| 6 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১২) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

 
 
কক্ষের পর কক্ষ পেরোতে লাগলেন দ্রৌপদী। যেন এক টুকরো প্রমীলা রাজ্য বসিয়ে দিয়েছে কেউ। এক একটি কক্ষের সঙ্গে লাগোয়া বিরাট ছাদ। কোনও ছাদে বড়ি দেওয়া চলছে। সেখানে একটু বয়স্ক মেয়েরা পিঠ ঝুঁকিয়ে বড়ি দিচ্ছে। একজন আরেকজনকে বলছে, “হ্যাঁ রে, রাজকুমারীর পুতুলদের জন্য ক্ষুদে ক্ষুদে রঙিন ভাজা বড়ি দিতে ভুলিস না। পালং শাকের পাতার সবুজ রঙ, কুমড়ো মিশিয়ে কমলা রঙ, চালকুমড়োর রস দিয়ে সাদা রঙের বড়ি দিয়েছিস তো?” 
কেউ বলছে, “রাণীমার বড়িতে কিন্তু শুকনো লঙ্কা একটি করে দিবি। রাণীমা ভয়ানক ঝাল ভালোবাসেন। বড় বড় লঙ্কাশদেওয়া বড়ি ঝোলে দিয়ে টোপা টোপা হয়ে ফুলে উঠবে, আর রাণীমা হুস হুস করে সেই ঝোলটি খাবেন। আমি কবে থেকে আছি। সবার পছন্দ অপছন্দ জানি।”
 
দ্রৌপদীর মুখে একটু হাসি এল। বড়ি তিনিও খুব ভালোবাসেন। ছোটবেলায় মা কখনও কখনও আশ্রম থেকে বড়ি এনে ভেজে দিত। সেই স্বাদ মনে পড়ে গেল। মায়ের কথা, ভাইয়ের কথা, জঙ্গলের কথা মনে করে একটু থমকে দাঁড়ালেন। 
“ওগো, একটু জলদি চলো। তুমি কি রাণীমাকে অপিক্ষে করিয়ে রাকবে নাকি? আশ্চয্যি মেয়ে বাপু! কখনও এমনটা দেকো নি, তা বুজতে পারচি। তা একেনে থাকলে সব দেকতি পাবে। একন এসো তো।”
 
আরেকটি ঘরে শুধু বিরাট বিরাট খাঁচায় নানা পাখি। সঙ্গের মেয়েটিই বলল, “এ রাজকুমারীর পাখির ঘর গো। তিনি নিজে মাজে মাজে এসে পাখিদের খাওয়ান। সারা পিতিবি থেকে মহারাজা তাঁর মেয়ের জন্যি এইসব পাখি এনেচেন। একেকজনের খাওয়ার আবার এক এক রকম ধরণ। কেউ নঙ্কা খায়। কেউ শুদু দামী দামী ফল। কেউ আবার পোকামাকড়। ওদের কারুর অসুক করলে রাণী আর রাজকুমারীর খুব দুক্কু হয়। তখন আবার কবরেজমশাই আসেন। তুমি আমার কতা শুনচ নাকি গো?”
এত পাখি! অথচ বন্দী। উড়তে না পেলে তো অসুখ হবেই। যত ভালো করেই রাখো, বন্দী মানে তো বন্দীই। তিনি একটা শ্বাস ফেললেন। না, তাঁর ইন্দ্রপ্রস্থে কখনও পাখিদের তিনি বদ্ধ করে রাখেননি। কেউ উপহারস্বরূপ নিয়ে এলেও তাকে তাঁর নিজের বনটুকুতে ছেড়ে দিতেন। তাঁর নিজের মহল তৈরির সময় ময়কে বলে দিয়েছিলেন নিজের মনের ইচ্ছেটুকু। ময় মনের আনন্দে একটি জঙ্গল বানিয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে একটি জলধারাও বয়ে যেত। সেই জঙ্গলে পাখিরা আপনি এসে বসত। খরগোশ হরিণেরা নির্ভয়ে চলা ফেরা করত। তাঁর মতো করে স্বাধীনতার মানে কেই বা বুঝবে! 
আরও এগোলেন। একটি কক্ষ থেকে আসছে ফুলের সুবাস। বুঝলেন এখানে ফুলের তোড়া, ফুলের গহনা তৈরি হচ্ছে। তার পরের ঘরে কত মেয়ে গানবাজনা করছে। তিনি বুঝলেন এইবার রাণীর প্রধান কক্ষটি আসছে। মেয়েটিও ঠিক তখুনি বলল, “সামনেই রাণীমা আছেন। গিয়েই পেন্নাম করবে। মনে করিয়ে দিলুম। এসো এবার। ঘর দেকে ভড়কি খে যেওনি যেনো!”

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-১১) । রোহিণী ধর্মপাল
 
 
দ্রৌপদী এগিয়ে ঘরের চৌকাঠ পার করলেন। এখনও মনে পড়ে, বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা কাঁপন অনুভব করছিলেন। রাণী সুদেষ্ণার ব্যবহার কেমন হবে, তাই ভেবে। আর যদি রাণী তাঁকে আশ্রয় না দেন, তাহলে কোথায় যাবেন, এই ভেবেও। তিনি কক্ষে ঢুকেই দেখলেন, চারিদিকে সখী পরিবৃতা হয়ে বসে আছেন সুদেষ্ণা। শতসখীর মাঝেও ঠিক বোঝা যায় রাণী কে। তিনি হাত অঞ্জলি করে নমস্কার জানালেন।পেছন থেকে কে যেন উঠল “পেণ্ণাম কর্। পেণ্ণাম কর্”। তিনি ঘুরেও দেখলেন না। বরং রাণী অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “কাছে এসো তো মেয়ে। কোথা থেকে আসছ তুমি? খুব সাধারণ কেউ তো নও। তোমার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছি তুমি কোনও সম্ভ্রান্ত ঘর থেকে এসেছ। নিজের পরিচয় দাও।”
 
দ্রৌপদী জানতেন এমন প্রশ্ন আসবে। যুধিষ্ঠির শুরুতেই সবাইকে বলে রেখেছিলেন। তাই তাঁর উত্তর তৈরিই ছিল।
” আমি বহু বছর রাণী সত্যভামা এবং তারপরে পাণ্ডবদের ঘরণী মহারাণী দ্রৌপদীর কাছে কাজ করেছি। আমার কাজ নিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি নানা ধরণে চুল বাঁধতে পারি। ফুলের সজ্জা বানাতে পারি। বিভিন্ন ভেষজ দিয়ে প্রসাধন দ্রব্য বানাতে পারি। আমার শর্ত একটাই। কারুর পা আর কারুর উচ্ছিষ্ট স্পর্শ করব না।”
“তোমার কাজ নিয়ে না হয় নিশ্চিন্ত থাকলাম। কিন্তু তোমার এমন রূপ নিয়ে? কালো কাপড় দিয়েই এই রূপ লাবণ্য ঢাকা পড়ছে না। আর আমার কাছে থাকলে এই বেশ তো থাকবে না। তোমাকে দেখে আমাদেরই হৃদয় কম্পিত হচ্ছে! তোমার দুটি গভীর চোখ, সুঠাম শরীর, ভারী অথচ কঠিন স্তন, তেমনই নিতম্বের গড়ন! এসব দেখলে তো আমার মহারাজের পর্যন্ত মাথা ঘুরে যাবে! অন্য পুরুষদের কথা তো বাদই দিলাম।”
 
“হে রাণী, দেবী সত্যভামা আমাকে মালিনী নাম দিয়েছিলেন। আপনিও আমাকে ওই নামেই ডাকতে পারেন। আর একেবারে দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি বিবাহিতা। পাঁচ পাঁচজন গন্ধর্ব পতি আমার। কোনও পুরুষ আমার দিকে কুদৃষ্টি দিলে তার প্রাণসংশয় হবে। তাছাড়াও আর কোনও পুরুষের প্রতি আমার কোনও আকর্ষণ নেই। আমাকে কোনও ভাবেই লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়েও কেউ বশ করতে পারবে না।”
দৃপ্ত কন্ঠে দ্রৌপদীর কথা শুনে রাণী খানিক হাঁপ ছাড়লেন। “বেশ। মালিনী। তুমি থাকো। আমার ঘরের পাশেই ওকে থাকার জায়গা দেখিয়ে দাও। ঘরে সব প্রয়োজনের বস্তু আছে কিনা, দেখে নাও। কাল থেকে আমার পরিধেয় বস্ত্র আর গহনা মালিনীই বেছে রাখবে। আর ওর সঙ্গে তো কাপড়চোপড় কিছুই নেই দেখছি। ওর যা লাগবে দাও।”
 
 প্রথম দিনেই রাণীর কাছে এতখানি আদর আর সম্মান পাওয়ার জন্য দাসীদের তো বটেই, সখীরাও ঈর্ষাণ্বিত হয়ে উঠল। তবে রাণীর ভয়ে আর দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্বের আভায় চুপ করে গেল। পরদিন ভোরে, সূর্য ওঠার আগেই দ্রৌপদী স্নান সেরে সাধারণ একটি কাপড় পরে, রাণীর সাজ বাছতে বসলেন। তাঁর থেকে ভালো এমন কাজ আর কে পারবে? সকালের জন্য তিনি বেছে নিলেন হাল্কা গোলাপী রঙের একটি রেশম বস্ত্র, সঙ্গে গোলাপী মুক্তো আর পান্না দিয়ে তৈরি অলঙ্কার। বাগান থেকে ফুল আনিয়ে তৈরি করে রাখলেন একটি লাল ফুলের চক্র। কাপড়টি পরার পর একদিকে সেটি সেলাই করে দেবেন। 
 
সুদেষ্ণা ঘুম থেকে উঠেই ডাকলেন, “মালিনী, আমার জন্য কী সাজ তৈরি করেছ দেখি”। দ্রৌপদীর ইশারায় এক দাসী সবটুকু একটা থালিতে করে নিয়ে এল রাণীর কাছে। সুদেষ্ণা অবাক হয়ে গেলেন। বিশেষ করে লাল ফুলের কাজটি দেখে। সেই সাজটি পরে যখন উঠে দাঁড়ালেন তিনি, মনে হল ঘরের মধ্যে ভোরের আলো ফুটেছে। চুলটি যত্ন করে আঁচড়িয়ে একটি হাত খোঁপা করে মুক্তোখচিত একটি কাঁটা দিয়ে আটকে দিলেন দ্রৌপদী। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুদেষ্ণা। সখীদের বললেন, “মহারাজকে খবর পাঠাও। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। এই অপূর্ব সাজ তাঁকে দেখাতে চাই। মালিনী, তোমার কাজে আমি অত্যন্ত প্রীত বোধ করছি। তুমি সত্যিই তোমার কাজে অতুলনীয়। তুমি আমার কাছে থাকো। নিশ্চিন্তে। আর সসম্মানে।”
যদিও রাণী থেকে দাসীতে পরিণত হয়েছিলেন, তবু বিরাট রাজ্যে, রাণীর কাছে প্রথম কিছুদিন বড় যত্নে আর সুখেই ছিলেন। সখী আর দাসীদের ঈর্ষাও কমে আসছিল। কারণ তিনি সবাইকে নানারকম ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে দিচ্ছিলেন। তাঁর জঙ্গুলে কালী রূপটা বেরিয়ে আসছিল। রাণী রাণী খেলার থেকে এ বরং অনেক সহজ আর মজার খেলা। মা আর বুড়ো দাদু যে কত টোটকা, গাছের পাতা থেকে শিকড়ের কত জাদু শিখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের দুই ভাই বোনকেই, এই সময় তা কী কাজেই না লাগছে! এক সখী, মণিমেখলা, চুল পড়ে টাক হয়ে যাচ্ছিল। সবাই খেপাত তাকে। তাকে বানিয়ে দিলেন ভৃঙ্গরাজ আর জবার পাপড়ি দিয়ে তেল। তার চুল পড়া তো বন্ধ হলোই, নতুন চুল বেরোতে শুরু করল। সে তো দ্রৌপদীর অন্ধ ভক্ত হয়ে গেল।
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত