| 2 মে 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অনুবাদ উপন্যাস: সুবালা (পর্ব-১) । হোমেন বরগোহাঞি

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

 

লেখক পরিচিতি-১৯৩২ সনে লখিমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় হোমেন বরগোহাঞির জন্ম হয়। ১৯৫৪ সনে কটন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। সাময়িকভাবে সরকারি চাকরি করে সাহিত্যচর্চা এবং পরবর্তীকালে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ‘নীলাচল’, ‘জনক্রান্তি’, ‘নাগরিক’,’অসম বাণী’ইত্যাদি কাগজের সম্পাদনা করেন। ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৭ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আত্মানুসন্ধান’,‘বিভিন্ন নরক’,‘সুবালা’, ‘মৎস্য গন্ধা’, ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’ লেখকের অন্যতম গ্রন্থ। লেখকের ছোটো গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ এবং আত্মজীবনী মূলক  রচনা অসমিয়া সাহিত্যকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। ১২ মে ২০২১ সনে এই মহান লেখকের মৃত্যু হয়। সুবালা লেখকের প্রথম উপন্যাস।


আমার নাম সুবালা। কিন্তু আমার পরিচিত বন্ধুরা আর পুলিশ আমার নাম সুবালা বললে বিশ্বাসই করবে না ।ওরা কেউ আমাকে সুবালা নামে জানে না। আমার যে কত নাম আছে তার হিসেব আমি নিজেই ভুলে গেছি। পৃথিবীতে যত মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে প্রায় ততগুলি আমার নাম অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষের কাছেই আমার নাম আলাদা। যে কয়টি নাম এখনও আমার মনে আছে সেগুলি হল চকোরী, রাণি, কুসুম, বীণা, পাপড়ি, ময়না, মধুমতী, রুচকি, সোনালি, নয়নতারা, ছুকরি, হরিণী, বাসন্তী, বসন্তসেনা। এর বেশিরভাগ নাম আমার নিজের তৈরি নয়,আমার বন্ধুদের দেওয়া। কোন সময়ে আমাকে কে নাম দিয়েছিল, সেসব কথা আমি পরে বলব। কিন্তু একটি কথা এখনই খুব ভালো করে বলে রাখা উচিত। আমার আসল নাম সুবালা। এই নামে আমাকে কেউ জানুক বা না জানুক, আমার আসল নাম সুবালা।

(২)

        সুবালা… অনেক দূর থেকে যেন আমাকে সেই নামে এখনও কেউ ডাকে।সু-বা-লা? গোধূলির অন্ধকার নির্জন মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে কেউ যেন এখনও আমাকে সুর করে ডাকে,আর চারপাশের পাহাড়ে, নদীর জলে,নদীর তীরে উঁচু উঁচু গাছ বনগুলিতে সেই কণ্ঠস্বর ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠে—সুবালা, সুবালা ,সুবালা! কিন্তু আমি বহুদূর পথ অতিক্রম করে এসেছি, কণ্ঠস্বর শুনলেও আমি আর এখন ফিরে যেতে পারি না, আমার ভয় হয়, হয়তো ফিরে যাওয়ার পথটাও আমি চিনতে পারব না। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর আমি সব সময় শুনি। আমি যেখানেই থাকি না কেন, শিলঙের পাইন বনের মাঝখানের কোমল ছায়ায় ঢাকা ঘাস বা গুয়াহাটির গলির অন্ধকার ঝুপড়ি, কুঁড়েঘর, মাড়োয়ারি মহাজনের সুন্দর অট্টালিকা বা মোটর ড্রাইভারের মদের গন্ধে অসহ্য ভাড়া-ঘর, আমি যেখানেই থাকি না কেন, সেই কন্ঠস্বর আমি সব সময় শুনি। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা সেই কন্ঠস্বর আমার বুকে ধাক্কা খেয়ে অহরহ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, সুবালা, সু-বা-লা, সু-বা-লা। কখনও রাতে ঘুমের মধ্যে অচেতন অবস্থাতেও সেই কণ্ঠস্বর শুনে আমি বিছানায় হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসি। একদিন রাতে আমার সঙ্গে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল সমরেন্দ্র। (কে জানে তার আসল নাম হয়তো সমরেন্দ্র  নয়, অমরেন্দ্র অথবা অমলেন্দু; কটা মানুষের আসল নাম কটা নকল মানুষের আসল রূপটা আমি জানি?) আমাকে এভাবে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসতে দেখে সমরেন্দ্র  জিজ্ঞেস করল,’ কী হল ছুকরি?’ ঘুমের ঘোরে আমি চট করে বলে ফেললাম—’ আমি যাই ,আমি যাই ,মা আমাকে ডাকছে।’

        মা ডাকছে? হ্যাঁ ,মা আমাকে ডাকছে। সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে, এখনও আমাকে বাড়িতে ফিরতে না দেখে মা চিৎকার করছে—। সু-বা-লা! আমি তখন মাঠের ওপারে রূপসী নদীতে জাকৈ দিয়ে মাছ ধরায় মগ্ন। মাছ মারতে পেরে আমি ঘর সংসার সমস্ত কিছু ভুলে গিয়েছিলাম। দুপুর বেলা না খেয়ে মুখে ভাত কয়টি কোনোমতে গুঁজে নিয়েই আমি জাকৈ নিয়ে মাছ  ধরতে বেরিয়ে পড়ি। আমি স্কুলে পড়তাম, কিন্তু প্রতিদিন স্কুল সকালবেলা বসত। আমার সঙ্গে কখনও প্রতিবেশীদের সমবয়সী মেয়েরা থাকে, কিন্তু তারা প্রতিদিন আসতে পারে না। ওদের বাড়িতে কাজকর্ম থাকে। আমার কিন্তু বাড়িতে কোনো কাজ ছিল না। ঘরের কাজ মা এবং দিদি করত।বলতে ভুলে গেছি, আমাদের বাবা ছিল না।আমার ভাই মায়ের গর্ভে থাকতেই বাবার মৃত্যু হয়েছিল।ভাইটারও গর্ভেই মৃত্যু হলে ভালো ছিল,কারণ সে কালা আর বোবা আর পঙ্গু হয়ে জন্মাল।আমাদের জমি জমা কিছুই ছিল না। বাবা বেঁচে থাকা কালীন নাকি আমাদের কয়েক বিঘা জমি ছিল কিন্তু তার মৃত্যুর পরে মা অভাবে পড়ে জমিটা বিক্রি করে দেয়। মা বাড়িতে কাপড় বোনে  বাজারে বিক্রি করে, মাঝেমধ্যে মাছ ধরা জালও তৈরি করে। সুতোর অভাবে সেই সমস্ত কাজ বন্ধ থাকলে গ্রামের ধনী মানুষের বাড়িতে ধানের চারা রোপণ করা, ধান বানা ইত্যাদি কাজ করে। দিদি বড়ো হওয়ার পর থেকে সেও ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে। কিন্তু তাদের সেই সমস্ত কাজে আমার সাহায্যের কোনো দরকার ছিল না।মা আমাকে সব সময় বলত,তিনি নাকি আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মাস্টারণী করবেন। মায়ের একমাত্র আশা ছিলাম আমি। কারণ আমি আগেই বলেছি, আমার ভাই ছিল কালা, বোবা এবং পঙ্গু। ঘরের কাজ না করলেও আমি যে ঘরের কোনো কাজেই লাগতাম না সেটা ঠিক নয়। সারাটা দিন আমি জাকৈ দিয়ে গোটা চরক পুঠি, খলশে মাছ ধরে আনতাম, সেটাই ছিল আমাদের ভাতের সঙ্গে খাওয়ার একমাত্র উপকরণ। ভাত এবং পোড়া মাছ। দিনের পর দিন সেটাই ছিল আমাদের একমাত্র আহার। কখন ও কখনও কেবল পোড়া মাছ খেয়ে থাকার কথাও মনে পড়ে। কারণ সব সময় যে কাপড় এবং জাল বিক্রি হবেই বা মানুষের বাড়িতে কাজ থাকবেই—তার কোনো মানে নেই। এরকম অবস্থায় চাল কেনার মতো আমাদের পয়সা থাকে না, ফলে কেবল পোড়া মাছ খেয়েই পেট ভরাতে হয়। কিন্তু মাছও যে সব সময় অপর্যাপ্ত হবে,তারই  বা কী মানে আছে? একদিন হল কি—বাড়িতে এক মুঠো চালও নেই, আমার পোড়া কপাল, সারাটা দিন জাকৈ দিয়ে মাছ ধরে সেদিন মাত্র চারটি গরৈ মাছ পেলাম। গোধূলি আমরা চারটি প্রাণী উনুনের কাছে বসে মাছ পোড়ায় লেগে গেলাম। পঙ্গু ভাইটার বোধহয় খুব ক্ষুধা পেয়েছিল, সে হাত পা নেড়ে জন্তুর মতো গোঁ গোঁ শব্দ করে আগুনের ওপরে থাকা আধ পোড়া মাছ গুলি দেখাতে লাগল। তার উৎপাতে টিকতে না পেরে মা দ্রুত একটা মাছ উনুনের ওপর থেকে এনে মাটিতে রেখেছে মাত্র, বেড়ার কোণে খাপ পেতে থাকা পুরুষ বিড়ালটা মাছটা মুখে নিয়ে দৌড়ে পালাল। ভাইটা তার অদ্ভুত ভাষায় চিৎকার করতে লাগল। ইতিমধ্যে বাকি তিনটি মাছও সিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে এবার মায়ের জন্য অপেক্ষা না করে থাপ মেরে তিনটা মাছ এনে মুখে ভরিয়ে দিল। মাছগুলি খেয়ে শেষ করে সে হাত এবং মুখের অঙ্গভঙ্গি করে’আরও চাই’বলে চিৎকার করতে লাগল। আর যে মাছ নেই, মা তাকে সে কথা কীভাবে বোঝাবে? কিছু সময় তিনি শূন্য দৃষ্টিতে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। পঙ্গু ভাইটার উৎপাত বেড়েই চলল। মার খাওয়া দুর্বল কুকুরের মতো কেউ কেউ করে সে উনুনটা লন্ডভন্ড করে দিতে লাগল। মা তখন তাকে দুই হাতে চেপে ধরে, কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করতে লাগল ’এই নে আমার মাথা খা, আমার মাথাটাই খা আর মাছ নেই।’ভাই তার পেটে চাপর মেরে মেরে ভাতের হাঁড়িটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে লাগল, অর্থাৎ তার খুব ক্ষুধা পেয়েছে, ভাত চাই। মায়ের করার কিছুই ছিল না, তিনি নীরবে বসে রইলেন। তার চোখ দুটি জ্বলন্ত কয়লার মতো একবার দপ করে জ্বলে উঠল বলে মনে হল।

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত