ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৩৬)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
বেড়া গলে বাংলাদেশ যাওয়া হয়নি আজো।‘সুজলা সুফলা’ সেই বাংলাদেশের জন্য মনে মনে কতদিনের জমা থরথর প্রতীক্ষা নিয়ে বসে আছি।পাসপোর্ট করে,বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে, কবে সেখানে আমার পা পড়বে, জানিনা।হয়ত সবটাই অলীক কুয়াশা হয়ে থেকে যাবে আর আমার অবস্থা হবে ‘আশায় মরে চাষা’র মত।
তবে একটা বেড়া ডিঙোনোর গল্প মনে পড়ল।সেটা বলেই ফেলা যাক। ছোটবেলায় স্কুল থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি আমাদের। হোক না সে চিড়িয়াখানা,জাদুঘর বা বেলুড়মঠ।বাড়ির অভিভাবকরা সে বেড়ানোয় সম্মতি দেননি কোনদিন।আমরাও তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম।এম এ পড়ার সময় হঠাৎ করেই সে নিয়ম ভাঙল।বর্ধমান ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের দিল্লী, আগ্রা যাবার পরিকল্পনায় সামিল হতে পারলাম।তখন হস্টেলে থাকি। এমনিতেই অনেকটা স্বাধীনতা পাওয়া গিয়েছে।ভাবিনি বেড়ানোয় বাড়ির অনুমতি পাওয়া যাবে।বাবা হ্যাঁ বলার পর আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাওয়ার মত মনের অবস্থা।বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাওয়া, সেখানে আবার বাড়ির অভিভাবকরা অনুপস্থিত। সেকি ভাবা যায়?
যাইহোক যাওয়ার জন্য উৎকন্ঠিত হৃদয়, শুভদিন আর আসেনা। অবশেষে দুজন স্যারের অভিভাবকত্বে আমরা রওয়ানা দিলাম। তাঁদের মধ্যে একজন আবার সপরিবারে সঙ্গে চললেন।তাঁর স্ত্রী ,ছেলে এবং আর একজন আমাদের থেকে বয়সে সামান্য বড় স্যার ছাড়া ,আমরা সবাই সতীর্থ।গরম কাল, মে কি জুন মাস হবে,ট্রেনের থ্রি টায়ারের কামরা।কুছ পরোয়া নেই।এ যেন সেই, ‘চল রে চল সবে স্নাতক সন্তান,অর্থনীতি বিভাগ করে আহ্বান।’
আনন্দের উৎস একটাই, ক্লাসের বন্ধুরা সবাই একসঙ্গে চলেছি । দু’একজন বাদে প্রায় প্রত্যেকেই উপস্থিতি দিয়েছে স্টেশনে, স্যারের হাজিরা খাতায়। সাতজন মেয়ে আর প্রায় কুড়ি জন ছেলে ছাড়াও চলেছেন স্যার,বউদি, ওনাদের ছেলে আর একজন কমবয়সী স্যার ।এক বিরাট দলের ভ্রমণ। উৎসাহে টগবগ করে ফুটছি আমরা। সুবিধের কথা এই যে দুজন স্যারই আমাদের ভীষণ প্রিয়,আমরাও তাঁদের সঙ্গে খুব সহজ ভাবে কথা বলতে পারি।
আরো পড়ুন: খোলা দরজা (পর্ব-৩৫)। সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ট্রেনে প্রচন্ড গরমের মুখোমুখি হতে হল।দুপুরের গরম হাওয়া থেকে বাঁচতে অনেকেই কামরার জানলায় ভিজে গামছা আটকেছে।স্টেশন এলেই ‘ওয়াটার বটলে’ জল ভরে আনা হচ্ছে।তখন এখনকার মত ঠান্ডা জল পাওয়া যেতনা,বা এই জলের বোতলের ব্যবস্থা চালু হয়নি।দিল্লী আর আগ্রাতে তাই আমাদের হোটেলের ঘরে মাটির কুঁজোতে খাবার জল দেওয়া হয়েছিল।মনে আছে ট্রেনে সারাক্ষণ শসার মত দেখতে লম্বা লম্বা কাঁকুড় খেয়ে জলের তেষ্টা মেটানো হয়েছিল।খাওয়া ,ঘুম, শোওয়ার দিকে কারো মন ছিলনা।সবাই মিলে গান,কবিতা আবৃত্তি,গল্প, করতে করতে আমরা প্রথমে গেলাম আগ্রায়।পুরনো একটি হোটেলে সকলে ওঠা হল।মেয়েদের আলাদা ঘর,আলাদা বাথরুম, বিশেষ যত্নের ব্যবস্থা।মনে আছে আমাদের দলের ছেলেরা হই হই করে স্যারের কাছে ওই বৈষম্যের প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
দুজন মাষ্টারমশাই সস্নেহে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করেছিলেন।বাড়ি থেকে অতদূরে ,অচেনা পরিবেশে, হিন্দী বা ইংরাজী ভাষায় কথা বলতে না পেরেও ‘সব পেয়েছির’ দেশে অনায়াসে পা রেখেছিলাম আমরা।সারাদিন টাঙ্গায় চেপে আগ্রার বিখ্যাত সব সৌধ দেখার পর আমরা বিকেল বিকেল পৌঁছেছিলাম তাজমহলে।ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে তাজমহলের মাথার ওপর কালো ঘোমটা টেনে দিয়েছিল।তখনই ঘটেছিল সেই অঘটন।সব অন্ধকার ধুয়ে না দিয়েও মৃদু আলোর জোছনা ছড়িয়ে চাঁদ উঠেছিল তাজমহলের মাথায়।মনে হয়েছিল সাদা মর্মর সৌধটিকে ময়দানব স্বর্গ থেকে কোলে করে এনে পৃথিবীর মাটিতে বসিয়ে দিয়েছেন।যমুনা নদীর তীরে সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের আচমকা মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা।মনে আছে দীর্ঘক্ষণ পেছনের চাতালে শুয়ে আমি একা, আকাশ, চাঁদ আর তাজমহলকে দুচোখ ভরে দেখেছিলাম।খুব বড় কোন কিছুর কাছে গেলে যেমন হয়, সেরকম পাগল পাগল লাগছিল।
পরে দলে ফেরার পর স্যারের বকুনি আর বন্ধুদের ভর্ৎসনায় নিজের অপরাধ সম্বন্ধে সচেতন হলেও মনে হয়েছিল , ঠিক আছে।একটা আস্ত তাজমহল চাঁদের আলোয় দেখার জন্য এটুকু স্বীকার করাই যায়।আসলে তারা তো ভুল কিছু বলেননি।অনেকক্ষণ ধরেই আমাকে খোঁজা হয়েছিল। ওই রকম পরিবেশে একজন একুশ বাইশ বছরের মেয়ের ওইধরনের বিপজ্জনক পাগলামী যেকোন বিপদ ডেকে আনতেই পারত।

ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।