে সে। তাদের কাজে ডেস্ক ওয়ার্ক তো আর কিছু নেই, পুরোটাই ফিল্ড ওয়ার্ক। তাই অফিসে থাকার দরকার হয় না। পরেশদার কেবিনের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে খামের মুখটা ছিঁড়ল রবি। ভিতরের ছবির মানুষটাকে চেনার জন্য তার নাম ঠিকানার দরকার নেই। ছবিটার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল রবি। পরের মুহূর্তে তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। নাঃ, কাজের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনকে মেলালে চলবে না। পার্টি অ্যাডভান্স পেমেন্ট করেছে, সুতরাং কাজ তো করতেই হবে। পরেশদা তার জন্য এত করেছে, তার এজেন্সির সুনাম রবি নষ্ট হতে দেবে না।

রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল রবি। রক্তের ভিতর আবার সেই উত্তেজনা টের পাচ্ছে সে। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা গরম রক্তের গন্ধ, আহ্, সেই নেশার তুলনা আর কোনও কিছুর সঙ্গেই হয় না। রবির হাত নিশপিশ করে। উত্তেজনায় বারবার হাত মুঠো করে রবি। বাড়িতে ফিরতে হবে। বীথি যে এখন বাড়িতে থাকবে না, সে তো জানাই কথা। ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে মুখোমুখি দেখা হল পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী মশাই, অফিস নেই আজ?”

রবি হেসে বলল, “ছিল। কাটিয়ে দিলাম। বউয়ের অভিযোগ আমি সময় দিই না। আজ সারাদিন তাই বউয়ের সঙ্গেই কাটাব।”

“ভালো ভালো, যান মশাই। নতুন নতুন বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়েনি, এখনই তো সময়। আমাদের বয়সে পৌঁছে রস মরে যায়।”

ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলল রবি। ভেতরে ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। বন্দুক পিস্তল পছন্দ নয় রবির। তার প্রিয় অস্ত্র ছুরি। সেটা নিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। খুনের আগে একবার ভিকটিমের চোখে চোখ রাখার মজাই আলাদা। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলি বরাবর সে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে এসেছে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। হাতের উপর রেখে ছুরির ধার একবার পরীক্ষা করে নিল রবি। পরেশদা ভুল কিছু বলে না। মানুষ মারা আর মশা মারার মধ্যে পার্থক্য কিছু নেই। রেজিস্ট্রি করা চিঠিটা কালকের মধ্যেই গ্রামে তার ছোট বোনের কাছে পৌঁছে যাবে। যাবতীয় সম্পত্তি, এই বাড়ি সব বোনের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে রবি। দলিলের সঙ্গে যাবে তার সুইসাইড নোট। ক্লায়েন্টের নাম গোপন রাখার শর্ত আছে, আত্মহত্যার কারণ না জানানোর কোনও শর্ত তো আর নেই। আত্মহত্যায় প্ররোচনার কথা সুইসাইড নোটে উল্লেখ করলেও শর্তভঙ্গ হয় না।

ছুরিটা আলতো করে গলায় ছোঁয়াল রবি, হালকা একটা চাপ। পরমুহূর্তেই অভিজ্ঞ হাতের নিখুঁত টানে গলার এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত অব্দি ফালা হয়ে ফিনকি দিয়ে রক্তের ধারা আয়নার উপর ছিটকে পড়ল। আয়না বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে তাজা গরম রক্ত। আহ্, গন্ধে যেন নেশা ধরে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে নেশাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে থাকে রবি, তাকিয়েই থাকে। ধীরে ধীরে খোলা চোখের সামনে থেকে সব মুছে যেতে থাকে। হাঁটু মুড়ে থৈ থৈ রক্তের উপর বসে পড়ে রবি। ঠোঁটের কুলে কুলে প্রতিবারের মতন তৃপ্তির হাসি। জীবনের শেষ প্রজেক্টটাও সফলভাবে সম্পন্ন করেছে সে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত