| 1 সেপ্টেম্বর 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: পবিত্র মাটির ঘ্রাণ । মোজাম্মেল হক নিয়োগী

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

হোটেলের এসি রুম ছেড়ে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম তখন বেলা দশটা। এই সকালেই কলকাতার দাবদাহ টের পেলাম যখন মুখে দমকা বাতাসের হলকা লাগল। আগেই জানতাম কলকাতার গরমের সুনাম আছে, এক দমকা বাতাসেই অকাট্য প্রমাণ দিয়ে গেল। আর সাক্য—প্রমাণের প্রয়োজন নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এক খণ্ড মেঘ পর্যন্ত কোথাও নেই। প্রগাঢ় নীল ঝকঝকে আকাশে সূর্যের আলো ও তাপ বিনা বাধায় তীর্যকভাবে পতিত হয়ে সকাল দশটাতেই সড়কের বুকে ঢেলে দিচ্ছে তপ্ত সীসা। বাতাসের হলকা আর নিচ থেকেও ভ্যাপসা ভাঁপ উঠে সেদ্ধ করার উপক্রম। এই রৌদ্রতপ্ত রাস্তা ধরে আমি আর বুশরা পার্ক স্ট্রিট ধরে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি কোনো খাবার হোটেলে নাশতা করার উদ্দেশ্যে। ঝাঁঝালো রোদের তীব্র গরমের কারণে অসুস্থ নাজুক শরীর নিয়ে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে বুশরার। আমি ওর হাত ধরে আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ হেঁটে একটি খাবারের হোটেলের সন্ধান পেলাম। খাবারের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কেটে গেল ধন্দে। বুশরার ইঙ্গিতে সেটিতে ঢুকে একটি ফাঁকা টেবিলে গিয়ে বসলাম। আমি এর আগে কলকাতায়, কলকাতা মানে দেশের বাইরেও কোথাও যাইনি। এজন্য কোথাও কোনো ভুল হয় কি না, কোনো আচরণে দেশের কোনো বদনাম হয় কি না, টাকা—পয়সা বেশি খরচ হয় কি না, কোনো প্রতারণার স্বীকার হই কি না এসব বিষয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন। আশেপাশের টেবিলে যারা খেতে বসেছে মনে হলো প্রায় সবাই বাংলাদেশি। তারা সাবলীলভাবে কথা বলছে, খাবারের অর্ডার দিচ্ছে, খাবার চেয়ে নিচ্ছে এবং খেয়েদেয়ে বিল চুকিয়ে দিব্যি বের হয়ে যাচ্ছে। ওদের কথাবার্তা শুনে কিছুটা সাহস পেলাম এই প্রত্যাশায় যে কোনো সমস্যায় পড়লে হয়তো অনেকের সাহায্য পাওয়া যাবে, ওরা উদ্ধার করবে।
তরুণ বয়সী একজন বেয়ারা এলে পরোটা, ভাজি আর ডালের অর্ডার দিলে ছেলেটি ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে আসে। বেশ পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন, খেতেও বেশ সুস্বাদু। ধীরে—সুস্থে দুজনে খেয়ে বিল চুকিয়ে বের হলাম।
ওই রেস্ট্ররেন্টে চায়ের ব্যবস্থা না থাকায় হাঁটতে হাঁটতে একটা মোড়ে মেহেগনি গাছের ছায়ায় একটি ভ্যানের ওপর কেরোসিনের স্টোভে চা বানানোর একটি স্টল থেকে মাটির কাপে চা নিলাম। এই যুগে কলকাতায় মাটির কাপ দেখে অবাক হলাম। দুনিয়ার কোথাও কি এমন মাটির কাপ পাওয়া যাবে? এমন আজব শহরের আজব কাণ্ড দেখে ভাবতে লাগলাম। পাশের এক ভদ্রলোক চা খেয়ে কাপটি রাস্তার পাশে ওষ্টেজ বাস্কেটে ফেলে দিয়ে কেবল সিগারেটা জ¦ালালেন, তাকে সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, আপনারা মাটির কাপে চা খান কেন? এই কাপ তো হাইজেনিক মনে হয় না। ভদ্রলোক স্মিত হেসে আমার দিকে চোখ বিস্ফারিত করে বললেন, ওপার থেকে এসেছেন?
ওনার মৃদুভাষণে ও ভদ্র কথা হলেও আমি মনে মনে রেগে গেলাম। ওপার আবার কি? আমার একটি দেশ আছে। আমার বাংলাদেশের নাম বলতে অসুবিধা কোথায়? সাতচল্লিশের পর এপার—ওপার বিলীন হয়ে গেছে দ্বিজাতি তত্ত্বের তলায় পড়ে। কিন্তু বিদেশের মাটিতে রাগ করা চলবে না। পাছে আমার দেশের বদনাম হবে ভেবে আমি ভদ্রভাবে বিনীত উত্তর দিলাম, জি, ওপার থেকে এসেছি।
আপনাদের লোকেরা প্রায়ই এই প্রশ্নটি করে, তাই জানতে চাইলাম। কিছু মনে করবেন না দাদা। আসলে মাটির কাপ ব্যবহার না করলে কুমোররা খাবে কী? ওদের জীবন তো চালাতে হবে, তাই না? পুরোনো পেশাকেও বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব, তাই না? তাছাড়া মাটির কাপ হাইজেনিক। একবার চা খেয়ে ফেলে দেওয়া হয়, এটি আর ব্যবহার করা হয় না।
ও, আচ্ছা।
বেড়াতে এলেন?
না, আমার ওয়াইফের চিকিৎসার জন্য এলাম।
হঠাৎ ভদ্রলোকের মুখটা কালো হয়ে গেল। কেন কালো হয়ে গেল আমি বুঝতে পারিনি। তারপর বললেন,আচ্ছা, ভালো থাকুন। কথা শেষ করে তিনি সামনের দিকে হেঁটে গেলেন।
অত্যধিক তপ্ত হাওয়ায় বুশরার কপালে কুচি কুচি শে^দকণা জমা হয়েছে। দুশ্চিন্তায় তার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আছে। সে আর দঁড়িয়ে থাকতে অপারগতায় রাস্তায় পা নামিয়ে ফুটপাতে বসে পড়ল। আমিও তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম, খারাপ লাগছে বুশরা?
অস্থির লাগছে।
আমাদের তিন বছরের প্রেম আর দুই বছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যে গত এক বছর ধরে বুশরার মুখের অম্লান তাজা হাসিটি দেখি না। ওর অম্লান ভুবন ভোলানো হাসি দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে এক বছরের বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে নাগাল পেয়েছিলাম ওর। তারপর পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। ওর মুখে সেই হাসি দেখতে পাই না বলে ওর দিকে তাকাতে পারি না, আমার বড্ড কষ্ট হয়। বুশরার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ফেসবুক খুলে বসলাম।
দুপুর দেড়টায় ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকায় হাসপাতালে যাওয়ার তেমন তাড়া নেই। ওখানে গিয়েও বসে থাকতে হবে, এখানেও বসে থাকা। তাই এক সময় গেলেই হলো। যদিও বাতাসে তপ্ত হলকা তবু এই খোলামেলা জায়গায়বহুকালের পুরোনো বিশাল মেহেগনির ছায়ায় বসে থাকতে খারাপ লাগছে না। ঢাকায় কত ফুটপাতে কত গাছের নিচে এভাবেবসে কত থেকেছি বুশরার সঙ্গে তা বলে শেষ করা যাবে না। ঢাকার বাতাসে ধূলিকণা, বিরাহীন গাড়ির কর্কশ বিকট হর্ন, রিকশার টুনটান, মানুষের চেঁচামেচি ইত্যাদির অসহ্যকর অত্যাচার এখানে নেই। বাতাসে ধূলি নেই, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রাস্তা, কর্কশ বিকট হর্ন নেই, ফুটপাতে অল্পসংখ্যক মানুষের পথচলায় মেজাজকে অস্থির করে তুলছে না। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন হাজারো কথায় কাটিয়ে দিয়েছি। অথচ আজকে বুশরার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে না। প্রেমালাপ হয়তো দাম্পত্যজীবনের বিশ্রাম্ভালাপ হয়ে দাঁড়ায়।
আমি ফেসবুকে মনোযোগ দিতেই ‘আয় আয় চুক চুক’ ধ্বনি শুনে পথের পাশে তাকিয়ে দেখলাম প্যান্টশার্ট পরিহিতা এক তরুণী একটি পলিব্যাগ থেকে কিছু হাড়মাংসের টুকরো বের করে রাস্তায় ফেলছে আর তাকে ঘিরে কয়েকটি কুকুর সেগুলো সানন্দে ভক্ষণ করছে। তরুণীর এ—রকম কাজ স্বাভাবিক মনে না হওয়াতে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সে কসাইখানা থেকে এসব উচ্ছিষ্ট হাড়মাংস সংগ্রহ করে পথের এই কুকুরগুলোকে খাওয়ায়। এই কুকুরগুলো এখন তার বন্ধু হয়ে গেছে। সে হাত দিয়ে ইশারা করে দূরের একটি গাছকে দেখিয়ে বলল যে, ওই গাছের নিচ থেকেও সে ডাক দেয় ওখানে কুকুরগুলো চলে যাবে। পথের কুকুরগুলো কোথায় খাবার পাবে যদি সে না দেয়। এজন্য কলেজে যাওয়ার আগে অথবা পরে কসাইখানা থেকে সে খাবার যোগাড় করে এদেরকে খাওয়ায়।
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দেখলাম কুকুরের প্রতি ওর ভালোবাসা। এই তো মানবতা! এই তো ধর্ম! ‘জীবে দয়া করে যেজন সেজন সেবিছে ঈশ^র!’ এই তরুণীর মহাত্ম্যের কাছে নিজেকে খুব ছোটো মনে হলো। ভাবলাম, আজ পর্যন্ত কোনো প্রাণীকে ভালোবেসে কিছুই খাওয়ানি। আমি কীভাবে মানুষ দাবি করি?
রোদ ক্রমে তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে, তেজ বাড়ছে, বাতাস কখনও নিশ্চল স্থবির, গাছের পাতা অনড় আবার মাঝে মাঝে দুষ্টু দমকা বাতাস গাছের পাতা সামান্য নাড়া দিয়ে যায়, মানুষের চোখে—মুখেও উত্তাপের ঝাপটা দিয়ে যায়। এই গরমে মনে হচ্ছে শরীরে ফোসকা পড়ে যাবে। শরীর নিংড়ে ঘাম বেরুচ্ছে। বুশরাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে বসে থাকবে নাকি হাসপাতালে যাবে?
কী লাভ? ওখানে রোগীদের ভিড়ে বসে থাকার চেয়ে এখানে থাকি। হাতে তো অনেক সময়।
তাহলে হোটেলের রুমে চলো। এসির হিমে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যাবে।
হোটেলের রুমে দমবন্ধ লাগে। এখানেই থাকি। জায়গাটা বেশ খোলামেলা।
এমন প্রচণ্ড তাপদাহে বুশরা কেন বসে থাকতে চাইছে বুঝতে পারছি না। তবু তার ভালো লাগার জন্য আমাকে তাপদাহের কাছে সমপর্ণ করতে হচ্ছে।
কিছু খাবে বুশরা? পাশে ফলের ফ্রেস জুস পাওয়া যাবে মনে হয়। ওই যে দেখ, অনতিদূরে রাস্তার মোড়ে ফুটপাতের পাশে ভ্যানের ওপর ফলের দোকানটির দিকে আঙুলি নির্দেশে বুশরাকে বললাম, ওখানে মনে হয় ফ্রেস ফলের জুস পাওয়া যায়।
ভ্যানের দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থেকেই সে বলল, না। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খেয়ে আসতে পারো।
ইন্ডিয়ার ফলের সুনাম আছে সারা পৃথিবীতে। না খেলে ফলের কি ইজ্জত থাকে?আনারের জুস খাও।
আমার দিকে তাকিয়ে বুশরা স্মিত হাসল। মনে হলো অনেক দিন পর সে হেসেছে। কত দিন ওর মুখের ম্লান হাসিটাও দেখি না! আজ দেখলাম। ওর ধারণা সে খুব দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা, বুশরা বাঁচবে। তাকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। জীবনমৃত্যু যদিও আল্লাহর হাতে, তবুও আমার সর্বস্ব শেষ করে হলেও তার চিকিৎসা করাব।
সে বলল, না, এখন কিছু খাব না। বমি বমি লাগছে।
কথা না বাড়িয়ে আমি ফেসবুকের দিকে মনোযোগ দিয়ে আজকের ঢাকার খবর বুঝতে চেষ্টা করছি। অনলাইনে পত্রিকা থেকে খবর পেলেও ফেসবুকের টুকরো আর বিদ্রƒপাত্মক খবরগুলো পড়তে ভালো লাগে বলে সেটাতেই মনোযোগ দিলাম। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক অঙ্গন উন্মাতাল। চলছে জটিল হিসাব—নিকাশ। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নয়, বরং জিওপলিটিক্সের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশে নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমেরিকার মোড়লগিরি ধরে রাখার জন্য চোখ রাঙাচ্ছে, একটার পর একটা গুটি চাল দিচ্ছে। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে র‌্যাবের সিনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তাসহ ভিসা নীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চীন ও রাশিয়াও আমেরিকার গুটি চালের টুকটাক জবাব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে রুষ্ট, তিনিও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভারত চুপ। নির্বাচনকে ঘিরে ভারতের নির্বিকার ভূমিকা থাকবে বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকারের প্রতি আমেরিকা নাখোশ থাকলেও তারা সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য মাতাব্বরী ফলাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলো নির্দলীয় কেয়ার টেকার গভর্নমেন্টের তত্ত্ববধানে নির্বাচন চাচ্ছে। তারা গণঅভ্যুত্থানেসরকারের পতন চাইলেও আন্দোলনে জনগণের সাড়া পাচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থান কী আর সোজা কথা! বিরোধী দলের আন্দোলন—সমাবেশ দেখে মনে হয় সরকার গেঁাফে তেল দিয়ে বেড়াচ্ছে। সরকার গায়েই মাখছে না। গত দশ বছরে বিএনপির ফিকে আন্দোলন দেখে ‘ঈদের পর আন্দোলন’ হবে বলে এক শ্রেণির লোক নিয়মিত ট্রল করে যাচ্ছে। ফেসবুক বেশ সরগরম। দুটি পক্ষই টুকরো খবর ও গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে অবিশ্রান্তভাবে। আমি নিচের দিকে স্ক্রল করছি, টুকরো খবরগুলো পড়ছি আর হাসছি। কোনো কোনো গুজব অতি হাস্যকর। আবার দু—একটি পোস্ট আছে যেগুলোর ভাষা অত্যন্ত জঘন্য, কদাকার। জাতীয় নেতাদেরক এ—রকম কদাকার ভাষায় গালাগাল দিতে পারে ভাবতেও অবাক হই। আরেক দল আছে মিথ্যে বানোয়াট ওয়াজ নিয়ে। ধর্মান্ধরা এদের সমর্থন করে যাচ্ছে আর প্রগতিশীলরা মৃদু প্রতিবাদ করছে। তীব্র প্রতিবাদ করার সাহস ওদের নেই। চাপাতির ভয় আছে। নিরুদ্বেগ, উত্তেজনাহীন নিরুৎসাহে আমি এগুলো পড়ছি। এসব পোস্টে আমার কোনো আগ্রহ নেই বলে কোনো রিঅ্যাকশন দিচ্ছি না। মাঝে মাঝে দু—একটা কবিতা সামনে এলে একটু থামি, একটু পড়ি। বিমূর্ত আধুনিক কবিতার ভাবার্থ উদ্ধার করতে পারি না বলে পড়ার আগ্রহ পাই না। দু—একটা ছড়া বরং ভালো লাগে। আজকে কোনো গরম খবর পেলাম না। যদিওফেসবুকে সারা দেশের মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে, তথাপি আজকের সবই গতানুগতিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ দুটি গ্রুপ অত্যন্ত সক্রিয় দেখা যায়। মনে হয় রাজনৈতিক পরস্পর বিরোধী দুটি দলে চরম বৈরিতা ও বিভেদের যে প্রাচীর তৈরি হয়েছে তা কোনো কালেও দূর হবে না।
বুশরা অসুস্থ হওয়ার পর ফেসবুকে কোনো দিন কোনো পোস্ট দিতে ইচ্ছে করেনি। এক বছর পর আজকে কেন যেন একটা পোস্ট দিতে ইচ্ছেহলে বুশরাসহএকটা সেলফি তুলে পোস্ট দিলাম। ক্যাপশন দিলাম, ‘বুশরাকে নিয়ে কলকাতায়’। পরিচিত অনেকেই জানত বুশরা অসুস্থ। তারা শুভকামনা জানাতে শুরু করল। দু—একজন মেসেঞ্জারে আমাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে। আমি সাড়া দিইনি। কী সাড়া দেব, এখনও ডাক্তারই দেখানো হয়নি। আমার খুব ফ্যানফলোয়ার না থাকাতে পোস্টে খুব রিঅ্যাকশন পড়বে সেটা ভাবিনি। তবে বুশরার পোস্ট দিলে রিঅ্যাকশন বেশ ভালোই হয়। আর কোথাও না থাকলেও সুন্দরী মেয়েদের সুবিধা অন্তত ফেসবুকে কিছুটা আছে।
আপনারা কী ওপারের?
আবার ওপারের প্রশ্নটি শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেল। কিন্তু বিদেশে এসে মেজাজ বিগড়ানো যাবে না—দেশের বদনাম হবে ভেবে আমার সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, আজ্ঞে, ওপারে। আমরা বাংলাদেশিরা‘আজ্ঞে’বলি না। কলকাতায় গিয়ে একটু ভাব নেওয়ার জন্য গল্প উপন্যাসে পড়া এই শব্দটা ব্যবহার করে মনে মনে হাসলাম।
ভদ্রলোক আমার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বেড়াতে এয়েচেন?
আজ্ঞে না। চিকিৎসার জন্য এসেছি।
আচ্চা। আপনাদের বাড়ি কোন জেলায়?
ভদ্রলোকের অভিব্যক্তি দেখে কেন যেন আমি এক প্রকার মায়ায় আক্রান্ত হলাম। তাঁর পরনে জরাজীর্ণ ধুতি, নীল রঙের হাতাকাটা ব্যাপারী শার্ট, মুখে খেঁাচা খেঁাচা দাড়ি—গেঁাফ, মুখে ঝড়ে আক্রান্ত পর্ণকুঠিরের মতো নড়বড়ে দাঁত, অবিন্যস্ত উসকো—খুসকো শে^তশুভ্র চুল। বুশরাকেও দেখলাম কৌতূহলী দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার মনে হলো তিনি কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে জানেন। আমি বললাম, মুন্সিগঞ্জ জেলা।
মুন্সিগঞ্জের কোথায়?
লৌহজংয়ে।
পদ্মার পারে। শুনেছি পদ্মার ওপর নাকি বিরাট ব্রিজ হয়েছে। সত্যি নাকি?
আজ্ঞে, সত্যি।
এবার আমি তাঁর দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে দেখতে পেলাম চোখ দুটি ছলছল করছে। মনে হচ্ছে কোথাও যেন তাঁর নাড়ির টান আছে। তিনি কিছুক্ষণ বিমূঢ় থেকে বললেন, ওখানের মাটি পৃথিবীর সব মাটির চেয়ে পবিত্র। এমন পবিত্র মাটি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাঁর কথায় আড়ষ্টতা লক্ষ করলাম। একটু ঘাড় ত্যাড়ামি করতে ইচ্ছে হওয়াতে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ওই মাটি পৃথিবীর সব মাটির চেয়ে পবিত্র কেন?
কারণ, ওই মাটিতে আমার জন্ম। ওই মাটি আমার জন্মভূমি। আমার পূর্বপুরুষদের জন্মমাটি।
তাহলে ওখানেই থাকতেন। এখানে এলেন কেন?
হঁ্যা, বাবা। সে কথা বলে আর কী লাভ? ধর্ম আমাদের ভাগ করে দিল, কেড়ে নিল মাটি। তবে আমি মৃত্যুর আগে হলেও পবিত্র মাটিতে এক দিন যাব। আমি সব সময় ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আমার জন্ম যেন ওই পবিত্র মাটিতে হয়।
এপারে আসার পর আর কোনো দিন যাননি?
না। যাইনি। সরকারি চাকরি করতাম। সময় করতে পারিনি। কতবার ভেবেছি যাব। এখন অবসরে আছি। একদিন যাব।
লোকটির প্রতি আমার খুব মায়া হলো। বুশরাকেও দেখলাম কৌতূহল ভরে লোকটির দিকে তাকিয়ে কথা শুনছে। তিনি বুশরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোন হোটেলে উঠেচেন?
হোটেল রক্তচন্দনে।
কিছু মনে না মনে করবেন না। আপনারা এখানকার সিম নিয়েচেন?
আজ্ঞে, নিয়েছি।
যদি দয়া করে আপনার ফোন নাম্বার দেন খুব ভালো হতো।
বিদেশের মাটিতে কাউকে ফোন নাম্বার দেওয়া কতটা নিরাপদ বুঝতে পারছি না। কলকাতায় নামিদামি প্রতারক আছে বলেও জেনেছি। কোনো প্রতারণার শিকার হই কি না ভেবে সময় নিলাম কিছুক্ষণ। আমার কালক্ষেপণ দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি আপত্তি আচে?
লজ্জিত হলাম তাঁর কথায়। তারপর বললাম, আজ্ঞে না। আপত্তি নেই। আমি নাম্বারটি বললে তিনি নিজের ফোনে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?
আমার নাম নাদিম খান।
তিনি কল দিয়ে বললেন, আমার নাম্বারটাও আপনাকে দিলাম। আমার নাম পবিত্র মণ্ডল। কয় দিন থাকবেন?
তা তো বলতে পারছি না। চিকিৎসার ব্যাপার। ডাক্তার দেখানোর পর বলতে পারব।
আচ্চা তাহলে এখন যাই।
পবিত্র মণ্ডল ধীর গতিতে চলে গেলেন বটে কিন্তু মনে হলো বাতাসে রেখে গেলেন অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস। তাঁর দীর্ঘশ্বাস যেন আছড়ে পড়ছে আমার বুকের ভেতরে যেমনটা পদ্মার ঢেউ আছড়ে পড়ে ভাঙনের তীরে। আমি এক রহস্যময় কষ্টের জালে আটকে ছটফট করছি। মাটির প্রতি মানুষের এত ভালোবাসা! জন্মভূমির হাহাকার কি পবিত্র মণ্ডল সারাটা জীবন বুকে ধারণ করে আছেন? সাতচল্লিশে মানচিত্রে পেন্সিল টেনে মাটি তো ভাগ করেনি, ভাগ করেছে মানুষের হৃদয়। আর সেই ক্ষত—বিক্ষত, রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে কত মানুষ হাহাকার করছে তার হিসাব কে রাখে!
আমার অনুভূতি কাউকে বোঝাতে পারব না জানি কিন্তু বুশরার অনুভূতি কি বোঝাার জন্য ওর দিকে তাকালাম। বুশরাও ম্রীয়মান, মাটির দিকে নিষ্পলক নিষ্প্রভ নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে। আমি বুঝতে পারছি সেও বিমূঢ় হয়ে গেছে ওই বৃদ্ধের কথায়।
রোদে পোড়া কলকাতা শহরটা খোলা থেকে নামানো মুড়ির মতো মুচমুচ করছে। রোদের এমন উত্তাপ জীবনে কখনও অনুভব করিনি। এখানে আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না ভেবে বুশরাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন উবার কল দেব?
দাও।
ঢাকার উবারের চেয়ে এখানকার সার্ভিস মনে হলো ভালো। গাড়িগুলোও ঝকঝকে চমৎকার আরামদায়ক। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি কার এসে সামনে দাঁড়াল। তারপর নির্দেশনা অনুযায়ী কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সাউথ ওয়েস্ট হলিস্টিক হেলথ হাসপাতালে গিয়ে নামলাম।
হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট পছন্দ হয়নি। ওখানে গিয়ে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়, ফোনে কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা এক প্রকার বিড়ম্বনা ছাড়া কিছু নয়। ক্যাশকাউন্টারে সুন্দরী তরুণীর দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরাতে ভুলে গেলাম। হঠাৎ তরুণী আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী দেখছেন?
তার কথায় হকচকিয়ে গেলাম আমি। তাই তো, কী দেখছি? আহা, দেশের বদনাম হবে না তো! আমি কিছু না বলে দুই হাজার টাকার নোট দিয়ে ডাক্তারের ফি দিলে তরুণী টাকাটা ফেরত দিয়ে বলল, এই টাকায় একটা দাগ আছে, নেওয়া যাবে না।
আমি টাকাটা হাতে নিয়ে দেখলাম একটি নীল রঙের বিন্দুসম দাগ। বললাম, এই বিন্দুর মতো দাগের জন্য টাকা নিবেন না? আমাদের দেশে অনেক টাকায় ঠিকানা পর্যন্ত লেখা থাকে। আর দাগ ছাড়া টাকা পাবেন এমন সৌভাগ্যবান মানুষ এখনও জন্মায়নি। কেউ তো ফেরত দেয় না।
মনে হলো তরুণী আমার সঙ্গে মজা করার জন্যই জিজ্ঞেস করল, ঠিকানা লেখা থাকে কেন?
আমিও হাসতে হাসতে বললাম, হয়তো কেউ প্রেমপত্র পাওয়ার আশায় নাম ঠিকান টাকায় লিখে ছেড়ে দেয়।
তরুণী কাচভাঙা হাসি দিয়ে বলল, এখানে কোনো টাকায় দাগ থাকলে নেওয়া হয় না।
তাহলে এই দুই হাজার টাকা কি গঙ্গায় ফেলতে হবে?
তরুণী আবার কাচভাঙা হাসি দিয়ে বলল, এত দূর যেতে হবে না। রাস্তাঘাটে ফেলে দিলেও চলবে। তারপর রহস্য রেখে বলল, আপনি যেখান থেকে ডলার ভাঙিয়েছেন সেখান থেকে টাকাটা চেঞ্জ করে নিতে পারবেন। ওরা চেঞ্জ করে দেবে।
অন্য একটি নোট দিয়ে ডাক্তারের ফি দিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হঠাৎ আমার পাশের চেয়ারে হানিফীকে দেখে অবাক হলাম। এই লোকটি আমাদের পাশের গ্রামের এক অল্প শিক্ষিত মওলানা। গত দুই বছর আগে তার উসকানিতে একটি মন্দির ভাঙা হয়েছিল। আর হিন্দুদের ঘরে খাওয়া, তাদের সঙ্গে ওঠাবসা করা, তাদের ঘরে যাওয়া ইত্যাদি হারাম বলেসকাল—বিকালফতোয়া না দিলে যেন তার এবাদতই হয় না। আমাকে দেখেও তার চোখের আয়াতন বেড়ে গেল। কারণ, কয়েক বছর আগে, কলেজে পড়ার সময় সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুতে প্রায় সময়ই ওর সঙ্গে আমার বাহাস হতো। কখনও খুব চরম পর্যায়ে উঠে গেলে গ্রামের মানুষের হস্তক্ষেপে থামতে হতো।
কী খবর হানিফী সাহেব? এখানে যে!
চিকিৎসার লাইগ্যা আইলাম?
হিন্দুদের চিকিৎসা কি হালাল?
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ গোমরা করে বসে রইল। অসুস্থ মানুষকে আমার খেঁাচাতে ভালো লাগেনি। থাক সে তার মতো। আমি চুপ করে রইলাম।
নির্ধারিত সময়ে বুশরাকে দেখে, বাংলাদেশের রিপোর্ট খুঁটিয়ে খঁুটিয়ে দেখে ডাক্তার বাবু বললেন, আপনাদের ভিসা কয় দিনের?
ছয় মাসের।
সঙ্গে টাকাপয়সা আছে?
জি স্যার আছে। কেন বলুন তো।
আপনাদের মাস খানেক থাকতে হতে পারে।
তা থাকা যাবে। সে রকম প্রিপারেশন নিয়েই এসেছি।
ডাক্তার বাবু আরও পরীক্ষা—নিরীক্ষার জন্য বললেন। বুশরা কেন যেন দুপুরের দিকে আরও কাহিল হয়ে গেল। ওর মনটা মরে গেছে অনেক আগেই। এভাবে সাহস হারালে কী হয়? এখন কত ক্যান্সার সারভাইভর আছে। বছরের পর বছর ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে কিন্তু বুশরা কেন জীবনের হাল ছেড়ে দিল? অবশ্যই আমিও হয়তো হাল ছেড়ে দিতাম। আমি মনের দিক থেকে ওর চেয়ে আরও বেশি নরম, দুর্বল।
রাতে দুজন হোটেলে বসে আছি। বাইরের কোনো শব্দ নেই, কোনো কোলাহল নেই। শরীর জুড়ানো এসির হিম যেন সারা দিনের ক্লান্তি শুষে নিচ্ছে। বুশরা চুপাচাপ শুয়ে আছে দেখে আমার বড্ড বিরক্ত লাগছিল। ওর নীরবতা আমার কাছে দিনের পর দিন অসহ্য লাগছিল যা কলকাতায় আরও বাড়িয়ে দিল। হয়তো বুশরা চোখ বন্ধ করে সারা রাত ঘুমের ভান করে পড়ে থাকবে। আমি বুঝতে পারি মৃত্যুভয়ে ও ঘুমাতে পারে না। কোনো দিন শেষ রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে দোয়া—কালাম পড়ে ফজরের নামাজ পড়ে একটু ঘুমায়। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে অনেক আগেই। কোনো একটি মেডিসিনের পাশ^র্—প্রতিক্রিয়ায় মুখ কিছুটা ফুলে গেছে। আমি বসে বসে ফেসবুক ঘাঁটছি। হঠাৎ বুশরা বলল, সকালের পবিত্র মণ্ডলের কথা মনে আছে?
হুম।
মানুষটার জন্য আমার মায়া লাগল। আসলে দেশ ভাগের কথা ভাবতে গেলে কেমন যেন লাগে। কয়েক পুরুষের সাজানো সংসার, ভিটেমাটি ছেড়ে অন্য দেশে উদ্বাস্তু হয়ে থাকা। মনে হয় শেকড় ছেঁড়া মানুষ।
কিন্তু দেশ ভাগ না হলে কি মানুষ বিদেশে গিয়ে স্যাটেলড হয় না? এখনকার হাজার হাজার ছেলেমেয়ে তো কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া গিয়ে স্যাটেলড হচ্ছে। তাদের জন্মভিটা, মাবাবা ভাইবোন ফেলে চলে যাচ্ছে। সেখানে কি তারা খারাপ আছে?
হুম। তা ঠিক। মাতৃভূমির প্রতি হয়তো সবার এক রকম টান থাকে না।
আমি মনে করি মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে যেখানে থাকতে পারে সেখানেই থাকে। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব বেশি সময় লাগে না।
হুম। তাই মনে হয়।
আমাদের আলাপচারিতার মধ্যেই পবিত্র মণ্ডলের ফোন এল এবং ডাক্তার কী বলেছেন, কী করতে হবে, কত দিন থাকতে হবে এসব খেঁাজ—খবর নিলেন তিনি। ভদ্রলোকের কথা শুনে খুব ভালো লাগল।
পরদিন আবার হাসপাতালে গিয়ে মওলানা হানিফীর সঙ্গে দেখা হলো। আমার দিকে তাকিয়ে, জানি না কেন, সে বলল, আজকে শরীরে রক্ত ঢুকাবে। হিমোগ্লোবিন কমে গেছে অনেক বেশি। হাসপাতালেও ভর্তি হয়ে সাত দিন থাকতে হবে, ডাক্তার জানাল।
হঠাৎ কেন যেন আমার মনুষ্যত্ব চূড়ান্তভাবে লোপ পেয়ে গেল, অথবা এমনও হতে পারে যে, অবচেতন মনে, পূর্বের কোনো আক্রোশের প্রতিশোধ নিতে বললাম, রক্ত কি হিন্দুর না মুসলমানের?
হানিফীও চোখ দুটিও লাল হয়ে গেল। হয়তো সেও অবচেতন মনে, অতীতের কোনো চাপা দেওয়া ক্রোধ হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো, মুখটা কাঁপছে তির তি করে, তারপর গরগর করতে করতে বলল, জীবন বাঁচানো আগে দরকার। ওইসব কথা বাদ দেন।
আমাকে একদিন মানুষের সামনে অপমান করেছিল এবং সেই প্রতিশোধ নিতেই বললাম, আপনি ধার্মিক হয়েছেন। এবার সুস্থ হয়ে গিয়ে আশা করি মানুষও হবেন।
আপনিও তো মানুষ হতে পারলেন না। আমি একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেন।
আমার উত্তপ্ত মেজাজ বাতাসে নিভে যাওয়া বাতির মতো হঠাৎ দপ করে নিভে গেল এবং অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়লাম। সত্যিই তো অসুস্থ মানুষকে কেন আঘাত করলাম। পুরোনো ক্রোধ কি মনে রাখা উচিত? আমিও মানুষ হতে পারিনি। আমি বললাম, হানিফী সাব, আমি দুঃখিত। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন দোয়া করি।
হানিফী আর কথা বলেনি। আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে দূরের এক কোণে গিয়ে রুগ্ণ পাখির মতো বসে রইল।
আমাদের পরীক্ষা—নিরীক্ষার কিছু রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার বাবুকে দেখালে তিনি বুশরার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার ধারণা আপনার ভুল ডায়াগনোসিস ও ট্রিটমেন্ট হয়েছে। ক্যান্সার বলে মনে হচ্ছে না। আমরা এই হাসপাতালে আরও পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে কনফার্ম রেজাল্ট দেব। আপনাদের কোনো অসুবিধা না হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান। কয়েক দিন থাকতে পারলে ভালো হবে।
মানুষের প্রতি পদে পদে অভিজ্ঞতা। কত অজানা থেকে যায় ঘরের বাইরে বের না হলে। এজন্য ঘর থেকে বের হতে হবে। ঘর থেকে বের হয়ে ধাক্কাগুঁতো খেলেও এক সময় পথ পাওয়া যায়। আমিও যেন পথ পেলাম। আমিও যেন দিশা পেলাম। এই হাসপাতালের আশেপাশে স্বল্প সময়ের জন্য বিছানা, রান্নাবাড়ার সরঞ্জামসহ বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। অসংখ্য বাংলাদেশি এসব বাসাবাড়িতে থাকে চিকিৎসার জন্য। আমাদেরও একজন পরামর্শ দিয়েছিল রুম ভাড়া নেওয়ার জন্য। আমি রান্না করতে পারিনি বলে হোটেলে থেকে গেলাম।
আমি বুশরার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার সেই হাসিটি বর্ষার পানির মতো মুখের ওপর খেলছে যে হাসিটি দেখার জন্য আমি দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম। দারুণ এক প্রকার প্রশান্তির প্রবাহ বুকের ভেতরে বয়ে যেতে লাগল।
সামনে কোরবানির ঈদ। এবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারব না, বুশরা এজন্য মনক্ষুণ্ণ। তবে সুখের বিষয় যে তার সুস্থতার নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বুশরাকে একটি ক্যাবিনে ভর্তি করালাম। পবিত্র সরকার প্রতি রাতেই ফোন করে বুশরার খবর নেন। একদিন ঠিকই হাসপাতালে চলে এসেছেন দেখার জন্য। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে গেলেন। বুশরার চিকিৎসার ভালো খবর শুনে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটি যেন চিরচেনা কোনো দেবদেু্যতি—হাসি, যেন এক দেয়ালচিত্র হয়ে আমার চোখে গেঁথে রইল।
চিকিৎসার পর্ব শেষ এবং ডাক্তার বাবু বললেন, আপনার শরীরে ক্যান্সারের কোনো জার্মই নেই। ভুল চিকিৎসা হয়েছে। তবে ভয় পাবেন না। পাশ^র্প্রতিক্রিয়ায় শরীরের যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত রিকভার করার ওষুধ দিচ্ছি। বাংলাদেশে এই ওষুধ হয়তো পাওয়া যাবে না। এখান থেকে বেশি করে নিয়ে যাবেন। তিন মাস পর আবার আসবেন। দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবেন।
একটি বড়ো সংকট থেকে বাঁচা গেল যে, আমাদের পূর্বের ডাক্তার বলেছিলেন জরায়ু রিমোভ করতে হবে। তাহলে বুশরার ক্ষতি হবে না, বুশরা বেঁচে যাবে। এক দিকে ক্যান্সার, অন্য দিকে জরায়ু রিমোভ করা। যদি সে ভালোও হয় সন্তান ধারণ করতে পারবে না। বুশরা একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তাহলে আমার বেঁচে থেকে কী লাভ?
হঠাৎ করে কলকাতা শহরটা ঝুমঝুমির মতো বাজতে শুরু করেছে। সেই ছোটো বেলায় মেলা থেকে ঝুমঝুমি কিনে বাজালে যেমন শব্দ শোনা যেত ঠিক তেমনই। আমি শুনতে পাচ্ছি কলকাতা সেভাবে বাজছে। কলকাতা শহরটি ঝুমঝুমি। আমি বাজাচ্ছি ঝুমঝুমির মতো।
ঈদের দুদিন পর ঢাকা ফেরার টিকিট পেলাম। চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা অনেক টাকা বেঁচে গেল। বুশরা বলল, শপিং করব। নিশ্চয়ই শপিং করব। সব টাকা খরচ করে ফতুর হয়ে যাব। এই আনন্দকে কি আর টাকা দিয়ে কেনা যায়? আমার বুশরা আবার আগের মতো হাসবে। এই আনন্দ কি আর থামানো যায়?
আমরা শপিংয়ে বের হয়ে কয়েকটি শপিং মল ঘুরে ঘুরে দুদিন পর্যন্ত কেনাকাটা করলাম। সবই বুশরার পছন্দের। শেষে বুশরা কিনল একটি আদি কাপড়ের পাঞ্জাবি ও একটি ধুতি। বুশরা কেন কিনল আমি জানি না। আমি জিজ্ঞেস করিনি। কোনো কিছুতেই প্রশ্ন করিনি।
ঈদের দিন দুপুরে পবিত্র মণ্ডল আমাকে ফোন করে বললেন, দুপুরে কোথাও যেন বের না হই। তারা স্বামী—স্ত্রী আসবেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এ যে দেখছি আপদ। ঈদের দিনে মুড়ির মতো মুচমুচে কলকাতায় ঘুরে বেড়াব আর তিনি এসে আমাদের বাধার সৃষ্টি করলেন। মুরুব্বি মানুষ হিসেবে মুখের ওপর না করতে পারিনি। শত হলেও লোকটার লৌহজংরে মাটির প্রতি টান নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। আমি ভাবলাম হয়তো ওনার সঙ্গে আর দেখা নাও হতে পারে। কে থাকে কে মরে? সেদিনের দুপুরে হাসপাতালে বলেছিলেন, আমি পদ্মার পলির আর লৌহজংয়ের মাটির ঘ্রাণ এখান থেকে পাই। আমার পবিত্র জন্মভূমির মাটির ঘ্রাণ পাব না?
যে মানুষটি আমার লৌহজংয়ের মাটিকে এতটা ভালোবাসে তার একটা আবদার কেন রাখব না?
ঈদের দিন দুপুরে সস্ত্রীক এলেন হটপট, দুটি টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি করে ঈদের খাবার নিয়ে। আমরা বাংলাদেশের মুসলমানরা ঈদের দিন যে খাবার খাই সেসব খাবারই রান্না করে নিয়ে এলেন। আমরা এর মধ্যে জেঠু আর জেঠুমা ডাকতে শুরু করে দিলাম। এত পরিশ্রম কেন করতে গেলেন বলাতে জেঠু বললেন, আমার পবিত্র মাটির সন্তানেরা ঈদের দিন কিছু খাবে না তা কি মেনে নিতে পারব? তোমরা আপত্তি করবে না। জেঠুর কথা শেষ হতে না হতেই জেঠুমা চারটি প্লেট সাজিয়ে ফেললেন। মাতৃত্বের কড়া ভাষায় বললেন, এত কথা কীসের ঈদের দিন? ঈদের দিন তোমরা কী খাও না খাও কে জানে? আমি রান্না করেছি। চুপ করে বসে খাও।
আহা! এই বুঝি মাতৃত্ব!
খাওয়া—দাওয়া আর গল্প করতে করতে বিকেল হলে তাঁরা দুজন বিদায় হওয়ার আগে বুশরা দুটি প্যাকেট বের করে তাঁদের হাতে দিলেন। একটিতে ধুতি আর পাঞ্জাবি, আর একটিতে শাড়ি।
ওনারা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমাদের দিকে। আসলে বুশরাকে কেউ হারাতে পারে না। জেঠুমা বললেন, বুশরা তোমার ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা হেরে গেল। তুমি সত্যি অনন্যা।
বুশরা বলল, এভাবে বলবেন না। আপনারা যখন লৌহজং যাবেন তখন আমাদের হারিয়ে দিয়ে আসবেন।
বিকেলে আমরা শহরে ঘুরতে ঘুরতে রাতে হোটেলে ফিরে এলাম।
রাতের গহিনে কীসের জন্য আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি আমি। বুকের ভেতরে দুর্বোধ্য অদম্য হাহাকার আমাকে অস্থির করে তুলছে। একদিন পর আমাদের ঢাকায় ফিরতে হবে। গভীর রাতে মনে হচ্ছে আমি পদ্মার পলির ঘ্রাণ পাচ্ছি। আছড়ে পড়া ঢেউয়ের তুমুল গর্জন শুনতে পাচ্ছি যে ঢেউগুলো কেবল ভাঙনের গান শোনায়। কেবল ভাঙনের গান…

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত