| 28 এপ্রিল 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গল্প: ভূমিকন্যা ও দশরথ কন্যা শান্তা । বিতস্তা ঘোষাল

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

রাজপ্রাসাদ জুড়ে আলোর রোশনাই। তোরণ থেকে প্রাসাদ সেজে উঠেছে ফুলের মালা দিয়ে।অঘোষিত ছুটির আনন্দে মাতোয়ারা পল্লীবাসী। এতদিন বাদে রাজ্যবাসীর অধীর অপেক্ষা পূরণ হয়েছে। তিনি ফিরেছেন বনবাস শেষ করে রাজ্যে।এবার বুঝি যাবতীয় অশান্তি,খারাপ দিন শেষ হয়ে স্বর্গ নেমে আসবে পৃথিবীতে।এই খুশিতেই তাদের এত উচ্ছ্বাস।

দুই ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী এত ঝড় সামলে অবশেষে ঘরে ফিরেছে জানার পর থেকে শান্তার মন চঞ্চল বাড়িতে আসার জন্য।কিন্তু তার স্বামী ক’দিন নিজের কুটীর থেকে দূরে অন্য একটি নির্জন স্থানে নিজস্ব কাজে ব্যস্ত থাকায় সেই আনন্দের মুহূর্তে শান্তা আসতে পারল না। সে যখন এল তখন উৎসবের রেশ অনেকটাই মিলিয়ে গেছে। যে যার কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এই রাজপ্রাসাদের মেয়ে শান্তা।জীবনের অধিকাংশ সময়টাই তার কেটেছে প্রাসাদের বাইরে অন্যত্র। কিন্তু এই পরিবারের বিপদে-আপদে সে সব সময় পাশে থেকেছে, নিজের মত করে চেষ্টা করেছে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে।এই আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করার জন্য  সে প্রাসাদে পা রাখল।

এই পরিবারকে বাইরে থেকে যতটা যৌথ মনে হয়,ভেতরে ততটাই ভঙ্গুর। খুব প্রয়োজন না হলে কেউ কারোর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা তো দূরের, মৌখিক কথোপকথনও প্রায় নেইও বললেই চলে। তবু বংশের প্রথম মেয়ে হিসেবে শান্তা একে একে সকলের সঙ্গে দেখা করে প্রণাম জানিয়ে ভাইয়ের স্ত্রীদের ডেকে পাঠালো মায়ের প্রাসাদে।

শান্তাদিদি এসেছেন শুনে দুই ভাই ভরত শত্রুঘ্নর স্ত্রী মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্ত্তি এসে প্রণাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করে নিজ নিজ প্রাসাদে ফিরে গেল।শান্তা অধীর আগ্রহে বড়ো দুই ভাই-এর স্ত্রীর অপেক্ষা করছিল। অনেকক্ষণ কেটে যাবার পরেও তারা না আসায় বিরক্ত হয়ে মায়ের কাছে গেল। মা কৌশল্যা এখন অধিকাংশ সময়-ই কাটান আরাধ্য দেবতার মন্দিরে। সংসার থেকে তাঁর বেঁচে থাকার কোনও রসদ আর খুঁজে পান না তিনি। শান্তা যখন মন্দিরে তাঁর কাছে এল তখন তিনি মালা গাঁথছেন।

-মা, চন্দ্র পরিবারের দুই পুত্রবধু কোথায়? আমি খবর পাঠিয়েছি জানার পরেও একবার দেখা করতে এলো না! শান্তার গলার স্বর শুনে কৌশল্যা স্থির চোখে শান্তার দিকে তাকাল। তার পর হাতের সুচ ও অর্ধেক গাঁথা মালা রুপোর পুষ্পপাত্রে রেখে ধীর স্বরে বলল-  তুমি -কখন এলে? মুনিবর এসেছেন তোমার সঙ্গে?

-না। তিনি আশ্রমে রয়েছেন।

-তোমাদের খবর সব ভালো?

-হ্যাঁ।কিন্তু আমি তোমাকে অন্য প্রশ্ন করেছি।

-তোমার ভাইদের সঙ্গে দেখা হল? কৌশল্যা এবারও প্রশ্নের উত্তর দিল না।

-না। তারা এখন দরবারে। আমি এতদিন বাদে এলাম।অথচ…

শান্তাকে থামিয়ে দিয়ে কৌশল্যা বলল- তুমি অযথা উতলা হচ্ছ। দীর্ঘ সময় তুমি এখানে আসনি, এত দিন বাদে এলে, বিশ্রাম করও, ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে।

-কী জানতে পারব? এতদিন বাদে এখানে এত বড়ো উৎসব হল, এখনও রাজপথ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিতে পুষ্পতোরণ, প্রাসাদেও তো খুশির ছোঁয়া থাকা উচিত ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছে কেমন নিষ্প্রাণ সব। বড়ো ভাইকে কি তার প্রাপ্য সম্মান দেয় নি ভরত?

-এ ভাবনা মনেও এনো না শান্তা। ভরত এত বছর তার ভাইয়ের পাদুকা সিংহাসনে রেখে এ রাজ্য শাসণ করেছে।সে ফিরে আসা মাত্র নিজে নগর দ্বারে গিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে এসে রাজ্যের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দিয়েছে।

কৌশল্যা মেয়েকে অন্য কথা বলে কথার অভিমুখ বদলাবার চেষ্টা করলেও শান্তার মন পড়ে রইল তার প্রাণাধিক প্রিয় দুই ভাতৃবধুর কথা জানার জন্য। এই প্রাসাদে তারা আসার অনেক আগে থেকেই মিথিলার এই চার রাজকন্যার সঙ্গে তার পরিচয়।জনকরাজের ডাকা একাধিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সে ও তার স্বামী অংশ গ্রহণ করেছে।সেখানে দেখেছে এই চার বোন পরম যত্ন নিয়ে অতিথিদের সেবা করছে, প্রত্যেকের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ রাখছে, তারা নিজেরাও যথেষ্ট শাস্ত্র জ্ঞান অর্জন করেছে অল্প বয়সেই।তাদের আতিথেয়তা ও সৌজন্য বোধ তুলনাহীন।

তার পর এই পরিবারের পুত্রবধূ হয়ে এল তারা। বহু বছর ধরে পিতা দশরথের তিন স্ত্রীর মধ্যে চলা নীরব সংঘাত, অস্বাভাবিক নীরবতা তারাই এসে অনেকটা স্বাভাবিক করে তুলল। এমনকি বনবাসে থাকার দিনগুলোতে যতবার দেখা হয়েছে মৈথেলীর সঙ্গে সেই একই প্রাণচঞ্চলে ভরপুর। কারণে-অকারণে সে ছুটে এসেছে তার প্রিয় দিদি-ননদ শান্তার কাছে।

আর ঊর্মিলা! জটিল পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে তার মতো যোগ্য নারী শান্তা কম দেখেছে। দশরথের মৃত্যুর পর সবাই যখন শোকমগ্ন, তখন সে একা হাতে যেভাবে রাজ্যকে তথা এই পরিবারকে আগলে রেখেছিল, তাতে তার কর্তব্যবোধ যে কত তীব্র তা বোঝা গেছিল।

তাহলে সে যখন এল ঊর্মিলা তখন কি লক্ষ্মণের সঙ্গে ছিল? তাই তৎক্ষণাৎ এসে দেখা করতে পারল না? এটাই তো স্বাভাবিক। সীতা তবু তার স্বামীর সঙ্গে ছিল, কিন্তু সে! এত বছর ধরে একা,সুখ –দুঃখ,আনন্দ কোনও কিছুই ভাগ করার মতো সঙ্গী তার ছিল না। এতদিনের জমানো কথা বলার জন্য সময় তো লাগবেই।

পরমুহুর্তেই শান্তার মনে পড়ল প্রাসাদে প্রবেশের সময়ই সে জেনেছে লক্ষ্মণ প্রাসাদে নেই। জরুরী কোনও কাজে অন্য নগরে গেছে। ঊর্মিলা তার সঙ্গে গেছে এমন কথা তো রক্ষী বলল না।

কৌশল্যা মেয়ের ভাবনাগুলো বুঝতে পেরে বলল- যেদিন এ বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্র আমার সন্তান বনবাসে গেল, লক্ষ্মণ ও সীতা তার সঙ্গী হল সেদিন থেকে ঊর্মিলার ঘরের দরজা বন্ধ। সেদিনের পর থেকে তাকে আর কেউ দেখতে পায়নি শান্তা।

-তা কি করে সম্ভব? ভরতরা অযোধ্যায় পৌঁছবার আগে রাজ্য জুড়ে যখন অশান্তি শুরু হল,এমনকি রাজা মারা যাবার খবর পেয়ে বহিঃশত্রুর রাজ্য আক্রমণের চক্রান্ত শুরু হল তখন তো সে একাই রাজ্যপাট সামলেছে মা। আমি আসার আগে পর্যন্ত তোমাদেরকেও দেখ-ভাল করেছে।আমি যখন এলাম তখনও সে তার সব দায়িত্ব নিপুণভাবে পালন করেছে।আমি জানি প্রথমদিকে রাজ্য পরিচালনায় সে দুই ভাইকেও সাহায্য করেছে।

-হ্যাঁ। কিন্তু  সে সব মিটে যাবার পর থেকে আর একটিবারের জন্যও বাইরে আসেনি।

-তোমরা একবারও তাকে ডাক নি? সে এই রাজ্যের এই পরিবারের কুলবধূ মা।

-প্রথমদিকে দু-একবার তাকে ডাকা হয়েছিল বোধ হয়। তখন সকলেই শোকে নিমগ্ন। তাছাড়া সে আমার পুত্রবধূ নয়।সুমিত্রা যদি তাকে যত্ন করে না ডাকে আমি কী করব?

– এত কিছু ঘটে যাবার পরেও তোমরা পাল্টালে না? শান্তা স্তম্ভিত হয়ে গেল কৌশল্যার কথা শুনে। যে মেয়েটি এই পরিবারের বিপদে একা হাতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব দায়িত্ব পালন করল তার খোঁজটুকু নেওয়া তোমরা আমার-তোমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে দিলে? এই পরিবার কখনও সুখী ছিল না, হতেও পারে না।

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শান্তা আবার জিজ্ঞেস করল- লক্ষ্মণ আসার পরও সে দরজা খোলেনি?

-খুলেছিল।কিন্তু…

-কি কিন্তু?

-সীতাকে…

-সীতার কী হয়েছে মা? ওকেও তো দেখতে পেলাম না। অদ্ভুতভাবে কেউ আমাকে কিছু বলল না।

-কি বলবে বাছা? সীতাকে তোমার দাদা বনে পাঠিয়েছে।আর স্বয়ং তার ভাই লক্ষ্মণ সে আদেশ পালন করে তাকে বনের সীমান্তে ছেড়ে এসেছে। ঊর্মিলা তা জানতে পেরে প্রথমে প্রতিবাদ জানালেও কেউ যখন তার কথা শুনলো না,তখন আবার নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।

-কী বলছ মা? সীতাকে বনে পাঠিয়েছে কেন?

-সে অসতী।রাবণ তাকে তুলে নিয়ে গেছিল। ফেরার পর সে সন্তানসম্ভবা হয়…

-বুঝেছি মা। এই বংশের রক্ত যাবে কোথায়? এই বংশ ধ্বংস হবে,

কৌশল্যা এতক্ষণে হাসল। রাজার কোনও দোষ হয় না শান্তা। আর ধ্বংস? কে চায় এই পরিবার অক্ষুণ্ণ থাকুক!

শান্তা রাজমাতার মুখে এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। এ কীসের অশণি সংকেত? চন্দ্র বংশের ইতিহাস ভবিষ্যতে কী লিখতে চলেছে? সবটাই কি পাপ অন্যায় অমর্যাদার ইতিহাস হবে! ভাবতে ভাবতে সে উঠে পড়ল।

ঊর্মিলার বন্ধ দরজার সামনে শান্তা এসে থামল যখন সূর্য অস্তগামী।কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে জ্যোতির চিহ্ণ। শান্তা চোখ বন্ধ করল। সেই মুহূর্তে তার উপলব্ধি হল ঊর্মিলা এই বাহ্যিক মান-অপমান চাওয়া পাওয়ার অনেক ঊর্ধে উঠে এক সাধিকার স্তরে উন্নীত হয়েছে।তাকে আর সাধারণ সুখ দুঃখ হাসি কান্না স্পর্শ করছে না।

তবু সে ডাকল ‘ঊর্মিলা’ বলে। কিছুক্ষণ বাদে উর্মিলার বিশ্বস্ত সখী বেরিয়ে এসে একটা চিরকুট দিল তাকে। তাতে লেখা- শান্তা দিদি আমার জন্য ভাববেন না, আমি ঠিক আছি।সীতার এখন আপনাকে বেশি প্রয়োজন। আপনি তার কাছে গেলে সে মনে শক্তি পাবে।আমাকে ক্ষমা করবেন।প্রণাম নেবেন।

শান্তার চোখ ভরে গেল জলে। মিথিলার সেই ছোট্ট মেয়েটা, যে অনর্গল কথা বলে যেত, হুটোপুটি করে এ ঘর থেকে অন্য ঘর দৌড়ে যেত, অতিথিদের যত্নে যাতে খামতি না হয়, অতটুকু বয়স থেকেই খেয়াল রাখত, পাশাপাশি নিরন্তর জ্ঞান চর্চা করত, এই পরিবারে এসে তার জীবন এভাবে বদলে গেল। ভাই লক্ষ্ণণ আগামী পৃথিবী তোমাকে করুণাটুকুও করবে না এই অধর্মের জন্য। দু-দুটি অধর্ম!

শান্তা ফিরে এল আশ্রমে।

তপবনে শান্তা যখন পৌঁছল আশ্রম শান্ত। মধ্যাহ্ণের সূর্য মাথার উপর। প্রথম পর্বের অধ্যয়ণ ও সকালের কাজ শেষ করে আশ্রমিকরা নিজের কুটীরে দ্বি-প্রহরের অন্ন গ্রহণ করছে।এই সময় কুটীরে প্রবেশ করে তাদের বিরক্ত করতে চায় না শান্তা।কিন্তু তার মন বড়ো অশান্ত।

রাজপ্রাসাদ ছেড়ে আসার সময় নগরপ্রান্তে লক্ষ্মণের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। শান্তাকে দেখা মাত্র রথ থেকে নেমে প্রণাম জানিয়ে কুশল বিনিময় করেছিল সে। জানতে চেয়েছিল কেন এখনই তিনি চলে যাচ্ছেন ভাইদের সঙ্গে দেখা না করে।

শান্তা বলেছিলেন – এই পরিবার কখনও কোনও নারীকে সম্মান দিতে শেখেনি। তাদের পিতা থেকে শুরু করে আজও সেই ধারা বহমান।

তার কথা শুনে লক্ষ্মণ বলেছিল – আমাকে মার্জনা করবেন।আমি কেবল আজ্ঞাধারী সেনামাত্র। ইচ্ছে না থাকলেও ছোটো থেকে জেনেছি রাজার ছায়াসঙ্গী দেহরক্ষীকে আদেশ মানতেই হবে। প্রশ্ন করা চলবে না। ন্যায় –অন্যায়, নীতি- এসব এখানে স্থান পায় না।আমি তাই করেছি। কথা বলতে বলতে তার চোখ বেয়ে জল নেমে এল।

শান্তা সেই দূর্বল মুহূর্তে জেনেছিল জানকী কোথায় আছে।

লক্ষ্মণ বলেছিল – ছল করে সীতাকে রথে করে যমুনার কূলে নিয়ে এসে নৌকায় নদী পার হয়ে বাল্মিকীর আশ্রমে রেখে এসেছি। ভ্রাতা আদেশ করেছিলেন তাঁকে রাজ্যে রাখা যাবে না।

-কিন্তু কেন?

-ভ্রাতা প্রজাদের কথা শুনে মনে করেছেন সীতা অসতী। রাবণের সন্তান তার গর্ভে।তাই তাকে ত্যাগ না দিলে রাজ্য অনাচারে ভরে যাবে।আমি তাকে অনেকবার বুঝিয়েছি সীতাকে বর্জন করলে এ রাজ্য লক্ষ্মী ছাড়া হবে।ভরত ও শত্রুঘ্নও তার এই রূঢ় প্রস্তাব শুনে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বারণ করেছিল এ কাজ করতে।আমরা এমনও বলেছিলাম, যদি একান্তই বিনা অপরাধে তাকে এমন শাস্তি দিতে হয় তবে এখানেই অন্য কোনও ভবনে রাখলেও তো হয়!

-শুনে সে কী বলল?

-সে বলল, তাতে অপবাদ আরও বাড়বে।তাই এ প্রস্তাব সে মানতে পারবে না।

এ কথা শোনামাত্র শান্তা ক্রদ্ধ হয়ে বলেছিলেন – রাজা হয়ে এক নারীর প্রতি তিনি যা করলেন তাতে পৃথিবীতে কোনও নারী তার মতো স্বামী কামনা করবেন না।কোনও মাতা-পিতা কন্যার জন্য এমন জামাই চাইবেন না।তুমিও সেই পাপের ভাগীদার। তবে তোমার অপরাধ তুমি নিজের স্ত্রীকেও মর্যাদা দিতে পারনি। তাকে একা রেখে তুমি কর্তব্য পালনে চলে গেলে।একবারও ভাবনি তার কী হবে,সে কিভাবে দিন কাটাবে! তুমিও কখনও শান্তি পাবে না লক্ষ্মণ। তোমার জন্যেও অনেক দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে।

ঊর্মিলার কথা শুনে লক্ষ্মণ কয়েকমুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যে ঊর্মিলাকে সে চোদ্দ বছর আগে রেখে গেছিল, ফিরে এসে সেই নারীকে আর ফেরত পায় নি। এখন যে আছে সে প্রগাঢ় প্রজ্ঞা সম্পন্ন এক সাধিকা।তার সামনে যেতে স্বামী হিসাবে সংকোচ হচ্ছে।   কিন্তু সে পুরুষ।এই দূর্বলতা প্রকাশ করা চলবে না।

সে নীরবে মাথা নীচু করে শান্তার কথা শুনে প্রণাম করল। শান্তা তাকে ‘আত্মদীপ ভবঃ’ বলে চলে এসেছিলেন।

আশ্রমের সামনে শান্তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন আশ্রমিক বাল্মিকীর কাছে তার আগমণের বার্তা পৌঁছে দিল। খবর পেয়ে তিনি নিজে এসে শান্তাকে স্বাগত জানিয়ে কুটীরে নিয়ে এলেন।

শান্তা মহর্ষিকে প্রণাম জানিয়ে কুশল বিনময় করলেন।

বাল্মিকীর নির্দেশে একজন মাটির পাত্রে মোদক, পরমান্ন ও ভাঁড়ে করে জল দিয়ে গেল।

বাল্মিকী সেগুলো গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে বললেন- দেবী আমি জানি কেন আপনি এখানে এসেছেন।আপনার অনুমান যথার্থই। জানকী এই আশ্রমে আমার কাছেই রয়েছে।

-আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

-একটু অপেক্ষা করতে হবে দেবী, অনেক কষ্টে তাকে খাইয়ে বিশ্রাম নিতে পাঠানো হয়েছে।

-সীতার শরীর?

-তিনি সন্তানসম্ভবা। এসে থেকে দিন-রাত রোদন করছেন। খাবার খাচ্ছেন না। তাকে তাই ক’দিন ধরে জোর করে খাবার খাওয়ানো হচ্ছে।

তাঁদের কথার মাঝেই একজন মৈথেলীকে নিয়ে মুনির কুটীরে এল। সেদিকে চোখ যেতেই শান্তা স্তব্ধ হয়ে গেল। এ কী চেহারা হয়েছে সীতার? আদরের জনক নন্দিনীর দেহে যেন কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই।চেহারার সেই লালিত্য, ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি সব ম্লান হয়ে ফ্যাকাসে।এ কোন সীতা!

শান্তাকে দেখে সীতার চোখ বেয়ে জল নেমে এল। অনেক চেষ্টায় কেবল ঠোঁট দুটো নড়ল।

শান্তা দ্রুত গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে টেনে নিল।

বাল্মিকী বললেন- দেবী, আপনারা নির্বিঘ্নে বাক্যালাপ করুন।আমাকে এবার পুঁথি লিখতে বসতে হবে।

শান্তা তাঁকে প্রণাম করে বিদায় জানিয়ে সীতাকে নিয়ে মাটিতে বেছানো মাদুরের উপর বসল। দুজনেই চুপ করে রইল।শান্তা এক হাত দিয়ে সীতার অবিন্যস্ত চুলে আঙুল বোলাতে লাগল।সীতার চোখের দৃষ্টিতে শূন্যতা শান্তাকে ভারাক্রান্ত করে তুলল।

অনেকক্ষণ পর শান্তা বলল- সীতা আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না তুমি কেন এখানে এলে? লক্ষ্মণ তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল আর তুমি মেনে নিলে?

সীতা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। অযোধ্যা থেকে চলে আসার পর এই কেউ তার খোঁজ নিতে এল। বাকি সবাই ভুলে গেছে সে রঘুকুলের পুত্রবধূ। যেদিন সে রঘুনন্দনকে বলেছিল তপোবনে ক-দিন ঘুরে আসতে চায় মন ভালো রাখার জন্য, তাছাড়া মুনি-পত্নীদের কিছু অলংকার উপহার দিতে চায়,  ঘূণাক্ষরেও সেদিন টের পায় নি তার সঙ্গে কী ঘটতে চলেছে। এমনকি লক্ষ্মণ যখন তাকে নিয়ে রওয়ানা দিল সারথী সুমন্ত্রকে নিয়ে একা রথে, তখনও তার বিন্দু মাত্র সন্দেহ হয় নি। কিন্তু খানিক দূর যাবার পর অশুভ নানা লক্ষন সে টের পাচ্ছিল। মন কূ ডাকছিল। পথের বাঁদিকে সাপ, ডানদিকে শিয়াল দেখে সে বার বার লক্ষ্মণকে বলছিল, রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। আমি যেতে চাই না তপোবনে। তাছাড়া আসার সময়ে শাশুড়িদেরও বলে আসিনি।

লক্ষ্মণ চুপ করে আছে দেখে সে আবার বলল- আমার মন বলছে আর কোনওদিন আমার অযোধ্যয় ফেরা হবে না।

কিন্তু তখনও সে জানত না রঘুনন্দন তাকে পরিত্যাগ করেছে। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছার আর কোনও মুল্য নেই।

লক্ষ্মণ তাকে রথ থেকে নামিয়ে নদী পার করে অরণ্যের প্রবেশ পথে নামিয়ে বিদায় নিয়েছিল। যাবার সময় কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছিল রামচন্দ্র তাকে রাজ্যে রাখতে চান না।তাঁর নির্দেশেই এখানে তাকে রেখে যেতে হচ্ছে।

লক্ষ্মনের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে সীতা প্রথমে বুঝতেই পারেনি এবার থেকে তার আশ্রয় এই ঘন অরণ্য। ভয়ে সে দিশেহারা হয়ে গেছিল। তার গর্ভে সন্তান। সে কী করবে এখন! নদীতে ডুব দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেবে! সে বেঁচে থাকলে তার সন্তানদের আজীবন জারজ সন্তানের পরিচয়ে বাঁচতে হবে। যে পুরুষ কেবল সন্দেহের বশে তাকে ত্যাগ করল, সেই পুরুষ বা তার পরিবার কখনও তার সন্তানকে মর্যাদা দেবে না। সে কাঁদছিল চিৎকার করে ভয়ে। এখান থেকে মিথিলা কতদূর সে জানে না। তার মা-বাবা জানলে তাকে নিয়ে যেতেন।কিন্তু তাঁরা কিভাবে জানবেন? কে তাঁদের জানাবেন? তার বোনেরা কি জানে তার সঙ্গে এই অপরাধ করা হল? জানলে নিশ্চয়ই তারা প্রতিবাদ করত। ঊর্মিলা! কিন্তু ঊর্মিলা, সে তো এই জাগতিক সুখ দুঃখ থেকে অনেক ঊর্ধে উঠে অগাধ জ্ঞানের আলোয় ডুবে। সে কী বুঝবে তার প্রিয় সীতাকে তারই স্বামী এই নির্জন অরণ্যে ছেড়ে দিয়ে গেছে একা একা মরে যাবার জন্য! এই নির্বাসন আসলে মৃত্য পরোয়ানা। এসব চিন্তা করতে করতেই সীতা কাঁদছিল।

তখনও সে জানতো না এখানেই ঋষির আশ্রম। আশ্রমিকরা তার কান্নার আওয়াজ শুনে খুঁজতে খুঁজতে বৃহৎ এক বৃক্ষের তলায় তাকে বসে থাকতে দেখে মহর্ষিকে খবর দিলে তিনি নিজে এলেন সেখানে।

সালংকরা এক নারীকে বসে থাকতে দেখে তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন –এই গভীর অরণ্যে আপনি কে মা? এখানেই বা কেন?কিভাবে এলেন এখানে?

বাল্মিকীর মা ডাক শুনে সীতা মুখ তুলে চাওয়ামাত্র বাল্মিকী বলে উঠলেন- তুমি সীতা মা না? রঘুকূলের পুত্রবধূ? সেই মুহূর্তে দিব্য দৃষ্টিতে তিনি বুঝতে পারলেন রঘুনন্দন তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে ত্যাগ করেছেন।তিনি যথাযথ মর্যাদা দিয়ে নিজ কুটীরে নিয়ে এলেন সীতাকে। দুজন আশ্রমিককে নিয়োগ করলেন তার পরিচর্যার জন্য।

শান্তা চুপ করে সীতার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। সীতা মৃদু স্বরে বলল, শান্তা দিদি আমি কী অপরাধ করেছিলাম যে রঘুপতি আমাকে…

সীতার বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে শান্তা বলল-  তুমি কোনও দোষ করোনি জানকী। দোষ তারা করেছে, যারা তোমার সম্মান রক্ষা করতে পারলো না, যারা তোমাকে কাপুরুষের মতো মিথ্যেচার করে এখানে ফেলে রেখে গেল।

-আমি এখন কী করব? আমার সন্তানের কী হবে?

শান্তা তৎক্ষণাৎ সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে সে ভাবতে লাগলো।

সীতা শান্ত কন্ঠে বলল- আমার সন্তানকে পিতার নাম কী বলব দিদি? আমার জন্ম রহস্যাবৃত। জনকরাজ আমাকে নিজের কন্যার স্বীকৃতি দিয়ে বড়ো করেছেন।আমার সন্তান কাকে পিতা বলবে!

শান্তা বলল- পিতার স্বীকৃতি কি খুব দরকার সীতা? আমি জন্মাবার পর কন্যাসন্তান বংশ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে না, এমনকি রাজ্য পরিচালনাতেও তার স্থান নেই –এই ভেবে আমার পিতা আমাকে তুলে দিয়েছিলেন তার বন্ধু অঙ্গরাজ রোমপাদের হাতে। আমার মায়ের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেন নি তিনি। যিনি আমাকে নিলেন তিনিও তো স্বার্থের জন্যই গ্রহণ করেছিলেন। রোমপাদ একবার এক ব্রাহ্মণকে অপমান করায় ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে খরা নেমে আসবে। তাঁকে তুষ্ট করে এই শাপ মকুব করার জন্য আমাকে পাঠানো হল। তিনি বললেন, এমন পুরুষকে আমার বিয়ে করতে হবে যিনি জন্ম থেকে কোনও নারীর মুখ দেখেন নি।ঋষি বিভাণ্ডক ও অপ্সরা উর্বশীর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গই ছিলেন এমন ব্যক্তি। তাঁকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে  বিয়ে করে পালক পিতার রাজ্যকে খরামুক্ত করলাম আমি। কিন্তু আমার কি এমন হওয়ার ছিল? কেউ জানতে চেয়েছিলেন আমি আদৌ ঋষ্যশৃঙ্গকে বিবাহ করতে চাই কি না! আমাকে মহৎ ধার্মিক বানানো হল নিজেদের স্বার্থে।

-আমাকে কার স্বার্থে ব্যবহার করা হল? আমি থাকলে কার ক্ষতি হচ্ছিল?সীতা স্বগোক্তি করল।

– পুরুষ রাজসিংহাসন ও ক্ষমতা ছাড়া কিছুই বোঝে না সীতা। যে রাজা আমাকে একদা অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তিনিই আমাকে ডেকে পাঠালেন আমার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ যাতে পুত্রকামেষ্টি যজ্ঞ করেন তার অনুরোধ জানাবার জন্য।যার ফলে এই চার ভাইয়ের জন্ম হল।পিতার রক্তই সন্তানদের শরীরে বইছে।

-আমি জানি শান্তা দিদি। কৌশল্যা-মা আমাকে সব বলেছেন।

-মা তোমাকে কী বলেছেন আমি জানি না।তবে এটুকু বলতে পারি একজন ঋষি মুনির সঙ্গে ঘর করা কিন্তু সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে রাজপরিবারে স্বাচ্ছন্দের মধ্যে বেড়ে ওঠার পর সব ছেড়ে আশ্রমে থাকা আমার পক্ষে যথেষ্ট কঠিন ছিল।যে পুরুষ আমার আগে কোনও নারীকে দেখেননি জন্ম থেকে, এমনকী  নিজের মাকেও না, একা একা বড়ো হয়েছে অরণ্যে, প্রকৃতির আশ্রয়ে, জীব-জন্তু-পাখি-গাছের সঙ্গে,তার ভাষা, তার কথা বুঝতেই আমার কতদিন লেগেছে।ধীরে ধীরে আমি তাকে আমাদের মতো কথা বলতে শেখালাম।নইলে আমার বাঁচাটাও দুঃসহ হয়ে উঠছিল।হ্যাঁ, তিনি সাধক, নিজে নিজেই শিখেছেন শাস্ত্র, যোগ।কিন্তু তা তো মানুষের দ্বারা নয়।কী সব দিন গেছে তখন আমার।কিন্তু একজনও কেউ জানতে চায় নি আমি কেমন আছি।যে যার স্বার্থ মিটিয়েছে আমাকে সামনে রেখে সীতা।তুমিও তেমনই এক স্বার্থ মেটাবার অংশ।

– দিদি পতির নিন্দে করা পাপ।

-হ্যাঁ। মেয়েদের জন্য সবই পাপ। তোমাকে রাবণ ধরে নিয়ে গেল, দুই ভাই আমার,তোমাকে সামলে রাখতে পারল না,অথচ দোষ হল তোমার।

-আমিই সোনার হরিণ আমার জন্য নিয়ে আসতে বলেছিলাম, আমিই লক্ষ্মণকে তার দাদাকে খুঁজতে পাঠিয়েছিলাম, আমি-ই সুমিত্রা নন্দনের টেনে দেওয়া সীমারেখা অতিক্রম করে বাইরে এসে ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা দিয়ে পুন্যার্জন করতে চেয়েছিলাম দিদি। আমার লোভই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

– নিজেকে অপরাধী ভাবা বন্ধ করো সীতা। তুমি যেটা করেছ সেটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। কিন্তু রাজপুত্ররা কী জানতো না সোনার হরিণ হয় না! না না সীতা তুমি নিজেকে দোষী ভেব না। কিন্তু ওরা যেটা করেছে তোমার সঙ্গে সেটা অন্যায়। যে রাজা নিজের স্ত্রীকেই অবিশ্বাস করে, তাকেই মর্যাদা দিয়ে ধরে রাখতে পারে না, সে আদৌ রাজা হবার যোগ্য কি না সেই নিয়েই আমার মনে সন্দেহ জাগছে।

সীতা চুপ করে শান্তার কথা শুনছিল। তার মন বলছিল, শান্তা যা বলছে তা একবর্ণও মিথ্যে নয়।কিন্তু সে জেনেছে শ্বশুরকুলের ও পতির নিন্দে সর্বসমক্ষে করা উচিত নয়। বিশেষ করে তার স্বামীর মতো মানুষের তো নয়-ই। তিনি এখন রাজা।এই দিনের জন্য সমস্ত অযোধ্যাবাসী অপেক্ষা করেছিল। সেখানে এখন তাদের রক্ষক।কিন্তু তাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই এখন।মহর্ষি তাকে নিয়ে এসে আশ্রমে রাখলেন বলে সে এখনও বেঁচে আছে। এই বেঁচে থাকাটাই তার কাছে পরম আশ্চর্যের।সন্তানের স্বার্থেই তাকে বাঁচতে হবে।

সীতার ভাবনার জাল ছিন্ন করে শান্তা বলল- তুমি আমার সঙ্গে চলো সীতা।আমার ভাইরা, আমার পরিবার তোমার প্রতি যে অন্যায় করেছে তা মোচন করার ভার আমাকে দাও সীতা।

সীতা শান্তার মুখে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।

–এমন কথা আর কখনও বোলো না। আমাকে যখন এখানে রেখে গেছিল আমি জানতাম না আমার কপালে কী ঘটবে। এখনও জানি না কিভাবে আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে,তাকে কিভাবে বড়ো করে তুলব,কিন্তু এখন আমি জানি তুমি এবং এই আশ্রমের সকলে আমার সঙ্গে আছ।তোমরাই আমার শক্তি।আমি এখানেই থাকব।

সীতার মুখে এ কথা শুনে শান্তা বিস্মিত হল। এতক্ষণ বাদে সে সীতার কন্ঠস্বরে হাহাকার ও দুঃখের বদলে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের স্বর শুনতে পেল।সে বুঝতে পারলো সীতা যথার্থই ভূমিকন্যা। শত আঘাতেও সে নিজেকে কঠিন আবরণে মুড়ে রাখার শক্তি অর্জন করে ফেলেছে। তার আর রঘুকুলের সাহায্য বা সহানুভূতি- কোনোটারই দরকার নেই।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত