| 6 মে 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ উপন্যাস: অর্থ (পর্ব-৩২) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায় চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন ।শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন ।’কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার‘আরু’অর্থ’এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি।ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’।শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকাগিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি।


অনুবাদকের কথা

কালান্তর ট্রিলজির তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হল’অর্থ’। সশস্ত্র হিংসার পটভূমি এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ জীবনের দ্রুত অবক্ষয়ের মধ্যে বেঁচে থাকার তাড়না এবং বেঁচে থাকার পথ অন্বেষণেই আলোচ্য উপন্যাসের কাহিনী ভাগ গড়ে তুলেছে। সম্পূর্ণ পৃথক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে অসমের মানুষ কাটিয়ে আসা এক অস্থির সময়ের ছবি আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের অন্বেষণ চিরন্তন এবং সেই জন্যই লেখক মানুষ– কেবল মানুষের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারে।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম।আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবে। নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


    ‘আমাদের এখানে মানে এই বেস ক্যাম্পের মধ্যে কেন থাকতে হবে?

      ‘মানে, কেন থাকতে হবে মানে?’

      ‘টিমটা ফিরে আসতে এখনও চার দিন বাকি আছে।’

      ‘আছে।’

      ‘আমরা গিয়ে ফিরে আসতে পারি। ফিরে আসার পরেও ওদেরকে পেয়ে যাব।’

      ‘তুমি কোথায় যেতে চাইছ?’

      ‘নিচে। তোমাদের যে অফিস আছে, মেকলডগঞ্জে।’

      ‘কেন?’

      ‘মানুষ মানুষের জন্য এখন আরও মানুষ দেখতে ইচ্ছা করছে। সাক্ষাৎ করার জন্য ইচ্ছা করছে। এখানে এত কম মানুষ। মানুষ প্রায় নেই।’সেই কিছুটা অনুযোগের সুরে বলল।

      দুটো দিনই আমার মেয়েটির সান্নিধ্য ভালো লাগছিল। কেবল ভালো লাগাই নয়, চাইতে শুরু করছিলাম। একটা বোঝাতে না পারা ধরনের জৈবিক আকর্ষণ তার প্রতি অনুভব করছিলাম। এরকম মনে হচ্ছিল যেন তার চোখ দুটি, ঠোঁটজোড়া,লম্বা গলাটার দুটো পাশ, তার স্তনের উপরের বুকের চ্যাপ্টা জায়গাটাতে আমার ঠোঁট দুটি চেপে ধরে রাখব। কল্পনা করেছিলাম সে তার হালকা এবং সুডোল বাহুদুটি দিয়ে আমার মাথাটা জড়িয়ে ধরে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরবে। আমার নাকে লেগে থাকবে তার শরীরের ফুলের মতো এবং মিহি ঘাম ঘাম গন্ধ। তার পিঠের মাঝখানের খালটায় আমি আমার হাতটা নিচ থেকে সুগঠিত  নিতম্বের ওপর পর্যন্ত বুলিয়ে নেব…  …। হঠাৎ এত তীব্র এক জৈবিক আকর্ষণ কেন অনুভব করছিলাম বলতে পারি না, কিন্তু এই কথাটা ঠিক যে আমার এই আকর্ষণ ছিল বিক্ষিপ্তভাবে, বিভিন্ন সময়ে। একসঙ্গে আসেনি, এত সংহতভাবেও আসেনি। তাই বেস কেম্প থেকে নিচে নেমে যাওয়ার কথা বলার সময় আমি খুশি হই নি। মেয়েটি যে কারণে নেমে যেতে চেয়েছিল, ঠিক সেই কারণটার জন্যই আমি নিচে যেতে চাইছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম মানুষ বিহীন নিভৃত জায়গায় তার নিবিড় সান্নিধ্য। মানুষ আমি চাইছিলাম না। ধৌলাধারের গিরি শিখরের ছায়য়  নির্জন প্রকৃতির মধ্যে আমি তার সান্নিধ্য চেয়েছিলাম।

      সেদিনও রাতে আমরা মাঝখানে পাইন কাঠের তক্তার বেড়াটা নিয়ে শুয়ে ছিলাম এবং পাইনের তক্তার মাঝখানের কাজটা ছাড়িয়ে যাওয়া চোখের ফাঁক দিয়ে কথা বলছিলাম। পাইন কাঠের চোখের ফাঁকের মধ্য দিয়ে … …

      ‘যেতে পারি,’মেয়েটিকে বলেছিলাম।’কিন্তু… …’

      ‘কিন্তু কী?’সে জিজ্ঞেস করেছিল।

      ‘এখানে এখনও অনেক দেখার জায়গা আছে।’

      ‘হিমালয়ের বুকে জায়গা দেখা কোনোদিন শেষ হবে কি, নাকি শেষ হবে এর সৌন্দর্য দেখে?’মেয়েটি বলেছিল।

      কথাটা সত্যি। আমি কিন্তু কিছু বলছিলাম না। দেখি সে আর কী বলে।

      ‘মানুষ ছাড়া প্রকৃতি কি সম্পূর্ণ হয়?’ফোটোটা দিয়ে ফিসফিস করে বলার মতো মেয়েটি বলেছিল।

      ‘হু’, আমি উত্তর দিয়েছিলাম।

      ‘কী হু?’তুমি টিমটার জন্য অপেক্ষা না করলে খারাপ হবে নাকি?’

      ‘না সেটা কোনো কথা নয়,’আমি বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি গিয়ে নিচে থেকে গ্যাটশ্বকে পাঠিয়ে দিতে পারব। সে এসে গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবে। এমনিতেও গাড়ি আসবেই।’

      ‘ওরা ফিরে এসে যদি তোমাকে দেখতে না পায়, খারাপ পাবে না?’

      ‘না গ্যাটশ্ব থাকবেই। সে সমস্ত ধরনের কাজ জানে। সবকিছুই সামলে নিতে পারবে।’

      ‘তাহলে যাই চল।’

      ‘যাওয়াটা এত সহজ নয়।’

      ‘কেন?’

      ‘যাতায়াত এত সহজ নয়। সকালবেলা গ্রামে গিয়ে খবর করতে হবে কোনো গাড়ি আসার কথা আছে কিনা? নাহলে তিন মাইলের  মতো নেমে গিয়ে বাসে যেতে হবে। মানুষ নিয়ে একটা জিপগাড়ি দিনে একবার দুবার কখনও আসে। প্যাসেঞ্জার পাওয়ার ওপরে কথা।কিছুটা অনিশ্চিত।’

      ‘ঘোড়ায় যাওয়া যাবে না?’সে জিজ্ঞেস করল।

      ‘ঘোড়ায়? এতদূর! ঘোড়ার যে কঠিন জিন। চামড়া টামরা ছিঁড়ে যাবে। তাছাড়া যায়ও না।’

      ‘চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। আগামীকাল।’

      ‘ঠিক আছে।’

      ‘তোমাকে বিরক্ত করছি তাই না?’

      ‘না না, বিরক্ত নয়। বিরক্তির কোনো কথাই নয়। আসলে… …’

      ‘আসলে কি?’

      ‘এখানে থাকতে ভালো লাগছিল বুঝেছ।’

      ‘ভালোলাগা অবস্থাতেই যাওয়া উচিত। একঘেয়েমি শুরু হয়ে গেলেই খারাপ লাগবে।’

      ‘ঠিক আছে। প্রস্তুত থেকো। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে কিন্তু। গত রাতের মতো হলে হবে না কিন্তু। সারারাত কথা বলে বলে… …’

      মেয়েটি বেড়ার ওপাশ থেকে খুক খুক করে হাসতে লাগল।

      ‘আজ ভয় লাগছেনা, একটুও ভয় লাগছে না। কিন্তু আজ ঠান্ডা।’

      আমার বলতে ইচ্ছা করছিল এসো, একসঙ্গে ঘুমোই, তাহলে ঠান্ডা লাগবে না। কথাটা ভেবে আমি নিজের মনেই হেসে ফেললাম। মেয়েটি বিদেশি স্লিপিং ব্যাগটার ভেতরে শুয়েছে। সেখানে ঠান্ডা লাগার কথা নয়। হঠাৎ মনে হল নীল পাতলা বেগটার উষ্ণতার মধ্যে তার কোমল শরীরটা একটা প্রাগৈতিহাসিক রেশম পোকার মতো শুয়ে আছে—লেটার ভেতরে একটা রেশম পোকার মতো। আহা, তার সুডোল বাহু দুটি বুকটা জড়িয়ে রয়েছে—হাত দুটির মাঝখানে ঢুকে আছে তার সুগঠিত স্তন যুগল, আর স্তনের ওপরের কোমল কালো  জামের মতো … …কী বলে? কী বলে? কালো জামের মতো সেই উপাঙ্গকে! আঁটোসাঁটো  নিতম্ব যুগল হয়তো ঘুমের পূর্বরাগে শিথিল এবং কোমল হয়ে পড়েছে… …আমি ক্রমে উত্তেজিত হয়ে পড়তে লাগলাম। নিজির অজান্তেই হাত দুটি উরুর মাঝখানে চলে গেল। পাইনের তক্তার ফুটোটার কাছে নাকটা রেখে লম্বা করে শ্বাস নিলাম। কে জানে তার শরীরের ঘ্রাণ পাওয়া যায় যদি।

      ‘কী হল চুপ করে আছ যে?’

      আমি উত্তর দিলাম না। চুপ করে রইলাম। আসলে উত্তর দিতে চাইছিলাম না– কারণ যৌন উত্তেজনা প্রশমনে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার নিঃশ্বাস ক্রমশ ঘন হয়ে আসছিল। বাঙ্ক বিছানাটা ক্রমশ কাঁপ ছিল। প্রথমে বিছানা এবং বিছানার সঙ্গে লেগে থাকা বেড়াটাতে যাতে কম্পন না উঠে সেই ব্যাপারে আমি কিছুটা সচেষ্ট  হয়েছিলাম কিন্তু পরে সেই চেষ্টা বাদ দিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমার দৈহিক মানসিক কসরতের  সঙ্গে সঙ্গে বাংকটা কাঁপছিল, বাংকে লেগে থাকা বেড়াটা কাঁপছিল এবং সেই কম্পন হয়তো বেড়ার ওপাশে লেগে থাকা মেয়েটির বিছানাতে ও সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু আমার তখন নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। পুলক ঘন সেই চরম মুহূর্তটিতে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুই বলতে না পারার মতো হয়ে পড়েছিলাম—আ আ। একটা সময় টান টান হয়ে পড়া আমার শরীরটা ঢিলা হয়ে পড়েছিল— জোরে জোরে  নিশ্বাস পড়ছিল। উত্তেজনার সময় প্রায় বন্ধ করে রাখা নিঃশ্বাস এখন বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সেই নিশ্বাসের শব্দ শুনে সে বিছানায় থাকা কম্বলটার সামনেটা দিয়ে মুখটা ঢেকে নিয়েছিল। ভিজে যাওয়ারুমালটা ঘরের অন্যপাশটাতে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম। বিছানার ওপরে ভাসতে থাকা ক্ষারের আঁশটে গন্ধটা মেয়েটি যেন না পায়… …

      বেড়ার ওপাশে মেয়েটি সম্পূর্ণ নীরব হয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটার কোনো উত্তর না পাওয়া সত্ত্বেও সে আর দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু সে ঘুমোয়নি, আমি জানি ওর ঘুম আসছে না… …। আমি ঠিক জানি ও জেগে আছে। জেগে আছে!

      বিছানার পাশের ছোটো টেবিলটার ওপরে থাকা বোতলটা এনে আমি জল খেলাম। বেড়ার ফুটোটার দিকে চোখ পড়ায় দেখলাম অন্ধকার হয়ে এসেছে। হঠাৎ ফুটোটা আলোকিত হয়ে উঠল। পাশের ঘরে জ্বলতে থাকা ল্যাম্পের আলো ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে। তার মানে? তারমানে সে ফুটো দিয়ে এই ঘরের দিকে তাকিয়ে ছিল— এখন মাথাটা সরিয়ে নিয়েছে। আমি কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে রইলাম। শরীর থেকে উত্তেজনার উত্তাপ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিছানার নিচে ঢুকে থাকা শীত টা যেন বেয়ে বেয়ে ওপরে চলে এল। আমি দুটো কম্বল গায়ে দিয়ে নিলাম।

      পাশের ঘরে ধড়মড় করে একটা শব্দ হল। উঠেছে নাকি? হ্যাঁ সে উঠে পড়েছে। স্লিপিং বেগের ভেতর থেকে সে বের হচ্ছে। কাপড়ের খড়খড় শব্দ  শোনা যাচ্ছে। আমার গলাটা শুকিয়ে আসছে। পাশের ঘরে জল খাওয়ার শব্দ হল। সে কিছু বলছে না, নীরব হয়ে আছে। বিছানা এবং বেড়ায় কম্পন তোলার পরে আমারও তাকে ডাকতে এক ধরনের সংকোচ হচ্ছে, সামান্য কিছু পাপ বোধ হল। কী করা যায়। ডাকতেও দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। সে হয়তো ভয় পাচ্ছে, কথা বলতে সংকোচবোধ করছে।

      হঠাৎ খুট করে পাশের ঘরে শব্দ একটা হল। তার হাত লেগে জলের গ্লাসটা টেবিলে কাত হয়ে পড়েছে, গ্লাসটা টেবিলের ওপর দিয়ে গড়িয়ে চলেছে, গিয়ে নিচের কাঠের মেঝেতে খট করে পড়ল। স্টিলের গ্লাসটার গড়িয়ে পড়া শব্দটা আমি অপেক্ষা করতে থাকা সুযোগটা এনে দিল,

      ‘কী হয়েছে? কী পড়ে গেল? আমি বলে উঠলাম।

      ‘গ্লাসটা পড়ে গেছে।তুমি ঘুমোওনি নাকি?’

    ‘ঝিমুনি এসেছিল,’মিথ্যা কথা বললাম।পুনরায় এক ঢোক জল খেলাম।

      ‘আগামীকাল কখন যাবে?’

      ‘সকালবেলা বের হতে হবে।’

      ‘ঠিক আছে।’

.     ‘আচ্ছা,তুমি কেন যেতে চাইছ?’সে গুড নাইট জানিয়ে কথা বন্ধ করার আগে বলল।

      ‘আসলে কী জান,’মেয়েটি ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল।‘আসার পথে যে সেখানে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুণী দেখতে পেয়েছিলাম… …’

      ‘মেকলয়েডগঞ্জেও তো বৌ্দ্ধ ভিক্ষু আর ভিক্ষুণী ভর্তি হয়ে আছে,’আমি বললাম।

      ‘তাঁরা ,বিশেষ করে ভিক্ষুণীরা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে।’

‘বেশিরভাগই খুব কষ্টে থাকে।বৌদ্ধভিক্ষুর জীবন সহজ জীবন নয়।’

‘আমাদের কাছে যা কষ্ট,বা যাকে আমরা কষ্ট বলে থাকি ,সেটা ওদের কাছে কষ্ট নাও হতে পারে।’

      ‘কষ্ট কষ্টই,’আমি বেশ জোর দিয়ে বলেছিলাম।

      ‘কিন্তু কিছু কষ্টে পরিপূর্ণতা আছে।আনন্দ আছে।’ সে প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল।

      ‘আনন্দ? কষ্টে আনন্দ?’

      ‘মা সন্তান জন্ম দেওয়ার কষ্টে,তাতে আনন্দও আছে,পরিপূর্ণতাও আছে।’

      আমি চুপ করে রইলাম।

      ‘কিন্তু,যারা ভিক্ষু বা ভিক্ষুণীর ব্রত গ্রহণ করেছে,তাঁরা তো নিজের ইচ্ছায় করেছে নয় কি?’


আরো পড়ুন: অর্থ (পর্ব-৩১) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


      কথাটা সব সময় ঠিক এরকম নয়,’আমি বললাম।‘তিব্বতী বৌদ্ধ সমাজে একটা পরম্পরা আছে যে পরিবারের একটি ছেলে সাধারণত বিহারে ভিক্ষু বা লামা হতে দেওয়া হয়।খুব শৈশবেই এই সব শিশুরা বিহারে আসে।বিহারেই ওরা লালিত পালিত হয় এবং এভাবেই ভিক্ষু হয়ে পড়ে।ভিক্ষুণীও হয়।প্রাপ্তবয়স্ক ইচ্ছার চেয়ে হয়তো পরিস্থিতি বেশি করে নির্ণয় করে ভিক্ষু হওয়াটা।

      মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।ঘর দুটি নীরব হয়ে পড়ল।বাইরের স্টোভটাতে বোধহয় চৌকিদার কাঁচা কাঠের খড়ি জ্বালিয়েছে।কাঁচা সরল কাঠ জ্বালানোর একটা গন্ধ ভেসে এল।ওকে চুপ করে থাকতে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,‘তোমারই বা  হঠাৎবুদ্ধ,বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে এত আগ্রহ জাগল কেন?

      ‘একটা আগ্রহ মনে মনে আগে থেকেই ছিল,কিন্তু জানার কোনো সুযোগ পাচ্ছিলাম না।’সে খুব ধীরে ধীরে কথাটা বলল।‘সেই যে মন্ত্রটা—বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি,ধর্মং শরণং গচ্ছামি,সংঘং শরণং গচ্ছামি—সেই মন্ত্রটি এত ভালো লাগে।শৈশব থেকে এই কথাগুলি আমাকে বড়ো আকর্ষণ করে।বুদ্ধের কাছে,ধর্মের কাছে,সংঘের কাছে আমি নিজেকে আত্মসমর্পণ করলাম—কথাটা শুনতে খুব সুন্দর নয় কি?বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি… …বৌদ্ধ ধর্মের বিষয়ে অবশ্য আমার জ্ঞান এতটুকুই।’

      এই কথাটা আমিও জানি।আর আমাকেও এই কথাটা একধরনে আকর্ষণ করে চলেছে।এক ধরনের বোঝাতে না পারা আকর্ষণ।আমার মনে পড়ছে –বৌদ্ধ ধর্মের এই বুনিয়াদি ধারণাটির বিষয়ে –বুদ্ধ,ধর্ম এবং সংঘ এই তিনটি মূল বিষয়ের বিষয়ে কেউ একটা মন্তব্য দিয়েছিল।কী ছিল?কী ছিল কথাটা?ওহো,মনে পড়েছে।একজন কবি বলেছিল।অন্য একটি প্রসঙ্গে—অসমের আণ্ডারগ্রাউন্ডদের সন্দর্ভে—বলেছিল অতীত থেকেই ,বুদ্ধের দিন থেকেই যে কোনো একটা সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটা কথাই প্রমাণিত হয়ে আসছে—নেতা-নীতি এবং সংগঠন।এই নেতা,নীতি এবং সংগঠনের কাছে সাধারণ সদস্য নিজেকে সমর্পণ করতে এবং এভাবে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে।তিনি এর প্রমাণ হিসেবে এই মন্ত্র গেয়েছিলেন—বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি,ধর্মং শরণং গচ্ছামি,সংঘং শরণং গচ্ছামি… …।আপাত-সাদৃশ্য আছে!আছে আছে, নিশ্চয় আছে।সাদৃশ্য আছে।কিন্তু তাৎপর্য আলাদা।কথাটা আমি ভাবতে লাগলাম।

      ‘কী ভাবছ,’বেড়ার ওপাশ থেকে সে বলে উঠল।‘একেবারে চুপ করে আছ যে?’

      ধড়মড় করে জেগে ওঠার মতো আমি বললাম,‘বুদ্ধ কতজন বল তো?’

      ‘বুদ্ধ এখন পঁচিশজন।’মেকলডগঞ্জে শোনা কথা থেকে গর্বের সঙ্গে নিজের জ্ঞান জাহির করলাম।‘আমরা গৌতম বুদ্ধের কথাই জানি।তার আগে আরও চব্বিশজন বুদ্ধ ছিলেন।প্রথমজনের নাম ছিল দীপংকর।ইনিই প্রথম জ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং এই দীপঙ্কর বুদ্ধের দিনে নাকি গৌতম বুদ্ধ পরবর্তী জন্মে বৌ্দ্ধত্ব লাভ করবেন বলে স্থির করেছিলেন।এসব অবশ্য পরবর্তী কোনো একটি যুগে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সৃষ্টি করে নেওয়া সূত্র বা আখ্যান।এই সূত্রকে বোধিসত্তের সূত্র বলে বলা হয়।’

      বোধিসত্ত।নামটা সে শুনেছে বলল।কিন্তু সে নাকি আগে এই আখ্যানটির কথা জানত না।আমি তাকে ভবিষ্যতে পুনরায় বুদ্ধের আবির্ভাব হবে বলে থাকা বিশ্বাসটির কথা জানে কিনা জিজ্ঞেস করলাম।না ও সেই বিষয়েও জানে না।আমি বেশ গর্বের সঙ্গে বললাম যে এটাও পরবর্তীকালে সৃষ্টি করে নেওয়া একটি আখ্যান।কিন্তু এই আখ্যান আজ একদল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর মনে এক দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।হয়তো বৌদ্ধ ধর্মের কোনো দুর্দিনের কালে,এবং বৌদ্ধ ধর্মে এই ধরনের দুর্দিনের কাল বহুবার এসেছে,সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষগুলির সঙ্গে সাধারণ ভিক্ষুকদের আশা এবং বিশ্বাস অটুট রাখা পর্যন্ত এই আখ্যানের সৃষ্টি করা হয়েছিল।এই আখ্যানমতে ভবিষ্যতে বৌদ্ধধর্মের সমস্ত দুর্বলতা,সমস্ত শিথিলতা,সমস্ত কালিমা দূর করার জন্য একজন নতুন বুদ্ধের আবির্ভাব হবে—আর তিনি হলেন মৈত্রেয় বুদ্ধ।

      ‘মৈত্রেয় বুদ্ধ?’সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

      ‘মৈত্রেয় বুদ্ধ,’আমি উত্তর দিলাম।

      এত সুন্দর নামগুলি,‘সে স্বগতোক্তি করার মতো বলল,‘দীপঙ্কর,গৌতম,মৈত্রেয়,বোধিসত্ত!’তার কণ্ঠস্বর খুব কোমল শোনা গেল।এইবার সে নিজেনিজে আওরাতে লাগল—দীপঙ্কর,গৌতম,মৈত্রেয়… …দীপঙ্কর… …।’

      বারবার সে আওরাতে থাকা নামগুলি এইবার অনেক দূর থেকে ভেসে আসা প্রার্থনার ধ্বনির মতো শোনা গেল।এরকম মনে হল যেন এক বিশাল নির্মল হ্রদের জল জ্যোৎস্নারাত এসে তীরের পাথরে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ধাক্কা মারছে।আমার চোখ বুজে এল এবং দ্রুত স্বপ্নহীন গভীর নিদ্রার কোমল আলিঙ্গনে অচেতন হয়ে পড়লাম… …

 

 

     

 

 

 

 

 

 

 

 

 

     

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত