| 7 মে 2024
Categories
শারদ অর্ঘ্য ২০২৩

শারদ অর্ঘ্য গদ্য: দুনিয়া কাঁপানো এক দিন । সংগ্রামী লাহিড়ী

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

শেয়ার মার্কেটের দালাল কথাটা শুনলেই মনে কেমন যেন একটু বিরাগ আসে, তাই না? ইশকুলের স্যার বা দিদিমনির প্রশ্ন, “বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?” সব্বাই লাফিয়ে উঠে বলত, “ডাক্তার হব, ইঞ্জিনিয়ার হব!” প্রফেসর হতেও উৎসাহের অভাব ছিল না। মেয়েদের ক্লাস হলে তো কথাই নেই, টিচার, অর্থাৎ শিক্ষিকা হতে চাইত বেশির ভাগ। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট শুনেছি কি না মনে পড়ছে না! তবে দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, কেউ কোনওদিন বলেনি সে শেয়ার মার্কেটের দালালি করতে চায়! বললে বোধহয় গোটা ক্লাসে ছিছিক্কার পড়ে যেত। স্যার মোটা কালো চশমার ফাঁক দিয়ে নির্ঘাত বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতেন, ভস্ম করে দেওয়ার অভিপ্রায়েই বোধহয়। দিদিমনি এমনভাবে নাক কোঁচকাতেন যেন বদগন্ধ পাচ্ছেন।

মোদ্দা কথা হল, শেয়ার কেনাবেচা বাঙালি খুব ভালো চোখে দেখে না। শেয়ার খায় না মাথায় মাখে, কেনই বা তার দরকার পড়ে, শেয়ারের দোকানদারির জন্যে স্টক এক্সচেঞ্জ – যেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসা থেকে কর্পোরেট মহীরুহ সব্বাই গিয়ে নাম লেখায় বাণিজ্যের দরকারি ক্যাপিটাল জোগাড় করার জন্যে – সে সব ব্যাপারে ছাত্রাবস্থায় কখনওই একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। আরো পাঁচজনের মত আম্মো ভাবতুম বিজ্ঞানই সবার উপরে সত্য, তাহার উপরে নাই! রেডিওফিজিক্স আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গেই দুনিয়া চলে, টেবিলে খাবার আসে, মাথায় ছাদ জোগাড় হয়! 

চোখ খুলল আপিস করতে গিয়ে। রেডিওফিজিক্স-এর বাইরে যে বাণিজ্য ও হিসাবশাস্ত্রের এক বিশাল দুনিয়া আছে, তা তো কই জানা ছিল না? হাঁদা এই আমি ঠেকে ঠেকে শিখলাম স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যকলাপ, শেয়ার-ডিবেঞ্চার-সিকিউরিটি-ইউনিটের অষ্টোত্তর শতরূপ, ব্যবসাদারির নানান খুঁটিনাটি। কারণ চাকরিজীবনের বেশ বড় অংশ জুড়ে আমি কাজ করেছি ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানিগুলোর প্রজেক্টে। এবং চুপিচুপি বলি, এ সব শিখতে বেশ ভালোই লাগল! সায়েন্স আর ইঞ্জিনিয়ারিংএর কচকচির থেকে ঢের বেশি চিত্তাকর্ষক শেয়ার বাজারের হিসেবনিকেশ!

পাঠক, এই সত্যকথনে আপনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লে আমার কিছু করার নেই! আমার পিতৃদেবও  খুশি হননি! তিনি চেয়েছিলেন তাঁর কন্যারত্নটি জ্ঞান-তপস্বিনী হবে। সে আশায় ছাই দিয়ে যখন আমি শেয়ার মার্কেটের অ-জ্ঞান অ-তাপসিক কক্ষপথে প্রবলবেগে আবর্তিত হলাম, তখন তিনি আমাকে আমার মত থাকতে দিলেন। দেখলেন, এ মেয়ের নাড়ির টান অন্যদিকে। নইলে এই অর্বাচীন স্বয়ং রবিঠাকুরকে ছেড়ে তার ঠাকুদ্দা ব্যবসাদার দ্বারকানাথকে নিয়ে মাথা ঘামায়? আমায় কর্পোরেটের হাতে সমর্পণ করে আশাহত তিনি নিজের বইগুলির মধ্যে বিলীন হলেন। সেই ফাঁকে আমিও পরপর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যঘাটের জলপান করে এসে পড়লুম আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে নিউ ইয়র্কের শহরের ওয়াল স্ট্রিটে। শহরের একদম দক্ষিণে যেখানে হাডসন নদী আটলান্টিকে গিয়ে মিশেছে, ঠিক সেইখানে মাত্রই কয়েকহাত চওড়া সরু একখানি গলি। তারই নাম ওয়াল স্ট্রিট। বিশ্ববিখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট, ব্যবসাদারদের কাশী-গয়া-মক্কা-মদিনা-জেরুসালেম-বেথলেহেম! এখান থেকেই দুনিয়ার যত ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হয় অদৃশ্য এক সুতোর টানে। ওয়াল স্ট্রিটে ধ্বস নামলে সারা পৃথিবীর স্টকমার্কেট হু হু করে পড়তে থাকে, এমনি তার দাদাগিরি! এ সবই আমার জানা ছিল। তাই ওয়াল স্ট্রিটের ডাক আসতে আমি উত্তেজিত! 

তখন আমার পুত্রসন্তানটি নেহাতই শিশু। তাকে বাড়ির বাকিদের জিম্মায় রেখে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছি। ওয়াল স্ট্রিটের কাছেই একটি শিং বাগিয়ে তেড়ে আসা ষাঁড়ের মূর্তি আছে, ব্রোঞ্জের তৈরী, the charging bull.  অর্থনীতির শক্তি আর সাহসের প্রতিরূপ। দুনিয়ার যত টুরিস্ট সেই ষাঁড়ের মূর্তি দেখতে আসে, ক্যামেরা বাগিয়ে ছবি তোলে। ষাঁড়ের ধাক্কায় আমেরিকার অর্থনীতি সে সময় ঊর্ধ্বগামী। ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানিগুলির রমরমা। ব্যবসা বাড়ছে, লাভের পয়সা বিনিয়োগ করে নিজেদের খোল নলচে বদলে ফেলছে তারা, হয়ে উঠছে আরও আধুনিক, আরও কার্যকরী। এমনই একটি ওয়াল স্ট্রিট প্রতিষ্ঠানে কনসাল্টিং অ্যাসাইনমেন্ট। প্রায় বছরখানেক থাকতে হবে নিউ ইয়র্কে। অতএব ক্ষুদ্র পুত্রটির ছলছলে চোখের সামনে দমদমে প্লেনে চেপে পড়া। সে অবিশ্যি দু’দিনেই তার উড়ন্ত মাতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে মহানন্দে বাড়ির অন্যদের আদরে কাল কাটাতে থাকে। তবে কিনা মা পাষাণী হলেও ছেলের জন্যে নিজে একটু উচাটন তো হবেই! তাই প্রজেক্টের মাঝে একবার অন্তত বাড়ি ফেরার জন্যে ক্লায়েন্টের সঙ্গে দর কষাকষি করা হল। ম্যাট আর অ্যালেক্স প্রজেক্টের দুই ডিরেক্টর। একজন ফাইন্যান্স দেখে, আরেকজন দেখে সময়মত সব কাজ হচ্ছে কি না। তারাই এই প্রজেক্টের সর্বেসর্বা। আমার বক্তব্য শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি।

“আরে সে কথা আর বলতে? সামনের তিন মাসের মধ্যে ব্লু প্রিন্ট ডিজাইন করে ফেলব সবাই মিলে। তারপর তুমি কলকাতা থেকে একমাস ঘুরে এস। তারপর বাকি কাজ।”

ঠিক হল গ্রীষ্মকালের তিন মাস নিউ ইয়র্কে কাটিয়ে পাষাণী মা সেপ্টেম্বর নাগাদ কলকাতায় আসবেন। একমাস পুত্রকে মাতৃসঙ্গ দান করে আবার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ধরবেন দমদম থেকে।

কী বললেন? ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ? বিশ্বাস হচ্ছে না তো? সেই প্রাগৈতিহাসিক কালে সত্যিই দমদম থেকে একলাফে অর্থাৎ এক উড়ানে হিথরো যাওয়া যেত। সেখান থেকে আরেক লাফে আটলান্টিক পেরোলেই নিউ ইয়র্ক! জীবন কত সুন্দর ছিল!

সে যাক। ক্লায়েন্টের সঙ্গে চুক্তিমত মনোরম গ্রীষ্ম কাটছে নিউ ইয়র্কে। রোজ সকালে বাস ধরে আসি নিউ ইয়র্কের প্রধান বাস স্টেশন পোর্ট অথরিটিতে। সেখান থেকে সাবওয়ে, অর্থাৎ মেট্রো ট্রেনে চেপে মাটির নীচের সুড়ঙ্গ বেয়ে পৌনে নটা নাগাদ ওয়াল স্ট্রিট স্টেশন। মাটির তলা থেকে ওপরে এলেই দেখা যায় আকাশ ছুঁয়েছে পাশাপাশি দুটি পেন্সিলের মত খাড়া স্কাইস্ক্র্যাপার। স্পর্ধিত যমজ – ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার। সামনে বিরাট বাঁধানো জায়গা – কোর্টইয়ার্ড। গ্রীষ্মের মাসগুলিতে সেখানে রোজই যেন মেলা বসে। কোথাও হিপ হপ, কোথাও বা wrap এর চমক, কেউ বা আলসে মেজাজে গিটারটি নিয়ে মেঠোসুরে গান ধরেছে। স্টান্টম্যানের খেলা, উৎসুক টুরিস্টদের ভিড়। ক্যামেরা তাক করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে বাঁধানো চত্ত্বরে। টুইন টাওয়ারের পুরো দৈর্ঘ্য ছবিতে ধরতে গেলে ও ছাড়া উপায় নেই।

জাপানি আর্কিটেক্ট মিনোরু ইয়ামাসাকির ডিজাইন করা দুটো আকাশচুম্বী বাড়িতে সাড়ে চারশো অফিস। ওয়াল ট্রেড সেন্টার সাবওয়ে স্টেশনে নেমে কাজ করতে আসেন দৈনন্দিন প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। সেই ভিড়ে ভাসতে ভাসতে হাজির হয়ে যেতাম আমার আপিসে। টুইন টাওয়ারের ঠিক উল্টো দিকে, রাস্তাটা পেরোলেই সেই আপিস।

লাঞ্চের সময় খাবার কিনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কোর্টইয়ার্ডে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা। প্রাণচঞ্চল, উত্তেজনায় ফুটছে সবসময়। কানাঘুষোয় একদিন শোনা গেল মেরিল স্ট্রিপ আসবেন কোর্টইয়ার্ডে। ছোট, ছোট, ছোট। কাজকম্মো শিকেয়। আরেকদিন তো মারিয়া কেরিকে দেখার জন্যে অসাবধানে এক ক্যামেরা কাঁধে শুয়ে থাকা জাপানিকে পায়ের ধাক্কা দিয়ে ফেললুম। মাটি থেকে সে নিজের ভাষায় খিচমিচ করে কী যেন বলে উঠল! “সরি সরি” বলতে বলতে দৌড়েছি। মারিয়া কেরি – উফ – All I want for Christmas is You গানের গায়িকা! কোনোভাবেই মিস করা যাবে না!

এই করে করেই সামার শেষ হয়ে এল। আমার কাজের প্রথম পর্ব শেষ। সেপ্টেম্বরের প্রথমেই লেবার ডে র ছুটি। দোকানে দোকানে লেবার ডে সেল। আশ মিটিয়ে সস্তায় কেনাকাটা করে সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ নাগাদ প্লেনে চেপে বসেছি। ছানাটাকে বহুদিন দেখিনি। বাড়ি যাই মাসখানেকের জন্যে। আবার আসতে হবে অকটোবরে। বাকি কাজ শেষ করতে। কলকাতায় নেমে গেলাম নির্বিঘ্নে। পুত্রও চকোলেটের বাক্স  সমেত মাকে দেখে খুশ!

কলকাতায় ফিরেও  ক্লায়েন্টের সঙ্গে নিত্য কনফারেন্স কল করতে হবে। মাঝে মাঝে অফিসের ভিডিও কনফারেন্সের সুবিধে নিয়ে মুখোমুখি আলোচনা। কাজ থামালে চলবে না। সেদিন বুধবার। সেপ্টেম্বর মাসের এগারো তারিখ। কলকাতা অফিসের সন্ধেবেলা, অর্থাৎ নিউ ইয়র্কের সকালবেলায় বসেছি কনফারেন্স কলে। ম্যাট আর অ্যালেক্স রয়েছে ওদিকে। ডিজাইনের খুঁটিনাটি মাথা ঘামিয়ে রিভিউ হচ্ছে, সিকিউরিটিতে এতটুকু যেন খামতি না পড়ে। ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজ্যাকশন বলে কথা!   

হঠাৎ দেখি ম্যাটের চোখদুটো বিস্ফারিত! কিছু যেন অবিশ্বাস্য ঘটছে। বিশালদেহী অ্যালেক্সএর চোয়াল ঝুলে যাচ্ছে। চোখের সামনে মুখের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে।

“ওহ মাই গড!” আর্তনাদ শুনলাম একটা।

তারপর সব অন্ধকার। বিশাল দেওয়ালের টিভি স্ক্রিন শুধুই নিকষ কালো!

আমরা হতবাক! কী হল নিউ ইয়র্কে? ভূমিকম্প? আগুন লাগল?

পড়িমরি করে সবাই ছুটেছি খবর দেখতে।

এ কী? টুইন টাওয়ারের একটা বাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া! আগুন লাগল? কী মারাত্মক!

বোধহয় কয়েক মিনিটও কাটেনি, দেখতে পাচ্ছি একটা প্লেন সোজা আসছে দ্বিতীয় টাওয়ারটির দিকে। মুহূর্তের মধ্যে তার পেটের মধ্যে ঢুকে গেল। আমরা কি দুঃস্বপ্ন দেখছি? অফিসভর্তি লোক নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এ কী হচ্ছে? কোনও হরর মুভি?

শরীর খারাপ লাগছে আমার। নার্ভ নিতে পারছে না এই অভিঘাত। ঠিক এই সময়ই তো আমি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ট্রেন স্টেশনে নামি, অফিস যাওয়ার জন্যে। আজ এগারোই সেপ্টেম্বর, সাতদিনও হয়নি আমি কলকাতায় ফিরেছি। আমার যে এখন ঠিক এই সময় ওখানেই থাকার কথা! আমি কলকাতায়? সত্যি? কেমন অবাস্তব লাগছে সবকিছু, চারপাশ।

কাঁধের ওপর আস্তে একটা হাতের ছোঁয়া। কলকাতার সেন্টার হেড।

“গাড়ি বলে দিচ্ছি, তুমি বাড়ি চলে যাও আজ।”          

কেমন ঘোরের মধ্যে বাড়ি এসেছি, ঢুকেই দেখি তুমুল উত্তেজনা। খবর ছড়িয়ে পড়ছে। একের পর এক আঘাত আছড়ে পড়ছে ওয়াশিংটন ডি সির পেন্টাগন দফতরে। টার্গেট ভুল করে পেনসিলভ্যানিয়ার মাঠে মুখ থুবড়ে পড়ল যাত্রীভর্তি প্লেন। ভুল হয়ে যাচ্ছে স্থান, কাল, পাত্র। আমি কি কলকাতায়? সল্ট লেকের বাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে? না কি ম্যানহাটানের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছি? ম্যাটের কী হল? অ্যালেক্স?

এর পরের ঘটনা সবারই জানা। দুহাজার এক সালের অভিশপ্ত সেই সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখের পর  পৃথিবীটাই বদলে গেল। ধ্বংস আর অবিশ্বাসের কালো ধোঁয়া আকাশ ঢেকে দিল। নিউ ইয়র্ক শহরের স্কাইলাইন পাল্টে গেল। আর মানুষের মনের স্কাইলাইন? তার খবর কেউ কি রাখে?

এক ফাঁকে বলে রাখি, আমার প্রজেক্টটা বন্ধ হয়ে গেল। ম্যাট আর অ্যালেক্স প্রাণে বেঁচেছিল, কিন্তু হারিয়েছিল বহু সহকর্মীকে। তাদের নাম পাওয়া যায় মেমোরিয়াল লিস্টে। ব্রোঞ্জের ফলকে খোদাই করা আছে। ছেলের টানে কলকাতায় ফিরে না এলে আমারও হয়ত ওই ব্রোঞ্জ ফলকেই একটা জায়গা হয়ে যেত। প্রায় তিনহাজার হতভাগ্যের তালিকায় আরও একটা নাম! সমুদ্রে বিন্দুবৎ – তাই না?

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত