শারদ অর্ঘ্য অণুগল্প: ভাগ্যিস । নাসরীন জাহান
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়েছিলাম।হালকা শীত আর গরমের প্রচ্ছায়ায়,গলির বাতি আমার মুখে শরতের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিচ্ছিল।ভাবছিলাম,কোথায় যাওয়া যায়?অদ্ভুত রাতছায়া বদচ্ছায়ায় রীতিমতো নিভে যেতে থাকার আগেই কুকুরেরা কেঁদে ওঠে।আসলে শীতকার। বুঝতে সময় লাগেকারণ আমি বাড়ির লাত্থি খেয়ে বেরিয়ে এসেছি।দিনরাত অনেক খারাপ লাগে,অনেকঅসহ্য আর অনেক রক্তাক্ত লাগে।
এরেঞ্জ ম্যারেজে আমার আশৈশবের স্বাধীনতা মরে গেছে। একসময় যার সাথে প্রেম ছিলো,কাশবন ছিল,গোপন ঘরে চুমোচুমি ছিল,, যখন ভাবতাম,কোনদিন ছেড়ে যাব না,,অনেক অন্ধকার আর আলোর চ্ছটায়,চাঁদ আর বাতাসের উড়ালে আমরা ভাসব,উড়ব,বলত,আমি তোমার ব্রা,র মাপ জানি,ধুর,,আমিও জানি তুমি শুধু শরীর শরীরকুসুম,,,তখন আমাদের ওপর দিয়ে ঘুঘুপাখি,আর ডোডোপাখি এক ঝাপটায় উড়াল দিত।বলতাম,পাহাড় আর আকাশের ওপর দিয়েআমরা ডিম ছাড়ব।ওহ,ডোডো পাখি?অত বাচ্চা বাচ্চা করো না।ঘোড়ার ডিমের শিল্পী তুমি,ঠিক আছে,মন খারাপ করো না,আমাকে একটু দাঁড়াতে দাও।
আব্বা ধর্মের বই বই পড়তে দিতেন,আম্মা রান্নার। আর আমি কোনটাইনা পেরে প্রেমিক কে বলতাম,কিছু করো,এই জমানায় দরিদ্র বাবা মা ক,জন মেয়েকেঘরে রেখে পড়াশোনা করায়?বলত,বিয়ে বিয়ে করে পাগল হয়ো নাত?জানো না,প্রেমে যে যত পাত্তা না দেয়,প্রেম ঘন হয়?তুমি অন্য কারো প্রেমে পড়েছ?ধুর! প্যাচাল পেরো না।এই করে করে হঠাৎ জেনে যাই,সে আমার বান্ধবীর প্রেমে পড়েছে।অন্ধকার রাত্রির নিচে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকি। কুকুরের দল আমাকে ঘিরে ধরলে দেখি,কোন এক মাতাল গান গাইতে গাইতে ভাঙাচুরাপথে হোঁচট খেয়ে আমার কাছে এসেথেমে গেছে।আসমান থেকে ধেয়ে নেমেছে রাত্রিররঙধনু,,প্রেমিকের নাম মনে পড়ে,অনির্বাণ,, ভেতর থেকে তার নাম ভেসে ওঠে,,কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়,অনির্বাণআমাকে ছেড়ে চলে গেছে,আমিআমাকে ছেড়ে যাওয়া বিরহের ওর বিরহেরচাইতে অপমানে অসহ্য হয়ে যাওয়ায়এরেব্জ ম্যারেজ করেছিলাম।কেন নিজের পায়ে দাঁড়ালাম না?কেন বিয়ের রাতে অনির্বাণের কথানিজের সহজ সরল স্বামীকে জানাতে গেলাম?কেন সত্যের সাথে মিথ্যা নামিশালে দাম্পত্য জীবন টিকেনা,বুঝলাম না?কেন তাকে লাত্থি দেয়ার সূযোগ দিলাম?
চুদির ভাই,,তোর মায়েরে,বাসর রাতে বলেছিল হারামিটা,,বাবা মার দারিদ্র্য কে ঘেন্না লাগছিল। জানতাম,ওই বাড়িতে ফিরে গিয়ে লাভ নেই, মানিয়ে নিতে বলবে। কিন্তু তারপরেও তো ওদের পায়ের নিচে পড়ে না থেকে হুহু রাস্তায় বেরিয়ে আসতে পেরেছি। কম কী? কার বাড়ি যাওয়া যায়? পাড়াতো চাকরিজীবি নারীর কথা মনে পড়ে। যাকে শ্বশুরবাড়ির চৌদ্দগোষ্ঠি পছন্দ করত না,স্বাধীন স্বাধীন বলত বলে। মনে পড়ে,ভালো বুটিকের কাজ জানি বলে, সে আমাকে নিজের কাজের সাথে প্রচুর জড়াতে চাইত। বুকের মধ্যে বাতাস লাগে। ধীরে ধীরে কুয়াশার সাথে রোদ পড়ার মতো ভেতরের ভয় কেটে যেতে থাকে। আমাকে কুকুরেরা ঘিরে থাকে, মাতাল বলে,এতো রাইতে কই যাবি? কাছেই থানা আছে,যাবি? না। কিছুটা বিন্যস্ত হয়ে বলি,আমি আমার একটা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি,কাছেই, কুকুরেররা আমাকে ঘিরে রাখে। যা,জলদি যা,এতোরাইতে রাস্তাঘাট ভালা না, জিন্দেগী জিন্দেগী বলতে বলতে মাতাল চলে যেতে থাকলে, ধাতস্থ হয়ে মনে আমার হয়,ভাগ্যিস ফাঁসির দঁড়ি ফসকে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলাম।
জন্ম: মার্চ ৫, ১৯৬৪, লেখক, ঔপন্যাসিক, এবং সাহিত্য সম্পাদক। আশির দশকের শুরু থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। উড়ুক্কু উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। এই উপন্যাসের জন্য লাভ করেন ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার।
নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালে ৫ মার্চ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গোলাম আম্বিয়া ফকির ছিলেন সরকারী চাকুরিজীবী ও মা উম্মে সালমা ছিলেন গৃহিণী।বাবার চাকরির কারণে থাকতেন মামাবাড়িতে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তাকে আর তার ভাইকে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের এক মামীর বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে ভর্তি হন শানকিপাড়া স্কুলে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য থাকতেন ফুফুর বাড়িতে। ফুফুর এক মেয়ে ছিল শবনম জাহান। ফুফু তার নামের সাথে মিল রেখে মা-বাবার দেয়া নাম নাসরীন সুলতানা পরিবর্তন করে তার নাম রাখেন নাসরীন জাহান। স্কুলে পড়াকালীন পারভিন সুলতানা নামে এক বন্ধুর সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে। সে বিদ্যাময়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়-এ ভর্তি হলে তিনিও একই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৭ সালে শিশু একাডেমি থেকে লেখা চাওয়া হলে দুই বান্ধবী লেখা পাঠায়। দুজনের লেখা প্রকাশিত হয় সেই পত্রিকায়। নাসরীনের লেখা গল্পের নাম ছিল ছাপানো গল্পটা।