ভ্রমণ গদ্য: মুর্শিদাবাদ-শান্তিনিকেতন-দার্জিলিং : মিলন দা’র সাথে ভারতযাত্রা । জিললুর রহমান
সেটা ২০০৪ সাল, কুমিল্লা চট্টগ্রাম নিত্য ভ্রমণে চাকরি জীবনে শরীর মন ভেঙে পড়েছে। একদিন সন্ধ্যায়, সম্ভবত নভেম্বর মাসে, বাংলা নাটকের অগ্রসেনা মিলন চৌধুরী আমার সাথে ভারত ভ্রমণ করতে চাইলেন। আমি ভাবলাম, এ তো বেশ দারুণ প্রস্তাব! মিলন দা’র সাথে বেড়াবো! একসাথে দুজনের দীর্ঘ একান্ত সময় কাটানো যাবে। ১৫ দিনের ছুটির অনুমতি নিয়ে মিলন দা আর আমি বেরিয়ে পড়ি বাস যোগে। সেকালে বায়ুপথে ভারতযাত্রার কথা মাথায়ও ছিল না, সামর্থ্যও ছিল কম। নানাকাণ্ডে বাসে চড়ে সীমান্তের ঝক্কি সামলে আমরা ওপার থেকে সুমো জিপগাড়ি চড়ে কলকাতা পৌঁছে যাই। কলকাতার প্রাণকেন্দ্রেই মিলন দা’র বোন শিলুদির বাড়িতে আমরা উঠি। দিদি এবং কুমারেশ দা’র আন্তরিক অভ্যর্থনা আমাকে আপ্লুত করে। দিদির ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজ পড়ুয়া। তারাও আমাকে মামার বন্ধু হিসেবে মামা বলেই সম্বোধন করে। ভীষণ ক্ষুধার্ত মুখে দিদির রান্না মধ্যহ্নের খাবার যেন অমৃত। আমাকে একটা রুমে একা থাকতে দেওয়া হলো। মিলন দা আলাদা রুমে। আমরা কিছুক্ষণ আলাপ আড্ডা সেরে তারপর বিশ্রাম করলাম। তবে, সহসাই বেরিয়ে পড়ি নাটক দেখার জন্য। শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে নাটক দেখলাম “চারকন্যা”। চার নারীর মধ্যে একধরনের শারীরিক মানসিক জটিলতার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে এমন নাটক সে যুগে আমার কাছে বেশ বিপ্লবাত্মক মনে হয়েছিল। নাটক দেখার সময় সঙ্গী ছিলেন কবি জয়দেব চক্রবর্তী। আমি তাঁকে আমার গদ্যের বই “উত্তর আধুনিকতা : এ সবুজ করুণ ডাঙায়” উপহার দিয়েছিলাম। নাটক দেখা শেষে, রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনের পাশে অনেক রাত পর্যন্ত নাটক সংক্রান্ত আলাপ আড্ডার মেতে ছিলাম। রাতে বাড়ি ফিরলে আয়েশ করে ভূরিভোজ হলো। শিলুদি’র রান্নার হাত দারুণ। হাঁটাহাঁটি করে ক্ষুধার্ত অবস্থায় এসেছি; যাকে বলে, কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া তেমন করেই খেলাম একেবারে গলা পর্যন্ত।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই ব্রাশ সেরে নিলাম। আর সাথে সাথে চা এসে গেল খাবার টেবিলে। বিছানা-চা বদলে প্রভাতী-চা হয়ে গেল। কুমারেশ দা গম্ভীর রাশভারী ভদ্রলোক। সোফায় বসে ভোরের দৈনিক কাগজ পড়ছেন গভীর মনোযোগের সাথে। আমাদের সাথেও মাঝেমধ্যে খবরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টুকটাক আলাপ হচ্ছে। এক ফাঁকে সবাই একে একে “স্নান সমাপন করিয়া যখন” ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে উঁকি দিলাম দেখি শিলুদি চারটা টিফিন ক্যারিয়ার রেডি করে সাজিয়ে রেখেছেন। একটু পরেই প্রত্যেকে তারা বেরিয়ে পড়বেন অফিস বা স্কুল কলেজের উদ্দেশ্যে। একটু পরে সকলে টেবিলে ডাকা হলো। আমরা বসতেই একের পর এক লুচি এসে হামলে পড়তে লাগলো আমাদের প্রত্যেকের প্লেটে;সাথে আলুর দম। আমরা দম না ফেলে বুভুক্ষা মিটিয়ে নিলাম। তারপর মিলন দার সাথে বেরিয়ে গেলাম এক সময়ের ডাকসাইটে নকশাল কর্মী নিবেদিত প্রাণ গল্পকার ‘মৌলিক স্বপ্নের উদ্যান’ ও ‘নিরুদ্দেশ’ গল্পগ্রন্থের প্রণেতা অসীম চক্রবর্তীর বাড়ি। দাদাকে উপহার দিলাম ‘অন্য মন্ত্র’। পরে মিলন দা’র কাছে জেনেছিলাম, তিনি বইটির খুব প্রশংসা করেছিলেন এবং আরও একজন লেখককে বইটি পড়তে দিয়েছিলেন। ওখান থেকে বেরিয়ে কলকাতার এদিক সেদিক ভ্রমণ করতে করতে দেখে নিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। তারপর সেখান থেকে কলেজস্ট্রিট যাবার জন্য একটা অ্যাম্বাসাডর টেক্সিক্যাবে উঠলাম। কিন্তু সে আমাদের নিয়ে গেল উল্টোপথে। মিলনদার সন্দেহ হতে একটি লোকালয় পার হওয়ার সময় গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন এবং তাকে উল্টোপথে নিচ্ছে কেন প্রশ্ন করলে সে তর্ক শুরু করে। এসময় আশপাশ থেকে যুবকেরা এসে আমাদের উদ্ধার করে টেক্সিঅলাকে ভাগিয়ে দিল। আমরা আরেকটা গাড়ি নিয়ে কলেজ স্ট্রিট গেলাম। কয়েকটা বইদোকান ঘুরে একসময় কফিহাউসে পৌঁছে এক কাপ করে কফি পান করি। আমরা ভাল করেই জানি, “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই”। তবু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি, কোথাওকি কবিতার সাহিত্যের আড্ডা চলছে?
রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমরা ঠিক করলাম পরদিন মুর্শিদাবাদ যাবো।
সেই মুর্শিদাবাদ , যেখানে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লা শাসন করেছেন, যেখানে ব্রিটিশদের কাছে বাংলা হাতছাড়া হয়েছিল ১৭৫৭ সালে। মুর্শিদাবাদ যেতে হলে প্রথমে বাসে চড়ে যেতে হয় বহরমপুর। আমরা সকালে রওনা দিলাম। লোকাল বাস, হেঁটে হেঁটে থেমে এবং থেমে থেমে চলে বাস এগিয়ে চলে কৃষ্ণনগরের ওপর দিয়ে। আমার চোখে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়ের গল্পদৃশ্য খেলা করে। আবার মাঝে মাঝে চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঝিমুনি ও ঘুম। কৃষ্ণনগরের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি, এমন সময় ঝিমুনির চোটে আমার চশমা বাসের বডিতে ধাক্কা খেল এবং ফ্রেমটা ভেঙে গেল। ভাঙা ফ্রেম হাতে ধরে চশমা চোখে ঠেকিয়ে বাসের জানালা দিয়ে চেয়ে থাকি অপসৃয়মান দৃশ্য। এভাবে বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাই বহরমপুর। বহরমপুর পৌঁছে এদিক ওদিক খুঁজে একটি হোটেলে রুম ভাড়া করে ব্যাগ রেখে বের হই চশমা সারাতে। একটা ফ্রেম পছন্দ করলাম। কারিগর আগের চশমার কাঁচ একটু ছেঁটেছুটে তাতে বসিয়ে দিল। এই কাজেই প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল। এর মধ্যে অবশ্য বসে ছিলেন না মিলন দা। তাঁর তৃষ্ণার্ত হৃদয় মহুয়ার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল এবং তা সংগ্রহও করে ফেললেন। অবশ্য, জগৎ এমনই, যে যা চায় সে তার সন্ধান পায়। যেহেতু সঙ্গী নটরাজ, তাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য শিল্পকলা একাডেমি। কোনো নাটক চললে তা দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু না, নাটক আজ নেই। কিছু তরুণ আমাদের সম্পর্কে উৎসুক হলে, তাদের জানালাম আমাদের আগমন সুদূর চট্টগ্রাম থেকে। দাদা নাটকের লোক। নাটকের দল বা নাটকের কারও সাথে আমরা আলাপে আগ্রহী। তারা আমাদের পাঠিয়ে দিল কাছাকাছি একটা জায়গায় বহরমপুরের প্রাচীনতম নাট্যদলের অফিসে, আজ আর নাম মনে নেই। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আমরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাই একটি ফাঁকা টিনশেডের বাংলোটাইপ ঘরের দিকে। একজন যুবক টিমটিমে টাঙস্টেন বাতির আলোয় তাস নিয়ে হাতসাফাই করছেন এক লম্বা টুলের ওপর বসে। আমাদের পরিচয় পেয়ে বসতে দিলেন। বললেন, শিগগির তাদের দলপতি এবং অন্যরা চলে আসবেন। ধীরে ধীরে জমে উঠল আড্ডা। প্রায় দেড়শতাধিক নাটকের রচয়িতা এবং পরিচালনার গল্প শুনতে বেশ ভালই লাগল। এই দলে বিভিন্ন বয়সের নাট্যকর্মীগণ, এমনকি পিতা এবং পুত্র একই সাথে অভিনয় করেন। পরে এক তরুণ তার মটর সাইকেলে করে আমাদেরকে হোটেলে নামিয়ে দিলে, তাকে রুমে ডেকে আমার বই অন্য মন্ত্র উপহার দিলাম। রাতে মহুয়ার ঘ্রাণ আমাদের ঘোরগ্রস্ত করেছিল। পরদিন সকালে আমরা রওনা দিলাম মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে।
সকাল থেকে সারাদিন নবাবদের কবর দেখে দেখে জেনে নিচ্ছিলাম তাদের মৃত্যুর করুণ ইতিহাস। এক নবাবের কবরের ওপর দিয়ে উঠে গিয়েছে সিঁড়িপথ। কথিত রয়েছে তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য ঐ নবাব শত শত মেয়েকে হত্যা করেছিল, মেয়েকে বাঁচানো যায়নি। অভিশপ্ত পিতা নিজেই তার শাস্তি নির্ধারণ করে যান, যাতে অনন্তকাল ধরে পৃথিবীর মানুষ তাকে পায়ে মাড়িয়ে যায়। এরকম কত না কাহিনী ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি পাথরের কোণায় কোণায়। আর সেসব কাহিনী ফেনিয়ে তুলছেন অর্ধশিক্ষিত কিছু গাইড। তাদের ঘিরে থাকা শাদা চামড়ার ট্যুরিস্টদের কেউ কেউ এমন কিছু ভাস্কর্য কর্ম দেখিয়ে অবলীলায় বলে যাচ্ছেন এগুলো মাইকেল এন্জেলোর কাজ। তিনি নবাবের অনুরোধে এদেশে এসে টানা ৬ মাস কি ১ বছর থেকে এসব সৃষ্টি করে গিয়েছেন। আমি মনে মনে চতুর্দশ শতক ও সপ্তদশ শতকের পার্থক্য হিসেব করে মিলন দা’কে প্রশ্ন করি কিভাবে সম্ভব। মিলন দা নিস্পৃহ নির্মোহ থেকে জবাব দিলেন কল্পনার দৌড় বেশি হলে সম্ভব হতেও পারে। আমরা এসবে গা না করে এগিয়ে যাই বিভিন্ন স্থাপনা, মসজিদ ও ভবনের দিকে। একসময় ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফিরে যাই বহরমপুর। রাত্রিযাপনের পর সকালে আবার কলকাতা ফিরে যাই।
একদিনের বিশ্রামের কালে কলকাতার আশেপাশের কিছু স্থান ঘুরে দেখি। তারপর যাত্রা শুরু শান্তি নিকেতনের পথে রেলে চেপে।
রেলগাড়ি বিকেল নাগাদ পৌছে গেলে স্টেশন থেকে একটা রিকশা যোগে শান্তিনিকেতন যাই। যেতে যেতে রিকশাচালকের সাথে আলাপ জমে ওঠে। রিকশাচালক একটি সরু মেঠোপথ ধরে আমাদের নিয়ে চললো। লক্ষ করি, মাটির রং একটু লালচে। আমাদের সারথি জানালো, এটাই সেই গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ। এই পথেরই পাশ দিয়ে একটু সরু খালের মতো নদী বহমান। সারথি জানায়, এটাই আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে। এসব স্বপ্নদৃশ্যের মতো মনে হতে লাগলো। পড়ার বই থেকে নদী এ রাস্তা যেন পৃথিবীপৃষ্ঠে নেমে এসেছে। রিকশাচালক আমাদের একটা ভাল গেস্ট হাউসে নিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় পাশের বাড়ির একজন চিত্রকরের সাথে দারুণ আড্ডা জমেছিল। আড্ডা মূলত মিলন দা এবং তিনিই দিয়েছিলেন, আমি ছিলাম নীরব শ্রোতা। আমি কি আর যামিনী রায় আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা রাখি?
সকালে প্রাতরাশ সেরে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অঙ্গন এবং ভাস্কর্য দেখতে দেখতে এক সময় মিলন দা নিয়ে গেলেন একটি ছোট্টবাড়িতে। বললেন, এসেছি যখন সোমনাথ দা’কে দেখে যাই। ভাস্কর সোমনাথ হোড় ভূভারতে সুপরিচিত ও সম্মানিত। আমরা লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে পৌঁছে যাই সোমনাথ হোড়ের বাড়ি। বন্ধ দরজায় করাঘাত করলে বয়স্ক এক নারী সম্ভবত সোমনাথ হোড়ের স্ত্রী দরজার আড়াল থেকে জানালেন তিনি অসুস্থ, তিনি কাউকে দেখা দিতে পারবেন না। মিলন দা, খুব বিনয়ের সাথে বললেন, আমরা চট্টগ্রাম থেকে এসেছি, একটু যদি ওনাকে বলতেন। একটু পরেই দুয়ার খুলে গেল। আমাদের বলা হলো, ওনাকে কথা বলাবেন না, যা বলার বলে ৫ মিনিট থেকে চলে যেতে হবে। আমরা তথাস্তু বলে ঢুকে পড়ি। একটি মশারি টাঙানো বিছানায় গুটিশুটি শুয়ে আছেন ছোটখাট আঙিকের বিশাল মানুষটি। আমাদের সাথে প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময় শেষে চট্টগ্রাম সম্পর্কে এটা সেটা জানতে চান এবং এক পর্যায়ে তিনি উঠে বসেন। আমাদের এ আন্তরিক সাক্ষাৎকারে সোমনাথ হোড়ের সাথে টানা কথা বলেছেন মিলন দা। শিল্প, ভাস্কর্য এবং ইতিহাসের নামা বাঁকে দুজনের আলাপ ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিল। আধ ঘন্টার মতো টানা আলাপ আড্ডার শেষ দিকে সোমনাথ দা’র কাশি শুরু হলে ভেতর থেকে আমাদের বলা হলো, এবার আসুন। আমরা প্রণতি জানিয়ে বিদায় নিলাম। আজ ভাবছি, ভাগ্যিস, সেদিন দেখা করেছিলাম। ২০০৬ সালে এই মহান ভাস্কর জীবনের ইতি টেনেছেন।
যাই হোক, ততক্ষণে মাথার ওপরে রোদ গনগনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আমরা ইতস্তত এদিক ওদিক বিচরণ করছিলাম। একটি বাড়ির দাওয়ায় বসে ছিলেন এক বৃদ্ধা মহিলা। দাদা, এক পথচারীকে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন তিনি অমিতা সেন, যাকে আশ্রমকন্যা বলা হয়। বিখ্যাত ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মা। আমরা তাঁকে নমষ্কার জানিয়ে দুয়েকটি বাক্য বিনিময় করে এগিয়ে চলি পরের গন্তব্যের দিকে। মিলন দা একে তাকে জিজ্ঞেস করে এগিয়ে গেলেন একটা সুন্দর গুছানো বাংলো টাইপ বাড়ির দিকে। ভেতর থেকে বিদেশী সুরের মৃদু মুর্চ্ছনা ভেসে আসছে। দাওয়ার বসে থাকা মধ্যবয়স্কা নারী আমাদের আসতে দেখে এলিয়ে পড়া আঁচল টেনে নিয়ে জানতে চাইলেন কাকে চাই এবং পরের প্রশ্নে কোথা থেকে এসেছেন। তিনি উঠে গিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বিশাল সাজানো ঘরে বসালেন। দুপাশের দেওয়াল জুড়ে সারিবদ্ধ রুচিশীল সোফা। দেওয়ালে পেইন্টিংয়ের পরিমিত অবস্থান বাড়ির মালিকের শৈল্পিক মনের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম, এর মধ্যে একজন কাঁচাপাকা শ্মশ্রুমণ্ডিত সুঠাম দেহের লোক পান্জাবি পরে আমাদের সামনে এসে বসলেন। আমাদের কুশলাদি জানতে চাইলেন। বাংলাদেশ, বিশেষত চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে আলাপ করলেন। মাঝে মাঝে মিউজিকের সাথে গুনগুন করছেন। ইনিই খ্যাতিমান ভাস্কর শর্বরী রায় চৌধুরী। আমাদের সৌজন্য বিনিময়ের এক পর্যায়ে বিস্কুট ও চা এলো। আমরা তা পান করছি। এক ধরনের আড়ষ্টতায় ভরে আছে ঘর। এমন সময় মিলন চৌধুরী হঠাৎ জানতে চাইলেন, এটা তো বাখ চলছে তাই না? চড়াৎ করে নড়েচড়ে বসলেন। একটু অবাক হওয়া কন্ঠে বললেন, ও এদিকেও ঝোঁকটোক আছে নাকি? ব্যাপারটা প্রথম থেকেই ছিল এমন যে মফস্বল থেকে এসেছে, অবাক বিস্ময়ে শিল্পী দেখতে এসেছে, এরা শিল্প সাহিত্যের এমন আর কিইবা জানবে। ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রে সঠিক হলেও মিলন দা’র ক্ষেত্রে ভয়ংকর ভুল। মিলন দা, খুব বিলোপের সাথে বললেন, তিনি এক আধটু ওয়েস্টার্ন মিউজিক শুনেছেন। এরপর মিলন দা খুব আস্তে আস্তে তাঁর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে একটু একটু করে বলতে শুরু করলেন বিটোভেন, মোৎসার্ট, বাখ সম্পর্কে। শর্বরী রায় চৌধুরী বেশ উৎসুক হয়ে উঠলেন আলাপে। এদিকে আমার চোখের সামনে দেওয়ালে টাঙানো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীর বিশাল পোর্ট্রটটি কার তা জানতে মিলন দা’কে দু’বার ইংগিত করলে তিনি আলাপ থেকে হঠাৎ বাঁক বদল করে, শর্বরী রায় চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করলেন, ছবিটা তো ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ’র, তাই না? এবার দারুণ চমকে উঠলেন শিল্পী। বিস্ময়ের সাথে মিলন দা’কে জিজ্ঞেস করলেন, ও, এদিকেও আগ্রহ আছে তাহলে!,মিলন দা, খুব ধীরে ধীরে ফৈয়জ খাঁ এবং তাঁর সংগীত ঘরানা নিয়ে কিছু কথা বললেন। শর্বরী রায় চৌধুরীও কিছু কথা যোগ করলেন। এভাবে আলাপ গড়াতে লাগলো উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতের অলিগলিতেও। এক পর্যায়ে লক্ষ করলাম, এবার সব কথা বলছেন মিলন দা। শর্বরী রায় চৌধুরী মনোযোগী ছাত্রের মতো শুনে চলেছেন। এর মধ্যে তিনি আমাদের বলে দিলেন, তাঁর বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ খেয়ে যেতে হবে। এই স্বারস্বত আড্ডা ছেড়ে আমাদেরও উঠতে ইচ্ছে করছিল না। দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে দিবারাশ গ্রহণ করলাম। তারপর শর্বরী রায় চৌধুরী আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর কাজের ঘরে। বিশাল ঘর জুড়ে নানারকম সমাপ্ত অর্ধসমাপ্ত অনেক ভাস্কর্যকর্মের ছড়াছড়ি। তিনি একেকটা কাজের কী সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে গেলেন। দীর্ঘসময় আমরা এই ঘরে কাটালাম। তিনি তাঁর ছেলের কাজের ঘরও দেখালেন। ছেলে মেটাল ব্যবহার করে তার ভাস্কর্য শিল্প তৈরি করেন। এই করে করে বিকেল গড়ি সন্ধ্যা হয়ে এলো। আরেক প্রস্থ চা পানের পর বিদায় নিলাম।
এবার মিলন দা বললেন, চলো চলো, কোলকাতা ফিরে যাই। অনেক ভাল ভাল নাটক অপেক্ষা করছে। আমি বললাম, দাদা, আমি তো দার্জিলিং যেতে চাই। দাদার তেমন আগ্রহ নেই। আমাকে বহুভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলেন, নাটকগুলো কেন দেখা দরকার। আমিও দার্জিলিং যাবার ব্যাপারে গোঁ ধরলাম। কোনদিন যা দেখিনি, তার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তো থাকবেই। আমি বললাম, দাদা, আমি আর কবে ছুটি পাব জানি না, তাই আমার এ সুযোগ ছাড়ার উপায় নেই। আপনি যদি না যেতে চান, তবে আপনি কোলকাতা ফিরে যান, আমি দার্জিলিং ঘুরে আসি। তখন মিলন দা বললেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল চলবে না, তিনিও আমার সাথে দার্জিলিং যাবেন।
খোঁজখবর নিয়ে দার্জিলিং যাবার ট্রেনে উঠে পড়ি। রাতের ট্রেনে ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও হাত পা এমনকি বুক পর্যন্ত হিম হয়ে আসছে। আমার অতিরিক্ত একটা সোয়েটার ছিল। সেটা বের করে সোয়েটারের হাতার ভেতরে পা দুটো ঢুকিয়ে দিলাম। তারপরও শীতে কাবু হচ্ছি। একপর্যায়ে মিলন দা এবং আমি আরেকটি চাদর শেয়ার করে জড়াজড়ি করে শীত কাটানোর চেষ্টা করতে করতে দিনের দিকে এগিয়ে গেলাম। যাই হোক, দার্জিলিং শহরে পৌঁছে আমরা হোটেল কৈলাস নামে একটি আবাসিক হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করলাম। মিলন দা বললেন, চলো একটু ঘুরে আসি। শহরের এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে ছোট্ট পাহাড়ি শহরটির মনোলোভা দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় ভয়ানক ঠাণ্ডায় বেশ কাহিল লাগছিল। আমরা হোটেলের কাছেই একটি পানশালার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভাগ্যিস শরীর গরম করে ঘোরের ঘেরাটোপে ঘরে ফিরেছিলাম। ঘুমিয়ে পড়ার পরে মাঝরাতে প্রচণ্ড শীতে ঘুম ভেঙে গেলে টের পাই, জানালার একটা কাঁচ ভাঙা। এটা শুধরানোর কোন উপায় তখন নেই। অগত্যা যত রকম জামাকাপড় গায়ে চড়ানো যায় তা দিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে করতে আমরা ভোরের দিকে এগিয়ে যাই। রাত সাড়ে তিনটায় গাড়িতে চড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর টাইগার হিলের কাছে যাই। তারপর কিছুদূর আঁধার হাতড়ে পাহাড় বেয়ে টাইগার হিলের চুড়ায় উঠে দেখি আমাদেরও আগে বেশ ক’জন এসে জায়গা দখল করেছে। আমরাও ফাঁকা সুবিধাজনক জায়গায় বসে সূর্যমামার ওঠার অপেক্ষা করি। আস্তে আস্তে চারপাশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে এবং দর্শকে প্রায় ভরে যায়। এমন সময় আমাদের তাকিয়ে থাকা দূর পর্বতের ফাঁকে বিস্তৃত মেঘসমুদ্রের ওপার থেকে টুপ করে এক সুবৃহৎ কমলালেবু ভেসে উঠে চারপাশে এক অদ্ভুত কমলা থেকে সোনালী আভা ছড়িয়ে দিল। চারপাশে অস্ফুট বিস্ময়সূচক মৃদু গুঞ্জরণের এক বন্দিশ ছড়িয়ে পড়লো। আর আমরা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল। কিন্তু কয়েকটু মুহূর্ত মাত্র। লোকজনের উসখুশ নড়াচড়ার শব্দে পেছনে তাকিয়ে দেখি দূরে বরফাচ্ছাদিত পর্বতশৃঙ্গগুলো সোনালী আগুনে পুড়ছে। সে বিহ্বল করা ক্ষণ। এই দৃশ্য প্রথমবার অবলোকনের অনুভূতিই আলাদা। এ অদ্ভুত ভাল লাগার আমেজ নিয়ে নেমে আসি ব্যাঘ্র-পর্বত থেকে। তারপর প্রত্যাবর্তনের পালা। কোলকাতা ফিরে শিলুদি ও কুমারেশদা’র কাছে জানতে পারলাম, আমাদের কোন সংবাদ না পেয়ে আমার বাবার বারবার উৎকন্ঠিত ফোন এসেছিল। তাড়াতাড়ি ফোন করি বাসার টিএন্ডটি নম্বরে। সেই প্রথম পিতার ক্রন্দন ধ্বনি আমাকে হত-বিহ্বল করেছিল। এদিকে ছোট ছোট দুই মেয়েসহ রুমিকে যে একা রেখে বিদেশ বিভূঁই টানা দুটো সপ্তাহ নিখোঁজ রইলাম, ঠিকমতো সংবাদ পৌঁছাতে পারিনি কোথায় কিভাবে আছি। আমার কোন সংবাদ না পেয়ে দেশে দেশান্তরে টেলিফোন করে লন্ডন আমেরিকা একাকার করে ফেলেছিল রুমি। পরদিনই মিলনদা’কে কলকাতায় রেখে দেশে ফিরে আসি।
নিবাস: চট্টগ্রাম।
কবিতাই প্রধান বিচরণ।তবে নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভ্রমণগদ্য এবং অনুবাদকর্মেলিপ্ত।
কবিতার বই:
অন্যমন্ত্র(লিরিক১৯৯৫),
শাদা অন্ধকার(লিরিক২০১০),
ডায়োজিনিসের হারিকেন(ভিন্নচোখ২০১৮)
দীর্ঘ কবিতার পুস্তিকা:
শতখণ্ড(বাঙময়২০১৭)
আত্মজার প্রতি(বাঙময়২০১৭)
প্রবন্ধ/নিবন্ধ:
উত্তর আধুনিকতা: এ সবুজ করুণ ডাঙায়(লিরিক২০০১, পরিবর্ধিত২য়সংস্করণ: খড়িমাটি২০১৯)
অমৃত কথা(লিরিক২০১০)
অনুবাদ:
আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্ব: কয়েকটি অনুবাদ(লিরিক২০১০)
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ(বাতিঘর২০১৮)
এমিলি ডিকিনসনের কবিতা(চৈতন্য২০১৮)