শারদ সংখ্যা গল্প: কিছু আলো নীল । সাইফ বরকতুল্লাহ
-‘এই শোন’,
-‘আমার একটা কথা রাখবি’?
-‘কী’?
-‘চল, কোথাও ঘুরে আসি।প্রচণ্ড মন খারাপ।গতরাতে ঘুম হয়নি।’
-‘তর আবার কী হলো? কী কারণে মন খারাপ’?
-‘আমার অবশ্য মন খারাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকে না।হুট করে মন খারাপ হয়। আবার হুট করে ভালো হয়ে যায়।’
-‘কী ব্যাপার কথা কস না কেন? তুই কী বিজি?’
-‘আরে নাহ।একটা লেখা পড়ছিলাম।’
-‘কী লেখার বিষয়, বিকেলে যাবি কোথাও?’
-‘না। আজ পারব না। তুই যা। কোথাও ঘুরে আয়।’
-‘ঠিক আছে।ভালো থাক।বাই।’
সায়নীর সঙ্গে কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বসের ফোন।
-‘হ্যালো,শিমুল আপনি একটু রুমে আসেন।’
-‘ওকে স্যার, আসতেছি।’
তখন সময় দুপুর।স্যারের রুম থেকে লাঞ্চ শেষ বের হয়ে গেলো শিমুল।অফিসের নিচে নেমে দেখলো বৃষ্টি হচ্ছে।এই এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে যায় রাস্তায়।একশ গজ দূরে কালামের চায়ের দোকান।এই দোকানে প্রতিদিন চিনি ছাড়া দুধ চা, কখনো চিনি ছাড়া লাল চা খায় শিমুল।বিশেষ করে লাঞ্চের পর এক কাপ চা না খেলে তো কাজ করতেই পারেনা শিমুল। আজ যখন চা খেতে নামল, লিফটে বারবার সায়নী ও স্যারের কথাগুলো খুব মনে পড়ছিলো।চা খেতে খেতে শিমুল একটা সিদ্ধান্ত নিলো।আজ অফিস শেষ করে যাবে কোনও খোলা জায়গায়।যেখানে থাকবে না কোনো কোলাহল।একটু ছায়াঘেরা খোলা জায়গা।যেখানে বসে চা খেতে খেতে নিজেকে কিছুটা সতেজ করবে।
যেই ভাবা সেই কাজ।অফিস শেষ।সময় তখন বিকেল সাড়েপাঁচটা।শিমুল চলে গেলো পঞ্চবটি থেকে সামান্য দূরে।পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে কাশফুল।পাশ দিয়ে সরু পাকা রাস্তা। পাশেই রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান।টংয়ে বসে পড়লো শিমুল।
-‘ওই খালা চা দাও।’
-‘কি চা খাবেন লাল চা না দুধ চা?’
-‘চিনি ছাড়া দুধ চা দাও।’
আজকের বিকেলের আকাশটা দারুণ।সামান্য মেঘ।আকাশে শরতের শুভ্র বিকেলে আকাশে সাদা মেঘের উড়াউড়ি।চমৎকার পরিবেশ।চা খেতে খেতে আকাশ দেখছিল শিমুল।হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের টুং টাং শব্দ।জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে দেখলো তানহার মেসেজ।
-‘ভাইয়া কেমন আছেন?কোথায় আছেন?লেখাটা শেষ করেছেন?’
শিমুল মেসেজ সিন করলো।কোনো উত্তর দিলো না।উত্তর দেওয়ার মতো মনের অবস্থা নেই। শুভ্র শরতের এই বিকেলে মন খারাপ দূরে ঠেলে একাকিত্ব থাকতে চায় কিছুটা সময়। অনেকদিন ধরেই তো অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা হলো, কিন্তু সত্যিকারের কাউকে তেমন পাওয়া গেলো না।মাঝে মধ্যে শিমুলের ইচ্ছে হয়, কাউকে কিছু অসমাপ্ত গল্প যদি বলা যেতো, যে গল্পগুলো মন দিয়ে শুনতো।মাথায় চুলগুলো টেনে দিতো আর মুহূর্তগুলো রাঙিয়ে দিত সুখে।
চা খাওয়া শেষ সামনে হাঁটতে লাগল শিমুল।আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ভেলা।আকাশে কিছুসংখ্যক বক উড়ে গেলো।কাশফুলগুলো হাওয়ায় দুলছে।শিমুলের মনটা ভীষণ উদাসীন হয়ে গেলো।
শিমুল হাঁটছে।শরতের কাশফুলের রূপ দেখে কিছুটা মন খারাপ।কতজনের সঙ্গেই তো ভালো বন্ধুত্ব, কিন্তু আজ কাশফুল দেখার মতো তার কেউ নেই।কিছুক্ষণ হেঁটে আবার টংয়ে এসে বসলো।
-‘ওই খালা আরও এক কাপ চা দাও।মনে আছে তো চিনি ছাড়া দুধ চা।কেমন’
-‘হা হা হা, মনে আছে।’
-‘একা কেন? কেউ নাই? আজকের আবহাওয়ার যা অবস্থা, একা ঘুইরা মজা পাবা না বেটা।’
-‘জী খালা, জীবন বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে।এই জগতে কেউ ভালোবাসার নেই।সবাই প্রেম খুঁজে।কিন্তু সত্যিকারের প্রেম বলে কিছু নেই।’
-‘বেটা ঠিক কইছো। এখানে দুপুর থেইক্যা চা বিক্রি করি। কত রকমের ছেলে মেয়ে দেখি। আসলে ঠিকি-ই কইছো। এখনকার দিনে প্রেমটেম ওইরকম নাই। লাইলি-মজনুরা যেইভাবে ভালোবাসছিলো।’
-‘বাহ! খালা তুমি তো দেখি লাইলি-মজনুরে চিনো।’
-‘হ, চিনমুনা কেন? তোমার খালুও তো আমারে জোর কইরা বিয়া করছে।আমি তখন যমুনার পাড়ে চিতই পিঠা বিক্রি করতাম। একদিন ও (স্বামী) আইসা কইলো, চল তরে বিয়ে করমু। তুই এত সুন্দরী, হাতছাড়া করন যাব না। চল কাজী অফিসে।’
-‘বাহ খালা। তোমার কাহিনি নিয়ে তো সিনেমা বানানো যাবে।’
-‘বানাইয়া ফেল।’
-‘আমাদের প্রেমটাই আসল প্রেম। তর খালু আমারে পাগলের মতো আদর করে।’
-‘শোনে ভালো লাগলো। সুখী হও খালা। উঠি। আবার কখনো আসলে তোমার গল্প শুনবো।’
ততক্ষণে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে।শিমুল একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা শুরু করলো।দূর থেকে তখন ভেসে আসছে গানের সুর।শিমুল মনে মনে কবিতা লেখার জন্য ভাবছে, একলাইন লেখার জন্য রেডিও হয়ে গেছে, লাইনটা এরকম-
‘কিছু আলো নীল,
আমি সাদা মেঘ,
তুমি গাঙচিল’।

সাইফ বরকতুল্লাহ
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
জন্ম ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৩ (বাংলাদেশ)
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ:
তেত্রিশ নম্বর জীবন (গল্প, ২০১৮)
তিন নম্বর লোকাল (গল্প, ২০১৯)
প্রকাশিত গ্রন্থ :
জ্যেৎস্না রাতের গল্প (কবিতা, ২০১০),
সম্ভাবনার বাংলাদেশ (গবেষণা, ২০১১),
ব্লগ কী লিখবেন কেন লিখবেন কীভাবে লিখবেন (গণমাধ্যম, ২০১৪),
পারুল (শিশু-কিশোর, ২০১১)।
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ:
১। ভিন্ন ভাষার সাহিত্য পাঠ (বিশ্বসাহিত্য)
২। ঘাষফড়িং জীবন (গদ্য)
৩। বইমেলা অন্যচোখে (প্রবন্ধ-সাক্ষাৎকার)