| 28 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য অনুবাদ গল্প: শিকড়ের টান । ইসমত চুগতাই

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

লেখক পরিচিতি

ইসমত চুগতাই (অথবা চুঘতাই  ) ( ১৯১৫-১৯৯১),

উত্তরপ্রদেশের ছোট্ট শহর বদায়ুনে জন্মেছিলেন  তিনি। (বিরাট বড়ো এক পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য ছিলেন ।  উর্দু ভাষার কিংবদন্তি  লেখিকা  তাঁর চিন্তা ও চেতনায় নতুন এক যুগের সূচনা করেছিলেন।  ১৯৩০-এর দশকে তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মহিলা যৌনতা এবং নারীবাদ, মধ্যবিত্ত কৌলীন্য এবং শ্রেণী সংগ্রামের মত বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন । সাহিত্যিক বাস্তবতার মাধ্যমে তিনি বিংশ শতাব্দীর উর্দু সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কন্ঠস্বর হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, । ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অন্যরকম। ছেলে ও মেয়েদের ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার যে পারিবারিক  ভঙ্গি,  এর বিরুদ্ধে তিনি ঝগড়া করতেন খুব অল্প  বয়স থেকেই ।এই ঝগড়াই ছিল ইসমতের প্রতিবাদ। মাট্রিক পরীক্ষার পর মেয়েকে আর পড়াতে চায়নি প্রাচীনপন্থী পরিবার, ইসমত খ্রিস্টান হয়ে মিশনারি কলেজে ভর্তি হওয়ার ভয় দেখিয়েছিলেন। ফলে বাধ্য হয়ে পরিবার তাঁকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অনুমতি দেয়। এখান থেকেই বিএ এবং বিএড পাশ করেন ইসমত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে করতেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন বোরখা পরা, যোগ দেন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম বৈঠকে। মহিলাদের বিরুদ্ধে নানা অবিচারের বিরুদ্ধে জমা ক্ষোভ থেকে আক্রোশ জমতে আরম্ভ করে তাঁর মনে। নানা প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে উর্দু পত্রপত্রিকায় লেখালেখি আরম্ভ করেন। উর্দু সাহিত্য পত্রিকা ‘আদাব-ই-লতিফ’-এ প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প ‘লিহাফ’।

সামাজিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে ইসমতের জেহাদ তাঁর সাহিত্যে বারবার প্রতিফলিত হয়েছে ।  

মৃত্যুর পর তাঁকে সমাধিস্থ না করে দাহ করা হয়েছিল, তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন বহু রক্ষণশীল। বার বার বলতেন, ‘মারা গেলে আমাকে কফিনে রেখো না’ – মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিবাদী চরিত্র বজায় রেখে গেলেন ইসমত!১৯৭৬ সালে ভারত সরকার দ্বারা  তিনি পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত হন এবং ১৯৮৪ সালে তিনি গালিব পুরস্কার পান।

 অনুবাদক: বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


 

থমথম করছে চারপাশ। সবার মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কারও বাড়িতেই উনুন জ্বলছে না। আজ ছ’দিন ধরে কোন বাচ্চা পা বাড়ায়নি স্কুলের দিকে। ঘরের মধ্যেই ওদের লাফঝাঁপ দৌড় ডিগবাজি এবং মারপিট। যেন এই প্রথম পনেরই আগস্ট এল দেশে। মাথামোটা মানুষগুলোকে বোঝানো যাবে না , ইংরেজ চলে গেলেও যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে বুকে তা নেভাতে  বছরের পর বছর লেগে যাবে।অন্য সময় হলে বাচ্চাগুলোকে কান ধরে ঘর থেকে বের করে বলা হত- যাও, যত পারো কাদা মাখো মুখে, যত খুশি দাঙ্গা বাঁধাও। কিন্তু শহরের অবস্থা এখন  ভালো নয়।মুসলমানেরা কার্যত গৃহবন্দী।দরজায় তালা ঝুলছে। বাইরে পুলিশের টহল । ছোটদের দুষ্টুমি তাই এখন সাত খুন মাপ। বাস্তব কথা হল এটাই যেখানে জনসংখ্যার লাগামছাড়া বিস্ফোরণ  সেখানে দারিদ্র অকাতরে আবর্জনা ছড়িয়ে যায়। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো জমতে থাকে অজ্ঞতার অন্ধকার।

মাড়বার এমনই এক ভূখণ্ড যেখানে পোশাক দেখে ধর্ম চেনার উপায় নেই। যাদের চেনা যেত তারা পনেরই আগস্টের ঘোষণার সাথে সাথেই পাকিস্তানে পাড়ি দিয়েছে।এই রাজ্যের যারা প্রকৃত বাসিন্দা  তারা হিন্দুস্তান পাকিস্তান ব্যাপারটা বোঝার মতো বুদ্ধিমান নয়।তাছাড়া তারা সমাজের তেমন কোন মুরুব্বি নয় যে সব মানুষকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে পুরো বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কারভাবে খোলসা করে বুঝিয়ে দেবে। যারা পাকিস্তানে চার আনায় চার সের গম আর ছ ইঞ্চি লম্বা পাউরুটির লোভে দৌড়েছিল তারা এখন আঙুল চুষতে চুষতে ফিরে আসছে অথবা কষ্ট করে মার খেতে খেতেও থেকে যাবে ঐ দেশে।

তবু কয়েকটা পরিবার রয়ে গেছে এখানে । তাদের মধ্যে আমাদের পরিবারটি। বড়ভাই যতদিন আজমীরে ছিল ততদিন সেরকম কোন তাগাদা ছিল না।কিন্তু যেই ও ফিরে এল, সবাই অনুমান করে নিল এরপর কী ঘটতে পারে। তবু কেউ বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ছাব্বা মিয়াঁর সাথে ওরকম আচরণ না হলে যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলত। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হত না। বড়ভাই তো কবে থেকেই বলে যাচ্ছিল- এবার চলে যেতেই হবে, এভাবে থাকা যায় না। সে শুধু বলার জন্য বলা। কিন্তু ছাব্বা মিয়াঁ একদিন স্কুলের দেওয়ালে দুম করে লিখে বসল- পাকিস্তান জিন্দাবাদ। রূপচাঁদজীর ছেলেরাই বা ছাড়বে কেন ? তারা ঐ লেখাটাকে রগড়ে রগড়ে মুছে তার উপর লিখল- অখণ্ড হিন্দুস্তান। এই নিয়েই শেষমেশ ঝগড়া শুরু হল। তা  এমন আকার নিল যে পুলিশ এসে যে কটা মুসলমান ছেলে সেখানে ছিল তাদের লরিতে চাপিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। ছেলেরা যখন বাড়ি ঢুকল তাদের মায়েরা এমনভাবে ছুটে এল এবং বুকে জড়িয়ে ধরল যেন তারা কোন যুদ্ধ জিতে এসেছে। অন্যদিন মায়েদের গালাগালির চোটে তাদের অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে । 

রূপচাঁদজী শুধু ডাক্তার নন, আমাদের পারিবারিক বন্ধুও। আব্বার বিশেষ বন্ধু। ওঁর ছেলেরা আমার ভাইদের বন্ধু। ওঁর ছেলের বৌরা আমার বৌদিদের বন্ধু। এই দুটো পরিবার তিন পুরুষ ধরে মিলেমিশে এমন ভাবে একাকার হয়ে গেছে যে কেউ কোনদিন ভাবতেও পারেনি হিন্দুস্তান ভাগ হয়ে গেলে ওদের সম্প্রীতিতে  এভাবে  চিড় ধরবে। বাড়িতে সকলেই বিভিন্ন দলের সমর্থক। কেউ কংগ্রেস তো কেউ মুসলিম লীগ। ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলার ক্লাবের মতো।  আব্বা  আপাদমস্তক কংগ্রেসি ,রূপচাঁদজী আর আমার বড়ভাই মুসলিম লীগ।  জ্ঞানচাঁদ হিন্দু মহাসভার সদস্য। আমার মেজভাই কমিউনিস্ট আর গুলাবচাঁদ সোশ্যালিস্ট। এদের বউ ছেলেরা পার্টি টার্টি করত না কিন্তু সাপোর্টার ছিল। এরকমই তো ছিল দিনগুলো। মতবাদ নিয়ে সবাই কট্টর, কিন্তু সে তো মুখে। কেউ কাউকে আক্রমণ করত না, অসম্মান করত না। এই তো সেদিনের কথা যখন পাকিস্তান বলে আলাদা কিছু ভাবা হত না। যখন আব্বা আর রূপচাঁদজী বৈঠকখানায় চা খেতে খেতে গল্প করত- সারা এশিয়াকে এক মানচিত্রের নীচে নিয়ে আসতে হবে।  আম্মা আর চাচী তখন ধনেপাতা, হলুদ , নুন লঙ্কার সাথে মেয়েদের দান দহেজ নিয়ে গল্পে মশগুল হয়ে থাকত। কেউ দুবার হেঁচেছে কিংবা পাতলা বাহ্যি করেছে তো ডাকো ডাক্তারচাচাকে। আম্মা তখন তড়িঘড়ি মুসুর ডালের পুর দেওয়া রুটি আর দইবড়া বানানোয় ব্যস্ত। ডাক্তারচাচাকে খাওয়াতে হবে রোগী দেখতে এলে। ভাবীজির রান্না শুনেই  মনটা টানত এদিকেই। নাতির হাত ধরে সোজা  চলে আসতেন।

ও গো , শুনছো, ওখানে  কিছু খেও না। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ডাক্তারগিন্নির সাবধান বাণী ভেসে আসত বাতাসে।

ঠিক আছে। বলতেন বটে কিন্তু কে কার নিষেধ শোনে। আঙুল চেটে খেয়ে বলতেন- আর নেই? সবাই তখন হেসে অস্থির।

মজা হত আম্মার অসুখ বিসুখ হলে।অল্পেই উতলা হয়ে পড়ত আম্মা। আর বিড়বিড় করে বকত- ওই উদ্ভট ডাক্তারের কাছে কিছুতেই চিকিচ্ছে করাব না।কেবল কুইনিন গেলাবে। 

কে কার কথা শোনে। সামনে ডাক্তার থাকতে লম্বাপথ পাড়ি দিয়ে শহর থেকে কে আর ডাক্তার নিয়ে আসে।খবর পেলেই ছুটে আসতেন রূপচাঁদজী – আপনার রোগ সারানো আমার কম্ম নয়। আগে পান জর্দার নেশা ছেড়ে দিন নইলে বাপের জন্মেও আপনার জ্বর ছাড়বে না।

চিকের আড়াল থেকে আম্মা বলে উঠত- সবাই কি আপনার মতো পেটুক।

অসুখ বিসুখ তো আসলে একটা কৌশল। মানুষটাকে দেখার ইচ্ছে হলেই আম্মা অসুখের ভান করত।

দেখি হাতটা দেখি, হাত না দেখে কি দাওয়াই দেওয়া যায়?

চিকের ফাঁক থেকে হাত টেনে ডাক্তার বলতেন – খুব পুরানো রোগ, রোজ একবার করে আসতে হবে। আব্বা মিটমিট করে হাসত তখন।

রোগ তো আম্মার একার নয়। ডাক্তার চাচা এলে কারুর পেট ব্যথা তো কারোও ব্রণ ফেটে রক্ত পড়ছে। কারও কান কটকট তো কারও বুক ধড়ফড়।

ডেপুটি সাহেব, আজ দু একটার খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেব। এত রোগ আর দিব্যি খাচ্ছে। লাইন দিয়ে দাঁড়াও, কী মনে করো আমাকে পশু চিকিৎসক ? রূপচাঁদচাচার বকবকানিও চলবে, রোগী দেখাও চলবে।

কারও বাচ্চা হবার খবর কানে গেলেই হচ্ছে। চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে দেবে- পেয়েছো বিনা পয়সার ডাক্তার, ফুর্তি করে যাও বাপধন। কিন্তু যেই প্রসব বেদনা শুরু হত অমনি  সারা বাড়ি অস্থির পায়চারি শুরু করে দিতেন রূপচাঁদচাচা। একে বকছে তো তাকে ধমকাচ্ছে। একবিন্দু বিরাম নেই। হবু বাবাদের বীরত্ব তখন চুপসে যেত নিমেষে। যেই বাচ্চার কান্না তাঁর কানে আসত অমনি বারান্দা পেরিয়ে দরজা ঠেলে সোজা ঘরের মধ্যে। ত্রস্ত মহিলারা চিকের আড়ালটাকে তখন আরোও জোরালো করে নিত। প্রসূতির হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করতে করতে অন্যহাতে পিঠ চাপড়ে দিতেন- সাবাস, সিংহী মা, এরকম তেজি বাচ্চাই তো চাই, নইলে দেশ গড়বে কারা?

আম্মা ছুটে আসত দ্রুত পায়ে, বলি এই যে বেহায়া মিনসে,  লাজশরম কিছুই কি নেই, বলি আঁতুড়ঘরে কি হচ্ছে শুনি। অমনি পড়িমরি করে দৌড়ে পালাতেন ডাক্তারচাচা। যেন তার কান মলে দিয়েছে ভাবিজী।

রূপচাঁদজী হাসপাতাল থেকে অবসর নেওয়ার পর আমাদের ঘরেই তার বেশিরভাগ সময় কাটে। এরমধ্যে পক্ষাঘাত হল আব্বার। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে জ্ঞান নেই। আব্বার পাশে সবসময় রূপচাঁদজী। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই , ঘুম নেই। আব্বাকে কবরে শোয়ানোর পর  আমাদের প্রতি ভালোবাসার সাথে যোগ হল এক গভীর দায়িত্ববোধ। বাচ্চাদের স্কুলের ফীজ দেওয়া, মেয়ের দহেজের গয়না বানানো বা সংসারের যাবতীয় দায়িত্বে তখন তিনি নিজেকে যুক্ত করে নিয়েছেন।পশ্চিমদিকে বাড়িটা ভেঙে নতুন ঘর তোলার ইচ্ছে ছিল মেজ ভাইয়ের। ডাক্তার চাচার এক কথায় তা নাকজ করে দিল আম্মা। মুজ্জান এফ এ পাশ করার পর কিছুতেই সায়েন্স পড়বে না।ডাক্তারচাচা একপাটি জুতো নিয়ে তার পিছনে এমনভাবে তাড়া করলেন  যে  খোদার কসম খেয়ে সে সায়েন্স পড়তে রাজী হল।  ফরিদা একদিন স্বামীর সাথে ঝগড়া করে চলে এল বাপের বাড়ি, কিছুতেই সে ফিরে যাবে না। ডাক্তার চাচা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার ফেরত পাঠাল সেখানে।

কিন্তু আজ যখন ছাব্বা নিজের বীরত্ব দেখিয়ে  বাড়ি ফিরে এল, তখন তার খাতির বেড়ে গেল। সবাই মিলে ওকে মাথায় তুলে নাচতে লাগল।যেন সে বিপ্লবী, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে এক মুহূর্তে। সবাই যখন তাকে সাবাস জানাচ্ছিল তখন সেই সমবেত কণ্ঠস্বরের মাঝে কেবলমাত্র একটি গলার স্বরই অনুপস্থিত ছিল তা আম্মার। পনেরই আগস্টের পর যেদিন ডাক্তার সাহেবদের ছাদে তেরঙ্গা পতাকা উড়েছিল ,তার উপরে উড়ছিল মুসলিম লীগের পতাকা সেদিন থেকেই আম্মা তার কথা বন্ধ করে দিয়েছিল। এই দুটো পতাকার ভেতর কয়েক যোজনের তফাত। আম্মা সেইদিকে চেয়ে থাকত আর জল ঝরে পড়ত তার অতীতফেরানো চোখে। মনে মনে কাঁপত অজানা আশঙ্কায়। দাঙ্গাবাজরা আসবে, মানুষের বুক থেকে লোপাট করে দেবে ভালোবাসার শেষবিন্দুটিও। এখন আর বাড়িতে কারও অসুখ বিসুখ হয় না। বাড়ির ছোট বউ হিস্টিরিয়া ভুলে জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদার কাজে ব্যস্ত।

“ আমার  টিনের বাক্সে হাত দিও না ছোট বউ’’ আম্মা দূরের দিকে তাকিয়ে বেশ কঠোর গলায় বলে ফেলল কথাগুলো।

কেন? আপনি যাবেন না? ধীর গলায় জিজ্ঞেস করল বড় বউ।

ওই সিন্ধী  বেশরম আউরৎগুলোর সাথে আমি মরতে যাব? আমার পাপ হবে না?

তাহলে সেজোর কাছে ঢাকায় চলে যান।

আম্মা চুপ করে থাকে।

 তাহলে ফরিদার কাছে যান রাওয়লপিন্ডি। খালা বলে।

তোমরা চলে যাও, আমি আর কোথাও যাব না। কবরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আম্মা করুণ গলায় কথাগুলো বলল।

এই বুড়ো বয়সে তুমি কতকগুলো বর্বর বিধর্মী লোকের কাছে থাকতে চাও, থাকো।

ওরা বান্ডিলগুলো গুনতে থাকে। কী কী এখনও বাকি থেকে গেছে তার হিসেব নিকেশ করে। সোনা রূপার গয়না, মুলতানী মাটি খাটের পায়া থেকে আরম্ভ করে বাচ্চাদের হিসু কাঁথা অবধি । কিছুই বাদ গেল না।  শুধু আম্মার টিনের বাক্সটা  পড়ে থাকল একপাশে। আমার আম্মা তার সরল নিষ্পাপ চোখ দুটো আকাশের দিকে তুলে দেখতে লাগল  কেউ তাকে মারতে আসছে কী না। এই দেশে শয়তান ছাড়া তো কোন মানুষ নেই। তারা কখন এসে তাকে আক্রমণ করবে এর জন্য সে অপেক্ষা করতে লাগল।

মেজ ভাই ফিসফিস করে বলল- আম্মার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। স্মৃতিলোপ পেয়েছে।

সবাই একবাক্যে বলল- হ্যাঁ। মাথাটা একদম বিগড়ে গেছে নইলে বুঝতে পারত এই দেশে কী অত্যাচার চলছে আমাদের উপর। এটা যদি নিজের দেশ হত তাহলে সম্পত্তি হারানোর ভয়, প্রাণের ভয় থাকত না।

আম্মা চুপ করে শুনল কথাগুলো। অন্যসময় সময় হলে চেঁচিয়ে উঠত- নিজের দেশ কোন আজব চিড়িয়ার নাম।

কোন দেশটা আমার নিজের? এই মাটিতে হামাগুড়ি খেতে খেতে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। সেটা আমার দেশ নয়? তাহলে  একটা নতুন দেশ তোমরা খুঁজে নাও গে।দেশ কি একজোড়া জুতো যে টাইট হয়ে গেছে বলে তাকে ফেলে দিয়ে নতুন এক জোড়া কিনে নিতে হবে? সেই আম্মা এখন স্বর হারিয়ে ফেলেছে। কথা হারিয়ে ফেলেছে। চোখে মুখে সবসময় চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।যেন হাজার হাজার বছর ধরে নিজের দেশ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে সে বসে পড়েছে এক প্রাচীন গাছের ছায়ায়। যখন গাড়িগুলো এল আর পুলিশ পাহারা দিয়ে এক এক করে তার ছেলেদের বউদের নাতিনাতনিদের  তুলতে লাগল গাড়িতে তখন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল তার হৃদয়।ভেঙে চৌচির হয়ে তা যেন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ঝাপসা চোখে সে চেয়ে রইল  রাস্তার ওপারের বাড়িটার দিকে। কত কাছে অথচ আজ মনে হচ্ছে যেন অনেকদূরে সরে গেছে বাড়িটা। রাস্তাটা যেন দীর্ঘ , না ফুরোনো দুঃখের মতো লম্বা। রূপচাঁদজীর বারান্দা খালি। খাঁ খাঁ করছে  চারপাশ।দু একটা বাচ্চা দরজা ফাঁক করে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু কেউ তাদের থাপ্পড় মেরে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের ভেতরে। এই ছোট্ট ফাঁকের মধ্য দিয়ে আম্মা যেন দেখতে চাইছিল কিছু। দেখতে পাচ্ছিল বাঁশের পাতা আর কিছু শুকনো ডাল। গাড়িগুলো বেরিয়ে গেল। ধুলোর ঝড় উড়িয়ে এক ধ্বংসচিহ্ন রেখে চলে গেল ওরা।

রাস্তার ওপারের বাড়িটার দরজা খুলল। চোরের মতো বাইরে বেরিয়ে এলেন রূপচাঁদজী। দূরের দিকে চলে যাওয়া গাড়িগুলোর দিকে চেয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। তারপর চোখ মুছতে মুছতে  তিনি চুপচাপ ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন।

আম্মা দেওয়াল ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। দেওয়ালে এখনও সেই দাগটা আছে। এই ঘরে যখন নতুন বউ হয়ে এসেছিল সে। সেদিনই লুকিয়ে লুকিয়ে পান খেতে গিয়ে পিকের এই দাগটা অজান্তে লেগে গিয়েছিল দেওয়ালে। মুছে যায়নি তো দাগটা। এই ঘরে দুলহান বিবি হয়ে যেদিন সে এসেছিল,এখানেই খোলা হয়েছিল তার সলাজ ভীরু ঘোমটা। একটা মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের জীবন এক মলাটে বাঁধা হয়েছিল এখানেই।  এই ঘরে কত গল্প ফিসফিস করছে প্রেমের বার্তা নিয়ে। ঐ ঘরে তার প্রথম কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছিল, নাড়িকাটা দড়িটা পোতা আছে এই ঘরে। একটা নয়, দশ দশটা নাড়ি কাটা দড়ি , দশ দশটা প্রাণ এই ঘরে প্রথম নিশ্বাসের বাতাস নিয়েছিল। এই ঘরে মায়ের জঠরে রক্তমাংস দিয়ে একটু একটু করে দশ দশটা মূর্তি গড়া হয়েছে। সেই শ্রম স্মৃতি আর টান এক মুহূর্তে সাপের খোলসের মতো ত্যাগ করা যায়? যারা পারে তারা  সুখ পেতে চলে যায়। চলে যায় এক টাকায় চার সের গম পাওয়ার লোভে। এখনও শিশুদের হাসি ভাসছে ঘরে। খিলখিল করে বাচ্চারা। দশ দশটা সন্তানের মা। আজ খাঁ খাঁ ঘরে শূন্য কোল নিয়ে বসে আছে আম্মা।

নৈঃশব্দ্যের মন্থন চলছে সারা ঘরে। ভয় পাওয়া চোখে  তাকাল সামনের দিকে। পাশের ঘরটি ফাঁকা শূন্য আলুথালু। এখানে তার জীবনের একমাত্র পুরুষ , পঞ্চাশটা বছর যার সুখ দুঃখের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে সে, সেও কেমন  মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । এখানেই তার মৃতদেহ শোয়ানো হয়েছিল। কত ভাগ্যবান পুরুষ,তার অন্তিমকালে পুরো পরিবার হাজির ছিল তার পাশে। তাদের কোলে মাথা রেখে চলে গেল সে। আর রেখে গেল  প্রিয় সঙ্গিনী এক হতভাগিনী নারীকে , কবন্ধের মতো এই নারী। তার শরীর আছে মাথা নেই। মাথা কেটে নিয়ে চলে গেছে কেউ। পা অবশ হয়ে আসছিল তার। েসব ভাবতে ভাবতে আম্মা এক জায়গায়  শরীর এলিয়ে দিল। এখানে বিগত দশ বছর ধরে সে মৃত স্বামীর জন্য প্রতিদিন প্রদীপ জ্বালিয়েছে। আজ সেই প্রদীপের তেল ফুরিয়ে গেছে।

রূপচাঁদজী  চঞ্চল ভাবে পায়চারি করছিলেন বারান্দায়। কী করবেন খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি তার পরিবারের দোহাই দিচ্ছিলেন, সরকারি নীতিকে দোষারোপ করছিলেন আর ভুল রাস্তার দিকে তাকিয়ে ইট পাথরগুলোকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। সামনের শুনশান বাড়িটা তাকে ভেংচি কাটছে, বিদ্রূপ করছে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তিনি স্থির থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। মনের মধ্যে জমে থাকা হিংসা, আক্রোশ আর বিদ্বেষের বাস্প যা শরীরে বাসা বেঁধেছিল তা অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল।

রাত্রিবেলায় যখন রাস্তা ঘাট নির্জন। যখন কারোও সাড়াশব্দ নেই, রূপচাঁদজীর বউ চোরের মতো চুপিচুপি দু থালা খাবার নিয়ে পেছনের দরজার দিয়ে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। দুই বৃদ্ধা একে অন্যের দিকে চেয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ । তাদের মুখ থেকে কথা সরছিল না। শুধু ওদের চোখ কথা বলছিল বিষন্ন ভারাক্রান্ত ভাষায়। থালা দুটো যেমন ছিল, তেমনই রইল। কারও ছুঁয়ে দেখার অবকাশ হল না।

সারা রাত মনের মধ্যে ঝড় বয়ে গেছে। কেউ কাওকে মনের কথা খুলে বলেনি। তবু দুজন বৃদ্ধার ভাবনার কম্পাঙ্ক মিলে গেছে একটি বিন্দুতে। বাড়ি ফিরে গেছেন রূপচাঁদজীর বউ। 

নিঃসঙ্গ চিন্তার ভেতর হুইশল বাজিয়ে চলে গেছে গভীর রাতের ট্রেন। একটা দুটো নয় নয়, সমস্ত ট্রেনগুলোই আক্রমণ করেছে ওরা, প্যাসেঞ্জারদের টেনে নামিয়ে কেটে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে নদীর জলে। শরীরের রক্ত দিয়ে মাংস দিয়ে মনের বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দিয়ে যে শস্য বুনেছিল তা আজ নির্বাসনে অন্য এক খেতের সন্ধানে। এই খেত কেমন হবে শস্যগুলি ঠিকমতো খাবার পাবে তো? না কি শুকিয়ে যাবে নির্বাসিতের যাতনা নিয়ে?ছোট বউ আবার পোয়াতি। সামনের মাসেই তার বাচ্চা হবে। কোন জঙ্গলের মধ্যে তাকে প্রসব করতে হবে কে জানে। ওরা তো সব ছেড়ে চলে গেছে ঘর দোর চাকরি বাকরি সব। নতুন জমিতে শেকড় ঠিকমতো মজবুত মাটি পাবে তো? ইঁদারার গায়ে লেগে থাকা জলবিন্দুর মতো ঘরের দেওয়াল ধরে বারবার বকবক করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে গেল আম্মার শরীর। কিন্তু ঘুম এল না। নিরালম্ব শূন্যতায় কেঁপে উঠতে লাগল তার অশক্ত শরীর।যতবার চোখ বন্ধ হয় ততবারই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জোয়ান মেয়েদের রক্তাক্ত  ছিন্নভিন্ন শরীর।তার  যুবতী বউদের নগ্ন করে কারা যেন মিছিলে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে দীর্ঘ পথ। কচি কচি নাতি নাতনিদের কুচি কুচি করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীর জলে। লাল জল বইতে বইতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই।এক ভয়ংকর চিৎকারের ভেতর তার তন্দ্রা  ভেঙে যায়।

দরজা ধাক্কা দিচ্ছে কেউ। তাহলে কি যমদূত ডাকতে এসেছে তাকে।দরজার কলকব্জা খুলে গেল হঠাৎ। আলো জ্বলে উঠল ঘরে। দূর দিগন্ত থেকে কেউ যেন ডাকল তাকে। মনে হচ্ছে অন্ধকার কুয়োর ভেতর থেকে শব্দটা আসছে। বড় ছেলে কি মা বলে ডাকছে? না কি ছোট ছেলে?অন্য জগতের আওয়াজ, এত ক্ষীণ যে তা স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে না। এটা বোধ হয় অন্য দেশ। তাদের নিজেদের দেশ। যাক ছেলেগুলো তাহলে নিজের দেশ খুঁজে পেয়েছে। ওই তো বড় ছেলে, তার পিছনে মেজো, তার পিছনে সেজো, ছোট… লম্বা লাইন দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। বৌমারা বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। বাড়িটায় আবার প্রাণ ফিরে এসেছে।ছোট বড়ো সব হাতগুলো অস্থির হয়ে আছে তাকে স্পর্শ করার জন্য। খরা মাটি থেকে হৈ হৈ করে বেরিয়ে পড়েছে অঙ্কুর। ঐ তো   ঐ তো দেখা যাচ্ছে শেকড়।

আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই সে পেল পরিচিত হাতের স্পর্শ।ঐ হাতটা তার নাড়ি পরীক্ষা করছে।

ভাবী,আমাকে একবার ডাকতে পারলেন না? আমি তো কাছেই ছিলাম। আপনি এরকম করতে গেলেন  কেন? পর্দার আড়াল থেকে রূপচাঁদজী কথা বলে যাচ্ছেন।

চুপ করে আছে রূপচাঁদের ভাবিজী।আমার আম্মা। 

আমি কিন্তু এক পয়সাও ফিস ছাড়ব না। চেয়ে দেখুন আপনার  কুলাঙ্গার ছেলেরা ফিরে এসেছে। কলোনি জংশন থেকে ওদের ধরে এনেছি। পালিয়ে যাচ্ছিল ওরা। কোথায় পালাবে? আমার হাত কি এতই ছোট যে ওদের নাগাল পাব না? হতভাগা ছেলেগুলো কী মনে করেছে কি?এ মাটিতে তাদের ধরে রাখার মতো ভালোবাসা নেই। এই বুকের ভেতর যে নরম পলিমাটি আছে, তা ওরা দেখতে পায়নি ভাবিজী।

প্রাণের স্পন্দনে নড়ে ওঠে আম্মার ঠোঁট। উঠে বসতেই হয় তাকে। চুপ করে থাকে কয়েক পলক। টুপটুপ করে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ে রূপচাঁদজীর হাতে। জল নয়, জল নয় দীর্ঘকাল ধরে চোখের কোণে জমিয়ে রাখা দুটি হীরক বিন্দু। 

  

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত