| 8 মে 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -৮)। হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস


 

বারো শতকেই প্রাচীন গ্রিকদর্শন তথা এরিস্টটলেরদর্শনের সঙ্গে ইউরোপের পরিচয়হয়েছিল যদিও প্রাচীন গ্রিসের সম্পূর্ণ জ্ঞান-ভান্ডারের সঙ্গে পরিচয় হতে ইউরোপকে আরও প্রায় দুশো  বছর অপেক্ষা করতে হল। এই দ্বিতীয়বারগ্রিক জ্ঞান ভান্ডারের সঙ্গে ইউরোপের যে পরিচয় ঘটল তার ফলে ইউরোপের সভ্যতা সংস্কৃতি এবং জীবনধারায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেল ।

ঘটনাটি ছিল এই ধরনের ।

 প্রাচীনকালে রোমানরা এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। রোমান সম্রাটদের ভেতর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করা প্রথম সম্রাট কনস্টানটিন (৩১০-৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ) ৩৩০ খ্রিস্টাব্দেরোমান সাম্রাজ্যের পূব খন্ডে অবস্থিত বাইজানটিয়ামে(বর্তমানের ইস্তাম্বুল) রাজধানী স্থানান্তরিত করে সেখানে কনস্টানটিনপল নামে একটি নতুন নগর গড়ে তোলেন। ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে যখন রোমান সাম্রাজ্য পূর্ব এবং পশ্চিম খন্ড স্থায়ীভাবে  দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ পতন  হয়, তখন পূব খন্ডের রোমান সাম্রাজ্য আসল রোমান সাম্রাজ্য বলে পরিগণিতহয়। তাই রোমান সাম্রাজ্য প্রায় এক হাজার বছর টিকে ছিল এবং সেই সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনপল ছিল ইউরোপের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী এবং প্রসিদ্ধ নগর। রোমান সাম্রাজ্যের প্রতি জন পন্ডিত এসে কনস্টানটিনপলেআশ্রয়নিয়েছিলেন এবং তারা গ্রিক এবং ল্যাটিন ভাষায় রচিত সমস্ত গ্রন্থ কনস্টানটিনপলেনিয়েএসেছিলেন। কনস্টানটিনপলে সংরক্ষিত হয়ে থাকা এই গ্রন্থ গুলির কথা ইউরোপের পশ্চিমাংশের মানুষ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল কিন্তু তারা এই জ্ঞান–ভান্ডার একদিন নতুন করে আবিষ্কার করলেন–প্রায় নাটকীয়ভাবে। 

কনস্টানটিনপল দখল করার জন্য তুর্কিরা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করে আসছিল। অবশেষে তাদের চেষ্টা সফল হল। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দের  ২৯ মে সকালবেলা, তুর্কিরা গড় ভেঙ্গে‌ কনস্টানটিনপলের ভেতরে প্রবেশ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এক হাজার বছর ধরে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে থাকা কনস্টানটিনপলের পতন ঘটল। সেখানে বসবাস করা পণ্ডিতরা যে যা পারে পুঁথি পত্র সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এল এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েপড়ল। অবশ্য বেশিরভাগই এলেন ইটালিতে।

বর্তমান যুগে ইতালি বললে আমরা যেভাবে সেই নামের একটি বিশেষ রাষ্ট্রের কথা বুঝিমধ্যযুগে কিন্তু সেই ধরনের ইতালির কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একটি অখন্ড রাষ্ট্রের পরিবর্তে দেশটি বিভিন্ন স্বশাসিত নগরে বিভক্ত ছিল—যেসবের মধ্যে ভেনিস, নেপলস এবং জেনোয়া ইত্যাদি নগর ছিল বিশেষ প্রসিদ্ধ।এই সমস্ত নগরের ভেতরে কোনোকোনো নগরে এক ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন চলছিল; কোনোকোনো নগর শাসন করত কয়েকজনঅভিজাতশ্রেণির মানুষ একত্রিতভাবে আর কোনো একটি নগরে হয়তোচলছিল একজন মাত্র পরাক্রমী মানুষের স্বেচ্ছাচারী শাসন। কিন্তু একটা কথা ইটালির এই নগর গুলির মধ্যে একটা বড়ো মিল ছিল।সূচলভৌগোলিক অবস্থিতির জন্য ইটালির এই নগরী ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র—যার ফলে সেই সময়ে ইতালিতে একটি অভূতপূর্ব সমৃদ্ধির যুগ দেখা দিয়েছিল।দ্বিতীয়ত,খ্রিস্টানদের পোপ ইতালিতে বাস করার ফলে কয়েক শতাব্দী ধরে ইতালিতে ধন-সম্পদের স্রোত বয়েছিল কারণ ইউরোপের সমস্ত খ্রিস্টান রাজা-প্রজাকেই পোপকে কর দিতে হত।মুসলমানদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চলা ধর্মযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার সৈনিককে ইতালির মধ্য দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয়েছিলআর এই সৈনিকদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন করেও ইতালির মানুষ প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিল।

মানুষকে যখন জীবিকা উপার্জনের জন্য দিনরাত নিশ্বাস ফেলার সময় না পেয়ে পরিশ্রম করতে হয় তখন অন্য কিছু চিন্তা করার তার সময় অথবা শক্তি থাকে না কিন্তু সঞ্চয় করার মতো মানুষের হাতে বেশি ধন-সম্পত্তি এলেই তাকে জীবিকার জন্য কম পরিশ্রম করতে হয় বা কখনও একেবারেই করতে হয় না অর্থাৎ সে প্রচুর পরিমাণ অবসর লাভ করে। মানুষের সভ্যতা সংস্কৃতি হল এই অবসর সময়ের সৃষ্টি। কিন্তু অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার করে সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর জন্য তার উপযোগী পরিবেশ এবং প্রতিভা মানুষের থাকতে হবে।ইটালিয়ানদের এই দুটি জিনিসই ছিল। প্রাচীন রোমানদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রে ছিল ইটালি।রোমান সভ্যতার গৌরবময় যুগে তারা যে উচ্চ স্তরের ভাস্কর্য স্থাপত্য এবং সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন তার উত্তরাধিকারী ছিলেন মধ্যযুগেরইটালিয়ানরা।বারোশতিকা থেকে যখন ইটালিতে একটি অভূতপূর্বক সমৃদ্ধির যুগ আরম্ভ হল এবং একশ্রেণির মানুষের হাতে প্রচুর অবসরের সৃষ্টি হল তখন তারা সেই অবসরটুকুকাটানোর জন্য উৎকৃষ্টউপায় খুঁজে শিল্প সাহিত্য সংগীত ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি নতুন করে মনোযোগ দিতে শুরু করলেন।অকাতরে ধন খরচ করে তারা তাঁরা প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য পুথির পান্ডুলিপি এবং প্রাচীন কালের শিল্পকলার নিদর্শনগুলি কিনতে শুরু করলেন। এর ফলে তাদের মানসিকতায় ধীরে ধীরে একটি পরিবর্তনের সূচনা হল।মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপের খ্রিস্টানরাইহকালের দিকে পিঠ দিয়ে সারা জীবন অতিবাহিত করেছিল কেবল পরকালেরচিন্তায়। মৃত্যুর পরে কীভাবে স্বর্গ লাভ করা যায় সেটাই ছিল তাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান।মধ্যযুগের বহু শতাব্দী ধরে চলা অবিরাম যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং মাড়ি-মড়কসর্বসাধারণ মানুষের জীবন এরকম যন্ত্রণাময় করে তুলেছিল যে পার্থিব জীবন থেকে আশা করার মতো কিছু থাকতে পারে বলে তারা কল্পনাই করতে পারেনি। সেই জন্য তাদের একমাত্র আশ্রয় ছিল ঈশ্বর। একমাত্র সান্ত্বনা ছিল মৃত্যুর পরে স্বর্গলাভ কিন্তু প্রাচীন গ্রীক এবং রোমানদেরদৃষ্টিভঙ্গি ছিল এর বিপরীত। তাদের চিন্তায়পরকালের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সেই জন্য তারা পার্থিব জীবনটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগকরতে চেয়েছিল। মৃত্যুর পরে স্বর্গ পাবারআশায় বসে না থাকে তারা এই পৃথিবীটাকেই স্বর্গে পরিণত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। সেই জন্য একমাত্র দাসরা ছাড়া অন্য বেশিরভাগগ্রিক এবং রোমানদের জীবন ছিল আনন্দময়। তারা শরীরটাকে বিশেষ মূল্য দিত বলে শরীরের পরিপূর্ণ উৎকর্ষ সাধনের জন্য চেষ্টা করেছিল।মানবদেহের মহিমাময় সৌন্দর্যের বন্দনা করে মার্বেল পাথরের অপরূপ মূর্তি নির্মাণ করেছিল। তাঁরা মৃত্যুর চিন্তায়ম্রিয়মাননা থেকে সমস্ত সময় চিন্তা করত কেবল জীবনের কথা আর তাদের সাহিত্য এবং দর্শনের কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করছিল কেবল মানুষ।তেরোশতকেরইটালি যখন প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানদের এই ভাব-সম্পদ নতুন করে আবিষ্কার করল তখন তাদের চিন্তায় একটি বড়ো বিপ্লব ঘটে গেল। মৃত্যু এবং পরকালের থেকে চোখ ঘুরিয়ে এনে তারা জীবন এবং ইহকালের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তারা হঠাৎ আবিষ্কার করল যে এই পৃথিবীটি সুন্দর। একে আরও সুন্দর করা যেতে পারে। এই জীবনটা সুন্দর করা যেতে পারে। কিন্তু কার জন্য সুন্দর করা হবে? মানুষের জন্য। যে মানুষ এতদিন অবহেলিত হয়েছিল সেই মানুষই হঠাৎ শিল্পী কবি এবং দার্শনিকের ধ্যানের প্রধান বিষয় হয়ে পড়লঅর্থাৎ শিল্পী কবি এবং দার্শনিকরা হয়ে পড়লেনমানবতাবাদী।মধ্যযুগের মানুষ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিল বাইবেল তথা ধর্ম শাস্ত্রের মধ্যে কিন্তু নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত মানবতাবাদীরা এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর  চাইতে লাগল প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের সাহিত্য এবং দর্শনের মধ্যে।


আরো পড়ুন: আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -৭)। হোমেন বরগোহাঞি


 ইতালিতে এই পুরো ঘটনাগুলি ঘটতে আরম্ভ করেছিল ১৩ শতকের শুরু থেকে। পৃথিবীতে যে একটা নতুন যুগ আসতে শুরু করেছে তার আগমন বার্তা পেয়ে কবি এবং ভাবুকের মন তখন থেকেই চঞ্চল হতে শুরু করেছিল। যে মানুষটির মন সবচেয়েবেশি চঞ্চল হয়েছিল তার নাম হল ফ্রান্সিস পেট্রার্ক (১৩০৪- ১৩৭৪)। পন্ডিতদের মতে তিনি হলেন প্রথম আধুনিক মানুষ। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কবিতা লিখে তিনি ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা করেন। এই কবিতার বৈশিষ্ট্য হল এটাই যে তার কবিতাতে মানুষ প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে অর্থাৎ একজন ব্যক্তির আশা আকাঙ্ক্ষা এবং আনন্দ  তার কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। এর আগেআত্মবিলোপই ছিল কবিদের আদর্শ।পেট্রার্ক একটি নতুন আদর্শ তুলে ধরলেন। তিনি বললেন যে আত্মবিলোপ নয় আত্মপ্রকাশইহওয়া উচিত সমস্ত কবি এবং শিল্পীর প্রধান উদ্দেশ্য। তার এই বাণী শিরোধার্য করে নেবার জন্যই ইউরোপের মানুষের পক্ষে নবজাগরণ সম্ভব হল।সেইজন্য ‘প্রথম আধুনিক মানুষ’পেট্রার্ককেরেনেসাঁ তথা নবজাগরণেরওজন্মদাতা বলা হয়ে থাকে।

      সে যাই হোক না কেন, ঠিক এই ধরনের একটি ইতালিতে দলে দলে এল কনস্টান্টিনপল থেকে পালিয়ে আসা পন্ডিতরা। যে সময়েইটালির মানুষ প্রাচীন গ্রিসএবং রোমান জ্ঞান ভান্ডারের সম্পূর্ণ আশ্বাস পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল সেই সময়ে এই শরণার্থী পন্ডিতরাইটালিতেনিয়ে এলকনস্টানটিনপলে হাজার বছর ধরে সঞ্চিত হয়ে থাকা সুপ্রাচীন গ্রন্থ সমূহ। এর আগের প্রায় একশো বছর ধরে ইটালি তথা ইউরোপের মানুষ যে ব্যক্তিত্ববাদ এবং ঐহিকতাবাদকেধীরে ধীরে মূল্য দিতে শুরু করেছিল, তারই পূর্ণ সমর্থন তারা খুঁজে পেলেন প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানদেরচিন্তায়। প্রাচীন গ্রন্থ অধ্যয়ন করে নতুন করে অনেক কথা জানার জন্য এবং চিন্তা করার জন্য তারা ব্যগ্ হয়ে পড়লেন।এতদিনদ তারা করে আসছিলেন কেবল ধর্ম-চর্চা। এখন তার জায়গা নিল জ্ঞান-চর্চা। অন্ধকার বন্ধ ঘর থেকে তাঁরা বেরিয়ে এলেন বাইরের উজ্জ্বল মুক্ত পৃথিবীতে।ইটালির পুনর্জন্ম হল। এই পুনর্জন্মকেই বলা হয় রেনেসাঁ অর্থাৎ নব-জাগরণ। ক্রমে ক্রমে তা ইটালি থেকে স্পেন, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ল।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত