| 3 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: ভালবাসা এবং একটি গুবরেপোকা । মাহবুব আলী

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছিল। তখন আকাশে গোধূলির বড় ডিম-কুসুম সূর্য জ্বলজ্বল রহস্যময়। রুকুর নোজপিনের চুনি পাথরে কোমল বিচ্ছুরণ মাতামাতি করছে। সামনে আত্রাই নদীর পাড়। সমুদ্র বেলাভূমির মতো দীর্ঘ প্রশস্ত বালিয়াড়ি; তারপর নদীর জল। সেদিকে তাকিয়ে আর একবার মনে হয়, এটি একসময় নদী ছিল; এখন শীর্ণ নালা। তার জীবনে বিশ্বাস আর ভালবাসার উদ্দামতার মতো শুকিয়ে যাওয়ার পথে। একদিন এ নদী হারিয়ে যাবে। রেখে যাবে দাগ। সে দাগ তার বুকের মধ্যে ক্ষতের মতো। অথচ এমন তো ছিল না…কোনোদিন ভাবেনি। কিছু কিছু বিষয় আছে, অতীতে ফেলে রাখতে হয়। কবরে কফিন শুইয়ে রাখার মতো। তাকে জাগাতে নেই। তবু মন মানে না। শুনছে না। সে কবর খুঁড়ে প্রেতাত্মার চেহারা দেখতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। রুকু নিশ্চুপ বসে থাকে। তার দৃষ্টি দূর অজানা আকাশে। শিহাব সেদিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি অসম্ভব করুণা করে বসল। কথায় বলে অতীতে বিচরণ শুধু দুঃখ টেনে নিয়ে আসে। সে তা হলে জেনে-শুনে ভুল কাজে হাত দিয়েছে।

নদীর ওপারে অনেক দীর্ঘ আমবাগান। তার শেষ-প্রান্তে উত্তর কোণায় মাথা উঁচু দুটো শিমুল গাছ। মগডালে কতগুলো শকুন। এখন এই পাখিদের খুব একটা দেখা যায় না। শিহাব একদৃষ্টিতে সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। বসন্ত ঋতু। ডালে ডালে থোকা থোকা লাল শিমুল। কিছু নতুন সবুজ পাতার আগমনী সংকেত। আকাশের গোধূলি লালিমা, পাতার সজীবতা; এসবের মধ্যে খয়েরি শকুনের দল অদ্ভুত বিমূর্ত দৃশ্যপট এঁকে যায়। এমন পটভূমিকায় কোনোকিছু বলতে ইচ্ছে করে না। উপায় নেই। কথা বলতে হবে। মন শুনতে আর জানতে উৎসুক। কয়েকদিন ধরে মাথার মধ্যে সেই নোংরা পোকা প্রচণ্ড দাপটে হেঁটে বেড়াতে শুরু করেছে। সেটি দেখতে হয়তো গুবরেপোকার মতো। কালো শক্ত খোলস। ভয়ানক বিদঘুটে। আধ-শুকনো গোবরের ভেতরে কোনো কোমল নরম আর আদ্র ঘা খুঁজে বেড়ায়। শিহাব নিজেকে হীনম্মন্য আর স্বার্থপর মানুষ হিসেবে শনাক্ত করে ফেলে। বুঝতে পারে অস্থির বাতিকের নাগপাশ। তারপরও…।

রুকু নদীর বুক বেয়ে ভেসে আসা বাতাসে মন-প্রাণ ডুবিয়ে দিয়েছে। মুহূর্ত জুড়ে উপলব্ধিতে খুব ভালোলাগা প্রশান্তি। সে দেখতে পায় না, হয়তো বুঝতেও, শিহাব তার মুখের দিকে অবিমিশ্র মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার কাঁধের উপর নীল ব্লাউজের ভেতর দিয়ে সাদা অর্ন্তবাসের ফিতে উদ্ভাসিত। সেখানে ছড়িয়ে পড়া একরাশ চুল মৃদু বাতাসে থিরথির কাঁপে। সে কি নিজের মধ্যে গভীর মগ্ন হয়ে গেছে? সেখানে তার কোনো জায়গা নেই? শিহাব পলকহীন তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে ভাবতে একসময় দৃষ্টি ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকায়। সূর্য হলো সত্যের মতো, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যায় না; দু-চোখ অন্ধ হয়ে পড়ে। অনেকসময় চরম কোনো সত্য কাউকে অন্ধ করে দেয়। তার সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। সে তখন মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে শত রকম ভাবে। তাকে পরিক্রমণ করতে করতে গোলকধাঁধার গ্রহাণুতে রূপান্তরিত হয়। ততক্ষণ জীবন থেকে সব সরে যায়। হারিয়ে যাওয়া সময় আর ফেরে না। তার মধ্যে এরকম ভাবনায় আত্মশ্লাঘার অনুরণন দানা বেঁধে ওঠে। নিজেকে মহৎ ভাবার কল্পিত পথ খুঁজে পায়।

রুকু গুনগুন করে সুর ধরেছে, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো’। শিহাবের জীবন শুকোতে শুরু করে। একটি পোকা, জঘন্য নোংরা কদর্য; তার মনের সূক্ষ্ম রেখা ধরে প্রচণ্ড স্বেচ্ছাচারীর মতো হেঁটে চলে। অসহনীয় সুড়সুড়ি। তীক্ষ্ণ জ্বালা। সে রুকুকে কিছু বলল না। চুপ করে শুনে গেল কয়েকটি লাইন। তখন নদীর টলটলে পানিতে কতগুলো চড়ুই কিচিরমিচির স্নান সেরে আকাশে উড়ে যায়। সে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ-তন্ময় বিভোর। এও ভালো…কঠিন বাস্তবতার মধ্যে একটু কল্পনা একটু স্বপ্নদোলা সকল ক্লেদ ভুলিয়ে দেয়। রুকু তার দিকে তাকিয়ে আকস্মিক বলে বসে, –

‘চলো যাই। নাকি কাব্য করবে আরও কিছুক্ষণ? কিছু তো বললে না। কী বলতে চাইছিলে?’

‘উঁ…না তেমনকিছু নয়। দেখেছ কেমন আশ্চর্য মৌনতা! নিস্তব্ধতার মধ্যে স্বর্গীয় সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, তাই না?’

‘কি জানি বাবা! আমি কবি নই। কবিতা লিখি না তোমার মতো। ওসব পাগলের কাজ।’

‘আমি পাগল?’

‘তাই তো! দুপুরের রোদে যে অকারণ ভেজে সে তো পাগল…নয় মাথা খারাপ।’

‘মাথা খারাপ?’

‘ওই হলো যাহা মাথা খারাপ তাহাই পাগল। তুমি পাগল।’

‘আমি পাগল মানে মাথায় গণ্ডগোল আমার?’

‘বলতে পারো…তবু এই পাগলকে ভালবাসি। আমার পাগল। এখন তুমি বলো কী বলতে চাইছিলে?’

 

শিহাব কিছু বলতে পারল না। রুকু তার বাঁ-হাত নিজের দু-হাতের মধ্যে নিয়েছে। এমন করে যে মেয়েটি তাকে ভালবাসে, সে ওই কথা জিজ্ঞেস করতে পারবে না। ভুলে যাবে। ভুলে যাওয়া সবচেয়ে ভালো। সে ডানহাতের দু-আঙুলে ধরে থাকা প্রায় নিঃশেষ সিগারেট নদীর দিকে ছুড়ে ফেলে। সেটি পানিতে পড়ে চুপ করে নিভে গেল কি না কে জানে, মনে হলো মাথার মধ্যে গুবরেপোকা থেমে গেছে। নিশ্চুপ স্থবির। সে রুকুর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে, –

‘চলো উঠি…যেতে হবে।’

‘আর একটু বসি। বেশ চমৎকার বাতাস।’

‘বাসন্তিক বাতাসে শীত লাগে। ক্ষতি হতে পারে। এখনই যেতে চাইলে আবার না…চলো ফেরা যাক।’

‘চারিদিকে আর একটু আঁধার নামুক। সেই আঁধারে মনের দৃষ্টিতে আমরা দু-জন দু-জনকে দেখব।’

‘এখন তোমারই কাব্য হচ্ছে।’

‘সঙ্গদোষ বুঝলে! বলো না কী বলবে বলছিলে?’

‘থাক সে-সব কথা, না শোনাই ভালো।’

‘আমার ঘুম হবে না। কী বলতে চেয়েছিলে তুমি?’

‘কিছু বলতে চাইনি তো!’

‘মোটেও না। তুমি তখন থেকে কয়েকবার বলেছ, কিছু কথা আছে; এখন চেপে যাচ্ছ কেন?’

‘বাদ দাও তো রুকু। চলো ফিরে যাই, পথঘাট ভালো না।’

‘না তোমাকে বলতে হবে। আগে শুনব তারপর যাব।’

‘তেমন কোনো কথা নয়…আচ্ছা চলো বাসায় গিয়ে বলব। এখানে রাত হয়ে যাবে।’

‘হোক। গভীর অন্ধকার রাত…কালো ভয়ার্ত, তুমি তো আছো। এখানে আমার আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছে। তুমি বলো আমি শুনব।’

শিহাব উঠে দাঁড়াতে চাইল। পারল না। রুকু তার হাত টেনে ধরে আছে। সন্ধে হয়ে আসে। দিগন্ত বিস্তৃত ফ্যাকাশে ধূসর ছায়া হাত-পা ছড়িয়ে নিচে নামে। এখন ধীরে ধীরে সবকিছু গভীর কালো অন্ধকার হয়ে যাবে। এখানে শহরের নিয়ন আলো নেই। যেখানে আঁধার থাকতে পারে না অথবা হারিয়ে যায়। মুখোশে ঢাকা মানুষের চেহারা দেখে সুখী-অসুখী বোঝা যায় না। শিহাব নিজের মধ্যে সেই গুবরেপোকাকে আবার সচল হতে উপলব্ধি করে। পিলপিল করে মনের দেয়ালে হাঁটছে। সেটির শরীরে কি শুয়োপোকার মতো সুচালো লোম? হলাহল বিষ? তার সর্বাঙ্গে যে বিষের যাতনা ছড়িয়ে যেতে থাকে। সে কিছু বলতে পারে না। স্থবির জড়-জঙ্গম অস্তিত্বের মতো নদীর পানি দেখতে চায়। সেখানে আলোছায়া অন্ধকার। কোনোকিছু স্বচ্ছ দেখা যায় না।

 

শিহাব আলগোছে রুকুর পিঠে বাঁ-হাত রাখে। আবেগে কাছে টেনে নেয়। তখন রুকু দু-হাত দিয়ে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে। দূরের আকাশে একটি-দুটি তারা ঝিলমিল জেগে ওঠে। আলোছায়া হালকা অন্ধকারে সেগুলো রহস্যের চিত্রকলা সাজাতে থাকে। শিহাবের মনে হয়, এই ছায়া-ম্লান-সন্ধের অন্ধকারে মুখ লুকানো খুব সহজ অথবা লুকিয়ে থাকা চেহারা দেখানোর ঝুঁকি নেই। দেখলেও বোঝা যায় না। সে নিজেকে লুকিয়ে রাখার অসম্ভব তাগিদ খুঁজে পায়। সে রুকুকে ওই কথা বলতে পারবে না। তারপর আকস্মিক শিহাবের মাথায় পোকাটি আচম্বিত টোকা মারে। সে শিহরে ওঠে।

‘তুমি রাজিমকে কত দিন ধরে চেনো?’

রুকু কি কেঁপে উঠল? নদীর জলে কোনো বুনো প্রাণি ঝাপিয়ে পড়ে? মনে হয় ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়ে গেল আলোছায়া অন্ধকারে। আমবাগানের উত্তর প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছে শকুনগুলো ডানা ঝাপটায়। তারপর নিস্তরঙ্গ দূরত্যয় সময়। শিহাব নিজের কাছে যন্ত্রণাবিদ্ধ জিজ্ঞাসায় থমকে গেছে। সে প্রশ্ন কত সহজে করে ফেলে, অথচ এ নিয়ে প্রায় সাতটি দিন নিজের সঙ্গে অসম্ভব বোঝাপড়া। আসলে সে একজন পরশ্রীকাতর হীনম্মন্য মানুষ। নিজের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। যে নিজের উপর আস্থা রাখতে পারে না, অন্যের প্রতি রাখবে কী করে? সে সুখের বর্তমান আর সম্ভাবনার আগামী ছেড়ে অতীতের কপিশ কানাগলিতে হাঁটতে চাইছে। কোনো অবিশ্বাস কোনো ভুল খনন করতে ব্যস্ত। সে থমকে গেল। কী বলবে কিংবা কোনোকিছুর অপেক্ষা ভেবে কূল পায় না সে।

‘এজন্যে তুমি কয়েকদিন কষ্ট করলে? আগে বলতে সাহস হলো না?’

‘আমি দুঃখিত রুকু, ঠিক এ কথাটি বলতে চাইছিলাম না। সরি…সত্যি অত্যন্ত দুঃখিত। চলো এখন ফিরি।’

‘না জেনেই ফিরবে? বসো তোমাকে খুলে বলি। আমি জানি না কী জেনেছ বা শুনেছ অথবা যদি বলি যা তুমি জেনেছ বা শুনেছ, সব মিথ্যে; তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অথবা যদি ধরে নাও সে এক দুর্ঘটনা তা হলে কী করবে? এ হলো অতীতের গোলকধাঁধা রক্তাক্ত খনন আর বেদনাময়, তাকে তুমি ডেকে এনেছ; ফেরাবে কেন? মুখোমুখি হও।’

 

শিহাবের বাঁ-কাঁধ থেকে রুকু মাথা সরিয়ে নেয়। শিহাব দেখে তার পাশে অন্ধকার রহস্যময় ছায়া। তার ঠোঁটে কিছুক্ষণ আগে সুর ছিল। তখন তার মনে হয়, এই মেয়েটি তার বউ…নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘ তিন বছরে কীভাবে একজন অন্যজনের অঙ্গ হয়ে গেছে! সে কি প্রেম না আত্মার যোগসূত্র? অথচ একটি প্রশ্নে দু-জনের মাঝখানে বোধাতীত অদৃশ্য কাচের মিহি দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল।

‘আমি কোনোকিছু জানতে চাই না। আমাকে ক্ষমা করে দাও রুকু।’

‘সে কী করে হয় বলো? নিজের মনকে খুঁচিয়ে তুলেছ। পুরো ঘটনা শোনো। তারপর বিচার করবে। নয়তো নিজেকে প্রতারিত ভাববে। আজ বলছ জানতে চাই না, দু-দিন পর আবার কৌতূহলী মন জেগে উঠবে। কষ্ট পাবে।…রাজিমকে পাঁচ ছয় বছর ধরে চিনি। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে…।’

 

শিহাবের কানে কোনো কথা যায় না। তখন তার দু-চোখে ফ্লাসব্যাক। ছায়াছবির রিলের মতো দ্রুত ছুটে চলে। সেদিন বিকেলে অফিসে দু-জন লোক এলো। নাম পরিচয় আর নানা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জানা যায়, শ্বশুরবাড়ি এলাকার লোক। সে বেশ যত্ন নিয়ে আপ্যায়ন করে।

‘বুঝলেন শিহাব সাহেব, আপনার শ্বশুরবাড়ির পশ্চিমের গ্রাম সরকারপুর। সেখানে এক বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশুনা করেছি। আপনার মিসেস তখন স্কুলে পড়ে। সিক্স বা সেভেনে। স্যারের মেয়ে। তাকে পড়াবার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। সে এক সুন্দর স্মৃতিময় দিন।’

‘আমার মিসেস তো বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেনি।’

‘আ রে ভাই, মায়ের কাছে মাসির গল্প আর কী করবেন? আমি তো জানি। তবে অসম্ভব মেধাবী সে।’

‘এসব কথা আমাকে বলছেন কেন? যে কাজে এসেছেন…।’

‘আমরা এ কাজেই এসেছি। আপনি কি জানেন, আপনাকে ঠকানো হয়েছে?’

‘মানে?’

‘শোনেন রুকুর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। আমরা বিয়ে করতাম। কিন্তু শালা হাজী সাদিক চৌধুরি রাজি হলো না।’

 

এরপর কী কথা হয় কানে যায় না। সেই থেকে একটি গুবরেপোকা মাথায় বাসা বেঁধে নেয়। নানা কল্পনা দৃশ্যপট আর জিজ্ঞাসার অস্থিরতায় তীব্র আঘাত শুরু করে। সে কোনো কাজ করতে পারে না। ফাইল খুলে আনমনা হয়ে পড়ে। দু-চোখের দৃষ্টি কোনো দিগন্তে ছুটে যায়। ঝাপসা হয়ে পড়ে। রাতে ঘুমোতে পারে না। কখনো ভাবে, সে খুব নগন্য একজন মানুষ, হীনম্মন্যতা যার সঙ্গী; কখনো মহান দেবতুল্য। না সে পেছনে তাকাবে না। রুকুকে ভালবাসে সে। রুকুর ভালবাসা তাকে পৃথিবীর সুখী মানুষ করেছে। আবার কখনো গুবরেপোকা খুঁচিয়ে তোলে। তাকে ঠকানো হয়েছে। সে একজন প্রতারিত মানুষ। বোকারা প্রতারণার শিকার হয়? সে বোকা মানুষ। বোকা মানুষেরা হতভাগ্য। এ সমাজে টিকে থাকার উপযুক্ত নয়। সে ব্যর্থ…প্রতারিত মানুষ। এই প্রবঞ্চনার সকল দায় অন্য কারও অথবা তার নিজের একার। পোকাটির আস্ফালিত বিচরণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। অভিশংসনের সহস্র বিষকাঁটা প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর ঝাঁজরা করে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে গজিয়ে ওঠে অবিশ্বাস। পরাজয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অন্ধকার গহ্বর। সে কখনো রুকুকে সেখানে ডেকে নিতে চায়নি। কেমন করে যে কী হয়ে গেল! সে নিস্তব্ধতার দেয়ালে নিজের বুকে প্রপঞ্চকথনের লিপি লিখে যায়। সেখানে কোনো সঙ্গীর উপস্থিতি নেই। নিজেকে তার খুব অসহায় একা লাগে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চমকে ওঠে। রুকু তাকে ধাক্কা দিয়ে চলেছে।

‘আমি জানতাম, তুমি আমার সবকিছু জানো। যদি না জেনে থাকো, জেনে নেয়া ভালো; শুধু শুধু কষ্ট পেলে। আর তা পাবে কেন?’

‘আমি কোনোকিছু জানতে চাই না। তুমি আছো, সামনে আগামী আছে; আর কী?’

‘রাজিম আমার গৃহশিক্ষক ছিল। আমাকে পড়াত। কৈশোরের কোনো সময়ে দুর্বল হতে পারি, কিন্তু এমন কিছু নয় যা নিয়ে তোমাকে ঠকানোর গল্প হতে পারে।’

‘রুকু এ প্রসঙ্গ থাক। আমার ভালো লাগছে না।’

‘এখন তুমি সে-সময়ের মুখোমুখি হতে চাইছিলে। আমাকে এই নির্জন নদীকূলে নিয়ে এলে। তার সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছো? আর তা পেলে আমি ছাড়ব কেন? কালকের সকালে তুমি আমার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকাবে এ আমি হতে দিতে পারি না।’

‘বেশ বলো। হাজার মিথ্যে আঘাতের চেয়ে একটি সত্যের মুখোমুখি হওয়া অনেক ভালো।’

‘ওই লোক আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমি যা কোনোদিন কল্পনা করিনি। শুনেছি সে দাদার কাছে প্রস্তাব দেয়। দাদা রাজি হননি। তাকে পড়াতে নিষেধ করে দেয়া হয়। তখন রাজিম রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দিতে থাকে। সে আমার স্কুল যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকত। আমার পড়ালেখা হয়নি। খালার বাসায় গিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হই। সেখানেও হানা দেয়। নানান আজেবাজে কথা প্রচার করে।’

‘তোমার গর্ভপাত করা হয়েছিল।’

‘তোমার কী মনে হয়?’

‘তুমি আমার কাছে পবিত্র ফুলের মতো। রুকু আমি তোমাকে প্রচণ্ডরকম ভালবাসি।’

‘আমিও!’

 

শিহাব বেশ জোরে রুকুকে বুকে টেনে ধরে। তখন আকাশের কোণায় চাঁদ জেগে উঠেছে। তারা কিছু দূর হেঁটে এসে রিকশা নেয়। ঝোপঝাড়ের অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। ঘনীভূত হয় রাস্তায় মানুষজনের কোলাহল। সে-সবের মধ্যে একটি গুবরেপোকা রুকুর ভাবনায় জায়গা খুঁজে পায়। সেখানে যুৎ করে বাসা বাঁধে। পোকাটি তীব্র আর্তস্বরে কাঁদাতে চায় তাকে। অস্থির অসহনীয় যন্ত্রণা। তার দু-চোখ ভিজে আসে বারবার। শিহাবের বাঁ-কাঁধে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে পরম নির্ভরতা খোঁজে। সে জানে না মানুষটির কাছে সেটি আছে কি না! শিহাব তাকে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। তখন রুকুর কেবলই মনে হয়, ভালবাসায় কোনো সন্দেহ চলে না বন্ধু।                                  

 

তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাচ্ছিল। তখন আকাশে গোধূলির বড় ডিম-কুসুম সূর্য জ্বলজ্বল রহস্যময়। রুকুর নোজপিনের চুনি পাথরে কোমল বিচ্ছুরণ মাতামাতি করছে। সামনে আত্রাই নদীর পাড়। সমুদ্র বেলাভূমির মতো দীর্ঘ প্রশস্ত বালিয়াড়ি; তারপর নদীর জল। সেদিকে তাকিয়ে আর একবার মনে হয়, এটি একসময় নদী ছিল; এখন শীর্ণ নালা। তার জীবনে বিশ্বাস আর ভালবাসার উদ্দামতার মতো শুকিয়ে যাওয়ার পথে। একদিন এ নদী হারিয়ে যাবে। রেখে যাবে দাগ। সে দাগ তার বুকের মধ্যে ক্ষতের মতো। অথচ এমন তো ছিল না…কোনোদিন ভাবেনি। কিছু কিছু বিষয় আছে, অতীতে ফেলে রাখতে হয়। কবরে কফিন শুইয়ে রাখার মতো। তাকে জাগাতে নেই। তবু মন মানে না। শুনছে না। সে কবর খুঁড়ে প্রেতাত্মার চেহারা দেখতে উন্মুখ হয়ে উঠেছে। রুকু নিশ্চুপ বসে থাকে। তার দৃষ্টি দূর অজানা আকাশে। শিহাব সেদিকে তাকিয়ে নিজের প্রতি অসম্ভব করুণা করে বসল। কথায় বলে অতীতে বিচরণ শুধু দুঃখ টেনে নিয়ে আসে। সে তা হলে জেনে-শুনে ভুল কাজে হাত দিয়েছে।

নদীর ওপারে অনেক দীর্ঘ আমবাগান। তার শেষ-প্রান্তে উত্তর কোণায় মাথা উঁচু দুটো শিমুল গাছ। মগডালে কতগুলো শকুন। এখন এই পাখিদের খুব একটা দেখা যায় না। শিহাব একদৃষ্টিতে সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। বসন্ত ঋতু। ডালে ডালে থোকা থোকা লাল শিমুল। কিছু নতুন সবুজ পাতার আগমনী সংকেত। আকাশের গোধূলি লালিমা, পাতার সজীবতা; এসবের মধ্যে খয়েরি শকুনের দল অদ্ভুত বিমূর্ত দৃশ্যপট এঁকে যায়। এমন পটভূমিকায় কোনোকিছু বলতে ইচ্ছে করে না। উপায় নেই। কথা বলতে হবে। মন শুনতে আর জানতে উৎসুক। কয়েকদিন ধরে মাথার মধ্যে সেই নোংরা পোকা প্রচণ্ড দাপটে হেঁটে বেড়াতে শুরু করেছে। সেটি দেখতে হয়তো গুবরেপোকার মতো। কালো শক্ত খোলস। ভয়ানক বিদঘুটে। আধ-শুকনো গোবরের ভেতরে কোনো কোমল নরম আর আদ্র ঘা খুঁজে বেড়ায়। শিহাব নিজেকে হীনম্মন্য আর স্বার্থপর মানুষ হিসেবে শনাক্ত করে ফেলে। বুঝতে পারে অস্থির বাতিকের নাগপাশ। তারপরও…।

রুকু নদীর বুক বেয়ে ভেসে আসা বাতাসে মন-প্রাণ ডুবিয়ে দিয়েছে। মুহূর্ত জুড়ে উপলব্ধিতে খুব ভালোলাগা প্রশান্তি। সে দেখতে পায় না, হয়তো বুঝতেও, শিহাব তার মুখের দিকে অবিমিশ্র মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার কাঁধের উপর নীল ব্লাউজের ভেতর দিয়ে সাদা অর্ন্তবাসের ফিতে উদ্ভাসিত। সেখানে ছড়িয়ে পড়া একরাশ চুল মৃদু বাতাসে থিরথির কাঁপে। সে কি নিজের মধ্যে গভীর মগ্ন হয়ে গেছে? সেখানে তার কোনো জায়গা নেই? শিহাব পলকহীন তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে ভাবতে একসময় দৃষ্টি ঘুরিয়ে সূর্যের দিকে তাকায়। সূর্য হলো সত্যের মতো, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যায় না; দু-চোখ অন্ধ হয়ে পড়ে। অনেকসময় চরম কোনো সত্য কাউকে অন্ধ করে দেয়। তার সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। সে তখন মিথ্যের উপর দাঁড়িয়ে শত রকম ভাবে। তাকে পরিক্রমণ করতে করতে গোলকধাঁধার গ্রহাণুতে রূপান্তরিত হয়। ততক্ষণ জীবন থেকে সব সরে যায়। হারিয়ে যাওয়া সময় আর ফেরে না। তার মধ্যে এরকম ভাবনায় আত্মশ্লাঘার অনুরণন দানা বেঁধে ওঠে। নিজেকে মহৎ ভাবার কল্পিত পথ খুঁজে পায়।

রুকু গুনগুন করে সুর ধরেছে, ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো’। শিহাবের জীবন শুকোতে শুরু করে। একটি পোকা, জঘন্য নোংরা কদর্য; তার মনের সূক্ষ্ম রেখা ধরে প্রচণ্ড স্বেচ্ছাচারীর মতো হেঁটে চলে। অসহনীয় সুড়সুড়ি। তীক্ষ্ণ জ্বালা। সে রুকুকে কিছু বলল না। চুপ করে শুনে গেল কয়েকটি লাইন। তখন নদীর টলটলে পানিতে কতগুলো চড়ুই কিচিরমিচির স্নান সেরে আকাশে উড়ে যায়। সে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ-তন্ময় বিভোর। এও ভালো…কঠিন বাস্তবতার মধ্যে একটু কল্পনা একটু স্বপ্নদোলা সকল ক্লেদ ভুলিয়ে দেয়। রুকু তার দিকে তাকিয়ে আকস্মিক বলে বসে, –

‘চলো যাই। নাকি কাব্য করবে আরও কিছুক্ষণ? কিছু তো বললে না। কী বলতে চাইছিলে?’

‘উঁ…না তেমনকিছু নয়। দেখেছ কেমন আশ্চর্য মৌনতা! নিস্তব্ধতার মধ্যে স্বর্গীয় সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, তাই না?’

‘কি জানি বাবা! আমি কবি নই। কবিতা লিখি না তোমার মতো। ওসব পাগলের কাজ।’

‘আমি পাগল?’

‘তাই তো! দুপুরের রোদে যে অকারণ ভেজে সে তো পাগল…নয় মাথা খারাপ।’

‘মাথা খারাপ?’

‘ওই হলো যাহা মাথা খারাপ তাহাই পাগল। তুমি পাগল।’

‘আমি পাগল মানে মাথায় গণ্ডগোল আমার?’

‘বলতে পারো…তবু এই পাগলকে ভালবাসি। আমার পাগল। এখন তুমি বলো কী বলতে চাইছিলে?’

 

শিহাব কিছু বলতে পারল না। রুকু তার বাঁ-হাত নিজের দু-হাতের মধ্যে নিয়েছে। এমন করে যে মেয়েটি তাকে ভালবাসে, সে ওই কথা জিজ্ঞেস করতে পারবে না। ভুলে যাবে। ভুলে যাওয়া সবচেয়ে ভালো। সে ডানহাতের দু-আঙুলে ধরে থাকা প্রায় নিঃশেষ সিগারেট নদীর দিকে ছুড়ে ফেলে। সেটি পানিতে পড়ে চুপ করে নিভে গেল কি না কে জানে, মনে হলো মাথার মধ্যে গুবরেপোকা থেমে গেছে। নিশ্চুপ স্থবির। সে রুকুর হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে, –

‘চলো উঠি…যেতে হবে।’

‘আর একটু বসি। বেশ চমৎকার বাতাস।’

‘বাসন্তিক বাতাসে শীত লাগে। ক্ষতি হতে পারে। এখনই যেতে চাইলে আবার না…চলো ফেরা যাক।’

‘চারিদিকে আর একটু আঁধার নামুক। সেই আঁধারে মনের দৃষ্টিতে আমরা দু-জন দু-জনকে দেখব।’

‘এখন তোমারই কাব্য হচ্ছে।’

‘সঙ্গদোষ বুঝলে! বলো না কী বলবে বলছিলে?’

‘থাক সে-সব কথা, না শোনাই ভালো।’

‘আমার ঘুম হবে না। কী বলতে চেয়েছিলে তুমি?’

‘কিছু বলতে চাইনি তো!’

‘মোটেও না। তুমি তখন থেকে কয়েকবার বলেছ, কিছু কথা আছে; এখন চেপে যাচ্ছ কেন?’

‘বাদ দাও তো রুকু। চলো ফিরে যাই, পথঘাট ভালো না।’

‘না তোমাকে বলতে হবে। আগে শুনব তারপর যাব।’

‘তেমন কোনো কথা নয়…আচ্ছা চলো বাসায় গিয়ে বলব। এখানে রাত হয়ে যাবে।’

‘হোক। গভীর অন্ধকার রাত…কালো ভয়ার্ত, তুমি তো আছো। এখানে আমার আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছে। তুমি বলো আমি শুনব।’

শিহাব উঠে দাঁড়াতে চাইল। পারল না। রুকু তার হাত টেনে ধরে আছে। সন্ধে হয়ে আসে। দিগন্ত বিস্তৃত ফ্যাকাশে ধূসর ছায়া হাত-পা ছড়িয়ে নিচে নামে। এখন ধীরে ধীরে সবকিছু গভীর কালো অন্ধকার হয়ে যাবে। এখানে শহরের নিয়ন আলো নেই। যেখানে আঁধার থাকতে পারে না অথবা হারিয়ে যায়। মুখোশে ঢাকা মানুষের চেহারা দেখে সুখী-অসুখী বোঝা যায় না। শিহাব নিজের মধ্যে সেই গুবরেপোকাকে আবার সচল হতে উপলব্ধি করে। পিলপিল করে মনের দেয়ালে হাঁটছে। সেটির শরীরে কি শুয়োপোকার মতো সুচালো লোম? হলাহল বিষ? তার সর্বাঙ্গে যে বিষের যাতনা ছড়িয়ে যেতে থাকে। সে কিছু বলতে পারে না। স্থবির জড়-জঙ্গম অস্তিত্বের মতো নদীর পানি দেখতে চায়। সেখানে আলোছায়া অন্ধকার। কোনোকিছু স্বচ্ছ দেখা যায় না।

 

শিহাব আলগোছে রুকুর পিঠে বাঁ-হাত রাখে। আবেগে কাছে টেনে নেয়। তখন রুকু দু-হাত দিয়ে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে। দূরের আকাশে একটি-দুটি তারা ঝিলমিল জেগে ওঠে। আলোছায়া হালকা অন্ধকারে সেগুলো রহস্যের চিত্রকলা সাজাতে থাকে। শিহাবের মনে হয়, এই ছায়া-ম্লান-সন্ধের অন্ধকারে মুখ লুকানো খুব সহজ অথবা লুকিয়ে থাকা চেহারা দেখানোর ঝুঁকি নেই। দেখলেও বোঝা যায় না। সে নিজেকে লুকিয়ে রাখার অসম্ভব তাগিদ খুঁজে পায়। সে রুকুকে ওই কথা বলতে পারবে না। তারপর আকস্মিক শিহাবের মাথায় পোকাটি আচম্বিত টোকা মারে। সে শিহরে ওঠে।

‘তুমি রাজিমকে কত দিন ধরে চেনো?’

রুকু কি কেঁপে উঠল? নদীর জলে কোনো বুনো প্রাণি ঝাপিয়ে পড়ে? মনে হয় ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়ে গেল আলোছায়া অন্ধকারে। আমবাগানের উত্তর প্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শিমুল গাছে শকুনগুলো ডানা ঝাপটায়। তারপর নিস্তরঙ্গ দূরত্যয় সময়। শিহাব নিজের কাছে যন্ত্রণাবিদ্ধ জিজ্ঞাসায় থমকে গেছে। সে প্রশ্ন কত সহজে করে ফেলে, অথচ এ নিয়ে প্রায় সাতটি দিন নিজের সঙ্গে অসম্ভব বোঝাপড়া। আসলে সে একজন পরশ্রীকাতর হীনম্মন্য মানুষ। নিজের প্রতি কোনো বিশ্বাস নেই। যে নিজের উপর আস্থা রাখতে পারে না, অন্যের প্রতি রাখবে কী করে? সে সুখের বর্তমান আর সম্ভাবনার আগামী ছেড়ে অতীতের কপিশ কানাগলিতে হাঁটতে চাইছে। কোনো অবিশ্বাস কোনো ভুল খনন করতে ব্যস্ত। সে থমকে গেল। কী বলবে কিংবা কোনোকিছুর অপেক্ষা ভেবে কূল পায় না সে।

‘এজন্যে তুমি কয়েকদিন কষ্ট করলে? আগে বলতে সাহস হলো না?’

‘আমি দুঃখিত রুকু, ঠিক এ কথাটি বলতে চাইছিলাম না। সরি…সত্যি অত্যন্ত দুঃখিত। চলো এখন ফিরি।’

‘না জেনেই ফিরবে? বসো তোমাকে খুলে বলি। আমি জানি না কী জেনেছ বা শুনেছ অথবা যদি বলি যা তুমি জেনেছ বা শুনেছ, সব মিথ্যে; তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অথবা যদি ধরে নাও সে এক দুর্ঘটনা তা হলে কী করবে? এ হলো অতীতের গোলকধাঁধা রক্তাক্ত খনন আর বেদনাময়, তাকে তুমি ডেকে এনেছ; ফেরাবে কেন? মুখোমুখি হও।’

 

শিহাবের বাঁ-কাঁধ থেকে রুকু মাথা সরিয়ে নেয়। শিহাব দেখে তার পাশে অন্ধকার রহস্যময় ছায়া। তার ঠোঁটে কিছুক্ষণ আগে সুর ছিল। তখন তার মনে হয়, এই মেয়েটি তার বউ…নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘ তিন বছরে কীভাবে একজন অন্যজনের অঙ্গ হয়ে গেছে! সে কি প্রেম না আত্মার যোগসূত্র? অথচ একটি প্রশ্নে দু-জনের মাঝখানে বোধাতীত অদৃশ্য কাচের মিহি দেয়াল দাঁড়িয়ে গেল।

‘আমি কোনোকিছু জানতে চাই না। আমাকে ক্ষমা করে দাও রুকু।’

‘সে কী করে হয় বলো? নিজের মনকে খুঁচিয়ে তুলেছ। পুরো ঘটনা শোনো। তারপর বিচার করবে। নয়তো নিজেকে প্রতারিত ভাববে। আজ বলছ জানতে চাই না, দু-দিন পর আবার কৌতূহলী মন জেগে উঠবে। কষ্ট পাবে।…রাজিমকে পাঁচ ছয় বছর ধরে চিনি। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে…।’

 

শিহাবের কানে কোনো কথা যায় না। তখন তার দু-চোখে ফ্লাসব্যাক। ছায়াছবির রিলের মতো দ্রুত ছুটে চলে। সেদিন বিকেলে অফিসে দু-জন লোক এলো। নাম পরিচয় আর নানা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে জানা যায়, শ্বশুরবাড়ি এলাকার লোক। সে বেশ যত্ন নিয়ে আপ্যায়ন করে।

‘বুঝলেন শিহাব সাহেব, আপনার শ্বশুরবাড়ির পশ্চিমের গ্রাম সরকারপুর। সেখানে এক বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশুনা করেছি। আপনার মিসেস তখন স্কুলে পড়ে। সিক্স বা সেভেনে। স্যারের মেয়ে। তাকে পড়াবার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। সে এক সুন্দর স্মৃতিময় দিন।’

‘আমার মিসেস তো বেশি দূর পড়াশুনা করতে পারেনি।’

‘আ রে ভাই, মায়ের কাছে মাসির গল্প আর কী করবেন? আমি তো জানি। তবে অসম্ভব মেধাবী সে।’

‘এসব কথা আমাকে বলছেন কেন? যে কাজে এসেছেন…।’

‘আমরা এ কাজেই এসেছি। আপনি কি জানেন, আপনাকে ঠকানো হয়েছে?’

‘মানে?’

‘শোনেন রুকুর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। আমরা বিয়ে করতাম। কিন্তু শালা হাজী সাদিক চৌধুরি রাজি হলো না।’

 

এরপর কী কথা হয় কানে যায় না। সেই থেকে একটি গুবরেপোকা মাথায় বাসা বেঁধে নেয়। নানা কল্পনা দৃশ্যপট আর জিজ্ঞাসার অস্থিরতায় তীব্র আঘাত শুরু করে। সে কোনো কাজ করতে পারে না। ফাইল খুলে আনমনা হয়ে পড়ে। দু-চোখের দৃষ্টি কোনো দিগন্তে ছুটে যায়। ঝাপসা হয়ে পড়ে। রাতে ঘুমোতে পারে না। কখনো ভাবে, সে খুব নগন্য একজন মানুষ, হীনম্মন্যতা যার সঙ্গী; কখনো মহান দেবতুল্য। না সে পেছনে তাকাবে না। রুকুকে ভালবাসে সে। রুকুর ভালবাসা তাকে পৃথিবীর সুখী মানুষ করেছে। আবার কখনো গুবরেপোকা খুঁচিয়ে তোলে। তাকে ঠকানো হয়েছে। সে একজন প্রতারিত মানুষ। বোকারা প্রতারণার শিকার হয়? সে বোকা মানুষ। বোকা মানুষেরা হতভাগ্য। এ সমাজে টিকে থাকার উপযুক্ত নয়। সে ব্যর্থ…প্রতারিত মানুষ। এই প্রবঞ্চনার সকল দায় অন্য কারও অথবা তার নিজের একার। পোকাটির আস্ফালিত বিচরণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। অভিশংসনের সহস্র বিষকাঁটা প্রতিটি মুহূর্ত বুকের ভেতর ঝাঁজরা করে দিতে থাকে। ধীরে ধীরে গজিয়ে ওঠে অবিশ্বাস। পরাজয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক অন্ধকার গহ্বর। সে কখনো রুকুকে সেখানে ডেকে নিতে চায়নি। কেমন করে যে কী হয়ে গেল! সে নিস্তব্ধতার দেয়ালে নিজের বুকে প্রপঞ্চকথনের লিপি লিখে যায়। সেখানে কোনো সঙ্গীর উপস্থিতি নেই। নিজেকে তার খুব অসহায় একা লাগে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চমকে ওঠে। রুকু তাকে ধাক্কা দিয়ে চলেছে।

‘আমি জানতাম, তুমি আমার সবকিছু জানো। যদি না জেনে থাকো, জেনে নেয়া ভালো; শুধু শুধু কষ্ট পেলে। আর তা পাবে কেন?’

‘আমি কোনোকিছু জানতে চাই না। তুমি আছো, সামনে আগামী আছে; আর কী?’

‘রাজিম আমার গৃহশিক্ষক ছিল। আমাকে পড়াত। কৈশোরের কোনো সময়ে দুর্বল হতে পারি, কিন্তু এমন কিছু নয় যা নিয়ে তোমাকে ঠকানোর গল্প হতে পারে।’

‘রুকু এ প্রসঙ্গ থাক। আমার ভালো লাগছে না।’

‘এখন তুমি সে-সময়ের মুখোমুখি হতে চাইছিলে। আমাকে এই নির্জন নদীকূলে নিয়ে এলে। তার সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছো? আর তা পেলে আমি ছাড়ব কেন? কালকের সকালে তুমি আমার দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকাবে এ আমি হতে দিতে পারি না।’

‘বেশ বলো। হাজার মিথ্যে আঘাতের চেয়ে একটি সত্যের মুখোমুখি হওয়া অনেক ভালো।’

‘ওই লোক আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আমি যা কোনোদিন কল্পনা করিনি। শুনেছি সে দাদার কাছে প্রস্তাব দেয়। দাদা রাজি হননি। তাকে পড়াতে নিষেধ করে দেয়া হয়। তখন রাজিম রাস্তা থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দিতে থাকে। সে আমার স্কুল যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকত। আমার পড়ালেখা হয়নি। খালার বাসায় গিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হই। সেখানেও হানা দেয়। নানান আজেবাজে কথা প্রচার করে।’

‘তোমার গর্ভপাত করা হয়েছিল।’

‘তোমার কী মনে হয়?’

‘তুমি আমার কাছে পবিত্র ফুলের মতো। রুকু আমি তোমাকে প্রচণ্ডরকম ভালবাসি।’

‘আমিও!’

 

শিহাব বেশ জোরে রুকুকে বুকে টেনে ধরে। তখন আকাশের কোণায় চাঁদ জেগে উঠেছে। তারা কিছু দূর হেঁটে এসে রিকশা নেয়। ঝোপঝাড়ের অন্ধকার ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকে। ঘনীভূত হয় রাস্তায় মানুষজনের কোলাহল। সে-সবের মধ্যে একটি গুবরেপোকা রুকুর ভাবনায় জায়গা খুঁজে পায়। সেখানে যুৎ করে বাসা বাঁধে। পোকাটি তীব্র আর্তস্বরে কাঁদাতে চায় তাকে। অস্থির অসহনীয় যন্ত্রণা। তার দু-চোখ ভিজে আসে বারবার। শিহাবের বাঁ-কাঁধে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে পরম নির্ভরতা খোঁজে। সে জানে না মানুষটির কাছে সেটি আছে কি না! শিহাব তাকে হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। তখন রুকুর কেবলই মনে হয়, ভালবাসায় কোনো সন্দেহ চলে না বন্ধু।                                  

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত