| 6 অক্টোবর 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১৯) । ধ্রুবজ্যোতি বরা

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

ডক্টর ধ্রুবজ্যোতি বরা পেশায়  চিকিৎসক,অসমিয়া সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য লেখক ২৭ নভেম্বর ১৯৫৫ সনে শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীবরা ছাত্র জীবনে অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ‘কালান্তরর গদ্য’ ,’তেজর এন্ধার’ আরু ‘অর্থ’ এই ত্রয়ী উপন্যাসের লেখক হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। ২০০৯ সনে ‘ কথা রত্নাকর’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাকি উপন্যাসগুলি ‘ভোক’,’লোহা’,’যাত্রিক আরু অন্যান্য’ ইত্যাদি। ইতিহাস বিষয়ক মূল‍্যবান বই ‘রুশমহাবিপ্লব’দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’,’ফরাসি বিপ্লব’,’মোয়ামরীয়া বিদ্রোহ’। শ্রীবরার গল্প উপন্যাস হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা, মালয়ালাম এবং বড়ো ভাষায় অনূদিত হয়েছে।আকাডেমিক রিসার্চ জার্নাল’যাত্রা’র সম্পাদনার সঙ্গে জড়িতরয়েছেন।’ কালান্তরর গদ্য’ উপন্যাসের জন্য ২০০১ সনে অসম সাহিত্য সভার ‘ আম্বিকা গিরি রায়চৌধুরি’ পুরস্কার লাভ করেন।শ্রীবরা অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি। 


অনুবাদকের কথা

আলোচ‍্য উপন্যাস ‘রক্তের অন্ধকার'(তেজরএন্ধার) একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস। এটি লেখার সময় কাল ২০০০-২০০১ ছিল অসময়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্যোগের সময়। সেই অশান্ত সময়ে, আমাদের সমাজে, আমাদের জীবনে এক দ্রুত অবক্ষয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়তে শুরু করেছিল। প্রতিটি অসমিয়াইমর্মেমর্মে   একথা উপলব্ধি করে ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের চারপাশে দেখা দেওয়ানৈরাজ্যবাদী হিংসা কোনো ধরনের মহৎ রূপান্তরের সম্ভাবনাকে বহন করে তো আনেই নি, বরঞ্চ জাতীয় জীবনের অবক্ষয়কে আরও দ্রুত প্রকট করে তুলেছিল। আশাহীনতা এবং অনিশ্চিয়তায় সমগ্র রাজ্য ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই যেন থমকে যেতে চায় কবির  কবিতা , শিল্পীর তুলি, লেখকদের কলম। তবে একথাও সত্যি যে শিল্পী-সাহিত্যিকরা সচেতন ছিলেন যে সমাজ জীবনের ভগ্নদশা’ খণ্ডহর’এর মধ্যে একমাত্র ‘সৃষ্টি’ই হল জীবন এবং উত্তরণের পথ। এই বিশ্বাস হারানোর অর্থ হল মৃত্যু । আর এই বিশ্বাস থেকেই সেই সময় লেখক লিখেছিলেন কালান্তর ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব – রক্তের অন্ধকার ।

এবার উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ নিয়ে এলাম। আশা করি ইরাবতীর পাঠকেরা এই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত অসাধারণ উপন্যাসটিকে সাদরে বরণ করে নেবেন ।নমস্কার।

বাসুদেব দাস,কলকাতা।


 

কাঁঠালপিঁড়িটাতে বসে বুড়ো গেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ভোগেই পুকুরে স্নান করে এসে সামনের দিকে সুপরি গাছের মধ্যে বেঁধে রাখা বাঁশটাতেকাপড় মেলার সময় স্বামীকে দেখতে পেল । মানুষটাকে একা এসে কাঁঠাল পিঁড়ির উপরে বসে থাকতে দেখে সে সামনে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তারপরেদৌড়ে কাছে এসে বলল‐’ আপনি কেন বেরিয়ে এলেন? আমার স্নান করে আসা  পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না?’‐মানুষটারকন্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল।

‘ বাইরে থাকলে নিঃশ্বাসটা হালকা মনে হয়।’‐রতিকান্ত সজোরে বলে উঠল। ভেতরে থাকলে কিছু একটা চেপে ধরেছে বলে মনে হয়।যা চা নিয়েআয় তোর জন্য ও নিয়ে আসবি ।

স্বামীর কাটাকাটা কথা শুনে ভোগেরভয় আরও বেড়ে গেল । সে দৌড়েগিয়ে ভেতর থেকে ফিকা চায়ের বাটি এনে স্বামীকে দিল।

‘ তোর জন্যও নিয়েআয়।’‐রতিকান্ত বলল। গুড় থাকলে একটু দিবি।’

উপায় না পেয়ে ভোগে নিজের জন্যও একটু চা ঢেলে আনল। একটা ছেঁড়া কাগজে দিয়াশলাই  বাক্সের অর্ধেকের মতোগুড় এনে স্বামীকে দিল ।

‘ তোর ভাগে  চা এত কম কেন?-রতিকান্ত স্ত্রীর বাটিটার দিকে তাকিয়ে বলল।

‘ আমি কমই খাই।’

‘ দেখি, বাটিটা এদিকে দে।’ রতিকান্ত জোর করে স্ত্রীর বাটিটিতে নিজের ভাগ থেকে কিছুটা চা ঢেলে দিল। কাঁঠাল পিঁড়িটার কাছে মাটিতে ছোটো একটি পিঁড়ি পেতে বসে স্ত্রীও নীরবে চা খেতে লাগল।

‘ আজ প্রেম আসবে।’ বুড়ো বেশ স্ফুর্তির সঙ্গে বলল- আজ ডিসির অফিস থেকে সে সঠিক খবর নিয়ে আসবে।’

‘ সেই জন্যই বোধহয় আপনি সকালবেলাতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে পথ চেয়ে রয়েছেন?’– ভোগেই কিছুটা কঠিন কণ্ঠে বলল–’ সে এখনই কোথা থেকে আসবে। আজ আসতে পারবে কিনা কে জানে। সকালের দিকে যদি কাজ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আসতে পারবে। লাস্ট বাস নাকি তিনটারসময়ছাড়ে। সেটাতে এলেও সন্ধেবেলা পৌঁছাবে।’

রতিকান্ত স্ত্রীর কথা শুনতেই পায়নি। তিনি আপন মনে বলে যেতে লাগলেন–’ টাকাটা কীভাবে সংগ্রহ করবে সেই সম্পর্কে সবিস্তার জেনে আসবে। আর বেশিদিন নেই। ডিসির হাতে পড়েছে যখন আমরা তাড়াতাড়ি টাকাটা এবার পেয়ে যাব। সে হয়তো নিয়েও আসতে পারে।

‘ এতগুলি টাকা?’ মা চমকে উঠল–’ সে কীভাবে নিয়ে আসবে।’

‘ হেঃহেঃ তুই কিছুই জানিস না।’– বুড়ো স্ত্রীকে কৌতুক করে বললেন।

‘ সরকার তোকে নগদ টাকা দেবে না। কাগজের টাকা দেবে– চেক দেবে। এটা ব্যাংকে জমা রাখলে সময়ে সময়ে সেখান থেকে টাকা তুলতে পারবি।হেঃহেঃ।’

রতিকান্ত পুনরায় কাশতে  শুরু করল। ফুফু করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়েরতিকান্তকাশতে লাগল। বুকের মাঝখান থেকে একটা দুটো শিসধ্বনি  বেরিয়ে এল। ভোগেই সঙ্গে সঙ্গে পাখাটা নিয়ে স্বামীকে হাওয়া করতে লাগল।

‘কথা বলে বলেকাশিটাকে আবার বাড়িয়ে নিলে।’– ভোগেই হাহাকার করে উঠল।

‘কী দরকার সেই অদরকারী কথাগুলি নিয়ে আলোচনা করার, ছেলে তো গিয়েছেই, যা খবর থাকে নিয়ে আসবে। আগে থেকে চিন্তা করার কী দরকার।’

রতিকান্ত কোনো উত্তর দিল না। বুড়োর  আসলে উত্তর দেবার মতো অবস্থাও ছিল না। নিঃশ্বাস নিতে বড়ো কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাসটা যেন ফিরে আসবে না।


আরো পড়ুন: রক্তের অন্ধকার (পর্ব-১৮) । ধ্রুবজ্যোতি বরা


আধঘন্টা পরে বুড়ো একটু শান্ত হল। নিঃশ্বাসটাও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এল। মানুষটা কিছুটা সুস্থির হয়ে বসলেন। চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলেন। ভোগেও ধীরে ধীরেহাওয়া করা বন্ধ করল। মানুষটার ঠোঁট জোড়া এবং নখগুলি নীল হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ স্বামীর কাছে অপেক্ষা করে ভোগেই বলল–’ আপনি একদম নড়াচড়া না করে বসে থাকুন। আমি রান্না ঘরে যাচ্ছি। আরও একবাটি চা দেব নাকি?

‘লাগবে না’ বলে রতিকান্ত হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিল।

ধীরে ধীরে ভোগেই ভেতরে চলে গেল। মানুষটার কাশির লক্ষণ  দিন দিন খারাপ হতে চলেছে। আজকাল একেবারে কফ বের হয় না। কিন্তু সামান্য কাশিতেই  এত হাঁসফাঁস করে উঠে।

রান্না শুরু করার আগে ভোগেই একবার এসে স্বামীকে দেখে গেল। শুয়ে পড়েছে– মানুষটা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোক, ঘুমোক- একটু ঘুমোতে পারলে শান্তি পাবে। ভোগেই ভেতরে গিয়েপুরোনো কম্বলটা এনে স্বামীর গায়ে জড়িয়ে দিল। কম্বলটা অনেক পুরোনো হয়ে গেছে । লোম প্রায় নেই । মাঝে মাঝে পাতলা জালের মতো হয়ে পড়েছে। কম্বলটার উপরে ছেঁড়া ধুতি, চাদর ইত্যাদি সেলাই করে করে ভোগেই সেটাকেকঠারমতো করে ফেলেছে। সেটা গায়েদিয়েদেওয়ায়রতিকান্ত কিছুটা নড়াচড়া করে শুয়েপড়ল।

কতক্ষনঘুমোলরতিকান্ত নিজেই জানে না। যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ রোদ উঠেছে। কটা বাজে?

এগারোটা না বারোটা বাজে। মনে হচ্ছে ভাত খাবার সময় হয়ে গেছে। রতিকান্তগলাখাঁকারি দিল। কিছুক্ষণ পরে একবাটি চা আর কিছু জলখাবারনিয়ে ভোগেই বেরিয়ে এল।

‘আপনাকে শুয়ে থাকতে দেখে জাগাইনি। জলখাবারটাখেয়ে নিন। সকাল থেকে পেটে একটাও দানা পড়েনি।’- ভোগেই বলল।

রতিকান্ত নীরবে জলখাবার খেতে লাগল। তার আবার অনেক কথা বলতে ইচ্ছা হল। কথাগুলি গলার কাছে এসে যেন জমা হয়ে আছে কিন্তু স্ত্রীর ভয়ে তিনি মুখ খুললেন না। কাশি আসার আশঙ্কায়ভোগেরগোমরা মুখ দেখে তিনি বেশ ভয় পেলেন।

জলখাবারখেয়ে শেষ করা পর্যন্ত ভোগেই কাছেই অপেক্ষা করে রইল। তার মনে হল যে স্বামী ঘন ঘন গেটের দিকে তাকাচ্ছে। মানুষটা যেন কিছুটা উত্তেজিত হয়ে রয়েছে বলে তার মনে হল।

‘ প্রেম এখন আসবে না, আজ এলেও সন্ধ্যা বেলা আসবে। গতকাল মাত্র গিয়েছে। কেন মিছামিছি পথ চেয়ে রয়েছেন?’রতিকান্ত কিছুই বললেন না। নীরবে তিনি চা টা শেষ করলেন। বাটিটা এবং প্লেট সামলে নিয়ে ভোগেই বলল–’ নড়াচড়া না করে এখানে বসে থাকুন। আমি চট করে নীরদেরবাড়ি থেকে আসছি। কালকেই চাল ভিজিয়ে রাখবে বলেছিল। গুঁড়ো করে দিতে হবে। আমি নিয়ে আসছি। আমাদের বাড়িতেই গুড়ো করব। যাব আর আসব। আপনি কোনো ঝামেলার সৃষ্টি করবেন না।’ 

রতিকান্ত মাথা নাড়ল। তার অসুখের জন্যই ভোগেই অন্যের ঘরে কাজ করতে যেতে পারে না। অন্যের ধান বানা, চাল গুঁড়ো করা যে কাজগুলি তাকে বাড়িতে করতে দেয়, সেটুকু মাত্র সে করতে পারে।

স্বামীর হাতে শুকনো আদা একটু দিয়ে সে নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

চা- জল খাবারটুকুখেয়েরতিকান্তের শরীরটা কিছুটা ভালো লাগল। আরাম করে তিনি এবার কাঁঠাল পিঁড়িটার  ওপরে বসে নিলেন। মুখে শুকনো আদা নিয়েচিবোতেচিবোতে তিনি গেটের দিকে তাকাতে লাগলেন। দীর্ঘ উঠোনটা পার হয়ে গেটটা অনেকটা দূরে। একপাশে সারিসারি সুপারি গাছ। প্রতিটি সুপুরি গাছ এবং তার গায়ের পানের লতাগুলি রতিকান্তের নিজের হাতে লাগানো। সন্ধ্যা মালতী,যূঁই, পাতাবাহারের গাছগুলির পাশ দিয়েউঠোন থেকে গেট পর্যন্ত দীর্ঘ পথটা। ফুল এবং গাছগুলি অযত্নে জঙ্গল হয়ে উঠেছে। গোলাপ গাছটাতে এখনও কয়েকটি গোলাপ ফুটে রয়েছে। রাস্তাটার অন্যদিকে ছোটো বীজের ভাঁড়ারটার পেছনে উঁচু গোয়ালঘরটা। তার কাছেই লাউয়ের মাচান, তার কাছে কয়েকটি লেবু গাছ। কলম খুঁজে এনে লেবু গাছগুলির চারা নিজের হাতে লাগানো। এখনও ডাল ভরে লেবু ধরে। কাশিটা বেশিহওয়ার পরে সে নিজেই লেবু খাওয়া বাদ দিয়েছে। বাগানের কোণে বাতাবি লেবুর গাছটারবাতাবি লেবু এত স্বাদ। কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে মাঠে যারা ধান কাটে তাদের কাছে পাঠিয়েদিলেই মুখে হাসি ছড়িয়েপড়ে।

বহুদিনরতিকান্তবাগানটার দিকে লক্ষ্য করেনি। আজ চোখে পড়ায় প্রতিটি জিনিস, প্রতিটি গাছকেই তিনি মায়ার চোখে দেখতে লাগলেন। স্থলপদ্মের একটা ডাল গেটের সামনে হেম কোথা থেকে এনে লাগিয়েদিয়েছিল। ডাল ভরে ভরে ফুল ফোটে। গাছের নিচটাখসে পড়া ফুলে উপচে উঠে।

ভাঁড়ারের কাছে উঠোনের প্রান্তে তুলসির ভিতটা এবং তার ওপারের বারো মাসের কালো লঙ্কা গাছগুলি ভোগের। সেই গাছগুলি সে নিজেই দেখাশোনা করে। সামনেই গোটা কার্তিক মাসটা তুলসিরতলায় প্রদীপ জ্বলে। আজকাল সরষের তেলের অভাব। কার্তিক বিহুর দিনই কেবল প্রদীপ জ্বলে।

ঘরবাড়িগৃহস্থালির ছোটো ছোটো কথাগুলি রতিকান্তের মনে একের পর এক ছবির মতো ভেসে উঠল।

কেউ একজন এসেছে। গেটের কাছে সাইকেল থেকে নেমেছে। রতিকান্ত চোখ দুটি ছোটো করে তাকাতে লাগল।

‘কে ?কে এসেছে সাইকেল নিয়ে? প্রেম এসেছে নাকি?’

রতিকান্ত চোখ কুঁচকে পিরপির করে তাকাতে লাগল।

‘ কে? কে ওখানে?– রতিকান্ত বলে উঠল।

‘ রতি দাদা।’– আগন্তুক বুড়োকে কাঁঠাল পিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে বলল।

‘ কে? নন্দরাম নাকি?’

‘ হ্যাঁ ,দাদা।’

নন্দররাম সাইকেলটা উঠোনেদাঁড় করিয়ে কেরিয়ার থেকে কাপড়ের একটা ব্যাগ বের করে আনল।

এ, নন্দরাম, ও তো ডাক পিয়ন। রতিকান্তের বুকটা হঠাৎ ধক ধক করে উঠল।

‘ দাদা, তোমার নামে একটা সরকারি চিঠি আছে। রেজিস্টার চিঠি।’

‘ সরকারি চিঠি!’ রতিকান্তবড়োঅসহায় বোধ করতে লাগলেন। ‘কিসের সরকারি চিঠি ?টাকা আসার খবর আছে নাকি? না হলে আবার টাকা দেব না বলে দিল নাকি?’

 রতিকান্তের বুকের ভেতর থেকে কাশিটা বেরিয়ে আসতে  চাইল। বড়ো কষ্টে তিনিকাশিটাকেদমিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন।তার কপালে ঘাম দেখা দিল। ‘এখানে একটা সই করুন দাদা । নন্দরাম  কাগজ আর কলমটা এগিয়ে  দিল।রতিকান্ত কোনো রকমে সইয়ের নামে খাতাটাতেকয়েকটা দাগ টেনে দিলেন। নন্দরামএইবার চিঠিটা এগিয়ে দিল। ‘তুই পড়ে দে।’– রতিকান্ত হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন। ‘দাদার শরীরটা দেখছি খুব খারাপ হয়ে গেছে ?’চিঠিটা  খুলতে গিয়েনন্দরামসহানুভূতির সুরে বলল। তারপরে প্রথমে চিঠির সারাংশটা বলতে শুরু করল।

উজিয়ে  আসা কাশিটা দমানোর চেষ্টা করে রতিকান্তের চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে পড়ল।

নন্দরামরতিকান্তকে বলে গেল–’ হেমকান্ত নাথের মৃত্যুতে সরকারের তরফ থেকে এক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে – সঙ্গে গেঁথেদেওয়াপ্রপত্রটা স্থানীয় থানায়  পূরণ করে সিলমোহরলাগিয়েওয়ারিশগিয়ে ডেপুটি কমিশনের অফিস থেকে টাকাটা সমঝে নেবে…’

এক প্রচন্ড কাশির বিস্ফোরণের শব্দে সে চমকে উঠল। রতিকান্ত এতক্ষণ চেপে রাখা কাশিটা আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না। এক প্রচন্ড বিস্ফোরণের মতো কাশিটা সবেগেবেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস টানার এক বিকট শব্দ নন্দরামেরভীতিবিহ্বল চোখের সামনে এবার রতিক্রান্ত মুখটা মেলে চোখ বড়োবড়ো করে, বুকের মধ্যে হারিয়ে যেতে যাওয়া নিঃশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করলেন। তার গলা এবং বুক থেকে বিচিত্র ঘড়ঘড় শব্দ বের হতে লাগল।মাঝে মধ্যে একগাদাবেসুরোশিসধ্বনি তার মুখ দিয়েবেরিয়ে উঠনের চারপাশে ছিটকে পড়তে লাগল।

চিঠিটা হাতে নিয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নন্দরামের সামনে রতিকান্ত মানুষটা নীল হয়ে যেতে লাগলেন এবং দেখতে দেখতেমানুষটা কাত হয়ে কাঁঠাল পিঁড়িটার উপরে গড়িয়েপড়লেন।

কোথা থেকে শ‍্যেনের মতো দৌড়ে এসে ভোগেই মানুষটার উপরে পড়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে লাগল। তখনই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নন্দরাম ডাকপিয়ন হাতের বই, কলম, চিঠি ফেলে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরল।

‘ হে রতি দাদা, হে রতি দাদা ,এরকম করছ কেন? কী হয়েছে?’– ভয়ে তার কণ্ঠস্বর বিহ্বল হয়ে উঠল।

রতিকান্ত নাথের নিঃশ্বাসের কষ্ট সেই মুহূর্তে চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাকে আর কষ্ট করে নিঃশ্বাস নিতে হবে না।

এক ঝাঁক অসময়ের হালকা হাওয়াহঠাৎ এবার উঠোনেপড়ে থাকা সরকারি চিঠিটা মাটি দিয়ে ছেঁচড়ে উড়িয়ে নিতে আরম্ভ করল– খসে পড়া কয়েকটি শুকনো গাছের পাতার মতো।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত