| 6 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৯) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

অনসূয়ার ডালাস যাত্রা

ব্যাঙ্গালোর আর ডালাস। মিঠি আর রাণীয়া। বড় আর ছোটো মেয়ের সংসার। মনের মত দুই জামাই। এই নিয়েই অনসূয়ার সারাক্ষণের দিনলিপি। সবই ঈশ্বরের কৃপা। নতজানু তিনি ঈশ্বরের কাছে।

রাণীয়ার বাবা মা কখনো জামশেদপুরে তো কখনো কলকাতায়।

মেয়ে জামাইয়ের কাছে ডালাস যাচ্ছেন বলে সব ঠিক হয়েও ভেস্তে গেল সেবার। ঠিক যেন দিদার মত গুছোতে শুরু করে দিয়েছিল তার মা। এতদিনের অদর্শনে আধুনিকা শহুরে মায়ের কী যে মনের অবস্থা তা আর কে বুঝবে ?
স্থান-কাল-পাত্র বদলে গেছে কিন্তু অনেক কিছুই এক রকম রয়ে গেছে আজো। রাণীয়ার মা নিজের কর্তাকে দিয়ে  একে একে সব যোগাড়যন্ত্র করতে লাগলেন। কোথায় শিশি ভরে খেঁজুর গুড়ের পাটালী যা শীতকাল থেকে তাঁর ফ্রিজে বন্দী আছে। নিজের হাতে বানানো মোটা মোটা লাল লঙ্কার মারাঠি আচার, জামাই ভালবাসে ডালের সঙ্গে পোস্ত, কালোজিরে দেওয়া কুট্টি কুট্টি ভাজা বড়ি। মেয়ের প্রিয় ঝোলে খাবার বিউলির ডালের হিংয়ের বড়ি আর শুকনো লঙ্কার কুচি ছড়ানো বড় বড় বড়ি। মেয়ে মায়ের হাতের  বড়ি-বেগুণের চচ্চড়ি  বড় ভালোবাসে যে । আবার  হলুদ রঙের মটরডালের কুড়মুড়ে বড়িও চাই মেয়ের। সেদেশে মেলেনা। সেগুলো ঘন্টের ওপর ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া হয় অথবা সুক্তো তে দেওয়া হয় ।

রাণীয়ার ঠাকুমা সেই দেখে বললেন,
আচার, বড়ি অযাত্রা বৌমা।

রাণীয়ার মা বললেন, তাই বলে ওরা খাবে না? ট্রেনে করে চেঞ্জে যাবার সময় আমার মা’ও তো নিতেন সেকালে। তেমন কিছু অঘটন ঘটেছে বলে তো মনে নেই। অমনি শাশুড়ি মা এক গাল হেসে সায় দিয়ে ফেলেন।
বৃদ্ধা বললেন, আর কিছু নাও ছাই না নাও বেশী করে সর্ষের গুঁড়ো নিও কিন্তু । আমার নাতনী বড় ভালোবাসে মাছের ঝাল। সম্বচ্ছর সেদেশের মাছ কিনে এনে সর্ষে বাটার অনুরূপ মাছের ঝাল চট করে বানিয়ে খেতে পারবে ওরা ।
এভাবেই টুকিটাকি সব গোছ করছিলেন তিনি। উত্কৃষ্ট সেমাই ঘিয়ে ভেজে বন্দী হল স্টিলের কৌটোর অন্দরে। পায়েস বানাতে হবে না? সে দেশে ড্রাইফ্রুটস বিস্তর মেলে অতএব বলাই বাহুল্য ঘিয়ে ভাজা সেমাই, পাটালীগুড়, ড্রাই ফ্রুটস  সহযোগে সেদেশের লো ফ্যাট দুধও কথা বলে উঠবে মায়ের হাতে। একবার যাচ্ছেন এত খরচ খরচা করে। জামাইষষ্ঠী থেকে জন্মদিন সব পালন করে আসতে হবে তো! রাণীয়া বলেছে ডিহাইড্রেটেড কন্ডেসন্ড মিল্ক ও মেলে অতি সস্তায় । তবুও মায়ের মন কেঁদে ওঠে।
অবাঙালী দোকানের মহার্ঘ্য খোয়াক্ষীরের গুঁজিয়া নেবার যে কী দরকার…এই নিয়ে কিছু বচসাও হল কর্তামশাইয়ের সঙ্গে । ওদের মত ক্ষীরের মিষ্টি বাঙালিরা পারেনা বানাতে কিম্বা ক্ষীরের মিষ্টি বেশীদিন থাকে… এসব বলে জিতেছিলেন সেদিন।
তক্ষুনি নিজের মায়ের নিদান মনে পড়ল। ওরে শোন! বোশেখের বাজারে নতুন কাঁচা আমের কথা। কাজের মাসীটিকে দিয়ে ছুলিয়ে ডুমো ডুমো করে কেটে চিনির গাঢ়ো রসে উগরেও নিস কিন্তু । আমার নাতজামাই বড় ভালোবাসে খেতে। মধ্যে কয়েকটি কিশমিশ আর একটু আদার কুচি দিবি । কিছুটায় পাঁচফোড়ন আর শুকনো লঙ্কার ছঁক দিবি । অতঃপর অনসূয়ার হাতেই মায়ের নিদান অনুযায়ী তৈরী হয়  আমের দু’রকমের মিষ্টি আচার। জ্যামের শিশি ধুয়ে মুছে, শুকনো করে হালকা গরম ঐ মিষ্টি চাটনী শিশির মধ্যে বন্দী হয় । তারপর ঢাকনা এঁটে প্ল্যাস্টিকের বুদবুদ র‍্যাপ জড়িয়ে আঁটোসাঁটো হয় স্কচ টেপ দিয়ে শিশির আপাদমস্তক। এবার সোজা চালান হয় তা ঢাউস স্যুটকেসে জামাকাপড়ের মধ্যে। শুক্তোর মশলাও শুকনো খোলায় ভেজে, গুঁড়ো করে চালান করেন অনসূয়া প্লাস্টিকের ছোট্ট কৌটোর মধ্যে।  
এতকিছু না গোছালে চলে? সেখানে গিয়ে একা হাতে মা’কে তো রান্নাবাটি সারতে হবে। গোছ থাকলে রান্না বসাতে কতক্ষণ? মেয়েটা খুব খাটে রান্নাঘরে। ওকে রেস্ট  দিতে হবে না? তারপর জামাই গাড়ী কিনেছে। দুজনেই গাড়ী চলাতে পারে। লাইসেন্স হয়েছে সম্প্রতি রাণীয়ারও। বিকেল হলেই কিম্বা উইকেন্ডে মা বাবা কে নিয়ে টো টো টোকলা। যখন তখন বেড়াতে যাওয়ার ধুম লেগেই আছে সেদেশে।  

এসব ভাবতে ভাবতে লাস্ট মোমেন্টে এবার পোল ভল্ট দিলেন গিন্নীর গর্ভধারিণী মানে রাণীয়ার দিদা। আমার নাতজামাইয়ের বড্ড প্রিয় ধোঁকার ডালনা। কতদিন খায়না বাছা। শোন্‌ ছোলার ডাল, মটরডাল বেটে নিয়ে  হিং, আদা-লঙ্কা দিয়ে নুন মিষ্টি দিয়ে যেমন ধোঁকা বানাস, তেমনি করে শুধু পিস করে ভেজে নিয়ে যাস, লক্ষী মা আমার। গিয়েই ছেলেটাকে  আদা-ঘি-গরমমশলা দিয়ে  ডালনা বানিয়ে দিস্‌।
কি মুশকিল!
আরে মুশকিলের কি আছে? প্লাসটিকের কতরকমের কৌটো আছে তোর। ভরে নিয়ে সোজা চেকড ইন লাগেজে চালান করে দিস ।
ওরা যদি বাক্স খোলে মা? এক পিস খাইয়ে দিস। সর্ষের তেলে ভাজা ধোঁকা খেয়ে সাদাচামড়ার সিকিউরিটি ভিরমি যাবে।
রাণীয়ার বাবা হাসতে হাসতে বললেন,
স্মার্টলি বলবে, লেন্টিল কেক। ফ্রায়েড স্ন্যাক্স। ইতি গজ’র মত মৃদু স্বরে তিনিও বললেন, চেখে দেখ,  নয়ত পস্তাবে। বিল পাশ হল। তার মানে কর্তা সায় দিলেন।
এবার মেয়েকে  অনসূয়ার মেসেজ… আর কিছু মনে পড়লে বলবি কিন্তু। বাক্স এখনও বন্ধ করিনি ।  
শোন, তোর দিদার আরেকটা অনুরোধ। টাটকা মৌরলা মাছ এনে সর্ষের তেলে মুচমুচে করে ভেজে নিয়ে যেতে বলেছে। এয়ারটাইট কৌটোর মধ্যে নেব তাহলে । সাতদিন থাকবে। গিয়ে ঐ আমের চাটনিতে ফেলে এক মিনিট মাইক্রো করে দিস। আম-মৌরলা খেতে বড্ড ভালোবাসিস যে তোরা। ওপর থেকে একটু সর্ষে আর শুকনোলঙ্কার ছঁক দিয়ে দেবখন। ঠিক বাড়ি বাড়ি গন্ধ পাবি তবে ।
সেবার সেই ফোনে তোর আম-মৌরলার গল্প শুনে আর দেখে দিদার সে কী আনন্দ ! আর দেখাতে দেখাতে তোর রান্নার ছবি দেখিয়ে কী মনখারাপ তার। ওই যে তুই দিদার নাম করেছিস। সারা বিশ্বের দরবারে দিদার রান্না বলেছিস। এখনও বলে তোর দিদা।  “এটা আমার দিদার  কাছে শেখা বেষ্ট চাটনীর রেসিপি।”… আমার নাতনী যে সে নয়। রান্নার রাণী সে। মানে কিচেন কুইন হয়েছে।


আরো পড়ুন: রাণীয়ার রান্নাঘর (পর্ব-১৮) । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


স্ট্রলি ব্যাগের ঢাকনা খোলা হয় আর বন্ধ হয়। স্ট্রলি ব্যাগ শুধু ভরবার জন্যে। কিছু বের করার জন্য নয়। স্ট্রলির অন্দর কভু খালি নাহি রয়।  বাবা চিন্তায় অস্থির। এতসব যাবে কী করে আকাশপথে?

কিন্তু এ তো গেল ঘর থেকে বেরুনোর আগেকার বেত্তান্ত। তারপরেই করোনা আছড়ে পড়েছিল সেদেশে প্রথম। অতএব এদিক থেকে ওদিকে আসা, যাওয়া সব চৌপাট হল। মাথায় হাত রাণীয়ার মা, বাবার আর ওদিকে মেয়ে জামাইয়ের নিদারুণ মনঃকষ্ট!
জামাই কুশল শ্বশুর শাশুড়ি কে হাসতে হাসতে বলেছিল। ওয়েট, ওয়েট। আচার, চাটনি, বড়ি থাকুক পড়ে। বাকীসব খেয়ে ফেলুন আপনারা।

আবার ফ্লাইট খুললেই সব ব্যবস্থা হবে একদিন । সে আর হয়না।

অনসূয়া খুব আপসেট। যাও বা বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল এই প্যান্ডেমিকের দাপটে সব ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে গেল।

এতকিছুর মধ্যেও মিঠির মুখে বেশ যেন স্বস্তির ভাব ফুটে উঠতে দেখলেন অনসূয়া। রাণীয়াও টের পেল তা আভাসে ইঙ্গিতে। তবুও এ নিয়ে অনসূয়া রাণীয়ার সঙ্গে কিছু বলেন না। পাছে দুই মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়।

ঘরবন্দী হয়ে রাণীয়ার মা একা একা ভাবতে থাকেন। বড় মেয়ে জামাইয়ের কাছেও যাওয়া যাবেনা এখন। সেই সেবার ওদের সংসারে গিয়েও খুব আনন্দ পেয়েছিলেন। কত যত্ন করেছিল মেয়েজামাই মিঠি আর শৈবাল! মিঠি রাঁধতে পারেনা। রোজ খাবার টেবিলে বেচারা শৈবালের মুখে গরম ভাতের গন্ধে আর পঞ্চব্যঞ্জনের আয়োজনে খুশির জোয়ার আর তৃপ্তির সুখ ঢেঁকুর দেখে কী আনন্দই না পেয়েছিলেন তিনি। তখনও এক আধদিন মিঠি বেশ মেজাজ দেখিয়েছিল খাবার টেবিলে বসে। যেন তার মা রেঁধে খাইয়ে জামাই কে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে। সেখানেও তার ভ্রূকুঞ্চনে খামতি নেই। আচ্ছা কার মত হল এই মিঠি? এত হিংসুটে কেন সে? অনসূয়ার বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।

শৈবাল রাতে শুতে গিয়ে নিশ্চয়ই বলেছিল, এমন সিন ক্রিয়েট কর না তুমি! তোমার মা আমাদের জন্য কত আনন্দ করে রাঁধাবাড়া করে টেবিল সাজিয়ে দিচ্ছেন আর তুমি কী না…কী হয়েছে বলতো তোমার?
মিঠি নিজেও জানেনা কী ঠিক হয়েছে ওর।
অনসূয়া ভাবেন, মিঠির সাইকিয়াট্রিক কাউন্সেলিং করালে হয়না একটু? এখনও সেই জিনিষই চলছে…মিঠির কিসের এত টেনশন? এত টানাপোড়েন? তাহলে কী তিনি যা ভাবছিলেন সেসবই সত্যি?  

ব্যাঙ্গালোরে মিঠির সংসারেও বড় মায়া পড়ে গেছিল সেবার অনসূয়ার। ফেলে আসা শহরের ওপর কিসের এত মায়া তোমার? মেয়ের বাবা বলেছিলেন। সে তুমি বুঝবে না গো। আমারই তো মেয়ে মিঠি। কুমাতা কদাপি নয়, জানোনা?  
মেয়ের অগোছালো সংসারে একাত্ম হয়ে একনাগাড়ে বেশ ক’টা দিন রান্নাবান্না করেছিলেন চুটিয়ে।  তার কি হবে? ফেরার পথে সেই স্মৃতি মা’কে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছিল । রোজ রাতে আপিস থেকে ফিরলেই মা বলতেন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে। একটু আধটু রান্না করলেও মন ভালো থাকে রে। এত জব প্রেশার তোর!
মিঠি সে সবে কান দেয় নি অবিশ্যি।
ব্যাঙ্গালোরের কেতাদুরস্ত একরত্তি মডিউলার কিচেনে লুচি ভাজার পর শৈবালের চোখেমুখে খুশীর তুফান? বহুদিন পর শাশুড়ি মায়ের হাতে সুক্তো খেয়ে তার অভিব্যাক্তি? অথবা ভাজা বড়ি, মূলো, বেগুণ, আলু দেওয়া পালংঘন্ট দিয়ে তার সাপটে গরম ভাত মাখা দেখে সেই শব্দ টা? “ব্যাপক, মা, ফাটাফাটি হয়েছে কিম্বা হেভেনলি” … জামাইয়ের মুখের এই কথাগুলো মনে পড়লে বড় কষ্ট হয় মায়ের। কথায় বলে না পেটের শত্তুর থাকার মহা জ্বালা।

সকালবেলা অফিস যাবার আগে এক আধদিন  ফুলকপির চচ্চড়ি আর গরম পরোটার গন্ধে মিঠি তার হাতের সব কাজ থামিয়ে দিত।  রান্নাঘরে মায়ের পেছনে চুপিচুপি এসে দাঁড়ানোটা ভুলতে পারেনা তাদের মা। অথবা সাইটসিইং করে এসে চালে ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দেওয়া দেখে খুশীতে ডগমগ হয়ে মেয়ের সেই বলে ওঠা…প্রেসারে সিটি দিলে এমন গন্ধ বেরোয় না গো, সত্যি বলছি মা। কি কি দিলে আর? আমার হয়না কিছুতেই।
শৈবাল বলেছিল সেই শুনে… সে কি? তুমি খিচুড়ি রান্না শিখছো যে!
মা নরম স্বরে সেই পিয়ার’স সাবানের বিজ্ঞাপনের মত বলেছিল, “কিচ্ছু না’ , ঘি, গরম মশলা, জিরে, তেজপাতা ফোড়ন আর একটু ফ্রেশ আদা গ্রেট করে দিলাম, ব্যাস! তুই যে রান্নায় ফ্রোজেন আদা পেষ্ট দিস, ওর গন্ধ অন্যরকম হয়। অমনি সে বলে ওঠে, আমার অত সময় নেই। আমি কী হালুইকর বামুন হব?
মা বলেছিল, তাহলে যা রাঁধবি তাই উত্তম, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা বলে চালিয়ে দিবি, বুঝলি? আর আমার জামাই তো যা দিই সব সোনা হেন মুখ করে খেয়ে নেয়। তাহলে আর তোর এত চিন্তা কীসের? একটুআধটু মনের মত না হলে বলবি “সেই সত্য, যা রচিয়াছি আমি’। তবুও একটু আধটু রাঁধবি । যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে, বুঝলি?
নো ওয়ে মা, আমায় বোলোনা। মায়ের উদ্দেশ্যে এসব বলেই মিঠি একটা আপেল হাতে নিয়ে দুমদাম অফিসের দিকে পা বাড়িয়েছিল সেদিন।
মা ভাবল, মেয়ের সব ভালো শুধু রাঁধতে বললেই মুশকিল। দুই মেয়ে ডায়ামেট্রিকালি অপোসিট। কেন যে বড়টা এমন হল কে জানে?

ব্যাঙ্গালোর থেকে সেবার ফিরে আসার আগের দিন মা মিঠির রান্নাঘর গুছিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলেন।
শোন, লুচির জন্য আনা ময়দা যেটুকুনি বাঁচলো সেটুকু তোর কন্টিনেন্টাল রান্নাবাটির হোয়াইট সস বানানোর জন্যে রেখে গেলাম। সেই শুনে শৈবাল বলেছিল, মা যে কী বলেন! সব সেদ্ধ দিয়ে ফেনা ভাতে বসাতেও ওর ইচ্ছে করেনা। ও না কী কন্টিনেন্টাল বানাবে!
শৈবাল পারদপক্ষে বউকে ঘাঁটায় না। যদিও মাঝমধ্যে ভয়ে ভয়ে উগরেও দেয় একটু আধটু। তবে তা বিষ নয়।
মা আড়ালে জামাইকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেন, রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, ফোঁস করবে, ছোবল মারবে না। বুদ্ধি করে চলবে। জানোই তো আমার মেয়েটা বড় বদরাগী।
আবারও বলেন তিনি…  
বড়ি, মুগডাল সব ভেজে রেখে গেলাম, তোর সুবিধে হবে বলে। কোলকাতা থেকে আনা কুকমী সরষে গুঁড়ো, নেসলে নারকোল গুঁড়ো, সব ফ্রিজে রেখে গেলাম। তোর কিচেন কাবার্ড যতটা পেরেছি গুছিয়েছি। পাঁচ ফোড়ন, মূসুরডাল, নুন, হলুদ সব। আমিই তো সব আনিয়েছিলাম। এবার আমিই রেখে গেলাম বাকীটুকু। তোদের রাঁধাবাড়ার জন্য । কে জানে সেই রেখে এসেছিলেন বলেই বুঝি আজকাল মেয়েটা একটু আধটু রান্নাঘরে ঢোকে বৈকি। কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন সেদিন। কোথায় যেন কিসের সেলাই খুলে গেছে বলছিলি? দে দিকিনি আমায়।

চিংড়ির রেসিপিটা শিখে গেলি তো? ওপাশ থেকে মেয়ের সাড়া না পেলেই তিনি বোঝেন মেয়ের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। শৈবাল বরং শিখে নেয়। ছোট্ট করে একটা ভিডিও নিয়ে নেয়।ওপরে থৈ থৈ চেরা সবুজ কাঁচালঙ্কা দিয়ে  সর্ষে-পোস্ত চিংড়ি তার বড় প্রিয়। এর সঙ্গে নো কম্প্রোমাইজ। শিখে নিলে ছুটির দিনে একদিন গরম ভাত আর এই চিংড়ি দিয়ে জমে যাবে তার উইকেন্ড লাঞ্চ। মিঠি খাবে বরের রান্না তবে হাত না ঘুরিয়ে।
কলের গানের মত মা বলেই চলেন। শৈবাল রেকর্ডিং করে নেয় টুক করে।
মাছগুলো ধুয়ে ম্যারিনেট করে রাখবে নুন, হলুদ আর লংকার গুঁড়ো দিয়ে। পোস্ত জলে ভিজিয়ে গ্রাইন্ড করে নেবে লংকা দিয়ে । একটা বাটিতে পোস্তর পেস্ট, সর্ষের গুঁড়ো, নুন দিয়ে ফেটিয়ে রাখবে। এবার নন স্টিক প্যানে মাছগুলো পাতিয়ে দিবি। সরষে-পোস্ত বাটা দিবি ফুটে উঠলে অনেকগুলো চেরা কাঁচা লংকা আর সরষের তেল ছড়িয়ে নামিয়ে নেলেই হল। হলুদ নয় কিন্তু। তুমি অত ভাপার টেকনোলজি পারবে না। এতেই দৌড়বে তোমার পোরসে চিংড়ি। তবে তুমি ঢাকা দিয়ে সবশুদ্ধ মাইক্রো আভেনেও দিতে পারো মিনিট ছয়েক। পোস্ত আর সর্ষের পরশে পোরসে চিংড়ির এহেন  নামকরণ অবিশ্যি শৈবালের। কারণ সে হল অটোমোবাইল ফ্রিক। ও হ্যাঁ, চিংড়ি না থাকলে মাশরুম দিয়েও দৌড়বে কিন্তু এই রেসিপি।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত