| 6 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

আধুনিক যুগের জন্ম কাহিনি (পর্ব -৪)। হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট

লেখক পরিচিতি-

Adhunik Juger Janmakahini

১৯৩২ সনে লক্ষ্মীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোট গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ– বাসুদেব দাস


 

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

 

ভাছারি নামে একজন ইটালিয়ান ঐতিহাসিক লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিষয়ে লিখে রেখে গেছেন–’ বিধাতা মাঝেমধ্যে মাত্র একজন মানুষকে এত বেশি রূপ ,গুণ এবং প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেন যে তিনি যে কাজই করেন তাই অলৌকিক বলে মানুষের মনে ধারণা হয় এবং বাকি প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তার পার্থক্যটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এই কথাও প্রমাণিত হয় যে তার প্রতিভা চেষ্টার দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয় ;তা হল ঈশ্বরের দান । এরকম একজন মানুষ ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য এবং কমনীয়তা ছিল বর্ণনার অতীত; তার প্রতিভা ছিল এতটাই অসাধারণ যে তিনি করতে না পারার মতো কোনো কাজই ছিল না।’

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি করতে না পারা কোনো কাজই ছিল না।ভাছারির এই উক্তির মধ্যে বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জন ছিল না। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর। তার আঁকা ‘মোনালিসা’ এবং ‘লাস্টসাপার’ নামের ছবি দুটিকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি বলে সমগ্র জগত একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে। সেই একই মানুষ এত বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন যে আজকের মানুষ যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কথা চিন্তা করেছেন বা যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন সেইসব তত্ত্ব চিন্তা এবং আবিষ্কার লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আজ থেকে ৪০০ বছর আগেই করেছিলেন। শরীর তত্ত্ব সম্পর্কে সর্ব প্রথম সর্ব মান্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। নিজ হাতে শবদেহ কেটে মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিষয়ে সচিত্র প্রামাণ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। যে মানুষটি এত বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন,সেই একই মানুষ ছিলেনঅসাধারণ প্রতিভাশালী সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুরকার। আবার যে মানুষ বাদ্যযন্ত্র থেকে বের করে আনতে পেরেছিলেন স্বর্গীয় সুরের ঝংকার, সেই একই মানুষ সেই দুই হাতে নির্মাণ করতে পেরেছিলেন নানাবিধযুদ্ধাস্ত্র,সেতু এবং যন্ত্রপাতি। যে মানুষ সারা জীবন নিমগ্ন ছিলেন শিল্পের সাধনায় এবং বিচিত্র জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায়,তাঁর শারীরিক শক্তিও এতটাই অসাধারণ ছিল যে কঠিন লোহা দিয়ে নির্মিত ঘোড়ার খুরের নালও তিনি অনায়াসে কোমল বাঁশের মতো বাঁকা করে দিতে পারতেন।

সম্পূর্ণ আক্ষরিক অর্থে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিলেন একজন ‘পূর্ণমানব’। নবজাগরণের আদর্শের জীবন্ত প্রতিমূর্তি।

১৪৫২ খ্রিস্টাব্দেইটালির ফ্লোরেন্স নগরে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জন্ম হয়। শৈশবে লিওনার্দো ছিলেন অত্যন্ত চঞ্চল স্বভাবের। বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ কিন্তু কোনো একটি বিষয়ে বেশি দিন তার মন বসে না। ছেলেটিকেনিয়ে বাবার যথেষ্ট দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু তিনি একটা কথা লক্ষ্য করেছিলেন যে লিওনার্দো অন্য সমস্ত বিষয়ে অধৈর্য হলেও একমাত্র ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তার আকর্ষণ ছিল গভীর এবং অকৃত্রিম। অনেক ভেবেচিন্তে বাবা একদিন লিওনার্দোকেফ্লোরেন্সের সেই সময়ের  সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী এন্ড্রিয়া- ডেল-ভেরকছিওর কাছে নিয়ে গেলেন। ভেরকছিওলিওনার্দোকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন।

লিওনার্দোকে  তার অসাধারণ প্রতিভার পরিচয়দেওয়ার জন্য উপযুক্ত সুযোগের জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না। একটা স্থানীয় মঠের খ্রিস্টিয়ানসন্ন্যাসীরা একদিন ভেরকছিওকে’ সেন্ট  জনের দ্বারা খ্রিষ্টকে দীক্ষা দান’ নামে একটি ছবি এঁকে দেবার জন্য অনুরোধ করলেন। সেই সময়েভেরকছিওর হাতে আরও অনেক কাজ ছিল। তিনি ভাবলেন যে তার পক্ষে একা ছবিটা যথাসময়ে এঁকে শেষ করা সম্ভব হবে না। সেই জন্য ছবিটার এক কোণে একজন দেবদূতের ছবি এঁকে দেবার জন্য লিওনার্দোকে নির্দেশ দিলেন।

লিওনার্দো যখন ছবিটা এঁকে সম্পূর্ণ করলেন, ছবির দিকেই তাকিয়েভেরকছিওবিস্ময়েহতভম্ব হয়ে গেলেন।  তাঁর কিশোর শিষ্য স্বাভাবিক প্রতিভার বলে এরকম একটি অনিন্দ্য- সুন্দর ছবি অংকন করেছে – যে ছবি তার মতো অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ শিল্পীর পক্ষেও সাধ্যের অতীত। ভেরকছিও বুঝতে পারলেন যে তাঁর শিষ্য ইতিমধ্যে তাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। শিষ্যের কৃতিত্বে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা পরাজয়ের গ্লানিও তাকে গ্রাস করে ফেলল। সেদিন থেকে তিনি চিত্রকরেরতুলিকা চিরদিনের জন্য বিসর্জন দিয়েভাস্কর্যেরসাধনায়মনোনিবেশ করতে লাগলেন।

এদিকে চিত্রকর হিসেবে লিওনার্দোর খ্যাতি চারপাশে ছড়িয়েপড়তে লাগল। কিন্তু সেই খ‍্যাতিলিওনার্দোকেবিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট করতে পারল না। বরং জীবনে প্রথমবারের জন্য আঁকা এবং শিল্প রসিকদের দ্বারা অভিনন্দিত হওয়া সেই ছবিটি তার মনে এটা গভীর অতৃপ্তি জাগিয়ে তুলল।

তিনি অনুভব করলেন যে শিল্প-কলার সাধনার মধ্য দিয়ে যদি তিনি জীবনের একটি বিশেষ তাৎপর্য সন্ধান করতে চান তাহলে তাকে  প্রকৃতির বিষয়ে গভীরভাবেঅধ্যায়ন করতে হবে। কারণ প্রকৃতিই হল সমস্ত জ্ঞানের উৎস। এই সময়ে তিনি কেবল ছবি আঁকায় ব্যস্ত না থেকে নানা যন্ত্রপাতিরনক্সাঅংকন এবং কঠিন কারিগরি প্রকল্পের পরিকল্পনা করায় যথেষ্ট সময় খরচ করতে লাগলেন। সেই সময় তিনি যে সমস্ত কাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন আজকের মানুষ সেরকম বহু স্বপ্নকেই বাস্তবে পরিণত করেছে। কিন্তু আজ থেকে ৪০০ বছর আগেই সেই সমস্ত কথা চিন্তা করতে পারা বিরাট প্রতিভা এবং অসামান্য কল্পনার শক্তি ছিল লিওনার্দোদ‍্যভিঞ্চির। পর্বত বিদীর্ণ করে তার মধ্য দিয়ে পথ নির্মাণ করা, মানুষের উপকারের জন্য নদীর গতিবেগের পরিবর্তন করে দেওয়া,গগনচুম্বী প্রাসাদ– আধুনিক ভাষায়’স্কাই স্ক্রেপার’ নির্মাণ করা এই সমস্ত কথা তখনই চিন্তা করেছিলেন লিওনার্দোদ‍্যভিঞ্চি।

ইতিমধ্যে সমগ্র ইটালিতেলিওনার্দোরনাম মানুষের মুখেমুখেছড়িয়েপড়েছে। বিভিন্ন জায়গার ডিউক এবং অমাত‍্যরা তার সঙ্গ লাভ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। এরকম একজন ডিউক ছিলেন মিলানেরলুডোভিকস্ফর্জা । লুডোভিকের দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়ে লিওনার্দো ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দেমিলানেগিয়ে উপস্থিত হলেন। তবে লিওনার্দো যদিও ইতিমধ্যে বিখ্যাত হয়ে পড়েছেনচিত্রকর হিসেবে, কিন্তু লুডোভিকেররাজসভায় তিনি উপস্থিত হলেন গিয়ে তিনি নিজে তৈরি করা একটি আশ্চর্য বাদ্যযন্ত্রনিয়ে। এই বাদ্যযন্ত্রবাজিয়েলিওনার্দোডিউককেএতটাই মুগ্ধ করলেন যে ডিউক লিওনার্দোরচিত্রকলার প্রতি যতটা আকৃষ্ট হলেন, ঠিক ততটাই আকৃষ্ট হলেন তাঁর সংগীতের প্রতি।

মিলানেলুডোভিকের অতিথি হয়ে থাকার সময়লিওনার্দো মানুষের প্রতিকৃতি আঁকায় বিশেষভাবে মননিবেশ করলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি নিসর্গ তথা প্রকৃতিকে অধ্যয়ন করা ছাড়াও মানব প্রকৃতিও গভীরভাবেঅধ‍্যয়ন করতে লাগলেন। মিলানেবসবাসকালেলিওনার্দো যে সমস্ত ছবি এঁকেছিলেন তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল’ লাস্টসাপার’ বা ‘শেষ ভোজন’। এই ছবির বিষয়বস্তুনেওয়াহয়েছিল বাইবেল থেকে। যিশুখ্রিস্ট তার প্রধান ১২ জন শিষ্যকে নিয়ে খেতে বসেছেন। তিনি জানেন যে এটাই তার শেষ ভোজন, কারণ রোমান শাসনকর্তা তার বিরুদ্ধে যে বিচার আরম্ভ করেছে সেই বিচারে তার প্রাণদণ্ড হওয়াটা নিশ্চিত। খেতে বসে তিনি শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বললেন–Verily I say unto you that one of you shall betray me– অর্থাৎ ‘আমি নিশ্চিতভাবে তোমাদের বলছি যে তোমাদের মধ্যে কেউ একজন আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে।’ লিওনার্দো তার ছবিটির জন্য বেছে নিয়েছিলেন ঠিক এই মুহূর্তটি, কারণ এর দ্বারাই মানব চরিত্র অধ্যয়ন এবং মানুষের অর্ন্তজীবনেরনাটকীয় চিত্র প্রকাশ করার সুযোগ তিনি পাবেন। 

‘লাস্টসাপার’ এঁকে শেষ করতে লিওনার্দোর কয়েক বছর সময় লেগেছিল। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে একটি মহৎ ছবি আঁকতে কেবল সহজাত প্রতিভা এবং শ্রমশক্তিই যথেষ্ট নয়; তার জন্য গভীর চিন্তা এবং ধ‍্যানেরও প্রয়োজন। ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে ছবিটা আঁকা শেষ হল। আগেই বলে আসা হয়েছে যে মানব প্রতিভার মহত্তম কীর্তি এবং জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি গুলির ভেতরে’ লাস্টসাপার’ অন্যতম। যিশুখ্রিস্ট তার বারো জন শিষ্যের সঙ্গে শুধু শেষ ভোজন কীভাবে করেছিল বা তার অভিযোগ শুনে শিষ‍্যদের মুখে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকট হয়ে উঠেছিল সে সমস্ত কথা অন্য কেউ দেখেনি। কিন্তু লিওনার্দোর এই অমর চিত্রটি গত ৪০০ বছর ধরে মানুষের কল্পনায় এমন গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে যে লিওনার্দো তার চিত্রটিতেযিশুখ্রিস্ট এবং তার শিষ্যদের যেভাবেদেখিয়েছেন, আসলেও তাকে দেখতে ঠিক সেরকমই ছিল। এবং সেই ধরনের আচরণে করেছিল বলে মানুষ বিশ্বাস করে। 

ইতিমধ্যে মিলানে কয়েকটি ঘটনা ঘটল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দেঅর্থাৎ লিওনার্দো‘লাস্টসাপার’ এঁকে শেষ করার পরের বছর– ফরাসিরা মিলান আক্রমণ করে দখল করল। মিলানের ডিউক এবং লিওনার্দোর পৃষ্ঠপোষক মিলান ত্যাগ করে জন্মভূমি ফ্লোরেন্সে ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। এইবারফ্লোরেন্সে এসেই তিনি অংকন করলেন ‘মোনালিসা’– তার সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্র জগতের একটি চিরন্তন বিষ্ময়।

লিওনার্দো দ‍্য ভিঞ্চির’মোনালিসা’ ছবিটিকে কেন্দ্র করে এক বিশাল সাহিত্য গড়ে উঠেছে। রসিক এবং ভাবুক মানুষের মনে এই ছবিটি গত ৪০০ বছর ধরে বিচিত্রভাবের আলোড়ন তুলেছে। যে মহিলাকে মডেল বা আধার হিসেবে নিয়েমোনালিসা ছবিটি অঙ্কন করা হয়েছে তিনি ছিলেন ‘ফ্রান্সেস্ক ডেল গিওকণ্ড’ নামে একজন ফ্লরেন্সের অমাত্যের তৃতীয়পত্মী। নাম – মোনালিসা ডি আন্টিনিওমেরিয়া ডি নল্ডোঘেরারডিনি। ফ্লোরেন্সের অভিজাত সমাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব সূত্রে লিওনার্দো একদিন তাকে কোথাও দেখতে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গেমহিলাটির ছবি আঁকার বাসনা তার মনে জাগে। কিন্তু কেবল একটি সুন্দর ছবি আঁকাই লিওনার্দোর উদ্দেশ্য নয়। ছবির মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করতে চান মানব চরিত্রের গভীর রহস্য অথবা কোনো প্রতীকী  তাৎপর্য । ‘মোনালিসা’ছবিটির মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে নারীর চিরন্তন রহস্যময় রূপ। বিশেষ করে মোনালিসার মুখে যে রহস্যময় হাসি দেওয়াহয়েছে তার অর্থ খুঁজে পৃথিবীর মানুষ আজ ৪০০  বছর ধরে নাস্তানাবুদ হয়েছে।সেইমায়াময় হাসি মানুষকে শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। যতদিন পর্যন্ত এই পৃথিবীতে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি থাকবে ততদিন পর্যন্ত মোনালিসার মুখের সেই রহস্যময় হাসিটা হয়ে থাকবে মানুষের আনন্দ এবং বিস্ময়েরযুগান্তকারীউৎস, মানুষের শিল্প প্রতিভার চরমতম নিদর্শন। 

‘মোনালিসা’ ছবিটিকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সাহিত্য গড়ে উঠেছে তার মাত্র দুটি পরিচিতি এখানে দেওয়া হল।

ওয়াল্টারপেটার একজন বিখ্যাত কলা-সমালোচক। জাতিতে ইংরেজ। ইংরেজিভাষায়লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তথা মোনালিসার বিষয়ে যত লেখা বের হয়েছে সেগুলির ভেতরে ওয়াল্টারপেটার লেখা রচনাটিই অধিক সুপরিচিত এবং জনপ্রিয়। মোনালিসার বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি এরকম তীব্র কবিত্বময় ভাষা ব্যবহার করেছেন যে গদ্যে লেখা হলেও রচনাটির একটি অংশ কবিতার ধর্ম অর্জন করেছে। বিখ্যাত আইরিশ কবি উইলিয়ামবাটলারইয়েটস সম্পাদনা এবং সংকলন করা ‘অক্সফোর্ড বুক অফ ইংলিশ ভার্সেস’ নামের কবিতার সংগ্রহে ওয়ালটারপেটারেররচনাটির উক্ত অংশটি কবিতা হিসেবেই স্থান দেওয়াহয়েছে। রচনার ঠিক আসল সৌন্দর্য এবং মহত্ব অনুভব করতে হলে মূল ইংরেজিতেই তা প্রত্যেকের পড়া উচিত। এখানে সংক্ষেপে কেবল এটা বললেই যথেষ্ট হবে যে ওয়াল্টারপ্যাটেলের চোখে মোনালিসা কেবল একটি অনিন্দ্য সুন্দর ছবি নয়, চিত্রিত মোনালিসার মুখে তিনি দেখতে পেয়েছেন মানুষের কয়েক হাজার বছরের আধ্যাত্মিক বাসনা এবং অভিজ্ঞতার প্রকাশ।তাঁর চোখে Lady Lisa might stand as the embodiment of the old fancy ,the symbol of the modern idea.’ আলেকজান্ডার লেনেটহলেনিয়া একজন অস্ট্রিয়ান লেখক। বিংশ শতাব্দীর জার্মান সাহিত্যে তিনি একটা নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। তার একটি বিখ্যাত গল্প হল ‘মোনালিসা’। এই গল্পে আমরা সমান্তরাল ভাবে দুটি জিনিস দেখতে পাই ।প্রথমে পাই মানুষের কল্পনার ওপরে মোনালিসাছবিটিরবিস্ময়কর প্রভাবের বিবরণ ।দ্বিতীয়তঃমোনালিসার স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির জীবন এবং ব্যক্তিত্বের আভাস। গল্প বলা হয়েছে যদিও কিন্তু কাহিনিটির মূল অবলম্বন হল একটি সত্য ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সম্রাট লুই ইটালির মিলান শহর দখল করার জন্য  সৈন্য বাহিনী পাঠালেন। এই বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন মঁসিয়ে দলা ট্রেমুই।তাঁর অধীনে একজন সেনাপতি ছিলেন ফিলিপ দা বুগেঁভিল নামে একজন ২৩ বছরের যুবক। শিল্প-রসিক ফরাসি সম্রাট তার সেনাপতিকে এই বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে রাজ্য জয় করার সঙ্গে তিনি যেন সম্রাটের জন্য চিত্র এবং ভাস্কর্য জাতীয় কিছু উৎকৃষ্ট শিল্প সম্পদ সংগ্রহ করে আনতে ভুলে না যান। শিল্পকলার প্রতি ফরাসি সেনাপতির নিজের সেরকম কোনো বিশেষ আগ্রহ বা অনুরাগ ছিল না। কিন্তু সম্রাটের নির্দেশ তিনি সব সময় মনে রেখেছিলেন। মিলানে যাবার পথে ফ্লোরেন্স শহর। সেনাপতি ট্রেমুইসৈন্যবাহিনীকে গন্তব্য স্থল অভিমুখে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে নিজে কয়েকজন অধীনস্থ সেনাপতিকে সঙ্গে নিয়েফ্লোরেন্সে কয়েক দিন কাটাবেন বলে ঠিক করলেন।

এই ফ্লোরেন্সরই  একজন বিখ্যাত বাসিন্দা হলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তার খ্যাতি তখন দূর-দূরান্তেছড়িয়েপড়েছে। কিন্তু সেনাপতি ট্রেমুই কখনও লিওনার্দোর নাম শোনেননি। কিন্তু যেহেতু ফরাসি সম্রাট তাকে যত সম্ভব উৎকৃষ্ট চিত্র এবং ভাস্কর্য সংগ্রহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই জন্য বন্ধু বান্ধবের পরামর্শক্রমে একদিন তিনি লিওনার্দোরস্টুডিও দেখতে গেলেন। অন্যান্য সেনাপতির সঙ্গে তার সঙ্গে ছিল ফিলিপ।ট্রেমুইলিওনার্দোর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের  দুজনের মধ্যে তর্কযুদ্ধ আরম্ভ হল। তর্কযুদ্ধের বিষয় ছিল মাছির কয়টা পা। লিওনার্দোর মতে মাছির পা চারটি। অন্যদিকে ফরাসি সেনাপতি বলতে চান যে মাছির পা চারটি নয় ,ছয়টি। কেউ নিজের মত থেকে সরে আসবেন না।এভাবে কিছুক্ষণ তর্কযুদ্ধ চলার পরে ফরাসি সেনাপতি বললেন যে বিবাদ মীমাংসা করার জন্য একটাই মাত্র উপায় আছে আর সেটা হল একটা মাছি ধরে তার পা গুলি গুনে দেখা। উপস্থিত সেনাপতিদের ভেতরে ফিলিপই ছিলেন বয়সে সবচেয়ে ছোটো। একটা মাছি ধরে আনার জন্য ট্রেমুইফিলিপকে আদেশ দিলেন। ফিলিপ মাছিটা ধরতে যেতেই সেটা উড়ে ঘরের চারপাশে বেড়াতে লাগল। এভাবে ঘুরে ফিরে মাছিটা কোনো এক ফাঁকে ঘরটারপেছনদিকে পর্দার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিলিপ পর্দাটা সরিয়েমাছিটাকে অনুসরণ করলেন।

ফিলিপ পর্দার ওপারে  দাঁড়ানো মাত্র উজ্জ্বল আলো এসে তার চোখে পড়ায় ক্ষণিকের জন্য তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তার ধারণা হল যে এটা নিশ্চয় আগুনের আলো অথবা হীরা মুক্তার ঝলসানো আলো। কিন্তু দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার পরে তিনি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন যে আসলে সেই আলোটা বেরিয়ে আসছে একটি ছবি থেকে। সেই সময়ে নতুন করে আবিষ্কৃত তেল রঙে আঁকা ছবিটা ছিল একজন মহিলার। তার চোখ দুটো সামান্য বাঁদিকেঘুরিয়ে এভাবে তাকিয়ে আছেন যে ফিলিপদাঁড়িয়ে থাকা জায়গা থেকে দেখলে ছবির মহিলাটি  ঠিক ফিলিপের দিকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হয়। মহিলাটির মুখে একটি মোহিনী হাসি। কিন্তু মহিলাটি কেন হাসছে এবং সে হাসির অর্থ কী সে কথা বোঝা অসম্ভব। তাছাড়া মহিলাটির মুখে যদিও ওড়না নেই কিন্তু তার হাসিটা দেখলে এরকম মনে হয় যেন একটি পাতলা ওড়নার মধ্য দিয়ে হাসিটা দেখা যাচ্ছে। যে উজ্জ্বল আলো দেখে ফিলিপের চোখ ধাঁধিয়েগিয়েছিল সেই আলোটা সৃষ্টি করেছিল ছবির মহিলাটির মুখের সেই হাসিটা। 

মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সেই ছবিটি ফিলিপের জীবনের গতি বদলে দিল। ছবিতে চোখ পড়ার মুহূর্ত থেকে সেই ছবিটাই হয়ে উঠল তার জীবনের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। কোন জীবন্ত মহিলাকে মডেল হিসেবে নিয়ে ছবিটি আঁকা হয়েছে সে কথা জানার জন্য ফিলিপ উন্মাদ হয়ে উঠলেন। মানুষকে জিজ্ঞেস করে ফিলিপ জানতে পারলেন যে লিওনার্দোর ছবির মডেলমহিলাটির নাম মোনালিসা দ্য এন্টেনিয়োমেরিয়া দ্য নল্ডোঘেরারডিনি, আর তিনি হলেন ফ্রান্সেস্কডেলগিঅ’কণ্ড নামে ফ্লোরেন্সের একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের তৃতীয় পত্নী । কিন্তু তার সঙ্গে এ কথা জেনেও ফিলিপমর্মাহত হলেন যে তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করা সেই মহিলাটি আর ইহ সংসারে নেই; প্রায় দুই বছর আগে ১৫০১ খ্রিস্টাব্দেমহামারীপ্লেগে তার মৃত্যু হয়েছে ।

কিন্তু ফিলিপের মানসিক অবস্থা তখন এরকম যে, যে মহিলাটিকেমডেল হিসেবে নিয়েমোনালিসার ছবিটি আঁকা হয়েছে তিনি আর সত্যিই ইহ সংসারে নেই  বলে বিশ্বাস করতে ফিলিপসের ইচ্ছা হল না । তিনি নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে মোনালিসারমডেলনিশ্চয় অন্য কোনো একজন মহিলা, আর তিনি এখনও বেঁচে আছেন। মহিলাটিকে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করার জন্য তিনি দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করলেন কিন্তু তবু পুরো ব্যাপারটাতে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি পুনরায় একবার দা ভিঞ্চিরবাড়িতে গেলেন। 

এবারও দা ভিঞ্চিফিলিপকে নতুন কোনো আশা দিতে পারলেন না । তিনি ফিলিপকে পুরো ঘটনাটা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন যে মোনালিসার সত্যিই কবেই মৃত্যু হয়েছে। সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

এবারও ফিলিপের কাজ হল মোনালিসার সমাধিস্থল খুঁজে বের করা। তিনি মোনালিসার সমাধি খুঁড়ে  দেখবেন। যদি সেখানে তিনি মোনালিসারশবদেহ আবিষ্কার করেন, তাহলে মোনালিসার মৃত্যু সম্পর্কে তিনি চিরকালের জন্য নিশ্চিত হতে পারবেন। ছবিটির যে মুখ তাকে উন্মাদপ্রায় করে তুলেছে, আর কিছু না হলেও মুখটার শরীরী রূপটা অন্তত তিনি নিজের চোখে দেখতে পাবেন ! আর যদি সমাধিতে মোনালিসারশবদেহ নেই ….

অনেক চেষ্টা করার পরে ফিলিপমোনালিসাকেসমাধিস্থ করা গির্জা ঘরটি খুঁজে বের করলেন। সমাধি খোঁড়ার  জন্য তিনি সঙ্গে দুটি মানুষ নিয়েগিয়েছিলেন। সেই সময় ইউরোপে এই ধরনের সিঁধ কাটা চোরের অভাব ছিল না। ওদের মাধ্যমে সমাধি খুঁড়েফিলিপ আবিষ্কার করলেন যে মোনালিসার শব দেহ যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে আসলে কিছুই নেই। সমাধি শূণ্য। এই কথার অর্থ কি?ফিলিপের মনে কোনো সন্দেহ বাকি রইল না যে মোনালিসা এখনও বেঁচে আছে অথবা বিশেষ উদ্দেশ্যে তাকে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কেবল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটা শব শূন্য সমাধির ওপরে মোনালিসা নামটা লিখে রাখা আছে । এরকমও হতে পারে যে সের ফ্রান্সেস্কঅর্থাৎ মোনালিসার স্বামী তার পত্নীর চরিত্রে সন্দেহ করে তাকে নির্জন কারাগারে বন্দী করে রেখে তার উপরে নানা অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। ফিলিপ সেই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি যেভাবেই হোক মোনালিসাকেবন্দিশালা থেকে মুক্ত করবেন।

এর কিছুদিন পরে ফিলিপ তার কয়েকজন বন্ধু সামরিক অফিসার এবং সৈন্য সামন্ত নিয়ে সের ফ্রান্সিস্কেরবাড়িতে গেলেন। উদ্দেশ্য বন্দি দশা  থেকে মোনালিসাকে মুক্ত করা। সেখানে মোনালিসার স্বামী ফ্রান্সিস্কের সঙ্গে ফিলিপের অনেক তর্কবিতর্ক হল।ফিলিপ অভিযোগ করলেন যে মোনালিসার মৃত্যু হওয়া বলে ফ্রান্সেস মিথ্যা প্রচার করেছেন কারণ যে সমাধিতে মোনালিসারশব যেখানে থাকার কথা সেখানে সেই শবদেহ নেই। তার একমাত্র অর্থ এই হতে পারে যে মোনালিসা এখনও বেঁচে আছেন এবং ফ্রান্সিস্কেই তাকে বন্দী করে রেখেছেন।ফিলিপ এখন দরকার হলে অস্ত্র প্রয়োগ করে হলেও মোনালিসাকে উদ্ধার করবেন। ফিলিপের অভিযোগ শুনে ফ্রান্সেস্কহতভম্ব  হয়ে গেলেন। তারপরে কোনো এক ফাঁকে তিনি ফিলিপএবং তার সঙ্গীদের ঠেলা মেরে রাজপথের দিকে দৌড় দিলেন।

ফিলিপ এবং তার সঙ্গীরা মোনালিসার খুঁজে ফ্রান্সেস্কের প্রাসাদ লণ্ডভণ্ড করতে লাগল। মোনালিসা ভেবে দুজন শুয়ে থাকা দাসীকে তারা বিছানা থেকে ছেঁচড়ে টেনে নামালেন ।কিন্তু তাদের ভুল ভাঙতেবেশিসময় লাগল না। এদিকে ফ্রান্সেস্কফ্লোরেন্সের  কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে তার প্রাসাদে ফিরে এলেন । তারা ফিলিপ এবং তার ফরাসিসৈন্যবাহিনীকে এমন ভাবে তাড়া করল যে তারা প্রাণ ভয়ে দৌড়ে পালাতে বাধ্য হল। ফ্লোরেন্সের  অধিবাসীরা নিজের নিজেরবাড়ি থেকে রাজপথে বেরিয়ে এসে ফরাসি সৈন্যদের মাথার উপরে শিলাবৃষ্টি করতে লাগল।

কিন্তু ফিলিপ এত সহজে হার মানার মানুষ নয়। মোনালিসার চিন্তা তার চেতনাকে এমন ভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে তার হিতাহিত জ্ঞান প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। তিনি খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে ফ্লোরেন্সের প্রাসাদ ছাড়াও গ্রামে ফ্রান্সেস্কের আরও দুটি বাড়ি রয়েছে।  সেই বাড়িদুটির যেকোনো একটিতেমোনালিসাকেলুকিয়ে রাখা অসম্ভব নয়। বিপদের ভয়কে তুচ্ছ করে তিনি সেই দুটো বাড়িতেতন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন কিন্তু আগের বারের মতোই এবারও তিনি হতাশ হলেন।মোনালিসার নিষ্ফল সন্ধানে সারাদিন এভাবে অতিবাহিত করে সন্ধ্যেবেলা তিনি পুনরায় ফ্রান্সেস্কেরফ্লোরেন্সেরবাসগৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। উদ্দেশ্য পুনরায় একবার ফ্রান্সেস্কের মুখোমুখি হওয়া। ফ্রান্সেস্কের বাড়ির দরজার সামনে উপস্থিত হয়ে ফিলিপ  ঘোড়া থেকে নেমেছেন মাত্র, ঠিক তখনই তিনি দেখতে পেলেন যে একজন যুবক দুজন কর্মচারী সঙ্গে নিয়েফ্রান্সেস্কেরবাড়িতে প্রবেশ করছেন। তাকে দেখেই ফিলিপ দরজার মুখ থেকে চিৎকার করে বললেন– শুনুন আপনি স্যার ফ্রান্সেস্ক ডেল গিঅ’কণ্ডকে চেনেন নাকি? যদি চেনেন তাহলে আমি আপনার কাছ থেকে তার বিষয়ে দুটো কথা জানতে চাইব।’

এরপরে স্বাভাবিকভাবেই দুজনের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হল এবং একে অপরকে নিজের পরিচয় দিতে হল। কিন্তু ফ্রান্সেস্কের বাড়িতে বেড়াতে আসা মানুষটি যেই বললেন যে তার নাম আমেরিগোকাপ্পনি, ফিলিপের তখনই মনে পড়ে গেল যে সেই নামটা তিনি আগে কোথাও শুনেছেন। কোথায় শুনেছিলেন? কোথায় শুনেছিলেন? অবশেষে তার মনে পড়ল । লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একদিন ফিলিপের জেরার উত্তরে বলেছিলেন যে ফ্রান্সেস্কের পত্নী মোনালিসাবোধহয় গোপনে  কাপ্পনির প্রতি আসক্তা ছিলেন । কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেফিলিপচিৎকার করে উঠলেন – তোমার এত স্পর্ধা ? তুমি যে মানুষটাফ্রান্সেস্কের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতাকরেছ সেই একই মানুষটা বন্ধুর বেশে ফ্রান্সেস্কেরবাড়িতে বেড়াতে এসেছ? আজ তোমাকে সহজে ছাড়ছি না। এসো তোমাকে এখন আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে।’

ফিলিপের আশ্চর্য আচরণ দেখে, কথাবার্তা শুনে কাপ্পনির মনে দৃঢ় ধারণা হল যে মানুষটানিশ্চয় পাগল। না হলে আর লোকের বাড়িতে এসে অপরিচিত মানুষ একজনের সঙ্গে এভাবে গায়েপড়েঝগড়া করে? তিনি ফিলিপেরকথায়  বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ফিলিপ তার পথ রোধ করে তর্জন গর্জন করে কাপ্পনিকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান করলেন। অবশেষে কাপ্পনির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। ফিলিপকেধাক্কা মেরে বের করে দেবার জন্য তিনি নিজের অনুচরদের হুকুম দিলেন। প্রভুর হুকুম পেয়ে অনুচররাফিলিপেরওপরে  ঝাঁপিয়েপড়ল। তাই দেখে ফিলিপের অনুচররাও তাদের প্রভুকে রক্ষা করার জন্য ইটালিয়ানদের  সঙ্গে হুটোপুটি শুরু করে দিল। দুই পক্ষের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। অবশেষে ঘটনা এরকম ধারণ করল যে কাপ্পনি নিজেও খাপ থেকে তরবারি বের করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু তিনি আর সেই তরোয়াল ব্যবহার করার সুযোগ পেলেন না। ফিলিপের একজন অনুচর পেছন থেকে তাকে এভাবে আক্রমণ করল যে কাপ্পনি নিজের তরোয়ালের ওপরে হুমড়িখেয়েপড়লেন এবং জায়গাতেই তার মৃত্যু হল। 

এই ঘটনা ফরাসিদের জন্য বড়ো বিপদের কারণ হয়ে উঠল, কারণ আগেই বলা হয়েছে যে তারা ফ্লোরেন্সে  কয়েকদিনের জন্য অতিথি হয়ে এসেছিলেন। ফিলিপের উন্মাদ সদৃশ আচরণ ইতিমধ্যেই ফ্লোরেন্সের  অধিবাসীদের ফরাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এখন ফিলিপের হাতে ফ্লোরেন্সের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির শোকাবহ মৃত্যু ঘটায়ফ্লোরেন্সের মানুষ ক্রোধে অগ্নি শর্মা হয়ে উঠল। তারা দলে দলে এসে ফরাসি ছাউনি ঘিরে ধরে প্রতিশোধ দাবি করতে লাগল। ফরাসি সেনাপতি মঁসিয়েদ‍্য লা ত্রেমুই অবশেষে বুঝতে পারলেন যে, যে কোনো উপায়েইটালিয়ানদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে তার পক্ষে প্রাণ নিয়ে ফ্লোরেন্স ত্যাগ করা অসম্ভব। তিনি ফিলিপের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আঁকা ‘মোনালিসা’ছবিটির এরকমই মাহাত্ম্য ছিল যে মৃত্যুর দরজা মুখে  পা রেখেও ফিলিপমোনালিসার মৃত্যু হয় নাই বলেই বিশ্বাস করতে থাকেন। মৃত্যুর আগেই তিনি শেষবারের জন্য মোনালিসাকে দেখতে চাইলেন। কিন্তু মোনালিসার তো সেই কবেই মৃত্যু হয়েছে, তিনি ফিলিপকে দেখা দিতে কীভাবে আসবেন?

কিন্তু মোনালিসা না এলেওফিলিপকে শেষ দেখা দেখতে অন্য একজন মানুষ এসেছিলেন, তিনি হলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।

মৃত্যু পথযাত্রী ফিলিপের সামনে দাঁড়িয়েলিওনার্দোশান্তভাবে ঘোষণা করলেন যে মোনালিসা এখনও বেঁচে আছে বলে ভেবে থাকা কথাটা ফিলিপের পক্ষে উচিত হয়নি, কারণ মোনালিসা সত্যিই ইহসংসারে নেই। লিওনার্দোর কথা শুনে ফিলিপ কিছুক্ষণ দাঁত চেপে  চুপ করে রইলেন। তারপরে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাসছেড়ে বললেন–’ অবশেষে আমি বিশ্বাস করছি যে মোনালিসা এখন সত্যিই পরলোকের অধিবাসিনী। কারণ কোনো মানুষই মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত একজন মানুষকে মিথ্যা কথা বলবে না । যা হল ভালোই হল কারণ যে পৃথিবীতে মোনালিসা নেই সেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। এখন আমার জন্য মরণই ভালো কারণ মরার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওপারে মোনালিসাকে দেখতে পাব।’

ফিলিপের কথা শুনে লিওনার্দো বললেন– মহাশয়, মৃত্যুকে প্রত্যেকেইভয় করে, যদিও আমি মনে করি যে সেই ভয় অতিরঞ্জিত। সে যাই হোক না কেন, কিছুক্ষণ পরেই আপনি মৃত্যুবরণ করবেন। এরকম অবস্থায় মৃত্যুর পরে আপনি যে আনন্দ এবং সৌভাগ্যের অভিজ্ঞতা লাভ করবেন বলে বিশ্বাস করছেন সেই বিশ্বাস থেকে আপনাকে বঞ্চিত করাটা আমার পক্ষে উচিত হবে না। অনেক মানুষই বিশ্বাস করে যে তারা মৃত্যুর পরে স্বর্গে গিয়েপ্রথমবারের জন্য মনের আনন্দে এই ধরনের সুখ এবং বিলাস-ব্যসন উপভোগ করতে পারবেন- যে সমস্ত সুখ এবং বিলাস-ব‍্যসন সাধারণত পৃথিবীতে থাকে না বলে ভাবা হয়। আপনি নিজেও ঠিক এই ধরনের একটা আনন্দ অর্থাৎ রমণীর রূপভোগ করার জন্য অস্থির হয়ে নিজের জীবনটা ধ্বংস করলেন। আমরা দুজনেই অভিজাত শ্রেণীর মানুষ। সেই জন্য একজন বন্ধু হিসেবে আপনাকে খোলাখুলি ভাবে একটা কথা বলতে চাই। আমি আপনাকে বলতে চাই যে, যে জিনিসটা আপনি ইহজগতে পেলেন না সেটা আপনি মৃত্যুর ওপারে কখনো আশা করতে পারেন না। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে উপনীত হয়ে আপনি আমার মুখে এই ধরনের ধর্মবিরুদ্ধ কথা শুনে খারাপ পেলেও তার জন্য আমার আক্ষেপ করার কিছু নেই। স্বর্গ এবং নরকের অস্তিত্ব মানুষের একটি উদ্ভট কল্পনা! প্রধানত ভীরু প্রকৃতির মানুষ এই স্বর্গ এবং নরকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। আর বিশ্বাস করে মৃত্যুর দরজা মুখে এসে উপনীত হওয়া মানুষ। আমার কিন্তু স্বর্গ এবং নরকের কথা শুনলে হাসি উঠে। আমরা মৃত্যুর পরে সর্বসুখ লাভ করব বা অবর্ণনীয়ইন্দ্রিয় সুখ লাভ করব– এই ধরনের অলীক বিশ্বাস থেকে আমরা বেঁচে থাকার প্রেরণা খোঁজা উচিত নয়। সত্য এবং সৌন্দর্যের মধ্যে আমরা যে আনন্দ অনুভব করি, একমাত্র সেটাই আমাদের শক্তি যোগানো উচিত। আমরা শক্তি আরোহন করা উচিত সম্মান এবং নৈতিকতার মধ্যে অনুভব করা আনন্দ থেকেও।’

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত