| 8 মে 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ গল্প: অনুতাপ । গি দ্য মোপাসাঁ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

গি দ্য মোপাসাঁ ৫ আগস্ট ১৮৫০ – ৬ জুলাই ১৮৯৩) সালে জন্মগ্রহন করেন। তিনি একজন বিখ্যাত ফরাসি কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক।


অনুবাদক: তপন রায়চৌধুরী 

মঁসিয়ে স্যাভেল, মান্তে শহরে যাঁকে সবাই ‘বুড়ো স্যাভেল’ বলে জানত, সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠলেন। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। পাতাগুলো ঝরে পড়ছে বেশ ধীরে। মনে হচ্ছিল, যেন আরেক ধরনের বৃষ্টি। ফোঁটাগুলো ভারি। মন ভালো নেই মঁসিয়ে স্যাভেলের। তিনি একবার ফায়ারপ্লেস থেকে জানালার কাছে, আবার জানালা থেকে ফায়ারপ্লেসের দিকে যাচ্ছিলেন। বড় দুঃখে দিন কাটছিল তাঁর। এখন তাঁর বাষট্টি বছর বয়স। তিনি একা মানুষ, অকৃতদার, সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়ার মতন কেউ নেই তাঁর। স্নেহ-ভালোবাসা বর্জিত এই জীবনে শেষমেষ মৃত্যুবরণ কতটা দুঃখের, তা ভাবা যায় না!

 

মঁসিয়ে স্যাভেল তাঁর এই নিস্ফলা রিক্ত অস্তিত্বের কথা ভাবছিলেন বসে বসে। ভাবতে ভাবতে তিনি একসময় চলে গেলেন তাঁর সুদূর অতীত জীবনে, তাঁর ছোটবেলায়, যখন বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিলেন। ভাবনায় চলে আসছিল তাঁর স্কুলজীবন, ছুটির দিনগুলোর কথা, তারপর যখন আইন পড়ছিলেন প্যারিসে। তারপর বাবার অসুস্থতা, মৃত্যু। তিনি ফিরে এলেন বাড়িতে। মায়ের সঙ্গে কাটতে লাগল তাঁর শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন। একজন যুবক, অন্যজন বৃদ্ধা, আর কোনো চাহিদা নেই তাঁদের জীবনে। সেই মা-ও চলে গেলেন একদিন। কত দুঃখময় হতে পারে একটা জীবন!

 

তিনি একাই থেকে গেলেন। এখন তার মৃত্যুবরণ করার পালা। তিনি চলে যাবেন একদিন। সব শেষ হয়ে যাবে তখন। মঁসিয়ে পল স্যাভেল বলে পৃথিবীতে আর কেউ থাকবে না। কী সাংঘাতিক! অন্য সবাই তখন সুখের জীবন কাটাবে, পরস্পরকে ভালোবাসবে। তারা উপভোগ করবে এক সুন্দর জীবন! কিরকম অদ্ভুত মনে হয় এই জীবন, যখন একদিকে মানুষ মজা করে, আনন্দ করে, উপভোগ করে সবকিছু, আবার একদিন অনিবার্য মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয় তাকে। যদি মৃত্যু একটা সম্ভাবনা মাত্র থাকত, তবে মানুষ একটা সুন্দর আশায় বুক বাঁধতে পারত। কিন্তু তা তো নয়, মৃত্যু তো অনিবার্য, যেমনভাবে দিনের পর রাত আসে।

 

ব্যাপারটা এত সাংঘাতিক হত না যদি তিনি একটা পরিপূর্ণ জীবন কাটাতে পারতেন। অর্থাৎ যদি তাঁর জীবন সুখের হত, সাফল্যে ভরা থাকত, কিংবা কোনো দুঃসাহসিক কাজ তিনি করতেন, কিংবা ওইরকম কিছু। কিন্তু সেসব কিছুই তিনি করেননি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা, সারাদিন সময় ধরে খাওয়াদাওয়া করা, তারপর আবার রাতে ঘুমোতে যাওয়া – এছাড়া তিনি কিছুই করেননি। আর, সেই নিয়ম মেনেই তিনি এই বাষট্টি বছরে এসে পৌঁছেছেন। তিনি বিয়ে পর্যন্ত করেননি, যা অন্য সবাই করে থাকেন। কিন্তু কেন? কেন তিনি বিয়ে করেননি? তিনি করতেই পারতেন বিয়ে কারণ, তিনি যথেষ্ট সম্পদশালী ছিলেন। সুযোগ কি তেমন আসেনি জীবনে কিংবা কম এসেছিল? সম্ভবত তাই হবে। তবে সেই সুযোগ তৈরি করতে হত। আসলে, তাঁর দিক থেকে অনীহা ছিল। সেটাই আসল কারণ। একরকম নিস্পৃহভাব ছিল তাঁর প্রধান দুর্বলতা, তাঁর ব্যর্থতা, তাঁর ত্রুটি। এই উদাসীনতার কারণে জীবন নষ্ট হয়ে যায়। কারুর কারুর মানসিক গঠন এমন হয় যে এই নিস্পৃহতার কারণে বিছানা থেকে ওঠা, লোকের সঙ্গে কথা বলা, যে-কোনো বিষয়ে তৎপর হওয়া বা কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা ভীষণ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

 

তিনি ভালোবাসা পাননি কোনোদিন। অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে কোনো মহিলা তাঁর অঙ্কশায়িত হননি কখনও। কোনো নারীর জন্য নিদারুণ উদ্বেগ নিয়ে এক মধুর প্রতীক্ষা, এক দৃপ্ত আবেগজনিত উচ্ছ্বাস অথবা এক নিবিড় আশ্লেষ থেকে যে স্বর্গীয় কম্পনের অনুভূতি জন্মায়, এসব সম্পর্কে কোনো ধারণাই কখনো হয়নি তাঁর। দুজোড়া ওষ্ঠ যখন পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয় প্রথমবার, যখন প্রেমাসক্ত দুটি প্রাণীর চার হাতের মধুর আলিঙ্গনে একটি সুন্দর শিশু জন্মলাভ করে তখন কিরকম যেন এক অপার্থিব সুখ হৃদয় ভরিয়ে তোলে! মঁসিয়ে স্যাভেল তাঁর পাদুটি তুলে একটা কাঠের পাটাতনে ভর দিয়ে ড্রেসিংগাউনসহ বসে পড়লেন। নিঃসন্দেহে তাঁর জীবন এক চরম ব্যর্থতায় ভরা। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যর্থতা। বড় বেদনায় এবং নিস্পৃহভাবে তিনি গোপনে ভালোবেসেছিলেন একজন মহিলাকে, যেমন তাঁর স্বভাব ছিল অন্য আর সবকিছুর ক্ষেত্রে। হ্যাঁ, তিনি ভালোবেসেছিলেন ম্যাডাম স্যান্ড্রেজকে, যিনি কিনা তার এক পুরোনো বন্ধু স্যন্ড্রেজের স্ত্রী ছিলেন। আহা! একমাত্র তাঁকেই একজন নারী হিসেবে ভাবতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেক দেরিতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, যখন তিনি বিবাহিত। যদি সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আগে দেখা হত, তাহলে নিঃসন্দেহে তাঁকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতেন। কিন্তু বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁকে বরাবর ভালোবেসে গিয়েছিলেন সাক্ষাতের সেই প্রথম দিন থেকেই। মনে পড়ছে, কী ভীষণ একটা ভালোলাগা ছিল, প্রত্যেকবার যখনই সেই ভদ্রমহিলাকে তিনি দেখতেন। আর, কী ভয়ঙ্কর খারাপ লাগত, যখন তাঁকে ছেড়ে আসতে হত। মনে পড়ে, সেই রাতগুলো কেটে যেত শুধু তাঁর কথা ভাবতে ভাবতেই। তিনি ঘুমোতে পারতেন না একদম। অথচ সকালে যখন ঘুম ভাঙত, সেই ভদ্রমহিলার প্রতি সেই টান অনুভব করতেন না, যতটা আগের রাতে মনে হত। কেন এমন হত?

           

বয়সকালে কী সুন্দরই না দেখতে ছিলেন সেই মহিলা! ফরসা কোঁকড়ানো চুল, সদাহাস্যমুখর। স্যান্ড্রেজ মোটেও তাঁর উপযুক্ত ছিল না। এখন তাঁর বয়স আটান্ন। মনে হয় ভালোই আছেন। ইস, তখন যদি সেই মহিলা শুধু তাঁকেই ভালোবাসতেন, শুধু তাঁকেই! কিন্তু ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ কেন ভালবাসতে পারেননি স্যাভেলকে, কেন নয়, তাঁর নিজের দিক থেকে তো ভালোবাসার ঘাটতি ছিল না? তিনি কি বুঝতে পারেননি স্যাভেলকে? কিছু দেখেননি? কিছুই অনুমান করতে পারেননি? আর, যদি বুঝতে পারতেন স্যাভেলের মনোভাব, তাহলে কী ভাবতেন তিনি? এরকম হাজার প্রশ্ন স্যাভেল করে চলছিলেন নিজেকে। আর, পর্যালোচনা করছিলেন নিজের গোটা জীবনকে, অতীত জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছু মনে করার চেষ্টা করছিলেন। মনে পড়ে গেল, সেই দীর্ঘ সন্ধেবেলাগুলোর কথা, যখন তিনি তাঁর বন্ধু স্যান্ড্রেজের বাড়িতে তাস খেলতেন। বন্ধুর স্ত্রী তখন যুবতী, লাবণ্যময়ী। মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁকে বলা বন্ধুর স্ত্রীর কথাগুলো, তাঁর সুরেলা কণ্ঠস্বর, নীরব মৃদু হাসি, যা-কিনা গভীর অর্থ বহন করত। তারপর সাইন নদীর তীর ধরে তিনজনের একসঙ্গে হাঁটা, প্রত্যেক রবিবার পিকনিক, কারণ, সারা সপ্তাহ জুড়ে স্যান্ড্রেজ খুব ব্যস্ত থাকত তার কাজে, উপনগরপালের কার্যালয়ে। আবার, দারুণভাবে মনে পড়ে গেল, নদীর ধারে ছোট্ট বনভূমির মধ্যে ম্যাডাম স্যান্ড্রেজের সঙ্গে কাটানো সেই বিকেলটার কথা। সঙ্গে খাবারদাবার নিয়ে সকালে রওনা দিয়েছিলেন তাঁরা তিনজন। এক উজ্জ্বল বসন্তের দিন ছিল সেটা। এরকম একটা দিনে সবকিছু ভালো লাগে, নিজেকে খুব হালকা লাগে, মনে হয় সবাই ভালো আছে, পাখিরা যেন আরও আনন্দে গান গায়, আরও ক্ষিপ্র গতিতে তারা ছোটাছুটি করে। মনে পড়ে, উইলো গাছের তলায় তাঁরা ঘাসের ওপর বসলেন, সামনেই রৌদ্রস্নাত নদীর জল বয়ে চলেছিল অলসভাবে। সুরভিত বাতাস বহমান তার পূর্ণ প্রাণশক্তি নিয়ে। আশ মিটিয়ে তাঁরা গ্রহণ করলেন সেই নির্যাস। কত মধুর ছিল সেই দিনটা!

           

দুপুরে খাওয়ার পর স্যান্ড্রেজ হাত-পা ছড়িয়ে একেবারে শুয়ে পড়ল ঘাসের ওপর। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। পরে যখন উঠল, বলল, এত ভালো সে কোনোদিন ঘুমোয়নি। সেই অবকাশে ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ এবং স্যাভেল পরস্পরের হাত ধরাধরি করে নদীর তীর ধরে হাঁটতে লাগলেন। একসময় ম্যাডাম আবেশে আনত হলেন স্যাভেলের হাতের ওপর, তারপর হেসে বললেন, আমি পুরোপুরি নেশাগ্রস্ত, প্রিয় আমার। স্যাভেল তাকালেন মহিলার দিকে। তাঁর হৃদয় কম্পিত হচ্ছিল ভীষণভাবে। নিজেকে কিরকম যেন বিবর্ণ এবং অসহায় বোধ করলেন স্যাভেল। তাঁর হাত কাঁপছিল। অনুভব করছিলেন, নিজের চোখের ভাষাও যেন ক্রমশ নির্লজ্জ হয়ে আসছে। স্যাভেল ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন। মনে হল, এই বুঝি তাঁর ভেতরের সমস্ত গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাবে। ম্যাডাম স্যান্ড্রেজকে তখন পত্রশোভিত জলপদ্ম দিয়ে তৈরি একটা মুকুটের মত দেখতে লাগছিল। বলে উঠলেন ম্যাডাম, “‘আপনি কি আমাকে এভাবে দেখতেই ভালোবাসেন?”

 

স্যাভেল কোন উত্তর দিলেন না। কারণ, তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না, কী বলবেন! তাঁর এই অবস্থা দেখে ভীষণ একটা বিরক্তি নিয়ে ভয়ঙ্করভাবে হেসে উঠে ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ বলে উঠলেন, “আরে বোকারাম, কিছু তো অন্তত বলুন!”

স্যাভেলের তখন প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। কিন্তু একটা শব্দও তাঁর মুখ থেকে বেরোলো না।

 

আজ সবকিছুই মনে পড়ছে একেবারে জীবন্তভাবে, ঠিক যেমনটা ঘটেছিল সেদিন। স্যাভেল ভেবে পাচ্ছেন না, কেন ভদ্রমহিলা তাঁকে বলেছিলেন, “আরে বোকারাম, কিছু তো অন্তত বলুন!”

 

মনে পড়ছে, কত নরম এবং সুন্দরভাবে ম্যাডাম নিজেকে ধরা দিয়েছিলেন তাঁর হাতের ওপর। বাঁকানো গাছটার তলা দিয়ে যাওয়ার সময় আচমকা স্যাভেলের গাল তাঁর কান স্পর্শ করেছিল। স্যাভেল প্রায় তড়িতাহত হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন সেই মুহূর্তে, মনে ভয় ছিল ম্যাডাম যদি ভাবেন ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছিল। তারপর স্যাভেল যখন বলে উঠলেন, “এবার কি আমাদের ফেরার সময় হয়নি?” ম্যাডাম তখন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন স্যাভেলের দিকে। অদ্ভুতই তো!  সেদিন মনে হয়নি তেমন, কিন্তু আজ যেন সবকিছু পরিষ্কার বুঝতে পারছেন।

ম্যাডাম বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, আপনার যেমন ইচ্ছে। আপনি যদি খুব ক্লান্ত বোধ করেন, তাহলে ফেরা যেতে পারে।“

স্যাভেল বলেছিলেন, “না, না, আমি ক্লান্ত নই। আসলে স্যান্ড্রেজ যদি জেগে ওঠে, তাই …”

কেমন একটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ম্যাডাম উত্তরে বলেছিলেন, “যদি আপনার ভয় হয়ে থাকে আমার স্বামী ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারেন, তাহলে আলাদা কথা। চলুন, ফেরা যাক।“

 

ফেরার পথে ম্যাডাম চুপচাপ ছিলেন একদম এবং শারীরিক স্পর্শ বাঁচিয়ে হেঁটে চলছিলেন আগাগোড়া। কিন্তু কেন? এই প্রশ্ন তাঁর আগে কখনও জাগেনি মনে। কিন্তু এখন তাঁর মনে হচ্ছে, কিছু একটার আভাস পাচ্ছেন যেন, যেটা আগে কোনোদিন মনে হয়নি তাঁর। তেমন কিছুর সম্ভাবনা ছিল কি?

 

মঁসিয়ে স্যাভেল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিরিশ বছর আগের অবস্থায় যেন ফিরে গেলেন তিনি। যেন শুনতে পেলেন, ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ তাঁকে বলছেন, “আমি ভালোবাসি আপনাকে।“

 

তার মানে? যে-সন্দেহ বা অনুমান তাঁর মনে দানা বাঁধল এইমাত্র, সেদিন সেটা ছিল নেহাতই অত্যাচার! এরকম যে হতে পারত, তাঁর ধারণাতেই আসেনি সেদিন! আর, সেটা সত্যি হওয়ার মানে, তিনি সুখের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছিলেন, অথচ তিনি তার নাগাল পাননি!

           

নিজের মনে বলতে লাগলেন স্যাভেল, আমাকে খুঁজে বার করতেই হবে, সংশয়ের মধ্যে আমি আর থাকতে পারব না, আমাকে খুঁজে বার করতেই হবে!

           

দ্রুত পোশাক পালটে নিলেন তিনি। আর, নিজের মনে বলতে থাকলেন, আমার এখন বাষট্টি, ওঁর আটান্ন, সুতরাং আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করতেই পারি এখন।

স্যাভেল বেরিয়ে গেলেন।

 

ম্যাডাম স্যান্ড্রেজের বাড়ি রাস্তার অপর প্রান্তে, একেবারে তাঁর বাড়ির উলটোদিকে। তিনি দ্রুত হাজির হলেন তাঁর বাড়িতে। কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। এত সকালে স্যাভেলকে দেখে মেয়েটি বেশ অবাক হয়ে গেল। সে বলে উঠল, “ওহ্ আচ্ছা, মঁসিয়ে স্যাভেল! কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে কি?”

স্যাভেল বলে উঠলেন, “না, না, তুমি যাও, তোমার গিন্নিমাকে খবর দাও, আমি তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।“

“ও আচ্ছা! কিন্তু ম্যাডাম এখন শীতকালের জন্য ন্যাসপাতির জ্যাম তৈরি করছেন। তিনি ব্যস্ত স্টোভের সামনে, ঠিকঠাক পোশাকে নেই।“

“ঠিক আছে। কিন্তু তাঁকে গিয়ে তুমি বল, খুব জরুরি একটা ব্যাপারে আমি এসেছি তাঁর কাছে।“

 

মেয়েটি চলে গেল বাড়ির ভেতরে। আর, স্যাভেল ড্রয়িংরুমের মধ্যেই বেশ একটু নার্ভাস হয়ে ঘরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পায়চারি করতে লাগলেন। তবে ঘাবড়ে যাননি একেবারেই। কোনো খাবারদাবার তৈরি  করার পদ্ধতি বিষয়ে জানতে গেলে যেমন প্রশ্ন করতে হয় তেমন সহজ এবং স্বাভাবিকভাবেই আজকের প্রশ্নটা রাখবেন তিনি। তাছাড়া, তাঁর বয়স এখন বাষট্টি, সুতরাং …

           

দরজা খুলে গেল। ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ আবির্ভূত হলেন। তিনি এখন বেশ মোটাসোটা এবং গোলাকার আকৃতির হয়ে গেছেন। একেবারে ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা। বেশ জোরে হেসে উঠলেন স্যাভেলকে দেখে। দুটো হাত জড়ো করে ধরা আছে, জামার আস্তিন গোটানো, হাতে আঠালো জুসের রস। বেশ উদগ্রীব হয়ে বলে উঠলেন স্যাভেলকে, “কী ব্যাপার? আপনি ঠিক আছেন তো?”

স্যাভেল বললেন, “না, না, ঠিক আছি। তবে কিছু জরুরি বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই, যা আমাকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে। আপনি খুব খোলামেলা উত্তর দেবেন বলুন?”

ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ স্মিত হেসে বললেন, “আমি সবসময় খোলামেলা কথাবার্তা বলি। বলুন আপনি।“

স্যাভেল বলে উঠলেন, “আসলে, কথাটা হচ্ছে, আমি আপনাকে ভালবেসেছি সেই প্রথম দিন থেকে যখন আপনাকে দেখলাম। আপনি কি বুঝতে পেরেছিলেন?”

 

ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর তাঁর সেই পুরনো পরিচিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “আরে বোকারাম! আমি সেটা প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম।“

স্যাভেল কাঁপতে শুরু করলেন, তারপর আমতা আমতা করে বলে উঠলেন, “আপনি জানতেন? কিন্তু তাহলে …’

আর কিছু বলতে পারলেন না স্যাভেল। একেবারে চুপ মেরে গেলেন। স্যান্ড্রেজ বলে উঠলেন, “তাহলে কী?”

স্যাভেল বলে উঠলেন, “তাহলে … তাহলে কী ভেবেছিলেন? … কী … কী বলুন?”

এবার খুব জোরে হেসে উঠলেন ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ। জুসের রস তখন ফোঁটা ফোঁটা আকারে তাঁর আঙুল থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে।

“কী বলব আমি? আপনি তো কিছু জিজ্ঞেস করেননি আমাকে! আমার তো বলার কথা ছিল না!”

           

মঁসিয়ে স্যাভেল এক ধাপ এগিয়ে গেলেন ম্যাডামের সামনে। তারপর বললেন, “বলুন, প্লিজ বলুন। আপনার কি মনে পড়ে সেই দিনটার কথা যখন মঁসিয়ে স্যান্ড্রেজ দুপুরের খাওয়ার পর ঘুমোতে গেলেন, আর, আমরা একসঙ্গে নদীর ওই বাঁকটার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম …”

           

এই পর্যন্ত বলে স্যাভেল থামলেন, অপেক্ষা করতে থাকলেন। ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ তখন হাসি থামিয়ে একেবারে সোজাসুজি স্যাভেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “আমার সব মনে আছে।“

সামান্য কেঁপে উঠে স্যাভেল বলে উঠলেন, “তাহলে … সেদিন … আমি যদি … আমি যদি উদ্যোগী হয়ে কিছু বলতাম … কী বলতেন আপনি?”

 

ম্যাডাম স্যান্ড্রেজ তখন হাসতে শুরু করলেন একজন সুখী নারীর মতন, যার মধ্যে বিন্দুমাত্র কোন অনুতাপ নেই, তারপর উত্তর দিলেন খোলাখুলিভাবে কিন্তু কণ্ঠস্বরে কিঞ্চিৎ শ্লেষ মিশিয়ে, “আমি তাহলে সঁপে দিতাম নিজেকে, প্রিয় আমার!”

 

কথাটা বলেই তিনি স্যাভেলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন এবং ত্বরিতগতিতে ফিরে গেলেন অন্দরের দিকে।

           

মঁসিয়ে স্যাভেল ছিটকে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে, যেন সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তাঁর। তিনি সোজা হেঁটে চললেন সেই নদীর দিকে, বৃষ্টির মধ্য দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে, কোথায় চলেছেন কোনো কিছু চিন্তা না করেই। যখন নদীর কাছে পৌঁছলেন, তিনি ডানদিকে ঘুরলেন, তারপর তীর ধরে হেঁটে চললেন। অনেকটা সময় ধরে তিনি হাঁটলেন, যেন কিছু একটা তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর জামাকাপড় সব ভিজে গিয়েছিল এবং তাঁর টুপিও একটা ভিজে কম্বলের মতন শিথিল, বেঢপ আকার নিয়েছিল, যেটার থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছিল। তিনি ক্রমাগত হাঁটতে থাকলেন সোজা। অবশেষে এসে পৌঁছলেন সেই জায়গায় যেখানে ম্যাডাম স্যান্ড্রেজের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন সেই দিনটাতে। ভয়ানক কষ্ট পেলেন স্যাভেল সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে। তিনি ধপ করে বসে পড়লেন মাটিতে একটা ন্যাড়া গাছের তলায় এবং নীরবে অশ্রুপাত করতে থাকলেন।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত