| 8 মে 2024
Categories
ধারাবাহিক

ধারাবাহিক: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-৮) । রোহিণী ধর্মপাল

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
বারো বছরের বনবাসকালে দ্রৌপদী বহু ভেবেছেন। বারবার প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। কিভাবে তাঁর প্রতি দুর্যোধনদের লালসা, সেই সঙ্গে প্রতিশোধস্পৃহা এতখানি বাড়ল! শুধুমাত্র লালসা হলে তো এমন হতো না। পুরুষের লালসা তো তিনি ভালো করেই অনুভব করেছেন। কিন্তু এতো নারীমাংসলোলুপতা নয়! এতো প্রবল ঘৃণা! তার কারণ কি স্বয়ংবর সভায় সবার সামনে অপদস্থ হওয়ার অপমান? কিন্তু সেখানে তো দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি ধনুটিই তুলতে পারেনি! হ্যাঁ, একমাত্র কর্ণ পেরেছিল। সুযোগ পেলে হয়ত লক্ষ্যভেদ করতেও সফল হত। কিন্তু দ্রৌপদী না করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারণ অর্জুনের জন্য অপেক্ষা করতেই হত। কর্ণ নামটি শুনেই তিনি বুঝেছিলেন এই মানুষটি সফল হওয়ার আগেই তাঁকেই না বলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। তাই বলে কর্ণ সবার সামনে তাঁকে নগ্ন করতে বলবেন! সূতপুত্র শব্দটি নিশ্চয়ই কর্ণ দ্রৌপদীর কাছে প্রথম শুনলেন, এমন নয়! তবে! শুধু নারী বলে অপমান আরও সহস্রগুণ বেড়ে গেল! আর একজন পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে একটি মেয়েকে সবার সামনে উলঙ্গ করে দেওয়ার ইচ্ছেকে এক করে দেখা যায় কী!
আরেকটা কারণ হতেই পারে, কোনও ভাবেই পঞ্চ পাণ্ডবের কোনও রকম ক্ষতি করতে না পারা! খাণ্ডববন সহ বিরাট একটা পতিত অনুর্বর জমিতে পাঠিয়ে দেওয়ার পরেও তাদের এতটুকু জব্দ করতে না পারা। বরং সেই রুক্ষ জায়গাতেই অমরাবতীর থেকেও সুন্দর এক প্রাসাদ তৈরি, খাণ্ডববনের সমস্ত গাছ পুড়িয়ে দিয়ে বিশাল এক উর্বর অংশের অধিকারী হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত রাজসূয় যজ্ঞে এসে অতুল ঐশ্বর্যের সম্মুখীন হওয়া। আর হবি তো হ, যুধিষ্ঠির দিলেন দুর্যোধনকে উপহার গ্রহণের ভার! ভারতবর্ষের সমস্ত প্রান্ত থেকে একে একে দুর্লভ মহার্ঘ্য সব উপহার আসতে লাগল আর সেই সব উপহার গুছিয়ে রাখতে রাখতে সব রকমে দিশেহারা হয়ে উঠল দুর্যোধন। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রেই বা দ্রৌপদীর কী করার আছে! তাঁর প্রতি এমন আচরণ কেন? 
অবশ্য পাণ্ডবদের ওই মোহময়ী প্রাসাদও একটা কারণ। ইন্দ্রপ্রস্থ। সূর্য ওঠার সময় যে প্রাসাদের স্ফটিকের দেওয়ালগুলিও এমনভাবে গোলাপী হয়ে ওঠে, যেন কেউ দুধে – আলতা গোলা রঙ দিয়ে পুরো প্রাসাদটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় রামধনু রঙের ঢেউ খেলে যায়। কোথাও স্বচ্ছ স্ফটিক দেখে মনে হয় ঘরের মধ্যেই স্রোতস্বিনীর ধারা। আবার কোনও কোনও ঘরে সত্যিই জলধারা বইছে। কোথাও বা ঘরের একটি দিক উন্মুক্ত। সেই দিকে এমন কৌশলে জলের তোড় ওপর থেকে ফেলা হচ্ছে, যে গুঁড়িগুঁড়ি জলে সামনেটাও সাদা হয়ে যাচ্ছে। আর আলো পড়লেই ছোট ছোট রঙের ফুল নাচানাচি করছে। হাত বাড়ালেই যেন সেই সব নাচন্ত ফুলগুলিকে ধরা যাবে হাতের মুঠোয়। আবার কোনও ঘরে দেওয়াল থাকলেও, তা এতই স্বচ্ছ, যে তার বাইরের নরম সবুজ ঘাসের গালিচায় সাদা সাদা খরগোশ আর ফুটফুটে চিত্রল হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে মনে হবে হাত বাড়িয়ে একটু ধরি। অথচ ধরতে গেলেই ধাক্কা। দেওয়াল তো!
যে ঘরে অতিথিদের রাখা হচ্ছে, এক এক জন অতিথির মনের ভাবনা পড়ে, জেনে, তবেই যেন সেই ঘরগুলি তৈরি হয়েছে। অল্পবয়স যাঁদের, ক্ষত্রিয় রাজপুত্ররা, তাঁদের ঘরে বিভিন্ন ধরণের অস্ত্রের ছোট ছোট প্রতিকৃতি রাখা। ঘরের চতুর্দিকে রত্নখচিত সুগোল পাত্রে কোনটায় অগুরু, কোনটায় সুগন্ধী পুষ্পমালিকা রাখা। দাসেরা এসে ক্ষণে ক্ষণে কিছু লাগবে কিনা, জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে। চন্দনের শীতল প্রলেপ মাখিয়ে যাচ্ছে। রাজপুত্রদের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে একজন কথককে, যার ভাণ্ডার রোমাঞ্চকর সব শিকারকাহিনিতে ভর্তি। রয়েছে শরীরচর্চার ঘর। সেখানে কেউ শরীরে তেল মাখাচ্ছে, কেউ কুস্তি করার জায়গায় বালি ঠিক করছে, কেউ ঘামের গন্ধ দূর করতে সুরভি ছড়িয়ে দিচ্ছে। বয়স্ক রাজাদের জন্যও নানারকম বিলাস বহুল ব্যবস্থা। সঙ্গে রানীদের, রাজকন্যাদের জন্য স্বয়ং দ্রৌপদী দায়িত্ব নিয়েছেন। কোথাও ঘর সাজিয়েছেন এমন ভাবে, যেন বিশাল সমুদ্রের ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে ঘরের সামনেটা। বিছানাগুলি যেন মেঘের নরম ভেলার মতো। বড় বড় ঝিনুকের ভেতরে দুর্লভ সব রত্নমালা, বাজুবন্ধ, কেয়ূর, চন্দ্রহার, মল, বালা। পশমের পোশাক। গায়ে মুখে মাখার হাজারো অনুলেপন। স্নানঘর। কোথাও শীতল জল এসে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো, কোথাও ঝর্ণার মতো। কোথাও টগবগে গরম জল তলায় ভরে রাখা, সেখান থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কোথাও সুগন্ধীমাখা জল রাখা বড় বড় পাত্রে। এসে বসলেই দাসীরা গা মেজে দেবে দুধের সর দিয়ে, মাটি দিয়ে, নানারকম মশলা দিয়ে।

আরো পড়ুন: একাকিনী শেষের কথা (পর্ব-৭) । রোহিণী ধর্মপাল


ব্রাহ্মণ অতিথিদের জন্য আরেক রকম ব্যবস্থা। তাঁদের জন্য যেন আলাদাই তপোবন তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এক পাশে চূড়া করে রাখা আছে । যদি কেউ একান্তে হোম করতে চান, কোনও রকম অসুবিধা না হয়। চার বেদ, ব্রাহ্মণ, উপনিষদ, নারদ-সংহিতা, মনুসংহিতার পুঁথি রাখা। আলোচনা করার জন্য একটি বিরাট উঠোন। ফলমূল, পরমান্ন, নানা ধরণের মিষ্টান্ন সকাল সন্ধ্যায় প্রস্তুত। স্বপাক খাবেন যাঁরা, তাঁদের জন্য আলাদা পাকশাল।
মোট কথা যাকে বলে দীয়তাং ভুজ্যতাং ব্যাপার। যেখানে যজ্ঞ হবে, সেখানে তো আসল যজ্ঞের আগে যেন দক্ষযজ্ঞ লেগে গেছে। মণ মণ ঘি, কাঠ, বেলপাতা, দুধ, কপ্পূর, চন্দন জড়ো হচ্ছে। পাঁচ ভাই আর দ্রৌপদী নিজের যেন চরকির মতো ঘুরছেন। একটা কোথাও ত্রুটি হওয়ার যো নেই। একজন অতিথিও যেন অবহেলিত বোধ না করেন। পাকশালাতে প্রতিদিন দ্রৌপদী ঘুরে আসছেন বারবার। অন্তত যাঁরা আত্মীয়, বন্ধু, তাঁদের পছন্দ অনুযায়ী খাদ্য পানীয় প্রতিদিন হয়। মনে মনে খানিক ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও কৌরবদের প্রাসাদ থেকে আসা সবার বিশেষ খেয়াল রাখছিলেন। তাঁর কানে আসছিল প্রাসাদে চলাফেরা করতে গিয়ে দুর্যোধনরা অনেক অসুবিধায় পড়ছেন, কিন্তু তিনি আলাদা করে গুরুত্ব দেন নি। তাঁর তো অভ্যাস হয়ে গেছিল। কারণ প্রাসাদে নতুন অতিথি এলেই হতবাক হয়ে যেতেন তাঁরা। কখনও জলাধার ভেবে স্ফটিককে পাশ কাটাচ্ছেন, কখনও বা স্ফটিক ভেবে হুড়মুড়িয়ে জলে পড়ে যাচ্ছেন। এমনিতে এবার সমস্ত প্রহরী দাসদাসী পরিজনদের বলাই ছিল, কেউ যেন হাঁটতে চলতে অসুবিধায় না পড়েন। কিন্তু দুর্যোধনরা এসেছেন বেশ আগেই। নিজেদের মতো করে প্রাসাদের সর্বত্র ঘুরেছেন। আর এইসব কাণ্ড ঘটিয়েছেন। পরিজনরা অতিকষ্টে হাসি চেপে তাঁদের সামলেছেন। কিন্তু সেখানেই বা দ্রৌপদী কী করবেন! তিনি তাঁর প্রতিটি দায়িত্ব সুচারু রূপে পালন করেছেন। এতবড় একটা যজ্ঞ সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সেই সবের জন্য পাঁচ ভাইয়ের ওপর রাগ, হিংসে হতেই পারে, কিন্তু দ্রৌপদী! তবে কী রাজ্যলোভের থেকেও দুর্যোধন কর্ণের লোভ বেশি ছিল দ্রৌপদীর শরীরের ওপর! নাকি সমস্ত সাম্রাজ্য কেড়ে নেওয়ার থেকে পুরুষের বেশি অপমান লাঞ্ছনা হবে তার স্ত্রীর শরীরকে সবার সামনে নিগ্রহ করলে ? তা নয়ত সভার মাঝখানে নিজের উরুতে বসার আহ্বান, বেশ্যা বলা এবং সবার ওপরে তাঁকে উলঙ্গ করার জন্য কী নির্লজ্জ কুৎসিত উল্লাস! তাহলে পুরুষ কিভাবে একজন নারীর পরিচয় তার বাইরের রূপ আর শরীর দিয়েই ভাবে! আর সেই নারী যখন কারুর স্ত্রী হয়, তখন স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে সমাজও ভাবে সেই স্ত্রী সেই স্বামীর সম্পত্তি। অত্যন্ত দুর্লভ বা মহার্ঘ্য হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পত্তি। আর সেই সম্পত্তিতে হাত দিলে পুরুষের সবচেয়ে অপমান, যদি সেই পুরুষ স্বামী হয়। আর সবচেয়ে পৈশাচিক আনন্দ হয়, যদি সেই পুরুষ তার স্বামী না হয়। তাই অনায়াসে যুধিষ্ঠির তাঁকে পণ রেখেছেন। এই জন্যই দুর্যোধনেরা সবাই মিলে তাঁকে অনায়াসে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে সভাতে টেনে এনেছে চুলের মুঠি ধরে। পরণের একমাত্র কাপড়টি খুলে বিবস্ত্র করতে চেয়েছে। এই যদি পুরুষের মানসিকতা হয়, তবে মেয়েরা তো সদাই বিবস্ত্র! সবাই উলঙ্গ! সবাই শুধুই এক একটি শরীর!
error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত