ছোটগল্প: ফিতরার কয়েকটি টাকা । মাহবুব আলী
তিন দিন পেরিয়ে গেল, ঈদের আর বাকি নেই; মোবাইল বেজে উঠল না। আলম একটি রিংটোনের প্রতীক্ষায় সময় গোনে। অধৈর্য হয়ে পড়ে মন। ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। হাতের কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। নূরবানু কখনো শত কাজের ফাঁকে তির্যক দৃষ্টি ফেলে যায়। গোপন দীর্ঘশ্বাস। কোনো খবর নেই। সেদিন ইফতারিতে চপ ভাজার জন্য বেগুন কেটে রেখেছিল। শেষমেশ তরকারির সবজিতে ঢেলে দিতে হয়। খেয়ালই করেনি বেসন শেষ হয়ে গেছে। মানুষটি পছন্দ করে। ছেলেমেয়েরাও। বছরের একটি মাস কোনো কোনোদিন বাজার থেকে বুন্দিয়া-জিলেপি কেনা হয়। সারা বছর আর হয় না। ছেলেটি পরশুদিন ঘোল খেতে চেয়েছিল। আলম বলে, –
‘একদিন অবশ্য আনতে হবে।’
‘তোমার বেতন কত তারিখে দেবে?
জিজ্ঞেস করে নূরবানু। মেয়েদুটি বেশ আগ্রহ নিয়ে বাবার দিকে তাকায়। আলম হতাশ করতে চায় না। সন্দেহের দোলা আশা-নিরাশা নিজের বুকে থাক।
‘আজ তো রোজার বাইশ। চব্বিশ-পঁচিশের দিকে নিশ্চয় হবে।’
‘আব্বা তোমার বোনাস কত?’
‘তোমার আব্বার অফিসে বোনাস হয়েছে কোনো বছর? বেতনই ঠিকমতো হয় না।’
নূরবানু ফোঁস করে জবাব দিয়ে হত-বিহ্বল। তার বলা উচিত হয়নি। বড় মেয়ে মিলু, অল্প বয়সে কেমন গম্ভীর; চুপ করে সকলের কথা শোনে। একটি কথা বলে না। ছেলে তখন আবার জিজ্ঞেস করে, –
‘বেতন যদি না হয়, তবে কাজ করো কেন আব্বা?’
আলম সেই প্রশ্নের মোড় ঘোরাতে ব্যস্ত হয়। পুব দেয়ালে লটকানো পুরোনো ঘড়ির দিকে দৃষ্টি রাখে। সাত বেজে প্রায় পঁচিশ মিনিট। আকাশের লালিমা অনেক আগে কেটে গেছে। মাগরিবের সময় যায় যায়। তারপরও ছেলের দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয়।
‘কালকে অবশ্যই ঘোল নিয়ে আসব। অনেকদিন চমচম খাওয়া হয় না।’
‘আব্বা আমার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। এবার একজোড়া কিনে দিতে হবে।’
ছোট মেয়ে বেশি অভিমানী। একটুতে গাল ফুলিয়ে রাখে। ক্লাস সিক্সে পড়লে কি হবে একেবারে মায়ের মতো! না নূরবানু এখন অন্য মানুষ। সারাদিন মুখ বুজে শত কাজ করে যায়। এটা-ওটা রান্না, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর ঝাড়ু দেয়া, বিছানা ঠিক করে দেয়া। এসবের মধ্যে একচিলতে আঙিনা। সেটিও কোমর বেঁধে পরিষ্কার করে। আলম তার দিকে তাকাতে পারে না। নিজের মায়ের জীবনে এমন কষ্ট দেখেনি। ফরিদপুরের এক কাজের মেয়ে সকল কাজ করে দিত। মা বিশ্রামে থাকতেন। অবশ্য রান্নার কাজ নিজের কাছছাড়া করেননি। তারপরও তার শত অভিযোগ। এমন কি আঙিনার কোণায় পেয়ারা গাছে কতগুলো কাক বসে চিৎকার দেয়, সেগুলোর পেছনেও বকবক করেছেন। নূরবানুর কোনোদিন কোনো অভিযোগ নেই। চুপচাপ কাজ করে যায়। রাতে ঘুমোবার জন্য সকলের মশারি টানানো পর্যন্ত করে।
নূরবানু করুণ দৃষ্টিতে আলমের দিকে তাকায়। রমজান মাস। কেউ তেমন করে খেতে পারে না। তরকারি ভালো না হলে রুচি আসে কী করে? তেমনকিছু জোগানোর ক্ষমতা মানুষটির নেই। চেষ্টা করে চলে। দিনরাত কাজ। নূরবানুর মুখছবি বিমর্ষ হতে থাকে। তারপর খুব সহজে বদলে ঠোঁটে হাসি টেনে নেয়। কৌতুক গলায় জিজ্ঞেস করে, –
‘কাল বেতন পাবে…না?’
‘দেখা যাক।’
‘আব্বা আমার স্যান্ডেল, না হলে স্কুলে যাওয়ার কিছু নেই।’
‘কিনে দেব মা।’
‘আমি কিন্তু প্যান্ট-শার্ট-জুতো নেব। সুদীপ্ত যেমন কিনেছে।’
‘আচ্ছা আচ্ছা হবে।’
আলম উঠে পড়ে। ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল। তড়িঘড়ি তাকিয়ে হতাশ। চার শূন্য শূন্য শূন্য থেকে কল। মোবাইল কোম্পানিগুলো যে কি করে! একদিন ইন-অ্যাকটিভ থাকলে শত শত এসএমএস। উদ্দীপক কল। একটি গান বেজে উঠল।
‘প্রিয় গ্রাহক, এখন আপনি রাঙিয়ে নিন আপনার দিনরাত। পবিত্র রমজানের নতুন নতুন ইসলামি গান ওয়েলকাম টিউন হিসেবে আপনার মোবাইলে নিয়ে বন্ধুদের অবাক করে দিন। জেনে নিন সাহ্রি আর ইফতারির সঠিক সময়। ইত্যাদি…ইত্যাদি।’
আলম বিরক্ত। মোবাইল টেবিলের এককোণায় রেখে দেয়। ইচ্ছে হয় বন্ধ করে রাখে, কিন্তু না, জরুরি কল আসতে পারে; প্রতীক্ষায় আছে। বড়ভাই ফোন দিল না। কি যে ব্যাপার! সুস্থ আছে তো? প্রত্যেক বছর উনিশ কুড়ি রোজার আগেই ফোন দেয়। সেও কাঙালের মতো অপেক্ষায় থাকে। এ ছাড়া গরিব মানুষের কী করার আছে? নিজের কাছে শতবার মরে গিয়ে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠা। তার অনেক কাজ। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে হবে। এ জন্য…আচ্ছা একবার ভাবীকে ফোন করবে না কি? যদিও বিষয়টি অস্বস্তিকর। উদোম হয়ে পড়ে অস্থিরতা। সে হোক…উপায় কি! কাল সকালে না হয় একবার চেষ্টা করবে। গরিব মানুষ তো উলঙ্গ। লজ্জা কি? আলম নামাজের নিয়ত ভুল করে ফেলে।
জীবনে কত যে ভুল হয়ে গেছে তার, শোধরানোর রাস্তা নেই। কোনো কোনো ভুল ঠিক করা সম্ভব নয়। সময় হাতে থাকে না। সে ফেলে আসা সকলকিছু ভুলে যেতে চায়। ভোলা যায় কি? যায় না। তারপর খুব ধীরস্থির নামাজ শেষ করে বিছানায় বসে। টিভির রিমোট বাটন চেপে দেয়। এই যন্ত্রটির দিকে যখন দৃষ্টি পড়ে, ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। তাকে খুব ভালোবাসে। অথচ এখনো…। সন্ধের খবর শেষ। কোনো বিউটিশিয়ান এক চিত্রনায়িকার রূপচর্চা-রহস্য নিয়ে আলোচনা করছে। লাইভ অনুষ্ঠান। যে কেউ ফোন করতে পারে। একটি রিভার্স লাইন ডানদিক থেকে বাঁয়ে স্ক্রলিং করে চলেছে। ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত গমের বিষয়ে আদালতের আদেশ। সৈয়দ আশরাফ এখন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী।…আর কি কি…তার মনোযোগ থাকে না। মোবাইল বেজে ওঠে। আলম অস্থির প্রত্যাশা নিয়ে মোবাইল হাতে তুলে নেয়। অফিস থেকে ফোন। তার চেহারা নির্বিকার হয়ে পড়ে।
‘হ্যাঁ মলি বলেন।’
‘আলম ভাই একটু অফিসে আসতে হবে যে, বস ডাকছে।’
‘হঠাৎ কোনো জরুরি কাজ?’
‘সে আমি বলতে পারব না ভাই। কোনো ফাইল খুঁজছেন বোধহয়।’
‘কোন্ ফাইল বলুন তো…?’
‘আপনি আসেন ভাই।’
আলম যখন অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামে, বেশ রাত। অবশ্য ঈদের উৎসবে রাত জেগে থাকে…নিশ্চুপ নিজ্ঝুম হয় না। সুপার মার্কেটে ঝলমলে আলো, মানুষজনের গমগম ভিড়; সবকিছু আনন্দ আয়োজন মত্ত। ফুটপাত দখল করেও বসেছে বিবিধ দোকান। মানুষের কত টাকা! কত শখ! কত আনন্দ! কত আয়োজন! সে দেখতে দেখতে এতকিছুর মধ্যে কোনো অলীক ভাবনায় মোবাইলে স্পর্শ রাখে। সতর্ক করে রাখে কান। যদি একবার বেজে ওঠে!
পুরোনো আমলের মোবাইল। বেঢপ আকার। ভারী। কখনো কখনো প্যান্টের পকেটে অস্বস্তি লাগে। রিং বেজে উঠলে টের পায় না। তাই বুক পকেটে রাখা। বেজে উঠলে সহজে রিসিভ করা যায়। অফিসে গিয়ে কম্পিউটারের একপাশে রেখেছিল। বেজে ওঠেনি। কাজের ফাঁকে সতর্ক মনোযোগ। অফিসে দুটো মেইল এসেছে। তাই জরুরি তলব। এনজিও’র চাকরি। নিজেকে সবসময় প্রস্তুত রাখতে হয়। নিয়োগপত্রে লেখা আছে: alwayes ready to serve as when required and capable to work under pressure। সুতরাং কর্ম পরিকল্পনার নিয়মিত কাজের মধ্যে যখন-তখন অন্য অ্যাসাইনমেন্ট হামলে পড়ে। উন্নয়নের স্বেচ্ছাকর্মী। নিজের উন্নয়ন কোথায়? আলম জানে না। তাকে দেখে পরিচালক অরুণ কুমার বলে বসেন, –
‘আলম সাহেব রোজা রমজানের দিন, আপনাকে ডাকতে চাইনি; কিন্তু কাজটা জরুরি। আপনি ছাড়া কে আর করতে পারে?’
‘জি ভাই বলুন।’
‘মেইলের জবাব লিখতে হবে। ফান্ড এসে গেলে তো আপনাদের সকলের বেতন সমস্যা থাকবে না।’
আলম উৎসাহিত। যদিও এনজিও ব্যুরো আর ব্যাংক থেকে ফান্ড ক্লিয়ারেন্স হতে হতে লেগে যাবে এক-দুই মাস। তারপর সেই বেতন যে সময়মতো পাবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? বসের মনমানসিকতা অন্যরকম। স্টাফ ড্রপ-আউট ঠেকাতে এই পদ্ধতি। বেতন পাবে। একটু হয়তো দেরি। যাক এত নেতিবাচক ভাবনা কেন?
অরুণ কুমার ব্রিটিশ কাউন্সিল লন্ডন থেকে ছয় মাসের ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স করেছেন। ভালো ইংরেজি লেখেন। প্রি-পজিশন প্রয়োগে তবু সন্দেহ। আলমের মূল্য তাই। সে হলো আলু…গোল আলু। মেইলের অনুবাদ করে শোনায়। ইংরেজ মানুষের লেখা চিঠি। কঠিন কঠিন শব্দ। বক্তব্য অনুযায়ী সামান্য ব্রিফিং হয়। অবশেষে সবকিছু গুছিয়ে দেড় ঘণ্টায় ড্রাফট তৈরি করে ফেলে আলম। দু-তিনবার সংশোধন সম্পাদনা শেষে চূড়ান্ত জবাব। এরমধ্যে ঝিমঝিম শব্দে বৃষ্টি। মাতাল বাতাস। কিছুক্ষণ নাকি অনেকক্ষণ কোনো অনুভূতি বা বোধ নেই। বস কোথাও কোথাও ফোন করেন। ফোন ধরেন। উচ্চ কণ্ঠধ্বনি। এসির হিমেল বাতাসের ঢেউয়ে ঢেউয়ে হাসি-গল্পে মুখরিত চেম্বার। আলম কখনো উৎকর্ণ। ফোনে হয়তো হুদা ভাই কথা বলেন। নাজমুল হুদা ব্যবসায়ী মানুষ। বস হেসে হেসে জিজ্ঞেস করেন, –
‘কি রে ঈদের কেনাকাটা শেষ? ভাবীর জন্যে কী নিলি?’
কিছুক্ষণ শোনেন। তারপর আবার বলেন। বৃষ্টির শব্দে সেই কথা কখনো ভেসে আসে না। আলমের চিঠি লেখার কী-বোর্ড শব্দ বাক্যবিন্যাসের রেখায় থমকে যায়। তখন বেশ কষ্টে নিজেকে কাজে নিবিষ্ট করার চেষ্টা।
‘বাব্বা ম্যালা খরচ করেছিস দেখছি!’
আলম মনিটরে দৃষ্টি রেখে খুব ধীরে ছোট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। তার কোনো কেনাকাটা হলো না। গরিবের জীবনে প্রতিটি উৎসব অক্ষমতাগুলো উৎকটভাবে তুলে ধরে। বুঝিয়ে দেয়, তুমি কত গরিব। অবলম্বনহীন অসহায়! তোমার জীবন, বেঁচে থাকা ও অস্তিত্ব সবকিছু আবর্জনা বই কিছু নয়। তার এখনো বেতন হলো না! ওই সামান্য টাকায় সকল সাধ-আহ্লাদ পূরণ হবে জানা নেই। ছেলেমেয়েদের ছোট ছোট আবদারগুলো রক্ষার পর যদি কিছু টাকা হাতে থাকে, নূরবানুর জন্য ভালো একটি শাড়ি নেবে। কত বছর হয়ে গেল তেমনকিছু দিতে পারে না। নিজের জন্য ভাবনা নেই। কোনো চাহিদা বা প্রয়োজন নেই। অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। এভাবেই জীবন চলে যাবে শেষ পর্যন্ত। এর মধ্যে বড়ভাই যদি…না এখনো তো মোবাইল বেজে উঠল না।
রাতে মোবাইলের প্রোফাইল সেটিংস’এ গিয়ে ভাইব্রেশন অন করা হয়। সিঁথানের পাশে আলগোছে রেখে দেয়। নিয়মমতো টেবিলের ড্রয়ারে ফেলে রাখে না। যদিও তেমন কেউ নেই যে রাতে কল করে। ভাই তো নয়ই। তারপরও মনোযোগ আর দৃষ্টি মেলে ভাবনায় জেগে থাকে। নূরবানু এসব দেখে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সারাদিনের গাধাখাঁটুনি শেষে বিছানায় গেলে শরীর আপনিই এলিয়ে যায়। সহসা দুচোখ বুজে আসে। কিন্তু কেন জানি তখন কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। সে আলমকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। ফিসফিস বলে যায়, –
‘তুমি এত উতলা হও কেন মিলুর আব্বা?’
‘উতলা…কিসের জন্য?’
‘না কিছু নয়…তুমি এবার ঘুমোও।’
নূরবানু ক’ মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে মৃদু জবাব দেয়। এরপর তার দিক থেকে আর কোনো কথা আসে না। ঘরের মধ্যে জেগে ওঠে অদ্ভুত মিঁহি কোনো সুর। আলমের অনেক পরিচিত সেই ছন্দ। সে আলগোছে ঘুমিয়ে যাওয়া স্ত্রীর কাঁধে ডানহাত রেখে আলোছায়া দেয়ালে তাকিয়ে থাকে। নিজের মধ্যে এতটুকু হয়ে যায়। কী করবে সে? চেষ্টার তো ত্রুটি করে না। পৃথিবীর এই আনন্দ উজ্জ্বল উৎসবে ক্রমশ বারবার অদ্ভুতরকম উলঙ্গ হয়ে পড়ে সে। তার দুচোখ কি ছলছল করে?
অনেক ক’জন ভাইবোনের শেষে তার জন্ম। মায়ের কোলামোছা সন্তান। বাবা মোসলেম মোল্লা শেষ-বয়সে তাকে পৃথিবীতে টেনে না আনলেও পারতেন। অসংযমী মানুষ। ছয় ভাই আর দু-বোনের শেষে সে নবম। শেষ অবস্থানে থাকার কারণে সকলের অতি আদর-যত্ন-মনোযোগ পেয়েছে। মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা…সুন্দর ভবিষ্যতের সুযোগ নিয়তিতে জোটে না। নিয়তিই বটে! সে বড় হয়ে উঠতে না উঠতে বাবা টুপ করে ওপারে চলে গেলেন। ভাইদের দয়ায় কলেজ পর্যন্ত পড়া হলো, কিন্তু চেষ্টা সত্ত্বেও রেজাল্ট ভালো হলো না। দু-তিন জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী খেটে খেটে অবশেষে এনজিও। সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা অবধি কাজ করে মাস গেলে সাতাশ শত টাকা। সেও অনিয়মিত। ভাইয়েরা সকলে নিজেদের ভালো জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছে। সে কিছু গোছাতে পারল না। এখন সেই ভাইয়েরা দূরের মানুষ।
বড়ভাই দায়িত্বশীল। ইউনিভার্সিটি পড়ার সময় কোনো এক ধনী মানুষের মেয়েকে বিয়ে করে একরকম আলাদা। সরকারি এক দপ্তরের বড় কর্মকর্তা। ভাবীও ব্যাংকের উচ্চ পদে। মর্যাদা ও বেতনে ভাইয়ের উপরে। পরিবারে দাপট বেশি। তারা ব্যস্ত মানুষ। বিবিধ কাজে দিনরাত পার হয়ে যায়। খোঁজখবর নেয়ার সময় পায় না। বড়ভাই তবু ঈদ পরবে মোবাইল করে। আগ্রহভরে জেনে নেয় কুশলাদি। সেও জানতে পারে ভাই ভালো আছে। তখন তার আদর স্নেহের কথা মনে পড়ে যায়। সহজে ভেসে ওঠে শৈশবের স্মৃতি। কত আনন্দের দিন ছিল সে-সব! এখন সে কথা থাক। দিন দিন দেশের উন্নতি হচ্ছে। বিশাল বিশাল বিল্ডিং উঠছে। নতুন নতুন অজানা অচেনা মানুষের মুখ দেখছে। অথচ সেই পরিচিত লোকগুলোর হারানো চেহারা আর দেখা যায় না। তারা সুখে থাক। সমৃদ্ধি আসুক তাদের জীবনে।
তার কোনো সমৃদ্ধি নেই। কোনোমতো খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে দিন পেরিয়ে যায়। সেখানে একটি স্বপ্ন একটি আবদার শুধু জাগিয়ে রাখে। সন্তানেরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজেদের আঙিনায় দুধে-ভাতে বেঁচে থাকায় সুখ খুঁজে পাবে। আলমের দৃষ্টির সামনে দেয়াল আলোছায়া থেকে থেকে ঝাপসা হয়ে যায়। অজান্তে ডুকরে উঠে মন। সে সত্যি দুর্বল মানুষ।
কয়েকদিন পর মোবাইল বেজে উঠল। আগামীকাল পনেরো জুলাই, বুধবার; সাতাশে রমজানের ছুটি। একদিন অফিস হয়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিন-সহ লম্বা বিরতি। আলম বাহাদুর বাজারের পথে। গতকাল বেতন হয়েছে। আজ কিছু ভালো-মন্দ কেনার শখ। নূরবানু আর ছেলেমেয়েরা প্রতীক্ষায়। বাজার সেরে অফিসে যাবে। মোবাইল বেজে ওঠে। স্ক্রিনে চোখ রেখে পুলকিত হয় সে। অথচ ভেবেছিল, বড়ভাই খোঁজখবর নিতে ভুলে গেছে অথবা সময় নেই। সে না নিক, তারা কেমন আছে জানা যায়। সে খুব দ্রুত রিসিভ বাটন চেপে ধরে। মানুষের গমগম ভিড়। চিৎকারে কে কার কথা শোনে! তারপর এক আতরঅলা লাউডস্পিকারে তারস্বরে ‘দশ টাকায় আতর-সুরমা’ বিক্রির প্রচার করে চলেছে। আলম মোবাইল কানে নিয়ে তেমনকিছু শুনতে পায় না। সে দ্রুত পশ্চিমে নবরূপীর গলিতে প্রবেশ করে।
‘হ্যাঁ রে আলম ভালো আছিস?’
‘আছি ভাই আছি, আস্সালামু আলায়কুম ভাই; তোমরা ভালো আছো তো?’
কথা আরও কিছু হতে থাকে। নিজেদের ফ্লাটের কোনো কক্ষ থেকে বড়ভাই কথা বলছে বোঝা যায়। অনেক বড় পদের দায়িত্ববান মানুষ। কথার মধ্যে সবকিছু হিসাবমতো যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ, না কি ঢাকা শহরের মানুষগুলো এমন করে ইট-পাথরের মতো কঠিন হয়ে যায়; কে জানে।
‘ভাই…ভাবী ভালো আছে, মিহির আর শান্তি? তোমরা বেড়াতে আসবে না ভাই? কত বছর তোমাকে দেখি না!’
‘অফিসে কাজের চাপ অনেক বুঝলি। এসব ছেড়ে হাওয়া খাওয়ার সময় আছে? এদিকে নতুন গাড়ির অর্ডার দেয়া হয়েছিল, ডেলিভারির কাগজপত্র তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। তো শোন…।’
আলমের আগ্রহ অনেক। সে কথা বলতে বলতে তার পুরোনো দিনে ফিরে গেছে। আবেগ-আনন্দ-উদ্বেল মনে অনেক কথা। অনেকক্ষণ গল্প করতে মন অস্থির হয়ে ওঠে।
‘কী গাড়ি নিলে ভাই…আর আগেরটা?’
‘ওটা তো ওল্ড মডেল…সমাজে চলে না। তোর ভাবী তো সকাল থেকে তাড়াহুড়ো করছে বুঝলি…তো শোন তোর অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়েছি, তুলে নিস।’
‘কত ভাই?’
ফ্লাটের সেই কক্ষের মধ্য থেকে কিছু শব্দ মোবাইল হয়ে কানে ভেসে আসে। আলম সে-সব ছাড়িয়ে অসম্ভব উৎকর্ণ হতে চেষ্টা নেয়। ভাই কত টাকা পাঠাল শোনা হয় না, জানা হলো না; যা শোনা গেল স্পষ্ট অথবা স্পষ্ট নয় আর না শুনলেই বোধকরি ভালো হতো। মোবাইল ডিসকানেক্ট হয়ে গেছে। সে অবাক বিস্ময়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, নাকি অনেকক্ষণ ঠাহর করতে পারে না। শ্রুতি হাতড়িয়ে খুঁজে ফেরে সেই কথা। মানুষের কলরোলে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনে। তারপর মনের দেয়ালে দেয়ালে আঘাত করে ফিরতে থাকে তীব্র শেল। হায় খোদা! ভাবী বড়ভাইকে বলে, –
‘তুমি এত বকবক করো কেন? যাকাত-ফিতরার টাকা গরিব মিসকিনের হক, দিয়ে দেবে ঝামেলা শেষ; শুধু শুধু কথা বাড়াও?’
ঠিক এমন অথবা তেমন নয়, কিংবা তার সবটুকু শোনার ভুল; মন সে কথা বোঝে না। আলম অবশেষে বিবিধ যুক্তিতর্ক দাঁড় করিয়ে মনকে প্রবোধ দেয়ার অসম্ভব চেষ্টা নেয়। তারা ব্যস্ত মানুষ। তার উপর নতুন গাড়ি নেয়ার ঝামেলায় আছে। সে গরিব, পৃথিবীতে সকলের কথা মনে ধরে রাখলে বাঁচবে কী করে? কিন্তু পোড়ামন কোনো কথা শোনে না। অবোধ দুচোখ কিছু বোঝে না। কোনো সান্ত্বনা খুঁজে পায় না যাকে অবলম্বন করে শক্ত হয়। ভাইরা তার কত আপন…আজ দূরের মানুষ। মনের কোনায় বিশ্বাস ছিল, ভাই-ভাবী নিজের মানুষ; আত্মার আত্মীয়। সেই অহংকার আর সাহসের কত কথা নিজের দুর্বল বুকের মধ্যখান থেকে বের করে কতজনকে শুনিয়েছে। মানুষ তো নিজ মানুষের সাফল্যে গর্বিত হয়…অপরকে দুটো কথা বলে তৃপ্তি পায়। নিজের ক্ষুদ্র জীবন, তাদের সেই মর্যাদায় আশ্রয় না পেলেও অন্তত সাহস খুঁজে নিতে সাধ করে। সেই আপনজনেরা আজ কত দূর! একদিন সকলের অতিকাছের ভাইবোন এমন করেই বুঝি দূরের হয়ে যায়। এই কি জীবন? নিজেকে তার বড় অসহায় আর অবলম্বনহীন মনে হতে থাকে। আকস্মিক সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখায়। তারপর দুপুরের রোদে পুড়তে পুড়তে বুঝে নেয়, বেঁচে থাকার দুনিয়ায় কোনো কোনো অভিমানের কোনো মূল্য নেই। সে এক মিসকিন। যাকাত-ফিতরার কয়েকটি টাকা অনেক কাজে আসবে তার।
সে গলি থেকে বেরিয়ে রাস্তার নেমে অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করে।
প্রভাষক, ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট
প্রকাশিত বই: ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা),অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প), ভয় (গল্প), অযোগ্যতার সংজ্ঞা (গল্প), পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় (গল্প), রাত পাহারা চোখ (গল্প), গোপনীয়তার অলিগলি(গল্প),
প্রকাশক: জয়তী বুকস, ঢাকা।