জার্মান সাহিত্যিক ভল্ফ্গাং বরশ্যর্টের জন্ম হয়েছিল ১৯২১ সালে জার্মানির হামবুর্গে এবং দেহাবসান হয় ১৯৪৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাজেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক হিসেবে ফ্রন্টে লড়াই করেছেন; যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তার লেখা গল্প, কবিতা এবং নাটকের বক্তব্য সাধারণ মানুষের দিনযাপনের দুঃখকষ্ট তুলে ধরেছিল।
ভাষান্তর- নন্দিনী সেনগুপ্ত
তার হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মাঝরাত। আড়াইটে বাজে। প্রথমে সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিল না যে এরকম সময়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো কেন! উফফ… একটা অস্বস্তি হচ্ছিল তার!
আচ্ছা, রান্নাঘরে কে যেন চেয়ার সরাচ্ছে। সে কান খাড়া করল। নাহ, সব চুপচাপ। বড্ড বেশি চুপচাপ। সে পাশ ফিরে হাতটা বাড়িয়ে দেখলো যে বিছানার একপাশ ফাঁকা। লোকটা নেই। ঠিক; সেজন্য বড্ড বেশি চুপচাপ ঠেকছে। লোকটার নাক ডাকার আওয়াজটা, নিঃশ্বাসের শব্দটাই নেই।
সে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধকার ফ্ল্যাটের মধ্য দিয়ে পা টিপে টিপে সে রান্নাঘরের দিকে যায়। কিচেন ক্যাবিনেটের সামনে একটা সাদা অবয়ব দেখতে পায়। লোকটা রাত্তিরে এই সাদা রাতপোশাকটা পরে ঘুমোয়। তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে আলো জ্বালে। মাঝরাতে রান্নাঘরে তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়। ঘড়িতে তখন আড়াইটে বাজে। রাতপোশাক পরা দুটি মানুষ রান্নাঘরে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়।
মধ্যরাতে আড়াইটের সময়। রান্নাঘরে। খাবার টেবিলে রুটির খালি পাত্রটা রাখা। সে বুঝতে পারছে যে নির্ঘাত লোকটা রুটির টুকরো কেটেছে। ছুরিটা পড়ে আছে থালায়। টেবিলক্লথে রুটির গুঁড়ো। অথচ রাতে ঘুমোতে যাবার আগে সে সব পরিষ্কার করে গিয়েছিল। রোজই করে। অভ্যেস।
তার হঠাৎ খুব শীত করে। মেঝের টালিগুলো হঠাৎ খুব ঠাণ্ডা মনে হয় তার। সে জোর করে এঁটো পাত্রটার দিক থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
‘হ্যাঁ, কিসের একটা আওয়াজ শুনলাম, বুঝলে!’ লোকটা বলে যায়, ‘মনে হল যেন কি একটা, তাই… উঠে দেখতে এলাম।’ বলে লোকটা রান্নাঘরে চারপাশে তাকায়।
‘হ্যাঁ, আমিও শুনেছি একটা আওয়াজ।’ সে জবাব দেয়। জবাব দিতে দিতে তার হঠাৎ মনে হয় লোকটাকে অতিরিক্ত বুড়োটে দেখাচ্ছে রাতপোশাক পরা অবস্থায় । মানে, যত বয়স, ততটাই… মাঝরাতে হঠাৎ তেষট্টি বছর বয়সটা তার মনে হয় খুব বেশি। আসলে দিনের বেলা লোকটাকে এতটা বুড়োটে দেখায় না, বেশ কমবয়সী মনে হয়।
লোকটাও হঠাৎ ভাবতে থাকে যে এই মহিলাকে বড্ড বয়স্ক দেখাচ্ছে রাতপোশাক পরে। রাতপোশাকের জন্য, নাকি চুলের জন্য, ভাবতে থাকে লোকটা। চুলটা বড় এলোমেলো হয়ে গেছে রাতে ঘুমনোর সময়। মেয়েদের চুলের জন্য অনেকসময় বয়স্ক দেখায়। মধ্যরাতে হঠাৎ করে তারা একজন আরেকজনের চোখে বড্ড বুড়োটে হয়ে যায়।
‘ঠাণ্ডা মেঝের উপরে… চপ্পল পরে আসবে তো! ঠাণ্ডা লেগে যাবে খালি পায়ে।’ বলে ওঠে লোকটা।
সে অন্যদিকে তাকায়। লোকটার দিকে তাকায় না। আসলে লোকটা মিছে কথা বলছে, এই ব্যাপারটা তার কাছে অসহ্য লাগছিল। বিয়ের ঊনচল্লিশ বছর পরেও খামকা মিথ্যে কথা বলার জন্য হঠাৎ তার লোকটার উপরে খুব রাগ হয়।
–‘আসলে আমি একটা আওয়াজ শুনলাম’… লোকটা বলে যায়। আবার রান্নাঘরে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে… ‘আওয়াজ শুনে দেখতে এলাম এদিকে।’
‘হ্যাঁ, আমিও শুনেছি।’ সে এঁটো পাত্রটা একটু সরিয়ে টেবিলক্লথের উপরে ছড়িয়ে থাকা রুটির গুঁড়ো পরিষ্কার করে… ‘ কিন্তু নাহ, কিচ্ছু না। কিছু নেই এখানে।’
‘নাহ, কিচ্ছু না!’ … লোকটা তারই কথার প্রতিধ্বনি করে। প্রতিধ্বনি করে, কিন্তু একটু দ্বিধা লেগে থাকে লোকটার কণ্ঠস্বরে।
–‘হ্যাঁ, ছেড়ে দাও!’ সে একটা অন্য মাত্রা যোগ করে ব্যাপারটাতে, ‘আওয়াজটা বোধহয় বাইরে থেকে এসেছিল। তুমি ঘুমাতে যাও। নাহলে এই শীত… উফফ, তোমারও ঠাণ্ডা লেগে যাবে। রান্নাঘরের মেঝের টালিগুলো খুব ঠাণ্ডা!’
লোকটা জানালা দিয়ে অন্ধকারে বাইরের দিকে তাকায়… ‘হ্যাঁ, হতে পারে। বাইরে থেকে এসেছিল আওয়াজটা। আমার মনে হয় তাইই হবে।’
সে আলো নিবিয়ে দেওয়ার জন্য হাত তোলে সুইচবোর্ডের দিকে। রান্নাঘর অন্ধকার করে দিয়ে এই পরিস্থিতির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। কিন্তু এঁটো পাত্রটা পরিষ্কার করা হল না। সে ভাবে। ওহ না, সে এখন এঁটো পাত্রটার দিকে তাকাতে পারবে না।
‘ছেড়ে দাও।’ সে আলোটা নিবিয়ে দেয়। ‘বাইরে থেকেই হবে। হাওয়া। হাওয়ায় মাঝে মাঝেই ওই ছাদের গাটারের পাইপটা এসে দেওয়ালে লাগে আর আওয়াজ হয়। নির্ঘাত এটা ওই গাটারের শব্দ।’
ওরা দুজনেই অন্ধকার করিডর দিয়ে আবার শোবার ঘরে ফিরে যায়। রান্নাঘরের মেঝের ঠাণ্ডা টালির স্পর্শে নারীটির পা শিরশির করতে থাকে।
‘হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম আওয়াজটা রান্নাঘর থেকে এলো। আসলে ওটা ওই গাটারের পাইপের আওয়াজ।’ আধোঘুমে থাকলে মানুষ যেভাবে জড়িয়ে কথা বলে, লোকটা সেভাবে কথা বলছে। কিন্তু লোকটা ঠিক ততখানি ঘুমজড়িত নয়, যতখানি সে কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করছে। নারীটি বুঝতে পারে। তার বিরক্তি আসে। লোকটার গলাটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে। মিথ্যে বললে যেমন অদ্ভুত শোনায়, তেমনি অদ্ভুত।
‘উফফ, বড্ড ঠাণ্ডা! আমি লেপের নিচে ঢুকলাম, শুভরাত্রি!’ বলে সে হাই তোলে।
‘শুভরাত্রি!’ লোকটা জবাব দেয়… ‘হ্যাঁ, ভীষণ শীত পড়েছে এবার!’
তারপর সব চুপচাপ হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে সে বুঝতে পারে যে লোকটা কিছু একটা চিবোচ্ছে। হ্যাঁ চিবোচ্ছে, খুব সাবধানে আর সতর্কভাবে। সে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে দীর্ঘ শ্বাস টানে, যাতে লোকটা মনে করে যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু লোকটাই এমন একটা ছন্দে চিবোতে থাকে, যে সেই তালে তালে সে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন রাতে খাবার সময় সে লোকটাকে চারটে রুটি দেয়। যদিও অন্যদিন লোকটা তিনটে রুটি খায়। সে টেবিলের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুমি চারটেই খেতে পারো। আমি রুটি খুব একটা ভালবাসিনা। যদি মনে কর আরও একটা নিতে পারো।’
সে একটু দূর থেকে দেখে লোকটা থালার উপর কেমন যেন ঝুঁকে পড়েছে। তার ওই মুহূর্তে লোকটার জন্য খুব মায়া হয়; সঙ্গে সঙ্গে সে তার সব দোষ ক্ষমা করে দেয়।
লোকটা ডিশের উপর ঝুঁকে ফিসফিস করে বলতে থাকে, ‘না, এখন তুমি দুটো রুটি খেয়ে উঠে যেতে পারবেনা! কি করে বোঝাব এইসময় আমার রুটি খেতে একদম ভালো লাগে না। খেতেই হবে। যাক গে, খেয়েই নিই।’ লোকটা ফিসফিস করে নিজেকে বোঝায়, ‘খেয়ে নাও, খেয়ে নাও।’
আরও বেশ কিছু সময় পরে নারীটি টেবিলে এসে বসে। আলোর নিচে একা বসে থাকে খালি পাত্রের সামনে।